ধোয়ার-নেশা পর্ব (২১+২২)

0
1859

#ধোয়ার-নেশা

#রোকসানা-রাহমান

পর্ব (২১+২২)

অন্ত্রীশা উপুত হয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে,বালিশের উপর থুতনি দিয়ে সামনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। এ জানালাটা সে খুব একটা খুলেনা,শুধু খুব খুশির সময় নাহয় খুব মন খারাপ হলেই খোলে। এটাও দক্ষিন সাইডে থাকায় বৃষ্টিতে ভিজে উঠা শীতল মৃদু বাতাস ছুয়ে দিচ্ছে অন্ত্রীশাকে। বাতাসের সাথে সাথে বৃষ্টির গুড়িগুড়ি ফোটারাও অন্ত্রীশাকে ছুয়ে দিচ্ছে। বিছানার অনেকাংশই ভিজে উঠেছে। বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে নিজের চোখের পানিও ফেলছে।

“” পত্রীকন্যা!””

হঠাৎ কারো কন্ঠ পেয়ে অন্ত্রীশা ভয় পেয়ে পেছনে ঘুরতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। মুখে দিয়ে শব্দ করে বেড়িয়ে যেতে চাইলো ‘আপনি’ সম্বোধনটা। কিন্তু না বের হয়নি।

পালক বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে,মাথার চুলগুলো সুন্দর করে মাথার চারপাশে গোলাকারে ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে। সামনের চুলগুলো ভিজে কপালের সাথে ল্যাপ্টে গিয়ে ব্রুগুলোকে ছুই ছুই অবস্থা। চুল থেকে এখনো পানি টপটপ করে পালকের নাকে এসে পড়ছে। জামাকাপড়ের অবস্থাও খুবই বাজে। গায়ের সাথে এমনভাবে মিশে আছে যেন,শরীর আর জামার সাথে দোস্তের সম্পর্ক! চোখের নিচের পাতার দিকে ভেতরের সাদা ধারের অংশটা অনেকটাই লাল হয়ে আসছে!

অন্ত্রীশা পালককে ভালো করে দেখে নিয়ে নিজের আগের অবস্থানে ফিরে শুয়ে পড়েছে। এমন একটা ভাব যেন শুধু শুধুই ভয় পেয়েছিলো!

অন্ত্রীশার এমন স্বাভাবিক আচরনে পালক আরো বেশি চমকিত। এখানে অন্ত্রীশার হয় তার কাছে ছুটে এসে বলা উচিত ছিলো,স্বামী তুমি এসেছো? আমি জানতাম তুমি আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবেনা। যেহেতু এটা বলেনি তাহলে অন্য কিছু করা উচিত ছিলো,যেমনঃ খুব রেগে গিয়ে বাড়িশুদ্ধ মানুষকে উথালপাথাল করে দেওয়া,কতগুলো আজেবাজে বকাবকি করা,থাপ্পড়ও দিতে পারতো। কিন্তু পালকের ভাবনাকৃত দুটো চরিত্রের সাথে একটাতেও সামিল হয়নি অন্ত্রীশা। কিন্তু কেন?? তাহলে কি ও বুঝতেই পারছেনা আমি সত্যিই এসেছি,আমাকে দেখতে পাচ্ছেনা?? নাকি অভিমানটা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে প্রকাশ করতে পারছেনা??

পালক এতোটাই ভিজে এসেছে যে,তার শরীর থেকে বেয়ে বেয়ে পড়া পানিগুলো তার দাড়ানরত জায়গাটাকে ভিজিয়ে আশেপাশে ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। পালক ভেজা শরীরসহ পা’টা নিয়ে ধীরগতিতে অন্ত্রীশার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চোখে তার এখনো বিস্ময় আর ভয় কাজ করছে। এটা ঝড়ের পুর্বে পরিবেশ নিয়িয়ে যাওয়া নয়তো??

অন্ত্রীশার কাছে এসে বিছানায় উঠে এসেছে পালক। চুপচাপ একপাশ থেকে অন্ত্রীশার পিঠের কাছটাতে নিজের মাথা রেখে ডান হাতটা দিয়ে অন্ত্রীশাকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,,

“” তুমি কেন বলোনি,তুমি আমার পত্রীকন্যা?””

অন্ত্রীশা তখনো চুপচাপ,পালকের উপস্থিতি,পালকের ছোয়া,পালকের কথা কিছুই যেন তার কাছে পৌছায়নি। সে এখনো জানালার দিকে তাকিয়ে। বাইরের বৃষ্টির সাথে মিশে যাওয়া বাতাসের ধমকা হাওয়াকে উপভোগ করছে।

পালক অন্ত্রীশাকে আরেকটু গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে বললো,,,

“” কিছু বলছো না কেন? রাগ করেছো? সরি তো!””

অন্ত্রীশা এতক্ষনে যেন সম্ভিত পেয়েছে। কিন্তু উত্তেজিত হয়নি,স্বাভাবিক ও যথেষ্ট নরম গলায় বললো,,

“” আপনি আমাকে এবং আমার বিছানাকে ভিজিয়ে ফেলছেন।””
“”আমি যে বৃষ্টিতে ভিজে আছি,সেটা তোমার চোখে পড়ছেনা? বিছানা ভিজা নিয়ে পড়ে আছো?””
“” সরুন!””
“” না,আমি সরবোনা। আগে বলো ক্ষমা করেছো আমায়।””
“” আমি সরতে বলছি।””
“” বলছিতো সরবোনা। আমি আমার পত্রীকন্যাকে কেন ছাড়বো? হুম? আমার এতো সাধনার ফল তুমি!””

অন্ত্রীশা আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারছেনা। রাগে,ক্ষোভে কি করবে বুঝতে পারছেনা৷ মানুষ যত রেগে যায় তত চিৎকার করে কথা বলে,যদিও তার বিপরীত মানুষটা কাছেই থাকে,তাহলে কেন চিৎকার করে?? তখন কি তার এমন মনে হয় যে তার বিপরীত মানুষটা অনেক দুরে অবস্থান করছে?? চিৎকার করে না বললে শুনতে পারবেনা??? অন্ত্রীশাও এবার চিৎকার করে উঠলো,,,

“” তোরে সরতে বলছি তুই সরবি,এতো বেশি কথা বলিস কেন?? আর কে তোর পত্রীকন্যা? তোর পত্রীকন্যা মরে গেছে,আমি কোনো পত্রীফত্রী না। সর আমার কাছ থেকে!””

পালক অন্ত্রীশার এমন আচরনে এতোটাই হতাহতিতো যে অন্ত্রীশা হালকা করে ধাক্কা দিতেই পালক ধুপ করে মেঝেতে পড়ে গেলো।

অন্ত্রীশা শোয়া থেকে উঠে পড়েছে। পালকের দিকে তাকাতে পারছেনা। রাগের পরিমানটা এতোটাই বেড়ে যাচ্ছে যে,সে চুপটি করেও বসে থাকতে পারছেনা,জোরে জোরে স্বাস প্রস্বাসের সাথে সাথে হাত দুটো কচলানো শুরু করে দিয়েছে।

অন্ত্রীশাকে এমন রুপে দেখে পালকের দম যায় যায় অবস্থা। এতো ঠান্ডা মেজাজের মেয়ে এতো গরম কি করে হতে পারে?? এর তো ভাষাও চেন্জ,আপনি থেকে সরাসরি তুই????

পালক অন্ত্রীশার কাছে যেতেও ভয় পাচ্ছে,মনে হচ্ছে অন্ত্রীশার উপর কোনো খারাপ ভুতের ছায়া পড়েছে। এখন ওকে ছুতে গেলেই খারাপ ভুতটা জেগে যাবে,আর জেগে যাওয়া মানেই রেগে গিয়ে তার গলা টিপে ধরা।

পালক ঢুক গিলে শুকনো গলা ভেজানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ভিজছেনা,ভিজবে কিভাবে? এখন তো শুধু তার গলাটাই শুকোয়নি,গলার সাথে সাথে তার শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে,এই যে একটু আগে ভিজে চুপচুপা হয়েছিলো সেই পানিও গায়েব!

অন্ত্রীশা চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার জন্য কয়েকটা সুরা পড়ে নিচ্ছে। বেশ কয়েকটা সুরা শেষ করে নিজের বুকে নিজেই কয়েকটা ফু দিয়ে,ঠান্ডা মেজাজে পালকের দিকে তাকিয়ে বললো,,,

“” কি বলতে চেয়েছিলেন বলুন!””

হঠাৎ করেই অন্ত্রীশার এমন ঠান্ডা কন্ঠটাও পালকের ভেতরের ভয়কে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা। খুবই ক্ষীনস্বরে বললো,,,

“” সরি,পত্রীকন্যা!””
“” কেন?””
“” আমি ভুল করে অন্য কাউকে পত্রীকন্যা ভেবেছিলাম,কিন্তু তুমিই যে আমার পত্রীকন্যা বুঝতে পারিনি,তাই সরি!””

পালক কথার তালে তালে অন্ত্রীশার দিকে এগুতেই অন্ত্রীশা কিছুটা উচ্চস্বরে বলে উঠলো,,,

“”নিজের অবস্থান থেকে এক ইঞ্চিও নড়াচড়া করলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে। আপনার যা বলার আপনি ওখান থেকেই বলুন!””

পালক আগের মতো বসে বললো,,

“” একটু কাছে আসি,তোমাকে ছুবোনা প্রমিস!””
“” না,আপনি ওখানেই থাকবেন।””

পালক অনুনয় স্বরে বললো,,,

“” এমন করছো কেন? আমি তো নিজের ভুল সুদরিয়ে তোমার কাছেই এসেছি,তোমাকে খুজে বেরও করেছি। ক্ষমা করে দাওনা। তুমি তো লক্ষীপাখি!””

অন্ত্রীশা এবার পালকের কাছে এসেছে,খুব কাছে,পালকের মুখোমুখি হয়ে বসে,ওর চোখে চোখ রেখে বললো,,,

“” একটা ভুলের ক্ষমা হয়,দুটো ভুলেরও ক্ষমা হয়,কিন্তু তিনটা ভুলের নয়। আপনি পরপর তিনটা ভুল করেছেন!””
“” তিনটা! কই আমি তো দুজনকেই ভুল করে পত্রীকন্যা ভেবেছি,তিননাম্বারটা কিভাবে পাইলা?? বিয়েতো হয়নি!””

পালকের ডান হাতটা অন্ত্রীশা নিজের কোলের উপর রেখে বৃদ্ধ আর কেনি আঙুলটা হাতের ভেতর সাইডে ভাজ করে নিয়েছে। বাকি তিনটা আঙুল পালকের দিকে এগিয়ে দিয়ে একটা আঙুল ভাজ করে বললো,,

“” নাম্বার ওয়ান,,আপনি আমার আপুকে পত্রীকন্যা ভেবে ভালোবেসেছেন,এক বছর প্রেম করেছেন, এটা আপনার সব থেকে বড় ভুল ছিলো,কেননা এই ভুলের প্রেক্ষিতেই আপনাকে বাকি দুটো ভুল করতে হয়েছিলো।
নাম্বার টু,,এক ভুল শেষ হতে না হতেই আরেক ভুলে পা। আবার সেই অন্য একটা মেয়েকেই আপনি পত্রীকন্যা ভেবেছেন,এবার প্রেম নয় সরাসরি বিয়েতে চলে গিয়েছেন।
নাম্বার থ্রি,,,আপনি অন্ত্রীশার প্রেমে পড়েছেন,যেটাতে পড়া আপনার উচিত হয়নি!””

অন্ত্রীশা পালকের হাতের সবগুলো আঙুল ভাজ করে ফেলেছে,ভেতরের রাগগুলোও এখন ঘুমিয়ে পড়েছে,মনে হয় না তারা জাগবে,তবে অভিমান?? অভিমানরা কি ঘুৃমাবেনা? এদের কি ঘুম পায়না? এদেরও যে এখন বড্ড ঘুমানো উচিত।

অন্ত্রীশা পালকের কাছ থেকে উঠে যেতে নিলেই বলে উঠলো,,,

“” ভুল কি আমি একাই করেছি তুৃমি করোনি?””

অন্ত্রীশা পালকের দিকে ঘুরে বললো,,

“” হুম,করেছিলাম তো! আপনাকে ভালোবেসে,মনের কথা চিঠিতে প্রকাশ করে। যদি চিঠিতে না লিখতাম তাহলে হয়তো আমরা আজ জজ আর আসামীর কাঠগড়ায় দাড়াতাম না।””

পালক বসা থেকে উঠে অত্রীশার কাছে আসতেই অনতি কঠিন গলায় বললো,,,

“”চলে যান এখান থেকে। এখনি!””
“” পত্রীকন্যা,প্লিজ! এমন করে ফিরিয়ে দিওনা। আমি সইতে পারবোনা। “”

অন্ত্রীশা নিজের রুমের জানালা বন্ধ করতে করতে বললো,,

“” বাইরে বৃষ্টি পড়ছে,মনে হয় ঝড় হবে। আজ রাতটা এখানে থেকে,কাল সকালেই চলে যাবেন। আমি ঘুম থেকে উঠে আপনাকে যেন দেখতে না পাই।””

অন্ত্রীশা আর পালকের দিকে তাকাইনি,সোজা বিছানায় শুয়ে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। কষ্ট হচ্ছে, না? কতটা কষ্ট হচ্ছে আপনার? আমার থেকেও বেশি?? ইশ! যদি কষ্ট মাপার একটা যন্ত্র থাকতো,তাহলে আজ মেপে দেখা যেতো কষ্টতে কে জিতেছে,পত্রীকন্যা নাকি পত্র পুরুষ!

অন্ত্রীশা কাথা দিয়ে পুরো মুখ ঢেকে শুয়েছে নাহলে তার অতৃপ্ত চোখটা বার বার যে তার পত্র পুরুষকে দেখতে চাইবে। নিশ্চয় মুখটাকে কালো মেঘে ঢেকে রেখেছে,হয়তো চোখে পানিও নিয়ে এসেছে,মনে মনে হাজারও রঙবেরঙের বকা দিয়ে যাচ্ছে নিজেকে,হয়তো জ্বলছে অনুতপ্ততার আগুনে। কিন্তু এতো কিছু সে কেন দেখবে? সেও তো ভোগেছে,আজ কত বছর ধরে ভুগে এসেছে,সেগুলোর কাছে উনারটা কিছুই নয়৷ কিছুইনা। আমি কিছু দেখবোনা। আমি তো আজকে আরাম করে ঘুমাবো,আজ তো আমি একা নয় আমার সাথে আরেকজনও কষ্টে বুক ভাসাচ্ছে!

সকালের ভোরের ফুটফুটে স্নিগ্ধ আলো এসে পড়েছে অন্ত্রীশার কাথার উপর। কিছুটা আলো কাথা ভেদ করে অন্ত্রীশার চোখে পড়েছে হয়তো। তাই রোদের মিস্টি গন্ধে নাকের ঘুম চলে গিয়ে চোখের ঘুমও ভেঙে গেছে। অন্ত্রীশা কাথাটা মেলে প্রথমেই চোখ মেলেনি। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ পাচ্ছে। ভালোবাসারমন বলছে চোখ খোলেই যেন তার পত্র পুরুষটাকে দেখতে পায় কিন্তু অভিমনি মন বলছে,না এই চোখে সে পত্রপুরুষকে দেখবেনা।

অন্ত্রীশা পিটপিট করে চোখ মেলতেই বুঝতে পারলো তার অভিমানি মনটাই জিতে গিয়েছে। পত্রপুরুষ নেই,চলে গিয়েছে।

অন্ত্রীশা উঠে বসতেই মুখটা ভার হয়ে এসেছে। লোকটা আমাকে বুঝলোইনা,সত্যি সত্যিই চলে গেলো??? অন্ত্রীশা কিছুক্ষন গাল হাত দিয়ে বসে থাকলো। বসা থেকে উঠতেই নিজের পড়ার টেবিলে একটা কাগজ দেখতে পাচ্ছে,কাগজটার উপরে একটা চেইন,সাথে লকেটও আছে। চেইনটা হাতে নিতেই বুঝতে পারছে এটা তার ব্যবহৃত সেই চেইনটা যেটা কিছুদিন আগে হারিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এটা এখানে কি করে এলো???

অন্ত্রীশা চেইনটা পাশে রেখে দিয়ে কাগজটা খুলে পড়তে শুরু করেছে,,,

****আমার অপেক্ষার রানী পত্রীকন্যা,

কি ভেবেছো? তোমার কড়া কড়া দুটো কথাতেই আমি সব ভুলে তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো? কখনোই না৷ যাকে কখনো পাবো কিনা তার গ্যারান্টিই ছিলো তবুও তাকে খুজে খুজে আমার অর্ধেক যৌবন ফুরিয়ে ফেলেছি। আমার সেই অর্ধেক যৌবন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য হলেও তোমাকে আমার কাছে আসতে হবে। এতোদিন শব্দে রাঙা মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছি কিন্তু এখন? এখন হাত,পা,চোখ,মুখ,নাক,ঠোট,মাথা,চুলসহ একটি পরিপুর্ন কিশোরী মেয়ের জন্য অপেক্ষা করবো। যার শরীরের আন্তিকে প্রতিটি শিরী উপশিরা,এক অঙ্গ থেকে আরেক অঙ্গে বহমান রক্তে, বাহ্যিকে প্রতিটি পশমে,নিশ্বাস-প্রশ্বাস এমন কি চুলের ঘ্রানেও রয়েছে আমার প্রতি ভালোবাসা। আমি তার অপেক্ষায় থাকবো,দরকার হলে আমি আমার বাকি অর্ধেকটা যৌবন তাকে পাওয়ার ভাবনায় দান করবো। তবুও আমার তাকেই চাই।

প্রথম আর দ্বিতীয় ভুলটা আমি স্বীকার করছি,কিন্তু তৃতীয় ভুলটা স্বীকার করবোনা। কারন ওটা ভুল ছিলোনা। কেননা পত্রীকন্যা আর অন্ত্রীশা শুধু নাম দুটোই ভিন্ন কিন্তু তাদের শরীর,আচার ব্যবহার,পাগলামী,কথাবার্তা,চালচলন সব তো একটাই তাইনা??? আমি তো তোমার নামের প্রেমে পড়িনি। চিঠিতে আমি আমার পত্রীকন্যার অনুভূতির প্রেমে পড়েছিলাম আর সেই অনুভূতিগুলো তো আমার বউ অন্ত্রীশার মধ্যেই বিচরন করছিলো। তাহলে আমি কি করে নিজেকে আটকে রাখতে পারতাম বলো??

তোমার কাছে পৌছানোর দায়িত্ব কি আমার একার ছিলো? তোমার ছিলোনা?? তুমি কি একবারও আমাকে খুজতে চেয়েচিলে? আমি জানি তুমি চাওনি,কেন চাওনি? ভালো তো তুমিও আমাকে বেসেছিলে তাহলে সেটা শুধু অভিমানেই কেন আটকে রাখলে?? কেন সেদিন আমার সামনা সামনি এসেও আমাকে বলোনি তুমি আমার পত্রীকন্যা,অনিকশা নয়। তার উপর তোমার লেখা যাতে বুঝতে না পারি তার জন্য তুমি চিঠিগুলোতে লেখার ধরন চেন্জ করেছিলে! কেন করেছিলে আমাকে কষ্টে থাকতে দেখতে?? লাস্ট চিঠিটা তুমি পত্রীকন্যা হয়ে লিখেছো,আমি এটা সিউর তুমি ইচ্ছে করে ওভাবে লেখনি,ভুল করে লিখে ফেলেছিলে। আর তোমার ভুলটা ও ধরতে আমার লেট হয়েছিলো। আমি তখন স্নিগ্ধাকে বিয়ে করার জন্য এতোটাই উত্তেজিত ছিলাম যে তোমার লেখার প্রতি আমার কোনো খেয়াল ছিলোনা। কিন্তু দেখো পরে তোমার এই ভুলটাই আমাকে তোমার কাছে এনেছে। সব ভুল খারাপের জন্য হয়না,কিছু কিছু ভুল ভালোর জন্যও হয়। আমার টা কেমন ভুল হয়েছে আমি জানিনা। কিন্তু আমি তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য ছটফট করছি। আমি জানি তুমি আমার এই ছটফট কমাতে আমার কাছে আসবে। আমি চাই তুমি আসো। সবসময় আমি কেন তোমার কাছে ছুটে যাবো। এবার নাহয় তুমি ছুটে এসে আমাদের অপেক্ষার ইতি টানলে!

ইতি

তোমার ছটফট পত্র পুরুষ

অন্ত্রীশা চিঠিটা রেখে চেইনটা আবার হাতে নিয়েছে। চেইনের মধ্যে থাকা লকেটটা খুলতেই সেখানে একপাশে পালকের হাসি হাসি মুখটা দেখতে পাচ্ছে আর অপর পাশটা এখনো খালি।

ভর দুপুরের মাথার উপরে উঠে যাওয়া সূর্যটার নিচে হাটুগেড়ে দাড়িয়ে আছে পালক। সুর্যের দিকে মুখ করে চোখটা বন্ধ করে রাখা। হাতদুটো পেছনে ভাজ করা। এমন একটা ভাব যেন তাকে কোনো সামরিকবাহিনীরা শাস্তি দিচ্ছে বর্ডার পার করে অন্যত্র সীমানায় যাওয়ার জন্য।

অন্য সবসময়ের মতো আজো সে সূর্যের তীব্র রশ্নিতে নিজের কষ্ট ধুয়ে নিবে। খুব বেশি কষ্ট,যেটাতে বুকের ভেতরের রগগুলো ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে ব্যথা অনুভব হয়,সেই কষ্টে সুর্যের নিচে দাড়িয়ে থাকতে আরামবোধ করে পালক।

পত্রীকন্যাকে পেয়েও পাওয়া হলোনা,ছুয়েও ছুয়া হলোনা,দেখেও দেখা হলোনা এমন একটা রোগে ভুগছে পালক। কিছুই ভালো লাগছেনা তার। মনের অজান্তেই বিড়বিড় করছে সে,হ্যা পত্রীকন্যা তুমি ঠিক ধরেছো,আমি সত্যি সত্যিই আমার বউ অন্ত্রীশার প্রেমে পড়েছিলাম। আমি যখন কলম ফেলে উঠে গিয়েছিলাম তখন তোমার প্রেমে পড়েই উঠে গিয়েছিলাম। ঐ কলমটা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো আমি আমার বউয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছি,আমি আমার অন্ত্রীশার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। কিন্তু সেটা ঠিকঠাক উপলব্ধি করার আগেই পত্রীকন্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। আমি তোমার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম শুধু পত্রীকন্যাকে পাওয়ার জন্য নয়,আমারতো অন্ত্রীশাকেও পাওয়ার ছিলো।

পালকের বিড়বিড় শেষ হওয়ার আগেই মুখে আঠালো জাতীয় কিছু এসে লাগে। পালক চোখ মেলতেই দেখে অন্ত্রীশা ওর মুখে টেপ লাগিয়ে পুরো মাথা ঘুরিয়ে আনছে। পালক অন্ত্রীশাকে আটকাতে নিলেই অন্ত্রীশা অগৃনিদৃষ্টি ছুড়ে দিয়েছে। তাতে পালক দমে গিয়ে চুপচাপ অন্ত্রীশাকে দেখে যাচ্ছে।

পালকের পাশে অন্ত্রীশাও হাটুগেড়ে বসে একটা সিগারেট নিজের মুখে পুড়ে নিয়েছে। ম্যাচ জ্বালিয়ে সিগারেটের মাথায় আগুন ধরিয়েছে।

চলবে

#ধোয়ার-নেশা

#রোকসানা-রাহমান

পর্ব (২২)

পালকের বিড়বিড় শেষ হওয়ার আগেই মুখে আঠালো জাতীয় কিছু এসে লাগে। পালক চোখ মেলতেই দেখে অন্ত্রীশা ওর মুখে টেপ লাগিয়ে পুরো মাথা ঘুরিয়ে আনছে। পালক অন্ত্রীশাকে আটকাতে নিলেই অন্ত্রীশা অগ্নিদৃষ্টি ছুড়ে দিয়েছে। তাতে পালক দমে গিয়ে চুপচাপ অন্ত্রীশাকে দেখে যাচ্ছে।

পালকের পাশে অন্ত্রীশাও হাটুগেড়ে বসে একটা সিগারেট নিজের মুখে পুড়ে নিয়েছে। ম্যাচ জ্বালিয়ে সিগারেটের মাথায় আগুন ধরিয়েছে। সিগারেট থেকে নিশ্বাস টেনে নিতেই অন্ত্রীশা কেঁশে উঠে। মুখ থেকে জ্বলন্ত সিগারেট নিচে পড়ে গিয়েছে। অন্ত্রীশার কাশি দেখে পালক নড়ে উঠতেই অন্ত্রীশা কঠিন স্বরে বললো,,

“” খবরদার নড়াচড়া করবেননা। আমার আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে। আপনি তো আপনার প্রেমের গল্প বললেন আজ আমি আপনাকে আপনার পত্রীকন্যার প্রেমে পড়ার গল্প শুনাবো। যেটা আপনি জানেননা৷ আমি জানি,অন্ত্রীশা জানে!””

অন্ত্রীশা তখনো কেঁশেই যাচ্ছে। কাশির ঝাকুনিতে সে আর পালকের পাশে হাটু গেড়ে বসে থাকতে পারেনি। অন্ত্রীশা কাশতে কাশতেই আরেকটা সিগারেট মুখে পুড়েছে।

সুর্যের তীব্রতা কমতে থাকলেও পালকের আর অন্ত্রীশার উপর তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে। দুজনের চেহারায় লাবন্যতা অনেকটাই শুকিয়ে এসেছে। দেখা যাচ্ছে,ঘামের প্রকট আর লাল এবং কালো রঙের এক অন্যরকম লাবন্য। দুজনেই যেন আজ অন্যরকম নেশায় ডুবতে চাচ্ছে। একজন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তির অস্তিত্বের উপস্থিতে তো আরেকজন সিগারেটের ধোয়াকে নিজের বশে করতে! দুজনেই আজ নতুন জিনিসের ছোয়া নিতে চাচ্ছে,দুজনেরই আজ নতুত্বের নেশায় ডুবে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে। কিন্তু পালক তো সফলতার দিক দিয়ে এগিয়ে কিন্তু অন্ত্রীশা?? সেতো ধোয়াকে হজমই করতে পারছেনা।

অন্ত্রীশা চোখটা বন্ধ করে সিগারেট থেকে আবার একটা নিশ্বাস গ্রহন করেছে। এবারও কাশি উঠেছে কিন্তু আগেরবারের মতো নয়। অনেকটাই ঠুনকোর পর্যায়ে পড়ে।

“” তখন আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। নতুন কলেজ,নতুন ক্লাস,নতুন জায়গা,নতুন ক্লাসমেট হওয়ায় তখনো সবকিছুর সাথে সখ্যতা হয়ে উঠেনি। আপু প্রথম দিকে আমাকে কলেজে দিয়ে আসলেও এক সময় আমি নিজেই মানা করি। তারপর থেকে আপুর যেদিন যেদিন ক্লাস থাকতো সেদিন সেদিন আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতো। এমনি নতুত্বের মধ্যে একটা সোনালী মুহুর্ত আসে আমার জীবনে,সোনালী কেন বলছি? ভিজে মুহুর্ত হবে।সেদিন তো আকাশে সুর্য ছিলো না,না ছিলো সূর্যের সোনালী রোদ৷ সেদিন তো ছিলো আকাশের কালো মেঘের আবরন। যে আবরন ভেঙে বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো আমার সব নতুনত্বকে। ক্লাস শেষে কলেজ টিচারের কাছেই প্রাইভেট শেষ করে বাড়ি ফিরছিলাম। কয়েককদম এগুতেই আমাকে অবাক করে বৃষ্টি নেমে বসে। বৃষ্টি আমার খুবই পছন্দ। বৃষ্টির প্রতিটি ফোটাতে আমি আনন্দের অনুভূতি খুজে পাই। চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির ফোটা উপভোগ করা এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। কিন্তু সেদিনটি আমি বৃষ্টিতে উপভোগ করতে পারছিলাম না। কেননা,তখন আমার পিরিয়ডের সেকেন্ড ডে ছিলো। এমন হুট করে বৃষ্টিতে আটকে পড়বো ভাবা হয়নি তাই ছাতাও সাথে ছিলোনা। তাই দৌড়ে পাশেই বন্ধরত একটি দোকানের ছাউনিতে গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আমার সাথে যেমন কেউ ছিলোনা তেমন আশেপাশেও কেউ ছিলোনা। মনের ভেতর বিরক্ত,ভয়,অসহায়ত্ব,রাগ সব একসাথে কাজ করছিলো। ঠিক তখনি আপনি আর কাদির ভাই কোথা থেকে যেন দৌড়ে এলেন। আশেপাশে জনমানবহীন এমন মুহুর্তে পাশে দুটো ছেলেকে দেখে আমার ভেতরটা ধুকধুক করছিলো। মনের ভেতর নানা কুডাক,কুচিন্তাভাবনা আসছিলো,তখনো আমি ফোন ব্যবহার করে উঠতে পারিনি। কি করবো না করবো বুঝতে পারছিলাম না। বৃষ্টির বর্ষন ও কমার নাম গন্ধ নেই,আমি যতটা পারছিলাম নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার পঞ্চম ইন্দ্রীয় তার সহোদর ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়কে ডেকে নিয়ে আপনাদের দিকে মনোনিবেশ করছিলো। কাদির ভাই আপনার সাথে কথার ছলে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। আর আপনি? আপনি নিজের ভেজা হাত দিয়েই নিজের ভেজা জিনিসগুলোকে শুকানোর বৃথা চেষ্টা করছিলেন। এর মধ্যেই কাদির ভাই একটা জ্বলন্ট সিগারেট মুখে পুড়ে দিয়েছে। আর সাথে সাথে উনার গালে টাস করে একটা চড় মেরে বসলেন আপনি। আপনার বাক্যনুযায়ী আপনি সিগারেট খুবই অপছন্দ করেন আর কাদির ভাইকে অনেকবার ওয়ার্নিং দেওয়ার পরও উনি আপনার সামনেই সিগারেট ধরিয়েছে। আপনি প্রচন্ড রেগে ছিলেন তখন। কিন্তু বেশিক্ষন রাগ নিয়ে থাকতে পারলেননা। আপনার রাগ বমি আকারে বের হয়ে এসেছিলো।

বেশ কিছুক্ষন এভাবে কাটার পরই কাদির ভাই আপনাকে তাড়া দিচ্ছিলো চলে যাওয়ার জন্য। আপনি হয়তো কোনো জরুরী কাজে বেড়িয়েছিলেন। বারবার ঘড়ি দেখছিলেন,বাইরের চারপাশটা চোখ বুৃলাচ্ছিলেন আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছিলেন,হয়তো বৃষ্টিকে বকাবকি করছিলেন। প্রকাশ্যে বলছিলেন বৃষ্টিটা আরেকটু কমুক। আপনাদের দেখে আমার বুকে যে ধুকধুকটা হয়েছিলো সেটা ক্রমশই কমে যাচ্ছিলো। কেমন জানি একটা নিরাপত্তা অনুভব করছিলাম। আর ঠিক তখনি আপনি ছাউনি ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন। আমি আপনার দিকে তাকিয়ে থাকলেও বুঝতে পারছিলাম বুকের ধুকধুকটা বেড়ে যাচ্ছে৷ আপনি চোখের আড়ালে হতেই কাদির ভাই আমার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হওয়ার উপক্রম,কাধের ব্যাগটা বারবার টেনে টেনে ঠিক করছিলাম,একবার জামা তো আরেকবার ওড়না ঠিক করছি। ঠিক তখনি হুট করে আপনি আবার আবির্ভুত হলেন!

ছাউনিতে না ঢুকেই আপনি বৃষ্টিতে থমকে গেলেন। বৃষ্টিতে ভেজা চোখ দিয়ে,আড়ভাবে একটা ভেজা চাহনি আমার দিকে ছুড়ে কাদির ভাইকে ডাকলেন। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই কাদির ভাইকে টেনে নিয়ে আবার হাওয়া।

আপনার কান্ডে অবাক হবো নাকি এই জনমানবহীন সন্ধ্যায় বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করবো বুঝতে পারছিলাম না। আকাশের অবস্থা আরো খারাপ। সন্ধ্যে তখনো নামেনি কিন্তু আকাশের কালো ছায়াগুলো জোর করে সন্ধ্যে নামিয়ে দিয়েছে। বৃষ্টির এতোটাই প্রবলতা ছিলো যে কোনো রিকশাও আসছিলোনা। একাকিত্ব আমাকে খেয়ে ফেলছিলো,ভয়েরা আরো বেশি করে জ্বলজ্বল করে উঠছিলো। একবার মনে হচ্ছিলো এই বৃষ্টিকে তুচ্ছ্য করে এক দৌড়ে বাড়ি চলে যায়। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। বৃষ্টিরা এবার শুধু আকাশ ভেঙেই নয় আমার চোখ ভেঙেও পড়বে এমন ভাব ঠিক তখনি একটা রিকশা এসে হাজির।

“” ভাইজান বললো,আপনারে নামাইয়া দিয়া আইতে। আপনি কই যাবেন আপা? তাড়াতাড়ি আহেন। মনে অয় ঝড় নামবো!””

লোকটার কথায় আমি যতটা না অবাক হয়েছিলাম তার থেকে দ্বিগুন আনন্দের সাথে রিকসায় চড়ে বসি। রিকসায় উঠতেই আমার বুঝতে বাকি রইলোনা যে কোন ভাইজান রিকসা পাঠিয়েছে। আসতে আসতে আপনার সব কান্ডগুলোর ব্যাখ্যা পেয়ে গেলাম। সাথে প্রথম প্রেমে পড়ার স্পর্শ!

সে রাতটা আমি নির্ঘুমে কাটালাম,বারবার আপনার সেই ভেজা চাহনিটা আমাকে আসক্ত করে তুলছিলো। এরপর থেকেই ঘটে প্রথম প্রেমের সুচনা। বৃষ্টি নামলেই আপনার কথা মনে পড়তো,রিকসা দেখলেও আপনার কথা মনে পড়তো,আর সিগারেট?? এই সিগারেটটা যে কেমন বস্তু এর গন্ধ কেমন তাতো আমার ধরাছোয়ার বাইরে ছিলো। কিন্তু সেদিন আপনাকে দেখার পর থেকেই যত অরুচি,যত বিরক্ত, যত তিক্ত,যত ঘৃনা সব এই সিগারেটের উপর গিয়ে পড়লো।

অল্প বয়সের প্রেমের ছোয়ায় তখন আমি উড়ছি,আপনাকে পাগলের মতো খুজছিলাম,বৃষ্টি হলেই সেই ছাউনিতে গিয়ে দাড়িয়ে থাকতাম যদি আপনার দেখা পাই এই আশায়। কিন্তু না,আপনার তো দেখার কোনো নাম নাই। বেশ কিছুদিন যেতেই দেখলাম আপনার সেই বন্ধু কাদির ভাই আমাকে ফলো করছেন। ইনিয়ে বিনিয়ে নানান জিনিস বুঝাতে চাচ্ছেন। উনাকে দেখে আমার যতটা না বিরক্ত লাগতো তার থেকেও বেশি হতাশ হতাম উনার সাথে আপনাকে না দেখে। মাঝে মাঝে আমার খুব ইচ্ছে হতো উনাকে গিয়ে বলতে,,আপনার সেই ভেজা বন্ধুটি কোথায়? উনি কি জানেননা উনার ভেজা চাহনির প্রেমে পড়ে একটি মেয়ে অতলে ভেসে যাচ্ছে???

তার বেশ কয়েক মাস পর হুট করেই আপনি আমাদের ক্লাসে এসে হাজির। হিসাববিজ্ঞানের স্যার আপনাকে নিয়ে এসেছেন,আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। আপনার পরিচয় পাওয়ার পর বুঝতে পারলাম আপনিই তাহলে সেই পড়ুয়া বালক! অতি শুদ্ধ পুরুষ।

আপনার পরিচয় পাওয়ার পর আমার প্রেম ভেঙে যাওয়ার অবস্থা। এতোদিনে আপনার সম্পর্কে যা যা জেনেছি তার প্রক্ষাটে আপনার সাথে আমার প্রেম হওয়া অসম্ভব। শুধু আমি কেন আমার জায়গায় কোনো বিশ্বসুন্দরীও যদি আপনাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় তাহলেও আপনি সাথে সাথে অনিচ্ছুক প্রকাশ করবেন। আমার মন ভেঙে যায় যায় অবস্থা। মনের ভেতরে ফুটে উঠা প্রেমের অঙ্কুরগুলো ফুল হয়ে ফুটার আগেই শুকিয়ে যাচ্ছে। কি করবো না করবো বুঝতে পারছিলাম না, তখনি আমার মাথায় এই চিঠির ব্যাপারটা আসে।

অন্ত্রীশা পালকের মুখোমুখে হয়ে বসে পড়েছে। পালক গাটুগেড়ে বসার ফলে ওর মাথাটা অন্ত্রীশার মাথা থেকে একহাত উপরে। অন্ত্রীশা মাথাটা কিছুটা পেছনে ঝুকিয়ে পালকের দিকে তাকিয়ে বললো,,

“” স্নিগ্ধা আপনাকে মিথ্যে বলেছে,ও পত্রীকন্যাকে চিনে খুব ভালো করেই চিনে ওরা দুজন ছোটবেলার ফ্রেন্ড।””

পালক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অন্ত্রীশার দিকে তাকাতেই অন্ত্রীশা আবার বলতে শুরু করেছে,,

“” স্নিগ্ধা বরাবরই পরীক্ষায় আমার থেকে মার্কস কম পেতো। এতে ও খুবই অসন্তুষ্ট ছিলো। আর সেকারনেই জীবনের বড় পরীক্ষাটাতে ও চাইনি আমি ফুুল মার্কস পাই। আপনি যদি আমাকে খুজে না পেতেন তাহলে ও কখনোই আপনাকে আমার ব্যাপারে বলতোনা। এটা আমি ১০০% সিউর দিয়ে বলতে পারি। চাইলে আপনি এখনো ওকে কল দিয়ে জেনে নিতে পারেন। কিন্তু তারপরও এই চিঠি চদান-প্রদানের ব্যাপারটা আমি ওকে দিয়েই শুরু করেছিলাম।

আপনার ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর আপনার একটা চিঠিও আমি পাইনি। কেন পাইনি তখন জানতাম না। আমি বারবার স্নিগ্ধার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম আপনার চিঠির আশায়,কিন্তু প্রতিবারই আমি খালি হাতে ফেরত আসতাম। ও আমাকে কড়া করে জানিয়ে দিতো আপনি কোনো চিঠি দেননি। মাঝে মাঝে এমনও বলতো আপনি নাকি ইচ্ছে করেই চিঠি লিখেননা,আপনাকে মাঝে মাঝেই অন্যকারো সাথে দেখা যাচ্ছে।

সেদিন আমি ক্লাসে বসে সবার সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। হঠাৎই বাইরে থেকে নানা গুনগুন শুনছিলাম। ক্লাসের সবাই এক এক করে দৌড়ে কোথাও একটা ছুটে যাচ্ছিলো ঠিক তখনি স্নিগ্ধা আমার কাছে এসে তাচ্ছিল্যভঙ্গিতে বললো,,বলেছিলাম না অন্য মেয়ের সাথে ঘুরঘুর করে? যা দেখে আয় তোর চিঠির প্রেমিক অন্য মেয়েকে প্রপোস করতেছে!

স্নিগ্ধার কথা আমি বিশ্বাসে না নিলেও ফেলে দিতে পারছিলাম না। অন্যদের মতো আমিও ছুটে গিয়েছিলাম। ভিড় ঠেলে যখন আপনার মুখটা দেখলাম তখন আপনার বুকে অন্যনারীর মুখ লুকানো!””

অন্ত্রীশার চোখ ভিজে এসেছে। গলাটাও ধরে এসেছে বুঝতে পেরে অন্ত্রীশা চোখ বন্ধ করে লম্বা করে কয়েকটা নিশ্বাস নিচ্ছে। রোদের তাপে অন্ত্রীশা ঘেমে উঠেছে। মুখটা মলিন হয়ে এসেছে তার মধ্যে এমন ছলছল হয়ে উঠা চোখটা দেখে পালক শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারছেনা। ইচ্ছে করছে এখনি ওকে জড়িয়ে নিতে নিজের বুকের সাথে। একটু ভালোবাসার পরশে ওকে ঠান্ডা করে দিতে। দুএকটা আদরী কথার বুলিতে ওর মনটাকে রাঙিয়ে দিতে। পালক পেছন থেকে ডানহাতটা মুখে লাগানো টেপটা ধরতেই অন্ত্রীশা নরম সুরে বলে উঠলো,,,

“” আজকে শুধু আমি বলবো আর আপনি শুনবেন। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি!””

পালক হাতটা আবার পেছনে নিয়ে নিয়েছে। আজ ইচ্ছে করছেনা অন্ত্রীশার কথার অবাধ্য হতে। ইচ্ছে করছেনা জোর করতে। আজ নাহয় একটু চুপ করে তার কথায়ই শোনা হোক। পালক আগের ন্যায় পেছনে হাত রেখে অন্ত্রীশার দিকে তাকাতেই ও আবার বলতে শুরু করেছে,,,

“” ঐদিন ছিলো আমার প্রথম প্রেমের প্রথম ধাক্কা। যে ধাক্কায় চুড়মার হয়ে যাচ্ছিলো আপনাকে নিয়ে বিশ্বাসেরা। জানেন তো,১৩-১৯ বছর বয়সকে টিন এজ বলা হয়? আর এই টিন এজের কিশোর কিশোরীর মনে বাস করে A magical kingdom of feelings. এই বয়সে একটা ছেলে একটা মেয়ের হাত ধরাতেও যে অনুভূতি ফিল করে,বুকের ভেতর অশান্তির ছটফটানি ফিল করে তার তুলনায় একজন প্রাপ্ত বয়সের দম্পত্তিরা মিলনেও সেরকম অনুভূতি ফিল করতে পারেনা। তাহলে ভাবুন তখনতো আমি টিন এজেই বাস করছিলাম তখন আমার মন ভাঙার ফলে আমি কেমন ভেঙে পড়েছিলাম??? আর সেই ভাঙা মন নিয়েই আমি একটি কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে আপনাকে চিঠি লিখলাম। প্রতিজ্ঞাটা এমন ছিলো আপনি যদি আমাকে না খুজে নেন আমি কখনোই আপনাকে ধরা দিবোনা!

ভাগ্যের কি পরিহাস! আমার সেই কঠিন প্রতিজ্ঞার চিঠিতো আপনার কাছে পৌছুলোইনা কিন্তু আমি ঠিকই এতোদিন তা বয়ে বেড়িয়েছি!

আমি আবার দ্বিতীয়বার আপনার প্রেমে পড়লাম,কখন জানেন? আপনার সেই প্রথম চুমুর যেটা আমাকে দেখতে এসে খেয়েছিলেন৷ আপনার সেই এক চুমু আমার সব বুলিয়ে দিয়ে নতুন করে আপনার প্রেমে ডুবিয়ে দিলো। আবার আমার মনের ভেতরে দ্বিতীয় প্রেমের অঙ্কুর ফুটছিলো। কিন্তু সেটাও শুকিয়ে গিয়েছিলো যখন জানতে পারলাম সেই চুমুটাও অন্য কারনে খেয়েছিলেন। তারপরও আপনার মধ্যে থাকা পত্রীকন্যার প্রতি এতো ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। এতোটাই মুগ্ধ করেছিলো যে আমি আমার প্রতিজ্ঞা ভুলে গিয়ে আপনাকে সবটা জানানোর সিদ্ধান্ত নেই। তার পরিপাক্ষিকে আপনি কি করেছেন??

অন্ত্রীশার প্রশ্নটাকে পালকের কাছে বিষদাঁতের বানানো তীর মনে হলো। যেটা শরীরে লাগার সাথে সাথে পুরো শরীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ছে৷ পালক অসহায়ভাবে অন্ত্রীশার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ত্রীশার হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছে। এতক্ষন কথার ছলে সে ধোয়া কিভাবে ছাড়তে হয় তাই প্রেক্টিস করছিলো। বার বার ব্যর্থ হয়ে ধোয়া গলায় প্রবেশ করতেই কেঁশে উঠছিলো অন্ত্রীশা!

অন্ত্রীশা তৃতীয় সিগারেটটা মুখে পুড়ে ম্যাচটা জ্বালাতে জ্বালাতে বললো,,

“” কাল রাতে আমি আবার আপনার প্রমে পড়েছি,আপনার সেই ভেজা উষ্ণতার! আর সেই প্রেমে পড়ার কারনবশত আমি আবার আপনার সামনে। কিন্তু প্রেম করার জন্য নয়।””

অন্ত্রীশা সিগারেট থেকে নিশ্বাস টেনে মুখ ভর্তি করে পালকের মুখের কাছে এসেছে। খুব কাছে এসে পালকের চোখে চোখ রেখেই মুখ ভর্তি ধোয়া পালকের পুরো মুখে ছড়িয়ে দিচ্ছে। পালক ধোয়ার গন্ধে নাক মুখ কুচকাতেই অন্ত্রীশা বললো,,

“” আপনাকে কঠিন হতে কঠিনতর শাস্তি দিতে!””

অন্ত্রীশার মুখে তারই বলে দেওয়া সেই বাক্য শুনতেই চোখদুটো ছানাবড় হয়ে গিয়েছে পালকের। অন্ত্রীশা পালকের মুখ থেকে টেপটা খুলতে খুলতে বললো,,

“” আপনার কঠিন হতে কঠিনতর শাস্তি হলো,,,আপনাকে কলংকিত পুরুষ হয়ে দেখাতে হবে। কিভাবে কলংক মাখবেন সেটা আপনার চিন্তা। কিন্তু তার আগে আমার সাথে আপনি কোনো কথা বলতে পারবেননা,আমাকে ছুতেও পারবেননা!””

অন্ত্রীশা পালকের হাতে সিগারেটের প্যাকেট,ম্যাচ আর টেপটা রেখে ধীর পায়ে ছাদের সিড়ির দিকে এগুচ্ছে। সে পেছনে তাকালে ঠিক দেখতে পারতো পালকের মুখটা এতো বড়ই হা হয়েছে যে সে চাইলে এখনি পালকের হা’য়ের মধ্যে টুপ করে ঢুকে পড়তে পারতো।

আতিশ অফিস থেকে বের হয়েই পালকের বাসার দিকে পা বাড়িয়েছে। পালকের জরুরী তলব। কিন্তু তার থেকেও জরুরী পাপড়িকে এক নজর দেখা। কাল দরজার বাইরে থেকেই তাকে ফেরত আসতে হয়েছে। এতোটা দিন পাপড়িকে দেখতে না পেয়ে পালকের মরি মরি অবস্থা। আজকে যেভাবেই হোক পাপড়িকে তার দেখতেই হবে৷ নাহলে সে পাপড়িকে দেখতে না পারার অপরাধে অন্ধ হয়ে যাবে!

বাসার ভেতরে ঢুকতেই আতিশের মুখটা আরো মলিন হয়ে এসেছে। এই বাসায় হঠাৎ এতো সাজসজ্জা কিসের? এমন লাইটিং আর ফুল দিয়েই কেন সাজানো হয়েছে? বাসায় তো মেহমানও ভর্তি। কি চলছে এই বাড়িতে??

আতিশ পা ফেলে যত ভেতরে ঢুকছে তার ভেতরটা তত খচখচ করছে। এক অদ্ভুত সন্দেহ কাজ করছে। পালকের রুমে পা ফেলতেই পেছন থেকে পালক আতিশকে জড়িয়ে ধরেছে।

“” আমি মনে হয় এবার মরেই যাবো রে,আতিশ!””

নিজেকে পালকের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললো,,

“” মানে?””
“” পত্রীকন্যা যে তার নামের মতো এতো কঠিন হবে তা জানলে আমি জীবনেও সেই চিঠির উত্তর দিতাম না!””
“” হেয়ালি না করে কি হয়েছে তাই খুলে বল। আর বাসায় কি কোনো প্রোগ্রাম নাকি? এতো সাজসজ্জা? আর এভাবে জরুরী তলবের কারন কি?””

আতিশ কথার ছলে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে,এতো মানুষের ভিড়ে সে পাপড়িকে কিভাবে খুজবে? ও কি একটাবার রুম থেকে বের হতে পারছেনা??

“” কাল পাপড়ির বিয়ে!””

আতিশ অন্য জায়গা থেকে চোখ সরিয়ে তাৎক্ষনিক পালকের দিকে তাকিয়ে বললো,,

“” মজা করছিস?””
“” বোনের বিয়ে নিয়ে মজা করবো কেন,আতিশ? আর আমি কি এখন মজার মুডে আছি?””

আতিশ পালককে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে পাপড়ির গলা শুনতে পেলো।

“” ভাইয়া দেখতো,কাল আমি কোন শাড়ীটা পড়ে বউ সাজবো?””

আতিশ পেছনে ঘুরতেই পাপড়ির হাতে লাল আর খয়েরী কালারের পাথর আর সুতোর ভারী কাজ করা শাড়ী দেখতে পাচ্ছে। মুখে তার সেই মনভোলানো চিকচিক হাসি। তবে কি পালক সত্যি কথাই বলেছে? পাপড়ি অন্য কারো জন্য বউ সাজবে? ভাবতেই আতিশের অন্তরআত্মা কেঁপে উঠছে!

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে