দূর আলাপন ~ ১৮
___________________________
কয়েক জোড়া সতর্ক নজরের জালে সে আজকাল বন্দি সারাক্ষণ। নিনাদের প্রতিটি সঞ্চালন, আক্ষেপ আর অভিব্যক্তিকে খেয়াল করছে যারা। সময়ে সময়ে খাদ্য, যত্ন, স্নেহ দিয়ে শোধ করছে জীবনের কোন অবিদিত উপকারের ঋণ।
ঘুমভেঙে লাফিয়ে উঠে বসে নিনাদ। শূন্য চোখে চারপাশ ফিরে তাকায়। মাত্র কয়েক পল, তারপরই বুঝতে পারে নিজ ঘর নয়, হাজার কিলোমিটার দূরের অচেনা শহরে সে পড়ে আছে অবরুদ্ধ নার্সিং হোমের নির্জন কক্ষে।
বুকের ভেতর বর্ণনাতীত অস্থিরতা। থেকে থেকে মনে হয় এক্ষুনি, ঠিক এই মুহুর্তে দেশে ফেরা প্রয়োজন। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ঝিগাতলার একতলা বাড়িতে, সদর দরজা পেরিয়ে তিতিক্ষার ঘরের সামনে। আর তারপর….
.
‘অনেক শুকিয়ে গেছো। খাওয়া দাওয়া বোধহয় একেবারে কমিয়ে দিয়েছো।’
‘তেমন কিছু নয়।’
‘তেমন কিছু না হলেই ভালো। নিনাদ, তুমি কি জানো কি পরিমাণ বদলে গেছো তুমি?’
শ্রান্ত দুচোখে প্রশ্নের ঝাপতাল নিয়ে তাকিয়ে থাকে নিনাদ।
‘এয়ারপোর্টে যখন তোমায় প্রথম রিসিভ করতে গেছিলাম, তোমার গুরুভার অভিব্যক্তি, সৌম্যতা দেখে অবাক হয়েছিলাম। ঢাবির দুর্দান্ত মেধাবী আর প্রাণোচ্ছল নিনাদ যেন রয়ে গেছে দেশেই। এখানে যে এসেছে সে গভীর, পছন্দ করে নির্জনতা।
তখনো জানতাম না সামনে আরো কত বিস্ময় অপেক্ষা করছে। হাসনাতের কাছে শুনেছি ওহিওতে শিফট হবার পর থেকে ও তোমায় অন্যরূপে দেখছে। দূরের মসজিদে সময়মতো নামাযে যাওয়া, গান, মুভি সহ যাবতীয় স্থুল বিনোদন কে পরিহার করা আর সবচেয়ে বড় বিস্ময় মেয়েদের কে সর্বাত্বক ভাবে এড়িয়ে চলা।
অথচ ক্যাম্পাসে তুমি অন্যরকম ছিলে। আমাদের জুনিয়র তবু বাতাসে তোমারই মেয়েবাজির ভেসে বেড়ানো গল্প শুনে হতবাক হতাম। আর আড়ালে ঈর্ষা করতাম তোমার ভাগ্যকে। কোন মোহমন্ত্রে সব মেয়েদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলে জানতে ভীষণ ইচ্ছে করতো।’
শেষ কথাটা বলে তাওহীদ স্পষ্ট তাকায় নিনাদের চোখে। অস্বস্তি ঢাকতে নিনাদ মাথা নত করে। ছেলেটার কালোর কাছঘেঁষা গায়ের রঙ ওহিওর বিশুদ্ধ জল হাওয়া লেগে যেন কিঞ্চিৎ পরিষ্কার হয়েছে। মুখে ঘন দাড়ি, অযত্নে বেড়ে ওঠা মাথার একরাশ ঝাকড়া চুল আর ঘন পল্লবিত চোখের গাঢ় শ্যামলা ছেলেটাকে আজ আবার নতুন করে ঈর্ষা হলো তাওহিদের। অনেকক্ষণ নিনাদের দিকে তাকিয়ে থেকে আভাসে হেসে বলল,’নিনাদ, তোমার এই বিরহ যদি কারো উপেক্ষার কারণে হয় তবে দিস ইজ হাই টাইম টু গো ব্যাক টু হার। আমি বাজি ধরে বলতে পারি তোমার এই মূর্তি দেখলে সে যত পাষাণই হোক ফেরাতে পারবে না।’
তেমনি নিরবচ্ছিন্ন গম্ভীরতার চাদরে নিজেকে জড়িয়ে রাখলো নিনাদ। একসময় নৈঃশব্দ্য ভেঙে বলল,’ভাইয়া আপনি যেমন ভাবছেন তেমন কিছু নয় আসলে। আমার এক কাছের মানুষের পরিবারে কিছু বড় বিপর্যয় ঘটে গেছে। খবরটা আমি জেনেছি অনেক পরে। এই সময় আমার ওদের পাশে থাকা প্রয়োজন।’
‘কবে নাগাদ ফেরার কথা ভাবছো?’
‘যত শীঘ্র সম্ভব।’
——————–
রোজ হাসনাতকে কল করে নিনাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতো তিহা আর রওশান। একটা সময় হাসনাত ছেলেটা নিশ্চিত করলো নিনাদ এখন অনেকটা সুস্থ। তবে তিহা কিংবা রওশানের সঙ্গে কথা বলতে প্রস্তুত নয়। যাক তার পরও ছেলেটা ভালো থাক। তিহার ছন্নছাড়া জীবনে আবারো স্বস্তি নেমে আসে। কটা দিন বড় এলোমেলো কেটেছে। এসবের প্রেক্ষিতে ভালো করে নজর দেয়া হয়নি তিতিক্ষার দিকে। এই অন্ধিসন্ধির চোরাপথ ধরে আজকাল আবারো নিজের মধ্যে গুম হতে শুরু করেছে তিতিক্ষা। তিহা সংসার গোছায়, রান্না দেখে, ছুটোছুটি করে ছেলেকে নিয়ে আর বাকি সময় ডুবে থাকে বিষাদে। অন্যদিকে একা ঘরে তিতিক্ষা নিজের অন্ধকার জগতে হয়ে থাকে আবিষ্টমান।
‘কি করছিস?’
হাতে থাকা বইটার দিকে দৃষ্টি ভিড়ালো তিতিক্ষা, ‘পড়ার চেষ্টা করছি।’
‘প্রচ্ছদটা তো বেশ সুন্দর। মরুভূমির গায়ে এঁকেবেঁকে চলা খেজুর গাছ বিছানো পথ। ‘নবীজির পাঠশালা’ নাম দেখে তো মনে হচ্ছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী গ্রন্থ।’
‘ঠিক জীবনী নয়। তবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বর্ণিত কিছু শিক্ষনীয় ঘটনা আকর্ষণীয় ঢঙে লেখা। আমার খুব প্রিয় বই।’
‘কত বই পড়িস তুই! আমাকে একটা বই দিবি?’
বোনের আদ্র স্বরে অবাক চোখে ফিরে তাকায় তিতিক্ষা
‘তুমি পড়বে বুবু?’
‘হ্যাঁ… দেখি চেষ্টা করে… যদি কিছু জ্ঞানগম্যি জন্মায়…’
‘দাঁড়াও এক্ষুনি দিচ্ছি।’ প্রবল উৎসাহে বইয়ের তাকে তিতিক্ষা ঝুঁকে পড়ল। অদূরে দাঁড়িয়ে বোনের ঔৎসুক্য দেখছিল তিহা।
‘এই নাও বুবু। এটা দিয়েই শুরু করো। বেশ সাবলীল ভাষায় লেখা। পড়ে আরাম বোধ করবে।’
কথা বলতে বলতে একঝলক হাসির বিচ্ছুরণ কি সত্যিই খেলে গেছিলো তিতিক্ষার মুখ জুড়ে? নাকি ভুল দেখেছে তিহা? কাল সন্ধ্যায় এই মেয়েটাই চেয়ার উলটে ফেলেছিল। একটা গ্লাস ছুড়ে মেরেছিল দেয়ালে। এইবার অবশ্য নিজেকে আঘাত করার পরিস্থিতিতে যায়নি, তার আগেই বোনকে থামিয়ে ফেলেছিল তিহা।
সেই মেয়েটাই কিনা আজ এত শান্ত সুস্থির হয়ে হেসে হেসে কথা বলছে! বিশ্বাস হয়?
.
‘বেলা ফুড়াবার আগে’ বইটা নিয়ে তিহা নিজ ঘরে ফিরে এলো। ছোটন তার নানা ভাইয়ের সঙ্গে উঠোনে খেলছে। আকবরের মা রাতের জন্য তরকারি কুটছেন রান্নাঘরে। বই নিয়ে বিছানায় পা মুড়ে বসলো তিহা। শেষ বিকেল, অল্প কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আযান দেবে। ততক্ষণ পর্যন্ত বইটা পড়া যাক।
তিতিক্ষা অনেকক্ষণ ছোটনকে দেখছে না। স্কুল থেকে ফেরার পর শেষ দেখা হয়েছিল। তারপর বাচ্চাটা গোসল খাওয়া সেরে মায়ের কাছে ঘুমিয়ে পড়ল। বিকেলে যখন এঘরে ঢু দিল তিতিক্ষা তখন আসরের সলাতে।
বাচ্চাটাকে একঝলক দেখার জন্য বইয়ের ভাঁজে বুকমার্ক রেখে সে বেরিয়ে আসে আপনার ঘর ছেড়ে। কিছুক্ষণ আগেও উঠোনে নানা নাতির হুটোপুটির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। মৃদু পায়ে সদর দরজার দিকে হেটে যায় তিতিক্ষা। মুখে একটু চোরা হাসি। দরজা খুলতেই হয়তো ছোটন খেলা ফেলে ছুটে এসে মিমিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরবে। আর তখন হাটু ভেঙে বসে বাচ্চাটাকে আষ্টেপৃষ্টে নিজের সঙ্গে চেপে কপালে চুমু খাবে তিতিক্ষা।
দুরন্ত ইচ্ছেটা বুকে নিয়ে সে নব ঘোরায়। বিকেলের শেষ আলো ওদের গোটা বাড়িকে কমলা রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। একদিকে গাঢ় আলো অন্যদিকে সন্ধ্যার আগমনী অন্ধকার। দিন ও রাতের এই ক্রান্তিলগ্ন দিব্য মাধুর্যের চাদরে ঘেরা। দরজা খুলতেই বিকেল শেষের রাঙা আলোর প্রথম ছঁটা তিতিক্ষার সারা গায়ে মেখে গেল। ধাঁধা লাগে চোখে। এবাড়িতে কোনো গাইরে মাহরাম নেই জেনেও উঠোনে নামার আগে অভ্যেসের বসে মাথার ওড়নাটা আরও একটু ভালো করে মুখের চারপাশে টেনে দেয় তিতিক্ষা। প্রকট আলোর শেষ ছঁটা বিচ্ছুরণ করতে থাকে ওর সারা মুখ জুড়ে। তিতিক্ষা ভালো করে তাকাতে পারে না প্রথম কয়েক মুহুর্ত। কতদিন… কতদিন পর ঘরের বাইরে পা রেখেছে আজ…
আলোর নিচে চোখকে অভ্যস্ত করতে করতে অস্ফুটে হাঁক ছাড়লো তিতিক্ষা, ‘ছোটন….’
উত্তর এলো না উঠোন থেকে।
‘ছোটন… ছোটবাবা কোথায় তুমি?’
বলতে বলতে সাবধানে সিড়িতে পা ফেলে ক্রমে নেমে এলো উঠোনে।
কোথাও কেউ নেই। শূন্য উঠোন খাঁ খাঁ করছে। বোধহয় বাবা ছোটনকে লজেন্স কিনে দিতে মোড়ের দোকানে নিয়ে গেছে। ব্যাপার টাতে ধাতস্থ হতে না হতেই তিতিক্ষা শোনে উঠোনের ওপাড়ে লোহার গেটের হাতল ঘোরানোর শব্দ। সন্দেহাতীত ভাবে ছোটন ফিরে এসেছে।
অনেক গুলো দিন পেরিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখার উচ্ছ্বাসে তিতিক্ষা তখনো সুখের পলকা স্রোতে ভাসমান। ওড়নাটা সাবধানে সারা গায়ের ওপর ভালো করে টেনে এগিয়ে গেল লোহার গেটের দিকে। আজ দরজার এপাশে থেকে নানা নাতিকে বিভীষণ চমকে দিয়ে দেখবে ওদের মুখের অবস্থাটা কিরূপ হয়!
অস্বাভাবিক স্থিরতার সঙ্গে দরজার হাতল ঘুরল। ওপাশে কোনো আওয়াজ নেই। বাবার কোলে থাকা ছোটন আজ এতো শান্ত হলো কি করে। আশ্চর্য তো!
খুলে গেল দরজা।
আবছায়া গাম্ভীর্যের আড়ালে দুর্বোধ্য হাসিটাকে সযত্নে সংগোপন করে তাকায় তিতিক্ষা। আর সঙ্গে সঙ্গে স্থানুবৎ হয়ে যায়। মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত অতীতের যে স্মৃতি, মুহুর্তে তা ওর চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। ভেতরের নাকাল হৃদয়ে হঠাৎ যেন ঘটে দুরূহ আস্ফালন। জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে তিরতির করে কাঁপতে শুরু করে তিতিক্ষা। দরজার ওপাশের লোকটা তিতিক্ষার মাহরাম কেউ নয়। তবু সে ভুলে যায় মুখ ঢাকতে কিংবা সরে যেতে। সম্মুখের দৃশ্যপট ক্রমে ঝাপসা হতে থাকে। অতীত বর্তমানের সীমারেখা ভুলে তিতিক্ষা বিস্মৃতির জালে আটকে যায়।
ওপাশের মানুষটার কণ্ঠে সকাতর আহ্বান, ‘তিতিক্ষা….’
মুখের ওপর দরাম করে বন্ধ হয়ে গেল লোহার দরজা। দরজার অন্যপারে কারো ত্রস্ত পায়ে ছুটে পালানোর সংকেত। নিনাদ স্তব্ধ, স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ।
চলবে…..
দূর আলাপন ~ ১৯
____________________________
পাশের ঘরের দরজাটা হঠাৎ দারুণ শব্দে বন্ধ হয়ে যেতে সম্বিৎ ফেরে তিহার। পড়া থামিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
‘শব্দ কিসের খালা?’
‘ছোট আপু একটু আগে বাইরে গেছিলো। হঠাৎ ফিরা আইসা দরজায় খিল দিলো।’
‘তিতি একা গেছিল বাইরে?
‘হ’
দৃষ্টি বা দিকে ঘোরাতেই দেখা গেল সদর দরজা তখনো হাট করে খোলা। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে তিহা। আর কোনো প্রশ্ন না তুলে ছুটে যায় বোনের ঘরের দিকে।
‘তিতি, দরজা বন্ধ করেছিস কেন? খোল, এই তিতি।’
ওপাশ নিরুত্তর। তিতিক্ষা কি ভাঙচুর করছে ভেতরে? নাকি নিজের কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করছে? বুকে অসহনীয় অস্থিরতা নিয়ে তিহা কান পাতে দরজায়। একটা ভোঁতা গোমরানো আওয়াজ দূর থেকে ভেসে আসে। সঙ্গে সঙ্গে তিহার ভেতরটা মুচড়ে ওঠে আতঙ্কে। এই ভর সন্ধ্যায়, একা বাসায় কি করবে সে? দরজায় হাত রেখে তিহা স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ভেতর থেকে নানান রকম আওয়াজ আসছে। কান্না, গোঙরান… সবই তিহার পূর্ব পরিচিত।
একসময় উৎকীর্ণ হয়ে শোনে মসজিদে আযান পড়ছে। তিহা কি করবে ভেবে পায় না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি ঘরে ফিরে সলাত শুরু করবে? মারুফ তখনো ফেরেননি। ছোটনকে নিয়ে বাবাই বা গেলেন কোথায়?
ভীষণ অসহায় লাগছিল তিহার। হঠাৎ মনে পড়ে তিতিক্ষার বলা একটা কথা। অনেক দিন আগে ও বলেছিল আযানের পরবর্তী সময়ের দুআ কবুল হয়। ঝুম সন্ধ্যায় অন্ধকার করিডরে একা দাঁড়িয়ে রবের কাছে দু হাত তুললো তিহা,
‘ইয়া আল্লাহ, আরহামুর রহিমীন। আপনি সব কিছু সহজ করে দিন। আমার বোন যেন নিজের কোনো ক্ষতি না করে বসে। আপনার বান্দাদের যাবতীয় কষ্টে আপনিই তো একমাত্র সহায়। আমাদেরকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করুন, ইহকালীন সমস্ত পরীক্ষায় আমাদের জয়ী হবার তাওফিক দান করুন আর উত্তম ভাবে ক্ষমা করুন। আমিন।’
দুআ শেষ করে বোনকে সে অবস্থায় রেখে তিহা ফিরে যেতে শুরু করল নিজের ঘরে সলাত আদায়ের জন্য। হঠাৎ এতো মনের জোর কি করে পেলো তিহা জানে না। শুধু মনে হচ্ছিল সলাত টা যাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদিত, তিনিই তো বোনকে দেখবেন। সামান্য বান্দা হয়ে সে আর কিইবা করতে পারে? তবে কেন এত অধীরতা? আল্লাহ চাইলে পরিস্থিতি আপনাতেই সহজ হয়ে আসবে।
.
বাড়ির পরিবেশ থমথমে। নাতিকে নিয়ে মসজিদ থেকে ফিরে মারুফ সোফায় চিন্তিত মুখে বসে আছেন। সামনে পড়ে আছে দুখানা খবরের কাগজ আর এককাপ গরম চা। ছুঁয়ে দেখার আগ্রহটুকু সঞ্চয় করে উঠতে পারছেন না। বিকেলে ছোটনকে নিয়ে মোড়ের দোকানে গেছিলেন। তারপর পাড়ার দু একজনের সঙ্গে খোশগল্পে সময় বয়ে গেল। একসময় খেয়াল হলো মাগরিবের ওয়াক্ত হতে আর বেশি বাকি নেই। বাড়ি ফিরে নাতিকে রেখে আসতে গেলে জামাতটা সময়মতো ধরা দায় হয়ে পড়ে। অগত্যা না ফিরে নাতিসহ মসজিদে যাবার সিদ্ধান নিলেন।
সন্ধ্যার পর যখন বাড়ি ফিরলেন, তিহা তখনো সলাতে। বসার ঘরে ফেরার পথে ছোট মেয়ের ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন মারুফ। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। দৃশ্যটা মারুফের জন্য আশঙ্কাজনক। মারুফ ঘামতে লাগলেন। শ্বাসপ্রশ্বাস অত্যধিক দ্রুত। এর মধ্যেই প্রেসার বাড়ল কিনা কে জানে। দরজা বন্ধের ব্যাপারে তিতিক্ষার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবুও কয়েকবার সেসব অমান্য করে বন্ধ দরজার ওপাশে পাগলামো করেছে সে। আজও কি তেমনি কিছু….
.
তিহার হৃদয়ে অবিদিত আনন্দধারা কলকল শব্দ বয়ে যাচ্ছে। দুআ কবুলের মুহুর্তরা বুঝি এমনি সুন্দর হয়! হয়তো এটাই প্রথম, যখন পরিবারের কারো হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজের অসুস্থতাকে লড়াইয়ে পরাভূত করতে পেরেছে তিতিক্ষা। কিঞ্চিৎ সময় ইতস্তত শেষে খোলা দরজা পেরিয়ে তিহা ভেতরে আসে। না, ঘরের কোথাও কোনো অসঙ্গতি নেই, নেই কোনো ঝড়ের চিহ্ন। তবে কি তিতিক্ষার কিছু হয়নি? বুঝি এমনিতেই দরজা বন্ধ করে বসেছিল এতক্ষণ! আর তিহা কি না কি ভেবে বসে আছে….
স্বস্তি পেতে গিয়েও তড়াক করে চিন্তাটা তিহার মাথায় ফিরে আসে। আচ্ছা, তিতিক্ষা গেছে কোথায়? ঘর তো পূর্বাবস্থাতেই রয়েছে কিন্তু তিতি… ও কেন ঘরে নেই?
ঘর, বাথরুম সব খুঁজে দেখল তিহা। তিতিক্ষা কোথাও নেই। বারান্দার কথাটা শুরুতে ওর মাথায় খেললো না। তিতিক্ষার ঘরের বারান্দাটা ঠিক ভালো জায়গায় নয়। গ্রীলের ওপাশে বিশাল পতিত ভূমি। জানা অজানা গাছ গাছড়ায় ভরপুর জায়গাটা। সন্ধ্যার পর পারতপক্ষে ওদিকটায় কেউ যায় না। এই রাতের বেলা তিতিক্ষা কেন ওই অন্ধকার বারান্দায় যাবে?
ভাবতে ভাবতেও তিহা পা বাড়ায় সেদিকে। তখনো ওর একহাত নিজের হাতের মুঠোয় আগলে রেখেছে ছোটন। তিহা অন্যহাতে ঠেলে খুললো বারান্দার ভিড়ানো দরজা।
ছোটন মুখ ভার করে নানা ভাইয়ের পাশের সোফায় গিয়ে বসল।
মারুফ মাথা তুলে নাতিকে দেখলেন,’কি হলো নানাভাই? মন খারাপ করেছো কেন?’
‘মিমি খুব কাঁদছিল। আমি কাছে যেতে চাইলাম তাই আম্মু আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে।’
‘মিমি কাঁদছিল! কেন কাঁদছিল নানাভাই?’
ছোটন সেভাবেই উত্তর দিল, এতকাল যেভাবে সে শুনে এসেছে,’মিমির কত কষ্ট তুমি জানো না? মিমি তো কাঁদবেই!’
.
বিহ্বলতা কাটিয়ে বোনের পাশে বারান্দার শীতল মেঝেতে বসে পড়ে তিহা। দরজার ফাঁক গলে আসা আবছায়া সাদা আলোয় দেখে কাছে বসা বোনটা কেমন দূরের মানুষ হয়ে একা একা কেঁদে যাচ্ছে।
‘এই তিতি, কি হলো তোর?’ তিহার গলার স্বরে বেজে ওঠে পলকা আতঙ্কজড়িত আহ্বান।
তিতিক্ষার ক্লান্ত ভেজা চোখজোড়া স্থির হয়। ওর কপালে হাত রেখে তিহা টের পায় দুদিনের পুরনো জ্বরটা রাক্ষুসে উত্তাপে আবারো বোনের গায়ে উপবিষ্ট হয়েছে। আপনাতে তিহার মায়াভরা হাতের ছোঁয়া বোনের সিক্ত গালে নেমে আসে। উষ্ণ অশ্রুর রেখা মুছে দিয়ে তিহা ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে, ‘কি হয়েছে? একা একা আর কত এই কষ্টের বোঝা বয়ে বেড়াবি? আপুকে বল, আয় কাছে আয়।’
তিহা হাত বাড়িয়ে দিল বোনের দিকে।
বাচ্চা মেয়ের মতো হামাগুড়ি দিয়ে কাছে এসে বোনের কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়ল তিতিক্ষা। বৃষ্টি বাদলার মরশুম। ঘরের মালকিনের অন্যমনস্কতার দরুন বারান্দায় জমে থাকা বৃষ্টির জল সরানো হয়না। বারান্দার এককোণায় জমে আছে বৃষ্টির জল। তিহার শুষ্ক পরিপাটি শাড়ির আঁচল ভিজছিল নোংরা জলে। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই।
বোনের মাথায় স্নেহভরে হাত রেখে পুনরায় বলল, ‘কি হয়েছে রে আপু?’
‘কিছু না বুবু। আমার ভেতরে কেন যে এত কষ্ট হয়… এই বর্ণনাতীত কষ্টের শেষ কোথায় বলতে পারো? আজকাল আম্মার কথা খুব মনে পড়ে। আম্মা থাকলে এসব হতো না। তাই না?’
তিহা নিরুত্তর থাকে। কাঁদতে ইচ্ছে করে তারও।
অন্ধকারে তার কোলে মাথা রেখে নিস্তেজ গলায় তিতিক্ষা আবারো কিছু বিরবির করে, ‘ছোটবেলায় দেখতাম বন্ধুরা কেউ ব্যথায় কষ্ট পেলে ওদের মায়েরা সূরা পড়ে পানিতে ফু দিয়ে বাচ্চাদের খাওয়াতো। রাগের সময় মারতো কিন্তু একটু পরেই কাছে টেনে সন্তানের মুখ চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিতো।
দূর থেকে দেখে আমি হাসতাম। ভাবতাম কিসব পাগলাটে স্বভাব থাকে মায়েদের! অথচ আজ বড় আফসোস হয় ভেবে যে আমার শৈশবে এমন কোনো পাগলাটে স্মৃতি নেই। ইচ্ছে করে আম্মা যেখানে আছে সব ফেলে সেখানে ছুটে যাই। কিন্তু মৃত দের কাছে যাবার সবচেয়ে বড় বাঁধাই যে বেঁচে থাকা। আজকাল বেঁচে থাকতেও…’
‘চুপ কর আপু। তোর না কত ধৈর্য? এতকাল সব সইতে পেরেছিস তবে আজ কেন অকারণে এত ভেঙে পড়ছিস?’
‘অকারণ ভেঙে পড়ছি? হ্যাঁ ভেঙেই পড়ছি হয়তো। বিষের মতো অতীত সামনে এলে ভাঙতেই হয়। ছাড়ো এসব.. আমার কষ্ট শুধু আমারই। তোমরা কেউ বুঝবে না কখনো।’ বোনের স্নেহাতুর বন্ধন ছাড়িয়ে উঠে চলে গেল তিতিক্ষা। তিহা শুনলো বাথরুমের দরজা বন্ধ হবার শব্দ। ভেতর থেকে অনবরত জলের ঝাপটার আওয়াজ আসছে। এই রাতের বেলা গায়ে মাথায় পানি ঢালছে নাকি মেয়েটা?
‘আম্মু তোমার ফোন…’
পাশের ঘর থেকে ছেলের ডাক ভেসে আসে। নিশ্বাস ফেলে সেদিকে পা বাড়ায় তিহা।
‘আম্মু দেখো দেখো, কে যেন ফোনের ওপাশে কাঁদছে।’
শূন্য দৃষ্টিতে ছেলের মুখে তিহা তাকিয়ে রয়। আবার কান্না! তিহার চারপাশের জগতে মানুষের বুঝি কান্না ছাড়া কিছু নেই…
‘হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?’
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপু আমি আফরিন।’
‘আফরিন! সব ঠিক আছে তো? ছোটন বলল কে নাকি কাঁদছিল.. ‘
‘চাচি আম্মার কথা কইসে আপু। উনিই প্রথমে কল দিসিলেন। কানতে কানতে আবোলতাবোল বকতাসেন তাই আমি ফোন নিসি।’
‘ফুআম্মা কাঁদছেন! কিন্তু কেন?’
‘মেলা কাহিনি গো আপু। আপনি পারলে একবার এহনি বাসায় আসেন। চাচিআম্মা তো কানতে কানতেই বেহুশ। আমি একলা কেমনে এসব সামলাই। এদিকে উনিও আজই দেশের বাড়িতে গেলেন। আসবেন না আপু?’
তিহা বুঝলো উনি বলতে আফরিন মিনহাজকে বোঝাচ্ছে। কিন্তু এদের ব্যাপার টা কি এখনো জানা গেল না। মেয়েটা সব বলেছে শুধু আসল কথাটা ছাড়া।
‘কিন্তু আফরিন হয়েছে কি বলবে তো?’
‘কি যে কই! আমার নিজের মাথাই আউলায়া গেছে এসব দেইখা।
সন্ধ্যার পরে হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ শুইনা দোর খুইলা দেখি নিনাদ ভাই! আমসি মুখ, হাতে ব্যান্ডেজ। কারো দিকে স্পষ্ট কইরা তাকায় না, হাসে না। ফ্রেশ হওয়ার জন্য ঘরে গিয়া দোরে খিল দিলো। তারপর অনেক ডাকাডাকিতেও এহনো খোলে নাই।
নিনাদ ভাইয়ের ভাবভঙ্গি ভালো না আপু। আজই যে দেশে ফিরব সেই কথাটাও আমরা জানতাম না। চাচিআম্মা চিন্তায় অস্থির। আপনি পারলে একবার আসেন আপু।’
‘আ.. আমি!’ তিহা দ্রুত ভাবছে। বোনকে এই অবস্থায় একা ফেলে যায় কি করে? অথচ ওখানেও তাকে প্রয়োজন। ফুআম্মা তো জানে না নিনাদের এই হালত হবার কারণ কি। কিন্তু আফরিন যে ব্যান্ডেজের কথা বলল। কই, হাসনাত তো আগে এই কথা বলেনি!
আর কত বিস্ময় অপেক্ষা করছে তিহার জন্য?
.
‘মিমির বাধ্য হয়ে থাকবে। আমি জলদি ফিরে আসবো।’ তিহা ছেলের কপালে চুমু খেল। ‘আমরা বেরোচ্ছি। দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে মিমির কাছে গিয়ে বসো। কেমন?’
মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করল ছোটন। দরজার নব ঠিকঠাক ঘুরিয়ে গুটিগুটি পায়ে চলে এলো তিতিক্ষার ঘরে। মিমির বিছানা তথা পালঙ্কটি বেশ একটু উচুতে হওয়ায় ওকে উঠতে খানিকটা কসরত করতে হলো। ততক্ষণে তিতিক্ষা এমুখে ফিরে বসেছে। ভাগ্নেকে আলতো হাতে টেনে বিছানায় তুলে নিল। আদুরে বেড়ালছানার মতো মিমির গা ঘেঁষে বসে পড়ল ছোটন। বুকে দুরুদুরু ভয়। ভয়টা মিমির গম্ভীর মুখকে।
‘তোমার মা কোথায় গেছে ছোটবাবা?’
ছোটন অবাক হয়ে তাকায়, ‘কেন মিমি? যাবার আগে আম্মু তোমায় বলেনি?’
‘না তো!’
কিঞ্চিৎ ক্ষণ ইতস্তত করে ছোটন। একসময় বলে, ‘একজন খুব অসুস্থ। তাকে দেখতে গেছে। ‘
‘কে অসুস্থ ছোটন?’
‘সেটা তো আম্মু বলেনি। কিন্তু….. আমি জানি!’
জ্বরটা ক্রমে বাড়ছিল। গালের নিচে হাত রেখে আস্তে আস্তে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় তিতিক্ষা ‘জানো?’
‘হ্যাঁ। আমি বলতে পারি কিন্তু তুমি আর কাউকে বলবে না তো?’
‘না ছোটবাবা।’
‘নিনাদ মামার খুব অসুখ। ওর ফুপ্পি ফোন করে কান্না করছিল। আমি শুনে ফেলেছি!’
ছোটন দেখল তার মিমির মুখটা হঠাৎ করেই কৌতুহল শূন্য হয়ে গেছে। ক্লান্ত উদাস চোখে তাকিয়ে আছে সামনে।
‘তোমার কি খারাপ লাগছে মিমি?’
‘না আব্বু।’
‘জানো মিমি আজ বিকেলে নানাভাইয়ের সঙ্গে মোড়ের দোকানে যাবার সময় আমি নিনাদ মামাকে দেখেছি। আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। নানাকে বললাম নানা কিছুতেই বিশ্বাস করলো না। বললো মামা নাকি অনেক দূরে, আ মেরিকায়। কিন্তু এখন তো সবাই দেখছে মামা এখানে। তারমানে আমি সত্যি দেখেছি। তাই না বলো?’
তিতিক্ষা নিরুত্তর।
‘আচ্ছা মিমি, তুমিও কি দেখেছিলে? আম্মু বলেছে বিকেলে আমায় খুঁজতে তুমিও উঠোনে গেছিলে।’
‘কথা বোলো না বাবা। খেলনা দিয়ে খেলো।’
‘তাহলে তুমি কি করবে মিমি? ঘুমোবে? তবে তো একা একা আমার খুব ভয় করবে।’ শিশুটির মুখে সত্যিকারের আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। তিতিক্ষা একদৃষ্টে কিছুক্ষণ দেখে ওকে। বুবু একটা ব্যস্ত থাকার সরঞ্জাম রেখে গেছে। এই ছোট প্রাণের কাছাকাছি থেকে চাইলেও নিজের নিভৃত জগতে একক বিচরণ সম্ভব নয়। তারচেয়ে ওর মনের ভয়কে জয় করার প্রয়াস চালানো যাক। ছোট করে নিশ্বাস ফেলে দুহাত বাড়িয়ে দেয় তিতিক্ষা, ‘মিমির কাছে এসো শোও আব্বু। তোমায় রূপকথার গল্প শোনাব আজ।’
চলবে…..