#নয়নাভিরাম (পর্ব-৬)
♡আরশিয়া জান্নাত
“আল্লাহ আমার এখনো বিয়ে হয় নাই, এতো তাড়াতাড়ি আমারে অপয়া বানাইও না। আমারে কেউ বিয়ে করবে না। আল্লাহ গো আমার আঙুল দুইটা নাকি আবার কেটে ফেলে। ও আম্মু ও আব্বু আমার আঙুল খুলতেছে না তো। আপুরে তোর বোন সারাজীবনের জন্য এভাবে আঙুল ধরে থাকবে। নেহিইইইইইই ”
আপু বিরক্তস্বরে বললো, উফফ মিমি এতো চিল্লাইস না তো। কিছু হবেনা সামান্য গ্লু তে আঙুল কাটা লাগে নাকি!
“তোর কি তোর তো আজ বিয়ে হয়ে যাবে নাচতে নাচতে চলে যাবি। তোর জন্য আমার সব শেষ। উহু উহু ,,,”
আব্বু বিচলিত কন্ঠে বললো, আহা মামণি প্যানিকড হচ্ছ কেন। রিলেক্স! দেখি পানিতে হাত চুবিয়ে দেখো তো নিশ্চয়ই আঠা ছেড়ে দিবে।
“আব্বু চামড়া খুলে চলে আসে যদি? একমাত্র বোনের বিয়েতে কব্জি ডুবিয়ে খেতে পারবোনা??”
“ধুরর বোকা মেয়ে কিচ্ছু হবেনা। যা বলছি করো”
তারপর ঠান্ডা পানিতে কিছুক্ষণ হাত ভিজিয়ে রাখতেই আঠা ছেড়ে দিলো। আমি আঙুল নাচিয়ে বললাম , ওরে আল্লাহ বাঁচাইছে। আমার আঙুল ঠিকঠাক আছে।
আপু– ড্রামা কুইন একটা। তোর চিল্লাচিল্লিতে মাথা ধরে গেছে আমার। আর জীবনে ধরিস সুপারগ্লু।
“এজন্য বলে ভালো করতে নেই। তোর জিনিস ঠিক করতেই তো ,,,”
“আমার জিনিস মানে? কি ধ্বংস করলি আবার??”
আমি কাঁচুমাচু করে বললাম, ঠিক করে ফেলছি তো, ধ্বংস হয়নাই।
“কি ঠিক করলি দেখি?”
আমি তখন না চাইতেও আপুর ফেভারিট কলমদানিটা এগিয়ে দিলাম। এটা আপু কক্সবাজার থেকে এনেছিল। সবসময় এক্সট্রা কেয়ার করে রাখতো। কাল রাতে হলুদ ফাংশনের পর রুমে এসে উড়াধুরা সব ছুড়ে ফেলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।সকালে সব গোছাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কলমদানিটা নীচে পড়ে বড় ঝিনুক দুটো খুলে গেছিল। আপু টের পাওয়ার আগেই গ্লু দিয়ে ঠিক করতে গেছিলাম। তখনই গ্লু লেগে আমার আঙুল আটকে গেছে,,,
কলমদানির বিশেষ ক্ষতি না হওয়ায় এ যাত্রায় বেঁচে গেছি। তবু আপু বারবার করে বলেছে, আমি যাওয়ার পর আমার জিনিস একটাও তুই ধরবিনা।আমি পরে এসে সব তালাবন্ধ করবো।
“হুহ ঢং! করুক গিয়ে তালাবন্ধ Who cares?”
সারাটাদিন কাটলো মহাব্যস্ততায়। এর ফাঁকে আমার ইনভাইট করা গেস্টদের ফোন করে মনে করিয়ে দিলাম কেউ যেন মিস না করে। সন্ধ্যায় সাজুগুজু করে নায়িকা সেজে বড় ভাইয়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে সবাইকে রিসিভ করছি তখন আমার ফ্রেন্ডরা এলো।
ইলহাম, ওমা এটা কে ? বাপরে আটা ময়দা সব খরচ করছোস দেখি!
“হয় আজকে কত্তজন আইবো, একটু সুন্দর না দেখাইলে চলে? বড় বোনের বিয়েতেই তো ছোট বোইনের লাইন হয় জানোস না?”
“ওহ এই ব্যাপার! ”
“যা তোরা ভেতরে গিয়ে বস। আবার আমার সুন্দরী কাজিনদের দিকে নজর দিস না।”
ইলহাম, নিজের বেলা ষোলোআনা পরের বেলা এক আনাও না? আমরা ক্যান নজর দিমুনা? পছন্দ হলে প্রপোজ ও করমু।
“তোরে কেউ গনায় ও ধরবে না।”
ভাইয়া বললো, তুই বরং ওদের নিয়ে যা আমি এদিকটা সামলাচ্ছি।
আমি বললাম, না ভাইয়া আমার স্পেশাল গেস্ট আসবে।উনাদের রিসিভ করেই চলে যাবো। নীলা তোরা গিয়ে ভেতরে বসতে পারবি না?”
নীলা, আরেহ সমস্যা নাই আমরাই তো। চল গিয়ে বসি।
সবাই চলে যাওয়ার পর ফাহিম হঠাৎ ফিরে এসে বললো, মিমি তোমাকে আজকে দারুণ লাগছে। এতো সুন্দর করে না সাজলেও পারতে,,
আমি হেসে বললাম, মাশাআল্লাহ বল শালা। নজর লাগবে।
ও মাথা চুলকে মুচকি হেসে চলে গেল।
ফয়েজ স্যার আর ম্যাডাম আসতেই উনাদেরকে নিয়ে ছোট ভাইয়ার দায়িত্বে দিয়ে আমি গেইটে এসে অস্থিরভাবে অপেক্ষা করছি। কে জানে উনি আসবেন কি না!
ওদিকে বরপক্ষ চলে এসেছে। গেইট ধরে অনেক হৈ চৈ হলো, বহু বাকবিতণ্ডার পর সাকিব ভাইয়াকে সাদরে বরণ করে স্টেজে বসিয়েই আমি ফের ছুট লাগালাম কিন্তু না তাঁর কোনো খবর নেই।
ফোন করে জিজ্ঞাসা করতেও কেমন জানি লাগছে, তিনি তো বলেছিলেন অবশ্যই আসবেন। তবে কি কোনো কাজে আটকে গেছেন?
কেমন জানি মন খারাপ হয়ে গেল। আগে বললেই পারতো আসবেনা তবে তো আর এতোক্ষণ অপেক্ষা করতাম না ,ধুরর।
_____________
পরদিন বেলা এগারোটার দিকে এসে আম্মু ডাকাডাকি শুরু করলো,আমি মরার মতো ঘুম ভেঙে বিরক্তস্বরে বললাম, ঘুমাতে দাও আম্মু আমি অনেক টায়ার্ড।
“তোর গেস্ট টিচার আর তাঁর মা এসেছে মিমি। তাড়াতাড়ি উঠ ”
আমার চোখের রাজ্যের ঘুম মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। আমি লাফ দিয়ে উঠে বললাম, আরশান আহমেদ এসেছেন??
” হ্যাঁ! তুই ফ্রেশ হয়ে আয় তো ।আমি একা আর ক’দিক সামলাবো।”
হুহ কাল এতো সুন্দর করে সেজেগুজে ছিলাম তখন আসেনি, এখন এই কামলার বেশে আছি আর এলো! ঘুমের কারণে চোখমুখ ফুলে বিছরি চেহারাটাই দেখাতে হবে ওহ নো!!
চটজলদি ফ্রেশ হয়ে ড্রইং রুমে যেতেই দেখি দাদীজান সেখানে বসে কথা বলছেন। যাক তাও ভালো একা তো বসিয়ে রাখেনি।
“আস্সালামু আলাইকুম আন্টি ভালো আছেন?”
“ওয়ালাইকুম আস্সালাম। এখন এসে খুব ডিস্টার্ব করলাম না তো? ”
“আরেহ না না কি যে বলেন! ভালো আছেন স্যার?”
“হ্যাঁ ভালো আছি। আসলে আমি খুব দুঃখিত মিস রুমাইসা। গতকাল আসবো বলেও আসতে পারিনি। তাই মা বলছিলেন,,,”
“ভালো করেছেন আপনারা এসেছেন। এখন লাঞ্চ না করে যেতে দিচ্ছিনা।”
” না মা আজ না অন্য একদিন। এখন আমাদের হসপিটাল যেতে হবে, ভাবলাম এই পথেই তো যাচ্ছি দেখা করে যাই বরং।”
“হসপিটাল যাচ্ছেন মানে? কারো কিছু হয়েছে নাকি? আপনি সুস্থ আছেন?”
“মা সুস্থ আছেন। গতকাল বিকেলে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। উনাকে হসপিটালাইজ করানো হয়েছে, সেজন্যই বিয়েটা এটেন্ড করতে পারিনি”
“বলেন কি! এখন কেমন আছেন তিনি? বেশি সিরিয়াস কিছু হলো?”
“আলহামদুলিল্লাহ মোটামুটি ভালোই আছেন,তেমন সিরিয়াস কিছু না ”
আম্মুর নাস্তা নিয়ে এসে বললেন, আপনাদের কে ঠিকঠাক আপ্যায়ন ও করতে পারছিনা কিছু মনে করবেন না।
আন্টি– কি যে বলেন আপা! আমরা এসে বরং আপনাদের বিপাকে ফেললাম। গতকাল তো আসতে পারিনি তাই প্রেজেন্টটাও দেওয়া হলোনা।এটা প্লিজ রাখেন আর অনেক দোআ রইলো তাদের প্রতি।
আম্মু– এসবের দরকার ছিল না ওদের জন্য দোআ করেছেন এতেই অনেক হবে।
__________
ফেইক আইডি দিয়ে নিপুণের আইডি স্ক্রল করছে আরশান। এটা তাঁর অপ্রিয় অভ্যাস। এতোদিনের ভালোবাসা তো চাইলেই সহজে ভোলা যায় না। টাইমলাইন জুড়ে নতুন মানুষটার সাথে অসাধারণ কাপল ফটোর ছড়াছড়ি। নিপুণ অনেক সুখেই আছে হয়তো। গেল মাসে বিয়ে করে ফরেনে শিফট করেছে। এই বিলাসবহুল জীবনটাই চেয়েছিল বোধহয়, যার সামনে চার বছরের ভালোবাসা ফিকে পড়ে গেছে।
সিগারেট এর প্যাকেটটা হাতে নিতেই মিমির কথা মনে পড়লো তাঁর,
“টাকা দিয়ে স্মোকিং না করে বরং ঐ টাকাটা গরীব কাউকে দিয়ে দেবেন,এতে অন্তত একবেলা পেট পুরে খেতে পারবে। নিজের তো ক্ষতি করছেনই সাথে পৃথিবী টাকেও দূষিত করছেন”
“আমি একজন স্মোক ছাড়লেই নিশ্চয়ই পৃথিবী দূষিত হওয়া থেকে বেঁচে যাবে না! আর আপনিই তো বলেছিলেন হাসিমুখে দুঃখ উড়াতে। এটা ছাড়া দুঃখ উড়ানো সম্ভব? ”
“আমি থেকেই শুরু হয় আমরা। একজন দুজনের সচেতনতায় দূষণ ঠেকবে না ঠিক, তবে নতুন করে তৈরি 0.00009% হলেও দূষণ কমবে তাই না? আর কে বলেছে এটা ছাড়া দুঃখ উড়ানোর উপায় নেই? হাজার হাজার উপায় আছে। উপায় না জানলে আমাকে বলবেন। আমি বলে দিবোনে।”
“আপনি খুব সাংঘাতিক মানুষ! আপনার সঙ্গে কথা বলে পারবোনা। ”
“আপনিও না কেমন রসকসহীন মানুষ! এটাকে কিন্তু চাইলে সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারতেন। কিন্তু না সেসব আপনার মাথাতেই নেই। আচ্ছা চার বছর রিলেশনে ছিলেন কিভাবে? প্রেমিকদের বৈশিষ্ট্য তো একটাও নেই দেখছি!”
“হয়তো সেজন্যই ছেড়ে গেছে,,,,”
“আবার সেন্টি খাবেন না প্লিজ! আপনাকে একটা বিশেষ জায়গায় নিয়ে যাবো। এক্সামটা শেষ হতে দিন,,,,,,”
আজকাল সবকিছুতেই মিমির কথা মনে পড়ে। মেয়েটা তাঁর কঠিন অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে ,,,,,,,
।
আরশানে মা আফরোজা বেডরুমে বসে তাঁর স্বামী নিজাম আহমেদ কে বললেন, অনেকদিন ধরে একটা কথা বলবো ভাবছি ,
“কি কথা?”
“আরশানের বিয়ের ব্যাপারে”
“ও কি এখনই বিয়ে করতে রাজী আছে? তোমাকে বলেছে নাকি পছন্দের কেউ আছে?”
“আরেহ না না। ও কিছু বলেনি এ ব্যাপারে। আমিই বলছি”
“এখনো ক্যারিয়ার গুছিয়ে আনলোনা, তুমি হঠাৎ বিয়ের কথা ভাবছো?”
“ক্যারিয়ারের সাথে বিয়ের কি সম্পর্ক? বিয়ে হলে আল্লাহ এমনিতেই বরকত দিবেন। ছেলেমেয়ে বিয়ের বয়স হলে এসব দুনিয়াবী কারণ দেখিয়ে পেছানোর মানে হয় না।তাছাড়া আল্লাহর রহমতে আমাদের কন্ডিশন তো এতো খারাপ না যে ছেলের বৌকে খাওয়াতে পারবোনা?”
“আফরোজা তা বলিনি। কিন্তু, ”
“কোনো কিন্তু না, আমার মনে হয় এখন সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই বেটার,,”
“আচ্ছা দেখো কেউ তোমার ছেলেকে মেয়ে দিবে কিনা ”
“এই কথা কেন বললে? কোনদিকে নেই আমার ছেলে? তুমি ইচ্ছে করে এসব বলো তাইনা?”
“হাহাহা। মজা করছিলাম, তা তোমার পছন্দসই কেউ আছে নাকি?”
“হুম! আছে বলেই তো দেরি করতে চাইছি না,,,”
চলবে,,,,