ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয় পর্ব-১২

0
389

ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ১২

শিউলি আর রহিম ভেবেছিল একটা সপ্তাহ এখানে থেকে যাবে। কিন্তু জোবাইদা বেগম আকারে ইঙ্গিতে চলে যাওয়ার কথা বলায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যাগ গুছিয়েছে শিউলি। আশা ছিল মেয়ে আটকাবে। হয়তো মেয়ে দুটোদিন থেকে যেতে কান্নাকাটি করলে জোবাইদা বেগম না করতেন না। কিন্তু চৈতালীর ভেতর সে-রকম কোন লক্ষণ দেখা গেল না। নিজের নতুন রুম গোছানোতেই ব্যস্ত সে। শিউলি আবার টাকার কথা তুলতে গিয়েছিল। চৈতালী বলেছে,

“এই পাঁচ লাখের কথা এখন ভুলে যাও আম্মা। যা পাইছো আগে তা শেষ হোক। সব একসাথে নিলে আব্বা জুয়ায় নষ্ট করবে।”

কথা ভুল না। রহিমের জুয়ার টান আছে। এতদিন টাকা ছিল না, তাই নিয়মিত খেলতে পারতো না। এত টাকা গন্ধ পেলে বহু দুধের মাছি তার সঙ্গ নেবে।

“এই শাড়িগুলা আলমারিতে রাখস না ক্যান?”

“শাড়িগুলো উপহার দেব।”

“আমারে?”

শিউলি খুশি হয়ে যায়।

“নাহ্। তুমি চাইলে এটা নাও। এটা নতুন শাড়ি। মাহিম সাহেব অনেকগুলো শাড়ি বাজার করে আনলেন না বিয়ের আগে। সেই শাড়ি।”

ফিরোজা রঙের বেনারসিটা শিউলির হাতে তুলে দেয় চৈতালী। শিউলি হাত বুলিয়ে অবাক হয়। কী মসৃণ শাড়ি। তার পরিশ্রম করা খসখসে হাত বুলাতে গিয়ে যেন শাড়িটাই কষ্ট পাচ্ছে।

“এই শাড়ির সাথে সোনার একজোড়া কানের বালি পরলে কী ভালো লাগবো। সোনালি কাজের সাথে খুব মিলতো। আমার গুলা তো তোদের পড়ালেখার জন্য বিক্রি করে দিলাম। আর বানানো হয় নাই।”

বলে আঁচলে শুকনো চোখ মুছে শিউলি। চোখ তার চৈতালীর গয়নার বাক্সগুলোর দিকে।

“আমার পড়ালেখার জন্য না। আব্বার দেনা শোধের জন্য আব্বা নিয়ে বিক্রি করছে। এখন তো আব্বার হাতে টাকা পয়সা আছে। একজোড়া বানিয়ে দিতে বলো।”

চৈতালী আলমারির দরজা বন্ধ করে দেয়। চাবি বিছানায় রাখা শাড়িগুলার উপর রেখে শাড়িগুলো নিয়ে নিচে ড্রয়িং রুমে নামে। পিছু পিছু নামে শিউলিও। মেয়ে এই শাড়িগুলো দিয়ে কী করবে ভেবে পান না। মেয়েটা জেদি, আপসহীন। পরিশ্রম করতে তার না নেই। ঘরে দুয়ারে এত কাজ করে, নিজের পড়ালেখার খরচ নিজে জোগাড় করে পড়ালেখা চালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এমন পরিবেশে এসেও এতটা শক্ত থাকতে পারবে তা ভাবেননি।

“সখিনা, হামিদা খালা আর নতুন আসলো যে মেয়েতা শিরিন না নাম? তাদের ডাকো। ইদ্রিস ভাই আর সোলেমান ভাইকেও ডাকবা।”

এই বাড়ির রান্নার কাজ দেখে হামিদা খালা। বাড়ি পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া এসব কাজ সখিনা আর হালিমা করতো। হালিমাকে হঠাৎ বাদ দিয়ে শিরিনকে আনা হয়েছে। ইদ্রিস আর সোলেমান পালা করে গেটে থাকে, মালির কাজও করে।
সখিনা তাদের সবাইকে ডাকবে কী ডাকবে না বুঝতে পারছ না। চৈতালীও এখন এইবাড়ির বৌ। কিন্তু বাড়ির সর্বেসর্বা জোবাইদা। জোবাইদাই ঠিক করে দেয় বাড়ির মহিলাদের কার কী অবস্থান হবে। জোবাইদার বাইরে জোহরা বেগম আর চন্দ্রিমার সব কথা শোনার আদেশ আছে তাদের কাছে। মাহিম আর ফজলে আলী খান সরাসরি তাদের কোন কাজে ডাকেন না। ডাকলে না করার সাহস কখনোই হবে না। কারণ তাদের অবস্থানও সুস্পষ্ট।
কিন্তু চৈতালীর অবস্থান কোথায় এখনও বলা যাচ্ছে না। হালিমার মতো অযথাই জোবাইদার রোষানলে পড়তে চায় না সখিনা।

“সখিনা দাঁড়িয়ে আছ কেন? বুঝেছি। ইন্টারকমে আম্মির রুমে কল দাও। ওনাকে জিজ্ঞেস করে অনুমতি নাও। কাজ চলে যাওয়ার ভয় তোমারও আছে জানি।”

জোবাইদাকে জিজ্ঞেস করে সবাইকে ডেকে আনে সখিনা। জোবাইদাও নিচে নেমে আসন। কী তামাশা করতে চাইছে চৈতালী। তিনিও দেখতে চান। চৈতালী শাড়িগুলো একটা একটা করে ওদের সবার হাতে তুলে দেয়। এত সুন্দর জমকালো শাড়ি পেয়ে যারপরনাই অবাক।

“ইদ্রিস ভাই, সোলেমান ভাই আপনারা আপনাদের স্ত্রীকে দিয়েন শাড়ি। আপনাদের জন্য অন্য সময় পাঞ্জাবি দেব।”

শিরিন তো বটেই, হামিদা আর সখিনাও অভিভূত হয়ে যায়। তারা পুরানো লোক বাড়ির। নানা সময় শাড়ি কাপড় পায়। কিন্তু তা তাদের অবস্থান অনুযায়ী দেওয়া হয়। জোবাইদার কিছু অলিখিত নিয়মের ভেতর একটি হলো নিজেদের পরনের কাপড় বাড়িতে কাজ করা মানুষদের দেয় না। আলমারিতে থেকে পুরানো হতে থাকে। অনেক সময় বিভিন্ন চ্যারেটি ফাংশনে দান করে দেওয়া হয়। কিন্তু বাসায় কাজ করে যারা তাদের দেন না। কারণ একই রকম পোষাক পরে তারা ঘুরবে এটা ওনার পছন্দ না। বাড়ির গৃহকর্তা ও গৃহকর্মীর চলন বলনের মাঝে পার্থক্য না থাকলে নাকি কাজের লোক চালানো যায় না। চন্দ্রিমারও বিয়ের পর তাদের সবাইকে শাড়ি কাপড় দিয়েছে। তবে সেগুলো এত সুন্দর না। সুতোর কমদামি শাড়িই ছিল। মেয়ের কাজ দেখে শিউলি থ বনে যায়। এত সুন্দর শাড়িগুলো তাকে না দিয়ে এদের দিয়ে দিলো? জোবাইদা বেগম চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখেন। কিছু বলেন না সবার সামনে।

****
মাহিম ব্যবসার কাজে বের হয়ে গিয়েছে। দুপুরে খেতে আসবে কিনা জানে না চৈতালী। মাহিমের নাম্বার নেই তার কাছে। শিউলি আর রহিম ছেলেদের নিয়ে চলে গিয়েছে। চৈতালী ভাইদের হাতে পাঁচশো করে দিয়েছে। বাবার সাথে কথা বলা এড়িয়ে চলছে। রহিম তরফদার বুঝেও আমলে নেয় না। এখন তার মন ফুরফুরে। মেয়ের এসব মান অভিমান বোঝার অবস্থা নেই। চৈতালীর এডমিট কার্ড দেবে আগামীকাল। কলেজ যেতে হবে। কলেজ ড্রেস না হলেও চলবে। সে তো ক্লাসে যাবে না। কিন্তু বই খাতা প্রয়োজন। নতুন বই থেকে পড়তে কষ্ট হবে। নিজের নোট খাতাই লাগবে। মাকে বলেছে কাল শফিককে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে। শিউলি বলেছিল আপাততঃ কয়েকদিন এসব বই খাতার চিন্তা বাদ দিয়ে স্বামী সংসারের চিন্তা করতে।

“আম্মা, সংসারের চিন্তা করা আমার কোন দরকার নাই। সংসার বড়চাচীমা, মানে আম্মির মাথাব্যথা। এই ব্যথা আর কেউ মাথায় নেক এটা তিনি চান না। স্বামী আমার সাথে ভাসুর সুলভ আচরণ করছে। মানে পর্দার আড়ালে আড়ালে চলছে। এই যে এতক্ষণ চন্দ্রিমা আপার রুমে ছিল। এখন বাইরে চলে গেল। এখন তাকে তো আমি জোর করে এনে রমে খিল দিতে পারি না। তাই আমাকে পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে দেন। আপনাদের চিন্তা তো শেষ। আমি ঘাড় থেকে নেমেছি। এখন শান্তিতে নিজের বাড়ি যান।”

****
“আম্মি, আসবো?”

“আসো চৈতালী।”

চৈতালী রুমটায় চোখ বুলায়। জোবাইদার রুমে খুব কম আসা হয়েছে চৈতালীর। অবশ্য কারও রুমেই খুব একটা যাওয়া হয়নি। তারা এ বাড়িতে আসলে নিচের ঘরগুলোতেই বেশি থাকতো। অকারণে কারও দোতলায় এসে হাঁটাহাঁটি করা জোবাইদা বেগম এর পছন্দ না। চৈতালীর শ্বশুর, মাহিমের বাবা নিরিবিলি থাকেন। এখন রুমে নেই। সম্ভবত বাগানে বসে পেপার পড়ছেন।

“আমাকে ডেকেছিলেন আম্মি?”

“চৈতালী শাড়িগুলো আমি তোমাকে দিয়েছিলাম। এত চমৎকার সব শাড়ি তুমি ওদের দিলে কেন? আমার ব্যবহার করা শাড়ি বলে? শুনলাম তোমার বাবা মাকে ভালো খাতির যত্ন করা হয়নি বলেও তোমার অভিমান হয়েছে। প্রকৃত আভিজাত্য কী সে বিষয়ে নাকি তুমি অনেক কিছু জানো। তাই ভাবলাম শিখি, জানি একটু। শেখার তো কোন শেষ নেই, বয়স নেই।”

“বসবো?”

“বসো।”

“আম্মি কাজের মানুষদের কথায় ঘরের মানুষদের দোষী করলে কী করে হবে। বুঝেছি সখিনা নাস্তা দিয়ে তখন চলে যায়নি। আড়াল থেকে কথা কিছু শুনে, বাকিটা নিজের মতো রঙচঙ লাগিয়ে বলেছে। ওরা এসব বলে মজা পায়।”

“আমাকে চন্দ্রিমা বলতে পারে না?”

“নাহ্। আপা রুম থেকেই বের হয়নি এখনও। সখিনার কথা লাগানোর অভ্যাস তো আমি জানি। আগে তো ওদের কাছাকাছি থাকা হতো বেশি। রান্নাঘরে বসে সবচেয়ে বেশি যে আপনার বদনাম করে, সে সখিনা। মুখে আনতে পারবো না এমন কথা বলে। আর যে মেয়েটা সবচেয়ে বেশি আপনার প্রশংসা করতো, সে হালিমা। আপনার হয়ে হালিমা, সখিনাকে বকা দিতো। তাই তো সুযোগ পেয়ে হালিমার কাজ ছাড়ালো। না হলে বলেন, হালিমা তো অন্যায় কিছু করেনি। ও আপনাকে ডাকতে চেয়েছিল। উপরেও এসেছিল। মাহিম সাহেব ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন কই যায় এত রাতে? ও যখন বললো আপনার কাছে আসছে। মাহিম সাহেবই না করলেন। বললেন আপনি হয়তো শুয়ে পড়েছেন। এখন ডাকতে না, রুম খুলে দিতে। অথচ কথাটা সখিনা কিভাবে লাগালো আপনার কাছে।”

“মাহিম বলেছিল? এত রাতে মাহিমই বা কেন বাইরে ছিল?”

“চন্দ্রিমা আপা বারবার ডেকে নিচ্ছিলেন।”

“তুমি বাঁধা দিয়েছিলে? কাল তো তোমাদের বাসর রাত ছিল।”

” নাহ্ ছিঃ। আমি নতুন বৌ। এসব কিভাবে বলি। তাছাড়া আপার অধিকার বেশি। তবে সকালেও যখন আপা বোঝাচ্ছিলেন তিনি অভিজাত পরিবারের মানুষ। আমার বাবা মা আর ওনার বাবা মা একই লেভেলের ন। তখন কিছু কথা যুক্তিতর্ক হিসেবে বের হয়েছে। কিন্তু তা কখনোই আপনার বিরুদ্ধে না। আমি তো জানি, আপনি আমাদের দু’জনকে সমান চোখে দেখেন। সকালে আপনার অনুমতি নিয়েই তো বাবা মাকে খেতে বসতে বললাম। সেটাই বলেছি আপাকে।”

জোবাইদা মনে মনে সন্তুষ্ট হোন। নাহ তিনি যা ভেবেছেন তা নয়। তাই তো এই পিচ্চি মেয়ের সাহস কিভাবে হবে তার মুখোমুখি দাঁড়ানোর। কম বয়স বলে না বুঝে হুটহাট কাজ করে ফেলে। শিখিয়ে নিতে হবে এই যা

“আর শাড়িগুলো কেন দিলে?”

“চন্দ্রিমা আপা বিয়ের পর আমাদের সবাইকে কিছু না কিছু দিয়েছেন। আমার আব্বা আম্মার তো সামর্থ্য নাই। আপনিই আমার আম্মি। আপনার শাড়িগুলো ওদের দিলাম যেন ওরা বুঝে আপনি আমাকে পছন্দ করেই মাহিম সাহেবের স্ত্রী করেছেন। তাই তো এত ভালো ভালো শাড়ি আমার হাতে দিয়ে ওদের দিচ্ছেন। এত ওরাও আমাকে এবাড়ির বৌ হিসেবে সমান সমান ভাববে।”

“আচ্ছা যাও। কিন্তু হুটহাট এভাবে কোন কাজ করবে না।”

“আম্মি, আমার এডমিট কার্ড তুলতে যাব কলেজে? পরীক্ষা দিতে চাই।”

“হ্যাঁ যেও। ড্রাইভার নিয়ে যাবে। পরীক্ষা ভালো করেই দিবে। অশিক্ষিত ছেলের বৌ আমিও চাই না। শোন বিকেলে রেডি থাকবে। শপিং এ নিয়ে যাব। তুমি ভালোই বুদ্ধিমতি। বেশি শেখানোর দরকার নেই। তবে ঘরের দরজা স্বামী থাকলে বন্ধ রাখবে।না হলে সবসময়ই অন্য কেউ স্বামীকে নিয়ে যাবে।”

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে