#ধূসর শ্রাবণ
#লেখিকা:#তানজিল_মীম
#পর্ব-১০+১১
________________
ভয়ে কাচুমাচু হয়ে খিঁচে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে বর্ষা। একেই বলেই বেশি ভাব নিতে নেই। একটু সুন্দর কি লাগছিল ওমনি ভাব নিয়ে নিচে নামতে গেল। ভালো হয়েছে তোর কোমড়টা দুইভাগ হয়ে গেছে। আর যাওয়া লাগবে না ঘুরতে এখন শুভ্র তোকে একা রেখেই চলে যাবে। এই রকম নানান কিছু ভেবে মনে মনে বকবক করতে লাগলো বর্ষা। হঠাৎই শুভ্র বিরক্তমাখা মুখ নিয়ে বললো,
‘ এই ইস্টুপিট গার্ল চোখ খোলো বলছি?’
সাথে সাথে চোখ খুলে ফেললো বর্ষা। আশেপাশে তাকাতেই বুঝতে পারলো বর্ষা তাঁর কোমড় ভাঙে নি কারন তাঁর কোমড় ভাঙার আগেই শুভ্র তাঁকে ধরে ফেলেছে। বর্ষা গালে হাত দিয়ে আনমনেই ভাবলো,
‘ ও মাই গড আহা কি রোমান্টিক সিন জামাই আমায় ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এ তো পুরোই বাংলা সিনেমার কাহিনী। আমি হিরো আর আমার জামাই হিরোইন থুড়ি থুড়ি আমার জামাই হিরো আর আমি হিরোইন। আহা! আমার জামাইডা কত্তো কিউট!’
এদিকে বর্ষাকে নিজের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুভ্র বিরক্ত হয়ে বললো,
‘ ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’
শুভ্রের কথা শুনে আনমনেই বলে উঠল বর্ষা,
‘ আপনাকে দেখছি?’
‘ কি বলতে তুমি?’
শুভ্রের ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনে বর্ষা তাঁর ধ্যান থেকে ফিরে এলো তক্ষৎনাত শুভ্রকে ছাড়িয়ে সোজা হয়ে বললো সে,
‘ ইয়ে না মানে কিছু না চলুন তাহলে যাওয়া যাক।’
উওরে শুভ্রও কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
‘ হাঁটার সময় চোখ কোথায় থাকে তোমার?’
শুভ্রের কথা শুনে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো বর্ষা,
‘ আসলে বুঝতে পারি নি, সরি।’
‘ হুম হয়েছে চলো এখন?’
শুভ্রের কথা শুনে বর্ষা খুশি হয়ে বললো,
‘ হুম চলুন।’
বলেই বাড়ির ভিতর থেকে আস্তে আস্তে বের হলো বর্ষা আর শুভ্রও জোরে নিশ্বাস ফেলে সোফার ওপর থেকে ব্লু রঙের শার্টটা হাতে নিয়ে সেটা পড়তে পড়তে চললো বর্ষার পিছু পিছু।’
‘ এই মেয়েটা নির্ঘাত তাঁকে পাগল বানিয়ে ফেলবে?’
_____
আকাশটা তো মস্ত বড়। আর এই মস্ত আকাশে মাঝে লন্ডনের বিশাল এক সমুদ্রের ভীড়ে পাশাপাশি জাহাজে করে দাঁড়িয়ে আছে বর্ষা আর শুভ্র। কয়েক মুহূর্ত আগেই তাঁরা এসেছে এখানে। বর্ষা তো মাঝ সমুদ্রের মাঝখানে এসে বহুত খুশি। সে ভাবে নি শুভ্র তাঁকে এত সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে আসবে। তাঁর ইচ্ছে করছে শুভ্রকে একবার জড়িয়ে ধরে বলতে ‘আমি ভীষণ খুশি হয়েছি জামাই’ কিন্তু কথাটা মন পর্যন্তই আঁটকে রইলো তাঁর। সময়টা পরন্ত বিকেল বেলা। আকাশটা একদম নীল-সাদা সংমিশ্রনে হয়ে আছে। মেঘেরাও দুলছে তাদের পিছু পিছু। নিচেই সমুদ্রের পানিরা দুলছে বারংবার। শুভ্রের দৃষ্টি সেই মাঝসমুদ্রের দুলতে থাকা পানিদের দিকেই। আর বর্ষার দৃষ্টি শুভ্রের দিকে। পাশাপাশি রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্র বর্ষা। হঠাৎই শুভ্র বলে উঠল,
‘ জায়গাটা সুন্দর না,বর্ষা?’
উওরে বর্ষাও শুভ্রের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পানির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ হুম খুব।’
বর্ষার কথা শুনে হাসলো শুভ্র। তারপর বললো,
‘ আইসক্রিম খাবে?’
উওরে বর্ষা অবাক হয়ে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ এখানে আইসক্রিমও পাওয়া যায়।’
‘ এখানে সব পাওয়া যায় চলো আমার সাথে?’
এতটুকু বলে বর্ষার হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো শুভ্র। আর বর্ষাও বেশি কিছু না ভেবে এগিয়ে চললো শুভ্রর সাথে সাথে।’
____
কলিং বেল বাজতেই হিয়ার মা এসে দরজা খুলে দিলো। সামনেই হিয়ার ভিজে যাওয়া মুখটা দেখে বললেন উনি,
‘ এত দেরি হলো কেন?’
মায়ের প্রশ্নে সামান্য বিরক্ত হলো হিয়া। হতাশা ভরা কন্ঠ নিয়ে বললো সে,
‘ দেরি হবে না মা? দেখো না বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে তারওপর রিকশা পাই না তাই তো এত দেরি।’
‘ হুম বুঝেছি তাড়াতাড়ি ড্রেস পাল্টে ফ্রেশ হয়ে আয় তোর জন্য নুডলস রান্না করেছিলাম এখন হয়তো ঠান্ডা হয়ে গেছে।’
‘ তিয়াস খেয়েছে মা?’ (হিয়ার ছোট ভাই)
‘ হুম।’
‘ আর বাবা?’
‘ তোর বাবা অফিস থেকে এখনো ফিরে নি।’
মায়ের কথা শুনে দেয়াল জুড়ে থাকা সামনের ঘড়িটার দিকে তাকালো হিয়া। প্রায় রাত নয়টার কাছাকাছি। কিছুটা অবাক হয়েই বললো হিয়া,
‘ রাত ন’টা বাজে বাবা এখনো আসে নি।’
এরই মধ্যে বাড়ির কলিং বেলটা আবারো বেজে উঠল। যা দেখে হিয়া বললো,
‘ ওই হয়তো বাবা চলে এসেছে?’
‘ হুম তুই গিয়ে তাড়াতাড়ি চেইঞ্জ করে নে এইভাবে দেখলে হাজারটা প্রশ্ন করবে।’
‘ ঠিক আছে মা।’
এতটুকু বলে নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো হিয়া। ভিজতো না সে নির্মল বলেছিল তাদের বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি থামাতে কিন্তু হিয়া রাজি হয় নি। তাই মাঝরাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে পড়ে হিয়া। বিকেলে সেই বৃষ্টিটা থেমে গিয়েছিল একটু কিন্তু হুট করে আবারো বেড়ে যায় কতক্ষণ পর যার দরুন বৃষ্টিতে ভিঁজে যায় সে। চোখ মুখ জ্বলছে, সাথে মাথাটাও জিম ধরে আছে হিয়ার। হিয়া চটজলদি ফ্রেশ হয়ে বসলো বিছানায় এরই মধ্যে তাঁর মোবাইলে মেসেজর টুং করে উঠলো। হিয়া দেখলো হাতে নিলো মোবাইলটা যেখানে লেখা,
‘ ঔষধ খেয়ে নিও কিন্তু তুমি যে বৃষ্টিতে ভিজেছো তা কিন্তু আমি দেখেছি জ্বর বাঁধলে তাঁর পরিনাম কিন্তু খারাপ হবে। তুমি হয়তো এখনো বুঝলে না আমার অবাধ্য হওয়ার পরিনতি কতটা ভয়ংকর!’
অবাক হলো হিয়া। এই লোকটা তাঁকে এইভাবে থ্রেড দিলো। পেয়েছেটা কি নিজের বিয়ে করা বউ নাকি যে যা বলবে তাই শুনতে হবে খাবে না সে ঔষধ! হুহ।’
বিরক্ত হয়ে ফোনটা ছুঁড়ে মারলো বিছানায়। এরই মধ্যে হিয়ার মা আসলো রুমে। মেয়েকে বসে থাকতে দেখেই বললেন উনি,
‘ তোর বাবা তোকে ডাকছে হিয়া?’
‘ কেন মা?’
‘ আমি কি করে বলবো?’
‘ তুমি সব জানো মা।’
উওরে মাথা নিচু করে ফেললো হিয়ার মা। মায়ের কান্ডে হিয়া বিস্মিত হয়ে বললো,
‘ আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না মা।’
এরই মধ্যে দরজা সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠল হিয়ার বাবা,
‘ দেখতে আসলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না হিয়া। ছেলে খুব ভালো। সরকারি চাকরি করে।’
বাবার মুখের ওপর আর কিছু বলতে পারলো না হিয়া চুপ হয়ে গেল সে।’
______
সারাদিন ঘুরে ফুঁড়ে সাথে বর্ষার জন্য কিছু শপিং করে বাসায় ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলো শুভ্র। কাল অফিস আছে তাঁর। শুভ্র বসতেই তাঁর দিকে একগ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দিল বর্ষা। শুভ্রও পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেয়ে নিলো। বর্ষা আবার শুভ্রের হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে টেবিলের ওপর রাখলো। তারপর খুশি মনেই বললো,
‘ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে আজকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’
প্রতি উওরে তেমন কিছু বললো না শুভ্র। কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
‘ আমার কাল অফিস আছে বর্ষা আমি এখন ঘুমাবো।’
‘ ঠিক আছে।’
‘ রুম পরিষ্কার করে ছিলে তো তুমি?’
উওরে বেশ কনফিডেন্স নিয়েই বললো বর্ষা,
‘ হুম।’
বর্ষার কথা শুনে তক্ষৎনাত বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো আলতো পায়ে এগিয়ে গেল সে উপরের রুমের দিকে। আর বর্ষাও বেশি কিছু না ভেবে সোফায় বসলো কতক্ষণ আজ কি কি করলো সেগুলো ভাবছে সে। জাহাজ ভ্রমন করলো, আইসক্রিম খেল, লন্ডনের শহরের আশপাশের অনেক জায়গায় ঘুরলো, শপিং করলো আর সব শেষে ডিনার সেরে বাড়ি ফিরলো। মোটামুটি লেভেলের বলতে গেলে ঝামেলা বিহীন খুব সুন্দর দিন কাটলো তাঁর। এমন সময় উপরের রুম থেকে কর্কশ কন্ঠে বলে উঠল শুভ্র,
‘ বরররররররররর্ষা?’
সাথে সাথে দৌড়ে এগিয়ে গেল সে উপরের দিকে।’
অন্যদিকে গা ভর্তি জামাকাপড়ের বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্র। চোখে মুখে বিরক্ত আর রাগের ছাপ। কিছুক্ষন আগেই আলমারির খুলতে গিয়ে আলমারি বোঝাই করা সব জামাকাপড় এসে পড়েছে তাঁর গায়ে। যার দরুন বর্ষাকে এত চিৎকার দিয়ে ডাকা। এদিকে বর্ষা হতভম্ব হয়ে রুমে ঢুকে বললো,
‘ কি হয়েছে? কি হয়েছে?’
বর্ষার কথা শুনে শুভ্র পিছন ঘুরে রাগে গদগদ হয়ে বললো,
‘ তোমার মাথা হয়েছে? এটা কি গুছিয়েছো তুমি?’
সাথে সাথে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো বর্ষা শুভ্রের মুখের দিকে। মনে মনে বললো,
‘ কাম সারছে?’😬
#চলবে…..
#ধূসর_শ্রাবণ💚
#লেখিকা:#তানজিল_মীম💚
#পর্ব-১১
________________
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুভ্র বর্ষার দিকে। চোখ দিয়ে যেন লাল আভা বের হচ্ছে তাঁর। আর বর্ষা ভয়ে ভয়ে শুভ্রের গায়ের ওপর থেকে একটা একটা করে জামাকাপড় সরাচ্ছে। বিকেলে তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করার জন্য সব জামাকাপড়গুলো একজোট বেঁধে আলমারিতে রেখেছিল বর্ষা। ভেবেছিল রাতে বাড়ি ফিরে শুভ্র ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সবগুছিয়ে রাখবে কিন্তু শুভ্র যে রুমে ঢুকেই সর্বপ্রথম আলমারিটাই আগে খুলবে বুঝতে পারে নি বর্ষা। বর্ষা সব জামাকাপড়গুলো সরিয়ে আস্তে আস্তে বললো,
‘ সরি?’
সঙ্গে সঙ্গে শুভ্র তেলেবেগুনে এক হয়ে বললো,
‘ তোমার সরির একশো এগারো।’
‘ রাগ করেন কেন তখন তাড়াতাড়ি যাবো বলে এই ভাবে গুছিয়ে রেখেছিলাম।’
‘ এইটাকে গুছিয়ে রাখা বলে?’
উওরে কি বলবে বুঝতে পারছে না বর্ষা। শুভ্র বর্ষার দিকে তেড়ে এসে বললো,
‘ তোমাকে যে কি করতে ইচ্ছে করছে আমার, তা বলে বোঝানো যাবে না?’
শুভ্রের কাজে বর্ষাও ঘাবড়ে গিয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়েছে নিমিষেই। শুভ্র আরো কিছু বলবে এরই মাঝে ফোনটা বেজে উঠল শুভ্রের। শুভ্র বিরক্ত নিয়ে ফোনটা তুলে বললো,
‘ হ্যালো?’
শুভ্রের ক্ষিপ্ত মেজাজের কথা শুনে অপরপাশে একজন বলে উঠল,
‘ কি মিস্টার হিরো আবারো ঝগড়া হলো নাকি বউয়ের সাথে।’
মোবাইলের কন্ঠ শুনে কান থেকে মোবাইলটা সরিয়ে মোবাইলের স্কিনের দিকে তাকালো শুভ্র। যেখানে লেখা ‘ঔপন্যাসিকা’।
শুভ্র একপলক বর্ষার দিকে তাকিয়ে জোরে নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো তক্ষৎনাত। তারপর মোবাইলটা কিছুটা দূরে রেখে কাট কাট গলায় বর্ষার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আধ ঘন্টার মধ্যে পুরো রুম পরিষ্কার না করলে আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন? ইস্টুপিট একটা!’
শেষের কথাটা শুভ্র এতটাই জোরে বললো যে পুরো কেঁপে উঠলো বর্ষা। বর্ষাকে কাঁপতে দেখে আর একটু বর্ষার কাজে এসে জোরে শব্দ করে বললো শুভ্র,
‘ বুঝতে পেরেছো, ইডিয়েট?’
শুভ্রের কথা শুনে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে মাথাটা উপর উপর নিচ করে বললো বর্ষা,
‘ হুম।’
বর্ষার কথা শুনে শুভ্রও বেশি কিছু না ভেবে মোবাইলটা কানে নিয়ে আরেকবার হ্যালো বলে চলে যায় বেলকনির দিকে। আর বর্ষাও নিরাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে শুভ্রের যাওয়ার পানে। হুট করেই মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। প্রায় রাতেই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলে শুভ্র। আর ফোনটা আসলেই শুভ্র কেন যেন শান্ত মুডে চলে যায় যে জিনিসটা বর্ষাকে খুব ভাবায়? গভীর ভাবে ভাবায়। কে করে রোজ রাতে শুভ্রকে ফোন। বর্ষা এখনো বুঝে উঠতে পারছে না তাঁর আর শুভ্রের সম্পর্কটা আসলে কোন দিকে যাচ্ছে। ‘ভালোবাসা’ শব্দটা কি তাঁর জীবনে আসবে কোনোদিন?’
তপ্ত নিশ্বাস ফেলে এলেমেলো আর অগোছালো রুমটাকে গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো বর্ষা। জীবনটা যেন ধূসরে ধূসরে আঁটকে গেছে খুব।’
ঘড়িতে একটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই।
জোরে নিশ্বাস ফেলে বেলকনি ছেড়ে রুমে প্রবেশ করলো শুভ্র। মোবাইলে কথা বলা শেষ হয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু রুমে আসে নি সে। বাংলাদেশ ছেড়ে লন্ডনে এসেছে মাত্র কয়েকদিনই হলো তাদের। অথচ এই কয়দিনেই বিতৃষ্ণা ধরে গেছে শুভ্রের। বর্ষার বোকা বোকা কাজ কর্মে বেশ বিপাকে ফেলছে তাঁকে? এই মেয়েটা কি আধও কখনো ঠিক হবে না। বুঝে উঠতে পারে না শুভ্র। রুমে ঢুকে পুরো রুমে চোখ বুলালো শুভ্র। পুরো রুম গুছিয়ে বিছানায় চুপটি করে শুয়ে আছে বর্ষা। হয়তো অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। শুভ্র আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল বর্ষার দিকে। বিছানায় থাকা কাঁথাটাকে সুন্দর করে জড়িয়ে দিল বর্ষার গায়ে। মেয়েটা যে এমন কেন সেটাই বুঝে উঠতে পারে না শুভ্র?’ এমনিতে তো ভালো কিন্তু মাঝে মাঝে এমন এমন কাজ করে বসে যে ভালো জিনিসটাই চলে যায় নিমিষে। জোরে শ্বাস ফেললো শুভ্র। তারপর রুমের লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো সে বর্ষার পাশ দিয়ে। প্রচন্ড ঘুম পেয়েছে তাঁর। শরীরটা ক্লান্ত থাকায় বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লো শুভ্র।’
অন্যদিকে,
শুভ্র ঘুমিয়ে পড়তেই চোখ খুলে ফেললো বর্ষা। ঘুমাইনি সে, জাস্ট শুভ্রের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল মাত্র। শুভ্র তাঁর গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়েছে বিষয়টা বেশ লেগেছে তাঁর। আনমনেই মুচকি হেঁসে কাঁথাটাকে আর একটু শক্তি করে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘ আপনি কি আমায় কোনোদিনও ভালোবাসবেন না শুভ্র?’
বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো বর্ষা। তারপর শুভ্রের দিকে মুখ রেখেই চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লো সে। রাতের জোৎসা ভরা আলোরা উঁকি মারছে রুমে, বেলকনি বেয়ে মৃদু বাতাস বইছে খুব। জানালা জুড়ে থাকা সাদা পর্দাগুলোও নড়ছে বারংবার। আর এসবের ভিড়েই একে অপরের মুখোমুখি হয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে শুভ্র বর্ষা।’
_____
আজ হিয়াকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে। সকাল থেকেই হিয়াদের বাড়িতে মোটামুটি একটা তোড়জোড় চলছে এর জন্য। হিয়ার মা পুরো বাড়ি গুছিয়ে রেখেছে অনেক আগেই এখন শুধু মেহমানদের আসার অপেক্ষা। নিজের রুমে লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে চুপচাপ বসে আছে হিয়া। বিরক্ত লাগছে তাঁর। আপাতত বিয়ে জিনিসটার ওপর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাঁর। হিয়া তো ভাবছে অন্যকিছু বাই এনিচান্স যদি নির্মল এই বিষয় সম্পর্কে জানে তাহলে কি হবে? আচ্ছা নির্মল যদি সত্যি সত্যি বিয়েটা ভেঙে দেয় তাহলে খুব ভালো হবে তাই না।’ আনমনেই কথাটা ভাবলো হিয়া। এমন সময় তাঁর রুমে প্রবেশ করলো তার মা হতভম্ব হয়ে বললেন উনি,
‘ জানিস হিয়া তোকে যাঁরা দেখতে আসতে চেয়েছিল ওনাদের গাড়িটা নাকি মাঝপথে খারাপ হয়ে গেছে তাই আজ আর ওনারা আসবে না।’
কথাটা শোনার সাথে সাথে যেন চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো হিয়ার। খুশি মনে বললো সে,
‘ কি বলো মা সত্যি?’
‘ হুম! তোর বাবা তো এইমাত্র তাই বললো।’
‘ ভালো হয়েছে দোয়া করো আর যেন না আসে।’
মেয়ের কথা শুনে হতাশ হলো হিয়ার মা। এমন সময় বিকট শব্দে ফোনটা বেজে উঠলো হিয়ার। হিয়াও বেশি কিছু না ভেবে ফোনটা তুললো তারপর যা শুনলো তাতে তাঁর মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো সঙ্গে সঙ্গে হতভম্ব কন্ঠ নিয়ে বললো,
‘ আমি এক্ষুনি আসছি?’
এতটুকু বলে ফোনটা কেটে মাকে হতভম্ব গলায় বললো,
‘ আমায় একটু যেতে হবে মা।’
মেয়ের কাজে হিয়ার মাও অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
‘ কোথায় যাবি?’
‘ এসে বলবো মা।’
এতটুকু বলে ড্রয়ার থেকে হ্যান্ড ব্যাগটা কাঁধে জুলিয়ে মোবাইল হাতেই বেরিয়ে পড়লো হিয়া। নিচে রুমে বাবা না থাকায় বিনা বাক্যেই বেরিয়ে গেল হিয়া বাড়ি থেকে।’
_____
শহর থেকে কিছটা দূরে কিছু গাছেদের আড়ালে লুকিয়ে আছে একটা কালো গাড়ি। তাঁর ভিতরই হাতে আর মাথায় ব্যান্ডেজ করে চুপচাপ বসে আছে নির্মল।’
এমন সময় সেখানে হতভম্ব হয়ে রিকশা করে আসছিল হিয়া। সামনেই তাঁর থেকে কিছুটা দূরে কালো গাড়িটাকে দেখে রিকশাটা কিছুটা দূরে থামিয়ে ভাড়া মিটিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লো হিয়া। তাঁরপর দ্রুত গতিতে অগ্রসর হতে লাগলো সে গাড়িটার দিকে। কয়েক মুহূর্ত আগেই শুনেছে সে নির্মলের নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে যার দরুন এতদূর ছুটে আসা। কথাটা শোনার পর একবারও হিয়ার মনে হয় নি সে আসবে না বরং কতক্ষণে আসবে এটাই যেন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তাঁর।’
অন্যদিকে লুকিং গ্লাসে হিয়াকে আসতে দেখে ওদিকেই তাকিয়ে রইলো নির্মল। লাল শাড়ি,খোলা চুল, চোখে কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিকে অপরূপ লাগছে যেন হিয়াকে। এরই মাঝে গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে বসে পড়লো হিয়া। তারপর হতভম্ব কন্ঠ নিয়ে বললো,
‘ এগুলো কি করে হলো?’
হুট করেই জিনিসটা হয়ে যাওয়াতে লুকিং গ্লাস থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে তাকালো নির্মল হিয়ার দিকে। মেয়েটাকে আজ যেন বড্ড বেশি সুন্দর লাগছে। কপালের পাশে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে হিয়ার। চোখে-মুখে স্পষ্ট হতাশার ছাপ। না চাইতেই নির্মল তাকিয়ে রইলো হিয়ার মুখের দিকে। এই একটা মেয়ের মুখে কি এমন যাদু আছে বুঝে উঠতে পারে না নির্মল। মেয়েটাকে দেখলেই আর উত্তেজিত মনটা শান্ত হয়ে যায় নিমিষেই। আবার যন্ত্রনা দেওয়ার ক্ষেত্রেও এই মেয়েটা সবার থেকে এগিয়ে। নানান কিছু ভাবতে লাগলো নির্মল হিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে। নির্মলকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবারো উত্তেজিত কন্ঠ নিয়ে বলে উঠল হিয়া,
‘ কি হলো আপনি কিছু বলছেন না কেন?’
প্রতিউওরে হুট করেই হিয়াকে জড়িয়ে ধরলো নির্মল। নির্মলের কাজে পুরোই চমকে উঠলো হিয়া। পাল্টা কিছু বলবে তাঁর আগেই নির্মল শান্ত কন্ঠে বলে উঠল,
‘ আমার কিছুক্ষন মানসিক শান্তি চাই হিয়া, প্লিজ ডিসটার্ব করো না।’
নির্মল শেষের কথাগুলো এমনভাবে বললো যে হিয়া ইচ্ছে থাকা সত্বেও কিছু বলতে পারলো না চুপচাপ বসে রইলো নীরবে। সে বুঝলো না হুট করে মানুষটার হলোটা কি?’
#চলবে…..