নিভৃত পূর্ণিমা পর্ব-০৩

0
517

নিভৃত পূর্ণিমা – ৩
নাদিম ভেবেছিল ঘরে নাস্তা করবে, কিন্তু সায়রা বানু এমন করে তাড়া লাগাল যে খাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে দূর করতে হলো। নিশ্চয়ই ঘরে কিছু জিনিস নেই, যেগুলো এতদিন নাদিমের দরকার হয়নি, কিন্তু সায়রা বানুর অবশ্যই লাগবে। তা না হলে সকাল সকাল উঠে দোকানে যাওয়ার কথা বলবে কেন?
কিন্তু সমস্যা হয়েছে গাড়িটা একজন সিঙ্গেল ব্যাচেলর ছেলের, যার গার্ল ফ্রেন্ড নেই। স্বভাবতই গাড়িটা অপরিষ্কার। পিছনের সিট, ট্রাঙ্ক অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ঠাঁসা।
নাদিম বলল, বাইরে যেতে অসুবিধা নেই। গাড়িটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। যাব আর আসব।
— আমি সাথে যাব। বলল সায়রা বানু।
— গ্যাস ষ্টেশনে শুধু শুধু কেন দাঁড়িয়ে থাকবে? ঘরে থাকো। আমার দেরি হবে না।
— একা একা ভয় লাগে। না, আমি সাথে যাব। জোর দিয়ে বলল সায়রা বানু।
— আচ্ছা। চলো।
নাদিম রাজি হওয়াতে মুখ ফরসা হলো সায়রা বানু্র। সাথে সাথে হাত ব্যাগ নিয়ে বাইরে এলো। ভাব দেখে মনে হলো নাদিম মত বদলানোর আগেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
একটা ছোট প্লাস্টিকের বাক্স এবং কয়েকটা ট্রাশ ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে এলো নাদিম। কাছের একটা গ্যাস ষ্টেশনে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের পাশে গাড়ি রাখল। একটু দূরে ছায়ায় দাঁড়িয়ে নাদিম কী করে দেখতে থাকল সায়রা বানু। সবগুলো দরজা, ট্র্যাঙ্ক খুলে প্রথমে ময়লা কাগজ, এটা সেটা পাশের ট্রাশ ক্যানে ফেলে দিল। কিছু প্রয়োজনীয় বইপত্র, জিনিস ব্যাগে ভরল। মেশিনে কোয়াটার দিয়ে পাঁচ-ছয় মিনিট ভালো করে ভ্যাকুয়াম ক্লিন করল। সিটের উপরে নিচে, ট্রাঙ্কে ভালো করে দুইবার ভ্যাকুয়াম করল। তারপর সায়রা বানুর দিকে তাকিয়ে বলল, আসো।
গাড়িতে উঠতেই জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?
হাতে লিখা একটা লিস্ট দেখে সায়রা বানু বলল, প্রথমে “বেড, বাথ এন্ড বিয়ন্ড”, তারপর “হোম গুডস”, তারপর “টার্গেট”। সব শেষে মাছ-মাংসের দেশি দোকানে যাব। কিন্তু কোনো পাকিস্তানি দোকানে যেয়ো না।
কোরিয়ান গ্রোসারি দোকান “লটে প্লাজা” কিংবা “এইচ মার্টে” আজকাল “হালাল” মাংসের আলাদা সেলফ থাকে। সেগুলো প্যাকেট করা মাংস। কিন্তু “খোলা মাংস” কিনতে গেলে সাধারণত পাকিস্তানি দোকানে যেতে হয়। পাকিস্তানি দোকানে অনেক মাংস বিক্রি হয়, সব সময় ফ্রেশ ল্যাম্ব, গোট কিংবা বিফ পাওয়া যায়। ইচ্ছে মতো দেখে দেখে “সিনার মাংস” বা “রানের মাংস” কেনা যায়।
সায়রা বানু পাকিস্তানি দোকানে যাবে না বলাতে আর কোথায় যাওয়া যায় চিন্তা করতে থাকল। এলিকট সিটি এবং বাল্টিমোর মিলে কয়েকটা প্যালেস্টাইনি মাংসের দোকান আছে। ওখানে যাওয়া যেতে পারে।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই সায়রা বানু বলল, ফোন নাম্বার পেতে পারি? হারিয়ে গেলে যোগাযোগ করব।
রাস্তায় চোখ রেখে ফোন নাম্বার বলল নাদিম।
প্রথমে বেড, বাথ এন্ড বিয়ন্ডে গেল। বিছানার চাদর, লেপ, বালিশ, দরজা-জানালার পর্দা, হাঁড়িপাতিল, প্লেট , ছুরি, রান্নার ঘরে সামগ্রীতে ভরা এই দোকান। সংসার সাজানোর সব কিছুই এখানে পাওয়া যায়। নানা রকমের জিনিস ট্রলিতে ভরতে থাকল সায়রা বানু। বড় দেখে একটা ছুরি হাতে নিতেই নাদিম বলল, ঘরে ছুরি আছে তো!
সায়রা বানু বলল, ওই ছুরিটা ছোট, ওতে কোনো কাজ হয় না। মেহেরবানি করে আমাকে কিছু জিনিস কিনতে দাও।
এভাবে অনুরোধ করার পর আর কথা চলে না। ট্রলি ঠেলে নেয়ার দায়িত্ব নিল নাদিম। সায়রা বানু যেদিকে যায় ট্রলি নিয়ে তার সাথে থাকে। পছন্দ মতো জিনিস তুলে কাউন্টারে যেতেই সায়রা বানু দাম দিতে চাইল। ওর ক্রেডিট কার্ড আছে। রফা হলো এইভাবে যে এক দোকানে সায়রা বানু দাম দেবে, পরের দোকানে নাদিম।
এখানে কেনাকাটা শেষ করে “হোম গুডস”, তারপর “টার্গেট” দোকানে গেল। দেখে দেখে ছুরি, চামচ, বিছানার চাদর, দরজা-জানালার পর্দা, ঘর পরিষ্কার করার জিনিস পত্র কিনল। “প্যাটেল ব্রাদার্স” নামের ভারতীয় দোকান থেকে একটা মাঝারি সাইজের লোহার কড়াই নিল।
লাঞ্চের সময় হতেই নাদিম জিগ্যেস করল, লেবানিজ? ইন্ডিয়ান?
সায়রা বানু বলল, যেটা ইচ্ছে তোমার
আশপাশে কয়েকটা আফগান রেস্টুরেন্ট আছে, ওদের ওখানে মাংস মানেই হালাল। সব চেয়ে কাছের আফগান রেস্টুরেন্টে যেয়ে একটা টেবিলে মুখোমুখি বসল দুজন। ওয়েটার লোকটা অর্ডার নিয়ে যেতেই নাদিম বলল, তোমার নাম খুব ফেমাস। জানো তো?
মনে হয় এই কথা অনেক শুনছে সায়রা বানু। মৃদু হাসল। বলল, আমার দাদাজান হিন্দি সিনেমার খুব ভক্ত ছিলেন। “জংলী” সিনেমা দেখে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে আমার নাম রেখেছিলেন সায়রা বানু। বলতেন, আমি সায়রা বানুর মত সুন্দরী।
— ঘটা করে আমার নামের মানে বললে, তোমার নামের কোনো অর্থ আছে?
— আছে। ফার্সি, উর্দু শব্দ থেকে নামের উৎপত্তি। সায়রা মানে ‘যে ভ্রমণ করে’। বানু মানে ‘প্রিন্সেস’ বা ‘সম্মানিত মহিলা’। বলতে পারো, সায়রা বানু মানে ট্রাভেলিং প্রিন্সেস।
— ওয়াও! হেসে ফেলল নাদিম।
নাদিমকে হাসতে দেখে আবার লাজুক হাসি দিল সায়রা বানু। না বললেও নাদিম কেন হাসছে বুঝতে পাড়ল। ট্রাভেলিং প্রিন্সেস ট্রাভেল করতে করতে এখন নাদিমের এপার্টমেন্টে এসে পৌঁছেছে। এক রাতেই অনেক সহজ হয়েছে সায়রা বানু। জিগ্যেস করল, তোমার নাম নাদিম আহ্‌-তার কীভাবে হলো? তুমি বলেছিলে, এটা খুব কমন নাম না।
— সে এক লম্বা কাহিনী।
ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। নান রুটি, ল্যাম্ব কাবাব। সাথে ঝাল চিকেন কারি। দুই জনের অর্ডার এক সাথে দেয়া হয়েছে। যে যার ইচ্ছে মতো নিজের প্লেটে তুলে নেবে।
লোকটা চলে যেতেই সায়রা বানু বলল, শুনি গল্পটা।
খুব ধীরে ধীরে গল্পটা বলল নাদিম।
ষাট দশকের শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে একজন বাঙালি যুবক ইউনিভার্সিটি অফ করাচীতে ব্যাচেলর্স পড়তে গিয়েছিল। করাচীর এক সহপাঠীর সাথে তার ভালোবাসা হয়। পাশ করে ওরা বিয়ে করে, সরকারি চাকরি নিয়ে দুজন করাচীতে সেটেল্ড হয়। একাত্তর সনে যখন স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়, ততদিনে তাদের এক ছেলে এবং এক মেয়ে হয়েছে। বোনটা ভাইয়ের চার বছরের ছোট। যুদ্ধের সময় বাঙালি ছেলেটা হাউজ অ্যারেস্টের মতো ছিল। করাচীর মেয়েটার প্রভাবশালী পরিবারের কারণে জেলে নিতে পারেনি। যুদ্ধে দুই পক্ষেরই আত্মীয়স্বজন হতাহত হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর সরকার থেকে বাঙালি ছেলেটাকে পাকিস্তান থাকার অথবা বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার অপশন দেয়া হয়। ছেলেটা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু স্ত্রী থেকে যায়। ওদের দুজনের সম্পর্ক এতো ভালো ছিল যে ওরা ঠিক করে ছেলে মায়ের সাথে থাকব, মেয়ে বাবার সাথে বাংলাদেশে চলে আসবে। ঐ ছোট মেয়েটা আমার আম্মু। আমার জন্মের পর আব্বু-আম্মুকে অনেক অনুরোধ করে নানাজান আমার নাম রেখেছিল নাদিম আখতার। এই হলো আমার নামের গল্প।
স্তব্ধ হয়ে থাকল সায়রা বানু। কিছুক্ষণ খাওয়া বন্ধ করে চুপ করে থাকল। তারপর খুব সহানুভূতির স্বরে প্রশ্ন করল, তোমার মামা’র নাম ছিল নাদিম আখতার, তাই না?
— হ্যাঁ। নানা ছেলেকে খুব মিস করত।
— দুই ফ্যামিলির মধ্যে যোগাযোগ ছিল?
— নানা-নানী দুজনের মধ্যে অনেক যোগাযোগ ছিল। ওদের কেউ আর বিয়ে করেনি। পরে মামাকে নিয়ে নানী অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়েছিল। অনেক দিন হয় দুজনই মারা গেছেন। মামা’র সাথে আম্মার যোগাযোগ আছে। আমার সাথে খুব বেশি কথা হয় না।
সায়রা বানু আর কোনো প্রশ্ন করল না। এত কিছু আলাপ করতে যেয়ে নাদিমের মনে হলো সায়রা বানুর সাথে কথা বলা অনেক সহজ হয়েছে। এক্কেবারে যে ইংরেজি বোঝে না তা না। কিছুটা অবাক হলো, কিন্তু এই নিয়ে ভাবার সময় হলো না। বাড়িতে যেয়ে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসতে হবে। কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের সাথে যোগাযোগ করে রেজুমে দিতে হবে। হাতে অনেক কাজ।
ধীরে ধীরে লাঞ্চ শেষ করে আবার কেনাকাটা করতে বের হলো দুজন।
এবার কয়েকটা কাঁচা বাজারের দোকান ঘুরে কয়েক রকমের মশলা, সবজি, মাছ, মাংস কিনে এপার্টমেন্টে ফিরল। অনেকগুলো প্লাস্টিক ব্যাগ হয়েছে। কিছু গাড়ির পিছনের সিটে রাখতে হলো। এপার্টমেন্টে ফিরতেই দেখা গেল বাড়ির মালিক ন্যান্সি বাগানে কাজ করছে। গাছে পানি দিচ্ছে।
গাড়ি থেকে নেমে মহিলাকে “হাই” বলল নাদিম। চোখ তুলে তাকাল ন্যান্সি। বলল, হ্যালো। নাদিমের পাশে সায়রা বানুকে খেয়াল করল। আবার গাছে পানি দিতে শুরু করল।
কয়েকবার আসা যাওয়া করে সবগুলো ব্যাগ ঘরে নিয়ে এলো নাদিম। জিনিসপত্র আনা শেষ হতেই টেবিলে বসল নাদিম।
সায়রা বানু বলল, কিছু মনে না করলে কিছুক্ষণ তুমি বাইরে থাক। আমি ঘর গোছাব। কমপক্ষে তিন ঘণ্টা পরে আসবে।
নাদিম ব্যাগ প্যাক কাঁধে বাইরে যেতে শুরু করতেই বলল, বেশি দূরে যেও না।
এলিকট সিটিতে বেশ কয়েকটা স্টারবাক্স ক্যাফে আছে। বাড়ির কাছের স্টারবাক্সে যেয়ে ল্যাপটপ খুলল। কয়েকটা কাজ এগিয়ে রাখতে হবে। সোমবার থেকে হায়ারিং এজেন্সির লোকজন যোগাযোগ শুরু করবে। সম্ভাব্য যে সব প্রশ্ন করতে পারে সেগুলোর উত্তর লিখে রাখতে হবে। কোন কোন বিষয় পড়তে হবে, কোন কোন বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করতে হবে, কোন ট্রেনিং ইউটিউবগুলো দেখতে হবে এগুলো গুছিয়ে রাখলে পরে সময় পেলে কাজগুলো শেষ করতে হবে।
কাজে ডুবে ছিল, কিভাবে আড়াইঘন্টা চলে গেছে বলতে পারবে না। এবার এপার্টমেন্টে ফিরতে হবে। গাড়ি পার্ক করে দরজার সামনে এসে দেখে কতগুলো কালো ট্রাশ ব্যাগ দরজার সামনে রেখে দিয়েছে সায়রা বানু। এভাবে অল্প কিছুক্ষণের জন্য হয়ত রাখা যায়, কিন্তু দরজার সামনে ট্রাশ ব্যাগ জড়ো করে রাখা নিষেধ। হাউজিং এ্যাসোসিয়েশন থেকে কমপ্লেইন করে চিঠি পাঠাবে। ট্রাশ ব্যাগগুলো ফেলে দিয়ে এলো নাদিম। ঘরে ঢুকতে যাবে, গানের সুর শুনতে পেলো। সায়রা বানু জানালার শাটার একটু উপরে তুলে রেখেছে যেন বাইরের বাতাস আসা যাওয়া করতে পারে। ঘরের কাজ শেষ করে জগজিৎ সিং এর গজল শুনছে।
“সারাক্ তি যায়ে হ্যাঁয় রুখসে নাকাব,
আহিস্তা আহিস্তা।”
মনে হয় সায়রা বানু গজল পছন্দ করে। দাদু হিন্দি সিনেমার ভক্ত, তার কাছে থেকে গজল শোনার অভ্যাস হয়ে থাকতে পারে।
মাত্র পরিচয় হয়েছে, নাদিম ঘরে ঢুকলে নিশ্চয়ই গান বন্ধ করে দেবে সায়রা বানু। গত কালের বিষণ্ণ মেয়েটা আজ গান শুনছে, এর চেয়ে ভাল কাজ আর কী হতে পারে? কিছুক্ষণ রিলাক্স করুক, সেই ভালো। নাদিমের আরো কিছুক্ষণ বাইরে থাকা উচিত। আবার গাড়িতে এলো। কাছেই একটা পার্কের মত যায়গায় বসে থাকল। পনেরো মিনিট পর সায়রা বানু টেক্সট করল, কাম হোম।
দরজা নক করে ভিতরে এলো নাদিম। তাকিয়ে দেখল ঘরের চেহারা বদলে গেছে। এয়ার ফ্রেশনারের মিষ্টি গন্ধ। বইপত্র সব গছানো। ডাইনিং টেবিলে নূতন টেবিল ক্লথ। বেডরুমের দরজায় একটা পর্দা। টেলিভিশন, চেয়ার টেবিলগুলো কেউ মুছেছে। কিচেনে সব কিছু নূতন করে গুছিয়ে রাখা। রেফ্রিজারেটরের পুরানো খাবার ফেলে দিয়ে, তাকগুলো পরিষ্কার করে, আজকের বাজার সদাই রেখেছে। নাদিমের কেনা রুটি-পরোটাগুলো ফেলে দিয়েছে।
রাইস কুকারে ভাত, সাথে দুই তিনটা আইটেম রান্না করেছে। রাতের ডিনার ঘরে হবে।
এতগুলো কাজ শেষ করে শাওয়ার নিয়ে গান শুনছিল সায়রা বানু। নাদিমের খারাপ লাগল। বলল, আমি হেল্প করতে পারতাম।
— আরেকদিন।
বিকেল হয়ে আসছে। নাদিম বলল, আমাকে কতগুলো কাজ শেষ করতে হবে। কোনো দরকার হলে বলো।
— ওকে। সোফায় বসে টেলিভিশন দেখলে অসুবিধা হবে?
— না। কিন্তু আমি যখন কারো সাথে কথা বলব, তখন সাউন্ড একটু কম দিও।
— ওকে।
রিমোট দিয়ে কীভাবে নেটফ্লিক্স, ইউটিউবে যেতে হয় দেখিয়ে দিল নাদিম। খুশি হলো সায়রা বানু। কিছুক্ষণের মধ্যেই খুঁজে খুঁজে সিরিয়াল দেখতে থাকল।
ল্যাপটপে কয়েকটা বিষয় পড়তে থাকল নাদিম। তারপর অকসয় কুমারকে ফেসটাইম করল। বাঙ্গালিরা এই নামকে উচ্চারণ করে অক্ষয় কুমার।
— হোয়াট’স আপ, ম্যান? হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল অকসয়। নাদিমের সাথে আন্ডারগ্রেড পড়েছে। কয়েকটা ক্লাসে স্টাডি পার্টনার ছিল।
— আই নিড এ জব। তোমার বড় বোন আকাংসাকে আমার রেজুমে দিতে পারো?
— ওকে, দেব।
অকসয়ের বড় বোন আকাংসা একটা আইটি কোম্পানিতে উচ্চপদে আছে। ওয়েব সাইটে রেজুমে পোস্ট করার সাথে সাথে ব্যক্তিগত ভাবে চেষ্টা করা উচিত। যদি কাজে লাগে। কিছুক্ষণ অকসয়ের সাথে কথা বলে ফোন রেখে দিল নাদিম।
একটু পর নিউ ইয়র্ক থেকে আম্মার দূর সম্পর্কের বোন ফোন করলেন, এই খালা তার এক বান্ধবীর মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজছিলেন।
— স্লামালাইকুম, খালাম্মা। কেমন আছেন?
— ভালো। তোমার আম্মুর সাথে কথা হয়েছে। নিউ ইয়র্ক আসতে পারবে? মেয়েটার সাথে ফেস টু ফেস কথা বলতে পারতে।
— জি, আসতে পারব। তবে তার আগে ছবি, বায়ো ডাটা দেখতে পারলে ভাল হত না?
— বায়ো-ডাটা আর কী? আমেরিকায় জন্ম, একটা কলেজ থেকে ব্যাচেলর্স শেষ করেছে। বাবা-মা তোমাদের মত ছেলে খুঁজছে। ফেসবুকে ওর ছবি দেখে নিয়ো।
— ওকে। প্লিজ, সেন্ড মি হার ফেসবুক লিঙ্ক। আমার লিঙ্কটা ওকে দিতে পারেন।
— আজ ফোন করে খুব ভালো লাগল। আমার বান্ধবীকে বলব তুমি আসছ। খুশি হয়ে বললেন ভদ্রমহিলা।
— জি, বলতে পারেন। বলল নাদিম। ফোন রেখে দিলেন খালাম্মা।
ফোন রেখে তাকিয়ে দেখে সিরিয়াল পজ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে সায়রা বানু। খালাম্মার সাথে কথা বলার সময় অনেক ইংরেজি শব্দ, বাক্য ব্যবহার করেছে নাদিম। কী ঘটছে বুঝতে না পারলেও একটা মেয়েকে দেখতে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছে, এইটুকু সন্দেহ করেছে। এটাও বুঝতে পেরেছে, নাদিম খুব সম্ভব ফেসবুকে মেয়েটার ছবি দেখতে চাইছে।
একটু অপ্রস্তুত হলো নাদিম। বলল, কিছু বলবে?
— তুমি খুব মন দিয়ে কাজ করো। মন্তব্য করল সায়রা বানু।
— কেন বললে এই কথা?
— দুই বার জিজ্ঞেস করেছি চা খাবে কিনা। শুনতে পাওনি।
মন দিয়ে পড়ছিল, তারপর অকসয় এবং খালাম্মার সাথে কথা বলার সময় আর কোনোদিকে মন ছিল না।
হঠাৎ বুঝতে পাড়ল, সায়রা বানুকে ওর মতো ফেলে রেখে, সারাক্ষণ নিজের কাজ করলে খারাপ দেখায়। সায়রা বানুকে কিছুটা এটেনশন দেয়া উচিত। সেটাই সে চাচ্ছে। বলল, আমি বরং তোমাকে চা বানিয়ে দেই। মিল্ক টি না লিকার টি?
— মিল্ক টি, কিন্তু তোমাকে বানাতে হবে না।
— সারাদিন কাজ করেছ, এখন শান্তি মত সিরিয়াল দেখ।
উঠে ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি চড়িয়ে দিল। ফিরে এসে বলল, আমি তোমার সাথে সিরিয়াল দেখি?
— দেখবে? উৎসাহিত হয়ে বলল সায়রা বানু।
— সিরিয়াল দেখব, কাজ করব, ফোন করব, অসুবিধা হবে?
— না, অসুবিধা হবে কেন?
এবার চেয়ার ঘুরিয়ে টিভি’র দিকে মুখ করল নাদিম। চা বানিয়ে, মিল্ক, সুগার সায়রা বানুর সামনে রাখল। নিজের পছন্দ মতো মিল্ক, সুগার দিয়ে চা হাতে নিয়ে রিমোট টিপতে থাকল।
খুঁজে খুঁজে একটা সিরিয়াল বের করে প্রথম শুরু করল।
ল্যাপটপে কাজ করতে করতে সায়রা বানুর দিকে না তাকিয়ে নাদিম জিজ্ঞেস করল, কোন সিরিয়াল দেখছ?
— “বিন্‌ধ বানুঙ্গা ঘোড়ী চোড়ুঙ্গা”। খুব মজার সিরিয়াল, রাজস্থানের একটা ট্র্যাডিশনাল পরিবারের গল্প।
— মানে কী?
— মানে একদিন হাজব্যান্ড হব। বর সেজে একদিন আসব।
— ওয়াও! কী বিষয় নিয়ে?
— রাজধানী জয়পুরের ট্র্যাডিশনাল এক ফ্যামিলিকে ঘিরে গল্পটা এগিয়েছে। মেয়েটা ডাক্তার হতে চায়, কিন্তু পরিবারের সবার ইচ্ছে সে বিয়ে করে সংসার শুরু করুক। একটা মেয়ের উপর ফ্যামিলি, সমাজের ইচ্ছেগুলো মেনে চলার জন্য কীরকম চাপ সৃষ্টি করা হয় সে সব তুলে ধরছে।
— বেডরুমের টিভিতে আরাম করে দেখতে পার।
— নাহ, একা একা বেশিক্ষণ ভাল লাগে না।
— ওকে, সোফায় বসে দেখ। এঞ্জয়।
শুরু হলো সিরিয়াল। একটা উনিশ কুড়ি বয়েসের মেয়েকে দেখাল। রাত জেগে পড়ছে, প্রচণ্ড ঘুম পেয়েছে কিন্তু হাই তুলে তুলে ডাক্তারি ভর্তি পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করছে। নাদিম দেখতে শুরু করাতে আরো আগ্রহ নিয়ে দেখছে সায়রা বানু।
একটু দেখে আবার ল্যাপটপে ফিরে এলো নাদিম। একটা চাকরি পেতেই হবে। পরিবারের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সায়রা বানু সিরিয়ালে এত ডুবে গেছে যে এখন নাদিম দেখছে, কি দেখছে না, সেদিকে খেয়াল করছে না।
পনেরো বিশ মিনিট পর সায়রা বানুর ফোন বেজে উঠল। নাম্বার দেখে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠল। “আম্মি জান” বলতে বলতে একছুটে বেড রুমে চলে গেল।
এমন সময় রঘুনাথ রেড্ডির ইমেইল পেল নাদিম। একদিনের মধ্যে ভদ্রলোক নাদিমের রেজুমেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে সাজিয়েছে। চাকরির জন্য একটা ফরওয়ার্ডিং লেটার টাইপ করেছে। অনেক সময় নিয়ে কাজ করেছে। এখন নাদিমকে রিভিউ করতে বলেছে। নাদিম পছন্দ করলে ইলেক্ট্রনিক ভাবে সাইন করতে হবে। তারপর এমপ্লয়ারের কাছে পাঠিয়ে দেবে।
সময় নিয়ে পড়ল নাদিম। সাইবার সিকিউরিটি’র বেশ কয়েকটা দিকে নাদিমের বাস্তব অভিজ্ঞতা দেখানো হয়েছে। ওই আই টি কোম্পানি চাকরিতে যে যে অভিজ্ঞতা চেয়েছে, সে ভাবে রেজুমে সাজিয়েছে। কিন্তু কয়েকটা ডাহা মিথ্যা অভিজ্ঞতা দাবী করা হয়েছে। লেখা হয়েছে ব্যাচেলর্স এর শেষ বর্ষে নাদিম সিটি ব্যাংকের এক কনট্রাক্টরের কাছে সামার ইন্টার্ন হিসাবে তিন মাস কাজ করেছিল। এবং তখন সিটি ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে “পেনিট্রেশন এবং সিমুলেটেড অ্যাটাক টেস্ট” করেছিল। রেফারেন্স হিসাবে সেই প্রোজেক্টের ম্যানেজার বালা সুব্রামানিয়ামের নাম এবং ফোন নাম্বার দেয়া আছে। বালা সুব্রামানিয়াম কে নাদিম জানে না। জীবনে এই প্রথম লোকটার নাম দেখল নাদিম। শেষ বর্ষের সামারে নাদিম কোনো ইন্টার্নশিপ করেনি। ইউনিভার্সিটিতে এক প্রফেসরের ল্যাবে স্টুডেন্ট ওয়ার্কার ছিল। এরকম আরো কয়েকটা অভিজ্ঞতা লেখা আছে যেগুলো সত্যি নয়। এই রেজুমে নাদিমের প্রাক্তন বস জেমস ওয়ার্ড দেখলে চোখ কপালে তুলবে। কাগজ পত্র সাইন করার আগে মিস্টার রেড্ডির সাথে কথা বলতে হবে।
বেডরুম থেকে সোফায় ফিরে এলো সায়রা বানু। হাসি মুখে বলল, আম্মিজানের সাথে কথা বললাম। আমার জন্য চিন্তা করছিল। বলেছি, ভালো আছি।
আরো কিছুক্ষণ সিরিয়াল দেখল সায়রা বানু। দুইটা পর্ব শেষ করে ডিনার করল দুজন। মাংস রান্না করেছে, সাথে সালাদ এবং রাইতা। মশলার ব্যবহার একটু ভিন্ন কিন্তু স্বাদ হয়েছে। ডিনার শেষ করে ঘুমাতে গেল সায়রা বানু। কিছুক্ষণ কাজ করে নাদিম নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন রবিবার একই সময় ভোরে আজানের শব্দে ঘুম ভাঙল। গতকালের মত একই ভাবে অজু করে, নামাজ পড়ে, একই সুরা পড়ল সায়রা বানু। তারপর বেডরুমে লাইট অফ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
গতকালের মতো নামাজ পরে আবার ঘুমিয়ে তারপর উঠল নাদিম। হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করতে এলো। ততক্ষণে নাস্তা তৈরি শুরু করেছে সায়রা বানু। নাদিম সাহায্য করতে চাইলে সায়রা বানু বলল, হেল্প লাগবে না।
টেবিলে বসে সায়রা বানুর রুটি বানিয়ে সেকে ফেলা দেখতে থাকল নাদিম। ময়দার গোল্লা হাতে নিয়ে তালু দিয়ে তালি দেয়ার মত করে চেপে চেপে গোল রুটি বানিয়ে ফেলে। দোকানে পিঁজা বানায় যেভাবে অনেকটা সে রকম। গতকালের লোহার কড়াইটা উলটা করে চুলার আগুনে দিয়েছে। কড়াইয়ের তলার উপর রুটি দিতেই টুপির মতো ফুলে উঠে। বেশ কয়েকটা রুটি তৈরি করে টেবিলে এলো সায়রা বানু। আগেই ভাজি এবং মাংস রাখা ছিল। সায়রা বানু বলল, শুরু করো। আমি চা দিচ্ছি।
ওর জন্য অপেক্ষা করল নাদিম। টেবিলে মুখোমুখি বসে নাস্তা করতে থাকল দুজন।
এক সময় নাদিম বলল, আমি একদিন বা দুই দিনের জন্য নিউ ইয়র্ক যাবো। তোমার কাছে এক সেট চাবি থাকবে, কোনো অসুবিধা হবে না।
খাওয়া থামিয়ে তাকিয়ে থাকল সায়রা বানু। একটু পরে বলল, অফিসের কাজ?
— না। একজনের সাথে দেখা করতে যাব।
— একা একা আমার ভয় করে। ভোর সকালে যাও, দেখা করে রাতে ফিরে আসো? প্রস্তাব করল সায়রা বানু।
— আচ্ছা, দেখি। চেষ্টা করব। আমার এক আত্মীয়ের সাথে কথা বলতে হবে।
জবাব শুনে কাষ্ঠ হাসি হাসল সায়রা বানু। না গেলে ভালো হতো, কিন্তু দিনে দিনে ফিরে আসুক, এটা মন্দের ভালো।
নাস্তা শেষ করে আবার “বিন্‌ধ বানুঙ্গা ঘোড়ী চোড়ুঙ্গা” দেখতে বসল সায়রা বানু। নাদিম কিছুক্ষণ দেখাল। সারে বারোটা বাজতেই বলল, আমি একটু লাইব্রেরীতে যাব। ঘণ্টা দুয়েক কাজ করব, তারপর ফিরব।
— কতদূরে লাইব্রেরি?
— দশ মিনিটের ড্রাইভ।
— আচ্ছা। ফোন সাথে রেখ।
— আচ্ছা।
রবিবার একটার সময় হাওয়ার্ড কাউন্টি লাইব্রেরী দরজা খুলে। নিরিবিলিতে বসে বসে কিছু কাজ করতে হবে। ঘরে সিরিয়াল দেখে দেখে সে কাজ হবে না। এক ঘণ্টার মতো কাজে ডুবে থাকল নাদিম।
এমন সময় সায়রা বানু’র টেক্সট মেসেজ এলো। মেসেজ দেখে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল নাদিমের। সায়রা বানু লিখেছে, “নাদিম, কাম হোম। আই এম ইন ডেঞ্জার।“
কিচেনে বা কোথাও আগুন লাগল? ইলেকট্রিক শক খেলো? ও কি নাইন ওয়ান ওয়ান কল করতে জানে না? সাথে সাথে ফোন করে জবাব পেলো না। পাওয়ার অফ করা মনে হয়। সবচেয়ে দ্রুত কীভাবে ঘরে ফেরা যায় চিন্তা করল নাদিম। সবচেয়ে কম ট্রাফিক লাইট কোন রাস্তায় চিন্তা করল, তারপর স্পিড লিমিট ব্রেক না করে ফিরতে শুরু করল।
পারকিং গাড়ি ঢুকতেই দেখতে পেলো এপার্টমেন্টের সামনে একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যানের মাঝের দরজা খোলা। একজন মহিলা এবং দুই জন পুরুষ, এই তিন জনে মিলে সায়রা বানুকে ভ্যানে তোলার চেষ্টা করছে। এখনো পাঁচ সাত ফুট দূরে আছে।
মহিলা এবং সাথের পুরুষ দুইজনকে দেখে মনে হয় এরা সবাই পাকিস্তানি। হাল ছেড়ে দিয়ে কেমন যেন নিস্তেজ হয়েছিল সায়রা বানু, ড্রাইভার সিটে নাদিমকে দেখতে পেয়ে সাহস ফিরে পেলো।
নাদিম বুঝতে পাড়ল একা একা কেন ভয় পেতো সায়রা বানু। ও নিশ্চয়ই জানত ওকে ধরে নিয়ে যেতে যৌথ পরিবার থেকে কেউ না কেউ কেউ আসবে। কিন্তু ওর বয়েস তো উনিশ! তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে জোর করে কীভাবে নিয়ে যাবে?
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে