নিভৃত পূর্ণিমা – ৯ (শেষ পর্ব)
ঘুমের ওষুধের প্রভাব কেটে যেতে জেগে উঠল নাদিম। সোফায় শুয়েছিল, উঠে বসল। পড়ার টেবিলে ল্যাম্প জ্বলছে। ঘরে মৃদু আলো। সন্ধ্যা সন্ধ্যা লাগছে। ঘুম ভাঙলেও কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। মনে করার চেষ্টা করল এই সন্ধ্যা বেলায় সে সোফায় ঘুমাচ্ছে কেন? ঘড়ি দেখল নাদিম। মোটেই সন্ধ্যা না। এখন রাত সাড়ে তিনটা।
কেন সোফায় ঘুমাচ্ছিল এবার মনে পড়ল। সায়রা বানু চলে যাওয়ার পর নিজেকে শাট ডাউন করেছিল। যেন কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে না হয়। লম্বা ঘুমের পর এখন জেগে উঠেছে। খুব তেষ্টা পেয়েছে। পানি খেতে রেফ্রিজারেটরের কাছে গেল নাদিম। ঝকঝকে তকতকে কিচেন। একজন পরিষ্কার পরিছন্ন মেয়ে ঘরবাড়ি কত গোছানো এবং কত ঝকঝকে রাখে তার উদাহরণ নাদিমের এপার্টমেন্ট। এলোমেলো, অপরিষ্কার এপার্টমেন্টকে গুছিয়ে ঝকঝক করে রেখে গেছে সায়রা বানু। পানি খেয়ে আবার ঘুমাতে গেল। এবার বেডরুমে বিছানায় ঘুমাল। পরদিন অনেক দেরি করে উঠল। সায়রা বানু চলে যাওয়ার কষ্ট ভুলে আবার জান প্রাণ দিয়ে চাকরির চেষ্টা করতে লাগল। এবার আরো নূতন অনেক রিক্রুটারদের সাথে কথা বলল। ইন্টার্ভিউ পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকল।
***
নিজের এপার্টমেন্টে জিনিসপত্র গুছিয়ে পরদিন আম্মিজানকে ফোন করল সায়রা বানু।
— আজ আমার এপার্টমেন্ট থেকে ফোন করছি আম্মি। তুমি আসবে? আমাকে দেখে যাও? উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করল।
— আরো একটু গুছিয়ে নাও, তখন আসব। কয়েকটা কাজের কথা বলি, আমার মাসিক খরচ রেখে আর সব টাকা তোমার মামা মিউচুয়াল ফাণ্ডে রেখেছে। টাকা পয়সা লাগলে জানাবে।
— এখন লাগবে না আম্মি। একটা কমিউনিটি কলেজের পাশে এই এপারটেমেন্ট। আশেপাশে অনেক ডাক্তারের অফিস, পাঁচ মিনিটি হাঁটলে অনেক রকমের কাজ পাওয়া যাবে। এই এলাকায় এসে বুঝতে পেরেছি, খালাম্মা বাল্টিমোরে যে জায়গায় থাকতে দিয়েছিল, ওরকম বিপদজনক জায়গায় থাকার, ওরকম অড জব করার কোনো দরকার ছিল না। মেরিল্যান্ডে অনেক সুন্দর, নিরাপদ এলাকা আছে।
এরপর সায়রা বানু আম্মার সাথে অনেকক্ষণ আত্মীয়স্বজন, কে কেমন আছে এবং নিজেদের অর্থনীতিক অবস্থা নিয়ে আলাপ করল। এক পর্যায়ে কথাবার্তা নাদিমের দিকে ঘুরে গেল।
সায়রা বানুর আম্মা বলল, তুমি একটা ছেলের সাথে প্রায় দুই মাস ছিলে, আমি কল্পনা করতে পারি না। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
— নাদিম ছেলেটা ভালো ছিল। তা না হলে অন্য কোনো উপায় খুঁজতে হতো। কি একটা ভীষণ বিপদে যে ছিলাম।
অনেক দ্বিধা করে আম্মিজান জিজ্ঞেস করল, তুমি কিছু মনে না করলে কয়েকটা কথা বলতে পারি?
— কী বলবে বলো আম্মি। এভাবে জিজ্ঞেস করতে হবে না।
— ছেলেটাকে তোমার কেমন মনে হলো?
— খুব ভালো ছেলে। একটা চাকরি পাওয়ার জন্য খুব চেষ্টা করছে।
— ওর সম্পর্কে একটু বল তো শুনি।
— নাদিম বাসার বড় ছেলে। ও ফ্যামিলিকে সাপোর্ট করে। ড্রিঙ্ক, ডেট করে না। একটু ছেলে মানুষী ভাব আছে। বেডরুমের দেয়ালে ইউরোপিয়ান ফুটবল ক্লাবের পোষ্টার, পোকিমান কার্টুনের পোষ্টার লাগিয়ে রেখেছে। হাসতে হাসতে বলল সায়রা বানু।
— বয়েস কম, এরকম তো হবেই।
— আমাদের ফ্যামিলির সাথে ওদের একটু তফাৎ আছে।
— কীরকম তফাৎ?
— নাদিমদের পরিবারের বাবা-মা, ভাইবোন, সবাই পড়ালেখা করে। চাকরি করা ওদের উদ্দেশ্য। ওদের আচার-ব্যবহার শিক্ষিত পরিবারের মত। নাদিম কিচেনে কাজ করতে সাহায্য করে। কোনো বিষয়ে ডমিনেট করে না। আমাদের যৌথ পরিবার বিজনেস ভিত্তিক। অনেকে ওয়াইফ, বোনকে ডমিনেট করতে চায়। এই রকম বেশ কিছু পার্থক্য আছে। নাদিম অনেক লিবারেল মনের।
— আচ্ছা, ও তোকে এত সাহায্য করল কেন? গাড়ি চালানো শেখানো তো অনেক রিস্কের ব্যাপার ছিল। যদি এক্সিডেন্ট হতো, প্রপার্টি ড্যামেজ হতো, ছেলেটাকে সব দায়-দায়িত্ব নিয়ে হত। কী পেলো সে তোমার পিছনে এত সময় দিয়ে?
কিছুক্ষণ কী বলবে কথা খুঁজে পেলো সায়রা বানু। সত্যি, কেন নাদিম ওকে সাহায্য করল? মনে যা ছিল, তাই বলল সায়রা বানু, আমিও অনেক ভেবেছি, আম্মি। বেসিক্যালি নাদিম একটা ভদ্রছেলে। তার পক্ষে মানুষকে সাহায্য করা সম্ভব। কিন্তু আমাকে এত করে সাহায্য করার অনেকগুলো কারণ ছিল। ওর চাকরি ছিল না, একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থেকে আসল সমস্যা ভুলে যেতে চেয়েছিল। আমাকে পছন্দ করত। অন্য কালচারের একটা মেয়ের প্রতি কৌতূহল ছিল।
— আরো একটু খুলে বলো না, আম্মু?
— আমি যখন হাতে হাতে রুটি বানিয়ে কড়াইয়ের উল্টা পিঠে সেকতাম, ও তখন পড়া ফেলে রেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। আমার সাথে রাজস্থানি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা দেখতে গিয়েছিল। খুব পছন্দ করেছিল।
— তোকে পছন্দ করে এমন কোন ভাব প্রকাশ করেছে?
— একদিন আমরা দুজন চা খাচ্ছিলাম, দেখলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাকিয়ে আছো কেন? অনেকটা আনমনে জবাব দিয়েছিল, “কাজল দিলে তোমাকে অন্য ভুবনের কেউ মনে হয়।“
— তাই নাকি? হেসে ফেলে প্রশ্ন করল আম্মি। তুমি কী বললে?
— আমি কিছু বলিনি। সোফা ছেড়ে বেড রুমে যেয়ে বসেছিলাম। অনেকক্ষণ পর আবার সোফায় ফিরে বসে বসে টিভি দেখছিলাম।
— কেন এরকম করেছিলে?
— ঠিক জানি না। খুব লজ্জা লাগছিল। সেদিনের পর থেকে সে আর কখনো কিছু বলেনি। কিন্তু যেদিন চলে আসব, সেদিন অনেকগুলো মিষ্টি কথা বলেছে।
— ওর সম্পর্কে যা শুনলাম, খুব আদর্শ ছেলে মনে হয়। তোমরা কোনো ইচ্ছে আছে? একদম সরাসরি প্রশ্ন করল আম্মি।
চুপ করে থাকল সায়রা বানু। জবাব খুঁজে পেলো না। আরো কয়েক বার জিজ্ঞেস করাতে বলল, তুমি কী বলো, আম্মি? আমি ঠিক বুঝতে পারি না কী করব? আমাদের ভাষা ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন। কেমন যেন একটু ভয় হয়।
— তুমি একজন সাহসী, বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমেরিকাতে থাকার অনেক সুবিধা আছে। পছন্দ তোমার, কিন্তু আমার মনে হয় এরকম ভালো ছেলে খুব কম দেখতে পাবে।
— আচ্ছা, ভেবে দেখব।
— একটা কথা, ও যেমন তোমার যত্ন করেছিল, তুমিও তেমনি ওর খবর রাখবে। বন্ধুত্ব নষ্ট করো না।
— না, যোগাযোগ বন্ধ করব না, আম্মি।
— গুছিয়ে নিয়ে একদিন বাড়িতে আসো? নিউ জার্সি আসতে বলল আম্মি।
— আচ্ছা, আসবো। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিল সায়রা বানু। জীবনটাই অন্য রকম হয়ে গেছে। সব কিছু মিষ্টি, মধুর লাগছে।
**
সায়রা বানু চলে যাওয়ার পর ঘরটা নিঃশব্দ, নীরব হয়ে থাকে। আগে ল্যাপটপে কাজ করার সময় টিভির শব্দ পেত। হিন্দি ভাষার সিরিয়াল হলে কী ঘটছে কিছু বুঝতে পারত, কিন্তু রাজস্থানি ভাষার কোনো প্রোগ্রাম হলে সুন্দর কিছু কণ্ঠ ছাড়া আর কিছু বুঝত না নাদিম। সায়রা বানু চলে যাওয়াতে ঘরটা শূন্য হয়ে গেছে। ফ্রিজ ভর্তি করে রান্না করে দিয়ে গেছে। রেফ্রিজারেটর সেকশন এবং ফ্রিজার দুই যায়গা ভরা। অনেকদিন রান্না না করলেও চলবে।
অনেক চেষ্টা করে বিশ-পঁচিশটা ইন্টার্ভিউ দিল নাদিম। অনেকগুলোতে শেষ তিনজনের মধ্যে জায়গা পেলো, কিন্তু চাকরি পেলো না। যে একজন বা দুজনকে নেয়া হয়, তাদের অভিজ্ঞতা নাদিমের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। সব ইন্টার্ভিউতে একই কারণের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
প্রথম প্রথম যে সব রিক্রুটিং এজেন্সির লোকজন ওর জন্য চাকরি খুঁজত, তাদের আগ্রহেও এখন ভাটা পড়েছে। রঘুনাথ রেড্ডি এখন আর আগের মতো আগ্রহ নিয়ে যোগাযোগ করে না। এক মাত্র ব্যতিক্রম মিশেল ময়নিহান। ভদ্রমহিলা নিয়ম ধরে নাদিমের সাথে যোগাযোগ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় এপ্লিকেশন পাঠাচ্ছে। কিন্তু মিশেলের চেষ্টাও কাজ হচ্ছে না। শেষ সিলেকশনে নাদিম বাদ পড়ে যাচ্ছে।
অনেক চেষ্টা করেও কিছু না হওয়াতে এক সময় উদ্যম হারিয়ে ফেলল নাদিম। বুঝতে পারল যত চেষ্টাই করুক না কেন, চাকরি হবে না। এক সময় গভীর ডিপ্রেশনে চলে গেল নাদিম। কিন্তু নিজেও বুঝতে পারছে না যে সে ডিপ্রেশনে ভুগছে।
নিউ ইয়র্কের খালাম্মা এবং দেশ থেকে আম্মা বেশ কয়েকবার সোফিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে বলল। নাদিম কাউকে মুখের উপর না করে দিল না। কিন্তু কিছুতেই সোফিয়াকে ফোন করল না। নাদিম যে সোফিয়াকে ফোন করছে না, এই বিষয়টা খেয়াল করল নাদিমের আম্মা। নাদিম একটি মেয়েকে পছন্দ করে, এই কথা জানার পর নাদিমের আম্মা বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছে। ছেলেকে বিরক্ত ভাব দেখানো ঠিক হয়নি। আর একটু মিষ্টি স্বরে কথা বললে ভালো হতো। দেশে থাকতে এবং বিদেশে যেয়ে নাদিম কখনও এমন কিছু করেনি যে তার উপর বিরক্ত হতে হবে। কোনোদিন নিজের পছন্দ আছে, এমন কিছু বলেনি নাদিম। ব্যক্তি জীবনে নাদিম তার পছন্দ মতো কিছু করতেই পারে। মা হিসাবে নিজের প্রভাব খাটানো উচিত হয়নি। “ছেলে যত ভালো হয়ে চলে, বাবা-মায়ের আবদার, খবরদারী তত বাড়ে”, এমনটা যেন নাদিম ভেবে না বসে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এমনিতেই কত রকমের সমস্যায় আছে ছেলেটা, এই সময় আরো মায়া-মমতা দেখানো উচিত ছিল। এরপর আবার কথা হলে নাদিমের সাথে আরো সহনশীল হয়ে কথা বলতে হবে। ওর ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার দাম দিতে হবে।
মাঝে মাঝে সায়রা বানু ফোন করে বিভিন্ন বিষয়ের খোঁজ খবর নেয়। নাদিম সুন্দর করে বলে দেয়, সব ঠিক আছে। আশা করছে খুব তাড়াতাড়ি একটা চাকরি হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই ঠিক মতো হচ্ছে না, এটা তার চেয়ে ভালো করে কেউ জানে না।
তিনমাস শেষ হতেই অফিস থেকে “এন্ড অফ এমপ্লয়মেন্ট” লেটার পেলো নাদিম। এই চিঠি পাওয়াতে এখন ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস, লাবককে জানাতে হবে যে তার চাকরি নেই। এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাকরি না পেলে নাদিম আমেরিকা থাকতে পারবে না। দেশে ফিরে যেতেই হবে, এমন একটা চিন্তা মাথায় স্থায়ী ভাবে স্থান নিল। সে রাতেই প্যানিক অ্যাটাক হলো।
অনেক রাত বলে কেমন একটা আতংক বোধ করল, কেমন যেন বমি বমি ভাব হলো। বাথরুমে যেয়ে সত্যি সত্যি বমি করল নাদিম। মুখ ধুয়ে আবার সোফায় বসল। একজন সুস্থ সবল ছেলে হয়ে এরকম অসুস্থ বোধ করেছে কেন বোঝরা চেষ্টা করল। চার থেকে চার-পাঁচটা কারণ খুঁজে পেলো নাদিম।
প্রথম কারণ, টারমিনেশন লেটার এসে গেছে। অথচ এতদিন ধরে জান প্রাণ দিয়েও চাকরি খুঁজে পায়নি। একে ওকে ধরাধরি করেও কোনো লাভ হয়নি। কম্পিউটার লাইনে চাকরি এখন খুব কম এবং অভিজ্ঞ লোকজন চাকরি খুঁজছে। ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে চাকরি পাচ্ছে না নাদিম।
মন খারাপের দ্বিতীয় কারণ চাকরি না থাকলেও নিয়মিত দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। কিন্তু এখন থেকে বেতন বন্ধ হয়ে যাবে, তখনও টাকা পাঠাতে হবে। যদিও এখন টাকা পাঠাতে না পারলে কেউ কিছু বলবে না, কিন্তু বাসার অবস্থা নাদিম জানে। সংসারে সাহায্য করতে না পারলে নিজের খারাপ লাগবে। খরচ কমাতে হলে বাসাটা ছেড়ে দিয়ে কারো সাথে এপার্টমেন্ট শেয়ার করতে হবে। দ্রুত চাকরি না পেলে গাড়িটা বিক্রি করে দিতে হবে। এতে ইনস্যুরেন্স, গ্যাসের এবং আনুষঙ্গিক খরচ কিছুটা কমবে। ইন্টার্ভিউ দিতে হলে গাড়ি রেন্ট করা যাবে অথবা উবার ডাকা যাবে।
তৃতীয় কারণ, সোফিয়া তার সাথে নির্লিপ্ত ব্যবহার করেছে। আম্মা, খালাম্মা যেভাবে বলে কয়ে নিউ ইয়র্ক যেতে বলেছে, তারপর এরকম নির্লিপ্ততা আশা করেনি। আম্মা, খালাম্মার চিন্তা ভাবনার সাথে সোফিয়ার চাওয়া পাওয়ার ব্যাপারটা মেলেনি।
চতুর্থ কারণটা ভাবতেই মনে কষ্ট হয়। আম্মাকে সায়রা বানুর কথা বলার সাথে সাথে আম্মা কেমন যেন একটু অসন্তুষ্ট হয়েছিল। কিছু না জেনে, কিছু না শুনে, নাদিমের ইচ্ছার সম্মান করেনি। বরং সোফিয়ার সাথে সম্পর্ক হয় কিনা আবার সে চেষ্টা করতে বলেছিল। মেয়েটার সাথে যোগাযোগ করার ইচ্ছা নাদিমের আছে কিনা, যোগাযোগ করাটা ঠিক কাজ হবে কিনা, সে সব ভাবার দরকার মনে করেনি। একটা জিনিস বুঝতে পারছে নাদিম, দেশে থেকে বাবা-মা, ভাই-বোন ওর অবস্থা বুঝতে পারে না। নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা থেকে নাদিমকে বুদ্ধি, উপদেশ দিতে থাকে। নাদিমের জন্য কোনটা ভালো সেটা না বুঝলেও নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। কিসে নাদিমের ভালো, কিসে অসম্মান, এগুলো এক সময় ভালো করে বুঝিয়ে বলতে হবে।
পাঁচ নাম্বার কারণটা একান্ত ব্যক্তিগত। সায়রা বানু ঘরে নেই, এটা সহ্য হতে অনেক সময় লাগবে। একজন মানুষের সাথে থাকা এবং একা থাকার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। দুজন থাকলে কীভাবে সময় কেটে যায় টের পাওয়া যায় না, অথচ একা থাকলে না না রকম দুশ্চিন্তা মাথায় ভর করে।
নাদিম ঠিক করল একটু একটু করে ঘরের জিনিস পত্র বিক্রি করে দেবে। আমেরিকায় লোকজন শনিবার সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটার মধ্যে বাসার সামনে পারকিং লটে জিনিস পত্র বিক্রি করে। জিনিসের গায়ে দাম লিখে চেয়ারে বসে থাকে। একে “ইয়ার্ড সেল” বলে। লোকজন শনিবার সকালে গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে ইয়ার্ড সেল থেকে খুব সস্তায় জিনিস পত্র কেনে। এভাবে চেয়ার, টেবিল, বই পত্র, কম্পিউটার, খেলনা, থালা-বাসন, হাড়ি-পাতিল, গানের সিডি, যার যা ইচ্ছে বিক্রি করতে পারে। নাদিম গাড়ি, ল্যাপটপ, বিছানা এবং অত্যাবশ্যক কয়েকটা জিনিস রেখে বাদ বাকি সব কিছু বিক্রি করে দিল। ঠিক করল সবার শেষে গাড়িটা বিক্রি করে দেবে।
নাদিমের ডিপ্রেশন সবার আগে ধরতে পারল কলেজের বন্ধু অকসয় কুমার। একদিন দুপুরে ফোন করে ঘুম থেকে তুলল।
— এখনও ঘুমাচ্ছিস? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল অকসয় কুমার।
— কাজ নেই, উঠতে ইচ্ছে করছে না।
— তাই বলে দিনে দুপুরে শুয়ে থাকবি?
— কেন যে সকাল হয় বুঝতে পারি না। রাতে ঘুমানোর সময় মনে হয়, কাল যদি ঘুম না ভাঙত, তাহলে খুব ভালো হতো। ঘুম ভেঙ্গে অন্ধকার ভবিষ্যৎ ফেস করতে ইচ্ছে করে না।
নাদিমের কথা শুনে হাত পা ঠাণ্ডা হওয়ার মতো অবস্থা হলো অকসয়ের। এসব কী বলছে? সকালে ঘুম না ভাঙলে ভালো হতো? কথা শুনে মনে হয় জীবনকে টেনে নিতে পারছে না। অথচ স্কুলে কী যে প্রাণবন্ত ছিল নাদিম! সবার সাথে মিশত, কথা বলত, খেলত, গল্প করত। একটা চাকরির জন্য চেষ্টা করে করে এখন ডিপ্রেশনে চলে গেছে। এখন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চায় না, এ জন্য দুপুরেও বিছানা থকে উঠে না।
— এখনি তুই এত হতাশ হয়ে পরেছিস কেন? তোর হাতে তো কয়েক মাস সময় আছে। আছে না?
— তিন মাসের বেশি হয়ে যাচ্ছে চাকরি খুঁজছি। বিশ-পঁচিশটা ইন্টার্ভিউ দিয়েছি। টপ তিনজনের মধ্যে থেকেও ফাইনাল সিলেকশনে আসতে পারিনি। এভাবে সময় নষ্ট করে, এনার্জি নষ্ট করে লাভ নেই। আমার ভাগ্য খারাপ, আমি সেটা মেনে নিয়েছি।
— তুই একজন ডেডিকেটেড ওয়ার্কার। চিন্তা করিস না, একটা কিছু হয়ে যাবে।
— এক সময় আমিও ওরকম ভাবতাম। অফিসের কাজের ব্যাপারে আমেরিকানরা খুব স্ট্রিক্ট। কোনো রকমের ইমোশন দেখায় না।
— ফায়ার করার ব্যাপারে স্ট্রিক্ট না হলে কোম্পানি বাঁচতে পারবে না। কেন বলছিস এই কথা?
— অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। তোকে একটা ঘটনা বলি। একদিন অফিস শেষে ঘরে ফিরব, এমন সময় বাইরে ভীষণ কালো মেঘ করল। ওয়েদার রিপোর্ট বলছে ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি হবে। সবাই বাড়িতে চলে যাচ্ছে। আমিও ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি, এমন সময় বস এসে বলল, একটা কাজ শেষ করা তার খুব দরকার। তবে আগামীকাল হলেও চলবে। বসের বলার আগ্রহ দেখে ঘরে না ফিরে কাজটা যখন শেষ করলাম। যখন গাড়িতে যাব, ততক্ষণে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে। গাড়ি পর্যন্ত যেতে যেতে ভিজে সপসপে হয়ে গেলাম। কিন্তু তবু খুব ভাল লাগছিল যে চাওয়া মাত্র বসকে কাজটা দিতে পেরেছি।
একটু থামল নাদিম। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, সেই বস আমাকে কোনো আভাষ না দিয়ে একদিন বিকেলে ফায়ার করে দিল। আমেরিকানদের এই রকম রুক্ষ ব্যবহার মোটেই বুঝতে পারি না। মনে হয় না আমেরিকানদের হৃদয় বলে কিছু আছে।
অকসয় বলল, অফিসে বিষয়গুলো এত ইমোশনালি নিস না। তিন মাসের বেতন দিয়েছে না? তোকে পছন্দ না করলে এরকম ভাল ব্যবহার দেখাত না।
— ওহ, তাই তো। বলল নাদিম। মনে হচ্ছে এসব আলাপ করতে সে আগ্রহ পাচ্ছে না। ফোন রেখে দিল অকসয়। ভাবল এই সময় নাদিমের সাথে ওর বাবা-মা থাকলে অনেক মানসিক সাপোর্ট পেত। এই সময় নাদিমের পাশে আপন মানুষের থাকা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। অকসয় ঠিক করল সে নিজেই মাঝে মাঝে নাদিমের খবর রাখবে।
একদিন একটা চিঠি এলো। নিউ ইয়র্কের পোষ্ট মার্ক। ভিতরে হাতে লেখা একটা নোট। খুব সুন্দর মেয়েলি হাতের লেখা। পড়তে শুরু করল নাদিম।
“হাই,
আমি জানি মেরিল্যান্ড থেকে ড্রাইভ করে নিউ ইয়র্ক আসতে অনেক ঝামেলা, অনেক সময় দিতে হয়। এই জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। একটা পজিটিভ সিদ্ধান্তে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু অনেকগুলো কারণে পারিনি। অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে, এখন একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় না। তোমার জীবন সুন্দর হোক এই কামনা করছি। অজস্র ধন্যবাদ।“
নাম-ঠিকানা কিছু নেই, তবু বুঝতে পারল সোফিয়ার চিঠি। কয়েকবার পড়ল নাদিম। পড়ে পড়ে অনেক শান্তি পেলো। একটা ভদ্র মেয়ে, মোটেই নির্লিপ্ত ব্যবহার করেনি। তার মতো করে জবাব দিয়েছে। অনেক সময় নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। এতে দোষের কিছু নেই।
আমেরিকাতে বাঙালি বাবা-মা বাড়িতে ছেলেমেয়ের সামনে প্রায়ই ঝগড়া করে, উচ্চ স্বরে তর্ক করে। আমেরিকার বড় হওয়া মেয়েরা মনে করে বাংলাদেশের ছেলেরা তার বাবা’র মতই হবে। স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করবে, স্ত্রী উপর খবরদারী করবে, সব ব্যাপারে ডমিনেট করতে চেষ্টা করবে। এরকম চিন্তা ভাবনা থেকেও অনেক মেয়ে বাংলাদেশি ছেলে বিয়ে করতে রাজি হয় না। সিদ্ধান্ত না নিতে পারার হাজারটা কারণ থাকতে পারে। বুঝতে পারল সোফিয়ার উপর ভীষণ রাগ করেছিল নাদিম, এই চিঠি পেয়ে সব রাগ চলে গেছে।
এক শুক্রবার জুম্মা পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসছিল নাদিম, দুবার হর্ন দিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল একটা নীল হোন্ডা সিভিক। নামাজ শেষে গেটে গাড়ির লাইন হয়ে যায়, দাঁড়ানোর সময় থাকে না, জানালার কাঁচ নামিয়ে একটা মেয়ে বলল, নাদিম, গাড়িতে উঠো।
তাকিয়ে দেখল সায়রা বানু। দরজা খুলে প্যাসেঞ্জার সিটে উঠল নাদিম। জিজ্ঞেস করল, কেমন আছো?
— আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো। হেঁটে হেঁটে কোথায় যাচ্ছ?
— উবার নিয়ে নামাজে এসেছি। হাসি মুখে বলল নাদিম। খুব কষ্ট পেলো সায়রা বানু। একদম প্রাণহীন হাসি। এই নাদিমকে চেনে না সায়রা বানু। চাকরি না পেয়ে অনেক বদলে গেছে নাদিম। আগেও মন খারাপ থাকত। কিন্তু তবুও প্রাণ চঞ্চল ছিল। মাঝে মাঝে প্রাণ খুলে হাসত। ভার্জিনিয়ার অনুষ্ঠান খুব এঞ্জয় করেছিল।
— আমি রাইড দিচ্ছি। বলল সায়রা বানু। এপার্টমেন্টের সামনে পার্ক করে নাদিমের গাড়ি দেখতে পেলো না। প্রশ্ন করল না গাড়ি কোথায়?
— রাইডের জন্য অনেক ধন্যবাদ। গাড়ি থেকে নেমে হাসি মুখে বলল নাদিম। সায়রা বানু খেয়াল করল, ওকে বসতে বলছে না নাদিম।
স্টার্ট বন্ধ করে বাইরে এলো সায়রা বানু। বলল, কিছুক্ষণ গল্প করব।
— এসো, ভিতরে এসো। হাসি মুখে আমন্ত্রণ জানালো নাদিম। নাদিমের সাথে এপার্টমেন্টে ঢুকল সায়রা বানু। নিজে চোখকে বিশ্বাস করতে পাড়ল না। ঘর ফাঁকা, আসবাব পত্র বলতে কিছু নেই। সোফা, ডাইনিং টেবিল, টেলিভিশন, কিচ্ছু নেই। সায়রা বানু যে বসবে, সে অবস্থাও নেই। শুধু নাদিমের পড়ার টেবিল এবং চেয়ারটা ছাড়া বসার ঘরে এবং কিচেনে আর কিছু নেই।
বেডরুমে ঢুকল সায়রা বানু। বিছানা ছাড়া আর কিছু নেই। দেয়ালের পোস্টারগুলো নেই। কিচেনে ফ্রিজ খুলল। ফ্রিজার সেকশনে খাবার ঠাসা। সায়রা বানু যেভাবে দিয়ে গিয়েছিল সেভাবেই আছে। ছুঁয়ে দেখেনি। শুধু রেফ্রিজারেটর সেকশনের খাবার শেষ করেছে। কিচেন দেখে মনে হয় রান্না-বান্না করে না।
আবার বসার ঘরে ফিরে এলো সায়রা বানু। নাদিমকে জিজ্ঞেস করল, তোমার গাড়ি কোথায়?
— বিক্রি করে দিয়েছি।
— কতদিন আগে?
— দুই সপ্তাহের মতো হবে।
আর কোনো প্রশ্ন করল না সায়রা বানু।
চেয়ার এগিয়ে দিয়ে নাদিম বলল, বসো না?
নাদিমের দিকে তাকাল সায়রা বানু। এত ডিপ্রেশনে চলে গেছে যে সায়রা বানুর কল্পনার বাইরে ছিল। চেয়ারের দিকে না তাকিয়ে মেঝেতে বসল সায়রা বানু। হাসতে ভুলে গেছে নাদিম। যে ছেলেটা জ্যোৎস্না দেখে ঘুমিয়ে পড়ত, আজ সে গভীর অন্ধকারে ডুবে আছে। দুই সপ্তাহ গাড়ি ছাড়া চলছে, অথচ সায়রা বানুকে বলেনি। কোনো অভিযোগ করল না সায়রা বানু। হাত ব্যাগটা পাশে রেখে দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকল।
কিছু বলল না নাদিম। অনেকক্ষণ পর বাথরুম যেয়ে চোখ মুখ ধুয়ে এলো সায়রা বানু। নাদিম বলল, তুমি শুধু শুধু মন খারাপ করছ। সব ঠিক হয়ে যাবে।
জবাব দিল না সায়রা বানু। বুঝতে পারছে মুখে বলছে, “সব ঠিক হয়ে যাবে”, কিন্তু কথাটা নাদিম নিজেও বিশ্বাস করে না। উঠল সায়রা বানু। বলল, নূতন একটা কাজ পেয়েছি। এখন যেতে হবে। আমাকে না বলে কিছু করো না, প্লিজ। আমি আবার আসব। চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল সায়রা বানু।
এরপর থেকে আরো বেশি যোগাযোগ রাখল সায়রা বানু। নিজে থেকে নাদিমকে ফোন করতে থাকল।
শত হতাশার মধ্যেও মিশেল ময়নিহান নিয়ম ধরে যোগাযোগ রাখল। একদিন পরপর দুবার ইমেইল করল মিশেল, কিন্তু ইমেইল পড়েও জবাব দিল না নাদিম। এরকম অনেক চেষ্টা করেছে, ফলাফল শূন্য। ইমেইলের জবাব না দেয়াতে সরাসরি ফোন করল মিশেল। ভদ্রতা করে সাথে সাথে ফোন ধরল নাদিম।
— হ্যালো, মিশেল।
— শুনো, মন খারাপ করে শুয়ে থাকলে কোনো লাভ নেই। এমন করে বলল মিশেল যেন নাদিম কী করে সব দেখতে পাচ্ছে। তোমাকে একটা কভার লেটার লিখে দিয়েছি। এটা সহ তোমার রেজুমে একজনকে কাছে পাঠাতে হবে। খুব ভালো করে পড়াশোনা করে ইন্টার্ভিউ দেবে। আমাকে লজ্জায় ফেলবে না। প্রমিজ?
এরপর চুপ থাকে কী করে? নাদিম বলল, প্রমিজ।
রেজুমে পাঠানোর দুদিন পর ইন্টার্ভিউ পেলো নাদিম। ফ্লোরিডার কিসেমি নামে শহরে অফিস। পাশেই ডিজনি, ইউনিভার্সাল স্টুডিও নামের থিম পার্ক আছে। ছোটখাটো একটি আইটি সাপোর্ট কোম্পানির মালিক ভদ্রলোক।
মিশেলের থেকে উৎসাহ ধার নিয়ে শেষ বারের মতো একটা চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলো নাদিম। রেজুমে পাঠিয়ে দিয়ে মন দিয়ে পড়তে বসল। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থকে আজ পর্যন্ত যত কিছু পড়েছে সব একবার করে ঝালাই দিল।
ঝাড়া এক ঘণ্টা ধরে নানা রকমের প্রশ্ন করল ভদ্রলোক। নাদিমের সম্পর্কে এমন কিছু নেই জানতে চাইল না। তারপর বলল, তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগল। আমাদের কোম্পানিটা ছোট। অল্প বেতনের একটা ইয়াং ছেলে খুঁজছিলাম। দুই সপ্তাহ পর কাজে যোগ দিতে পারবে?
পারব। এক নিঃশ্বাসে বলল, নাদিম। লোকটা বলল, ফ্লোরিডা মুভ করার জন্য তোমাকে পাঁচ হাজার ডলার সাইনিং বোনাস দেব।
— থ্যাংক ইউ। বলল নাদিম। অফিশিয়াল কথা শেষ করার জন্য প্রশ্ন করল, আর কোনো প্রশ্ন আছে?
নাদিম বলল, না। আমার কোন প্রশ্ন নেই। এখন থেকে ফ্লোরিডা আসার সব প্রস্তুতি নেব।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এক সময় লোকটা বলল, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
— অবশ্যই। কী প্রশ্ন?
— তুমি মিশেলকে কী করে চেন? ওর ছোট ছেলের ক্লাস মেট ছিলে?
— না। আমি মিশেলকে চিনতাম না। রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে তার সাথে পরিচয় হয়েছে। কোনো কারণে মিশলে আমাকে খুব স্নেহ করে, চাকরি জন্য অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
— ওহ, আচ্ছা। কভার লেটার কী মিশেল লিখে দিয়েছে?
— হ্যাঁ। কভার লেটার, রেজুমে মিশেল লিখে দিয়েছে।
— আমারও তাই মনে হয়েছে। আমি মিশেলের লেখার স্টাইল চিনি। কলেজে মিশেল আমার সুইট হার্ট ছিল। আমাদের বিয়ে হাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি তখন একটু বাউন্ডেলে হয়ে গিয়েছিলাম। অনেক চেষ্টা করে মিশেল হাল ছেড়ে দিয়েছিল। আমি যখন ফিরে এসেছিলাম, ততক্ষণে মিশেল এঙ্গেজড হয়ে গেছে। আমার সাথে গত দশ বছর মিশেলের যোগাযোগ নেই। আমি ভেবেছিলাম, মিশেল আমাকে কোনদিন ক্ষমা করবে না। কিন্তু কভার লেটারটা পড়ে বুঝতে পেরেছি, সে শুধু আমাকে ক্ষমা করেনি, এখনো তার মনের এক কোনে আমার জায়গা আছে। চিঠিটা আমি অনেক বার পড়েছি। অনেকদিন পর নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি। নাদিম, তুমি আমার জীবনে একটা আশীর্বাদ হয়ে এসেছ। তোমাকে না করার শক্তি আমার নেই। মন দিয়ে কাজ করো যেন, কাজ নিয়ে কথা না হয়। আর আমি যে এত কথা বলছি, কখনো কাউকে বলো না। কেমন?
— আচ্ছা। বলল নাদিম।
ফোন রেখে দিল ভদ্রলোক। দুজন অপরিচিত আমেরিকানের ভালোবাসা পেয়ে চোখে পানি এসে গেল। অনেকক্ষণ কাঁদল নাদিম। আজ সবাইকে ক্ষমা করল। বাবা-মা, ভাই-বোন, খালাম্মা, সোফিয়া, কারো উপর রাগ ধরে রাখল না।
বাড়িতে ফোন করে আম্মাকে খবরটা দিল নাদিম। অনেকদিন পর বাড়িতে অসময়ে ঈদের খুশি এলো। সব শেষে সায়রা বানুকে বলল, রাতে ফ্রি আছো?
— আগে বলো কেন?
— একটা খুশির খবর আছে? দেখা হলে বলব।
— না। এখন বলো।
— মোটেই না। দেখা হলে বলব।
— সন্ধ্যায় কাজ ছিল, কিন্তু ওদের না করে দেব। কোথায় দেখা করব?
— তুমি বলো।
একটা রাজস্থানি রেস্টুরেন্টের নাম বলল সায়রা বানু।
— দেখা হবে। ফোন রেখে দিল নাদিম।
উবার নিয়ে রেস্টুরেন্টে পৌঁছল নাদিম। পারকিং এ সায়রা বানুর নীল রঙের হোন্ডা চিনতে পারল।
ভিতরে যেতেই রিসেপশনের মেয়েটা একটা টেবিলে নিয়ে গেল। বসে আছে সায়রা বানু। রঙ্গিন ঘাগরা-চোলি-ওড়না পরে সত্যিকারে একজন রাজস্থানি রাজকুমারী সেজেছে। ভার্জিনিয়া যাওয়ার দিনের চেয়ে অনেক বেশি অলঙ্কার পরেছে। আজ চোখে কাজল দিয়েছে।
কিছু বলার সুযোগ পেলো না সায়রা বানু। চেয়ারে না বসেই নাদিম বলল, জানো, আমার চাকরি হয়েছে।
নাদিমের মুখে হাসি। চোখে পানি এসে গেল সায়রা বানুর। ওড়না দিয়ে চোখ মুছে বলল, আলহামদুলিল্লাহ্। এমনটাই ধারণা করেছিলাম।
— কাঁদছ কেন? এ তো খুশির কথা। বলল নাদিম।
— তোমার এই হাসিটা আমি কোনোদিন দেখিনি। আজ সূর্যের মত জ্বলজ্বল করছ। বসো।
বসল নাদিম। কিছুক্ষণ লাগল দুজনের স্থির হতে।
— কোথায় চাকরি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল সায়রা বানু।
— ফ্লোরিডা। দু সপ্তাহের মধ্যে চলে যেতে হবে।
— দেখ, চোখে কাজল দিয়েছি। তুমি বলেছিলে না, কাজল দিলে আমাকে অন্য ভুবনের কেউ মনে হয়?
— খেয়াল করেছি। সত্যি তুমি অন্য ভুবনের কেউ।
— একা একা ফ্লোরিডা চলে যাবে? মলিন মুখে প্রশ্ন করল সায়রা বানু।
প্রশ্নটা শুনে নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারল না নাদিম। মৃদু স্বরে বলল, তুমি যাবে আমার সাথে?
কিন্তু নাদিম কী বলের শোনার মতো অবস্থায় ছিল না সায়রা বানু। নাদিম কি বলেছে খেয়াল করল না। বলতে থাকল, আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া কোনো ছেলেকে চিনি না। আমি একা একা থাকতে পারব না।
অবাক চোখে একটা নিষ্পাপ মেয়ের ভালোবাসা দেখতে থাকল নাদিম। আবার বলল, ট্রাভেলিং প্রিন্সেস, যাবে তুমি আমার সাথে?
এবার ফিক করে হেসে ফেলল সায়রা বানু। বলল, যাবো। কিন্তু হাজব্যান্ড-ওয়াইফ হিসাবে। দুদিন পর আবার ভিসার কথা ভেবে মন খারাপ করবে তুমি। তোমার আজকের হাসিটা সারা জীবন দেখতে চাই।
— তোমার কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার পাশে বসো। সত্যি? যাবে আমার সাথে?
একটু দ্বিধা করল সায়রা বানু। তারপর উঠে এসে নাদিমের পাশের চেয়ারে বসল। বলল, আগে কানে কানে বলো, আমাকে অনেক ভালোবাসো। সারা জীবন ভালোবাসবে। শুধু তাহলেই যাবো।
(সমাপ্ত)
লেখক – হাসান মাশরিকী,