#নীলপদ্ম
#১৪তম_পর্ব
মনে মনে একটাই চাওয়া, হৃদয় যাতে ফিরে আসে সুস্থ ভাবে, দরকার হলে ক্ষমা চেয়ে নিবে সে। রুমের মাঝে পায়চারি করছিলো ঠিক তখন দরজা খোলার শব্দ পায় দিশা। দরজার দিকে তাকাতেই দেখে হৃদয় ঢুকছে। হৃদয়ের মুখখানি দেখেই বুকে কামড় পড়ে দিশার। শুকনো মুখখানি দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারাদিন কিছুই খাওয়া হয় নি তার। চোখ জোড়া মলিন, যেনো হাজারো কষ্টেরা দলবদ্ধ হয়ে রয়েছে। দিশা কিছ বলতে যাবার আগেই সুস্পষ্ট ভাষায় হৃদয় বলে,
– আমি তোমার সাথে যা করেছি, ভুল নয় অপরাধ করেছি। তুমি চাইলে সারাটাজীবন সেটার মূল্য দিতে রাজী আমি। তুমি যা চাইবে তাই হবে। চাইলে আমি তোমাকে বিয়ে অবধি করতে পারি। যা হয়ে গেছে তা আমি ফিরাতে পারবো না। তবে……
কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে লাগলো,
– আমি এতোটা নিচ নই যে তোমার অসুস্থতার সুযোগ নিবো। তুমি আমাকে জানিয়ে দিও কি চাই তোমার।
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো হৃদয়। দিশাকে কিছু বলার সুযোগটুকু দিলো না সে। অনুতাপের জ্বলন্ত আগুনে জ্বলছে দুজন। একদিকে হৃদয়ের অনুতাপ কেনো দিশার সম্মতি ব্যাতীত তারকাছে গিয়েছিলো সে। অপরদিকে দিশার অনুতাপ কেনো সে হৃদয়কে এতোটা কঠিন কথাগুলো বলতে গেলো। হয়তো তার বিষের মতো ধারালো কথাগুলো না বললে হৃদয়ের এই করুণ মুখটি দেখতে হতো না তাকে। কিন্তু এ ছাড়া উপায় ও নেই তার কাছে। আর সে ফেলে আশা গলিতে হাটতে চায় না দিশা। এতোকিছু ঘটে যাবার পর আজ আর সেই গলিতে নিজেকে হারাতে চায় না সে। এই অবাধ্য চোখগুলো বারবার ভিজে যাচ্ছে। একই দেহের অঙ্গ হবার পরও কেনো বুঝতে চাচ্ছে না ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। এটা তো সবার ভালোর জন্য করা। তাই নয় কি? নাকি_____
দুদিন পর,
বাসার দিকে রওনা দিচ্ছে হৃদয় এবং দিশা। যে কাজ পাঁচদিন ধরে করার কথা ছিলো তা দু দিনে শেষ করে ফেলেছে তারা। এই দুদিন কেউ কারোর সাথে কথা অবধি বলে নি। এক রকম চাপা অভিমান কাজ করছে হৃদয়ের ভেতর। সাথে অনুশোচনা ও। সব মিলে দিশাকে আর ঘাটায় নি সে। এর চেয়েও বড় কাজ করতে হবে যে তাকে। বিয়ের দিন এগিয়ে আনা হয়েছে। নিশাত কেনো জানে খুব তাড়াহুরো করছে। যে বিয়ে শুক্রবার ছিলো সেটা এগিয়ে মঙ্গলবার করা হয়েছে। তিন দিন যেনো সহ্য হচ্ছে না তার। হৃদয়ের মাথায় আপাতত বিয়ের ঝামেলাটা মিটানোটা বেশি দরকার। এরপর দিশাকে দেখবে সে। এই মেয়েটার শুধু ছুট ছুট পালাই পালাই ভাব। একই গাড়িতে পাশাপাশি দুজন বসা, অথচ কারোর মুখে কোনো কথা নেই। এতোক্ষণ চুপ থাকার পর, শেষ মেশ হৃদয় বলে,
– কি ভাবলে? তুমি যা ডিসিশন নিবে সেটা অনুযায়ী আমাকে কাজ করতে হবে। বলে রাখি আমার বিয়ের ডেট এগিয়েছে। এখন তুমি কি চিন্তা করলে?
বিয়ের ডেট এর কথাটা শুজে স্তব্ধ হয়ে যায় দিশা। কি বলা উচিত ঠিক জানা নেই তার। হ্যা তার হৃদয় এখন আর তার নেই। সে অন্য কারো। তাই অহেতুক স্বপ্ন দেখার কোনো মানেই নেই। চোয়াল শক্ত করে দিশা বলে,
– আমি চাই আমরা যেনো কখনোই মুখোমুখি না হই। একরাতের ভুল হিসেবে সেদিনের রাতটুকু ভুলে যাবো। আমি আপনার এবং আপনার হবু ওয়াইফের মাঝে কোনো তৃতীয় ব্যাক্তি হতে চাই না। আমিও ভুলে যাবো আমাদের মাঝে কিছু হয়েছিলো। আপনি ও ভুলে যাবেন। আমি কালকেই রেজিগনেশন লেটার জমা দিবো।
দিশার কথাগুলো চুপ করে শুনে হৃদয়। এরপর তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দিশার দিকে। এই দৃষ্টির অর্থ বুঝা দিশার জন্য খুব কঠিন নয়। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয় দিশা। নয়নজোড়াতে যে শ্রাবণের মেঘ জড়ো হয়েছে তার। মুচকি হেসে মনে মনে হৃদয় বলে,
” তুমি চাইলেও আমার কাছ থেকে দূরে যেতে পারবে না। তুমি যে আমারই। আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমার ই থাকবে, তুমি চাও কিংবা না চাও। আগে পথের কাটাটাকে সরাই”
দুদিন পর,
দিন কেটে যায়। কথায় আছে সময়ের স্রোত কারোর জন্য অপেক্ষা করে না। দিশা চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। হৃদয় তাকে বাধা অবধি দেয় নি। বিছানায় এপাশ থেকে অপাশ করছে। ঘুম আসার নাম নেই তার। মানুষের মন ও কি অদ্ভুত না! নিজেই একটি সিদ্ধান্ত নেয় আবার নিজেই সেই সিদ্ধান্তটির জন্য কষ্ট পায়। আচ্ছা সেদিন যদি গাড়িতে হৃদয়ের বিয়ের প্রতাবে রাজী হয়ে যেতো তবে এই কষ্টগুলো হতো না?? দিশা নিজেই হৃদয়ের কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করে দিয়েছে কিন্তু এখন সেই সিদ্ধান্তে নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে কাল হৃদয়ের বিয়ে। আচ্ছা দু বছর আগে যদি নিজের ভালোবাসার জন্য লড়তো তবে কি এই দিনটি দেখতে হতো না তার? অবশ্য সেদিন অসহায় ছিলো সে। নিজের প্রিয়জন এবং ভালোবাসার মধ্যে একটিকে বাছতে হয়েছিলো। এতে তার বাবা অন্তত বেঁচে রয়েছেন। নিজের ভালোবাসার জন্য আজ তার বাবাকে হুইল চেয়ারের সাথে নিজেকে জুড়ে নিতে হয়েছে। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলে ধ্যান ভাঙ্গে দিশার। মোবাইলটা অন করলে দেখতে পায় ফয়সাল ফোন রয়েছে। বুকের বা পাশটা এমনিতেই চিনচিনে ব্যাথায় বারংবার অস্থির করে ফেলছে। এখন কারোর সাথে কথাটুকু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তাই শেষমেশ ফোনটা সাইলেন্ট করে চোখ বন্ধ করে রাখে দিশা। দিশা ফোন না ধরলে শেষমেশ সায়মাকে ফোন দেয় ফয়সাল। দুবার বাজতেই সায়মা রিসিভ করে। হ্যালো বলার আগেই শুনতে পায়,
– কি সমস্যা? তোরা ফোন কেনো ধরছিস না? দিশাকে কত ফোন দিলাম একবার ধরলো ও
– ওর মন ভালো নেই।
– কেনো কি হয়েছে?
