নিভৃত পূর্ণিমা পর্ব-০৮

0
439

নিভৃত পূর্ণিমা – ৮
মুখোমুখি একবার এবং কয়েকবার জুম ইন্টার্ভিউ দিয়েও চাকরি না পেয়ে দমে গেল না নাদিম। অকসয় কুমার, রঘু রেড্ডি, মিশেলকে ধন্যবাদ জানিয়ে, কেন চাকরি হচ্ছে না তার সম্পর্কে কয়েক লাইন লিখে, আরো ইন্টার্ভিউ যোগার করার জন্য অনুরোধ করল। সবাই সাথে সাথে জবাব দিল। ওদের বক্তব্য, রাতারাতি কিছু হয় না। চাকরি পেতে তিন-চার মাস লেগে যাওয়া কোনো ব্যাপার না।
নূতন উদ্যমে, মনের সমস্ত শক্তি জড়ো করে চেষ্টা করতে থাকল। ওদের স্কুলের এবং যারা লাবক থেকে পাশ করেছিল তাদের একটা ইন্সটগ্রাম গ্রুপ আছে। সে গ্রুপের বন্ধুদের সাথে নূতন করে যোগাযোগ করে চাকরির ব্যাপারে খোঁজ খবর দিতে বলল। কিন্তু তারপরও হাতে অনেক সময় থাকে, জীবন একঘেয়ে মনে হয়। ভাগ্য ভালো যে সায়রা বানুর সাথে পরিচয় হয়েছিল। একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারছে।
ড্রাইভিং শেখানো যত সহজ ভেবেছিল, তত সহজ না। অনেক সময় দিতে হয়। অনেক দুশ্চিন্তা মাথায় থাকে। একটু এদিক সেদিক হলে এক্সিডেন্ট হতে পারে। এক্সিডেন্ট হলে যে শুধু গাড়ির ক্ষতি হবে তা না, শারীরিক আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাবধানতা থেকে “এটা করো না”, “সেটা করো না”, এই রকম নির্দেশনা দিতে হয়। এতে যে শিখছে সে কদিনেই বিরক্ত হয়ে উঠতে পারে। সায়রা বানুকে এই কথাটা সবার আগে বুঝিয়ে বলল, যেন সে বিরক্ত না হয়।
কোন সপ্তাহে কি শেখাবে তার একটা পরিকল্পনা করল নাদিম। মেরিল্যান্ডে প্যারালাল পারকিং এর পরীক্ষা নেয়া হয় না। কাজেই এটা এখন না শিখলেও চলবে।
এলিকট সিটির এপার্টমেন্ট থেকে রিগাল সিনেমার পারকিং এ যেতে একটু সময় নেয়, কিন্তু জায়গাটা সায়রা বানুর মতো ড্রাইভারের জন্য আদর্শ। বিশাল পারকিং এর সব জায়গায় দাগ দেয়া আছে। এক লাইনে থেকে চালাতে সুবিধা হয়। লেইন চেঞ্জ করা শেখা যায়। পারকিং এর চারিদিকে রাস্তা আছে। স্টপ সাইন এবং স্টপ সাইনে কোথায় দাঁড়াতে হবে সে দাগ দেয়া আছে। এগুলো পরীক্ষায় পাশ করার জন্য বিশেষ প্রয়োজন।
অনেকে আশেপাশের হাই স্কুলের পারকিং এ ড্রাইভিং শেখে। তিনটার মধ্যে হাই স্কুল ছুটি হয়ে গেলে তারপর লোকজন স্কুলের পারকিং এ ছেলেমেয়েদের ড্রাইভিং শেখায়। বাড়ির কাছের একটা হাই স্কুলে কয়েকবার গিয়েছিল নাদিম। প্রায়ই দেখা যায় আরো একজন বা দুজন ড্রাইভিং শিখছে। স্কুলের পারকিং খুব বেশি বড় হয় না, আরেকজন কী করছে সে দিকে খেয়াল করতে হয়। সায়রা বানু ভয় পেয়ে যায়। বলে, চলো, রিগাল এর পারকিং যাই।
সেই থেকে রিগাল পারকিং এ ড্রাইভিং শেখায়।
একদিন পারকিং লটে গাড়ি চালাচ্ছিল, হঠাৎ মুশলধারে বৃষ্টি শুরু হলো, সাথে প্রচণ্ড বজ্রপাত। আগে থেকে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছিল কিন্তু এত দ্রুত ঝড় শুরু হবে বুঝতে পারেনি। কাঁচের উপর যেন পানির প্রপাত বয়ে যাচ্ছে। দুই হাত সামনে কিছু দেখা যায় না। সায়রা বানু ভয় পেয়ে গেল। বলল, এখন কী করব? তুমি ড্রাইভিং সিটে আসবে? ইস! এত ঝড় আসছে, একটু খেয়াল করলাম না?
— কিছু হবে না। বজ্রপাতের সময় গাড়ি একটা সেফ জায়গা। ভালোই হলো ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। এমন সময় কীভাবে চালাতে হয় প্রাকটিস হয়ে যাক। বৃষ্টিতে গাড়ি চালানোর সময় হেডলাইট অন করতে হয়, ওয়াইপার চালিয়ে দিতে হয়। সামনে এবং পিছনে ফুল স্পিডে ওয়াইপার দাও।
ফুল স্পিডে ওয়াইপার চালিয়ে, হেড লাইট অন করে সায়রা বানু বলল, দিয়েছি।
— এবার ইমারজেন্সি লাইট দাও।
— দিয়েছি।
লেফট এবং রাইট টার্নের সিগনাল ব্লিঙ্ক করতে থাকল।
নাদিম বলল, এবার খুব ধীরে ধীরে চালাও। যখন দেখবে আর চালাতে পারছ না। তখন রাস্তার পাশে শোল্ডারে পার্ক করে বসে থাকো।
হেড লাইট, ইমারজেন্সি লাইট, ওয়াইপার চালু রেখে খুব ধীরে পারকিং এ এবং পাশের রাস্তায় ড্রাইভ করল সায়রা বানু। পানি জমে থাকা পথে খুব সাবধানে ব্রেক করা শিখল। একটু স্পিড দিয়ে আবার খুব সাবধানে ব্রেক করা প্র্যাকটিস করল। একটুতেই গাড়ি স্কিড করতে শুরু করে। কন্ট্রোল থাকে না।
ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ চালিয়ে এক জায়গার পার্ক করে বসে থাকল সায়রা বানু। বলল, ভালো একটা অভিজ্ঞতা হলো। অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এখনও ভয়ে আছে, কিন্তু নাদিম পাশে থাকায় প্রকাশ করেছে না। ঝড়ো বাতাসে বৃষ্টির ছাট এসে পাশের জানালায় ছিটকে পড়ছে।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থামলে নাদিম গাড়ি চালিয়ে ঘরে ফিরল।
সে রাতে নিউ ইয়র্কের খালাম্মা ফোন করল, কিছুক্ষণ আলাপ করে কাজের কথায় এলো। বলল, সোফিয়ার আম্মা তোমাকে, তোমার ফ্যামিলিকে খুব পছন্দ করেছে। সোফিয়া তোমার সম্পর্কে ভালো ছাড়া মন্দ কিছু বলেনি। ওর আম্মা তোমাকে সোফিয়ার মোবাইল ফোন নাম্বারটা দিতে বলেছে। উনি মনে করেন, সোফিয়া একটু দ্বিধায় আছে। তুমি ফোন করলে সম্পর্কটা আগাবে।
খালাম্মার কথায় নাদিম একটু অবাক হলো, এভাবে ফোন নাম্বার দেবে মোটেই আশা করেনি। বলল, খালাম্মা, আমার ফোন করা ঠিক হবে না। তাছাড়া আমার ইচ্ছে হচ্ছে না। দেখা করতে যাওয়াটাই ভালো কাজ হয়নি।
খালাম্মা বুঝতে পারলেন নাদিম কিছুটা রেগে আছে। তবু বলল, ফোন না হয় না করলে। কিন্তু নাম্বারটা রাখতে তো কোনো ক্ষতি নেই।
নাদিমকে সোফিয়ার নাম্বার টেক্সট করে দিল খালাম্মা।
পরের কয়েক দিন পারকিং লটে ভালো করে চালানো শিখে সায়রা বানু বলল, এইবার রাস্তায় চালাই?
— আরো পরে। কয়েকদিন পারকিং এবং এর আশেপাশে রাস্তায় চালাও।
— পারব তো, রাস্তায় অসুবিধা হবে না। দাও না? অনেক অনুরোধ করে বলল সায়রা বানু।
— আমিও চাই তুমি রাস্তায় চালাও, কিন্তু আর একটু প্র্যাকটিস হোক।
মন খারাপ করে পারকিং এর মধ্যে গাড়ি চালাতে থাকল সায়রা বানু। এক ঘেয়ে কাজ। সোজা চালানো, স্টপ সাইনে থামা, তারপর টার্ন নিয়ে ঘুরে আসা।
সায়রা বানুর অস্থিরতার কারণ বুঝতে পারে নাদিম। এভাবে বেশিক্ষণ পারকিং প্র্যাকটিস করতে ইচ্ছে করে না। বিরক্ত লাগতে শুরু করে। মনে হয় আর সবার মতো কখন রাস্তায় চালাব। এই সময়টাতে যে শেখায় তার সাথে যে শেখে তার মনোমালিন্য শুরু হয়।
নাদিম যখন লাবক ছিল, তখন এক সিনিয়র ভাই তার স্ত্রীকে ড্রাইভিং শেখাচ্ছিল। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। ভাবি বলত, জানো নাদিম, কোনো মেয়ের তার হাজব্যান্ডের কাছে ড্রাইভিং শেখা উচিত না।
জবাবে ভাইয়া বলত, ভাতের থালা হাতে নিয়ে, স্টিয়ারিং হুইল মনে করে, ঘরে টার্ন নেয়া প্র্যাকটিস করো। এতে যদি রাস্তায় চালানো সহজ হয়।
এই কথা শুনে ভাবি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠত।
সায়রা বানুর মন খারাপ দেখে পরদিন নাদিম বলল, ঠিক আছে, আজ রাস্তায় চালাব। আগে আমি দেখিয়ে দিচ্ছি কোন পথে কতদূর যাবে।
সাথে সাথে খুশিতে হেসে উঠল সায়রা বানু।
কাছেই একটা আবাসিক এলাকার কোথায় চালাতে হবে দেখিয়ে দিল নাদিম। পারকিং থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠে ভয় পেতে শুরু করল সায়রা বানু। পাশে গাড়ি চলতে থাকায় নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে।
ট্র্যাফিক সিগনাল গ্রিন হবার পর আগাতে কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে পিছনের ড্রাইভার হর্ন দেয়। আমেরিকাতে গাড়ি চালানর সময় সাধারণত হর্ন দেয় না। কাউকে হর্ন দেয়া মানে সে ভুল করছে, অথবা অন্য ড্রাইভারদের অসুবিধার সৃষ্টি করছে।
পিছন থেকে হর্ন দিলে সায়রা বানু আরো ভয় পেয়ে যায়। তখন কী করতে হবে নাদিমকে বলে দিতে হয়। প্রায়ই দেখা যায় নাদিম বলছে, “স্টপ সাইন আসছে, থামো”, “সামনে রেড লাইট হচ্ছে, থামো”, “তুমি গ্রিন লাইট পাচ্ছ, না থেমে চলে যাও।“
এরকম বলতে থাকলে যে চালাচ্ছে সে অনেক সময় বিরক্ত হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সায়রা বানু বিরক্ত হচ্ছে না। এভাবে কয়েকবার রাস্তায় প্র্যাকটিস করল সায়রা বানু। নাদিম সারাক্ষণ ভয়ে থাকে, কোনো গাড়ির সাথে যদি লেগে যায়? কিন্তু সায়রা বানু এখন বেশি বেশি রাস্তায় চালাতে চায়।
নাদিম বলল, রাস্তায় চালাতে হলে শনি এবং রবিবার সকাল বেলা আবাসিক এলাকায় চালাতে হবে। ওই সময় রাস্তায় গাড়ি কম থাকে।
সে ভাবেই শনি-রবি সকালে রাস্তায় চালিয়ে তারপর একদিন বড় রাস্তায় উঠল। এরপর যখন মনে হলো ভালো পারছে, তখন বাল্টিমোর পাইকে কয়েক দিন ইচ্ছে মতো ড্রাইভ করল।
চালানো শিখতেই গ্রেগ’স স্কুলে প্রথম লেসনের এপয়েন্টমেন্ট করল। সকালে গ্রেগ’স স্কুলে নামিয়ে দিল নাদিম। এক মহিলা ইন্সটাক্টর এলো। সায়রা বানুকে ড্রাইভারের সিটে বসিয়ে গাড়ি নিয়ে বাল্টিমর পাইকে উঠে, গাড়ির ভিড়ে কোথায় হারিয়ে গেল।
আজকে রাস্তায় কিছুক্ষণ চালাবে, তারপর পারকিং এ যেয়ে ফ্রন্ট পারকিং, ব্যাক পারকিং শেখাবে। দুই ঘণ্টা পরে ফিরে আসবে।
এই দুই ঘণ্টা কী করবে বুঝতে পাড়ল না নাদিম। বাসায় যেতে কুড়ি মিনিট লাগবে, ফিরতে আরো কুড়ি মিনিট। তারচেয়ে বার্গার কিং এ বসে বসে ল্যাপটপে কাজ করলে ভাল হবে। দুই ঘণ্টা পর পারকিং এ গাড়ি ঢুকল। সায়রা বানু চালাচ্ছে, পাশে আফ্রিকান আমেরিকান ইনস্ট্রাক্টর মহিলা। সায়রা বানু চালাচ্ছে, গাড়ি অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছে, দেখে নাদিমের খুব ভালো লাগল। যে মেয়েটা কোনোদিন গাড়ি চালায়নি, সে একজন আমেরিকান প্রশিক্ষককে পাশে বসিয়ে দুই ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ফিরে এসেছে। এই ভালো লাগা অন্য রকম, প্রজাপতির মতো আপনা থেকে মনে এসে বসে।
ল্যাপটপ বন্ধ করে বাইরে এলো নাদিম। গ্রেগ’স স্কুলের দরজার পাশে এসে দাঁড়াল। গাড়ি পার্ক করে অফিসের কাছে ফিরে এলো ইন্সট্রাকটর। সায়রা বানু নিজেও খুব খুশি। হাসি মুখে মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
— কেমন হলো ইন-পারসন ট্রেনিং? মহিলাকে জিজ্ঞেস করল নাদিম।
— খুব ভালো। মেয়েটা ভালো গাড়ি চালায়। হাসি মুখে বলল মহিলা।
পর মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেল। কিন্তু হাসি মুখে বলতে থাকল, আমরা শুধু বেসিক স্কিল চেক করি, গাইড করি। ড্রাইভিং শেখাই না। ওকে ইচ্ছে মতো গাড়ি চালাতে দিবে। তুমি যদি পিছু টেনে ধরো, তাহলে মেয়েটা ভালো করে ড্রাইভিং শিখতে পারবে না। ওকে সাহস দিতে হবে, বেশি বেশি চালাতে দিতে হবে। ফেরার সময় হোম ডিপো থেকে অরেঞ্জ কোন কিনে নিয়ে যেও। পারকিং লটে কোন রেখে ফ্রন্ট পারকিং, ব্যাক পারকিং শেখাবে।
ঝাড়া দুই মিনিট নাদিমকে বকা দিল মহিলা। কিন্তু হাসি মুখে এমন করে কথাগুলো বলল যে কমপ্লেইন করার উপায় নেই। থতমত খেয়ে গেল নাদিম। সাধারণত আমেরিকানরা কাস্টমারকে এভাবে কথা বলে না। কিন্তু কী হয়েছে বুঝতে পাড়ল নাদিম। সায়রা বানুকে দেখলে ইনোসেন্ট একটা মেয়ে মনে হয়, আদর দিতে ইচ্ছে করে। সায়রা বানুকে মহিলার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। মহিলা ভেবেছে সায়রা বানু নাদিমের ওয়াইফ। নাদিম একজন ডমিন্যান্ট হাজব্যান্ড, সায়রা বানুকে সারাক্ষণ কন্ট্রোল করছে। মুসলিম পুরুষদের সম্পর্কে আমেরিকানদের ধারণা এমনই। এর জন্য সমস্ত ধন্যবাদ আরবদের এবং তালেবানদের প্রাপ্য।
মহিলাকে থ্যাংক ইউ দিয়ে গাড়িতে এলো নাদিম। রাস্তার ওপাশে হোম ডিপো। কমলা রঙের চারটা ট্রাফিক কোন কিনল। এগুলো দিয়ে ব্যাক পারকিং প্র্যাকটিস করতে হয়। কয়েকজনকে দেখেছে, কিন্তু লাগবে না ভেবে এত দিন কেনেনি নাদিম।
সায়রা বানু বলল, আমি কিন্তু মহিলাকে কিছু বলিনি।
বকা খেয়ে নাদিম চুপ হয়ে আছে দেখে বলে ফেলল সায়রা বানু।
— মহিলা কেন বলেছে আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু নূতন নূতন গাড়ি চালানো সহজ না। একটা এক্সিডেন্ট হলে অনেক ঝামেলা হবে। শরীরে ব্যথা পেলে তো কথাই নেই। আমরা আমাদের মতো করে শিখব। তাড়াহুড়ার দরকার নেই।
শনি এবং রবিবার সকালে এবং সন্ধ্যায় অনেক করে প্র্যাকটিস করল সায়রা বানু। কিছুদিন বড় রাস্তায় ড্রাইভ করল, কিছুদিন ইন্টারস্টেট সেভেনটিতে চালিয়ে ফ্রেডারিক সিটিতে গেল। কিছুদিন রাতের বেলায় ড্রাইভ করল। এরপর গ্রেগ’স স্কুলের বাকি দুইটা ইন-পারসন ট্রেনিং শেষ করল। এখানে পাশ মার্ক পেলো। স্কুলে থেকে বলে দিল, এবার লাইসেন্স পরীক্ষা দিতে অসুবিধা নেই।
নাদিম বলল, লাইসেন্স পরীক্ষার এপয়েন্টমেন্ট নাও।
একদিন বিকেল একটার সময় ফ্রেডারিক কাউন্টির মোটর ভেহিকল অফিসে রোড টেস্টের এপয়েন্টমেন্ট পেলো সায়রা বানু। তার আগে জায়গাটা ভাল করে দেখে এলো দুজন। আশে পাশের রাস্তায় অনেকক্ষণ ড্রাইভ করল সায়রা বানু।
রোড টেস্টের দিন কয়েকটা ফর্মে নাদিমকে স্বাক্ষর দিতে হলো। সে নিজে সায়রা বানুকে ষাট ঘণ্টা ড্রাইভিং শিখিয়েছে, এই মর্মে একটি ফর্মে স্বাক্ষর দিতে হলো। নাদিমের গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ইনস্যুরেন্স এবং ইনস্যুরেন্সে সায়রা বানুর নাম দেখাতে হলো। নাদিমের লাইসেন্সের নাম্বার কপি করে রাখল। তারপর সায়রা বানুকে বলল, তুমি গাড়ি নিয়ে টেস্ট লেনে চলে যাও। নাদিমকে সায়রা বানুর পাশে প্যাসেঞ্জার সিটে বসে থাকতে বলল।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মোটর ভেহিকল অফিসের একজন পরীক্ষক এসে নাদিমের লাইসেন্স দেখল। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন এবং ইনস্যুরেন্স দেখল। তারপর নাদিমকে বলল, তুমি নেমে যাও। একটা বেঞ্চ দেখিয়ে বলল, ওখানে অপেক্ষা কর। টেস্ট শেষ হলে তোমার সাথে কথা বলব।
লাইসেন্স টেস্ট এর দুইটা ভাগ আছে। প্রথমে পারকিং এ ব্যাক পারকিং করে থ্রি পয়েন্ট টার্ন নেয়ার পরীক্ষা দিতে হয়। তারপর রাস্তায় চালাতে হয়। যেখান ব্যাক পারকিং পরীক্ষা হয় সে জায়গাটা বেঞ্চ থেকে দেখা যায়। অনেক অভিভাবক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা দেখছে।
সায়রা বানুকে লোকটা কোথায় যেয়ে কী করতে হবে বুঝিয়ে দিল। তারপর নিজে পারকিং এর জায়গায় যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যাক পার্ক করতে হয়। তারপর ব্যাক পার্ক থেকে বের হয়ে কয়েকটা স্টপ সাইনে থেমে লোকটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এখানে ঠিক মতো পাশ করলে রোড টেস্ট শুরু হবে।
সায়রা বানু কী করছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল নাদিম। ঠিক মতো ব্যাক করে পার্ক করল। কিন্তু পার্ক করা থেকে বের হওয়ার সময় অর্ধেক টার্ন নিতেই থামতে বলল লোকটা। সায়রা বানুকে কী যেন বলল। তারপর নাদিমকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। হেটে গাড়ির পাশে গেল নাদিম। লোকটা বলল, ব্যাক পার্ক ঠিক মতো হয়েছে, কিন্তু বের হবার সময় ওর পেছনের চাকা পারকিং এর কংক্রিট ব্লকের উপর উঠে গেছে। এরকম হলে অন দি স্পট ফেল। আজ আর টেস্ট হবে না।
কী হয়েছে দেখতে পেলো নাদিম। আরো সামান্য একটু এগিয়ে, তারপর টার্ন নিলে পিছনের চাকা কংক্রিটের উপর উঠে যেত না। পরীক্ষায় পাশ করতে পারত সায়রা বানু। বাম দিকে অনেক জায়গা ছিল, তবু নার্ভাস হয়ে দ্রুত ডান দিকে টার্ন নিতে যেয়ে এই ভুল করেছে।
নাদিম জিজ্ঞেস করল, এখন কী হবে?
লোকটা বলল, সায়রা বানু আর গাড়ি চালাতে পারবে না। এখান থেকে তোমাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আবার এপয়েন্টমেন্ট করো। মন খারাপ করার কিছু নেই, নূতন ড্রাইভারদের এমন অনেক হয়।
ড্রাইভারের দরজার পাশে এসে নাদিম বলল, আজ আর টেস্ট হবে না। দাও, আমি চালাই।
একটা কথা না বলে নেমে গেল সায়রা বানু। প্যাসেঞ্জার সিটে যেয়ে ওড়নায় মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকল। লোকটা নিশ্চয়ই বলেছে, সায়রা বানু থ্রি পয়েন্ট টার্ন নিতে যেয়ে ফেল করেছে।
নাদিম বুঝতে পারল আরো ভাল করে প্র্যাকটিস করা উচিত ছিল। এই কথাটাই গ্রেগ’স স্কুলের মহিলা বোঝাতে চেয়েছিল। অনেক প্র্যাকটিস করলে মাসল মেমোরি ডেভেলপ করে, তখন নার্ভাস থাকলেও অভ্যাস অনুযায়ী ঠিক মতো গাড়ি চালায় মানুষ।
যারা পারকিং লটে পাশ করে, তাদের নিয়ে রোড টেস্ট করতে রাস্তায় গাড়ি চালায়। একটা ছেলে রোড টেস্টের জন্য বের হচ্ছিল, ওর পিছনে পিছনে যেয়ে কোন রোডে যায়, সেটা দেখে নিল নাদিম। রাস্তাটা পরিচিত থাকলে রোড টেস্টে সুবিধা হবে। তা না হলে এখানেও আবার ফেল করার সম্ভাবনা বাড়বে।
বাড়ি ফিরতে শুরু করল নাদিম। ফ্রেডারিক থেকে এলিকট সিটি আসতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে। কিছুক্ষণ কথা বলল না নাদিম। সায়রা বানুকে সময় দিল। তারপর বলল, এরকম অনেক হয়। মন খারাপ করার কিছু নেই। আবার একটা এপয়েন্টমেন্ট করো, পরের বার পাশ করে যাবে। যে রাস্তায় টেস্ট হবে, এখন সেটা দেখে এলাম। এই রাস্তার সবগুলো টার্ন, সব স্টপ সাইন দেখে, এখানে এসে ড্রাইভ করলে রোড টেস্টে পাশ করা সহজ হবে।
কোথায়, কীভাবে যে ভুল হলো বুঝতেই পারলাম না। চোখ মুছতে মুছতে বলল সায়রা বানু। খুব মায়া লাগল নাদিমের। এই সময়টায় নিজেকে খুব অসহায় লাগে। মনে হয় আমাকে দিয়ে ড্রাইভিং হবে না।
— আর একটু সামনে এগিয়ে তারপর ডানে টার্ন নিলে পিছনের চাকা ফ্রি থাকত। এটাই ভুল হয়েছে। বলল নাদিম।
কিছু বলল না সায়রা বানু। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু আরেকজনকে এত দূর এনে, এভাবে ফেল করা ভীষণ লজ্জার এবং অনেক কষ্টের।
এলিকট সিটির কাছে ফিরতে সায়রা বানু বলল, হাওয়ার্ড কমিউনিটি কলেজে একটু যেতে পারো? ওখানে এডমিশন অফিসের সাথে কথা বলব।
কমিউনিটি কলেজের দরজায় নামিয়ে পারকিং এ বসে থাকল নাদিম। পঁচিশ তিরিশ মিনিট পর কয়েকটা বুকলেট এবং কয়েকটা ফোন নাম্বার নিয়ে ফিরে এলো সায়রা বানু। বলল, আমার অ্যাড্রেস দেখে জানাল, আমি এই কাউন্টির রেসিডেন্ট, তাই অনেক কম খরচে পড়তে পারব। কয়েকটা ইন্ডিয়ান মহিলা স্টুডেন্টদের নাম্বার দিল যাদের সাথে কথা বলতে পারি। ওদের কেউ কেউ মেয়ে রুম মেট চায়। হেঁটে হেঁটে কলেজে আসা যাবে।
একটু থেমে বলল, এখন শুধু লাইসেন্সটা পেলে হয়। কলেজের ল্যাবে স্টুডেন্ট হিসাবে কাজ করা যায়। বাইরে কোথাও কাজ নিতে হবে না।
চুপ করে থাকল নাদিম। বুঝতে পারছে একদিন সায়রা বানু বিদায় নেবে, সে সময়টা দ্রুত এগিয়ে আসছে।
বাড়িতে এসে আবার ড্রাইভিং টেস্টের এপয়েন্টমেন্ট নিল সায়রা বানু। এবার অনেক করে ব্যাক পারকিং, থ্রি পয়েন্ট টার্ন নেয়া প্র্যাকটিস করল। যে রাস্তায় রোড টেস্ট হবার সম্ভাবনা বেশি, সেই রোডের প্রতিটা স্টপ সাইন, টার্ন এবং লেনগুলো ভাল করে দেখল। অনেক বার করে ওই রাস্তায় ড্রাইভ করল সায়রা বানু।
তারপর পরীক্ষা দিতে গেল। এবার ঠিক মতো পাশ করল সায়রা বানু। একই দিনে মেরিল্যান্ডের ড্রাইভিং লাইসেন্স হাতে পেলো। লাইসেন্স হাতে পেয়ে খুশিতে মহিলার সামনেই কেঁদে ফেলল। মহিলা মৃদু হেসে তাকিয়ে রইল। এরকম কত রকম দৃশ্য তাকে দেখতে হয়। আমেরিকাতে সারা পৃথিবী থেকে লোকজন আসে, একেক জন একেক রকম অনুভূতি প্রকাশ করে।
নাদিম বলল, চলো, আজ লাইসেন্স পাওয়াটা সেলিব্রেট করি।
— কীভাবে? সায়রা বানুর মুখে এখনও হাসি লেগে আছে।
— আজ তোমাকে খাওয়াব।
গাড়ি থেকে ফোন করে একটা কাবাবের দোকানে ল্যাম্ব করাহি অর্ডার দিল নাদিম। এরা লাহোরের রেসিপিতে রান্না করে। বেশ ঝাল হয়। অনেকটা দেশের স্বাদ পাওয়া যায়।
করাহি, রাইতা, নান রুটি, সোডা এবং পানির বোতল নিয়ে সেন্টেনিয়াল পার্কের মাঠে এলো নাদিম। গাড়িতে ঘাসে বসার জন্য একটা ভারি চাদর থাকে। সেটা বসিয়ে পিকনিকের মতো করে খাবার সাজাল। আলাদা প্লেট, চামচ, ছোট বাটি ছিল, দুজনের খেতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
— তোমার সাথে দেখা না হলে ফ্রিডম কী জিনিস জানতেই পারতাম না। খেতে খেতে বলল সায়রা বানু।
— কী রকম?
— আমি যেখানে থাকতাম, সেখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অনেক ভালো। গাড়ি না হলেও চলে। একটু হাঁটলে বাস পাওয়া যায়। যেখানে খুশি যাওয়া যায়। কিন্তু এখানে গাড়ি ছাড়া কোথাও যাওয়া সম্ভব না।
— এর কারণ আছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ভালো হলে কম আয়ের লোকজন বেশি থাকে। ক্রাইম বেশি হয়। হাওয়ার্ড কাউন্টি মেরিল্যান্ডের সবচেয়ে ধনী এবং শিক্ষিত কাউন্টি। এখানে একটা পরিবারে চারটা বয়স্ক মানুষ থাকলে, বাড়িতে চারটা গাড়ি থাকে। ধনী না হলে এই কাউন্টিতে থাকার অনেক অসুবিধা। এই জন্য ক্রাইম কম, তুমি গাড়ির দরজা লক না করলেও কিছু চুরি হবে না। আমি যেখানে থাকি, সে এলাকায় বেশিরভাগ ফ্যামিলি শ্বেতাঙ্গ, চাইনিজ বা কোরিয়ান। অল্প কিছু সাউথ ইন্ডিয়ান থাকে। বেশিরভাগ সিঙ্গেল ইউনিট বাড়ি। প্রাইভেসি অনেক বেশি।
— সেটাই দেখলাম। এখানে প্রাইভেসি অনেক বেশি। আমি যেখানে থাকতাম, সেখানে একটা রাস্তায় লাইন দিয়ে সব পাকিস্তানিদের বাড়ি। বাড়ির সামনে পিছনে সবজির চাষ করে। বিকেলে কয়েকজন মহিলা লনে গল্প করতে বসে। কে আসে, কে যায় সব দেখতে পায়। কার ছেলেমেয়ে কী পরে, কী করে, এসব নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়। অথচ এখানে এক বছর তোমার সাথে থাকলেও কেউ খেয়াল করবে না আমি কে? তোমার সাথে আমার সম্পর্ক কী?
কিছুক্ষণ চুপচাপ খেতে থাকল দুজন। সায়রা বানু বলল, এই পার্কটা খুব সুন্দর। এত বড় পার্ক, অথচ ভিড় কত কম। মাঠের ঘাসে বসেও অনেক প্রাইভেসি থাকে।
এক সময় সায়রা বানু বলল, একটা গাড়ি কিনে দাও না?
এমন করে অনুরোধ করল, যেন নাদিমের পয়সায় গাড়ি কিনতে হবে। হেসে ফেলল নাদিম। জিজ্ঞেস করল, কী গাড়ি কিনতে চাও?
— হোন্ডা সিভিক। আমার খুব শখ চার দরজার ব্লু সিভিক চালাবো।
— কার ম্যাক্স থেকে দুতিন বছরের পুরানো, সারটিফাইড গাড়ি কিনলে সস্তায় ভালো গাড়ি পাবে।
— প্লিজ, কিনে দাও না? ক্যাশে কিনব। বলল সায়রা বানু।
ঘরে ফিরে নাদিম বুঝতে পাড়ল সায়রা বানু চলে যাচ্ছে। খুব ইচ্ছে হয় বলতে, সায়রা বানুকে তার ভালো লাগে। কিন্তু কিসের এক লজ্জা, দ্বিধা এসে বাধা দেয়। একটা মেয়ে বিপদে পড়ে কিছুদিন থেকেছে, তাকে এসব বলা উচিত না। তাকে তার মতো সিদ্ধান্ত নিতে দেয়া উচিত। না বলে থাকতে ভীষণ কষ্ট হয়।
প্রায় রাতেই আবোল তাবোল এমন অনেক কিছু ভাবে নাদিম। অনেক কিছু কল্পনা করে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে। আজ আম্মা ফোন করল। অনেকক্ষণ আলাপ করে মনের কথাটা বলতে ইচ্ছে হলো। তোমাকে একটা কথা বলি? জিজ্ঞেস করল নাদিম।
— এভাবে কথা বলছিস কেন? বল কী হয়েছে?
— একটা রাজস্থানি মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে। তুমি কী মনে কর?
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল নাদিমের আম্মা।
— কিছু বলছ না যে?
— একটা বয়সে সবকিছু সম্ভব মনে হয়, কিন্তু নিজের কালচারের বাইরে গেলে অনেক অসুবিধা আছে। মেয়েটা কেমন? কিছুটা বিরক্ত গলায় কথা বলছে আম্মা।
— আমার কাছে ভালো লাগে।
— আমি কিছু বলবো না। তোর ভালো তোকে বুঝতে হবে। আব্বুর কষ্টের কথা মনে রাখিস।
নানার কথা মনে করিয়ে দিল আম্মা।
— তুমি খুব একটা রাজি না? জিজ্ঞেস করল নাদিম।
— বললাম তো, তোর ভালো তোকে বুঝতে হবে। বাঙালি মেয়ে হলো ভালো হতো। নিউ ইয়র্কের মেয়েটার পরিবার তোকে খুব পছন্দ করে।
— ঠিক আছে কথাটা মনে রাখলাম। আর কিছু বলল না নাদিম।
কয়েকবার এলিকট সিটি কার ম্যাক্সে যেয়ে অনেক দেখে একটা ফোর ডোর ব্লু হোন্ডা সিভিক কিনল সায়রা বানু। এক সাথে ক্যাশ পেমেন্ট করাতে আরো কম দামে পেয়ে গেল। কার ম্যাক্স থেকে টেম্পোরারি ইনস্যুরেন্স দিয়েছিল। ঘরে এসে নাদিমের ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে ইনস্যুরেন্স কিনল সায়রা বানু। এক ছাদের নিচে থাকে, এ জন্য নাদিম কে দ্বিতীয় ড্রাইভার হিসাবে যোগ করল। ইচ্ছে করলে নাদিম সায়রা বানুর গাড়ি চালাতে পারবে।
এরপর সায়রা বানু সত্যি মুক্তির স্বাদ উপলব্ধি করতে শুরু করল। নাদিমকে পাশে বসিয়ে ইচ্ছে মতো গাড়ি চালায়। লং ড্রাইভে যায়। অনেক খুঁজে একজন ইন্ডিয়ান মেয়ের সাথে হাওয়ার্ড কাউন্টি কমিউনিটি কলেজের পাশে এপার্টমেন্ট ভাড়া নিল। দুই বেডরুমের এপার্টমেন্ট। যার যার এটাচড বাথরুম।
তারপর এলো সেই দিন। সায়রা বানু নাদিমকে বলল, আজ নূতন এপার্টমেন্টে উঠবো।
রাতে সুটকেস গুছিয়ে রেখেছিল, নাদিম সুটকেস, ব্যাগ গাড়িতে তুলে দিল। ড্রাইভারের সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল সায়রা বানু। কী ভেবে আবার বাইরে এলো। গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, এতগুলো দিন তোমার সাথে ছিলাম। চলে যাচ্ছি, কিছু বলবে না?
সায়রা বানু চলে যাচ্ছে, কেমন যেন দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছিল। সায়রা বানু প্রশ্ন করাতে সম্বিৎ ফিরে পেলো।
নাদিম বলল, তুমি যদি মনে না করো, একটা কথা বলতে পারি?
প্রশ্ন শুনে নিজের অজান্তেই লাল হয়ে হয়ে উঠল সায়রা বানু। যেন আঁচ করতে পারছে কী বলবে। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল। এখন দাঁড়াবার একটু শক্তি পেলো।
ভীষণ আগ্রহ নিয়ে নাদিম জিজ্ঞেস করল, প্রতিদিন ভোরে তুমি কোন সুরা পড়? কেন পড়?
অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল সায়রা বানু। নিজেকে সামলে নিল। এমন একটা প্রশ্ন মোটেই আশা করেনি। প্রশ্ন শুনে কেঁদে ফেলল সায়রা বানু। ওড়নায় মুখ ঢাকল। কিছুক্ষণ পর চোখ মুছে বলল, আম্মিজান ফ্যামিলি ভিসায় এদেশে এসেছিল। আমার বয়স কম ছিল, আম্মার সাথে আমিও ভিসা পেয়েছিলাম। আমেরিকা এসে আমি ক্লাস নাইনে ভর্তি হই। হাই স্কুল পাশ করার সাথে সাথে আমার বয়স আঠারো হয়। আম্মার সাথে সাথে আমিও সিটিজেন হওয়ার পরীক্ষায় পাশ করি। আম্মার সিটিজেন সার্টিফিকেট সাথে সাথে পেয়ে যায়। কিন্তু আমি মুসলিম এবং বয়েস কম দেখে ভিসা অফিসার বলল, তুমি ন্যাচারালাইড সিটিজেন হয়ে গেছ, পাসপোর্ট করার তাড়া না থাকলে তোমার সার্টিফিকেট কয়েকদিন পরে নাও। আমরা বেছে বেছে অল্প কয়েকজন সিটিজেনকে হোয়াইট হাউজে শপথের প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ করি। আমি রাজি হয়ে যাই।
একটু থামল সায়রা বানু। আবার বলতে থাকল, আমি সিটিজেন পরীক্ষায় পাশ করেছি শুনতে পেয়ে খালাম্মা, এবং আরো কয়েকজন আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগে। ওদের একজন বিজনেস পার্টনারের ছেলে টুরিস্ট ভিসায় ছিল, ওর সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল। লোকটা ভালো না। প্লে বয় টাইপের। আমি যে দিন পালিয়ে আসব, আম্মিজান আমাকে তার নিজের কোরআন শরীফ দিয়ে বলল, আমাদের আল্লাহ্‌ ছাড়া কেউ নেই। আমি তোমাকে আল্লাহ্‌র হাতে সপে দিলাম। প্রতিদিন ভোরে সুরা আল আ’লা পড়বে। যে এই সুরা অর্থ বুঝে পড়বে, সে কোনো দিন পাপ করতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ্‌ কোনো বিপদ, কোনো অসম্মান তোমাকে স্পর্শ করবে না।
আবার কিছুক্ষণ কাঁদল সায়রা বানু। দিনগুলোর কথা মনে করল। ওড়নায় চোখ মুছল। বলল, তোমার সাথে যখন দেখা হয়েছিল, তখন আমার কেউ ছিল না। কোথাও যাওয়া জায়গা ছিল না। অথচ আজ দেখ, আমি গাড়ি চালাতে পারি। আমার একটা গাড়ি আছে, আমি নিজের এপার্টমেন্টে যাচ্ছি। স্কুলে ভর্তি হবো, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব। নিজের ইচ্ছায় চলতে এখন আর কোনো বাধা নেই। আমি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি।
— গুড ফর ইউ, ট্রাভেলিং প্রিন্সেস। ইংরেজিতে মন্তব্য করল নাদিম। মন্তব্য শুনে সামান্য একটু হাসল সায়রা বানু। মুখটা আরো মলিন হলো। জিজ্ঞেস করল, আমার সম্পর্কে আর কিছু বলার নেই?
কী জানতে চাইছে বুঝতে পাড়ল নাদিম, কিন্তু তবু প্রশ্ন করল, কী বলব?
— এতদিন একসাথে থাকলাম, কত জায়গায় ঘুরতে গেলাম, কত সময় কাটালাম, কিচ্ছু বলার নেই?
— থাকবে না কেন?
— বলো শুনি?
কি যেন ভাবল নাদিম। তারপর বলতে থাকল, প্রথম প্রথম কিছু ভাবিনি। একদিন খেয়াল করলাম একটুতেই বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। রাতে ঘুম আসে না। এমনি সময় বুঝতে পারলাম আমার একটা নিজস্ব, একান্ত ভুবন হয়েছে। আমি ছাড়া আর কেউ সেখানে যেতে পারে না। ঘুম না এলে আমি চোখ বন্ধ করতাম। নিঃশব্দে আমার ভুবনে প্রবেশ করতাম। আশ্চর্য হয়ে দেখতাম, অন্ধকার ভুবন জ্যোৎস্নায় ছেয়ে আছে। খুব অবাক হতাম, জ্যোৎস্না এলো কোথা থেকে? তারপর দেখতে পেতাম, আমার অন্ধকার, হতাশ জীবন তুমি জ্যোৎস্নায় ভরে দিয়েছ। ক্লান্ত আমি জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পরতাম।
অবাক হয়ে কথাগুলো শুনল সায়রা বানু। কিছুক্ষণ মুখে কোনো শব্দ এলো না। এক সময় সম্বিৎ ফিয়ে পেয়ে বলল, এতগুলো দিন একসাথে ছিলাম, কোনো দিন বলনি তো?
— কোনো দিন জিজ্ঞেস করনি তো?
— ওহ, তাই তো! আমি জিজ্ঞেস করিনি!
আর কিছু বলতে পাড়ল না সায়রা বানু। বিদায় নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল সায়রা বানুর। একা থাকলে কষ্ট সহ্য করা সহজ হতো। গাড়িতে উঠল সায়রা বানু। বলল, ভালো থেকো নাদিম। তোমার জন্য সব সময় মন থেকে দোয়া করি। একটা কিছু হয়ে যাবে।
খুব ধীরে ধীরে পারকিং থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠল সায়রা বানু। দেখে মনে হয় পাকা ড্রাইভার। এক সময় অন্য গাড়ির ভিড়ে হারিয়ে গেল।
ঘরে ফিরে এলো নাদিম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। মনের ক্লান্তি শরীরে ক্লান্তি এনে দিচ্ছে। খুব ঘুম পেয়েছে। কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারলে কষ্ট কিছুটা কমতে পারে। ফোন অফ করে, দুইটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে গভীর ঘুমে ঢলে পাড়ল নাদিম।
(চলবে)
লেখক – হাসান মাশরিকী,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে