#দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব
#পর্ব_০১
#অনন্যা_অসমি
নিজের পছন্দের পুরুষকে অন্য রমণীর হাত ধরে হাঁটতে দেখে থমকে গেল তোহা। দাঁতে দাঁত চেপে চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করছে সে। নীরবে সরে আসার পূর্বেই মানুষটা তাকে দেখে ফেলল। ছুটে এসে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
” কিরে তোহারাণী, আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিস কেন?”
সাফাইতের প্রশ্নে তোহার বেহায়া চোখে পুনরায় জল জমতে শুরু করেছে। সে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করল। সাফাইতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীকে আড়চোখে পরখ করে বলল,
” তোদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হতে চাইনি। তোরা কথা বল, আমি ক্লাসে যাচ্ছি।”
তোহা এড়িয়ে চলে আসতে চেয়েও ব্যর্থ হলো। সাফাইত তার হাত টেনে আটকে দিয়েছে।
” কোনো ক্লাসটাস করতে হবেনা। ইশরার ইচ্ছে হয়েছে আজ দুপুরে খাবার রেস্টুরেন্টে খাবে। তুইও যাবি আমাদের সাথে।”
তোহা নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
” নারে তোরা যা। তোদের মাঝে আমি গিয়ে কী করব? তোরা হলি লাভ বার্ড’স, সেখানে আমি কেবল মাত্র তৃতীয় ব্যক্তি। আমি গেলে তোরা নিজের সময় ঠিক মতো উপভোগ করতে পারবিনা। তার থেকে ভালো তোরা যা, আমি ক্লাস করে বাসায় চলে যাবো।”
তার কথায় কোনরূপ মনোযোগ দিলনা সাফাইত। পুনরায় হাত ধরল, অপরদিকে ধরল ইশরার হাত। টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ” আমি তোর থেকে উওর জানতে চাইনি, শুধু জানিয়েছি। ইদানীং বড্ড বেশি কথা বলছিস তুই।”
ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে তোহা মনে মনে বলল,
” বেশি কথা বলছি বলেই তো ভিতরে ভিতরে গুমড়ে মরছি৷”
ইশরা এবং সাফাইত পাশাপাশি বসল, তাদের মুখোমুখি বসল তোহা। খাওয়ার সময় তারা দু’জন কথা বললও তোহা নীরব শ্রোতার মতো মনযোগহীনভাবে তাদের শুনে গেল। আচমকাই পরিচিত মানুষটার সামনে বসতে তার অস্বস্তি হতে লাগল, ভেতরে ভেতরে নিঃশ্বাস আটকে আসছে বলে মনে হচ্ছে।
ডেজার্ট খাওয়ার সময় তোহা খেয়াল করল ইশরা কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিছুসময় ভেবে সে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ দাঁড়ানোর কারণে দু’জনের কথার মাঝে ব্যঘাত ঘটল। তারা কোন প্রশ্ন করবে তার পূর্বেই সে দ্রুততার সাথে বলল,
” তোমরা কথা বলো আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।” দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল সে।
ওয়াশরুমে এসে বেশ কয়েকবার মুখে পানি ঝাপটা দিল তোহা। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবিয়ে গেল সে।
তোহা চলে যাওয়ার পর সাফাইত চেয়ারটা টেনে ইশরার আরেকটু পাশে এসে বসল। টেবিলের নিচে হাতখানা আঁকড়ে ধরে বলল,
” তোহা আমাদের সাথে এসেছে বলে কি তুমি মন খারাপ করেছে ইশরা?”
” তা হবে কেন? তোহা আপু কি অপরিচিত কেউ নাকি?”
” দেখো ইশরা তোহা আমার অনেক পুরোনো বন্ধু। আমার সকল সুখ-দুঃখের ভাগীদার তোহা। বলতে গেলে সে আমার জীবন্ত ডায়রি৷ ওর সাথে আমি মেলামেশা করি বলে তুমি মন খারাপ করো না ইশরা। ওকে ছাড়া আমি একপ্রকার অচল। তোহাবিহীন আমার কেন যেন সবকিছু আনন্দহীন লাগে।”
ইশরা সাফাইতের বাহু আঁকড়ে ধরে বলল,
” আগে তো আমার জায়গাটা ফাঁকা ছিল, এখন তো আমি আছি। তাই তোহা না থাকলেও তোমাকে আমি হাসিখুশি রাখব। একটা সম্পর্কে বিশ্বাস অতীব প্রয়োজন। তোমার উপর আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে তুমি কখনোই এমন কিছু করবেনা যা দেখে আমি কষ্ট পাবো কিংবা আমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরবে৷ তার থেকেও বড় কথা ভালো মূহুর্তগুলো কাছের মানুষের সাথে ভাগ করে নিলে তা আরো আনন্দঘন হয়।”
” এই না হলে আমার ইশরাপাখি। তুমি এতো বুঝদার বলেই তো আমার তোমাকে এতো ভালো লাগে। এই নাও এবার কেকটা খেয়ে একটু মিষ্টিমুখ করতো দেখি।”
চামচ দিয়ে একে-অপরকে কেক খাইয়ে দিল তারা। এর ফাঁকে সাফাইত দুষ্টমি করে একটু ক্রিম ইশরার নাকে লাগিয়ে দিল। ইশরাও মিথ্যা রেগে যাওয়ার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে নিল৷ সাফাইত রাগ ভাঙানোর চেষ্টায় যখন ব্যস্ত ছিলে ইশরাও সুযোগ বুঝে তার গালে ক্রিম লাগিয়ে দিল৷ তার মুখভাব দেখে হাসি আটকাতে পারল না ইশরা। হাসিতে মগ্ন থাকা প্রেয়শীকে মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগল সাফাইত।
খানিকটা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছে তোহা। দাঁতে দাঁত চেপে ওড়নার একপ্রান্ত খাঁমচে ধরে দু’জনকে দেখে চলেছে সে। তবে এখনোই ফিরে এলোনা। বেশকিছুসময় আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল৷ তাদের এই ভালোবাসার মূহুর্তটা সে নষ্ট করতে চাইনা।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো তিনজন। সাফাইত একটা রিকশা দাঁড় করিয়ে তোহার দিকে ফিরে বলল,
” তোহা তুই বাড়ি চলে যা।”
” তুই যাবি না?”
” যাবো তবে আগে ইশরাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।” তারপর তার কানে ফিসফিস করে বলল, ” বুঝিস না ওকে ছাড়তে আমার দিলে লাগে। সারাদিন ওর সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে।”
সেও হেসে ফিসফিস করে বলল, “ওরে আমার প্রেমিক পুরুষরে। এখন তো তোরই সময়। যা যা একান্তে সময় কথাটা, আমি আর হাড্ডি হব না।”
রিকশা চড়ে বসল সে। ইশরার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল, ” আসি ইশরা। সাবধানে যেও আর এই পাগলটার খেয়াল রেখো৷ রাস্তায় চলাফেরার সময় তার মন আকাশে-বাতাসে থাকে।”
” ইশরে…দিলি তো আমার মানসম্মান ডুবিয়ে৷ মামা এই ফাজিলটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বিদেয় হন। না হলে আরো কী কী বলে আমার ইজ্জতের ফালুদা বানাবে তার ঠিক নেয়।”
হাত নাড়িয়ে দু’জনকে বিদায় জানল তোহা। রিকশা খানিকটা এগিয়ে যেতে সে পেছন ফিরে তাকাল। দূরে দেখা যাচ্ছে সাফাইত যত্ন সহকারে ইশরার হাত ধরে আছে, দু’জনে পা মিলিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। যতক্ষণ দেখা যায় সে তাকিয়ে ছিল, চলতে চলতে একসময় তারা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।
.
.
পড়াশোনা করছিল তোহা, ফোনের শব্দে বিরতি নিল সে। স্ক্রিনে “সাফাইত” নামটা দেখে কিছুসময় সে তাকিয়ে রইল। বেশ কয়েকমাস আগেও এই মানুষটার ফোন পেলে সে সব কাজকর্ম ফেলে ছুটে আসত, এখন সময় পরিবর্তন হয়েছে। এখন কেন যেন তার সাফাইত নামক মানুষটা আশেপাশে থাকলেও দ্বিধা লাগে কথা বলতে।
পুনরায় রিংটোনের শব্দে তোহা ভাবনায় ইতি টানল। গলা পরিষ্কার করে কন্ঠ স্বাভাবিক করল।
” হ্যাঁ সাফু বল।”
” কোথায় ছিলি এতোক্ষণ? কতবার ফোন দিয়েছি।”
” মিথ্যা কথা বলবিনা, মাত্র একবারই দিয়েছিস।” মিথ্যা রাগ দেখিয়ে বলল সে। অপর প্রান্ত হতে সাফাইত হেসে বলল,
” আরে এসব তো কথার কথা। আচ্ছা ওসব রাখ, শোন না তোহারাণী।”
” জ্বি বলুন না সাফাইত সাহেব।” তাকে অনুকরণ করে বলল তোহা।
” তোহারাণী কালকে যাবি তোর পছন্দের বার্গার খেতে?”
” শোন এতো লোভ দেখাতে হবেনা। সোজাসুজি বল কী কাজ আছে?”
পুনরায় সে ছোট বাচ্চাদের মতো হেসে বলল, “বুঝতে পেরে গিয়েছিস।”
” তোকে আমি আজকে দেখছি নাকি? তোর নাড়িনক্ষত্র আমার জানা। এবার বল কী করতে হবে?”
” শোন না তোহারাণী আমার এসাইনমেন্টটা একটু করে দে প্লিজ প্লিজ। পরশু লাস্ট ডেট আমি এখনো কিছু করিনি। প্লিজ বাবু এবারের মতো বাঁচিয়ে দে। এই শেষবার।”
তোহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ব্যস ব্যস বুঝতে পেরে গিয়েছি। তোর এই শেষ বার কথাটা আমি আজ পর্যন্ত বহুবার শুনেছি। গতমাসেও সেম কথাটাই বলেছিলি।”
” আরে এটা তো শেষ বার বলেছি, শেষের শেষবার এখনো বহুদূরে। প্লিজ বাচ্চা করে দে।”
” আচ্ছা দেবো আর বাচ্চাদের মতো কান্না করিস না।”
” থ্যাংক ইউ বাবু। তোকে কাল পাক্কা বার্গার খাওয়াবো।”
” সেটা দেখা যাবে তবে এই বাবু টাবু ডাকবিনা। আমি তোর বাচ্চা নাকি?”
” অবশ্য তুই আমার বড় বাচ্চা৷ আচ্ছা আমি এখন রাখছি, ইশরা ফোন দিচ্ছে। বাই বাই তোহারাণী।”
তোহা বাই বলবে তার আগেই ফোন কেটে গেল। হতাশ নয়নে সে ফোনের দিকে তাকিয়ে ভাবল,
“একসময় আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতাম আর এখন সেসব শুধু স্মৃতি। তুই কি আমার থেকে সত্যি সত্যি দূরে চলে যাচ্ছিস সাফাইত?”
চলবে……