– কাল হৃদয়ের বিয়ে। তাই ও নিজেকে রুমবদ্ধ করে রেখেছে। চাকরিটা ও ছেড়ে দিয়েছে ও। আমি তাই ওকে ঘাটাই নি
– হুম বুঝলাম, আচ্ছা চিটাগাং এ গিয়েছিলো না সে। কিছু হয়েছিলো নাকি তার?
– জানি না।
– অহ, ঠিক আছে। কালকের দিনটা যাক। পরসু ওকে নিয়ে বের হবো নে। আর শোন তোর সাথেও কথা আছে আমার।
– কি কথা?
– দেখা হলেই তো জানবি, এতো ক্যাত কায়ত করিস কেনো?
বলেই খট করে ফোনটা কেটে দিলো ফয়সাল। হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে মোবাইলের দিকে সায়মা। ছেলেটার সমস্যা কি? সেদিনের পর থেকেই যেনো চেঞ্জ হয়ে গেছে সে। এতো অদ্ভুত আচারণ করছে। সায়মার মাথায় এখন একটি প্রশ্নই ঘুরছে। কি বলতে চায় ফয়সাল_____
মঙ্গলবার,
দুপুর ২টা,
ঢাকার নামকরা একটি ফাইভ স্টার হোটেলে বিয়ের অনুষ্ঠান এরেঞ্জ করা হয়েছে। কাজী সাহেব হৃদয়ের সামনে বসে রয়েছে। যখন তিনি হৃদয়কে কবুল বলতে বলে তখন হৃদয় বাঁকা হাসি হেসে বলে,
– আমি এই বিয়ে করতে পারবো না।
বলেই উঠে দাঁড়ায় সে। হৃদয়ের কথা শুনে উপস্থিত সকলে হতভম্ব হয়ে যায়। বিয়ের দিন বরের মুখে এরুপ কথা শুনে কানাঘুষা শুরু হয়ে যায়। হৃদয়ের কথা শুনে নূর বেগম এবং নিশাতের বাবা- মা ছুটে আসে। নিশাত তখন অন্য একটি রুমে ছিলো। হৃদয়ের এমন কথা নিশাতের কানে গেলেই তাড়াতাড়ি ছুটে আসে সে। নূর বেগম হৃদয়ের হাত চেপে বলেন,
– কি ফাজলামি শুরু করেছো তুমি?
– কোনো ফাজলামি করছি না। যেটা সত্যি কথা সেটাই বলছি। এই বিয়ে আমি করবো না। আমার প্রথম স্ত্রী এখনো বেঁচে আছে। আর আমি তাকে তালাক দেই নি। তাই এই বিয়ে সম্ভব না।
উপস্থিত মেহমানরা আবারও কথা বলা শুরু করে। নিশাত হৃদয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
– তুমি আবার পাগলামি করছো?
– তুমি তো কথাই বলো না। তুমি জানো না আমি কি বলছি?
-…….
– দিশাকে আমার জীবন থেকে সরাতে মুখ্য ভূমিকা তো ছিলো তোমার। এটা কি অস্বীকার করছো?
– ক..কি বলছো?
– আমার অপারেশনের দিন ওকে কিডন্যাপ তো তোমার লোকেরাই করেছিলো তাই নয় কি? ভুল বললাম?
কথাটা শোনামাত্র ভয়ে অস্থির হয়ে যায় নিশাত। একথাগুলো হৃদয়ের জানার কথা নয় তবে কিভাবে জানল সে?
– অবাক হচ্ছো? আমি কিভাবে জানলাম? আমার জানার অনেক ওয়ে আছে। তুমি ওখানে দিশাকে কিডন্যাপ করেছিলে, শুধু তাই নয় দিশাকে হুমকি দেয়াতে যখন দিশা মানতে চায় নি তখন তুমি লোক দিয়ে দিশার বাবার এক্সিডেন্টটা করাও। তুনি তো জানে মেরে চেয়েছিলে উনাকে। এবার বলো এমন কঠিন হৃদয়ের মানুষের সাথে বিয়ে করাটা কি আমার মানাবে।
– তোমার কাছে কি প্রুভ আছে? ওই মেয়ে বলেছে না? আমি ওকে
– কিছুই করতে পারবে না। আর তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণ পুলিশকে অলরেডি সাবমিট করা হয়েছে। উনারা আসলো বলে। আর তোমার এসিস্ট্যান্ট সব স্বীকার ও করেছে।
নিশাত ধপ করে নিচে বসে পরে। নিজের কাজের প্রায়াশ্চিত্ত তো দূরে থাক দিশার প্রতি ক্ষোভ যেনো আরো গাঢ় হচ্ছে না। কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না। ইচ্ছে করছে দিশাকে মেরে ফেলতে। কিন্তু এখান থেকে বের হওয়া প্রয়োজন। নিশাতের বাবা হাবিব চৌধুরীর মাথা নিচু হয়ে যায়। নিজের মেয়ের এমন কাজে লজ্জিত সে। বেশি ভালোবাসা দেবার ফল পাচ্ছেন। এতো ঘৃণ্য কাজ তার মেয়ে কিভাবে করেছে!!
হৃদয় যেতে ধরলে নূর বেগম বলেন,
– মানছি নিশাত অনেক খারাপ কাজ করেছে, কিন্তু ওই মেয়েটা টাকার বিনিময়ে
– সে অসহায় ছিলো মা, তার বাবাকে বাঁচানোটা বেশি জরুরি ছিলো। আর তুমি তো আমার মা ছিলে মা তবে কেনো তুমি আমার কষ্টটুকু বুঝলে না। আমি যখন ওকে হন্যে হয়ে খুজছি তুমি চুপিসারে আমার জীবন থেকে ওকে সরানোর ছক কষেছো। আমি যতবার নিজের গন্তব্য এর কাছাকাছি যেতাম অমনি তুমি আমাকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে? এগুলো কি আমার ভালোর জন্যে করেছিলে তুমি? আমার তো মনে হয় না। যাক গে, তোমার শাস্তি এটাই হবে তোমাকে ধুমধাম করে ওর সাথেই আমার বিয়ে দিতে হবে।
বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে হৃদয়। আজ মুশলধারে আবারো বৃষ্টি হচ্ছে। হাত ছড়িয়ে বৃষ্টিকে আলিঙন করছে সে। এখন প্রেয়সীর কাছে যাওয়া বাকি কেবল। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজের জয়ের পতাকা উড়িয়েছে এখন শুধু প্রেয়সীর সামনাসামনি হওয়া বাকি। আর কোনো বিপদ তাদের আলাদা করার আগেই সেটা করতে হবে তাকে।
সন্ধ্যা ৭টা,
ঔষধ কিনতে বাসা থেকে বেরিয়েছে দিশা। এতোক্ষণে হৃদয়ের বিয়েটা হয়ে গিয়েছে তাই বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হচ্ছে তার। আর হৃদয় তার নেই। ফাঁকা রাস্তায় হেটে যাচ্ছে সে। সোডিয়ামের লাইট যেনো পুরোনো স্মৃতিগুলোকে আরো সতেজ করে দিচ্ছে। চোখ না চাইতেও পানিতে ডুবে যাচ্ছে। রাস্তায় হাটছিলো দিশা হঠাৎ একটা কালো মাইক্রো এসে তার সামনে দাঁড়ায়। কালো মুখোশধারী কিছু মানুষ এসে তার হাত পা,মুখ চেপে গাড়িতে তুলে দিশাকে। ঘটনার আকর্ষিকতায় কি করবে বুঝে পাচ্ছে না দিশা। তারা তাকে……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি