#নয়নাভিরাম (পর্ব-৩)
♡আরশিয়া জান্নাত
ফুটন্ত পানিতে চা পাতা দিয়ে বোকা বনে গেছি,অন্য সময় চা পাতা দিতেই কালার চেইঞ্জ হয়ে চা-পাতার ঘ্রাণ বের হয়। সেই ঘ্রাণটা আমার ভীষণ প্রিয় বলেই চা বানানোর সময় মায়ের পাশে থাকি। কিন্তু আজ কেন ঘ্রাণ বের হচ্ছেনা বুঝে আসছে না। বেশ কিছুক্ষণ সিদ্ধ করে বিরক্ত হয়ে মা কে ডেকে আনতেই উনি চেঁচিয়ে বললো,তুই কি রে মিমি এখনো চা পাতা আর কালো জিরার মধ্যে পার্থক্য বুঝিস না? তোকে আমি কিভাবে বিয়ে দিবো বুঝিনা!
আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,এজন্য ভালো করতে নেই। ভাবলাম আজ বিকেলের চা আমি বানিয়ে সবাইকে দিবো তাও হলোনা। তুমি জারে লেভেল এটে দিবা না?
মা আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললো ,তুই ছাড়া এই সমস্যা বাসার আর কারো হবেনা।
মনের দুঃখে ছাদে গিয়ে দেখি নাহিদ আর সিয়াম ক্রিকেট খেলছে। আমি গিয়ে ঢুকতেই ওরা খেলা বন্ধ করে চলে যাচ্ছিল। আমি ওদের থামিয়ে বললাম,চলে যাচ্ছিস কেন তোরা? চল আমিও খেলবো।
নাহিদ ভ্রু কুঁচকে বললো,হ্যাঁ তোমার সঙ্গে খেলবো আর তুমি বল মেরে অন্য বিল্ডিং এর গ্লাস ফাঁটাবে লাগবেনা তোমার সঙ্গে খেলার।
— ক্রিকেট খেলবি আর কিছু ভাঙবে না তা হয় নাকি? সাকিব আল হাসান কি পাড়ার কারো গ্লাস ভাঙা ছাড়া ক্রিকেটার হয়েছে? এতো সুন্দর ছক্কা মেরেছি সেই প্রশংসা করলিনা,অথচ গ্লাস ভাঙার দোষ দিলি। যা এবার আস্তে খেলবো,চল।
সিয়াম–না না তুমি আস্তে খেললে আরেক ভেজাল, ছাদের টব ভাঙবা।
–উফফ। তাহলে চল মাঠে যাই?
সিয়াম–মাঠে বড় ভাইরা খেলতে দিলে তো?
–আমি গেলেই দিবে দেখিস
নাহিদ–আগে প্রমিস করো আমার ব্যাট ভাঙবা না।
–ভাঙলেও কিনে দিবো।
তারপর মাঠে গিয়ে দেখি সবাই জায়গা দখল করে আরামছে খেলছে। ছোট ভাইয়াকে ডাক দিতেই ভাইয়া এসে বললো,কি রে তুই আবার এসেছিস?তোকে না বলছি এখানে খেলতে আসবিনা।
–ভাইয়্যু খেলতে মন চাইছে। তোর টিমে নে নাহয় জায়গা করে দে আমরা খেলি।
–হ এরপর কারো না কারো মাথা ফাটাবি। তোরে দেখলেই এখন সব কয়টা ভাগবো। যা তো বাসায় গিয়ে টিভি দেখ।
–জানতাম তো তুই আমার সৎ ভাই। আজ যদি আমি তোর রক্তের বোন হতাম এটা বলতি না।আমাকে তো ডাস্টবিন থেকে তুলে আনছে।তাই দাম নাই আমার।
–মিমি নাটক করবিনা একদম। যা তো সিরিয়াস খেলা চলতেছে।
আমি রাগ করে লেকে চলে গেলাম(লেকটা আমাদের বাসা থেকে দশ মিনিট দূরে। তাই ওখানে প্রায়ই যাওয়া হয়)। ধুরর কেউ ভালোবাসেনা আমারে, জীবনডা বেদনার।
লেকের সামনে বসে একটার পর একটা ঢিল ছুড়ছি আর নিজে নিজে হাজারটা কথা বলছি।এমন সময় একজন এসে বললো, Excuse me Medam?
আমি তাঁর দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বললাম,কি সমস্যা?
সে কাঁচুমাচু করে বললো,সমস্যা কেন হবে।কোনো সমস্যা না।
–তাহলে কি চাই?
–আপনি এভাবে রেগে কথা বললে তো বলতে পারবো না মেডাম।
–আপনি আমার চেনা কেউ? নাকি প্রাণের সখা যে হেসে হেসে কথা বলবো?
–আপনি এর মধ্যেই ভুলে গেলেন? সেদিন এই পার্কেই তো আমাদের দেখা হয়ে ছিল। আপনি আমায় এডভাইজ দিয়েছিলেন আমি যেন ব্রেকাপ করি।
আমি তাঁর দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললাম,আপনার নাম মেহবুব?
তিনি মাথা নাড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে?
–ভালোই হয়েছে আপনি এসেছেন।এমনিতেও আপনার সঙ্গে আমার কথা বলার ছিল।
–সিরিয়াসলি?? আমাকে খুঁজছিলেন আপনি? Wow, What a pleasant surprise for me!
–এতো আনন্দিত হবার কি আছে?
–আপনাকে আমি কত খুঁজেছি জানেন?
–মানে? আমাকে খোঁজার কি ছিল!
–তো খুঁজবো না? আপনি সেদিন বললেন না আমার ধৈর্যের উপর আপনি ক্র্যাশড? আমি যেন আপনার সঙ্গে,,,,,
–আরেহ মিয়া কিসব কন এসব? ঐটা তো কথার কথা বলছি আপনার গফের ঢং দেইখা। যাই হোক শোনেন আমার মতো অচেনা মেয়ের দু তিন লাইন কথা শুনে ব্রেকাপ করা টা আপনার ভুল ছিল।যদিও ব্রেকাপ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হইছে।তবুও এখন এখানে আমার উপর পুরা দোষ আসছে, এটা ঠিক না। আপনি আপনার গফের সাথে সব মিটমাট করেন…..
–কিন্তু এটা তো সম্ভব না।
–কেন সম্ভব না? এতো দিন তো ঠিকই সম্ভব ছিল এখন কেন অসম্ভব?
— এতোদিন তো আপনাকে দেখি নি মেডাম!
–মেডাম মেডাম করেন কেন আমি আপনার কোন ক্লাসের মেডাম?
–আপনি সবসময় এভাবে রেগে কথা বলেন?
— হ্যাঁ।কোনো সমস্যা?
–আপনি বোধহয় আজ খুব রেগে আছেন আমি বরং পরে এ বিষয়ে কথা বলবো। আচ্ছা আপনার ফোন নাম্বার বা ঠিকানা পেতে পারি?
আমি রেগে তাঁর দিকে তেড়ে যেতেই সে বলল, ওহ স্যরি আমি যাই বরং পরে কথা হবে। আল্লাহ হাফেজ
আচ্ছা পাগল জুটছে দেখি! দুইদিনেই পুরান ভালোবাসা ফুড়ুৎ? এতো সহজ নাকি প্রেম ??
______________
আপুর সাথে শপিংমলে এসে আমি মহাবিরক্ত হয়ে গেছি।একটা মানুষ এতো সময় নিয়ে ঘুরতে পারে আপুর সাথে না আসলে জানা যেত না।এজন্য আমি শপিং এ আসিনা।কিন্তু আজ এসেছি পাহারা দিতে।আমার ক্ষীণ সন্দেহ আপুর বফ আছে।শপিং এর বাহানা দিয়ে সে তাঁর সঙ্গেই মিট করতে এসেছে।সন্দেহ টা আরো পাকাপোক্ত হলো যখন আমি সঙ্গে যাবো বলায় আপু সাথে সাথে ফোন হাতে নিলো।এমনিতেই আমার ডিটেকটিভ মাইন্ড সবকিছুতে রহস্য খুঁজে,তার উপর এমন লক্ষণ তো এড়ানো যায় না।আপু ইচ্ছে করে দুনিয়ার ড্রেস দেখছে কিন্তু কিছুই নিচ্ছেনা।শেষে আমাকে তিনটা ড্রেস ধরাই দিয়ে বললো,যা তো ট্রায়াল দিয়ে দেখ সব ঠিকঠাক আছে কিনা।
–আমার জন্য দেখছো কেন? আমিতো কিনবোনা
–তোরে কিনতে বলছে কে? এগুলো আমি তোরে কিনে দিবো। যাস না মাপ সব ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করে আয়।
আমি ঠিকই বুঝলাম নিশ্চিত ঐ পোলা আশেপাশেই আছে।সেজন্যই আপু আমাকে ট্রায়াল রুমে পাঠাচ্ছে।আমিও কম না ট্রায়াল রুমে ঢুকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চুপি চুপি বেরিয়েছি।
খানিকটা দূরে দেখি আমার ধারণাই সত্যি।আপুর সঙ্গে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।ঝটপট দু চারটা ছবি তুলে পিছু ফিরে যেতেই একজনের পায়ে পাড়া দিয়ে বসলাম।
“স্যরি স্যরি! আমি একদম দেখতে পাইনি আপনি ঠিক আছেন তো?”
সে রেগে বললো,আপনি কি কখনোই দেখে চলতে পারেন না মিস রুমাইসা? সবসময় কোন দিকে মনোযোগ থাকে আপনার?
আমি চেহারার দিকে তাকিয়েই আৎকে উঠে বললাম, স্যার আপনি এখানে?
–হাইট তো কম না তারপরো এমন ডাকাত মার্কা হিল পড়েছেন কেন? আমার পা বোধহয় শেষ স্টুপিড মেয়ে একটা।
স্যার রেগে আরো কিছু বকাঝকা করে চলে গেল।আমার কপাল কত্ত ভালো তা ভেবে মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে যাই।শহরে কি আর কোনো শপিং মল ছিল না স্যারকে এখানেই আসতে হলো!
বাসায় ফিরেই দাদীজানের রুমে গিয়ে উনার কোলে মাথা রেখে বললাম,দাদীজান আমি কবে ঠিকঠাক চলতে পারবো বলো তো! যতো চাই সাবধানে চলাফেরা করবো কিছু ভাঙবোনা কাউকে সমস্যায় ফেলবোনা ততোই এসব বেশি করি।আমার আর ভাল্লাগেনা
দাদীজান আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না বুবু। আমাগো একেক জনেন একেক খুঁত আছে। কেউই সবদিক দিয়া ভালা না। যখন তোর বিয়া হইবো বাচ্চাকাচ্চা হইবো দেখবি সব ঠিক হইয়া যাইবো।
–তোমার সব কথার একটাই কথা বিয়ে। তোমার ধারণা সবকিছুর একটাই সমাধান! বিয়ে করলেই যদি সব ঠিক হয়ে যেত তাহলে সবাই বিয়ে করতো অন্য কিছু করতো না।
–হিহিহি বিয়াই তো সব সমস্যার সমাধান। দেখ বুবু আমাগো আদি পিতা আদম আঃ যখন জান্নাতে আছিল,তাঁর কোনোকিছুর অভাব ছিল না।জান্নাতের খানা,সুন্দর বাগান, কিছুরই তো অভাব নাই।তাও মন কিন্তু শান্তিতে আছিল না।তাইনের মনে কিসের একটা অভাব।আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তো সব জানেন।তাইনে আদম আঃ এর বুকের পাঁজর দিয়া মা হাওয়া আঃ রে বানাইছে।তখন গিয়া আদম আঃ এর মনের অশান্তি দূর হইছে।আমাগো জীবনে যতো অশান্তিই থাকুক না কেন জান্নাতের সাথী মানে জীবনসঙ্গী যদি পাশে থাকে সব দূর হইয়া যায়। কঠিন রাস্তাও সহজ লাগে,অসম্ভব ও সম্ভব হইয়া যায়।
–ওহ এই ব্যাপার! কিন্তু বিয়ের পর যদি দেখি বর সুবিধার না? তখন সমস্যা আরো বাড়বেনা?
— নিয়্যত ভালা রাখ। নিয়্যত আরমানে বরকত। যদি খারাপ ও হয় তাইলে বুঝবি ভাগ্যে আছিল এটা আল্লাহ পরীক্ষা নিতাছে,এর বিনিময়ে নিশ্চয়ই মাফ করবো। সবসময় আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকবি বুবু।যাই হোক কখনো নিরাশ হবিনা।
–তুমি অনেক ভালো দাদীজান। I love u উম্মাহ।
দাদীজান হাসতে হাসতে বললো, I love u too বুবুন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, বাব্বাহ আনজুমান বেগম এটাও কয় এখন?
–তুই কি ভাবোস শুধু তোরাই জানোস আমরা জানিনা?
–না না সেটা ভাবমু ক্যান। আমি জানিতো আমার দাদীজান সব জানে। দাদাজানরে বলছিলা কোনোদিন?
দাদীজান লাজে রাঙা হয়ে বললেন, এসব মুখে কইতে হয়না। মনে জানলেই চলে।
আমি মুগ্ধ চোখে আমার প্রৌঢ়ত্ত্বে পৌঁছানো দাদীজানের নিষ্পাপ হাস্যোজ্জল চেহারা দেখি।জীবন থেকে বিশেষ কোনো চাহিদা না থাকা মানুষটা এভাবেই দাদাজানের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে থাকুক বাকিটা সময়।
______________
আফরোজা আহমেদ সেই কখন থেকে ছেলের অপেক্ষায় বসে আছেন। এ কয়দিন ছেলেটার কি যে হলো তাঁর বুঝে আসেনা। সবকিছু ঘড়ির কাটা মাফিক করা ছেলেটা আজকাল কোনোকিছুই সময়মতো করছেনা। রাতে ঠিকঠাক খেতেও চায় না,তাই তিনি নিজে বসে থেকে জোর করে খাইয়ে তবেই ঘুমাতে যান। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের কত রকম হতাশা থাকে, পরিবারের মানুষদের ঠিকঠাক বলেনা। কিন্তু আরশান তো সব কথা তাঁর মা কে বলতো। এবার কি এমন হলো যে মাকেও বলতে চাইছেনা?
আফরোজা আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,ইয়া আল্লাহ আমার ছেলেটার মন শান্ত করো। বিপদআপদ থেকে হেফাজত করো রাহমানুর রাহিম।
আরশান কলিং বেল চাপতেই তাঁর মা দরজা খুলে দিলো।আরশান মুচকি হেসে বললো,মা কত করে বলেছি এতো রাত অবধি জেগে থেকোনা।তবুও তুমি অপেকগ থাকো,
–যতোদিন না তোর জন্য অপেক্ষা করার কাউকে আনছি ততোদিন আমিই অপেক্ষা করবো।মায়ের জন্য টান থাকলে এতো দেরি করে ফিরতিনা।
আরশান হাতমুখ ধুয়ে চেয়ারে বসলো।তাঁর মা প্লেটে ভাত দিতে বললো, হ্যাঁ রে খোকা তোর কি কিছু হয়েছে? এমন মনমরা থাকিস কেন? ক্লাস নেওয়াতে প্রেশার হচ্ছে বেশি?
–না মা। আমি ঠিক আছি।
–মিথ্যে বলবিনা আমার সঙ্গে। কি হয়েছে বল না মা কে? তুই না আমার সোনা ছেলে এমন কষ্ট পাচ্ছিস কেন বাবা?
আরশানের বুকের পাথর যেন গলে গেল,জমিয়ে রাখা কষ্টের বাঁধ ভেঙে হঠাৎ করেই শব্দ করে কেঁদে ফেললো। কান্নামিশ্রিত গলায় বললো, মা নিপুণ আমায় ছেড়ে চলে গেছে। আমি নাকি ওর লাইফ পার্টনার হবার যোগ্যতা রাখিনা। আমার সঙ্গে থেকে ওর এতোগুলো বছর অযথাই নষ্ট হয়েছে। ও আমায় আর ভালোবাসে না মা,,,
চলবে,