#দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব
#পর্ব_০২
#অনন্যা_অসমি
ইশরা এবং সাফাইতকে একসাথে দেখে তোহা ভাবতে লাগল তার যাওয়া উচিত হবে কিনা। তারপর নিজেই নিজেকে ধমকে বলল,
” সাফাইতের সাথে যেই থাকুক এতো দ্বিধা করার কি আছে? সেকি আমার দূরের কেউ নাকি? তোহা তুই নিজেই নিজেকে অস্বস্তির মধ্যে ঠেলে দিছিস।”
সাফাইতের পাশে এসে দাঁড়াল সে। ব্যাগ থেকে একটা ফাইল বের করে টেবিল রাখল।
” এই নে তোর এসাইনমেন্ট। যত্ন করে রাখিস, হারিয়ে আবার কান্নাকাটি করিস না। আমি তখন আর করে দেব না।”
” আরে আমার তোহারাণী থ্যাংক ইউ। তুই বস, আমি তোর জন্য গরম গরম চা নিয়ে আসছি। কাল রাতে ঠিকমতো ঘুমাসনি আমি জানি।”
তোহা প্রথমে বারণ করতে চাইলেও পরবর্তীতে করল না। খালি চেয়ারটাতে বসে পড়ল। মুখে হাসি রেখে বলল,
” এই যে আমি তোমাদের মাঝে চলে আসি এতে তুমি বিরক্ত হও বুঝি?”
” আরে না না কি বলছ এসব? তুমি সাফাইতের বেস্টফ্রেন্ড, সে হিসেবে তুমি আমারো বন্ধু। তার থেকেও বেশি আমি তোমাকে বড় বোনের নজরে দেখি। সাফাইত আমাকে সবসময় তোমার কথা বলে, তুমি নাকি ওর জীবন্ত ডায়রি।”
” সত্যি সে আমার কথা বলে?”
” তা নয়তো কি? মিথ্যা বলব না, প্রথমদিকে যখন সে তোমার কথা বলত তখন না আমার হিংসে হতো। সাথে তোমাকে দেখার সুপ্ত ইচ্ছে জেগেছিল। যখন তোমার সাথে দেখা হলো, তোমার সাথে কথা বলা শুরু হলো। বুঝতে পারলাম কেন সাফাইত তোমার এতো প্রশংসা করে।”
সাফাইত তার কথা ইশরাকে বলে জানতে পেরে তোহার অধরের কোণে তৃপ্তিমাখা হাসি ফুটে উঠল।
চা হাতে সাফাইত ফিরে এলো। তোহাকে দেওয়ার আগে কয়েকবার তাতে ফুঁ দিল।
” সাবধানে খাবি, গরম। আবার জিহ্বা পুড়িয়ে মুখের সাধ খারাপ করে রাখবি।”
” আমি জানি, তোকে আর আমার গার্জিয়ান সাজতে হবেনা।”
” জানিস বলেই তো বারবার জিহ্বা পুড়িয়ে রাখিস। জানো ইশরা খেয়াল না করিয়ে দিলি ইনি প্রতিবার গরম চা খেয়ে জিহ্বা পুড়িয়ে আ..উ.. করবে আর বলবে খাবারে সাধ নেয়।”
তোহা কথায় পেরে উঠতে না পেরে ভেংচি কাটল।
” এরকম মুখ আঁকাবাকা করিস না। দেখবি কখন একেবারে বাঁকা হয়ে গিয়েছে৷ তখন কোন সুন্দর ছেলে আর তোর পিছনে ঘুরবেনা।”
” তোকে তো আমি….”
” আরে আরে তোমরা এবার থামো। হাসতে হাসতে আমার মুখ ব্যথা হয়ে গিয়েছে।”
” কথা বলবি না আমার সাথে আর বেয়া’দব। আমি গেলাম, তুই থাক একা।”
আধো গরম চা’টা এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিল সে। যদিওবা গলা খানিকটা জ্বলছে তবে তা প্রকাশ করল না। আরেকবার ভেংচি কেটে গটগট করে চলে গেল।
” বুঝলে ইশরা ছোট থেকেই সে এরকম। কথায় পেরে না উঠলে রাগ দেখিয়ে চলে যায়।”
“তা তো তোমাদের কান্ড দেখেই বুঝতে পেরেছি। তুমিও কম না, সবসময় ওর পেছনে পড়ে থাকো।”
” কি করব বলো? পেটের ভাত হজম করতে হবে তো।”
সাফাইতের কথা শুনে ইশরা না হেসে পারল না।
.
.
টিউশনি করিয়ে বাড়ির ফিরে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল তোহা। ঘুমের মাঝে কানের কাছে ঠান্ডা বাতাস অনুভব হতেই নড়ে চড়ে উঠল। কাঁথাটা আরো গায়ে জড়িয়ে নিল। পুনরায় আবারো একি ধরণের বাতাস অনুভব করলে সে অপর পাশে ফিরে গেল। তবে ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।
” তোকে এখন আমি নিয়ে যাবো। আমাদের জ্বিন সর্দার তোকে খুব পছন্দ করেছে। হিহিহি….” কথা শেষে বিদঘুটে হাসি শুনে ধরফরিয়ে উঠে বসল তোহা। নিঃশ্বাস দ্রুত বেগে উঠানামা করছে৷ তার অবস্থা দেখে সাফাইত উচ্চস্বরে হেসে উঠল। তার হাসি দেখে তোহার বড্ড রাগ হলো। বালিশ নিয়ে ছুঁড়ে মারল তার দিকে।
” আরে পেত্নী কি করছিস? লাগছে তো।”
” লাগুক, লাগার জন্যই তো মেরেছি। এটা কি ছিল? এভাবে কেউ রাক্ষসের মতো হাসে? আরেকটু হলে আমার প্রাণ বেরিয়ে যেত।” কথা শেষে বুকে হাত দিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস নিল সে।
” ভালোই হতো, তখন কবজি ডুবিয়ে তোর চল্লিশা খেতাম।”
” তবে রে।” আরেকটা বালিশ নিয়ে ছুঁড়ে মারার আগেই সাফাইত বাঁধা দিল।
” আচ্ছা বাবা সরি সরি, কুল বাবু কুল।”
তোহা বালিশটা উঁচিয়ে বলল, ” আবারো বাবু বলেছিস। তোকে তো আমি এবার শেষ করে ফেলব।”
” আচ্ছা তোহা, তোহা। এবার বালিশটা রেখে দে, এই নাদান বাচ্চাকে আর মারিস না।”
তোহা আড়চোখে তাকিয়ে বালিশটা জায়গায় রেখে দিল। চুল বাঁধতে বাঁধতে বলল, ” এখানে কি এখন? আবারো কি কোন কাজ আছে নাকি? থাকলে তাড়াতাড়ি বলে ফেলল।”
” আমি তো সবসময় তোর কাছে কাজ করানোর জন্য আসি।” মুখ ভার করে বলল সে। তোহা ততক্ষণে বিছানা থেকে নেমে পড়েছে৷ সে এগিয়ে এসে সাফাইতের থুতনি ধরে ঢং করে বলল,
” না তুমি তো আমার কাজ করে দিতে আসো।”
” যা তাহলে আমি আর আসব না। কাট্টি তোর সাথে।”
” হয়েছে এবার নাটক বন্ধ কর আর আসল কথায় আয়। মা কোথায়? কিছু খেতে দেয়নি তোকে?”
” জিজ্ঞেস করেছিল কী খাবো তবে আমি বারণ করেছি। কারণ বাইরে গিয়ে খাবো। এখন তুই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।”
” কেন? কোথায় যাবো? আমি কিছুক্ষণ আগেই এলাম, এখন আর বাইরে যেতে ইচ্ছে করছেনা।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। আলমারি খুলে সব জামাকাপড় নাড়াচাড়া করে একটা জামা নিয়ে তোহার হাতে ধরিয়ে দিল সে। একপ্রকার ঠেলে তাকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়ে বলল,
” তাড়াতাড়ি বের হবি, না হলে এই অবস্থায় তুলে নিয়ে যাবো।”
আর কথা বাড়াল না তোহা। কারণ সে ভালোই জানে গলা ফাঁটিয়ে ফেললেও সাফাইত তার কথায় কোন কান দেবে না।
বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তোহা। সাফাইত একটা হেলমেট নিজে পড়ে নিল। অপরটা তোহার দিকে বাড়িয়ে দিতে গিয়েও দিল না। তোহার মন ক্ষুণ্ণ হল। সে ভাবল হয়তো এখন ইশরা এটা ব্যবহার করে বলে সাফাইতের দিতে দ্বিধা লাগছে।
” থাক কেন অন্যের জিনিসে ভাগ বসাব? এটা তো সামান্য হেলমেট, একদিন না পড়লে কিছু হবে না। যেখানে পুরো মানুষটাকেই দিয়ে দিয়েছি, সেখানে এটা তো সামান্য হেলমেট।”
সে যখন নিজ ভাবনায় মত্ত ছিল সেসময় সাফাইত তার চুলগুলো যত্ন সহকারে গুছিয়ে বাঁধলো। তোহা ভাবনায় ইতি টেনে অবাক নয়নে তার কাজকর্ম দেখে চলেছে। সাফাইত হেলমেটটা পড়িয়ে দিয়ে বেল্টখানা বাঁধতে বাঁধতে বলল,
” এভাবে চোখ গিয়ে গিলে খাচ্ছিস কেন? নতুন দেখছিস আমাকে?”
” তোকে বহু বছর ধরে দেখলেও যে আমার দেখার তৃষ্ণা মিটবে নারে৷” বিরবির করে বলল তোহা।
” কি বিরবির করছিস? বড় করে বল।” এতোক্ষণে সাফাইত দূরে সরে গিয়েছে। তোহা মাথা নাড়িয়ে জানাল কিছুনা।
” বুঝিনা বাপু তুই মাঝেমধ্যে কি এতো বিরবির করিস। নে এবার উঠে বস, আমাকে ভালো করে ধরবি। পড়ে গেলে এখানে-ওখানে যাওয়ার বদলে হসপিটালে ঘুরতে হবে।”
সাফাইতের পর তোহা উঠে বসল। দু’হাত রাখল সাফাইতের কাঁধে। বাইক সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। শোঁ শোঁ বাতাসে তার পেছনে পড়ে থাকা চুলগুলো উড়তে লাগল। শখানেক মানুষ, গাড়ি পেরিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। তবে সেসবে এখন তোহার খেয়াল নেয়। সে সাইড মিররে সাফাইতের প্রতিচ্ছবি দেখতে ব্যস্থ। মানুষটাকে আজ যে প্রথম দেখছে না, তার সবকিছু তোহার জানা। তবুও সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখে চলেছে। তৃষ্ণার্ত পাখির মতো সাফাইতকে দেখে নিজের চোখের তৃষ্ণা নিবারণ করার চেষ্টা করছে সে।
” সাফাইত তুই কি আমার জীবনে এখন অতিথি পাখি হয়ে গেলি? সময় শেষ হতেই কি আমাকে একা করে চলে যাবি? তুইহীনা আমি পারব তো থাকতে?”
চলবে….