#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২১
#আদওয়া_ইবশার
দৃষ্টির কথার বিপরীতে কোনো কথা বলেনা রক্তিম। স্থির চিত্তে কতক্ষণ শুধু তাকিয়ে থাকে অষ্টাদশীর কান্নারত মায়াবী মুখপানে। অন্তঃকরণে জ্বলন ধরে রক্তিমের। তবে সেটা দৃষ্টির দুঃখে না। বিভীষিকাময় দুই বছর আগের ফেলে আসা সেই অতীত দুয়ারে এসে কড়া নাড়ায় অন্তরে জ্বলন অনুভূত হয়। মস্তিষ্ক হয় অসাঢ়। একটু একটু করে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারায় আবার। ইচ্ছে হয় চোখের সামনে থাকা সমস্ত কিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে। বিধ্বংসী তান্ডব লীলা চালিয়ে ভালোবাসা নামক যন্ত্রণা পোকাটাকে এই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে দিতে। নিজেকে বহুকষ্টে সামলায় রক্তিম। পুরোপুরি ভারসাম্য হারানোর আগেই টলতে টলতে বেরিয়ে পরে ঘর থেকে। অসহায় নয়নে তাকিয়ে দেখে দৃষ্টি রক্তিমের প্রস্থান। আবারও অশ্রুস্বজল হয় আঁখি যুগল। বুক চিরে বেরিয়ে আসে হাহাকার মিশ্রিত নিঃশ্বাস। এক দিনেই হাপিয়ে গেছে দৃষ্টি। কথার আঘাতে জর্জরিত ভালোবাসায় টইটম্বুর হৃদয়। ইচ্ছে করছে ভালোবাসা নামক যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়ে এই নশ্বর পৃথিবীর বুক থেকে পালিয়ে যেতে। তবে সেই ইচ্ছেটুকু পূর্ণতা পাবার নয়। সবার সব ইচ্ছে এক জীবনে পূর্ণতা পায়’ও না। এ যুদ্ধের আহ্বায়ক যে সে নিজেই। এখন যুদ্ধের ময়দানে নেমে সে নিজেই যদি পরাজয় মেনে পালিয়ে যায় তবে তো নিজের বিবেকই নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। হেরে যাবে নিজ স্বত্তার কাজেই ভালোবাসা। এমনটা হতে দেওয়া যাবেনা। কিছুতেই না। দাঁতে দাঁত পিষে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। হাজারটা তীরবিদ্ধ হয়ে হৃদয় ক্ষতবীক্ষত হলেও নিঃশ্বাস চলা অব্দি থামা যাবেনা। সেও দেখতে চায় শেষ পরিণতি কি হয়। ঐ নিষ্ঠুর মানবের পাষাণ হৃদয়ে তার জন্য কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভালোবাসার সৃষ্টি না হলেও মায়ার সৃষ্টি হয় কি না। কোনোদিন ঐ মানুষটার মনে শিশির বিন্দু পরিমাণ মায়ার খোঁজ’ও যদি পায় দৃষ্টি তবে সেটুকুই চলবে। তার একার ভালোবাসাটুকু উজাড় করে মানুষটার সাথে গুছিয়ে নিবে এক মায়ার সংসার। এই পৃথিবীতে কয়জন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালোবাসা দিয়ে সৃষ্টি হয়? হাজারে একশটা সম্পর্কে ভালোবাসা থাকলেও বাকী নয়শ সম্পর্কই খোঁজ নিলে দেখা যাবে ভালোবাসাহীন। তারা স্রেফ মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে দিব্যি কাটিয়ে দেয় পুরো একটা জীবন। তাদের মতো দৃষ্টিও পারবে ভালোবাসাহীন মায়ার সংসার গড়তে।
কেটে যায় আরও একটা নির্ঘুম রাত। বুকে চাপা যন্ত্রণা নিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগ পযর্ন্ত দৃষ্টি অপেক্ষায় থাকে রক্তিমের বাড়ি ফেরার। তিমিরাচ্ছন্ন রাত কেটে ভোরের নির্মল আভা ছড়ায় প্রকৃতির বুকে। তবুও রক্তিম ফিরেনা। হতাশ হয় দৃষ্টি। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয় বিছানায়। অল্পক্ষণের মাঝে ঘুম নেমে আসে ফোলা চোখ দুটোতে। দুই-তিন ঘন্টার ব্যবধানে পেটের ক্ষিদে মাথা চারা দিয়ে উঠতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় আপনাতেই। বন্ধ চোখ জোড়া খুলে আবারও একবার খোঁজ করে পাষাণ পুরুষটা এলো কি না। কিন্তু না। আসেনি। মলিন মুখে বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দৃষ্টি। ছোট্ট উঠোনের একপাশে একটা চাপকল। ঠান্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে দুই হাতের আজলায় একটু পানি পান করতেই খালি পেটে পাক দিয়ে ওঠে। এবার যেন ক্ষিদেটাকে দমিয়ে দায়। উপায় না পেয়ে ঘরে এসে ফোন হাতে নেয়। খোঁজে খোঁজে বের করে প্রথম দিন রক্তিমের দেওয়া রাকিবের নাম্বার। ডায়াল করে কানে ধরতেই দুইবার রিং হবার পরই ঐপাশ থেকে ভেসে আসে রাকিবের উৎফুল্ল কন্ঠস্বর,
“ওও পরদেশী সুন্দরী! এতোদিন পর এই অচেনা পুরুষের কথা মনে পরল তোমার? তা সাত সকালে কি মনে করে ফোন দিলে? ঠিকানা দিতে না কি? তুমি তো দেখি ভারী অলস সুন্দরী। সেই কবে ঠিকানা চেয়ে ম্যাসেজ করেছিলাম! এতোদিন পর আজ মনে হলো?”
একেতো পেটের ক্ষিদে, কান্নার ফলে মাথা ব্যথা। হৃদয়ে অশান্তি। এই এতো এতো যন্ত্রণার মাঝে এখন আবার ঐ ছাগলটার এমন কথা। মেজাজ খিঁচে ওঠে দৃষ্টির। দাঁতে দাঁত পিষে ধমকে ওঠে দৃষ্টি,
“ঐ চামচার বাচ্চা চামচা! চুপ, একদম চুপ! আর একটা উল্টাপাল্টা কথা বললে মাথা ফাটিয়ে দিব।”
এতো সুন্দর সুন্দর কথার বিপরীতে এমন ধমকে ভড়কে যায় রাকিব। চোখ দুটো বড় বড় করে তৎক্ষণাৎ কান থেকে ফোন সরিয়ে নাম্বারে চোখ বুলায়। হ্যাঁ, এটাই তো নাম্বার। এই নাম্বার থেকেই তো ম্যাসেজ করে বলেছিল কেউ তার প্রেমে পরেছে। তবে আজকে কেন এমন ঝাড়ি! এটা প্রেমের কয় নাম্বার ধাপ? এই ধাপের কথা তো রাকিবের জানা নেই। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আবারও কানের কাছে ফোন নেয় রাকিব। ফের কিছু বলতে যাবে তার আগেই দৃষ্টি বলে ওঠে,
“রক্তিম শিকদার কোথায়? তাকে ফোন দিন।”
সাহস কত মেয়ের! তার ফোনে কল দিয়ে তাকেই উপেক্ষা করে রক্তিমকে চায়! এই মেয়েকে তো উচিৎ শিক্ষা দিতেই হয়। বড়সড় একটা ধমক দিয়ে চোখের পানি নাকের পানি এক করে বুঝিয়ে দিতে হবে রক্তিম আর রাকিবের মাঝে কোনো তফাৎ নেই। রক্তিম যদি হয় বারুদ তবে সে হলো আগুন।
“এই মেয়ে এই!”
“বললাম না উল্টাপাল্টা কিছু বললেই মাথা ফাটাবো। চামচা চামচার মতো থাকুন। রক্তিম শিকদারকে বলে দিন তার বউ গত দুপুর থেকে অভুক্ত। পাঁচ মিনিটের ভিতর যেন ঘরে খাবার আসে। নইলে কিন্তু আপনার মাথা চিবিয়ে খাব আমি।”
রাকিবের কথা কেড়ে নিয়ে বলে ওঠে দৃষ্টি। নিজের প্রয়োজনটুকু বলে সাথে সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ঐদিকে রক্তিম শিকদারের বউ শুনে রাকিবের মাথা ঘুরে ওঠে। ফোন কানে ঠেকিয়েই আশ্চর্যের চরম পর্যায় গিয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে তাকায় একটু দূরে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানা রক্তিমের দিকে। আকস্মিক এমন একটা কথা হজম করতে না পেরে মাথা ঘুরিয়ে ওঠে রাকিবের। নিশ্চল ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় রক্তিমের দিকে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন ফোনটাই এখনো কানে ঠেকানো। সেভাবেই অসহায় সুরে ডেকে ওঠে,
“ভাই!” ঠোঁটের ভাজে সিগারেট নিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে রক্তলাল চোখে রাকিবের দিকে তাকায় রক্তিম। একের পর এক দুশ্চিন্তায় বিগত দুই-তিনটা রাত পুরোপুরি নির্ঘুম কেটেছে রক্তিমের। যার প্রমাণ রক্তলাল চোখ দুটো। হিমশীতল ঐ লাল আঁখি জোড়া কি ভয়ংকর ঠেকাচ্ছে! মনে হচ্ছে কোনো এক হিংস্র পশু শিকারের আশায় ওত পেতে আছে জলন্ত চোখে। ঐ চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় হয় রাকিবের। পেটের ভিতর মুচড় দিয়ে ওঠে।কিছুদিন যাবৎ এমনিতেই তার ঘাড়ের উপর শনি নাচন করছে। প্রাণ প্রিয় ভাই হুট করেই মেজাজ হারিয়ে ক্ষণেক্ষণে তাকেই প্রহার করে যাচ্ছে। দুদিনে দুটো থাপ্পড় দিয়েই তার নাদুসনুদুস গাল দুটো কেমন চেপ্টা করে দিয়েছে। আজ না জানি আবার বউয়ের কথা শুনে তাকে এই দুনিয়া থেকেই এক থাপ্পড়ে বিদায় করে দেয়। কিন্তু কৌতূহলও তো দমার নয়। কেমন পেটের ভিতর সুরসুরি দিয়ে যাচ্ছে। কথাটা না বলেও শান্তি নেই। বা-হাতে এখনো ফোন কানে ঠেকিয়ে ডান হাতে গাল ঘষে বলে,
“ভাই আপনি ঘরে বউ এনেছেন?”
সাথে সাথেই হাসির রুল পরে যায় সেখানে। উপস্থিত প্রত্যেকে স্ব-শব্দে হেসে ওঠে রাকিবের এমন কথায়। ঘরে বউ এনেছে মানে কি? বউ কি মেলাই কিনতে পাওয়া যায় কাঠের ফার্নিচারের মতো! যে ইচ্ছে হলো ঘরের শোভাবর্ধনের জন্য একটা বউ কিনে এনে সাজিয়ে রাখল।এই রাকিবটাও যে কি বোকা বোকা কথা বলে! এতোদিন পযর্ন্ত রক্তিম শিকদারের আশেপাশে থেকেও একটু চালাক-চতুর হতে পারলনা। রাকিবের কথাটা ছেলেরা মজার ছলে নিলেও মেহেদী ঠিকই বুঝে যায় আসল মর্মার্থ। রক্তিমের কপালেও শুক্ষ ভাঁজ পরে। জোরালো ধমকে সবাইকে চুপ করিয়ে মেহেদী জানতে চায়,
“ফাও প্যাঁচাল রেখে আসল কথা বল।”
নিজের গাল দুটো শক্ত হাতের প্রহার থেকে বাঁচাতে মেহেদীর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায় রাকিব। ফটাফট বলে দেয়,
“একটা মেয়ে ফোন করে বলল ভাইকে যেন বলি তার বউ গত দুপুর থেকে অভুক্ত। ভাই যেন পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাবার পাঠায়। নইলে আমার মাথা চিবিয়ে খাবে।”
কথাটা শুনে হা হয়ে যায় উপস্থিত প্রত্যেকে। অত্যধিক বিস্ময়ে ছানাবড়া সকলের চোখ। ব্যতিক্রম শুধু রক্তিম, মেহেদী। হতবাক দৃষ্টিতে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে দলের সব গুলো ছেলে এক সুরে বলে,
“ভাই! আপনি বিয়ে করেছেন?”
বিরক্ত হয় রক্তিম। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। মনে মনে রাগে ফুঁসে ওঠে দৃষ্টির প্রতি। কত বড় বেয়াদব মেয়ে। নিজে থেকে ছলনা করে তার বউ হয়ে ঘাড়ে চেপেছে। এখন আবার হুকুম জারি করে! বিয়ের আগে মনে ছিলনা এই গুন্ডার ঘরে এসে খাবে কি? গুন্ডাটার আদও তাকে খাওয়ানোর সামর্থ্য আছে কি না! কোনো খাবার ঘরে নিবেনা রক্তিম। পেটে খাবার না থাকলে দুদিন পর ভালোবাসা এমনিতেই পালাবে। ঐ আপদও তখন নিজে থেকেই ঘর ছাড়বে। এতো বড় সুযোগ একদম হাতছাড়া করবেনা রক্তিম। রক্তিমের হাবভাব দেখে ঠিক বুঝে যায় মেহেদী এই ছেলে জিন্দিগীতেও মেয়েটার জন্য খাবার পাঠাবেনা। ভালোবাসার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত মেহেদীর বড্ড মায়া হয় মেয়েটার জন্য। একটু হলেও অনুভব করতে পারে দৃষ্টির মনের ব্যথা। কারণ সে নিজেও তো একই নাইয়ের মাঝি। দৃষ্টির কষ্টে ব্যথিত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মেহেদী। কাওকে কিছু না বলে নিজেই চলে যায় সেখান থেকে। উদ্দেশ্য হোটেল থেকে খাবার কিনে দৃষ্টিকে দিয়ে আসা।
***
আজও অপেক্ষা করতে করতে রাত গভীর হয়। কিন্তু রক্তিমের ফেরার কোনো নাম নেই। তবে আজ আর ঘুমায়না দৃষ্টি। কোনো কাজ না থাকাই বলতে গেলে পুরো দিনটাই সে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। এখন আর চোখে ঘুম নেই। গত রাত একটা ঘোরের মাঝে থাকার কারণে একা থাকতেও কোনো ভয় করেনি। কিন্তু আজ ভয়টা যেন দৃষ্টির পিছুই ছাড়ছেনা। বারবার মনে হচ্ছে সে হাঁটলেও তার পিছন পিছন কেউ হাঁটছে। বসে থাকলেও মনে হয় কেউ তার পিছনে বসে আছে। কানের কাছে অদ্ভূত আওয়াজ হয়। অজানা ভয়ে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। সকালে খাবার দিয়ে যাবার সময় মেহেদী নিজের নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল দৃষ্টিকে। বলেছিল যেকোন প্রয়োজনে নির্দ্ধিধায় ফোন দিয়ে বলতে। মেহেদীর ব্যবহার দৃষ্টির কাছে যথেষ্ট আন্তরিক মনে হয়। তবে এই মুহুর্তে মেহেদীকেও তার বন্ধুর মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হচ্ছে। দৃষ্টি সেই কখন থেকে বারবার ফোন করে বলছে রক্তিমকে যেন একটু তাড়াতাড়ি চলে আসতে বলে।
একলা এমন এক ভূতুড়ে বাড়িতে থাকতে তার ভয় হচ্ছে। দৃষ্টি যতবার ফোন দিয়েছে ততবার মেহেদী বলেছে রক্তিমকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেই পাঠিয়ে দেওয়া অব্দিই সীমাবদ্ধ। পাষাণ পুরুষের এখনো আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। মনের ভয়টা এখন কান্নায় পরিণত হচ্ছে দৃষ্টির। চোখ গড়িয়ে পরেও যায় অশ্রুজল। বিছানায় বসে দৃষ্টি যখন অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই দরজায় কড়াঘাত পরে। তৎক্ষণাৎ ভয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায় দৃষ্টি। কাঁপা স্বরে জানতে চায়,
“ককে!” কয়েক সেকেন্ড নিরবতায় কেটে যায়। ক্ষণকাল পর ভরাট কন্ঠে রক্তিম নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়,
“আমি।” ছোট্ট একটা শব্দে রক্তিমকে প্রথমে চিনতে অসুবিধা হলেও কিছুক্ষণ পর বুঝে নেই এটা রক্তিমই। সিংহের গুহায় সিংহ ছাড়া আর কে আসবে! ঝটপট দুইহাতে চোখের অশ্রু মুছে দৌড়ে গিয়ে কপাট খুলে দেয় দৃষ্টি। গম্ভীর চিত্তে দৃষ্টিকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে রক্তিম। তাকে দেখার সাথে সাথেই অভিমানে ফুলে ওঠে দৃষ্টি। নাক ফুলিয়ে অভিযোগের স্বরে বলে,
“এই আপনার আসার সময় হলো! ঘরে একটা মেয়ে মানুষ রেখে কেউ এতোক্ষন বাইরে থাকে? নির্দয় পুরুষ একটা!”
ঘামে ভেজা শার্ট গা থেকে ছাড়াতে টপ বোতামে সবেই হাত রেখেছিল রক্তিম। এর মাঝেই দৃষ্টির কথায় বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে যায়। থেমে যায় হাতটাও। ইচ্ছে করে ঐসব ন্যাকা কথার বিপরীতে এক থাপ্পড়ে মেয়েটার মাথা ঘুরিয়ে দিতে। কিন্তু তা করেনা। একটা মানুষের গায়ে কতদিন হাত তোলা যায়! তবুও সে যদি কোনো ছেলে হতো তবে একটা কথা ছিল। মারতে মারতে মেরে ফেলতেও কোনো দ্বিধা ছিলনা রক্তিমের। কিন্তু যেখানে এই মেয়ে জাতির গায়ে হাত দেবার কথা ভাবতেও এখন ঘেন্না হয় রক্তিমের। সেখানে এই মেয়ের গায়ে আর কত হাত তুলবে! চোখে-মুখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়েই দৃষ্টির দিকে দু-পা এগিয়ে যায় রক্তিম। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে,
“আমি আসতে বলেছিলাম, না কি নিয়ে এসেছিলাম! দুটোর একটাও না। যেভাবে একা এসেছিস, সেভাবেই একা নিজের ভাবনা নিজ ভাব। দুনিয়া উল্টে গেলেও এই রক্তিম শিকদার কোনো মেয়েকে নিয়ে ভাববেনা।”
‘তুই’ শব্দটায় ক্ষেপে যায় দৃষ্টি। চোখ রাঙিয়ে বলে,
“একদম তুই-তুকারি করবেন না বলে দিচ্ছি। কাল রাগের মাথায় ডেকেছেন কিছু বলিনি। তাই বলে সবসময় ডাকবেন আর আমি হজম করে নিব এটা ভাববেন না।”
দৃষ্টির সাহসে রক্তিম হতবাক। অবাক চিত্তে কতক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জোরালো ধমকে ওঠে। নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলে,
“চুপ! গলা নামিয়ে আর চোখ নিচে রেখে কথা বলবি। তুই কেন? বাংলা অভিধানে যদি তুই শব্দের থেকেও নিম্ন কোনো শব্দ থাকত তবে সেটাই উচ্চারণ করতাম তোর বেলায়। দ্বিতীয়বার আমার সাথে গলা উচিয়ে কথা বলতে আসলে গলা কে টে বস্তা ভরে নদীতে ভাসিয়ে দিব।”
এমন শুকনো হুমকিতে অল্প ভিতু হয় দৃষ্টি। তবে সেটা চেহারায় প্রকাশ করতে চায়না। মনের ভয় মনে রেখেই রক্তিমের মতোই গম্ভীর হবার ভাব ধরে বলে,
“মিস্টার রক্তিম শিকদার! আপনি নিজেও গলা নামিয়ে কথা বলবেন আমার সাথে। পুরো সাভারবাসীর কাছে আপনি সবার বড় ভাই হলেও ঘরের ভিতর আমি আপনার হোম মিনিস্টার। সো রেসপেক্ট মি। আমার সাথে বাহাদুরী করতে আসলে একেবারে নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দিব। তখন দেখব চৌদ্দ সিকের ভিতর থেকে কিভাবে আমার উপর দাও ঘুরান।”
কথাটা বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায়না দৃষ্টি। দুরুদুরু মনে গালে থাপ্পড় পরার আগেই দৌড়ে বিছানায় গিয়ে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরে। মনে মনে আল্লাহকে জপে। বারবার আর্জি জানায় তাকে এবারের মতো বাঁচিয়ে দেবার আশায়। আজ যদি তার সুন্দর গাল দুটো ঐ রাক্ষসের হাত থেকে বাঁচে তো সকাল হতেই প্রথম চোখ খুলে যাকে দেখবে দৃষ্টি তাকেই একশো টাকা দান করবে। অন্যদিকে রক্তিম দৃষ্টির সাহসীকতায় বিস্ময়ে জড়িভূত হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গায়। দিন দিন মেয়েটার কার্যকলাপ যত দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে। এতো মার খাওয়ার পরও তার মুখের ওপর কথা বলার সাহস পায় কোথায় এই মেয়ে!
চলবে…..
#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২২
#আদওয়া_ইবশার
কুয়াশাচ্ছন্ন নতুন আরও একটা সকাল। ভোরের দিকে শীত শীত ভাবটা একটু বেশি অনুভব হওয়াই আরামের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে দৃষ্টির। গায়ের উপর মোটা এক কম্বল সাথে একটা কাঁথা। দুইয়ে মিলেও শীত নিবারণ করতে পারছেনা। সে তো রাতে রক্তিমের থেকে বাঁচতে কাঁথা, কম্বল সব দখল করে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রক্তিম! সে কোথায়? মানুষটা কি আজকেও এই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় বাইরে ছিল। ভাবতেই শীতের ভয় দূরে ফেলে ধরফরিয়ে ওঠে বসে দৃষ্টি। তখনই চোখ আটকে যায় তার পাশেই পাতলা এক চাদর গায়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা রক্তিমের দিকে। তৎক্ষণাৎ থমকে যায় দৃষ্টি। এই শীতে মানুষটা সারারাত পাতলা একটা চাদর গায়ে কাটিয়েছে! অন্তঃকরণে ব্যথারা এসে হানা দেয় দৃষ্টির। চোখ দুটো জ্বালা করে। ঝটপট একটা হাত বাড়িয়ে দাড়ি ভর্তি গালের একটা পাশ ছুঁয়ে দেয় আলতো স্পর্শে। সাথে সাথেই কেঁপে ওঠে শরীরের অত্যধিক শীতলতায়। আর একটুও দেরী না করে নিজের গায়ের কাঁথা, কম্বল দুটোই অতি সাবধানে জড়িয়ে দেয় রক্তিমের গায়ে। অপলক দৃষ্টিতে রক্তিমের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে, লোকটা এতো অদ্ভূত কেন? এই তীব্র শীতের মাঝে এমন ভাবে শুয়ে থেকে ঠান্ডায় ভোগার কোনো মানে হয়? কি এমন পাপ হয়ে যেতো দৃষ্টির গায়ে থাকা কম্বলের একটা অংশ নিজের গায়ের উপর মেলে দিলে? কত নিষ্পাপ দেখাচ্ছে ঘুমন্ত মুখটা! অথচ জেগে ওঠলেই জল্লাদের মুখোশ পরে সুন্দর এই মুখটা ঢেকে ফেলবে হিংস্রতার আড়ালে। মানুষ প্রেমে পরে বিপরীত লিঙ্গের কোমল হৃদয় দেখে, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটা মনের সন্ধান পেয়ে। আর সে কপাল পুড়ি আজীবন ক্রোধের অনলে পুড়তে প্রেমে পরল এক গুন্ডা, মাস্তানের হিংস্র রূপ দেখে।খাল কেটে কুমির আনা বোধহয় একেই বলে।
টিনের চালায় টুপটাপ ছন্দ তুলে বৃষ্টির ফোটার মতো ঝরে পরছে শিশির বিন্দু। মন্দ লাগছেনা শুনতে। বরং এতো এতো দুঃখের মাঝেও অন্যরকম একটা সুখ সুখ অনুভূতি জাগাচ্ছে মনে। সাথে ইচ্ছে জাগছে প্রিয় মানুষটাকে সঙ্গে নিয়ে এই কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে খালি পায়ে শিশির ভেজা ঘাসের উপর কিছু পথ হেঁটে আসতে। কিন্তু এই সিংহ মানবকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া ইচ্ছে গুলো কি আর পূর্ণতা পাবার হয়! সে তো মন জমিনে উকি দেয় শুধু আফসোস নামক শব্দটাকে ভারী করতে। না পাওয়ার ঝুলিটাকে পূর্ণতা দিতে। সাত সকালে ঘুম থেকেই ওঠেই সুন্দর, পবিত্র একটা ইচ্ছেকে মাটি চাপা দিতে হয় দৃষ্টির। বিছানা ছেড়ে দখিনের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ভারী কাঠের পাল্লা দুটো খুলে দিতেই এক দফা ঠান্ডা বাতাস এসে ছুঁয়ে দেয়। কনকনে শীতের তীব্রতায় ক্ষণেক্ষণে কেঁপে ওঠে দেহ। বাইরে যতদূর দৃষ্টি যাচ্ছে সবটুকু অন্ধকার। এক হাত দূরের কিছুও স্পষ্ট ন। হঠাৎ ঘরের লাইট জ্বলে ওঠায় জানালার বাইরে থেকে নজর সরিয়ে পিছন ফিরে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় রক্তিম থমথমে মুখে আলনা থেকে হুডি নিয়ে গায়ে জড়াচ্ছে। কাজটা সম্পূর্ণ করে একবারও দৃষ্টির দিকে না তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সেদিকে তাকিয়ে হতাশামিশ্রিত একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে দৃষ্টি। ভাবে এইযে বেরিয়েছে এবার হয়তো একেবারে রাতের সেই বারোটা, একটা বাজে ফিরবে। কিন্তু দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে ঘন্টা খানেক এর মাথায় ফিরে আসে রক্তিম। হাতে খাবারের প্যাকেট। কোনোকিছু না বলে থমথমে মুখেই বিছানায় বসে থাকা দৃষ্টির দিকে ছুড়ে মারে প্যাকেটটা। পাষাণতুল্য পুরুষটা হুট করে দৃষ্টির জন্য খাবার নিয়ে এসেছে! চোখের দেখাটাও যেন বিশ্বাস হয়না দৃষ্টির। অবাক, বিস্ময়ে কতক্ষণ রক্তিমের দিকে তাকিয়ে থেকে কোলের কাছে পরে থাকা প্যাকেটটা হাতে নেয়। খুলতে খুলতে সন্দিহাত কন্ঠে বলে,
“বাব্বাহ্! এতো দরদ দেখিয়ে খাবার আনলেন। তাও কি না আমার জন্য! সূর্য আজকে কোন দিক দিয়ে ওঠল?”
কথাটা রক্তিমের কর্ণকোহরে পৌঁছালেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়না রক্তিম। গোসল করার জন্য চুপচাপ নিজের কাপড় খোঁজে নিতে ব্যস্ত সে। তার এমন নিরবতা যেন দৃষ্টির সহ্য হয়না। খ্যাঁপা বাঘকে একটু খ্যাঁপানোর আশায় ফের বলে ওঠে,
“এই! আপনি আবার খাবারে বিষটিষ মিশিয়ে আনেন নি তো! না বাবা! সাত দিন না খেয়ে থাকলেও আমি এই খাবার মুখে তুলবনা। আপনাকে বিশ্বাস নেই। আমাকে মারতে খাবারে বিষ মিশাতেও আপনার হাত কাঁপবেনা। দেখা গেল এই খাবার খেয়ে আজকে মরে গেলাম। আর কাল সকালেই স্যোসাল মিডিয়া সহ সকল সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরবে,”স্বামীর হাতে খাবার খেয়ে নববধূর মৃত্যু।” তখন আবার পুলিশ এসে আপনাকে জেলে ভরবে। স্ত্রি হয়ে আমি কিভাবে স্বামীকে জেলে পাঠানোর মতো কাজ করতে পারি!”
কাধে কাপড় নিয়ে দরজা পযর্ন্ত গিয়েও দৃষ্টির কথায় থমকে যায় রক্তিম। ঘাড় ঘুরিয়ে কটমট চোখে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“তোর মতো একটা পোনা মাছকে মারার জন্য আমার খাবারে বিষ মিশিয়ে ছলনার আশ্রয় নিতে হবেনা। মারলে বীর পুরুষের মতো সামনে থেকেই মারব। কাপুরুষের মতো আড়াল থেকে না। অমানুষ হতে গিয়েও এখনো পুরোপুরি অমানুষ হতে পারিনি। তার জন্যই চোখের সামনে জেনে-শুনে কাওকে অভুক্ত রাখতে মন সাই দিচ্ছিলনা। যতদিন কিঞ্চিৎ মনুষ্যত্ব বেঁচে থাকবে এই রক্তিমের মনে। ততদিন তুই’ও বাঁচতে পারবি। যেদিন একেবারে অমানুষে পরিণত হব সেদিনই হবে তোর শেষ দিন।”
তুই-তুকারি শুনে এবারও নারাজ হয় দৃষ্টি। তবে তা নিয়ে কিছু বলেনা। বর্তমান প্রসঙ্গটাকেই গুরুত্ব দিয়ে বলে,
“সেই সুযোগ দিলে তো! যেদিন,যে মুহুর্তে অনিচ্ছা স্বত্বেও আমাকে কবুল করেছেন। ঠিক সেই মুহুর্তেই পুরোপুরি অমানুষ হবার সুযোগ হারিয়েছেন।আপনার মনের ঐ কিঞ্চিৎ মনুষ্যত্বের খোঁজ পেয়েই তো এসেছি,ঐটুকু পুঁজি করে পুরো আপনিটাকে বদলে দিয়ে একজন সু-পুরুষে পরিণত করার জন্য। যে সু-পুরুষের হৃদয় থাকবে মায়া দিয়ে পরিপূর্ণ।”
কথাটা বলেই রক্তিমের থেকে নজর ফিরিয়ে খাওয়ায় মন দেয় দৃষ্টি। শান্ত চোখে কতক্ষণ দৃষ্টিকে দেখে নিয়ে কলপাড়ে চলে যায় রক্তিম। তাকে এভাবে কোনো প্রতিত্তোর না করে চলে যেতে দেখে মিটিমিটি হাসে দৃষ্টি। মনে মনে ভাবে, পাষাণ শিকদার সবে অল্প অল্প কথা হারানো শুরু করেছে। এর মানে আগুনের দিন খুব শিগ্রই শেষ হতে যাচ্ছে। শীতের পর যে বসন্ত ঋতু আসবে। সে ঋতুই হয়তো প্রকৃতির সাথে সাথে দৃষ্টির সংসারেও সুখের হাওয়া বইয়ে দিবে।
প্যাকেটে থাকা খাবার অর্ধেক রক্তিমের জন্য রেখে বাকী অর্ধেক খেয়ে টেবিলে থাকা জগটা নিয়ে করপাড়ে যায়। রক্তিম এখনো কল চেপে বালতিতে পানি ভরছে গোসলের জন্য। হাতে থাকা জগটা এগিয়ে দেয় দৃষ্টি রক্তিমের দিকে। মুখটা গম্ভীর করার যথাসাদ্ধ চেষ্টা করে বলে,
“দ্রুত পানি দিন। খাবার আটকে গেছে গলায়।”
কল চাপা বন্ধ করে কতক্ষণ গরম চোখে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে রক্তিম। পরক্ষনে দৃষ্টির মুখের হাবভাব দেখে ভাবে হয়তো সত্যিই খাবার আটকেছে গলায়। এক প্রকার ছু মেরে জগটা হাত থেকে নিয়ে পূর্ণ করে দেয় পানি দিয়ে। বিনিময়ে মুখ ভরে হাসে দৃষ্টি। বাচ্চাদের “থ্যাংকিউ” বলে ঝটপট ঘরে চলে যায়।
****
গোসল ছেড়ে রক্তিম ঘরে আসতেই দৃষ্টি মুখটা সিরিয়াস করে বলে,
“খাবারটা খেয়ে দ্রুত রেডি হয়ে নিন। বাইরে যাব। আমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে।”
ভ্রু কুঁচকে দৃষ্টির দিকে তাকায় রক্তিম। চুল মুছতে ব্যস্ত থাকা হাতটা থামিয়ে শীতল কন্ঠে বলে,
“কিসের জন্য?”
“বাজার করতে হবে। হাড়ি-পাতিল কিনতে হবে। টুকটাক ঘরের কিছু জিনিস কিনতে হবে। আমার কয়েকটা ড্রেস কিনতে হবে। এভাবে কতদিন বাইরের খাবার খেয়ে এক পোশাকে থাকব? অনিচ্ছা স্বত্বেও তো বিয়েটা করেছেন। এবার স্বামীর দায়িত্বটুকুও যথাযথ ভাবে পালন করুন।”
এতোক্ষনের সামলে রাখা মেজাজটা এবার লাগামছাড়া হয় রক্তিমের। তেড়ে আসে দৃষ্টির দিকে। হাত উচিয়ে চড় দেবার ভঙ্গিতে এগিয়ে নিয়ে বলে,
“একদম বউগিরি ফলাতে আসবিনা বলে দিলাম। গলা কে টে বস্তায় ভরে ডাস্টবিনে ফেলে রাখতে খুব বেশি সময় লাগবেনা। যেভাবে আছিস সেভাবে থাকতে পারলে থাক না হয় নিজের রাস্তা মাপ।”
রক্তিমের এমন আক্রমণাত্মক মনোভাবে ভয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে পিছিয়ে যায় দৃষ্টি। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে মনে সাহস জুগিয়ে সমান তেজে বলে,
“একটা সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে জানেন না? সবসময় এমন হম্বিতম্বি করেন কেন? যাবেন কি যাবেন না সেটা বলুন।”
“যাবনা। কি করবি তুই?”
“যাবেন না!”
হাত দুটো ভাজ করে শান্ত চোখে তাকিয়ে জানতে চায় দৃষ্টি। নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে শক্ত কন্ঠে আবারও না বলে রক্তিম। সাথে সাথেই দৃষ্টি ফোন হাতে নিয়ে আজীজ শিকদারের নাম্বারে ডায়াল করে। ফোন রিসিভ হতেই দৃষ্টি কন্ঠে অসহায়ত্ব ঢেলে বলে,
“শশুর বাবা! আজ দুইদিন হয়ে গেছে আপনার ছেলের সংসারে আছি আমি। দুটো দিনে পেটে একটা দানাও পরেনি আমার। বাপের ঘর থেকে যে পোশাকে বেরিয়েছিলাম সেই পোশাকেই এখনো আছি। একটা সুতা পযর্ন্ত কিনে দেয়নি আপনার ছেলে। না দিয়েছে খাবার জন্য এক ফোটা বিষ। আজকে বলেছি আমাকে নিয়ে একটু বাজারে যেতে। বলতেই আমার গায়ে হাত তুলেছে। আপনিই বলুন, আমি কি কোনো অন্যায় আবদার করেছি? কোন স্ত্রী তার স্বামীর কাছে নিজের প্রয়োজনের কথা বলেনা! সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার কথা বললে স্বামী বউয়ের গায় হাত তুলবে কেন? আপনি একজন সম্মানিত এমপি। আপনার কাছে আমি বিচার চাইছি। হয় আপনার ছেলেকে বলুন আমাকে বাজারে নিয়ে যেতে না হয় আপনার ছেলের বিচার করুন।”
একদমে কথা গুলো বলে থামে দৃষ্টি। ছেলের এমন আচরণের কথা শুনে আজীজ শিকদারের শান্ত মেজাজ অশান্ত হয়। গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
“কোথায় অপদার্থটা? ফোনটা দাও তুমি ওর কাছে।”
সাথে সাথে ফোন লাউডে রেখে রক্তিমের দিকে এগিয়ে ধরে দৃষ্টি। রক্তিমের কানে ভাসে বাবার শান্ত কন্ঠের হুমকি,
“আমি এই মুহূর্তে মেহেদীর বাসায় আছি। বিশ্বাস না হলে তোমার গুণধর বন্ধুকে ফোন দিয়ে জেনে নিতে পারো। বিয়ের কথাবার্তাও প্রায় এগিয়ে গেছে। এখন যদি তুমি চাও তো সব ক্যান্সেল করে দেই! আর সেটা যদি না চাও তবে দশ মিনিটের ভিতর বউমাকে নিয়ে মার্কেটে যাবে। বউমা যা যা চায় সব কিনে দিবে। টাকা না থাকলে আমি পাঠাচ্ছি। তবুও যে বউমা’র একটা আবদার’ও অপূর্ণ না থাকে। কথাটা মাথায় রেখো।”
পাষাণ হৃদয়ের রক্তিম শিকদারকে নাকানি-চুবানি খাওয়ানোর খুব ভালো এক পন্থা খোঁজে নিয়েছে আজীজ শিকদার। সে খুব ভালো করেই জানে, ছেলে তার যেকোন কিছুর বিনিময়ে হলেও প্রাণপ্রিয় বন্ধ আর বোনের ভালোবাসার পূর্ণতা চায়। প্রাণের থেকেও প্রিয় এই মানুষ দুটোর জন্য রক্তিম শিকদার শুধু বাবা আর বউ নামক বিনা নোটিশে ঘাড়ে চাপা মেয়েটার আবদার গুলোই না। নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে প্রস্তুত। রক্তিম খুব ভালো করেই জানে তার বাবা কেমন মানুষ। মানুষটাকে সবাই যতটা শান্ত আর সরল ভাবে চিনে। তার থেকেও ভিন্ন ভাবে জানে রক্তিম। সে খুব ভালো করেই জানে আজীজ শিকদার মুখে একবার যা বলে তা অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করবেই। এমন শান্ত স্বভাবের মানুষ গুলোর জেদ নামক জিনিসটা অত্যন্ত প্রখর হয়। এরা হুটহাট না রাগলেও শান্ত মস্তিষ্কে একবার রাগ চাপলে নিজের ক্ষতি করতেও দ্বিধা করেনা।
জলন্ত দৃষ্টিতে কতক্ষণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে নিরুপায় রক্তিম রেডি হয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। রক্তিমের নিরব প্রস্থানে দৃষ্টি হতাশ হয়ে ভাবে শশুরের হুমকি হয়তো কাজে দেয়নি। ঠিক তখনই বাইরে থেকে লাগাতার বাইকের হর্ন ভেসে আসে। দৃষ্টি বুঝে যায় রক্তিম তাকে যাবার জন্যই নিরবে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছে। সাথে সাথেই মনে অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে যেভাবে ছিল সেভাবেই ওড়নাটা মাথায় পেঁচিয়ে বেরিয়ে যায়।
চলবে……