#নিয়তি
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(কন্ঠ)
#পার্ট৩
-আচ্ছা তুমি কী বাচ্চা পড়াও?
-আগে পড়াইতাম।এখন পড়াই না।কেন?
ফোনের এপাশ থেকে আলভীর কথার জবাব দেওয়ার সাথে পালটা প্রশ্ন করে হৃদি।ফোনের ওপাশ থেকে আলভী জবাবে বলে,,
-আমার ছোট ভাই টা ক্লাস টু তে উঠলো।ওর জন্য প্রাইভেট টিউটোর খুজছিলাম।পড়াবে আমার ছোট ভাইটাকে?
-দেখি।আমি মামার সাথে কথা বলে তোমায় জানাবো নি।
-আচ্ছা।কয়টা বাজে খেয়াল আছে মেডাম?
ফোনের ওপাশ থেকে আলভীর বলা কথা শুনে হৃদি ঘড়ির দিকে তাকায়।দেখে দেড়টা বাজে।এত রাত হয়ে গেছে হৃদি বুঝতেই পারেনি।আলভীর সাথে কথা বললে সময় কেমন যেন তাড়াতাড়ি বয়ে যায়।
-কী হলো মেডাম?বললেন না তো কয়টা বাজে।
ফোনের ওপাশ থেকে হৃদির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারে আলভী।লজ্জা মাখা কন্ঠে হৃদির আলভীর প্রশ্নের উত্তর দেয়।
-ইয়ে মানে…দেড়টা।
-ঘুমাবেন না?
-ঘুম আসছে না।
-ঘুমায় পড়ো।আবার সকালে উঠেই তো তোমাকে রাজ্যের কাজ করতে হয়।কখনো খারাপ লাগে না?
-খারাপ লাগবে কেন?নিজের ঘরে কাজ করতে কার খারাপ লাগে!
-নিজের ঘর?তুমি না তোমার মামাবাড়ি থাকো।
-মামা কী আপন না?মা মারা যাওয়ার পর বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হই।তখন তো মামাই আমায় কাছে টেনে নিয়েছে।সাম্যদার থেকে মামা আমায় কোনো অংশে কম দেখে না।
-কিন্তু তোমার মামি?
আলভীর কথা শুনে হৃদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।হাসি মাখা কন্ঠে বলে,,
-মামি তো আমায় আরও বেশি ভালোবাসে।তাই তো বকা ঝকা করেন।অনেক রাত হয়েছে।আল্লাহ হাফেজ
-হুম আল্লাহ হাফেজ।
হৃদি ফোন কেটে দেয়।স্টাডি টেবিলের পাশে চার্জিং পয়েন্ট।ফোন চার্জে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৃদি।সে জানে মামির কাছে হৃদি বোঝা।কিন্তু ঘরের কথা কী আর বাইরের মানুষকে বলা যায়?লোকে ছি ছি করবে।ছোট বেলায় হৃদি বেশ পেট পাতলা স্বভাবের ছিলো।কোনো কথাই গোপন রাখতে পারতো না।তাই হৃদির মা হৃদিকে বলতেন,,
-আমাদের কাছে বলছিস বল। কিন্তু বাইরের মানুষের কাছে ঘরের কথা কখনো বলবি না।লোকে ছি ছি করবে আর সুযোগ পেলে কটু কথা বলবে।
সময় আর পরিস্থিতি কত কিছুই বদলে দেয়।৪-৫বছর আগের সেই হৃদি এখন বদলে গেছে।কিছু হলেই বাড়ি মাথায় করতো যে মেয়ে আজ চুপচাপ থাকতে শিখে গেছে।গোপন রাখতে শিখে গেছে হাজারো কথা।যে মেয়ে গোসল করে বাথরুমে কাপড় ফেলে আসতো অন্য কেউ তার কাপড় ধুবে বলে সেই মেয়ে আজ ৪-৫জনের কাপড় দিব্যি ধুয়ে দিচ্ছে।হাত নষ্ট হয়ে যাবে বলে যে মেয়ে বাসন মাজতো না আজ সেই মেয়ে তিনবেলার এটোঁ বাসন ধুচ্ছে।কেউ নিজের জিনিসের দিকে তাকালে যে মেয়ে তাকে সহ্য করতে পেতো না।আজ সেই মেয়ে হাসি মুখে প্রিয় জিনিসটাকে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছে।মেয়েদের জীবনটা ঠিক এই রকমই।সেক্রেইফাইজ আর মানিয়ে নিয়েই চলে যায়।দুটো চোখের একটি দিয়ে নিজের পরিবার আপনজনের সুখ দেখে।আর অন্য চোখ দিয়ে ভালোবাসার মানুষটার।নিজের দিকে তাকানোর সময় সুযোগ কোনোটাই নেই তার।কেন যেন ইদানীং রাত হলে হৃদির মায়ের কথা খুব মনে পড়ে।আজকেও মনে পড়ছে।হৃদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখের কার্ণিশ থেকে জল গাল গড়িয়ে বালিশে পড়ে।
★★
-হৃদি তো এইচএসসি দিলি এইবার তাই না?
-জ্বী মামা।
কথাটা বলে সালাম সাহেবের প্লেটে তরকারি দেয় হৃদি।সালাম সাহেব রুটির টুকরো মুখে দিয়ে বলেন,,
-তা বিয়ে সাদি করার ইচ্ছা কী এখনো আছে?না আর একটু পরে করবি।
-তোমরা যা ভালো বুঝো।তোমরা তো আমার ভালোই চাইবে।কখনো খারাপ চাইবে না।
-তোর পছন্দের কেউ আছে?
কথাটা শোনা মাত্রই হৃদি সাম্যের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,,
-মামি কিছু লাগবে তোমার?
-নাহ।
কারও বুঝতে বাকী রইলো না যে হৃদি কথাটা এড়িয়ে গেলো।সবার খাওয়া যখন শেষের দিকে তখন হৃদি আর সিঁথি খেতে বসে।খাওয়া শেষে সালাম সাহেব উঠে যাচ্ছিলেন।তখন হৃদি তাকে বলে,,
-মামা আমি যদি একটা টিউশনি করি তো তোমাদের কী কোনো সমস্যা হবে?
-বাসায় গিয়ে পড়াবি নাকি স্টুডেন্ট বাসায় আসবে।
পানির গ্লাসটা টেবিলে রেখে হৃদিকে পাল্টা প্রশ্ন করে সাম্য।সাথে সাথে হৃদি জবাব দিয়ে দেয়,,
-বাসায় গিয়ে ভাইয়া।
-বাসা কই?
-তা তো জিজ্ঞাস করি নি।
-আচ্ছা আমায় জানাস।
কথাটা বলেই সাম্য অফিস ব্যাগ কাঁধে নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সালাম সাহেব উঠে ঘরে যান।পেছন পেছন তার সহধর্মিণীও যান।
সিএনজিতে আনমনে বসে আছে সাম্য।শহুরে যান্ত্রিক জীবনের কলহল তার কান স্পর্শ করেনি।সেদিনই সাম্যের ফুপি পুতুলটাকে সাম্যের কোলে দিলো।দেখতে দেখতে পুতুলটা বড়ও হয়ে গেলো।হয়ে গেলো কৈশরের প্রেম।পরিস্থি পুতুলকে সাম্যের থেকে দূরে সরিয়ে নেয়।যাকে নিয়ে সাম্যের পুরো জীবন কাটানোর কথা ছিলো সে একদিন অন্যকারও হয়ে যাবে।ভাবতেই সাম্যের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। সাম্য ছাদে দাঁড়িয়ে নিজ মনে সিগারেট টেনে যাচ্ছে।হৃদি জানে যে এই সময় সাম্য সিগারেট টানে।তাই সে ছাদে আসে।সিঁথির সাথে বিয়ের কথা জানানো হয়েছিলো সাম্যকে।সে সোজা না করে দেয়।তা নিয়েই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন বিলকিস বেগম আর সালাম সাহেব।এবং তা হৃদি আড়াল থেকে শুনতে পায়।সবার মতো সেও চেষ্টা করে সাম্যকে রাজী করানোর।হৃদি ডাক দিলে সাম্য পেছন ফিরে তাকায়।হৃদিকে দেখে সাম্যের মলিন মুখে হাসি ফুটে।সিগারেটটা প্রায় শেষের দিকেই।সিগারেটের ফিল্টারটা ছুড়ে ফেলে মেঝেতে।ছাদের রেলিংয়ের সাথে ধাক্কা লেগে অনাদরে রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে পড়ে থাকে সিগারেটের জলন্ত ফিল্টার।
সাম্য হৃদির কাছে গিয়ে বলে,,
-শুনলাম সিঁথির সাথে মা বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।তুই কিছু জানিস?
-হু জানি।এও জানি তুমি বলেছো সিঁথিদিকে তোমার দ্বারা বিয়ে করা সম্ভব নয়।
-ভুল কিছু বলেছি?আমার পুতুল থাকতে আমার অন্য কাওকে চাই না।
-অবশ্যই।সব কিছু সম্ভব না সাম্যদা।তুমি জানো আমি আশ্রিতা।
-আশ্রিতা তো কী হইছে!তোকে আমি বিয়ে করে পার্মানেন্টলি এই বাড়ির সদস্য বানাবো।
হৃদির গালে হাত দিয়ে একরাশ আশা ভরা কন্ঠে কথাটা সাম্য বলে।হৃদি এক ঝটকায় সাম্যের হাত সরিয়ে দেয়।হৃদির এমন আচরণের জন্য সাম্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।সে অবাক দৃষ্টিতে সাম্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।করুণ কন্ঠে বলে,,
-হৃদি!তোর কী কিছু হয়েছে?এমন করছিস কেন তুই?
-কী হবে কিছু না।
-তাহলে এমন করছিস কেন?তুই কী আমায় আর ভালোবাসিস না?
-সব ভালোবাসা পুর্ণতা পায় না সাম্যদা।অন্যের খুশীর জন্য কখনো কখনো নিজেদের সেক্রিফাইজ করতে হয়।
-কী বলতে চাইছিস তুই?
-সিঁথিদিকে এই বাড়িতে বউ করে নিয়ে এসো।
হৃদির মুখে এমন কথা শুনে সাম্যের মাথায় রক্ত চড়ে যায়।রাগে ওর চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে।
-পাগল হইছিস?কী বলতেছিস এগুলা?ওর মতো মেয়েকে আমি বিয়ে করবো?নেশাখোর ছেলের সাথে সম্পর্ক। দুই তিন বার বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে।
-জানো সাম্যদা মেয়েরা না অনেক সরল হয়!হতে পারে ছেলেটা সিঁথিদিকে ফুসলিয়ে বের করে নিয়ে গিয়েছিলো।অন্তত আমার খুশীর জন্য সিঁথিদিকে বিয়ে করো।
কথাটা বলে হৃদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সাম্য সিগারেটে আগুন ধরিয়ে এক টান দেয়।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,,
-আমি ওকে বিয়ে করলে তুই খুশী হবি?
-কেন নয়?অবশ্যই খুশী হবো।
-কিভাবে?
-মামা মামি খুশী হবে।
-আর তুই? আমি?
-সব সময় নিজেদের কথা ভাবলে হবে?কবি বলেছেন ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।
হৃদির কথা শুনে সাম্য ফিক করে হেসে দেয়।এই মেয়েটার বাচ্চামি স্বভাব হুট করেই চলে আসে।তাও সিরিয়াস মোমেন্টে!তখন বা হেসে থাকা।যায় না।হৃদি চলে যাচ্ছিলো।ঠিক সেই সময় সাম্য হৃদিকে পেছন থেকে ডাকে।হৃদিও পেছন ফিরে তাকায়।সাম্য মুচকী হেসে বলে,,
-বেশ তাই হবে।আমি সিঁথিকেই বিয়ে করবো।কিন্তু একটা আবদার রাখবি?
-কী?
-কাছে আয়।
হৃদি সাম্যের কাছে যায়।সাম্য হৃদির কপাকে এঁকে দেয় তাদের ভালোবাসার শেষ চিহ্ন।হৃদিও চোখ বন্ধ করে তা পরম আয়েশে গ্রহন করে।
চলবে,,,