৩য় পর্ব
#নন্দিত_নরকে – হুমায়ুন আহমেদ
আমাদের সংসারে কী–একটা পরিবর্তন এসেছে। সুর কেটে গেছে কোথাও। শীলু আমার সমস্ত চেতনা এমনভাবে আচ্ছান্ন করে রেখেছে যে, আমি ঠিক কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। মা ভীষণরকম নীরব হয়ে পড়েছেন। শঙ্কিতভাবে চলাফেরা করছেন। তাঁর হতাশ ভাবভঙ্গি, নিচু সুরে টেনে–টেনে কথা বলা সমস্তই বলে দেয় কিছু একটা হয়েছে। বাবা এসে প্রায়ই আমার ঘরে বসেন। নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় দু— একটি কথাবার্তা বলেন : কেমন পড়াশোনা চলছে? বাজারের জিনিসপত্রের যা দাম!
আমি তাঁর ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারি, তিনি কিছু একটা বলতে চান। এলোমেলো কথা বলতে-বলতে এটি সেটি নাড়তে থাকেন, তারপর হঠাৎ করে উঠে চলে যান। কী বলতে চান তা বুঝে উঠতে পারি না। বাবাকে আমরা বড়ো ভয় পাই, নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাই না। মাকে যখন জিজ্ঞেস করি, কি হয়েছে মা? মা অবাক হবার ভান করে বলেন, হবে। আবার কি রে খোকা?
মা মিথ্যা বলতে পারেন না, কিছু লুকোতে পারেন না। আমি জোর দিয়ে বলি, বল, কী হয়েছে?
মা মেঝের দিকে তাকিয়ে টানা সুরে কাঁপা গলায় বললেন, কোথায় কি হায়েছে?
অথচ প্রায়ই দেখছি বাবা আর মা ফিসফিস করে আলাপ করছেন। বিরক্তিতে বাবার ভ্রূ কুঁচকে উঠছে ঘন ঘন। অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে বসে থাকছেন। পরশু রাতে মা গুনগুন করে কাঁদছিলেন। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, কে যেন ইনিয়েবিনিয়ে গান গাইছে। রাবেয়া বলল, ও খোকা, ও ঘরে মা কাঁদছে রে।
রুনু বলল, সত্যি দাদা, মা কাঁদছে। আমি ভেবেছি–বুঝি বেড়াল।
রাবেয়া গলা উঁচু করে ডাকল, মা, ও মা, কাঁদছ কেন?
মা চুপ করে গেলেন। রাবেয়া আবার ডাকল, মা, ও মা!
মা ধারা— গলায় বললেন, কি?
তুমি কাঁদছিলে কেন?
আমি সমস্ত কিছু বুঝতে চাই। আমি সবাইকে ভালোবাসি। যে-সংসার বাবা গড়ে তুলেছেন, সেখানে আমার যা ভূমিকা, আমি তার চেয়ে অনেক বেশি করতে চাই। যদি কোনো জটিলতা এসেই থাকে, তবে সে-জটিলতা থেকে আমি দূরে থাকতে চাই না। আমি চাই সবাই সুখী হোক। রুনুশীলুর মতো একটি ময়না এনে পুষুক, যেটি সময়ে-অসময়ে মানুষের মতো সুখের শিস দিয়ে উঠবে।
দুপুরবেলা ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ রাবেয়া আমায় ডেকে তুলল। উত্তেজনায় তার চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে।
ও খোকা, শুনছ, আমার বিয়ে।
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তোকালাম? রাবেয়া খিলখিল করে হেসে বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না? আল্লার কসম, সত্যি বিয়ে, আম্মাকে জিজ্ঞেস করে দেখ।
কখন বিয়ে?
আজ বিকেলে। এখন আমি গোসল করে সাজব! তুমি আবার সবাইকে বলে বেড়িও না খোকা, আমার বুঝি লজ্জা নেই?
মাকে জিজ্ঞেস করতেই মা বললেন, বরপক্ষের ওরা বিকেলে দেখতে আসবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, পাগল মেয়েকে বিয়ে করবে কে?
মা বললেন, পাগল কোথায় রে, ঐ একটু যা আছে তা সেরে যাবে।
বরপক্ষের লোকজন জানে?
মা ভীত কণ্ঠে বললেন, আমি ঠিক বলতে পারি না তোর আরা বলেছে কি না। তুই আপত্তি করিস না খোকা।
কিন্তু হঠাৎ বিয়ের কী হল?
আমি জানি না। তোর আর। শাল ঠিক করেছেন। তোর আরাকে জিজ্ঞেস কর।
দেখতে আসবে পাঁচটায়, চারটার ভিতরেই সব তৈরি হয়ে গেল। মা ঘামতে ঘামতে খাবার তৈরি করলেন। বসবার ঘরে নতুন পর্দা লাগান হল; ট্রাঙ্কে তোলা টেবিল-ক্লথ বিছিয়ে দেয়া হল টেবিলে। মন্টু সাইকেলে করে দূর কোথাও থেকে ফুল এনে ফুলদানি সাজাল। রুনু রাবেয়ার একটি শাপলা রঙের শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। রাবেয়া ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল, মা, রুনু যে বড়ো আমার শাড়ি পরেছে, ময়লা করে ফেলবে তো।
ময়লা হলে ইন্ত্রি করিয়ে দেব।
যদি ছিঁড়ে ফেলে?
কি ভ্যাজর ভ্যাজার করছিস।
হুঁ, আমি তো ভ্যাজর ভ্যাজর করছি। আমার যদি আজ বিয়ে না হত, দেখতে রুনুর চুল ছিঁড়ে ফেলতাম না!
রাবেয়া পরেছে বেশ দামী আসমানী রঙের শাড়ি। সাধারণ সাজগোজের বেশি। কিছু করে নি। এতে তাকে যে এত সুন্দরী লাগবে, কে ভেবেছে! বড়ো বড়ো ভাসা চোখ, বরফি-কাটা চিবুক, শিশুর মতো চাউনি। সব মিলিয়ে রূপকথার বইয়ে আকা বন্দী রাজকন্যার ছবি যেন।
মাস্টার কাকা একটা ফর্সা পাঞ্জাবি পরে বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছেন, বরপক্ষীয়দের অভ্যর্থনার জন্য। পাঁচটায় তাদের আসার কথা, ছটা পর্যন্ত কেউ এল না। ঠিকানা নিয়ে মাস্টার কাক খুঁজতে গেলেন। জানা গেল কেউ আসবে না। একটি পাগল মেয়ে গছিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র তারা কী করে যেন জেনেছে।
লজ্জায় আমার চোখে পানি এসে পড়ল। কী দরকার ছিল এ সবের? না-ই হত বিয়ে। মা কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, দরকার ছিল রে।
কী জন্যে?
আমার কেমন যেন সন্দেহ হয় খোকা!
কী সন্দেহ?
কাল তোর বাবা রাবেয়াকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে, তখন জানবি।
বাবা নামলেন রিকসা থেকে। রাবেয়া ধীরে-সুস্থে নামল। মুখ কালো করে বলল, মা, ডাক্তার আমাকে বেশি পরিশ্রম করতে নিষেধ করেছেন। এখন শুধু বিশ্রাম। তাই না বাবা?
বাবা মার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বললেন, এখন কী করবে?
ব্যাপারটা আমি জানলাম। রুনু জানল। মন্টু ফুটবল খেলতে বাইরে গেছে, শুধু সে-ই জানল না। রাবেয়ার নির্বিকার ঘুরে বেড়ানর ফল ফলেছে। ডাক্তার তাকে পরিশ্রম করতে নিষেধ করেছেন। এখন রাবেয়ার প্রয়োজন শুধু বিশ্রাম।
রাবেয়ার মাথার ঠিক নেই। ছোটবেলা থেকেই সে ঘুরে বেড়ােত চারদিকে। সব বাড়িঘরই তার চেনা। চাচা খালু দাদা বলে ডাকে আশেপাশের মানুষদের। তাদের ভিতর থেকেই কেউ তাকে ডেকে নিয়েছে। এমন একটি মেয়েকে প্রলুব্ধ করতে কী লাগে? মোর রাত্রে ঘুম হয় না। তাঁর চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। রুনু আর শীলুদের বাসায় গান শুনতে যায় না। নাহার ভাবী বেড়াতে এসে বললেন, কি ব্যাপার, তোমরা কেউ দেখি আমাদের ওখানে যাও না, রাবেয়া পর্যন্ত না।
রুলু কথা বলে না। মা নিচু গলায় বলেন, রাবেয়ার অসুখ করেছে মা।
কি অসুখ, কই জানি না তো?
এমনি শরীর খারাপ।
বলতে গিয়ে মায়ের কথা বেধে যায়। অসহায়ের মতো তাকান।
ব্যাপারটার উৎস রাবেয়ার কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করলাম। আমি। সন্ধ্যায় যখন রুনু মাস্টার কাকার কাছে পড়তে যায়, ঘরে থাকি আমি আর রাবেয়া। তখনই আমি কথা শুরু করি :
রাবেয়া।
কি?
কোথায় কোথায় বেড়াতে যাস তুই?
কত জায়গায়। চেনা বাড়িতে।
খুব ভালো লাগে?
হুঁ।
কাকে কাকে ভালো লাগে?
সবাইকে!
ছেলেদের ভালো লাগে?
হুঁ।
নাম বল তাদের।
একটানা নাম হলে চলে সে। তাদের কাউকেই সন্দেহভাজন মনে হয় না। আমার। সবাই বাচ্চা বাচ্চা ছেলে। রাবেয়াকে বড়ো আপা ডাকে।
তারা তোকে আদর করে, রাবেয়া?
হুঁ।
কী করে আদর করে?
আমার সঙ্গে খেলে, আর—
আর কি?
গল্প করে।
কিসের গল্প?
ভূতের।
ইতস্তত করে বলি, তোকে কেউ চুমু খেয়েছে রাবেয়া?
যাহ! তাই বুঝি খায়?
মার কথাগুলি হয় আরো স্পষ্ট, আরো খোলামেলা। আমার লজ্জা করে। মা আদুরে গলায় বলেন, রাবেয়া, কে তোর শাড়ি খুলেছিল? বল তো নাম।
যাও মা, তুমি তো ভারি…
মা রেগে যান। হপাতে হাঁপাতে বলেন, তাহলে এমন হল কেন? বল তুই হারামজাদী?
রাবেয়া বলে না কিছু, মা ফুঁপিয়ে—ফুঁপিয়ে কাঁদেন। রাবেয়া বড়ো বড়ো চোখে তাকায়। বলে, কাঁদা কেন, মা?
বল, কার সঙ্গে তুই শুয়েছিলি?
রাবেয়া চুপ করে থাকে। কথাই হয়তো বুঝতে পারে না। বাবা পাগলের মতো হয়ে উঠেছেন। মেজাজ হয়েছে খিটখিটে, অল্পতেই রেগে বাড়ি মাথায় তোলেন। রুনু স্কুল থেকে ফিরতে দেরি করেছে বলে মার খেল সেদিন। এক দিন দেখি বাবা গণক নিয়ে এসেছেন, পাড়ার সব যুবকদের নাম লিখে কী-সব মন্ত্র পড়ছে সে।
রাবেয়ার অসুখের প্রত্যক্ষ চিহ্ন ধরা পড়ল এক দিন ভোরে। চা খেয়েই ওয়াক ওয়াক করে বমি করল সে। যদিও তার শারীরিক অস্বাভাবিকতা নজরে আসার সময় এখনো হয় নি, তবু তার শরীরে আলগা শ্ৰী আসছিল। একটু চাপা গাল ভরাট হয়ে উঠছে, ভুরু মনে হচ্ছে আরো কালো, চোখ হয়েছে উজ্জ্বল, চলাফেরায় এসেছে এক স্বাভাবিক মন্থরতা। স্কুলের হেড-মাস্টারের বউ এক দিন বেড়াতে এসে বললেন, দেখ ও বউ, তোমার মেয়ে কেমন হাঁটছে–ঠিক যেন পোয়াতি।
কথাগুলি আমার বুকে ধক করে বিধেছে। কিছু একটা করতে হবে এবং খুব শিগগিরই। সবার জানিবার ও বুঝবার আগে। একটি করে দিন যাচ্ছে, অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সবাই। কিন্তু কী করা যায়? বাবা নিশ্চয়ই কিছু একটা ভেবেছেন। এক বার ইচ্ছে হয় তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু সাহসে কুলোয় না। বাবাকে বড়ো ভয় করি আমরা।
সেদিন রাতে শুনলাম। বাবা চাপা কণ্ঠে বলছেন, বিষ খাইয়ে মেরে ফেল মেয়েকে। মা বললেন, ছিছি, বাপ হয়ে এই বললে? বাবা বিড়বিড় করে বললেন, আমার মাথার ঠিক নেই শানু, তুমি কিছু মনে করো না। পাগল মেয়ে আমার! বাবার দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনলাম। অনেক রাত অবধি ঘুম হল না। আমার। একসময় রাবেয়া ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। কাতর গলায় বলল, খোকা।
কি? বাথরুমে যাবি?
উঁহু!
কী হয়েছে? খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ।
বমি করবি?
না।
স্বপ্ন দেখেছিস?
হুঁ।
কী স্বপ্ন?
মনে নেই।
ঘুমিয়ে পড়, ভালো লাগবে।
আচ্ছা।
রাবেয়া শুয়ে পড়ল আবার। মুহুর্তেই উঠে বসে বলল, খোকা।
কি?
পলা এসেছে।
কে এসেছে?
পলা। দোর খুলে দেখ, বারান্দায় বসে আছে। আমি ডাক শুনলাম।
দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম দু জনেই। কোথায় কি? খা-খাঁ করছে চারদিক। রাবেয়া ডাকল, পলা, পলা।
মা বললেন, কে কথা বলে?
আমি রাবেয়া, মা।
বাবা ধমকে উঠলেন, যাও যাও, ঘুমুতে যাও! কী কর এত রাত্ৰে?
শব্দ শুনে মাস্টার কাকা বাইরে আসেন।
কী হয়েছে খোকা?
রাবেয়া বলে, পলাকে ডাকছিলাম কাকা।
যাও শুয়ে পড়, পলা কোথেকে আসবে এত রাত্তিরে?
শুতে শুতে রাবেয়া বলল, খোকা, পলাকে একটা চামড়ার বেল্ট কিনে দেবে? গলায় বেধে দেব।
আচ্ছা!
আর একটা লম্বা শিকল কিনে দেবে?
দেব!
আচ্ছা, আর একটা জিনিস দেবে?
কি জিনিস?
নাম মনে নেই আমার। দেবে তো?
আচ্ছা দেব।
কবে? কাল?
না, চাকরি হোক আগে।
বাবা বলে উঠলেন, কি ভ্যাজর ভ্যাজর করছিস তোরা? ঘুমো। সারা দিন খেটে এসে শুই, তাও যদি শান্তি পাওয়া যায়।
বহু আকাঙ্ক্ষিত চিঠিটি এল। সরকারী সীল থাকা সত্ত্বেও কিছুই বুঝতে পারি নি। আর দশটা খাম যেমন খুলি, তেমনি আড়াআড়ি খুলে ফেললাম। আমাকে তাঁরা ডাকছেন। রসায়নশান্ত্রের লেকচারারশিপ পেয়েছি, একটি কলেজে। প্রাথমিক বেতন সাড়ে চার শ টাকা, ইয়ারলি পাঁচশ টাকা ইনক্রিমেন্ট। লেখাগুলি কেমন অপরিচিত মনে হচ্ছিল। খুব খুশি হয়েছি। এমন একটা অনুভূতি আসছিল না। অথচ আমি সত্যি খুশি হয়েছি। এবং আমি সবাইকে সুখী করতে চাই। সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চাই, বুনুকে গাঢ় সবুজ একটি শাড়ি দিতে চাই, রোল নাম্বার থাটিন-এর গায়ে যেমন দেখেছি। এখন হয়তো সমস্তই আমার মুঠোয়, তবু সেই অগাধ সুখ, সমস্ত শরীর জুড়ে উন্মাদ আনন্দ কই? আমরা বহু কষ্ট পেয়ে মানুষ হয়েছি। আমাদের ছেলেমানুষি কোনো সাধ, কোনো বাসনা আমার বাবা-মা মেটাতে পারেন নি। আমাদের বাসনা তাঁদের দুঃখই দিয়েছে। আজ আমি সমস্ত বেদনায় সমস্ত দুঃখে শান্তির প্রলেপ জুড়াব। আলাদীনের প্রদীপ হাতে পেয়েছি, শক্তিমান দৈত্যটা হাতের মুঠোয়।
মা আমার চাকরি হয়েছে।
মা দৌড়ে এলেন। বহুদিন পর তাঁর চোখ আনন্দে ছলছল করে উঠল। বললেন, দেখি। আমি চিঠিটা তার হাতে দিলাম। মা পড়তে জানেন না, তবু উল্টেপান্টে দেখলেন সেটি। এমনভাবে নাড়াচাড়া করছিলেন, যেন খুব একটা দামী জিনিস হাতে। মা বললেন, বেতন কত রে?
সাড়ে চার শ।
বলিস কি? এত।
আমি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললাম, বেশি আর কোথায়? বলেই আমি লজ্জা পেলাম। ভালো করেই জানি, টাকাটা আমার কাছে অনেক বেশি। মা বললেন, এবার বিয়ে করাব তোকে।
কী যে বলেন।
বেশ একটি লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে আনতে হবে। রূপবতী কিন্তু সাধাসিধা, নাহার মেয়েটির মতো।
মা কল্পনায় সুখের সাগরে ড়ুব দিলেন।
শহরে তুই বাসা করবি?
তা তো করতেই হবে।
বেশ হবে, মাঝে মাঝে তোর কাছে গিয়ে থাকব।
মাঝে মাঝে কেন, সব সময়ে থাকবেন।
না রে বাপু, সংসার ফেলে যাব না।
মা ছেলেমানুষের মতো হাসলেন। আমি বললাম, প্রথম বেতনের টাকায় আপনাকে কী দেব মা?
তোর বাবাকে একটা কোট কিনে দিস, আগেরটা পোকায় নষ্ট করেছে।
বাবারটা তো বাবাকেই দেব, আপনাকে কী?
মা রহস্য করে বললেন, আমায় একটা টুকটুকে বউ এনে দে।
মাস্টার কাকাও খবর শুনে খুশি হলেন। তাঁর খুশি সব সময়ই মৌন। এবার একটু বাড়াবাড়ি ধরনের আনন্দ করলেন। নিজের টাকায় প্রচুর মিষ্টি কিনে আনলেন। অনেক মিষ্টি। যার যত ইচ্ছে খাও। কাকা বললেন, সুখ আসতে শুরু করলে সুখের বান ডেকে যায়, দেখো খোকা, কত সুখ হবে তোমার।
রুনু স্কুল থেকে এসে বলল, দাদা, তোমার নাকি বিয়ে?
কে বলেছে রে?
মা, হি হি।
খুব হি হি, না? তোকে বিয়ে দি যদি?
যাও, খালি ঠাট্টা। কাকে তুমি বিয়ে করবে দাদা?
দেখি ভেবে!
আমি জানি কার কথা ভাবছি।
কার কথা?
শীলার কথা নয়?
পাগল তুই!
অবহেলায় উড়িয়ে দিলেও বুঝতে পারছি, আমার কান লাল হয়ে উঠছে। অস্বস্তি বোধ করছি। শীলুকে কেন যে হঠাৎ ভালো লাগল। যত বার তাকে দেখি, তত বার বুক ধ্বক করে ওঠে। একটা আশ্চর্য সুখের মতো ব্যথা অনুভব করি। সমস্ত শরীর জুড়ে শীলুশীলু করে কারা বুঝি চেঁচায়। আমি একটু হেসে বলি, কে ভাবে তোর শীলুর কথা?
না, এমনি বলছি মা। বড়ো ভালো মেয়ে শীলু।
হুঁ। তুই কাকে বিয়ে করবি রুনু?
যাও দাদা, ভালো হবে না বলছি।
আমার এক জন বন্ধু আছে, খুব ভালো ছেলে–
দাদা, আমি কিন্তু কেঁদে ফেলব এবার।
আনন্দ-অনুষ্ঠান থেকে মন্টু বাদ পড়ল। বড়ো নানার বাড়িতে গিয়েছে সে, আগামী কাল আসবে। বাবা এলেন রাত নটার দিকে। মা খবরটা না দিয়ে মিষ্টি খেতে দিলেন বাবাকে।
মিষ্টি কিসের?
আছে একটা ব্যাপার।
বাবা আধখানা মিষ্টি খেলেন, ব্যাপার জানার জন্যে উৎসাহ দেখালেন না। মা নিজের থেকেই বললেন, খোকার চাকরি হয়েছে। সাড়ে চার শ টাকা মাইনে।
বাবা খুশি হলেন। থেমে থেমে বললেন, ভালো হয়েছে। আমি চাকরি ছেড়ে দেব এবার। বয়স হয়েছে, আর পারি না। রাবেয়া, রাবেয়া কোথায়?
ঘুমিয়েছে, শরীর খারাপ।
ভাত খায় নি তো?
না, একটা মিষ্টি খেয়েছে শুধু।
আহ্! বললাম খালিপেটে রাখতে, মিষ্টিই—বা দিলে কেন?
সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়লাম সেদিন। রাত একটার দিকে মা পাগলের মতো ডাকলেন, খোকা, ও খোকা।–শিগগির ওঠ। ও খোকা, খোকা।
খুব ছোটবেলায় গভীর রাতে একবার মা এমন ব্যাকুল হয়ে ডেকেছিলেন। ভূমিকম্প হচ্ছিল তখন। আমাদের বাসা থেকে চল্লিশ গজের ভিতর নদী সাহেবদের ছেড়ে-যাওয়া পুরানো বাড়ি ধ্বসে পড়ে গিয়েছিল। আজকের এই গভীর রাতে মায়ের আতঙ্কিত ডাক আমাকে ভূমিকম্পের কথা মনে করিয়ে দিল। দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই মা বললেন, আয় আমার ঘরে, আয় তাড়াতাড়ি।
কী হয়েছে?
মা অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন। তিনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন। দরজা খোলা, চোখে পড়ল মায়ের বিছানায় রাবেয়া শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে বাবা গরুর মতো চোখে তাকিয়ে আছেন। রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। আমি থমকে দাঁড়ালাম। এ্যাবোরশান নাকি? কাকে দিয়ে কি করালেন? নাকি নিজে নিজেই কিছু খাইয়ে দিয়েছেন? বাবা ধরা-গলায় বললেন, খোকা, তুই মাথায় একটু হাওয়া কর, আমি এক জন বড়ো ডাক্তার নিয়ে আসি। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না।
ডাক্তার এলেন এক জন। গম্ভীর হয়ে ইনজেকশন করলেন।
আপনার মেয়েকে আমি চিনি।
বাবা ডাক্তারের হাত চেপে ধরলেন, বড়ো দুঃখী মেয়ে, মেয়েটাকে আপনি বাঁচান ডাক্তার।
ডাক্তার সেন্টিমেন্টের ধার দিয়েও গেলেন না। এক গাদা ঔষধ দিয়ে গেলেন। সকালে আরো দুটো ইনজেকশন করতে বললেন। দশটার দিকে তিনি আসবেন।
বাবা হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন, কেউ জানবে না তো ডাক্তার?
ডাক্তার বললেন, মান ইজ্জত পরের ব্যাপার, আগে মেয়ে বাঁচুক।
রাবেয়া চি চি করে বলল, মা, আমার কী হয়েছে?
কিছু হয় নি, সেরে যাবে, চুপ করে শুয়ে থাক।
বুকটা খালিখালি লাগছে কেন?
সেরে যাবে মা, দুধ খাবে একটু?
না।
আমি আচ্ছন্নের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঘরে লম্বালম্বি একটা ছায়া পড়ল। তাকিয়ে দেখি মাস্টার কাকা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। একটু কাশলেন তিনি। বাবা হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, শরীফ মিয়া, আমার মেয়েটাকে বাঁচাও।
মাস্টার কাকা মৃদু গলায় বললেন, শহর থেকে খুব বড়ো ডাক্তার আনব আমি। খোকা, তোর সাইকেলটা বের করে দে।
আমি বললাম, আমি যাই কাক?
না, তুমি গুছিয়ে বলতে পারবে না। তুমি থাক।
বাবা ধমকে উঠলেন, ওর কথা শুন না। ও একটা পাগল-ছাগল। তুমি যাও। নিজেই যাও।
রুণু কখন-বা এসেছে। আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। ঘরময় নষ্ট রক্তের একটা দম আটকান অস্বস্তিকর গন্ধ। রাবেয়া চোখ বুজে শুয়ে। তার মুখটা কী ফর্সাই না দেখাচ্ছে। বাবা বললেন, মা রাবু, একটু দুধ খাও।
না।
মাথায় পানি দেব মা?
না বাবা।
রাবেয়া চোখ মেলে বাবার দিকে তাকাল। বলল, বাবা।
কি মা?
আমার বুকটা খালিখালি লাগছে কেন?
সেরে যাবে মা।
তুমি আমার বুকে হাত রাখবে একটু? এইখানে?
এমনি করেই ভোর হল। মন্টু এল ছটায়।
সে হাতভম্ব হয়ে গেল। বাবা গিয়েছেন ইনজেকশন দেবার লোক আনতে। রাবেয়া মন্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, মন্টু আমার অসুখ করেছে।
মন্টু বিস্মিত হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল। রাবেয়া আবার বলল, মন্টু, আমার বুকটা খালিখালি লাগছে।
মন্টু রাবেয়ার মাথায় হাত রাখল। মা নিঃশব্দে কাঁদছেন। রুনু আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। সকালের রোদ এসে পড়েছে জমাট-বাঁধা কালো রক্তে। রাবেয়া আমাকে ডাকল, খোকা, ও খোকা।
আমি তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। নীল রঙের চাদরে ঢাকা রাবেয়ার শরীর নিষ্পন্দ পড়ে আছে। একটা মাছি রাবেয়ার নাকের কাছে ভনভন্ন করছে। রাবেয়া হঠাৎ করেই বলে উঠল, পলাকে তো দেখছি না। ও খোকা, পলা কোথায় রে? আমাদের চারদিকে উদ্বিগ্ন হয়ে পলাকে খুঁজলে সে। আর কী আশ্চৰ্য, বেলা নটায় চুপচাপ মরে গেল রাবেয়া। তখন চারদিকে শীতের ভোরের কী ঝকঝকে আলো!
গত বৎসর আমরা বড়ো খালার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। বড়ো খালার মেয়ে নিনাও এসেছিল মায়ের কাছে। প্রথম পোয়াতি মেয়ে। মা নিয়ে এসেছেন নিজের কাছে। নিনা আপা কি প্রসন্ন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন চারদিকে। প্রথম সন্তান জন্মাবে, তার কী প্রগাঢ় আনন্দ চোখে-মুখে। যদি ছেলে হয়, তবে তার নাম দেব কিংশুক, মেয়ে হলে রাখী। হোসে-হেসে বলে উঠেছিলেন নিনা আপা। আর তাতেই উৎসাহিত হয়ে রাবেয়া বলেছিল, আমিও আমার ছেলের নাম কিংশুক রাখব। আমরা সবাই হেসে উঠেছিলাম। রাবেয়া, নীল রঙের চাদর গায়ে জড়িয়ে তুই শুয়ে আছিস। হলুদ রোদ এসে পড়ছে তোর মুখে। কিংশুক নামের সেই ছেলেটি তোর বুকের সঙ্গে মিছে গেছে। যে—বুক একটু আগেই খালিখালি লাগছিল।
বারোটার দিকে ফিরে এলেন মাস্টার কাকা। সঙ্গে শহর থেকে আনা বড়ো ডাক্তার। আর মন্টু, দিনে-দুপুরে অনেক লোকজনের মধ্যে ফালা-ফালা করে ফেলল মাস্টার কাকাকে একটা মাছ-কাটা বঁটি দিয়ে। পানের দোকান থেকে দৌড়ে এল দু-তিন জন। এক জন রিকশাওয়ালা রিকশা ফেলে ছুটে এল। ওভারশীয়ার কাকুর বড়ো ছেলে জসীম দৌড়ে এল। ডাক্তার সাহেব চেঁচাতে লাগলেন, হেল্প! হেল্প! চিৎকার শুনে বাইরে এসে দাঁড়াতেই আমি দেখলাম, বঁটি হাতে মন্টু দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে তাকে জাপটে ধরে আছে কজন মিলে। রক্তের একটা মোটা ধারা গড়িয়ে চলেছে নালায়। মন্টু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা, ওকে আমি মেরে ফেলেছি।
আমার মনে পড়ল, হাস্নুহেনা গাছের নিচে মন্টু এক দিন পিটিয়ে একটা মস্ত সাপ মেরেছিল।
রাবেয়াকে ঘিরে সবাই বসে ছিল। আমি ঢুকতেই নাহার ভাবী বললেন, বাইরে এত গোলমাল কিসের?
আমি মায়ের দিকে তাকালাম, মা, এইমাত্র মন্টু মাস্টার কাকাকে খুন করেছে। আপনি বাইরে আসেন। মন্টুকে থানায় নিয়ে যাচ্ছে সবাই।
হাস্নুহেনা গাছের নিচে মন্টু একটা মস্ত চন্দ্রবোড়া সাপ মেরেছিল। সাপের মাথায় গোল বেগুনি রঙের চক্র। চার হাতের উপর লম্বা। মন্টু, মরা সাপটাকে কাঠির আগায় নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াতেই ছোট বাচ্চারা উল্লাসে লাফাতে লাগল। রাবেয়া খুশিতে হেসে ফেলে বলল, মন্টু, কাঠিটা আমার হাতে দে।
পলা আনন্দে ঘেউঘেউ করছিল। মাঝে মাঝে লাফিয়ে সাপটিাকে কামড়াতে গিয়ে ফিরে আসছিল। রাবেয়া পলার দিকে তাকিয়ে শাসাল, এই পলা এই, মারব থাপ্পড়।
সাপটাকে সবাই মিলে পুকুরপাড়ে কবর দিতে নিয়ে গেল। মিছিলের পুরোভাগে রাবেয়া। তার হাতের কাঠিতে সাপটা আড়াআড়ি ঝুলছে। মন্টু পলাকে নিয়ে দলের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল। সাপের জন্য লম্বা করে কবর খোঁড়া হল। মন্টু পুকুরপাড়ে বিষণ্ণভাবে বসেছিল।
কাকাকে মেরে ফেলবার পর মন্টুকে সবাই জাপটে ধরে রেখেছিল। জসী মন্টুর হাত শক্ত করে ধরে চেঁচাচ্ছিল, পুলিশে খবর দিন। পুলিশে খবর দিন। মাছকাটার বঁটিটা কাৎ হয়ে ঘাসের উপর পড়ে আছে। সেখানে একটুও রক্তের দাগ নেই। কাকা যেখানে পড়ে ছিলেন, সেখান থেকে একটা মোটা রক্তের ধারা ধীরে ধীরে নালার দিকে নেমে যাচ্ছিল। মন্টু আমায় দেখে বলল, দাদা, ওকে আমি মেরে ফেলেছি।
মন্টু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। আশেপাশে প্রচুর লোক জমা হয়ে গিজগিজ করছিল। মোটা ডাক্তার ভাঙা গলায় প্ৰাণপণে চেঁচাচ্ছিলেন, হেল্প! হেল্প! একটা পাংশুটে রঙের কুকুর মরা লাশটার কাছে ভিড়বার চেষ্টা করছিল।
মন্টুর কুকুরের রং ছিল সাদা। গলার কাছে কালো একটা ফুটকি। মন্টু কাঞ্চনপুর থেকে এনেছিল কুকুরটাকে। অল্প দিনেই ভীষণ পোষ মেনেছিল। মন্টু তাকে টুলকািঠ দিয়ে একটি চমৎকার ঘর বানিয়ে দিয়েছিল। আমি কুকুরটার নাম দিয়েছিলাম পলা। রাবেয়া মন্টুর কাছ থেকে আট আনা দিয়ে কিনে নিয়েছিল। মন্টুর বিক্রির ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু রাবেয়া পীড়াপীড়ি করছিল, মন্টু পলাকে আমি কিনব।
না। আপা, আমি পলাকে বেচব না।
আহা, দে না মন্টু। আট আনা পয়সা দেব আমি। দে না।
বললাম তো আমি বেচব না।
মন্টু দিয়ে দে, এমন করছিস কেন?
রাবেয়া সব সময় পলাকে নিয়ে বেড়াতে বেরুতি। পরিচিত। ঘরবাড়িতে গিয়ে বলত, খালাম্মা আমার পলাকে একটু দুধ দিন। আহা, চিনি দিয়ে দিন। শুধু শুধু দুধ বুঝি কেউ খায়?
মন্টু এক দিন একটা টিয়। পাখির বাচ্চা আনল কোথা থেকে। সেটি বাচ্চা হলেও খুব চমৎকার ছিল দেখতে। বারান্দায খাঁচা বুলিয়ে পাখিটিকে রাখা হত। ঠাণ্ডা লেগে এক দিন সেটি মারা গেল। মন্টু পাখির শোকে এক বেলা ভাত খেল না।
মন্টু আর মাস্টার কাকা সবচেয়ে ছোট ঘরটায় থাকতেন। ঘরটায় আলো আসত না ভালো। গরমের সময় গুমোট গরম। বাতাস আসার পথ নেই। মন্টুর হাজতবাসের দিনগুলি এখন কেমন কাটছে? মন্টু বয়স এখন উনিশ, সাত বাদ দিলে হয় বারো। বারো বৎসর সে আর মাস্টার কাকা একসঙ্গে একটি ঘরে কাটিয়েছে। মাস্টার কাকার অভাব সে অনুভব করছে কি? খুনের পর শুনেছি। অনেকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যায়। দিনরাত্তির খুন করা লোকের চেহারা, খুনের দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে থাকে। মন্টুর সে-রকম হবে না। তার বড়ো শক্ত নাৰ্ভ। মন্টুর মা, আমাদের বড়োমা যেদিন মারা গেলেন, মন্টু সেদিন নিতান্ত সহজভাবেই কাটাল। পরদিন শিমুলতলা গাঁয়ে ফুটবল ম্যাচ দেখতে গেল বাসায় কাউকে না বলে। বয়স অল্প ছিল। শোক বোঝবার বুদ্ধিই হয়তো হয় নি। কিন্তু আমার মনে হয় কম বয়সের জন্যে নয়। বড়োমার মতো তারও ইস্পাতের মতো শক্ত নাৰ্ভ ছিল। মন্টু দেখতে অনেকটা বড়োমার মতো। তার চাইবার ভঙ্গি, কথা বলার ভঙ্গি, সমস্তই বড়োমায়ের মতো। বাবার শোবার ঘরে বড়োমা আর বাবার একটা যৌথ ছবি আছে। বিয়ের ছবি। সেই ছবির দিকে তাকালেই মন্টুকে চেনা যায়। ছবির কাচে ময়লা জমে ছবিটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। তবু বড়োমার বালিকা বয়সের ছবি আমাদের আকর্ষণ করে। চৌঠা আগষ্ট আমাদের বাসায় একটা উৎসব হয়। ভুল বললাম, শোকের আসর হয়। বাদ-মাগরেব মিলাদ পড়ান হয়। বাবা বড়োমায়ের কবর জিয়ারত করেন। দু-একটি ফকিরমিসকিনকে খাওয়ান হয়। হাউমাউ করে বাবা বড়োমায়ের মৃত্যুদিন স্মরণ করে কিছুক্ষণ কাঁদেন। তাঁর শোকটা নিশ্চয়ই আন্তরিক, তবু সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন হাস্যকর লাগে। বিশেষ করে এই দিনটিতে মা মুখ কালো করে ভয়ে-ভয়ে ঘুরে বেড়ান। তাঁর ভাব দেখে মনে হয় চৌঠা আগষ্টের এই শোকের দিনটির জন্যে মা নিজেই দায়ী। বাবা সেদিন অতি সামান্যতম অতি তুচ্ছতম ব্যাপারেও মায়ের উপর ক্ষেপে যান। আমার কষ্ট হয়। বড়োমা আমাদের সবারই অতি শ্রদ্ধার মানুষ। রাবেয়া আর আমি অনেক দিন পর্যন্ত তাঁকে জড়িয়ে না ধরে ঘুমুতে পারি নি। যখন বয়স হয়েছে, তাঁর কোলে এসেছে মন্টু। আমি আর রাবেয়া দক্ষিণের ঘরে নির্বাসিত হয়েছি, তখনো তিনি মাঝে মাঝে এসে বলতেন, খোকা আজ তুই শুবি আমার সাথে। আগে আমার সঙ্গে ঘুমাবার জন্যে এত হৈচৈ করতিস, এখন যে বড়ো চুপচাপ?
বড়ো হয়েছি যে।
ওহ, কী মস্ত বড়ো ছেলে।
চলবে….