নাপুরুষ পর্ব-০৪

0
1105

#নাপুরুষ
#৪র্থ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



ওর শাশুড়ি বলে,’আমরা কিন্তু আজকেই আবার এসে পড়বো। ইফতারের আগে যাবো আর ইফতার করে এসে যাবো।মিম্মিরাও যাবে।সবাই মিলে যাবো।’
রুপা মুখ ফুটে কিছু বলে না। কিন্তু মনে মনে ঠিকই বলে,সে কাল গেলে শাশুড়ির সাথে কিছুতেই আসবে না। মাকে বলবে তাকে যেন তিন চারদিনের জন্য রেখে দেয়। সাথে পৃথুলকেও।পৃথুলের সাথে ও থাকলে সব জেনে যেতে পারবে।মাকেও জানাতে পারবে সবকিছু।

প্ররদিন দুপুর বেলা রুপাদের বাড়ির দিকে যাত্রা করে ওরা।পৃথুলদের যে নিজেদের গাড়িটা আছে ওটা করেই যায়।যেন আসতে সুবিধে হয়।যতো রাতই হোক না কেন!
ওখানে পৌঁছাবার পর হঠাৎ করে পৃথুলের পেটে ব্যথা হয়। খুব ব্যথা।পৃথুল বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খায়।ওর মা চিন্তিত মুখে বলে,ওর যে কী হলো! তিন চারদিন ধরে সময়ে অসময়ে পেটে ব্যথা হয়!
রুপা পৃথুলের কাছে আসতে চাইলে লায়লা বেগম বলে,’বউ মা আমি ওর কাছে থাকি। তুমি বরং মিম্মি আর সুফলাকে নিয়ে তোমার চাচাদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসো।’
রুপা রাগ করবে কি না কিছু বুঝতে পারে না। কিন্তু তার কেন যেন মনে হয় পৃথুলের পেটে সত্যি সত্যি কোন ব্যথা উঠেনি। এসব ওর মায়ের চল চাতুরি।
রুপার মন ভেঙ্গে যায়। বাড়িতে আসার আনন্দ মাটি হয়ে যায়।সে সুফলা আর মিম্মিকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যায় না। বরং বিছানায় শুয়ে থেকে কাঁদে।
ওর মা ওকে এভাবে দেখে অবাক হয়।আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে রে মা? কাঁদিস কেন?’
রুপা লজ্জায় কিছু বলবে না বলবে না করেও মুখ খুলে বলে ফেলে।বলে,’পৃথুল আজ পর্যন্ত আমার সাথে কথাই বলেনি! আমার ধারে কাছে ঘেঁষে না। আমার ছাঁয়াটুকুও ডিঙায় না পর্যন্ত!’
কথাটা বলেই সে কেঁদে উঠে আবার।
ওর মা ওকে বুকের সাথে চেপে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।আদর করে। তারপর কোমল গলায় বলে,’চুপ কর মা,চুপ কর।কাঁদিস না আর।ওরা শুনলে সমস্যা হবে।কী না কি ভেবে বসবে আল্লাই জানে! ‌ওর মা সব ভেঙ্গে বলছে আমারে।পৃথুলের নাকি একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। সেই মেয়েও ওর সাথে আমেরিকায় পড়াশোনা করেছে। কিন্তু গত বছর হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক করে মেয়েটা মারা গেছে। এরপর থেকেই পৃথুল নিরব হয়ে গেছে। চুপচাপ থাকে।কারো সাথে কথা বলে না।’
রুপা কান্নাভেজা গলায় বললো,’সে যদি আমার সাথে কথা না বলে তবে ওখানে থেকে আমার লাভ কী মা?আমি একা একা ওখানে থাকতে পারবো না! আমার ওখানে ভালো লাগে না’
ওর মা মৃদু হাসে। হেসে বলে,’বেকুব মেয়ে।তুই ই তো একদিন ওর মন জয় করবি।ওর মন থেকে ওই মেয়েটার নাম মুছিয়ে দিবি। একটু সময় লাগবে। লাগুক। মেয়েদের জীবনের একটাই লক্ষ্য। তার স্বামীর সেবা করা। স্বামীর মন জোগানো। এরপর সন্তান সন্তুতী হলে এদের লালন পালন।আর কি!’
রুপার এসব পুরনো দিনের কথা ভালো লাগে না।সে কোন স্বামীর মন জোগাবে যে তার কাছে আসছেই না।তাকেও তো কাছে যেতে দিচ্ছে না ওরা। কিন্তু এই কথা গুলো মার কাছে সে বলতে পারে না। লজ্জা বলে একটা বিষয় আছে তো!মায়ের কাছে কী সব বলা যায়!
তাছাড়া মায়ের স্বরটাও তার ভালো লাগে না।মা এসব কোন ধরনের কথা বলছে!অতি সেকেলে কথা এইগুলো। এখন সময় পরিবর্তনের। স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত এটা যে হাদিস নয় তাও প্রমাণ হয়ে গেছে।স্বামীর প্রতি স্ত্রীর যেমন দায়িত্ব আছে স্ত্রীর প্রতিও আছে স্বামীর দায়িত্ব। এখানে কেউ কারো থেকে বড় ছোট নয়।দুজনই মানুষ।দুজনই সমান।এই কথাগুলো সে মনে মনে বলে।

এরপর রুপা তার মায়ের কাছে আবদার করে বললো,’মা,পৃথুলের মাকে বলো না আমি তিন চারটে দিন এখানে থাকতে চাই! আমার খুব মন পোড়ছে বাড়িটার জন্য!’
ওর মা বললো,’রমজানের মাসটা তোর ওখানেই থাকতে হবে মা।তোর শশুর ঈদের পর পরই চলে যাবে।উনি যতোদিন বাড়িতে আছে ততোদিন তুই ওখানেই থাক। আরেকবার উনি কবে আসতে পারেন তার কোন ঠিক ঠিকানা আছে!’
রুপা বলে,’মা,উনি তো ঢাকা গিয়েছেন। তিন চারদিন দেরি হবে আসতে!’
রুপার মা বললো,’দেরি হোক মা।তোর শাশুড়ি আবদার করেছে।তুই ওখানেই থাক গিয়ে। উনারা ধনী বিত্তবান মানুষ।উনাদের রাগানো ঠিক হবে না!রাগালে যদি আমাদের সাথে সম্পর্ক চিহ্ন করে!’
রুপার খুব কান্না পায়।সে বুঝতে পারে না তার মা তার প্রতি এমন নিঠুর কেন! কীভাবে তার মা ওদের সাফাই গায়ছে!কেন তার কষ্টটা বুঝতে পারছে না একটুকুও। তার মনে যে ভীষণ কষ্ট!পাফাড়ের পর পাহাড় দিয়ে চাপা দিয়ে রাখতে চায়ছে সে এসব কষ্ট। কিন্তু পারছে না ‌।বুক ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে চায় একেকবার!
ওদের কথায় সব মানতে হবে কেন রুপা বোঝে না!ওরা ধনী হলেই কী ওদের সব কথা মাথা পেতে নিতে হবে? কেন?

ইফতারের পর পর লায়লা বেগম বলে,’বউমা রেডি হও ‌। এখান থেকে গিয়ে পৃথুলরে আবার ডাক্তার দেখাবো।’
রুপা মুখে আর বলতে পারে না সে থাকতে চায় এখানে আরো দু তিনটে দিন। যেহেতু তার জন্মদাত্রী মাই-ই চায় না সে আজ এখানে থাকুক।এক প্রকার রাগ নিয়েই তাই সে ফিরে যেতে মনস্থির করে।আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,আর কখনো এখানে আসবে না সে। কখনোই না। প্রয়োজনে ওখানে থেকে থেকে মরে যাবে। তবুও বাড়িতে ফিরে আসবে না।

রুপা পৃথুলদের বাড়িতে ফিরে এসে মন খারাপ করে খুব।
সুফলা তখন তাকে সময় দেয়।বলে,’রুপা,পৃথুলের বিষয়টা বোধহয় শুনেছো তুমি!ওর মনে খুব কষ্ট। সত্যি বলতে সে অন্য কোন মেয়েকেই তার নিজের করে নিতে পারছে না। নেয়ার কথা ভাবতেও পারছে না।
একটু ধৈর্য ধরো বোন প্লিজ! মাত্র কয়েকটা দিন।আস্তে আস্তে দেখবা সব ঠিক হয়ে গেছে।আর এক দুটা দিন যাক। এরপর দেখবে সে তোমার সাথে এসে এখানেই থাকবে।দেখবে আস্তে আস্তে সে তোমার সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। হাসি তামাশা করছে।’
রুপা লজ্জা ভেঙ্গে বলেই ফেলে। সাহসী মেয়েদের মতো।
‘আপনার ভাই যদি কোন মেয়েকে মেনেই নিবে না তবে ওকে বিয়ে করালেন কেন?ওর অনুমতি নেননি কেন?’
সুফলা লজ্জিত হওয়ার ভঙ্গি করে বলে,’ভেবেছিলাম বিয়ে করালেই পরিবর্তন হবে। কিন্তু এর জন্য তো সময় লাগবে।কটা দিন ধৈর্য্য ধরো।দেখবা তোমার সংসার সুখের হবে ‌।আমি বলে দিচ্ছি, আমার ভাইয়ের মতো ভালো মনের একটি ছেলেও নাই এই জগতে!’
রুপার এই কথাগুলো একটু ভালো লাগে।মনে শান্তি খুঁজে পায় সে। এবং মনে মনে আশা বাঁধে। যদিও পৃথুলের অন্য কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল কথাটা শুনে ভীষণ খারাপ লাগে।এটাই নিয়ম।একটা মেয়ে কিংবা ছেলে তার জীবন সঙ্গীকে শুধুমাত্র তার একার করেই পেতে চায়।অন্য কারোর সাথে তার সম্পর্ক আছে কিংবা কোন এক সময় সম্পর্ক ছিল এটা সে মেনে নিতে পারে না ‌।কষ্ট হয় ‌। মন খারাপ হয়।
রুপা তবুও মনে আশা বাঁধে।কাঙালের মতো। তৃষ্ণায় কাতর ছাতকের মতো।ওসব কষ্ট ভুলে গিয়ে ভাবতে থাকে। কল্পনা করে।যেন পরাগ তার কাছে ধীর পায়ে হেঁটে আসছে।এসেই তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খাচ্ছে।গলার এক পাশে ওর লম্বা খাড়া নাকটা ঘষে দিচ্ছে। তারপর। তারপর আরো কত কী যে ভাবে।কল্পনায় মজে যেতে থাকে!
রুপার বিশ্বাস হতে শুরু করে হঠাৎ। এরকম কল্পনা নয় বাস্তবেই একদিন পৃথুল ওর কাছে ঘেষবে। ওকে ভালোবাসবে।

লায়লা বেগম চিন্তায় অস্থির হয়ে যায়। বিয়ের দুই সপ্তাহ চলে গেলেও ছেলেকে কিছুতেই সে ও ঘরে তার পুত্রবধূর কাছে পাঠাতে পারে না।এ নিয়ে রাতে পৃথুলের বাবা তার গালে শক্ত হাতের দুটো চড় দিয়েছে।চড় দিয়ে বলেছে,’আমি নিষেধ করি নাই ছেলের জন্য বিয়ে করানো লাগবে না।বলি নাই,কুটি টাকা দিয়েও এই সমস্যা দূর হবে না!তুই শুনছিলি তখন?চলে গেলি পীরের দরবারে! বেয়াদব মহিলা কোথাকার!’
স্বামীর চড় খেয়ে লায়লা রাগে দুঃখে ফুঁসতে থাকে। ওদিকে রুপার জন্যও তার মায়া হয় খুব। এই মেয়েটা খুব মায়াবতী। খুব লক্ষ্মী একটা মেয়ে। অনেক সহ্য করতেছে। মেয়েটাকে কীভাবে যে সে আনন্দ ফিরিয়ে দিবে তাই বোঝে পায় না সে!
এরপর সে রাতেই লায়লা ফোন করে ওর বিজ্ঞ বান্ধবী শেলি নাহারকে।শেলি নাহার পড়াশোনা করেছে মনোবিজ্ঞানে। কিন্তু পড়াশোনার পর কোন কর্মে যুক্ত হয়নি ‌।দুই ছেলে মেয়েকে মানুষ করা আর সংসার গোছানোর দায়িত্বেই মোটামুটি একটা জীবন পার করে দিয়েছে।
শেলী ফোন রিসিভ করলে দুজনের মধ্যে কুশল বিনিময় হয়। তারপর দুঃখের কথাটা বলে লায়লা তার প্রিয় বান্ধবীর কাছে।
শেলী শুনে আফসোস করে।বলে,’এটা তো আর জোর করে হয় না রে লায়লা! চিকিৎসাও তো করিয়েছো অনেক।কাজ তো আর হয়নি। আসলে ছেলেটার সমস্যাটা খুব বড়!সে আছে একেবারে ডেনজারস স্টেজে!’
লায়লা তাড়া দেয়।বলে,’দয়া করে একটা উপায় বলো না শেলী। তুমি আমার শেষ ভরসা!’
শেলী তখন বলে,’এক কাজ করো। ফুটপাতে দেখবে ওসব গোপন বিষয়ক বই পাওয়া যায়।যা পড়লে ওর ফিজিক্যাল নীডটা ওয়াক হতে পারে!এটা স্বাভাবিক। এসব রসালো বই পড়লে ওর ইচ্ছে করবে মেয়েটার কাছে যেতে!’
লায়লা বেগম বললো,’মা হয়ে কীভাবে এটা করবো আমি!এসব স্বস্তা বই কিনে দিবো কীভাবে?’
শেলী আশ্বাস দেয়।বলে,’চিকিৎসা করাচ্ছো।এটা রোগ। এখানে লজ্জা ফজ্জা রাখলে তো হবে না!’
এরপর থেকেই শুরু হয়। লায়লা বেগম এরপর দিন মার্কেটে গিয়েই ফুটপাত থেকে ওসব বই কিনে আনে। তারপর সেই বই পৃথুলের টেবিলের উপর রেখে দেয় গোপনে।আর রুপাকে বলে দেয়,’মা, তুমি কিন্তু এখন সময়ে অসময়ে এ ঘরে এসো। তুমি এলেই দেখবে ওর মনে জায়গা করে নিতে পারছো তুমি আস্তে আস্তে।’
রুপা ওসব জানতো না।সে শাশুড়ির কথায় রোজ করে এ ঘরে আসতে থাকে। কিন্তু পৃথুলের কাছ থেকে কোন সাড়া পায় না। তবে একটা বিষয় তাকে খুব আশ্চর্য করে। টেবিলের উপর রেখে দেয়া তিন চারটে বই। সেই বইয়ের মলাটে অর্ধনগ্ন নারীদের ছবি। এরপর ভেতরের পাতা উল্টিয়ে সে আশ্চর্য হয়।বইয়ের ভেতরের পাতায় পাতায় নগ্ন ছবি আর নোংরা নোংরা গল্প। এইসব গল্পের একটি শব্দ পড়লেও কিংবা ভেতরের পাতার একটি ছবি দেখলেও গা গুলিয়ে আসে।বমির উদ্রেক হয়। সঙ্গে সঙ্গে সে ওই বইগুলো ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ময়লার ঝুড়িতে রেখে আসে।আর মনে মনে বলে,’ছিঃ!কী নোংরা মানুষ এরা।’
এরপর সে নিজেই পৃথুলের কাছে যায়। মুখোমুখি হয় ওর।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে