নীরবে_নীরবে পর্ব ৬

0
1024

নীরবে_নীরবে পর্ব ৬

দিলু উৎসুক চোখে তার মাকে খুঁজছে। কিন্তু তার নিজের পরিবারের কেউ আসেনি। হয়তো বা আসা প্রয়োজন বলে মনে করেনি। কেবল লাভলীর পরিবার এসেছে। এই বাড়িতে তার স্বামীর পক্ষের আর কেউ আসেনি। সবাই এখানেই আছে। কিছুক্ষণ পর তাদের বিয়েটা হয়ে গেল। দিলু অবাক হয়ে ভাবে, বিয়েটাকে বিয়ের মতো মনেই হচ্ছে না। ওদের জুটিকে দেখে বোধ হচ্ছে অনেক আগেই তাদের বিয়ে হয়েছে। হয়তো বা তার কারণ লাভলীর শারীরিক গঠন। হয়তো বা কোনোদিকে সাজসজ্জা নেই বলেই।
বিয়ে সত্ত্বেও দুপুরটায় তেমন ঝামেলা ছিল না। দিলু তার ঘরে এলে সাখাওয়াত বলল, “এখানে যে কাজটার জন্য এসেছি তা তো শেষ। আজ বিকেলে চলে যাব। বাবা নিজেই চলে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ছেন। মনে হচ্ছে, মেঝ ছেলের পর ছোট ছেলেরগুলো দেখে দুর্বল হয়ে পড়ছেন।”
“ওহ্, প্যাকিংটা করে ফেলি?”
“হ্যাঁ, কিন্তু আমারগুলো।”
“মানে?”
“মানে তুমি যাচ্ছ না।”
দিলু হতভম্ব হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল, “কিন্তু বাবা অসুস্থ। এজন্যই তো আমি ওখানে গিয়েছিলাম।”
“বাবারও তোমার প্রয়োজন নেই। তিনি এই কয়েকবছর যেভাবে থেকেছেন সেভাবে থাকতে চান। আমি কী আর বলব? আমার কথার কোন সময় মূল্য দেন?”
দিলুর ভেতরের জগতটা নড়ে উঠল। কেবল অন্যের জন্য না, সে যে চায় নিজের জন্যেও ওখানে যেতে!
“প্লিজ, আমি ওখানে যেতে চাই।”
“না।”
সাখাওয়াতের মুখটা উজ্জ্বলতায় ছেয়ে গেছে। এতটা উজ্জ্বল দিলু আর দেখেনি। এমনকি তাকে এর আগে শাস্তি দিয়েও এতটা উজ্জ্বল হয়নি। সে ক্রমে বুঝতে পারল, কেন মনে হচ্ছিল সাখাওয়াত কোনো প্ল্যান করছে। এই ছিল প্ল্যান? তাকে রেখে চলে যাওয়া? এত বড় শাস্তিটা সে পেতে চায় না। কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা নেই। সে এত বছর একা থেকে অনেকটাই নির্জীব হয়ে গেছে। কেউ কিছু বললে কেবল শোনে রয়। তার ছোট জীবনে এতকিছু হয়ে গেছে যে, কেউ তার কথাকে মূল্যও দেবে না।
দিলু প্যাকিং করছে। কিন্তু ভেতরে অজস্র স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এখনের এই সময়টা তার নিজের বিয়ের সময়টার মতো মনে হচ্ছে। বিয়ের পরদিনটা আজকের মতোই স্বাভাবিক ছিল, যেন বিয়েই হয়নি। আমজাদ কিশোরগঞ্জে ব্যবসার জন্য যাবেন। তিনি সাখাওয়াতকেও নিয়ে যেতে চান। দিলুর ভেতরে কোথাও যেন তল পড়ে গেল। তার বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, আমাদের সময় দরকার। আমাদের মাঝে অনেক ভুল বোঝাবুঝি আছে। দিলু প্রাণপণে তা চাইছিল। কারণ আশেপাশের কেউ ঘনিষ্ঠ হতে চাইবে না। তাছাড়া এই ছেলেটি তাকে ভালোবেসেছে। দিলুর তৎক্ষণাৎ মাথায় আসে, প্রকৃতভাবে ভালোবাসলে সে তার কথার সামান্য হলেও মূল্য দিত। পরিবর্তে সে কিনা তাকে লোভী বলেছে? সে সাখাওয়াতকে বাধা দেয়নি। কিন্তু এটাই তার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তত স্বামী বিশ্বাস করলে বাকিরা ভেবে দেখত। কিন্তু তার পক্ষে সে কাউকেই পেল না। কেউ জিজ্ঞেসও করতে এলো না কিছু। তার এখানে থাকা না থাকা সমান। বছরের পর বছর সাখাওয়াত কিশোরগঞ্জে থেকেছে। বাড়িতে ফিরে আসেনি। ওর কথা কারও মনে পড়লে স্বয়ং সেই কিশোরগঞ্জে গিয়ে দু’জনের সাথে দেখা করে আসত। আমজাদও ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছেন। দিলুর কোনো সঙ্গী ছিল না। জাহানারা ভাবীর সাথে যা তার বোঝাপড়া, তাও অবসর সময়ে সীমিত। অগত্যা সে ধর্মের দিকে অধিক ঝুঁকে পড়ে। সময় কোনদিকে অতিবাহিত হয়েছে টের পায়নি। এসবের তিন বছর পর লাভলীর অবস্থা ধরা পড়ে। অনেক ঘটনা শেষে রাগীব আত্মগোপন করল। সেই রাগীব ওই মেয়েটিকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিচ্ছে।
কবে দিলু ঘুমিয়ে পড়েছে, কবে সাখাওয়াতরা চলে গেছে সে টেরই পায়নি। কেউ ওকে জানানো প্রয়োজনও মনে করেনি? দিলু হাঁটু ভাঁজ করে বসে তাতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। এমন কেন তার ভাগ্য? যাকে সে ভালোবাসে, সেই কেন তাকে এতো অবজ্ঞা করে? সে এই দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে চায়। এমন জায়গায় সে চলে যেতে চায়, যেখানে দুঃখ, একাকীত্ব তাকে পিছুধাওয়া করবে না।
ছাদে গিয়ে সে জাহানারার দেখা পায়। ওদের ছাদ এই ছাদের সাথে রেলিঙের পার্থক্যে লাগানো। জাহানারা বলল, “আরে দিলু তুমি যাওনি?”
সে নির্লিপ্তে বলল, “না।”
“কেন?”
“এমনি।”
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

“আমাকে মিথ্যা বলবে না। সাখাওয়াত নেয়নি না?”
দিলু চুপ করে রইল।
“তার মানে তোমাদের সম্পর্কটা এখনও ঠিক হয়নি!” সে অবিশ্বাসের সাথে মাথা নাড়ল, “তুমি কী মেয়েরে বাবা। স্বামীকে পর্যন্ত কিছু বুঝাতে পারলে না?”
“তুমি জানো না, ও কত কঠোর হয়ে গেছে।” দিলু অকপটে এই বিশ্বস্ত মহিলাকে সাখাওয়াতের সম্বন্ধে বলল কিছু কিছু বাদ দিয়ে। জাহানারার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। দিলু তৎক্ষণাৎ বলল, “আমার মনে হচ্ছে কম সময়ে বিয়ে হওয়াটা ওর উপর প্রভাব ফেলেছে।”
“আমার এমন মনে হচ্ছে না দিলু। এই পরিবারের সবাই এমন। স্বার্থপর, লোভী। তোমার তো লাভলীর মতো কিছু হয়নি, তবু কেন ওরা তোমাকে পাত্তা দেয় না। আসলে ওরা সবাই এক জাতের।”
“ভাবি, আল্লাহ ক্ষমা করুক। আমি কারও সম্বন্ধে গীবত করতে চাই না। আমার স্বামী যেমনই হোক এতে তাঁর দোষ নেই।”
“হয়তো বা। অনেকেই কিছু কষ্টের মুহূর্তের পর কঠিন হয়ে যায়। হতে পারে, আশেপাশের সবাই মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে বলেই সাখাওয়াত ভাই এমনটা হয়ে গেছে। অ্যাই, নিচ থেকে কী কোনো আওয়াজ আসছে?”
“কী? হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমি যাই। গিয়ে দেখে আসি।”
দিলু যতই নিচে নামছে, ততই চিৎকার বাড়ছে। তার শাশুড়ির আওয়াজ বেশি শোনা যাচ্ছে। কী নিয়ে কাঁদছে মহিলা? সে নিচে আসতেই বিষম খেল। শাশুড়ি তড়িঘড়ি করে অভ্রান্তের মতো বোরকা পরছে। রাগীব তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, “আম্মা, তাড়াতাড়ি আসুন।”
চারিদিকে মানুষ শূন্যে কমে এলো। ভাশুরও হয়তো চলে গেছে বউকে নিয়ে। খালা এসে বলে গেল, দিলু, আমার মেয়ের একটু খেয়াল রাখিস। তিনিও চলে গেলেন। দিলুর ভেতরটা ধকধক করছে। পাশে এসে কবে লাভলী দাঁড়াল সে বুঝতে পারেনি। সে দিলুকে দেখে তার প্রতিক্রিয়া বুঝে বলল, “ওরা হাসপাতালে যাচ্ছে। বাবা আর সাখাওয়াত ভাইয়া যে গাড়িতে বসেছিল তার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।”
দিলু বজ্রাহত হয়ে তার দিকে তাকাল। এই ধরনের হুট করে শোনা কথা যে-কারও বিশ্বাস হওয়ার নয়। কয়েক মুহূর্ত নীরবে কেটে যাওয়ার পর তার মনে হলো, চারিপাশটা ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে আসছে। সে মেঝেতে বসে পড়ল। এমন সময় তাকে আবার স্ত্রীত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সবাই ওখানে গেছে। আর তাকে এখানে লাভলীর দেখাশোনা করতে রেখে যাওয়া হয়েছে? তার স্বামী হাসপাতালে জেনে আরেকজনের খেয়াল সে কী করে রাখবে?
আজকের রাতটা দিলুর অনেক বড় বলে মনে হলো। নয়টা বাজলে মনে হলো একটা দিন বুঝি পার হয়ে গেছে। কারও কোনো খবর নেই।
দিলুর ভ্রম ভাঙল একটা আওয়াজ শুনে। দরজায় বাড়ির আওয়াজ শোনে খুলে দেখল, জাহানারা এসেছে।
“আমি শুনেছি ওরা..”
দিলু কিছু বলল না।
“কিছু বল দিলু। সাখাওয়াত ভাইকে কি দেখতে যাবে না? তার কী খবর?”
“ওকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। না জানি কী অবস্থা। শুনেছি ওর আব্বার অবস্থা আরও খারাপ। খালা ফোন করে বলল।” তার গলা ধরে এলো, “আর আমাকে লাভলীকে দেখতে বলা হয়েছে।”
“তার দরকার নেই। তুমি ওখানে যাও। আমি ওর দেখাশোনা করব।”
দিলু ছলছল চোখে তার দিকে তাকাল।
“যাও বলছি। কোন হাসপাতালে নিয়েছে জানো?”
“হ্যাঁ।” দিলুকে তড়িঘড়ি করে জাহানারা বের করে দিয়ে নিজে এসে দিলুর জায়গা নেয়। রাতটা হতে পারে এরচেয়েও খারাপ। কাজেই দিলুকে সবই চোখের সামনে দেখা উচিত। মেয়েটি আজকের দিনেও এভাবে বঞ্চিত হতে পারে না।
সবাই এতো আহত যে, দিলুকে কেউ টের পায়নি। পেলেও কেউ ভ্রূক্ষেপ করেনি। সে ওয়ার্ডে গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। সাখাওয়াতের অবস্থা এখন ততটা খারাপ নয়। সে চোখের পানি ফেলে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাল। যদিও তার জীবনের তিনটি দিন ব্যতীত কখনও লোকটির ভালোবাসা পায়নি, তবু ওই তিন দিনের বদৌলতে সে ওই লোকটিকে ভালোবেসে এসেছে, লোকটির অত্যাচারকে ভালোবেসে এসেছে। দিলুর মন জানে, লোকটি খারাপ নয়। একেক মানুষের সংসার একেকরকম। তারটাও তাই ছিল। সে জটিল কিছু খুঁজে পায় না।
কিন্তু সে কৃতজ্ঞতা সম্পূর্ণ প্রকাশ করে উঠতে পারল না, শুনতে পেল কারও আর্তনাদ। বুক ছিঁড়ে যাওয়ার মতো আর্তনাদ। কারও স্বামী মারা গেছে। আমজাদ মারা গেছে। সে ছটফট করতে লাগল। সাখাওয়াত জানলে কেমন করবে? সে তার বাবাকে কতটা ভালোবাসে তা দিলু ছাড়া আর কেউ দেখেনি। বাবা আর ছেলের মাঝে একটা দেয়াল তৈরি হলেও বাবাকে নিয়ে তার মনে সবসময় ছিল গভীর শ্রদ্ধা, ভক্তি। বাবা এতো অবজ্ঞা করার পরও সন্তান যখন তাঁকে সমানে ভালোবেসে যায়, তখন সেই সন্তানকে কীভাবে জানানো যাবে বাবা মারা গেছে?
দিলু মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। সবকিছু ধু ধু মরুভূমি মনে হচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে জীবনের এই খেলা দেখতে লাগল।
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
[আগামী পর্বে এই গল্পটি শেষ করে দেওয়া হবে।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে