দোলনচাঁপা পর্ব-০৪

0
321

#দোলনচাঁপা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৪

রিপা কথা শেষ হতে না হতেই জোরে আওয়াজ হয়। রিপার পিঠের উপর খুন্তি দিয়ে বা”ড়ি মেরেছে তনিমা। রিপা হতভম্ব হয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। তনিমা মেয়েটা ছোটবেলা থেকে শান্ত স্বভাবের। কোন কথায় হুট করে রেগে যায় না। কখনো রাগ হলে নিজের মধ্যে পুষে রাখে, তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সেবার মা বিনা কারনের আপুকে ব’কাব’কি করেছিলো। আপু অনেক কষ্ট পেয়েছিল। সেই সঙ্গে ভীষণ রেগে গেছিল। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। মুখে কিছু বলেনি, চালচলনও স্বাভাবিক ছিলো। বেশ ক’দিন পরে রিপাকে বলেছিল, ” মা’য়ের উপর ভীষণ রেগে ছিলাম।

” তোমায় দেখে তো বুঝতে পারিনি। সত্যিই রেগে ছিলে?”

” মিথ্যা বলবো কেন? রাগ দেখাতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় রাগ দেখালে মান কমে যাবে। ”

” এ কেমন কথা!”

” তুই বুঝবি না। বাদ দে। ”

শান্তশিষ্ট তনিমা রেগে গিয়ে কাউকে আঘা’ত করেছে। এ কথা যেন বিশ্বাস হতে চায় না। রিপা জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে।

মুখ সামলে কথা বলবি। দিনে দিনে বেয়াদব হয়ে গেছো তাই না? মুখে কিছুই আটকায় না। ”

কর্কশ গলায় বলে ওঠে তনিমা। রিপা যথাসম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করে। নরম গলায় বলে,

” রেগে যাওয়া স্বাভাবিক। তবে এতটা রেগে যাওয়ার মতো কিছু বলিনি। কথাগুলো মজার ছলে নিতে পারতে। ”

” চরিত্রের দাগ অনেক বড় ব্যাপার। এসব তোর মাথায় ঢুকবে না। তাছাড়া এখন মজা করার সময় নয়। তুমি আমাদের বাড়িতে আনন্দ ফুর্তি করতে আসোনি। মনে থাকে যেন।”

” হবে হয়তো। ”

রিপা কথা বাড়ালো না। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে রঞ্জুর রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ায়। বোনের কাজে দারুণ কষ্ট পেয়েছে। পিঠ জ্বলছে এখনও।

তনিমা মন খারাপ করে অবশিষ্ট পেঁয়াজগুলো কুঁচি কুঁচি করে কেটে নিলো। গরম তেলে পেঁয়াজ ভেজে তাতে কয়েকটা ডিম ছেড়ে ভালো করে নাড়তে লাগলো। শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে। চোখ জ্বলছে, বোধহয় কিছুক্ষণের মধ্যে চোখে পানি চলে আসবে । রিপাকে বড্ড ভালোবাসে, আদরের ছোট বোনকে খুন্তি দিয়ে আঘা’ত করছে ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ করে রেগে যাওয়া উচিত হয়নি। রিপা কথাগুলো মজার ছলে বললেও তনিমার ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি। ফাহাদ শুনলে সন্দেহ করবে। এমনিতেই তাকে নানান কথা শুনতে হয়। স্বামী মানুষটা ভালো না হলে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যায়।

রঞ্জু বাবুর ঘরের দরজা লাগানো। হয়তো বিশ্রাম নিচ্ছে। রিপা নরম হাতে দরজার কড়া নাড়ায়। রঞ্জু এসে দরজা খুলে দিলো। শান্ত গলায় বললো, ” কিছু বলবে?”

” কাজের কথা না থাকলে আসা যাবে না?”

” তা কখন বললাম! আসো, ভেতরে এসে বসো। ”

” এখানে এসে আপনাদের অসুবিধায় ফেলে দিয়েছি। সমস্যা নেই, বিকেলে চলে যাব। ”

” এমন কথা বলছো কেন?”

” জানি না। ”

” রিপা, কি হয়েছে? কাঁদছ কেন?”

” আপা মেরেছে। ”

রিপার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না। ভাবী নাকি ওকে মে’রে’ছে। যে ভাবী কখনো ভাইয়ের মুখের উপর কথা বলে না। ভাইয়ার অন্যায় আবদারগুলো মুখ বুঝে মেনে নেয়। সাত কথায় রা নেই। সে কি-না কাউকে আ’ঘা’ত করতে পারে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! বেশ অবাক হচ্ছি, কিন্তু প্রকাশ করলাম না। কোমল গলায় বললাম, ” কি করেছিলে তুমি? গুঁড়ো দুধ চু’রি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছিলে নাকি?”

” নাহ্। ”

” ছোটবেলা থেকে গুঁড়ো দুধ চু’রি করে খাওয়ার অভ্যাস আছে আমার। সেজন্য ভাবলাম তুমিও বুঝি একই কাজ করতে গেছিলে। ”

” আপুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম তার কোন বয়ফ্রেন্ড আছে কি-না। সেজন্যই ভীষণ রেগে গেছে। ”

” বিবাহিত মেয়েরা স্বামীর সংসারে থাকার পরেও যদি তাদের বয়ফ্রেন্ড থাকে তখন কি হয় জানো?”

” মজা করে বলেছিলাম। ভাইয়া তো সময় দেয় না তেমন, সেজন্য। ”

” কাজটা মোটেও ঠিক করোনি তুমি। তুমি মজা করে বললেও সবার কাছে ব্যাপারটা মজার হবে না। কেউ কেউ সত্যি মনে করে বসবে। কোন নারী চাইবে না তার উপর পরকীয়ার দোষ চাপুক। ”

” আর যারা পরকীয়া করে তারাও কি এসব কথা শুনতে চায় না?”

” নাহ্। জানো রিপা পৃথিবীর সব নারী একরকম হয় না। সবাই স্বামীর কাছে থেকে সময় আশা করে না। কিম্বা আশা করলেও প্রকাশ করে না। ”

” কি বলতে চান?”

” বললাম সময় না পেলে সবাই পরকীয়া করে না। তাহলে প্রবাসী ভাইদের বউ থাকতো না। আমার একজন ছাত্র আছে। ওর বাবা বিদেশে থাকে। সেখানে কাজ করে। দুই-তিন বছর পর পর ক’দিনের জন্য দেশে ফেরে। ওর মা’য়ের এসব নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। ”

” আপনি এতোকিছু বলছেন কেন?”

” তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সুন্দরী মেয়েদের জ্ঞান দেওয়ার মজাই আলাদা। ”

রিপার চোখ-মুখ বদলে গেল। ব্যস্ত স্বরে বললো, ” আপার কাছে ক্ষমা চেয়ে আসি। কি বলেন?”

” হ্যাঁ। যাও। ”

রিপা চলে যেতেই বিছানায় বসে পড়লাম। বাবার খু’নের সঙ্গে ভাইয়ার কোন যোগ নেই তো? না না। ভাইয়া এমন করবে কেন। ওর কাছের খু’নের কোন কারণ নেই। আজীবন বাবার পছন্দের ছেলে হয়ে থেকেছে। বাবার প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। ভাবীর মতো সাদাসিধে মানুষ খু’ন করতে পারে না। তাহলে কে? কাল রাতে কি কেউ এসেছিল নাকি? আসলেও আমরা জানতে পারলাম না কেন!

চিন্তার সাগরে ডুবে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। রিপা নুডলস নিয়ে এলো। লাজুক গলায় বললো, ” ভাবী বললো এগুলো খেয়ে নিতে। সকাল থেকে তো কিছু খাননি। এভাবে না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ হবে। ”

” আচ্ছা। খেয়ে নিবো। টেবিলের উপর রেখে দাও। ”

” না না। এখনই খেতে হবে। ”

” কেন?’

” আমার কথা রাখতে। ”

” রাখতেই হবে?”

” হুম। ”

” আচ্ছা দাও। আমি এখনই খেয়ে নিচ্ছি, তুমিও গিয়ে কিছু খেয়ে নাও। ”

” যাচ্ছি। সবটুকুই খাবেন কিন্তু। ”

রিপা চলে গেল। চাচা, ফুফুকে খবর দেওয়া হয়েছে। খবর শুনে উনারা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আজকের মধ্যে চলে আসবে এখানে। বাদশা বাবুর ওদের সাথে কি কথা বলবে কে জানে।
মোবাইল বাজছে। এখন আবার কে! খাওয়া বাদ দিয়ে কল রিসিভ করলাম।

” হ্যালো, কে?”

” জ্বি, আমি বাদশা। ”

” হ্যাঁ হ্যাঁ। বলুন। ”

” বিকেলবেলা থানায় আসার প্রয়োজন নেই। মনির বাবুর পো’স্ট’ম’র্টেম হতে সময় লাগবে। ডোম কাকু দেশে বাড়ি গেছে। রাতের আগে আসতে পারবে না। ”

” পোস্ট’ম’র্টেমের সাথে আমাদের যাওয়া না যাওয়ার কি সম্পর্ক?”

” রিপোর্ট হাতে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। না হলে দু’বার করে যাওয়া-আসা করতে হবে। অযথা সময় নষ্ট। ”

” আচ্ছা। তাহলে কখন আসবো?”

” কাল বিকেলে হয়তো। সময় জানিয়ে দেওয়া হবে। ”

” আমার নম্বর পেলেন কোথা থেকে?”

” পুলিশের চাকরি করি, কতশত খু’নি বজ্জাত লোকদের পাকড়াও করি। এতো সামান্য মোবাইল নম্বর। ”

কল কেটে গেল। লোকটাকে সুবিধার মনে হয় না। উনি বোধহয় আমাকে সন্দেহ করেন। কিন্তু আমি তো অন্যভাবে মা’রার চেষ্টা করেছি। যেভাবে এই লোকটা….

” রঞ্জু। খাওয়া শেষ হলে একটু নিচে আসো তো। ”

” কেন ভাবী? কিছু হয়েছে নাকি?”

” তোমার ভাই ডাকছে। ”

” আচ্ছা। আসছি। ”

দ্রুত পায়ে বসার ঘরের দিকে হাঁটা ধরলাম। কি জানতে চাইবে আল্লাহ মালুম।
বসার ঘরে অনেকেই উপস্থিত। বাড়ির লোক বাদ দিয়ে বাইরের লোকও আছে। হয়তো বাবার ঘটনা শুনে সমবেদনা জানাতে এসেছে। ভাইয়া আমায় দেখে নড়েচড়ে বসলো। তরল গলায় বললো, ” কাল রাতে কি হয়েছিল? ”

” জানি না। ”

” সত্যিই কি কিছু জানিস না?”

” না ভাইয়া। সত্যিই কিছু জানি না। ভ’য়ংক’র কিছু জানলেও খুব সহজে স্বীকার করে নিতাম। ”

” আমার মনে হচ্ছে তুই আর তনিমা মিলে বাবাকে খু”ন করেছিস। ”

ভাইয়ার কথায় সকলে চমকে উঠলো। ভাবী যেন আকাশ থেকে পড়েছে।

” এাব কি বলছো? আমরা কেন মা’র’বো? তাছাড়া ভাবী বাবাকে নিজের বাবার মতো ভালোবাসে। ”

” কথায় বলে অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। তোদের বেলায়ও তাই হয়েছে। ”

ভাবী আর চুপ করে রইলেন না। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ” আমি কেন মা’র’তে যাব? এাব কি বলছো তুমি? তোমার মাথা ঠিক আছে তো?”

” হ্যাঁ আছে। কেন খু”ন করবে বুঝতে পারছো না? আচ্ছা আমিই বলছি। রঞ্জুর সঙ্গে ওইসব করছিলে, বাবা দেখে ফেলেছে। সেজন্যই বাবাকে সরিয়ে দিয়েছো। ”

ঠাসস করে শব্দ হলো। ভাবী ভাইয়ার ডান গালে সজোরে থা’প্প’ড় মে’রে’ছে। ভাবীর এমন কান্ডে সকলে হতভম্ব হয়ে গেল। ভাইয়া গালে হাত দিয়ে ভাবীর দিকে তাকিয়ে আছে।

” তোমার এতো সাহস! তুমি আমাকে চ’ড় মা’রলে?”

” কপাল ভালো তোর জিভ ছিঁ’ড়ে ফেলিনি। নিজেকে কি মনে করিস? যা খুশি তাই বলবি। আমার চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বললে কাউকে ক্ষমা করবো না। ”

রিপা নিজের পিঠ ডলতে লাগলো। ভাবীর বাবা শান্ত গলায় বললো, ” জামাইয়ের মাথা ঠিক নেই। নিজেকে শান্ত কর মা। ”

” হ্যাঁ মা। তোর বাবা ঠিকই বলেছে। বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। নিজেদের মধ্যে কাঁদা ছোড়াছুড়ি উচিত নয়। ”

ভাবী শান্ত হয়ে বসে পড়লো। ভাইয়া চট করে উঠে দাঁড়ালো। বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, ” তোদের সবাইকে দেখে নেব। এখনই থানায় যাচ্ছি। দরকার হলে টাকা খরচ করে গোয়েন্দা ভাড়া করবো। তবুও এর শেষ দেখে ছাড়বো। ”

ভাইয়া চলে যেতেই ভাবী কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

* * *

ফাহাদ ছুটে গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো। মাস দুয়েক হয়েছে নিজে একটা চার চাকার গাড়ি কিনেছে। তুলির অনেকদিনের শখ মোটরগাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াবে। গাড়ি চালিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর গাড়ি থামলো। সুন্দরী এক যুবতী গাড়িতে চেপে বসলো। ফাহাদ তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। মেয়েটার চুল খোলা, ঠোঁটে গাড় লিপস্টিক, পরনে সেলোয়ার-কামিজ। খোলা চুল বাতাসে উড়ছে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে