ধূসর শ্রাবণ পর্ব-২২+২৩

0
1160

#ধূসর শ্রাবণ
#লেখিকা:#তানজিল_মীম💚
#পর্ব-২২+২৩
________________

হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্র তাঁর আর বর্ষার রুমের বিছানার পাশ দিয়ে। সে ভাবতেও পারে নি শেষ মুহূর্ত এসে এমন কিছু ঘটবে। বর্ষা চলে যাবে তাও তাঁকে কিছু না জানিয়ে। কয়েক মুহূর্ত আগেই বাড়ি এসে রুমে ঢুকে শুভ্র। বর্ষার নাম নিয়ে ডাকে অনেকবার কিন্তু বর্ষার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বুকটা কেমন যেন করে উঠে তার। পুরো বাড়ি জুড়ে খুঁজে বর্ষাকে কিন্তু পায় না। পরক্ষণেই টেবিলের উপরে একটা চিঠি লেখা দেখে পড়ে সেটা। যেখানে লেখা ছিল,

‘ প্রিয় শুভ্র,

আমি জানি এইভাবে হুট করে আপনায় কিছু না বলে চলে যাওয়াটা হয়তো আমার উচিত হয় নি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি আর পারছি না। আপনার আমার দূরত্ব যেন তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছিল আমায়। তাই নিজেকে বাঁচাতে আর আপনাকে মুক্তি দিতে চলে যাচ্ছি আমি। ভালো থাকবেন আর হ্যাঁ ভয় পাওয়ার কিছু নেই আমি বাড়িতে কাউকে কিছু বলবো না। আপনার কোনো দোষ নেই আপনি তো বিয়ের আগেই ডিভোর্স চেয়েছিলেন, আমার আফসোস একটাই আপনি বিয়ের আগে সব কথাগুলো বলেন নি আমায়। শুধু বলেছিলে আমায় আপনার পছন্দ নয়। যাইহোক ভালো থাকবেন। শুনেছি দাদু নাকি খুব অসুস্থ, যার জন্য বিয়েটা করেছিলাম সেই মানুষটাই অসুস্থ হয়েছে আবার। তবে আজ একটা কথা আপনাকে না বললেই নয়। আপনাকে বিয়ের করার কারন শুধু এটা ছিল না দাদুর অসুস্থতা। আসলে আপনায় আমি সেই ছোট বেলায় থেকেই ভালোবাসতাম, আপানাকে নিয়ে হাজার স্বপ্ন বুনেছি আমি। সেদিন আপনাকে যে বার্থডে সারপ্রাইজ দিয়েছিলাম সেটাও আমার একটা স্বপ্ন ছিল বলতে পারেন। যাইহোক আপাতত এই কথাগুলো বড্ড অর্থহীন। জানানোর ইচ্ছে ছিল না তেমন কিন্তু কেন যেন আজ বলতে ইচ্ছে হলো খুব তাই বলেদিলাম। তবে ভাববেন না এই ভালোবাসার দোহাই দিয়ে আপনার জীবনে কেনো ঝামেলা করবো না আমি। ভালো থাকবেন আপনি আপনার মতো আর আমি আমার মতো৷ এই কয়েকদিনের দূরত্বে আমি এতটুকু বুঝে গেছি,

জোর করে ভালোবাসা হয় না। আমি আপনার জীবনের একটা ঝামেলা মাত্র। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি খুব শীঘ্রই আপনাকে সেই ঝামেলা থেকে মুক্ত করে দিবো।’

ইতি আপনার অপ্রিয় একজন মানুষ,

‘ বর্ষা।’

পুরো চিঠিটা পড়ে পুরোই নিস্তব্ধ শুভ্র। আনমনেই বলে উঠল,

‘ তুমি আমার অপ্রিয় নয় বর্ষা, প্রিয় কেউ।’

তপ্ত নিশ্বাস ফেললো শুভ্র। বড্ড খারাপ লাগা কাজ করছে তাঁর ভিতর। কেন সে আগে কিছু বললো না বর্ষাকে। ধাপ করে নিচে বসে পড়লো বর্ষা। মাথা ভনভন করছে তার এখন কি করবে সে, কিভাবে বুঝাবে বর্ষাকে,

‘ এক সময় অপ্রিয় ছিল সে, কিন্তু এখন অনেক আপন প্রিয় কেউ।’

মাথা ভনভন করছে শুভ্রের। হঠাৎই শুভ্রের চোখ গেল খাটের ঠিক কর্নারে দিকে। বর্ষার দেওয়া সেই গিফট বক্সটা পড়ে আছে সেখানে। তালে তালে এই কয়দিনে দেখা হয় নি সেটা। শুভ্র চটপট এগিয়ে যায় সেটার দিকে। নিচে বসেই খুলে দেখলো গিফট বক্সটা। যেখানে রয়েছে লাভের তৈরি একটা শপিচ সাথে ছোট্ট একটা লাল রঙের টেডি। তার সাথে ছোট্ট একটা চিরকুট। শুভ্র সব রেখে চিরকুটটা হাতে নিলো যেখানে লেখা,

‘ জানি না আমার অনুভূতিগুলো আজও আপনার কাছে উপস্থাপন করতে পারবো কি না। অনেকদিন যাবৎ ভাবছি আপনাকে আমার মনের কথাগুলো বলে দেই কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছিল না। তবে আজ অনেক ভেবেচিন্তে সাহস করে বলতে এসেছি আপনায় ‘ভীষণ ভালোবাসি আপনায়’ সেই ছোট বেলা থেকে। আপনাকে ছোট বেলা থেকেই নিজের অজান্তেই অনেক বার আঘাত করেছি আমি। এর জন্য আমি খুবই দুঃখিত।
জানি না আপনি কোনোদিনও আমায় ভালোবাসবেন কিনা। তবে আমি বাসি, ভীষণ বাসি, বড্ড ভালোবাসি আপনায়। আপনার উওরের অপেক্ষায় আছি কিন্তু, প্লিজ নিরাশ করবেন না একটুও।’

ইতি,

বর্ষা।’

আনমনে হাসলো শুভ্র। মেয়েটা তাঁকে বড্ডই ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু এখন,

কথাটা ভাবতেই হাসি গায়েব হয়ে গেল শুভ্রের। কি করবে এখন? হঠাৎই বলে উঠল শুভ্র,

‘ বাংলাদেশ যেতে হবে তাঁকে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূরত্ব হাঁটাতেই হবে। এ যেন বেশি যন্ত্রনা দিয়ে ফেলছে তাদের।’

_____

‘ জানিস তো,
একটুখানি ভুল বোঝাবোঝি একটা সম্পর্কে ভেঙে দেওয়ার অনেকখানি ক্ষমতা রাখে। কিছুটা ওই কাঁচের গ্লাস হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে যাওয়া সময়ের মতো।’

ভরা ক্লাস রুমের মাঝে বসে হুট করেই কথাটা বলে উঠল হিয়া শিফাকে। আর হিয়ার কথা শুনে হাল্কা চমকে উঠলো শিফা। বেশ খানিকটা অবাক হয়েই বললো সে,

‘ মানে?’

প্রতি উওরে তাকায় হিয়া শিফার মুখের দিকে তারপর বলে,

‘ তুই কি বুঝিস নি আমার কথা?’

‘ বুঝি নি এমনটা নয় আসলে তুই কিসের ভিত্তিতে কথাটা বললি সেটাই ভাবছি।’

‘ বেশি ভেবে কাজ নেই বুঝলি, সব সময় এতটুকু কথা মাথায় রাখবি যে, অনেক সময় আমরা চোখের সামনে যেটা দেখি সেটা সত্যি হয় না। দেখা না দেখার মাঝেও অনেক সত্যতা লুকিয়ে থাকে। যেটা জানলে হয়তো তুই নিজেও ভীষণ চমকে যাবি।’

শিফার কথার আগামাথা কিছু বুঝতে না পেরে বলে উঠল শিফা,

‘ আমি তোর কথার আগামাথা কিছু বুঝতে পারছি না হিয়া?’

এবার বেশ বিরক্ত হলো হিয়া। বিরক্ত মাখা দৃষ্টি নিয়েই শিফার দিকে তাকিয়ে বললো সে,

‘ এত বুঝে তোর কি কাজ?’

‘ যাহ বাবা এতকিছু বললি, কিন্তু কেন বললি তা শুনবো না।’

‘ বেশি শুনে কাজ নেই, শুধু এতটুকু জেনে রাখ খুব শীঘ্রই আমি আর নির্মল বিয়ে করছি।’

সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় বড় হয়ে যায় শিফার। অবাক হয়েই বলে সে,

‘ কি?”

‘ দিনে দিনে কি কানা হয়ে যাচ্ছিস নাকি?’

‘ কানা হয় নি কিন্তু তোর কথাটা যেন হজম হলো না।’

‘ হজম না হওয়ার কি আছে?’

‘ তুই সত্যি সত্যি নির্মল ভাইয়াকে বিয়ে করবি?’

‘ তা নয়তো কি নির্মল আমায় কতটা ভালোবাসে বল তো?’

‘ কিন্তু কিছুদিন আগেই তো নির্মল ভাইয়াকে ভিলেন বলে আখ্যায়িত করলি তাঁর বেলা?’

‘ ওগুলো সব পুরনো আর আগের কথা। জানিস না আগের দিন বাঘে খায়।’

‘ তার মানে তুইও,

উওরে মুচকি হাসে হিয়া। যা দেখে শিফা খুশি হয়ে বলে,

‘ যা ভালোই হয়েছে। অবশেষে নির্মল ভাইয়া তোর মন জয় করতে পারলো। উড়ে কাক্কু বিয়া খামু?’

শেষের কথাটা শিফা এতটাই জোরে বললো যে আশেপাশের সবাই তাকালো ওদের দিকে। টিচার তো তক্ষৎনাত বলে উঠল ‘সাইলেন্ট’। শিফা ঠোঁটে কামড় দিলো মুহূর্তেই। শিফার কান্ডে হিয়া সোজা হয়ে বসলো তারপর বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললো,

‘ তুই কি আস্তে কথা বলতে পারিস না বুদ্ধু।’

হিয়ার কথা শুনে শিফাও ঠোঁটে কামড় দিয়ে আস্তে বললো,

‘ সরি দোস্ত এক্সাইটিং এ জোরে হয়ে গেছে।’

প্রতি উওরে শুধু একটা শব্দই উচ্চারন করে হিয়া,

‘ পাগল একটা।’

_____

সত্ত্বা দিয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে বসে টিভিতে নাটক দেখতে দেখতে সুপারি কাটছিল বর্ষাদের বাড়ির কাজের লোক রাহেলা সুন্দরী। পাশেই বর্ষার মা বসে আছে চুপচাপ। ইদানীং কোনোকিছুই ভালো লাগে না তাঁর। ‘বর্ষা’ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান যার দরুন বর্ষা চলে যাওয়ায় পুরো বাড়িটাই একদম ফাঁকা হয়ে গেছে তাদের। হঠাৎই রাহেলা সুন্দরী বলে উঠল,

‘ আচ্ছা আফা এই যে বাংলা নাটকগুলায় খালি নায়করে লইয়া টানাটানি করে কামডা কি ঠিক করে কন? বিয়া হইয়া গেছে তারপরও এক লগে দুই তিনডা মাইয়া নায়করে লইয়া টানাটানি করে। কই হেতিগো দেশে কি পোলাগো অভাব পড়ছে নাকি। আমগো গ্রামে কতগুলো ব্যাডা আছে এহনো বিয়া করে নাই ওডির পিছনে ঘুর ঘুর করলেও তো হয়।’

রাহেলার কথা শুনে বর্ষার মা ফিক করে হেঁসে ফেললো তারপর বললো,

‘ তুমিও না রাহেলা কি যে বলো?’

‘ হাঁচা কইতাছি আফা মোর ছোডো বেলা থেইক্কা স্বপ্ন একটু ঘটকালি করমু কিন্তু কোনোদিন সুযোগই পাইলাম না।’

রাহেলার কথা শুনে এবার উচ্চস্বরে হেঁসে ফেললো বর্ষার মা। পাল্টা কিছু বলবে এরই মাঝে বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠল উচ্চ স্বরে। যা দেখে রাহেলা সুপারি কাটা বন্ধ করে বললো,

‘ আপনি বহেন আমি খুলতাছি।’

বলেই চটজলদি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো রাহেলা তারপর এগিয়ে গেল দরজার কাছে। দরজা খুলতেই বর্ষাকে দেখে। বেশ অবাক হয়েই চেঁচিয়ে বললো রাহেলা,

‘ আফা বর্ষামনি আইছে?’

রাহেলার কথা শুনে বর্ষার মা বেশ অবাক হয়েই বললো,

‘ মাথা গেছে নাকি রাহেলা বর্ষা কি করে আসবে ও তো লন্ডন?’

‘ আমি সত্যি কইতাছি আফা দেহেন?’

ততক্ষণে বর্ষাও বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ে। বর্ষার মাও পিছন ঘুরে সত্যি সত্যি বর্ষাকে দেখে অবাক হয়ে বলে উঠল,

‘ তুই এসেছিস মা?’

প্রতি উওরে মায়ের কাছে এগিয়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে নির্বিকার গলায় বললো বর্ষা,

‘ কেমন আছো মা?’

‘ হুম ভালো তুই?’

‘ হুম ভালো।’

মেয়ের কথা শুনে মেয়েকে ছাড়িয়ে বললো বর্ষার মা,

‘ তা হঠাৎ চলে এলি শুভ্র আসে নি।’

‘ তোমাদের কথা ভীষন মনে পড়ছিল আর দাদুরও নাকি শরীরটা ভালো নেই তাই চলে এলাম।’

‘ তা নয় বুঝলাম শুভ্র আসে নি?”

‘ উনি অফিসের কাজে ব্যস্ত মা তাই আসে নি আমি একাই এসেছি।’

‘ ওহ তা তুই কি এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি এখানে এসেছিস?’

‘ হুম।’

প্রতি উওরে কিছুক্ষন ভেবে বলে উঠল বর্ষার মা,

‘ যাক ভালো হয়েছে তুই রুমে গিয়ে ফ্রেশ হ আমি খাবার বারছি।’

মায়ের কথার উওর হিসেবে তেমন কিছু না বলেই৷ নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো বর্ষা। মেয়ের কাজে খানিকটা খটকা লাগলো বর্ষার মায়ের। মেয়েটা হুট করে চলে এলো কাউকে কিছু না বলে। চোখ মুখ দেখেও ঠিক ভালো ঠেকলো না কিছু কি হয়েছে তবে?” ভাবলো বর্ষার মা।’

_____

হসপিটালে নিজের রুমের চেম্বারে বসে আছে নির্মল। চোখে মুখে খুশির ছাপ তাঁর। পরিশেষে তার প্রান প্রিয়দর্শিনী তাঁকে ভালোবাসি বলেছে’৷ এবার খুব শীঘ্রই হিয়াকে বিয়ে করে একেবারে নিজের করে নিবে নির্মল। হঠাৎই পেশেন্টের কথায় হুস আসে নির্মলের। পেশেন্ট বলে,

‘ আবার কি আসা লাগবে ডাক্তার বাবু?’

প্রতি উওরে পেশেন্টের দিকে তাকিয়ে বললো নির্মল,

‘ জ্বী এই ঔষধগুলো খেয়ে কতটুকু সুস্থতা ফিল করছেন এটা বলার জন্য হলেও আপনাকে একবার আসতে হবে।”

‘ ঠিক আছে ডাক্তার বাবু।’

এই বলে লোকটি বেরিয়ে গেল রুম থেকে। এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হলো নির্মলের বন্ধু আকিব। খুব খুশি খুশি ভাব নিয়েই বললো সে,

‘ ভাই! ভাবি তো বিয়ে করতে রাজি এবার তবে বিয়ের তোড়জোড়টা শুরু করে দেই?’

আকিবের কথা শুনে বেশ অবাক হয়েই বললো নির্মল,

‘ তুই কি করে জানলি?’

‘ আরে ভাই এখন কি আর খাই সুজি আপনার হাব-ভাব দেখে হলেও অনেক কিছু বুঝি।’

হাসলো নির্মল। আশ্চর্য তাঁর হাব-ভাব কি বলে দিচ্ছে হিয়া তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে। নির্মল লজ্জা পাচ্ছে, চোখ মুখে স্পষ্ট লজ্জার ছাপ। নির্মলের কান্ডে আকিব হেঁসেই বলে উঠল,

‘ আরে ভাই এত লজ্জা পেলে চলে কন?’

‘ আমি মটেও লজ্জা পাচ্ছি না।’

‘ আপনার চোখ তো তা বলছে না ভাই।’

‘ তুই আবার কবে থেকে চোখ পড়তে শুরু করলি?

‘ এই তো ভাই মাত্রই।’

‘ তুই যাবি এখান থেকে।’

হাসলো আকিব। প্রথমবার নির্মলের পিছনে লাগার সুযোগ পেয়েছে সে। এত সহজে ছেড়ে দিলে চলে নাকি। আকিব হেঁসেই বললো,

‘ তা ভাই আপনার বাসর ঘরের বিছানার চাঁদরটা কি কালার দিলে ভালো হবে বাইট্টা কালার নাকি রং চা খাওয়ার পর নিচে চা পাতা পড়লে যে কালারটা হয় ওই কালার তবে আপনি চাইলে আমি সিলভার কালারও দিতে পারি ভাই।

নির্মল মগ্ন ছিল হিয়াকে নিয়ে তাই আকিবের কথা শুনে আনমনেই বলে উঠল নির্মল,

‘ বাইট্টা কালারই দিস।’

পরক্ষণেই কি বললো সেটা ভাবতেই চোখ বড় বড় করে বললো নির্মল,

‘ কি কইলি তুই?’

সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ স্বরে হেঁসে ফেললো আকিব। আকিবের হাসি দেখে তেড়ে আসলো নির্মল তারপর বললো,

‘ মজা নিচ্ছিস আমার সাথে তোরে তো আমি,

সাথে সাথে আকিব হাসতে হাসতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। আকিব যেতেই থেমে গিয়ে বসে পড়লো নির্মল মাথাটা বোধহয় সত্যি সত্যি গেছে তাঁর। হঠাৎই দরজা খুলে আবারো বলে উঠল আকিব,

‘ ভাই আমি যেমনে পারি আপনার জন্য বাইট্টা কালার বিছানার চাঁদর কিনেই ছাড়মু যতই হোক আপনার বাসর ঘর বলে কথা।”

রেগে যায় নির্মল দ্বিতীয় বারের মতো আকিবের দিকে তেড়ে যেতে যেতে বলে,

‘ দাঁড়া তোর বাইট্টা কালার বার করছি আমি,

নির্মলের কথা শুনেই পগার পার আকিব। তাঁকে আর পায় কে?’ তবে বাইট্টা কালার চাঁদর মাস্ট চাই তাঁর!

#চলবে……

#ধূসর_শ্রাবণ💚
#লেখিকা:#তানজিল_মীম💚
#পর্ব-২৩
________________

অন্ধকার রাত। আকাশটা নির্বিকার প্রায়। আর এই নির্বিকার আকাশের ভিড়েই বেলকনিতে চুপচাপ বসে আছে শুভ্র। হাতে তাঁর সিগারেট, সচরাচর এইসব খায় না শুভ্র কিন্তু আজ খাচ্ছে। নিজের ভুলের জন্য নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে শুভ্রের সাথে কষ্টও পেতে হচ্ছে খুব। বর্ষা তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে মাত্র কয়েক ঘন্টাই তো হলো, কিন্তু এই কয়েক ঘন্টাই শুভ্রকে বর্ষার শুন্যতা ফিল করাচ্ছে হারে হারে। বোকারানি বড্ড বেশিই কষ্ট দিয়ে গেছে তাঁকে। শুভ্র বুঝতে পারছে না এই মুহূর্তে তাঁর ঠিক কি করা উচিত? বাংলাদেশ গেলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তাঁর। কিন্তু বর্ষা কি বুঝবে তাঁকে? বুঝে উঠতে পারছে না শুভ্র সবকিছু শুন্য শুন্য লাগছে কেমন? সিগারেটে আরেকবার টান দিলো শুভ্র ধোঁয়া উঠালো পরপর। এমন সময় বিকটও শব্দে শুভ্রের ফোনটা বেজে উঠল। শুভ্র ফোনটা হাতে নিলো দেখলো মোবাইল স্কিনে থাকা ‘ঔপন্যাসিকা’ নামটা জ্বল জ্বল করছে। শুভ্র দেখলো নামটা তাকিয়ে রইলো মোবাইল স্কিনের দিকেই কিন্তু ফোনটা তুললো না। ভালো লাগছে না এই মুহূর্তে। শুভ্র তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ফোন বেজে কেটে গেল একবার। শুভ্র তাকিয়ে রইলো সেদিকে এরই মাঝে আবারো বেজে উঠলো ফোনটা। শুভ্র এবারও তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন তারপর ইচ্ছে না থাকা সত্বেও ফোনটা তুললো সে তারপর নীরব কন্ঠে বললো,

‘ হ্যালো,

সাথে সাথে অপরপ্রান্তের মেয়েটি বলে উঠল,

‘ কি মিস্টার হিরো হিরোইন ছেড়ে চলে গেছে বলে দেবদাস হয়ে বসে আছেন নাকি?’

মেয়েটির কথা শুনে খুব আক্ষেপ নিয়েই বলে উঠল শুভ্র,

‘ আর হিরো আমার তো মনে হয় এই গল্পের আসল ভিলেন আমিই।’

শুভ্রের কথা শুনে হাসলো মেয়েটি যা শুনে বললো শুভ্র,

‘ তুমি হাসছো?’

‘ হাসবো না তো কি করবো কি এতো ভাবছেন বলুন তো?’

‘ বিশ্বাস করো আমি সত্যি বুঝতে পারছি না এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিত?’

‘ কি করবেন মানে হিরোইনের অভিমান ভাঙাবেন।’ তা বাংলাদেশ কবে আসছেন?’

‘ আসতে তো কালই মন চায় কিন্তু অফিস থেকে ছুটি দিচ্ছে না।’

‘ আপনার অফিস আগে না বউ।’

‘ আর বউ সে তো ভুল বুঝে ডিভোর্স দেওয়ার কথা ভাবছে।’

‘ তা ভাববে না, আপনি অন্য মেয়েকে জড়িয়ে ধরবেন বউকে ইগনোর করবেন তাহলে বউ কি তা দেখে ঘরে বসে আঙুল চুসবে।’

হতভাগ শুভ্র। হতভাগ হয়েই বললো শুভ্র,

‘ তুমি সব জেনেও এসব বলছো।’

‘ হুম বলছি কারন বর্ষা তো জানে না এটা আপনায় বুঝতে হবে। আর বর্ষার জায়গায় যে কেউ থাকলে এমনটাই করতো। আমি থাকলে হয়তো আমিও এমনই করতাম।’

‘ সব বুঝতে পারছি আমি। কিন্তু পরিস্থিতিটাই এমন ছিল যে আমি চাইলেও কিছু করতে পারছিলাম না। তবে আমি তো এসেছিলাম বর্ষার কাছে সবটা বলতে কিন্তু সব শোনার আগেই তো বর্ষা চলে গেল।’

‘ আসলে কি বলুন তো জীবনটা এমনই হুট করেই সব কিছু ঘটে যায়।’

‘ সেটাই তো দেখছি।

‘ হুম, তবে এখন যা হয়ে গেছে সেটা ভেবে লাভ নেই। সামনে খারাপ কিছু হওয়ার সবটা সামলান শুভ্র।’

‘ হুম সামলাবো তো বটেই।’

‘ হুম তাড়াতাড়ি করবেন দূরত্ব আর সয় না।’

শুভ্র অবাক হলো অপরপ্রান্তের মেয়েটার কথা শুনে অবাক হয়েই বললো সে,

‘ তোমার আবার কিসের দূরত্ব?’

‘ ওটা আপনি বুঝবেন না।’

‘ যাইহোক তোমার খবর বলো বিয়ে কবে করছো?’

শুভ্রের কথা শুনে বেশ আগ্রহ নিয়েই বললো মেয়েটি,

‘ হুম করবো খুব শীঘ্রই। আপনাকে আর বর্ষাকে কিন্তু আসতেই হবে?’

‘ তা নয় আসলাম তোমার হিটলার বাবা রাজি তো বিয়েতে?’

‘ বাবার কথা জানি না কিন্তু বিয়েটা আমি করছি। ভালোবাসি কিনা?’

উওরে হাসলো শুভ্র। তারপর বললো,

‘ অল দা বেস্ট।’

‘ আপনাকেও। খুব শীঘ্রই চলে আসুন শুভ্র, অভিমান মেশানো দূরত্ব বেশিদিন ফেলে রাখা ঠিক না।’

তপ্ত নিশ্বাস ফেললো শুভ্র। তারপর বললো,

‘ আমি জানি কিন্তু কি করবো বলো আমি যে নিরুপায়।’

‘ নিরুপায় বলে কিছু হয় না শুভ্র, সবই পরিস্থিতির শিকার। পরিস্থিতি নিয়ে তো অনেকদিন চললেন এবার না হয় একটু বেরিয়ে আসুন। নিজের প্রিয় মানুষের কাছ থেকে বেশিদিন দূরে থাকা যায় না কিন্তু?’

‘ তা আর বলতে?’

প্রতি উওরে কিছুক্ষন চুপ থাকলো অপরপ্রান্তের মেয়েটি। তারপর বললো,

‘ শুনুন, বেশি কষ্ট পাবেন না। বিয়ে করা বউ আপনার অধিকার খাটান আর নিয়ে আসুন নিজের কাছে। ভুল বোঝাবুঝি কাটান, দূরত্ব কমান জীবন সুন্দর হবে। শুধু সিগারেটে ধোঁয়া উঠালেই হবে নাকি।

অবাক হলো শুভ্র, স যে সিগারেটে ধোঁয়া ওড়াচ্ছে এটা ওই মেয়েটা কি করে জানলো। তবে বেশি ভাবলো না, একটু সাহসীকতাটাও বাড়লো যেন শুভ্রের ঔপন্যাসিকার কথা শুনে। শুভ্র মনে মনে ভাবলো অনেক কিছু তারপর বললো,

‘ হুম ঠিক বলেছো। আমি আসছি ঔপন্যাসিকা।’

শুভ্রের কথা শুনে খুশি হলো অপরপ্রান্তের মেয়েটি তারপর বললো,

‘ এই না হলে হিরোর মতো কথা।’

অতঃপর, পর পর আরো কিছুক্ষন কথা হয় শুভ্রের সাথে ঔপন্যাসিকা নামে সেইভ করা মেয়েটার সাথে। সিগারেটটা হাতে বসেই পুড়ে পুড়ে কমতে থাকে একটু একটু করে। শুভ্র আর খেলো না, হয়তো ভুলেই গেছে তাঁর হাতে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে।’

______

পরন্ত বিকেল। জানালার কার্নিশ বেয়ে উপচে আসছে রঙিন আলো। বাতাস বইছে না তেমন। হাল্কা গরম গরম ভাব। গাছের পাতারাও নিশ্চুপ আজ। নড়ছে না তেমন। আর এই নিশ্চুপতার ভিড়েই বেলকনিতে থাকা গ্রিল ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বর্ষা। আজ দু’দিন হলো বর্ষা লন্ডন থেকে এসেছে। অথচ এই দুদিনে একটি বারও কথা হয় নি শুভ্রের সাথে বর্ষার। অবশ্য হবে কি করে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোবাইলটা ব্যাগ থেকেই বেরই করে নি বর্ষা। মন খারাপ তাঁকে এমন ভাবে গ্রাস করেছে যে, মোবাইল, টিভি, ইন্টারনেট সবকিছুকেই বেমানান লাগছে নিজের কাছে। কষ্ট হয় বর্ষার, ভীষণ কষ্ট যখনই হসপিটালের সেই মেয়েটার সাথে শুভ্রের জড়িয়ে ধরার বিষয়টা মনে করে তখনই সবকিছু এলেমেলো লাগে বর্ষার। চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো নিচে। শুভ্র তাঁকে ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে, এই যন্ত্রনা প্রথম অনুভব করেছিল বর্ষা যেদিন শুভ্র রেস্টুরেন্টে বসে তাঁকে বিয়ে করার আগেই ডিভোর্স শব্দটা উচ্চারণ করেছিল। তবে তখনকার যন্ত্রণার থেকেও এখন বেশি কষ্ট হচ্ছে বর্ষার। লন্ডনের সেইসব দিনগুলোর কথা ভাবলে আজও ভালোবাসার শীতল স্পর্শের কথা মনে পড়ে বর্ষার। সেই একসাথে জাহাজ ভ্রমন, স্কেটিং করা, শুভ্রকে জ্বরের ঘোরে জড়িয়ে ধরা, তাঁর সেবা করা, আর জন্মদিনের পার্টি। সবকিছুই যেন স্বপ্নের মতো ছিল বর্ষার৷ আর আজ সেসব দিনগুলোর কথা ভাবলেও হৃদয়টা যেন ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে বর্ষার। ভালোবাসা যে মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি গভীর যন্ত্রণাও দেয় তা হারে হারে টের পাচ্ছে বর্ষা। আর ভাবলো না বর্ষা কষ্ট হচ্ছে তাঁর ভীষণ কষ্ট। গ্রিল ছেড়ে রুমের দিকে হাঁটা দিলো বর্ষা আর ভালো লাগছে না। এমন সময় তাঁর রুমে দৌড়ে আসলো শুভ্রতা, বর্ষাকে দেখেই ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো সে। তারপর উত্তেজিত কন্ঠ নিয়ে বললো,

‘ ভাবি কেমন আছো তুমি? কতদিন পর তোমায় দেখলাম?’

আচমকা শুভ্রতাকে দেখে সাথে শুভ্রতার কাজে চমকে উঠলো বর্ষা। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো সে,

‘ হুম ভালো তুমি?’

‘ ভালো কিন্তু আমি তোমার ওপর রাগ করেছি ভাবি?’

শুভ্রতার কথা শুনে বর্ষা কিছুটা নির্বিকার গলায় বললো,

‘ কেন?’

‘ কেন আবার তুমি দুদিন হলো বাংলাদেশ এসেছো অথচ আমাদের বাড়ি যাও নি কেন?’

থমকে গেল বর্ষা। এবার কি বলবে সে। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল বর্ষা,

‘ আসলে হয়েছে কি শুভ্রতা শরীরটা আসার পর থেকেই ভালো না তাই আর কি? আমি এসেছি বেশি দাদুকে দেখতে অথচ দেখো তাঁকেই দেখতে যেতে পারছি না।’

শুভ্রতা শুনলো। সাথে মেনেও নিলো। বেশি না ভেবে বললো সে,

‘ হুম আন্টির কাছে শুনেছি আমি। যাই হোক আজ বাড়ি যাবে তো ভাইয়া কিন্তু আসছে?’

এবার অবাক হলো বর্ষা। শুভ্র আসছে? কিন্তু কেন ওহ হয়তো দাদুর জন্য। খানিকটা নিরাশা নিয়েই বললো বর্ষা,

‘ আমি আজ যাবো না শুভ্রতা পরে যাবো শরীরটা সত্যি ভালো নেই।’

‘ এমনটা করলে কিন্তু চলবে না, বাবা বার বার বলেছে তোমাকে যেন নিয়ে যাই আমি। আর মা তো রেগে আগুন হয়ে আছে তুমি কেন আগে আমাদের বাড়িতে যাও নি তাই। আর দাদুর কথা কি বলবো দাদু তো এখনো জানে না যে তুমি এসেছো?’

শুভ্রতার কথা শুনে মন খারাপ হলো বর্ষার। সবাই তাঁর উপর রেগে আছে। বর্ষার ভাবনার মাঝেই আবারো বলে উঠল শুভ্রতা,

‘ তুমি যাবে তো আমার সাথে ভাবি, বাড়িতে সবাই তোমার অপেক্ষা করছে?’

প্রতি উওরে কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো বর্ষা,

‘ হুম।’

খুশি হলো শুভ্রতা। তারপর বর্ষার গলা জড়িয়ে ধরে বললো সে,

‘ থ্যাংক ইউ ভাবি।’

উওরে শুঁকনো হাসে বর্ষা। হঠাৎই শুভ্রতা বলে উঠল,

‘ তোমার সাথে কিছু সিক্রেট কথা আছে ভাবি?’

শুভ্রতার কথা শুনে বেশ বিস্মিত ভরা কন্ঠ নিয়ে বললো বর্ষা,

‘ সেটা কি?’

‘ বাড়ি গিয়ে বলবো।’

______

সকাল থেকে রান্না ঘরে বসে আছে হিয়া। স্পেশাল কিছু রান্না করছে সে। জীবনে ফাস্ট টাইম রান্না করছে হিয়া। তাও নির্মলের জন্য। যদিও হিয়া জানে না রান্নাটা কেমন হবে তারপরও চেষ্টা করছে সে। আর মেয়ের এমন কাজে চরম অবাক হিয়ার মা। যে মেয়ে কখনো রান্নার ‘র’ও শেখতে চায় নি সেই মেয়ে আজ রান্না করছে ভাবলেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠছে হিয়ার মার। মেয়েটা পাগলটাগল হয়ে গেল কি না সেটাই ভাবছেন উনি। রান্না ঘরে যেন কেউ না ঢোকে সেই জন্য দড়ি দিয়ে আঁটকে দিয়েছে হিয়া। অতঃপর ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে রান্না কমপ্লিট করলো হিয়া। তারপর সেগুলো টিফিনবক্সে ভরে টেবিলে সুন্দর মতো গুছিয়ে রাখলো। তারপর কাউকে কিছু না বলেই চলে যায় হিয়া ওয়াশরুমে। এরপর ফ্রেশ হয়ে সুন্দর মতো সেজেগুজে সোজা চলে যাবে হিয়া নির্মলের হসপিটালে। আজ বড়সড় একটা সারপ্রাইজ দিবে সে নির্মলকে।’

এদিকে মেয়ের কান্ডে অবাক প্রায় হিয়ার মা। মেয়ের কান্ড কারখানা সব যেন তাঁর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।’

হসপিটাল নিজের চেম্বারে বসে ছিল নির্মল। এমন সময় চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, পেস্ট কালার থ্রি-পিচ, খোলা চুল, হাতে সাদা রঙের চুড়ি আর ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক দিয়ে হাজির হলো হিয়া। হাতে তাঁর টিফিনবক্স। হিয়া দরজা সামনে দাঁড়িয়ে তাকালো নির্মলের দিকে। তারপর বললো,

‘ আসবো?’

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে