||দৃষ্টিভ্রম|| ||পর্ব: ০২||
রুমটা একদম খালি। ভেতরে কেউ নেই। অথচ সব জিনিসপত্র এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে হাম্মাদের। নিজ হাতে জিনিসপত্র গুছাতে লাগে। অল্প কিছু গুছিয়ে আর কোনো জিনিসে হাত দেয় না। আজ ঘরে কী হয়েছে কে জানে! কিন্তু এই মূহুর্তে সে এসব জানতে চায় না। আশেপাশে কিছু একটা খুঁজে বিছানায় বসে সিগারেট ধরায়। জীবন প্রায় তিন যুগের কাছাকাছি চলে এসেছে। অথচ এই জীবনে পাওয়ার খাতায় স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও সুখ নেই। টাকা দিয়ে সে সব কিনতে পেরেছে কিন্তু সুখপাখিকে কিনতে পারেনি। দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে সিগারেট হাতে নিয়েই এগিয়ে যায় সে। কাজের মেয়ে রানু বলল, “স্যার, বড় ম্যাডাম কল করেছিলেন। আপনার ফোন নাকি বন্ধ। জিজ্ঞেস করেছেন আপনি কবে বাসায় যাবেন। আর আপনি যেন একবার কল দেন সেটাও বলেছেন।”
হাম্মাদের মা-বাবা আর ছোট ভাই ঢাকায় থাকেন। সে বান্দরবান থাকে গত তিন বছর ধরে। এই শহরটা তার মোহময় লাগে। চোখ ধাধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার মনে ঘর বেঁধেছে। তাই সে এখানেও নতুন ব্যবসা শুরু করেছে। এই তিন বছরে একবার মাত্র ঢাকায় বাবা-মায়ের কাছে গিয়েছে। বাবা মা চাইলেও এখানে তার কাছে আসতে পারেন না। কারণ তার ঠিকানাই কারো কাছে নেই। যাযাবরের মতো ছ’মাস এই জায়গায় তো ছ’মাস অন্য জায়গায়। কিছুদিন পরপরই বাসা বদলায় সে। নিজের মাঝে নিজেই একটা রহস্য সে।
শতরূপা কোনোরকম লুকিয়ে রুমে চলে আসে। ইরাম তাকে রুমের ভেতরে ঢুকিয়ে দরজার কাছে এসে বলল, “বুবু, আজকের কথা কিন্তু বাবাকে বলবে না।”
“কোন কথা!”, ভ্রু কুঁচকে তাকায় সে।
আজ দুপুরের কথাটা সে নিজেই ভুলে গিয়েছিল। ইরাম না বললে মনেই পড়ত না। তাকে একটা মেয়ের সাথে দেখেছে রিকশায় ঘুরতে। আপন ছোট ভাইয়ের মতো আদর করে সে ইরামকে। নিজের কোনো ভাই নেই বলেই হয়তো এত আদর করে। ইরামের সকল দোষ সে ঢেকে রাখে।
শতরূপা তাদের তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। বড় বোন চম্পা বাক প্রতিবন্ধী আর মেজ বোন অর্পার একবার বিয়ে হয়েছিল এখন আবার বাবার ঘরেই আছে। স্বামীটা খারাপ ছিল যে-কোনো ছুতো ধরে তাকে প্রতিদিন মারধর করতো। এসব সহ্য করতে না পেরে বাবার বাড়িতে চলে আসে। এরপর ডিভোর্স হয়ে যায় তাদের। বাড়িতে এখন সে সেলাইয়ের কাজ করে। ছোট্ট একটা মেয়েও আছে তার। দুই বোন মিলে সংসারের খরচ চালায়। তার জীবনের এসব কথা শুনে বাড়িওয়ালার মন গলে যায়। যার ফলে তিনি তাকে এখানে কম ভাড়ায় থাকার জায়গা দিয়েছেন। নাহলে তিনি অবিবাহিত মেয়েকে জায়গা দিতেন না। তার কথামতে, অবিবাহিত মেয়েরা এক একটা মহা বিপদ।
শায়ান এর মধ্যেই হাম্মাদকে পাঁচটা কল করেছে। ক্লায়েন্ট এসে বসে আছে। আজকে একটা ডিল ফাইনাল হওয়ার কথা অথচ এখনো হাম্মাদ অফিসেই আসেনি। পুনরায় কল দিতে যাবে তখনই দেখতে পেল সে কনফারেন্স রুমে এসে ঢুকেছে। শায়ান হাম্মাদের পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। চার পাঁচ বছর ধরে একসাথে কাজ করছে তারা। বিশ্বস্ত মানুষদের মধ্যে সে অন্যতম একজন। হাম্মাদের সকল ভালো-মন্দ কাজের একমাত্র সাক্ষী শায়ান।
হাম্মাদ ডিল ফাইনাল করে চেয়ারটায় মাথা হেলিয়ে বসে বলল, “এই ডিল তো ফাইনাল করে ফেললাম, কিন্তু যেটা তিন বছর ধরে করতে চাচ্ছি সেটা কবে করতে পারব?”
“স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না। প্ল্যান মতোই কাজ চলছে। এই সপ্তাহেই পজিটিভ কিছু আশা করছি আমি। আপনি কোনো সাড়া পাননি?”, বলেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাম্মাদ। অনেক কথা বলতে যেয়েও যেন এই দীর্ঘশ্বাসের সাথে আটকে যায়। খানিকক্ষণ থেমে আবার বলল, “তুমি তো জানোই, আমি এসব কম বুঝি, খুবই কাঁচা। তাই তো তোমাকে আমার সহযোগী হিসেবে রাখা।”
“সব ঠিক হয়ে যাবে। ভরসা রাখুন।”
শায়ানের কথায় ক্ষীণ হাসে যে। মনটা বিষন্ন হয়ে এসেছে। এখন কিছুক্ষণ একা থাকতে চায়। শায়ান রুম থেকে বেরিয়ে যায়। লাঞ্চ করার জন্য কাছের একটা রেস্টুরেন্টে যায়। এখানে তার প্রায়ই আসা-যাওয়া হয়। আজ আরেকটা কারণে আসা। খুব কাছের একজন মানুষের অপেক্ষা করছে সে। আসলেই খাওয়া শুরু করবে। অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে সেই মানুষটা আসে। তার সামনে বসে বলল, “স্যরি, দেরি হয়ে গেল। জানোই তো আমার অফিসে বসটা কেমন।”
“রূপা, তোমাকে কতবার বললাম এই চাকরিটা ছেড়ে দাও। আমি হাম্মাদ স্যারের সাথে কথা বলে তোমার চাকরির ব্যবস্থা করে দিতাম। কিন্তু তুমি…”
শতরূপা মৃদু হেসে বলল, “কারো সুপারিশ নিয়ে চাকরি করার হলে তো কবেই তোমাকে হ্যাঁ বলে দিতাম শায়ান। কিন্তু আমি চাই আমার যোগ্যতায় চাকরি হোক কারো সুপারিশে নয়।”
“তুমি সেই আগের তুমিই থেকে গেলে। কলেজ জীবন থেকে দেখে আসছি। একটুও বদলাওনি।”
“আমি বদলাতে চাইও না।”
কথার মাঝখানেই ওয়েটার এসে খাবারের অর্ডার নিয়ে গেল। শায়ান মাঝেমধ্যে শতরূপাকে এনে খাওয়ায়। তারা কলেজ জীবনের বন্ধু। মাঝখানে বেশ কয়েক বছর যোগাযোগ ছিল না একে অপরের সাথে। এই শহরে চাকরির সুবাদে আবার যোগাযোগ হয়ে উঠে।
খাবার শুরু করতে যাচ্ছিল আচমকা সেখানে হাম্মাদের আগমন। শায়ান দূর থেকে তাকে দেখে এগিয়ে যায়। এই সময় তো তার এখানে উপস্থিত থাকার কথা নয়!
“আরে স্যার আপনি এখানে!”
চোখের চশমাটা খুলে আশেপাশে তাকিয়ে বলল, “কেউ একজন বলেছিল এই রেস্টুরেন্টের খাবার নাকি অনেক ভালো কিন্তু কোনোদিন খাওয়ার দাওয়াত করেনি তাই ভাবলাম নিজেই গিয়ে টেস্ট করে আসি।”
লজ্জায় মাথা চুলকায় শায়ান। সে নিজেই হাম্মাদকে এখানের খাবারের কথা বলেছিল। কিন্তু কখনো সময়ে সুযোগে তাকে নিয়ে আসা হয়নি। আজ যখন নিজে থেকেই এসেছে তখন সে খাতিরযত্নের কোনো কমতি রাখবে না। নিজের বুকিং করা টেবিলে নিয়ে যায়। শতরূপা হাম্মাদকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
হাম্মাদ শতরূপাকে দেখে ঘাড়টা ঈষৎ বাঁকিয়ে বলল, “আমি কী ভুল সময়ে এসে পড়লাম?”
শতরূপা চোখ কুঁচকে তাকায়। দুইজন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে আসলেই কী তাদের মধ্যে প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক! মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত। মন কখনো পজিটিভ ভাবনা আনতে পারে না। সবসময় নেগেটিভ চিন্তাটাই আগে আসে।
“আমরা কেবল বন্ধু…”, শতরূপা আর শায়ান কথাটা একসাথে বলে উঠে।
হাম্মাদ তাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে বলল, “কুল!”
একসাথে তিনজন বসে পড়ে। শতরূপার সম্মুখে তারা দু’জন বসে আছে। এতক্ষণ বেশ আয়েশ করে বসেছিল সে কিন্তু হাম্মাদের উপস্থিতি কেমন যেন একটা অপ্রতিভ পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। এসি চালু করা তবুও ঘামছে। শরীরটা গরম হয়ে আছে। সময় যেন যেতে চাচ্ছে না। এতক্ষণ কত কথা বলছিল তারা কিন্তু এখন তাদের মাঝে নেমে এসেছে কঠিন নীরবতা। যেন কেউ কাউকে চেনে না। এই প্রথম দেখা করতে এসেছে।
শায়ান কিছুক্ষণ পর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “স্যার, পরিচয় করিয়ে দিই ও হলো আমার কলেজ ফ্রেন্ড, শতরূপা। আর রূপা, উনি আমার বস মি. হাম্মাদ খন্দকার। যার কথা আমরা কিছুক্ষণ আগেও আলাপ করছিলাম।”
“বাহ! আমি তাহলে তোমাদের গল্পের অংশ! আমি মিস. শতরূপাকে চিনি।”, সোফায় হেলান দিয়ে শতরূপার দিকে দৃষ্টি নিয়ে বলল সে।
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শায়ান বলল, “তাই নাকি! কই রূপা তুমি তো আমাকে বললে না কখনো!”
“আসলে বলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু…”
শতরূপার কথা শেষ করার আগেই হাম্মাদ বলল, “কিন্তু আমি এসে গেলাম! তাই তো?”
“আপনি আমাকে যেদিন থেকে চেনেন আমি আপনাকে তারও আগে থেকে চিনি।”, দৃঢ় কণ্ঠে বলল শতরূপা।
“কত আগে থেকে? ছ’মাস? কিন্তু আমি তো আপনাকে তিন বছর আগে থেকে চিনি।”
হাম্মাদের কথা শুনে অবাক হয় সে। বসের বিবাহবার্ষিকী ছ’মাস আগে হয়েছে আর তখন থেকেই তাকে চেনে। কিন্তু সে কীভাবে তিন বছর আগে থেকেই চেনে এটা ভাবায় তাকে। কিছু বলতে যাবে তখনই খাবার নিয়ে হাজির হয় ওয়েটার।
তাদের এত কথার মাঝে শায়ান চুপ করে বসে আছে। মনে হচ্ছে সে এখানে বিনা কারণেই বসে আছে। এখানে কেবল তাদের দু’জনের উপস্থিতিই যথেষ্ট। সে যেন কাবাবের মাঝে হাড্ডি হয়ে। চুপচাপ খাবার শুরু করে। বসের কথার উপর কোনো কথা বলার সাহস তার নেই। আগ্রহ ধরে রাখতে না পেরে শতরূপা জিজ্ঞেস করল, “তিন বছর আগে থেকে কীভাবে চেনেন আমাকে?”
“এতটা আগ্রহ ভালো না মিস শতরূপা। পৃথিবীতে কত ঘটনাই তো ঘটে আমাদের অজানা এই জিনিসটাও না হয় অজানাই থাকুক। সবকিছু জেনে গেলে তো চমকটাই নষ্ট হয়ে যাবে।”, বলেই স্যুপ মুখে দেয় সে।
শতরূপার ভাবনাকে গভীরে নিয়ে ছেড়ে দেয় হাম্মাদ। উপরে উঠার সিঁড়িটা আর এগিয়ে দেয় না। ভাবনাত এই অতল গহ্বর থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসবে তা এখনো জানে না সে। তবে গভীরে যখম গিয়েছে তখন শূন্য হাতে ফিরবে না, ভরা হাতেই উঠে আসবে। হাম্মাদের স্যুপ খাওয়া দেখে নিজের অর্ডার করা ফ্রাইড রাইস আর ক্রিসপি চিকেন মুখে দিতে পারছে না সে। এই দুপুরে ক্ষুধার্ত পেটে কেউ স্যুপ খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্টে আসে বলে জানা ছিল না তার। অন্যদিকে শায়ান খেয়েই চলেছে। তার অর্ধেক প্লেট প্রায় শেষ। পাশাপাশি দু’জন ছেলে অথচ দুইজন দুই মেরুর। শায়ান স্বাভাবিক হলেও হাম্মাদ অদ্ভুত একটা চরিত্র। তবে এই মানুষটার কথার প্যাচ উন্মুক্ত করা মুশকিল হলেও অসম্ভব কিছু নয়।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা