দূর আলাপন ~ ১২
___________________________
ঘরময় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। এককোণে উলটে পড়ে আছে কাঠের চেয়ার। ভাঙা কাঁচের গ্লাসের টুকরো সারাঘরে ছড়ানো। আয়নায় ভাসমান এক অপ্রকৃতস্থ মানবীর প্রতিবিম্ব। হাপরের মতো যে নিশ্বাস ফেলছে, উত্তেজনায় তিরতির কাঁপছে। হঠাৎ তার নজর পড়ে আয়নাতে। ক্ষণকাল স্থির চোখে চেয়ে দেখে নিজের রুক্ষ বিধ্বস্ত মূর্তি। দুচোখে যার অগাধ ধোঁয়াশার ঢেউ।
আয়নাতে কে ও? ছিঃ কি বাজে দেখতে! শনের মতো চুল লেপ্টে আছে গালে, মুখে অসংখ্য ক্ষতের চিহ্ন, চোখ দুটিতে অবিরল ঝরছে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আর ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা। সহ্য হয়না। ক্রমে ক্রমে ওর নিশ্বাসের গতি বাড়ে, শিরায় শিরায় কিলবিলে পোকারা বসায় মরণ কামড়। সইতে না পেরে দুহাতে মাথা চেপে ধরে সে। আতিপাতি করে খুঁজে হাতের কাছে একটা ফুলদানি পেয়ে যায়। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ফুলদানিটা ছোড়ে আয়নার দিকে। ঝনঝন শব্দে পাহাড়ি ঝর্ণার মতো ভূতলে লুটিয়ে পড়ে টুকরো টুকরো কাঁচ।
শব্দটা ভালো লাগে। অস্থির মস্তিষ্কে প্রশান্তির ফল্গুধারা বইয়ে দেয়। কিন্তু এতে কিছু হবে না।
তার আরো শান্তি দরকার। আরো আরো…
দরজার বাইরে থেকে স্থানুর মতো দৃশ্যটা দেখছিল ছোটন। কি হচ্ছে এসব? এ কি প্রলয়?ওই ডাকিনী পিশাচীনি কি এবার ওর ঘাড়টাও মট করে ভেঙে রক্ত চুষে খাবে? ছোট্ট শরীর থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। সারা গায়ে খিল ধরে যায় ভয়ে। নিজের ঘর ছেড়ে দৌড়ে আসে তিহা। ছোটনকে বোনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে। মুহুর্তকাল বিলম্ব না করে ছেলেকে কোলে নিয়ে সরে যায় দরজা থেকে। নিজের ঘরে গিয়ে বাচ্চাকে নামিয়ে রেখে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বাইরে থেকে খিল তুলে দেয়। ছুটে এসে ঢোকে বোনের ঘরে।
তিতিক্ষা তখন মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে। সারা দেহ এলিয়ে ঢলে আছে বিছানার গায়ে। অনেক ভাঙচুর আর ক্রুদ্ধ আস্ফালনের পর ওর চোখের দৃষ্টি এখন নরম, যদিও মুখের পেশির শক্তাভাব আর দাঁতে দাঁত ঘষে চলাটা তখনো থামেনি।
তবু আর ভয় নেই, জানে তিহা। দৌড়ে বোনের কাছে ছুটে যায়। উবু হয়ে বসে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বোনকে। কান্নার প্রকোপে কথা জড়িয়ে আসে, বাষ্পরুদ্ধ গলায় তিহা থেমে থেমে বলে,
‘কি.. করে.. ছিস.. তুই? কি.. করেছিস..এসব? নিজেকে কেউ এভাবে মারে? কষ্ট দেয়?’ বলতে বলতে নিজের ওড়না দিয়ে মুছে দিতে থাকে বোনের গাল।
‘কি হয়েছে আমার আপু? কেন এমন করেছিস বলতো?’
তিতিক্ষা তখনো হাঁপাচ্ছে। চিৎকার করে করে গলা ভেঙেছে। ব্যগ্র ভাঙা গলায় বলে,’আমি কিছু করতে চাইনি বিশ্বাস করো। কিন্তু ওরা…. ওরা… বাজে কথা বলছিল আমাকে।’ হু হু করে কাঁদতে থাকে তিতিক্ষা।
‘আমাকে বলে কিনা নষ্টা মেয়ে। জানো বুবু, ওদের কত করে বললাম কিছু করি নি আমি। আমার কোন দোষ নেই। তবু ওরা কেউ আমার কথা বুঝতে চাইল না….
এসব শুনলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। তখন… নিজেকে আর সামলাতে পারি না। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তাই না বুবু? পাগলরা এমন করে। এবার আমাকেও তোমরা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবে। না?’
কাঁদতে কাঁদতে তিহা থমকে যায়। পাখির ছানার মতো চারপাশ থেকে বোনকে আগলে ধরে বলে,’ এইসব বাজে কথা কে বলেছে তোকে? তুই আমাদের বাড়ির প্রাণ। তোর সাথে আমরা অমন করবো ভাবলি কি করে? ‘
‘কিন্তু আ.. আ.. মি যে পাগল। পাগলকে কি কেউ ভরসা করে? বিশ্বাস করো, আমি এমন করতে চাইনি। কিন্তু… কিন্তু… ওই আওয়াজ টা… সবাই মিলে ওরা যখন আমাকে বে….’
‘চুপ… চুপ….কেউ কিছু বলেনি তোকে। কান খাড়া করে শুনে দেখ…
আর তুই কেমন তা তুই নিজে জানিস না? কেউ কেন তোকে শুধুশুধু বাজে কথা বলবে? ভুল শুনেছিস… সবটা ভুল…’
বোনের যুক্তিনির্ভর কথা বোঝার মতো মানসিক অবস্থা তিতিক্ষার নয়। কিছু শুনছে, কিছু শুনছে না। নিজের মনে বলে চলেছে আপনার কথা…..
‘ওরা খুব কষ্ট দেয় আমায়। দেখো, একদিন আমি ঠিক মে রে ফেলব ওদের। সবাই আমার শত্রু। সবাইকে মে রে ফেলব আমি।’
বলতে বলতে আবারো উচ্চগ্রামে চড়ে তিতিক্ষার স্বর। তিহা কিছু বোঝবার আগে দুহাতে নিজের চুল খা ম ছে ধরে তিতিক্ষা। ওকে থামাতে গিয়ে তিহা নিজেও অল্পবিস্তর আহত হয়। কিন্তু এই আসুরিক শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠে কার সাধ্য?
ক্লান্ত তিতিক্ষা হার মেনে একসময় ঢলে পড়ে বোনের গায়ে। অনতিবিলম্নে চেতন হারায়। শান্ত নরম ঘুমন্ত একটা মুখ। কে বলবে এই নরম মুখের মায়াবী তরুণী খানিক আগে ধ্বংসযোজ্ঞ চালিয়েছে এই ঘরে!
তিতিক্ষার দুচোখের পাতায় চেপে বসেছে কালঘুম। যে ঘুমের জন্যই অপেক্ষা ছিল তিহার। বোনের ঘুম এবার সহজে ভাঙবে না। পাগলামির কিছুক্ষনের ভেতর ও ঘুমিয়ে পড়ে সবসময়। তিহা গলা ছেড়ে আকবরের মাকে ঘর পরিষ্কার করতে ডাকল। বৃদ্ধা মৃদু সংশয় নিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন।
‘ভয় নেই। ও ঘুমোচ্ছে। আমাকে একটু সাহায্য করুন ওকে ওপরে ওঠাতে।’
দুজন মিলে তিতিক্ষাকে তুলে বিছানায় শোয়ালো। এবাড়িতে মাস পাঁচেক হলো কাজে রাখা হয়েছে আকবরের মাকে। তিতিক্ষার সেবাযত্ন আর সংসারের সমস্ত কাজ একা কুলিয়ে উঠতে পারছিল না তিহা।
আকবরের মায়ের ষাটের ওপর বয়েস। গায়ে এখনো মোষের মতো শক্তি। তিহা ধরতে না ধরতেই তিতিক্ষার পলকা দেহটা তুলে ওপরে শুইয়ে দিল। ফার্স্ট এইড বক্স এনে তিহা বোনের মুখের ওপর ঝুঁকলো। তুলোয় ডেটল মেখে কাঁপাকাঁপা হাতে পরিষ্কার করে দিতে লাগল মুখের ক্ষতস্থান।
আকবরের মা কাছেই দাঁড়িয়ে। একমনে দেখছে। একসময় নিচু হয়ে তিতিক্ষার হাতের শক্ত মুঠি খোলার চেষ্টা করল। তিহা তাকিয়ে ছিল। মুঠো খুলে যেতেই দেখল বোনের হাতে একগাছি ছেড়া চুল। চুলগুলো আকবরের মা তিতিক্ষার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল।
‘দেহেন অবস্থা, নিজের চুল নিজে ছিড়ছে।
আর অমন চাঁদপানা মুখটারে কি করছে খামছি দিয়া। নিজেরে খামছাইয়া, চুল ছিড়া কি পায় আল্লাহ জানে! মা মরা মাইয়া… জীবনডা কি হয়া গেল….’
কথা শেষ করে আকবরের মা তাকায় তিহার পানে। সচকিত হয়ে দেখে স্থবির ভঙ্গিতে অসহায়ের মত বোনের দিকে চেয়ে আছে তিহা। চোখের কোণে পুনরায় জলের আভাস। এই মেয়েটাই বা কত করবে? চেষ্টার কোন ত্রুটি তো রাখছে না। নিজের ওইটুকু একটা বাচ্চা, চারজনার সংসার, তার ওপর এই অসুস্থ বোন! সবার ভার তার একার ওপরে। পাঁচ মাস আগে যা দেখেছিল তার চেয়ে এখন অনেক শুকিয়েছে তিহা, চোখ সেঁধিয়েছে কোটরে। নিরবে ঘুরে ঘুরে সবই খেয়াল করে আকবরের মা।
.
সেদিন সারাদিন অসংখ্য বার নিনাদ কল করল তিহাকে। রেসপন্স না পেয়ে একসময় রওশানকেও। কেউ ফোন তুলল না।
মাঝরাতে নিনাদ তখনো একা জেগে বসে। মনে নানা অশুভ ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। কি হতে পারে, কি এমন হতে পারে তিতিক্ষার?
তিহার কল এল তখন। প্রথমেই সে জিগ্যেস করল,’এখনো জেগে বসে আছিস জানার জন্য না? আগের মত বেহায়াই রয়ে গেলি তুই! বলতে না চাইলেও…’
‘প্লিজ বলে দে কি হয়েছে..’নিনাদের ব্যগ্র স্বর।
তিহা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ক্ষণকাল নিশ্চুপ থাকে। আবার আর্তস্বরে তাড়া দেয় নিনাদ, ‘কি হলো? বলতে বলছি না?’
‘বলছি..’ ঢোক গেলে তিহা। সঙ্গে সঙ্গে গলায় ব্যথার মতো কি যেন একটা বাজে। চোখের কার্ণিশে দেখা দেয় জলের আভাস। ভাবাবেগ ঝেড়ে ফেলে তিহা দৃঢ় হয়। কষ্ট হোক, তবুও আজ সে নিনাদকে বলবে, তার জীবনের সবচেয়ে অপছন্দনীয় দুঃখ গাঁথা।
.
নিনাদ দেশ ছেড়ে আসার পর তিতিক্ষার বেশ কিছু ভালো বিয়ের সম্মন্ধ এসেছিল। সম্মন্ধ যে আগেও আসেনি তা নয়৷ তবে নিনাদের উপস্থিতিতে বোনকে অনত্র বিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি শুরু করা তিহার জন্য অস্বস্তিকর ছিল।
বন্ধু দেশ ছাড়াতে সে দ্বিধা দূর হলো৷ বাঁধা দেয়ারো কেউ রইল না।
কয়েক মাসের ব্যবধানে আসা চারটে সম্মন্ধের মধ্যে প্রভাষকের সম্মন্ধটাই মারুফের বেশি পছন্দ হলো। পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ আর খোঁজখবর নিয়ে যা জানলেন, তাতে বাকিদেরও আপত্তি রইল না। ছেলে একটি বেসরকারি নামজাদা কলেজের প্রভাষক, বাবাও এককালে মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। বাবা মা আর ছোট অবিবাহিত বোন নিয়ে যাত্রাবাড়ীতে থাকে। ছোট নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার। বড় মেয়ের কাছে জানলেন তিতিক্ষারও বিশেষ আপত্তি নেই।
সুতরাং তোড়জোড় শুরু হলো। মেয়ের বিয়েতে সবচেয়ে উচ্ছ্বাসিত হলেন মারুফ। এমন যোগ্য, নম্র ছেলে… বেশ ধার্মিক না হলেও তার উল্টোটা নয়। নিয়মিত সলাত পড়ে, কোন বদ অভ্যেস নেই। সৎ, কর্মোঠ, মেধাবী… সবমিলিয়ে মারুফের ভীষণ পছন্দ। কাছের গুটিকয়েক আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হবে ঠিক হল। এই ছিল অনেককাল থেকে তিতিক্ষার ইচ্ছে।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে। তিতিক্ষাদের একতলা বাড়ি সাজানো হয় বাহারি রঙা ফুল আর বাতির পসরায়। উঠোনে বাঁধা হয় শামিয়ানা। মামা, চাচা, ভাই, বোন আত্মীয়ের ভিড়ে বিয়ে বাড়ির শোরগোল চারিদিকে। সবকিছু ভালো ভাবে এগোচ্ছিল। তিহা খুশি… বাবা খুশি… আর হয়তো তিতিক্ষাও খুশি। কিন্তু নিয়তিতেই যে অন্যকথা লেখা ছিল। খণ্ডন করে কার সাধ্যি?
অশনির প্রথম সংকেতটা বাজে বিয়ের দিন সকালে। মা নেই, একমাত্র বোনের বিয়ে। সমস্ত কাজের ভার তিহার একার কাঁধে। বাড়িতেই রান্নাবান্না হবে। বিয়ের বাজার, জোগারযন্ত… কম কথা নয়। দু দন্ড বিশ্রাম নেবার ফুরসত মিলছে না। ভোররাত থেকে ছুটোছুটি করছে।
সকালে যার যার কাজ তাকে বুঝিয়ে দিয়ে বোনের ঘরে এসে প্রথম খেয়াল করে তিতিক্ষা ঘরে নেই। ফোন, বোরকা সবকিছু রয়েছে। কিন্তু তিতিক্ষার দেখা নেই। বেশি ভাবান্বিত হয় না তিহা। বোরকা ছাড়া তিতিক্ষার বেরোনোর প্রশ্নই আসে না। হয়তো আশেপাশেই কোথাও আছে। বাবাকে ছেড়ে চলে যাবে বলে মন খারাপ নিয়ে হয়তো ছাদেই বসে আছে।
বিয়ের বাড়ির হাজার রকম কাজ। তদারকের ভারটা সন্দেহাতীত ভাবেই তিহার ওপর বর্তায়। তিতিক্ষার ব্যপার টা সে বেমালুম ভুলে বসে কাজের চাপে। বেলা বাড়লে খেয়াল হয়। বোনকে তৈরি করা হয়নি। জুম্মাবার, জামাত শেষ করেই চলে আসবে সবাই।
উঠোনে বড় পাতিলে রান্না হচ্ছে। দিনভর সেখানেই ছিল তিহা। কাজের ধ্যানে অন্যমনস্ক হয়ে বোনের ঘরে এসে টের পায় বোন তখনো আসেনি! ফোন, বিয়ের শাড়ি, সাজসরঞ্জাম যেটা যেভাবে রেখেছিল সেভাবেই পড়ে আছে।
বুকের ভেতরটা কি এক ভাবনাতীত আশংকায় ধক করে ওঠে। ভয়ে ভয়ে নরম গলায় কথাটা সে জানায় মারুফকে। অনতিবিলম্বে কাছেপিঠের দু চারজন আত্মীয়স্বজন, যারা এসেছিল বিয়েতে, কথাটা ওদের কান পর্যন্ত প্রচার হয়ে যায়। তারপর সবাই মিলে খোঁজ চলতে থাকে। বাড়ির প্রতিটি ঘর, ছাদ, উঠোন, স্টোররুম.. আনাচকানাচ কিছুই বাদ দেয়া হয়নি। তিতিক্ষা কোথাও নেই!
আতঙ্কে বিবর্ণ হয়ে আসে তিহার মুখ। কি হলো? এমন কি করে হতে পারে? তিতিক্ষা তো আর দশটা মেয়ের মতো নয়। অন্যের বেলায় অনায়েসে যা সন্দেহ করা যেত, তিতিক্ষার বেলায় যে তা ভাবনাতীত। সে ঘরকুনো মেয়ে। চিরকাল বাবা বোনের গা ঘেঁষে থাকা অভ্যেস। ওর কোনো বন্ধু নেই, নিজের বোন ছাড়া আর কারো সঙ্গে গভীর একাত্বতা নেই। কোথায় যাবে ও? আর কেনই বা যাবে? কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। অথচ কি হতে পারে ঘুনাক্ষরেও তার আন্দাজ পর্যন্ত করতে পারল না তিহা।
সম্মানহানির চিন্তা পাশে রেখে একান্ত ভাবে বোনের দুশ্চিন্তায় কাঠ হয়ে রইল সে। কি এমন হতে পারে? কোনো বড় বিপদে পরেনি তো তিতিক্ষা? ইতোমধ্যে রওশান বাসার বাইরেও খুঁজতে শুরু করেছে। জলের মতো সময় বয়ে যাচ্ছে। কোনো খবর নেই। বোনটা আদৌ ভালো আছে তো? হাজার রকম শঙ্কার বায়ু উড়ে বেড়াতে থাকে তিহার মনের আকাশে। মাথাটা বিবশ হয়ে আসে। ঠিক ভুল, যুক্তি অযুক্তি দিয়ে ভাবার ক্ষমতা ক্রমশ লোপ পেতে থাকে। আবোলতাবোল চিন্তায় অস্থির তিহার সহসা মনে পড়ে, ফজরের সলাতের পর তার বোন রোজ ভোরবেলা বাইরে হাঁটতে যেত। আজও গিয়েছিল। এমনকি ভোরে বাইরের দরজা খোলার শব্দ সে শুনেছিল! কিন্তু তারপর তিতিক্ষার ফিরে আসার আর কোন আওয়াজ বা ইঙ্গিত পায়নি।
দুপুর হয়ে আসে। বরযাত্রীরা চলে এসেছে। সংখ্যায় তারাও খুব বেশি নয়। তিহার মামা চাচা ছুটে গেল ওদের আপ্যায়ন করতে।
ঘরের ভেতর বাবা মেয়ে স্থানুবৎ হয়ে বসে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এই কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মারুফের অভিব্যক্তির দারুণ পরিবর্তন ঘটেছে। ফ্যাকাসে সাদা মুখ, চোখের দৃশ্য ঝাপসা, শ্বাসপ্রশ্বাস অবিশ্বাস্য রকমের জোড়ালো। মুখে রা নেই। আদরের মেয়েটা এতক্ষণ ধরে নিখোঁজ। অথচ বিয়ে বাড়িতে বদনাম রটবে বলে পুলিশে খবর দিতে দিচ্ছে না তার আত্মীয়স্বজন। বলছে, বোঝাচ্ছে চব্বিশ ঘণ্টার আগে নাকি শত অনুরোধেও পুলিশ কোন ব্যাবস্থা নেবে না। মারুফ পাথর হয়ে বসে থাকেন। অনতিদূরে দেয়ালে গা এলিয়ে পড়ে থাকে তিহা। বিয়ে, সমাজ, সম্মান কিচ্ছু চাই না তাদের। শুধু যে পথে তিতিক্ষা বেরিয়েছে, ভালোভাবে ঘরে ফিরে আসুক….
বরযাত্রী সবাইকে বাইরে আপ্যায়নে ব্যস্ত রাখা গেলেও ছেলের মা বোনের সঙ্গে পেরে ওঠা গেল না। পুত্রবধূকে একঝলক দেখার জন্য ব্যকুল ছেলের মা। ভরা বাড়ির বাতাসে ভেসে বেড়ানো দু একটা ফিসফিস, কূট কথাও তাদের কানে এসে থাকবে। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সোজা অন্দরমহলে চলে এলেন। হাসিমুখে আবদার করলেন ‘কই আমার বৌমা? চাঁদমুখখানি একবার দেখি!’
সদুত্তর দিতে পারলো না কেউ। ব্যস্তসমস্ত হয়ে চূড়ান্ত বিব্রত মারুফ একসময় নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তিহা তখনো এলিয়ে পড়ে আছে। সৌজন্যতার ধার ধারলো না। এখন আর একবিন্দু লড়ার শক্তি তার নেই। এই সেই নানানরকম কথার জালে ছেলের মা বোনকে থামিয়ে রাখা হলো। কিন্তু এই ছলনাও আর কতক্ষণ? একসময় তারা অধৈর্য হয়ে পড়েন। দু একটা কড়া কথা বলে বসতে তখন আর বাঁধে না। ঘরভরা মানুষের সামনে মারুফ নিশ্চুপ। বোবা হয়ে অপমানের ঢোক গিলছেন। সেসময় বাড়ির সামনে একটা মাইক্রো এসে থামে। গাড়ির গর্জন, মানুষের শোরগোলে অনেকে ছুটে যায় সেদিনে। সবার চোখে বিস্ময় খেলা করে। বর তো আগেই এসে গেছে। তবে এই মাইক্রোতে, এমনি মহাসমারোহে আবার কে এলো?
অদ্রিজা আশয়ারী
চলবে…..
দূর আলাপন ~১৩
___________________________
মাইক্রো থেকে প্রথম যে ব্যাক্তিটি নামে তাকে দেখেই সর্ব শরীর কেঁপে ওঠে তিহার। পৃথিবীটা দুলতে থাকে। বুকে অবাধ কান্নার উতরোল। সে বোঝে এবার সব সম্ভব হতে পারে। তার বোনের অপহরণ, গুম কিংবা এর চেয়েও ভয়ানক কিছু….. সব করতে পারে এই ছেলে! রাজনকে চেনে সে। নিকৃষ্ট বাবার নিকৃষ্টতম পুত্র। এলাকার নামী মাস্তান। স্কুল জীবন থেকে তিতিক্ষাকে হয়রানি করে আসছিল। ওর চোখকে ফাঁকি দেয়ার জন্য, ওর অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য কিশোরী বয়সেই বোরকা গায়ে জড়িয়েছিল তিতিক্ষা। সব তিহার জানা। জানতো নাই বা কে? কতবার নিনাদ শাসিয়েছিল রাজনকে। কোন লাভ হয়নি। বড় বেলায় এসে তিতিক্ষার অতিরিক্ত কঠোরতার জন্য বেয়াড়াপনার সুযোগ পায়নি ঠিক, কিন্তু অনুক্ষণ ওর গতিবিধি নজরে নজরে রাখতো।
এতসব কিছু জানার পরেও কি করে এতটা নিশ্চিন্তে বোনের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল তিহা? কয়েকটা বছর রাজনের সমস্ত অমিতাচার স্তিমিত ছিল। সে নিরবতাকেই বুঝি ভেবে নিয়েছিল অপরাধবোধ। হয়তো রাজন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। হয়তো আর কখনো তিতিক্ষার পেছনে লাগবে না। কিন্তু… কিন্তু…. হঠাৎ যেন সব ধোঁয়াশা দূর হয়ে যায় তিহার দৃষ্টির সামনে থেকে। ও স্পষ্ট বুঝতে পারে পরিস্থিতি এখন সম্পুর্ন রাজনের নিয়ন্ত্রণে। বোবা আর্তনাদে তিহার পৃথিবী ভারি হয়ে ওঠে। কি করে এতবড় ভুল হয়ে গেল! কি করে এতটা অসতর্ক থাকল সে! নিনাদকে পথের কাটা ভেবে, ও দূরে সরে যেতেই বোনের বিয়ের আয়োজন করেছিল…. অথচ… অথচ নিনাদই একমাত্র ছিল যাকে রাজন একটু ভয় করতো। মহাজনেরও মহাজন আছে। নিনাদ জানতো কোন প্রতিষেধকে রাজনের মতো বিষধর সাপকে কাবু করা যায়।
আনন্দের আতিশয্যে তিহা অন্ধই হয়ে গেছিল সত্যি। নাহয় কি করে ভুলে গেল রাজন যেকোনো মূল্যে তিতিক্ষাকে চাইবে। সে চাওয়ায় প্রেম নেই, অনুরাগের আসঞ্জন নেই, আছে শুধু চাওয়া, নিপাট শরীরি আবেদন। এলাকার সমস্ত মারামারি, খুনোখুনি আর যত অপরাধ ছিল… সবেতে চিরকাল অগ্রগামী এই রাজন। কেউ ওকে কিছু বলে না, শত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় না। রাজন ক্ষমতাবান বাবার ছেলে। পাড়াজোড়া মানুষ ওদেরকে ভয়ই করে। তবু তিহা নির্বিকারে বোনের নতুন সংসার সাজাচ্ছিল। কোনো সাবধানতার ধার ধারেনি, নিরাপত্তার কথা ভেবে দেখেনি। নির্দয় সত্যিটা হলো একমাত্র নিনাদকেই এতকাল আসল প্রতিপক্ষ ভেবে এসেছিল তিহা। নিনাদ নামক বাঁধা দূর হতেই আর সব সমস্যা ধূসর হয়ে গেল ওর কাছে। দুচোখে নতুন স্বপ্নের লাল নীল জড়িমায় তিহা বিস্মৃত হয়ে গেল বাকিসব বিপদ সম্মন্ধে….
শীতল আমেজে গাড়ির বাইরে পা ফেলে রাজন। তারপরই গাড়ি থেকে নামেন তার বাবা। লোহার গেট পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজায় এসে দাঁড়ান। পেছন পেছন সুঠাম দেহ, একফালি নিষ্ঠুর হাসিমাখা শান্ত মুখ নিয়ে রাজন অপরাধীর মত বাবার পেছনে দাঁড়ায়। তারপর একে একে আসে রাজনের বাবার জনাকতক চেলা ও এলাকার কিছু বিশিষ্ট জনেরা। রাজনের বাবা ঝানু ব্যাবসায়ী। পাশাপাশি সংসদের সদস্যপদ পেয়েছেন অল্পদিন আগে। অতন্ত্য ক্ষমতাশালী এবং তুখর বুদ্ধিমান ব্যক্তি। জনসমাগমও সেজন্য তুলনামূলক বেশি। তিনিই প্রথম কথা শুরু করলেন। মারুফ তখনো ঘরের অন্যপাশে নির্বাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনেই কি সমবেদনা জানাতে এসেছে লোকটা? নাহয় আর কি কারণ থাকতে পারে?
নমনীয় গলায় রাজনের বাবা হাঁকলেন,’মারুফ সাহেব, আপনি দেখছি বড় ভেঙে পড়েছেন। আদরের মেয়েটা না বলে কয়ে একরাত বাইরে কাটালে বাবা হিসেবে কষ্ট পাওয়ারই কথা… ‘
মারুফ চমকে তাকালেন। সন্দেহ হলো হয়তো তিনিই ভুল শুনেছেন। তা নাহলে এই বয়স্ক লোকটা ঘরভরা মানুষের সামনে এমন মিথ্যে কথা কেন বলবে? তিতিক্ষাকে আজ শেষ রাতেও তিনি সচোক্ষে দেখেছেন। ফজরের ওয়াক্তে মেয়েটা তার সলাতের জন্য ওযুর পানি এনে দিয়েছে। অথচ লোকটা বলছে তার মেয়ে একরাত ধরে নিখোঁজ!
‘দেখুন মারুফ সাহেব, ছেলেমেয়েরা তো ভুল ত্রুটি করবেই। ওদের যা বয়েস, এই বয়সে আমরাও তো আর সাধুসন্ন্যাসি ছিলাম না।
যাইহোক, পিতামাতার কাজ হলো ক্ষমা করে দেওয়া। নিজের সন্তানের সাথে আমাদের কোনদিন বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে না বলেই ওরা ভুল পথ বেছে নেয়। আমাদের দায়ও এইক্ষেত্রে কম না। ওরা ছেলেমানুষ… না বুঝে একটা ভুল করে ফেলেছে। আমার টাকে আমি মাফ করেছি, এইবার আপনের টাকে আপনি মাফ করুন!’
লোকটার কথাবার্তা আদতেই মারুফের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই দুশ্চিন্তাতে অস্থির তিনি, যেখানে মেয়েই নেই সেখানে ক্ষমা করার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে?
কিয়ৎকাল হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকেন সামনের মানুষটার দিকে। তারপর আগেপিছে কিছু না ভেবে হঠাৎ ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করেন,’ভাই আমার মেয়েটাকে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় আছে জানেন আপনি?’ এই আলাভোলা মানুষটার এমন সরল অকপট প্রশ্নে লোকটা মুহুর্তের জন্য ভরকায়। পেছন ফিরে গম্ভীর গলায় একজনকে আদেশ দেয়, ‘গাড়ি থেকে ওকে নিয়ে এসো।’
মারুফের দুচোখ যেন জ্বলে ওঠে হঠাৎ, ‘আ.. আমার মেয়ে আপনার গাড়িতে?’
‘হ্যাঁ, এতক্ষণ যাবৎ সে কথা টাই তো বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম। আপনার মেয়ে আর আমার ছেলে মিলে একটা ভুল করে ফেলেছে। বোঝেনই তো এই….’
‘কি ভুল করেছে ওনার মেয়ে?’ গর্জে ওঠেন বরের বাবা। অনেকক্ষণ ধরে এসব তামাশা সহ্য করছেন তিনি। বিয়ের আসর যেন ক্রমেই একখানা রঙ্গমঞ্চে পরিণত হচ্ছে। এক এক করে অভিনেতা আসছে, নিজের মতো কাহিনি রচনা করে যাচ্ছে। আর না। বহুক্ষণ ধরে যে কথাটা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল তা যে এমন প্রকট রূপ সত্যি হয়ে ধরা দেবে কল্পনাও করেন নি তিনি। মারুফ একজন সম্মানিত লোক। এলাকার সবাই ভদ্র, সম্ভ্রমশীল ব্যক্তি হিসেবে একনামে চেনে। শুধুমাত্র সেজন্যই তার মেয়ের নামে কলঙ্কের রটনা হবার পরও তিনি অপেক্ষা করেছেন। আশা ছিল হয়তো এর একটা যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে পারবেন মারুফ। কিন্তু… ক্রমে সে আশাও ফুড়িয়েছে।সাদা হায়েস গাড়িটা থেকে যখনি এই বাবা ছেলে নামলো তখনি বুঝলেন জল অনেকদূর গড়িয়েছে। রাজনের বাবা আমজাদ কে না চেনে? এই লোক যখন ঘটনায় প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত অতএব ব্যাপার কিছুতেই সামান্য নয়…
আমজাদ নিরীহ ভাবে মুখ ফেরালেন, ‘ও আপনিই বুঝি মারুফ সাহেবের হবু বেয়ান ছিলেন? তা কি আর বলবেন। বিয়েটা তো আর হচ্ছে না! বলবো কি ভাইসাব, আজকালকার ছেলেমেয়ের খেয়াল বোঝেন না? বাবা মেয়েটার অমতে বিয়ে ঠিক করেছিল। মেয়ে মানতে না পেরে রাত বিরেতে অভিমান করে আমার ছেলের কাছে গিয়া উঠল। দুইজন দুইজনকে ছোটকাল থেকে মহব্বত করে কিনা। বিয়ে ঠিক করার আগে মেয়েটার মতামত আছে কিনা সেকথা জেনে নিলে এত ঝামেলা হতোই না। যাক, এই বয়সে এমন ভুল অনেকেই করে। বয়সের দোষ। এখন কাজী ডেকে ওদের বিয়েটা পড়িয়ে দিলেই হয়।’
রাজনের বাবার কথা শেষ হওয়া মাত্র চারিদিকে একটা হৈচৈ পড়ে গেল। মুহূর্তেই অসংখ্য খারাপ মন্তব্য ভেসে আসতে শুরু করল ভিড় থেকে। সে সবই তিতিক্ষাকে ঘিরে।
‘আগেই জানতাম, ওই ঘোমটার নিচে আসলে একটা শয়তান বাস করে।’
‘সুন্দরী মেয়ে, মা ছাড়া মানুষ। কত আর ভালো হবে? বোরকার আড়ালে তবে এইসব করে বেড়াতো এতকাল!’
এরপরের কাহিনি বলা বাহুল্য। বরপক্ষ মারুফের কোনোরকম কৈফিয়ত শুনতে নারাজ। তারা নিজ চোখেই দেখেছেন মেয়ে নিখোঁজ, বাপ বোনের মুখে রা টুকু নেই। এরপর আর কিছু বলার থাকে না। যে সমারোহে তারা এসেছিলেন, এখন সেই পথে কটুবাক্য ছড়াতে ছড়াতে ফিরে যেতে উদ্যত হলেন।
পরিস্থিতির আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়েছিল তিহা। চোখে জল নেই, দৃষ্টিতে ভাস্বরতা নেই। ও শুধু বুঝতে পারছিল, আড়ালে আড়ালে এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র চলছে ওদেরকে ঘিরে, ওর বোনকে ঘিরে। এসবই যেন একটা দুঃস্বপ্নের অংশ। না… না… বাস্তবতা কখনো এত জঘন্য হতে পারে না। নিশ্চয়ই শেষ রাতের অমানিশায় কোনো বাজে স্বপ্ন দেখছে তিহা। এখনি ঘুম ভাঙবে, জেগে উঠে বা দিকে থুথু ছেটাবে সে। দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবে আর সমস্ত বিপর্যয় কেটে যাবে। আসবে নির্মল শান্তিঘেরা ভোর। বোনকে জড়িয়ে ধরে তিহা হাসবে, বলবে ‘তোকে আমি নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসি।’
কিন্তু কই? এত চেষ্টা করেও তিহা স্বপ্ন ছেড়ে জেগে উঠে বসতে পারছে না তো! উল্টো চারপাশের চিৎকার, শোরগোল ক্রমশ বাড়ছে। হঠাৎ আর্তনাদ করে ওঠে তিহা, ‘মিথ্যে… মিথ্যে… এসবই মিথ্যে। সাজানো নাটক সব। আমার বোন নিখোঁজ হয়েছে ভোর থেকে। তাহলে রাতে সে কিভাবে রাজনের কাছে গেল? অনুরোধ করছি এসব বিশ্বাস করবেন না আপনারা। ষড়যন্ত্র… সব ষড়যন্ত্র… ‘
কিন্তু না, কেউ শুনল না তিহার কথা। উল্টো তিতিক্ষার বদনামই বাড়তে লাগল। বরপক্ষ চলে যাচ্ছে, আশেপাশের শোরগোলও ক্রমেই বেড়ে উঠছে দেখে তিহা এবার হুশ জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মত দৌড়ে গিয়ে রাজনের কলার চে পে ধরল। চিৎকার করে বলল, ‘আমার বোন কোথায় বল?’
রাজনের ছদ্মবেশী মুখে অশনির মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে মৃদু হাসি। কলার থেকে তিহার হাত ছাড়িয়ে পেছন ফিরে হাটতে শুরু করে সে। বেশিদূর যেতে হয়না। ততক্ষণে একজন নারীর গায়ে ভর দিয়ে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে ফিরে আসছিল তিতিক্ষা। রাজন গিয়ে নিঃসংকোচে ওকে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে তিতিক্ষাকে ছেড়ে কিঞ্চিৎ দূরে সরে যায় নারীটি। ঘোর বিস্ময় নিয়ে তিহা দেখে, তার বোনের গায়ে অজ্ঞাত পুরুষের ছোঁয়া লাগা সত্ত্বেও তিতিক্ষা আজ সরে আসছে না, এমনকি কোনোরকম প্রতিক্রিয়াই দেখাচ্ছে না। মন্ত্রে বশ হওয়া মানুষের মতো অনুভূতি শূন্য চোখ নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। পা কাঁপছে, বোধহয় হাটতে কষ্ট হচ্ছে। আর… আর… ঘরভরা মানুষের লুব্ধ দৃষ্টি ওকে ঘিরে বর্ষিত হচ্ছে জেনেও তিতিক্ষা আজ নির্বিকার। এমন তো হবার কথা না… আর যাইহোক পর্দা নিয়ে তিতিক্ষা সহনশীল হবে এতো ভাবনার অতীত! তবে কেন ও নড়ছে না? কেন কিছু বলছে না? কেন ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে না এই জনারণ্য ছেড়ে? আদতে কি হয়েছে তিতিক্ষার? ওর সারা গায়ে এত মারের দাগ কেন? কাপড় ছেড়া কেন? কেন চুল এলোমেলো? এসব কে করেছে? কেন করেছে? এসব কি কোনো অশুভ ঘটনার সংকেত দিচ্ছে? তিতিক্ষাকে কি কিছু করেছে কেউ? খুব বাজে কিছু? কি ঘটে থাকতে পারে ওর সাথে?
না না… কিছুতেই চূড়ান্ত কথাটা ভেবে উঠতে পারছিল না তিহা। ভাবতে গেলে দুনিয়া অন্ধকার লাগে। কেন এমন হবে? কেন কেউ ওর বোনের অতবড় সর্বনাশ করবে?
রাজন তিতিক্ষাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে এলো তিহার সম্মুখে। ঠেলে দিল তিহার দিকে। বোধহয় হুড়মুড় করে মাটিতেই গিয়ে পড়ত। খপ করে দু’হাতে বোনকে আঁকড়ে ধরে ফেললো তিহা। অবিশ্বাস নিয়ে আবারো তাকাল বোনের দিকে। সারা শরীরে অসংখ্য আঁচড়ের দাগ, ছোপ ছোপ রক্ত মাখা জামাকাপড়ের কিয়দাংশ ছেড়া, গায়ে ওড়নাটাও ঠিকমতো জড়ানো নেই। হঠাৎ যেন সব স্পষ্ট হয়ে গেল। না, আর কিছু বাকি নেই। সব শেষ হয়ে গেছে! ধ্বংস হয়ে গেছে তার বোনের জীবন। অস্ফুট আর্ত চিৎকার বেড়িয়ে এলো তিহার মুখ দিয়ে। ঘোর আবিষ্ট অবস্থায় বোনকে নিয়ে মাটিতে বসে পড়ল তিহা।
তিতিক্ষার আগমন ঘটা মাত্র ক্রুদ্ধ জনস্রোতে নতুন জোয়ার উঠেছে। ছোট বৈঠকঘর খানা যেন এবার মনস্যকণ্ঠের আস্ফালন সইতে না পেরে ভেঙে পড়বে। চিৎকার, হৈচৈ, অসংখ্য নোংরা কথা আর অপবাদে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস।
সেসবের কেন্দ্রে মধ্যমণি হয়ে বসে আছে তিনজন। তিহা তিতিক্ষা আর তাদেরকে ঘিরে অসহায় বাবা মারুফ। তিহা তখনো অপ্রকৃতস্থের মতো চিৎকার করছে। অথচ যাকে ঘিরে এত কিছু, সে যেন চিরনিথর, নিস্প্রভ এক জীব। ওর ভেতরে যেন কোনোদিন ছিল না প্রাণের সঞ্চার….
রাজনের বাবা অতিশয় কাতর হয়ে দাড়িতে হাত বোলালেন, ‘তাহলে বিয়েটা….’
‘বেরিয়ে যান এক্ষুনি। আপনাকে আর আপনার ওই বেজন্মা ছেলেকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবই। যান এখান থেকে। আমি খু নো খু নি বাঁধানোর আগেই বেরিয়ে যান।’
তিহা চেঁচিয়ে ওঠার সাথে সাথে নাটকীয় ভাবে মুখভঙ্গি পালটে যায় রাজনের পিতার। হেসে ওঠেন তাচ্ছিল্য ভরে। এত বড় কীর্তির পর এটুকু অপমান সওয়াই যায়। তাই কথা না বাড়িয়ে ফিরে যেতে উদ্যত হন। যাওয়ার আগে রাজনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘চলে এসো রাজ। খেলা শেষ। তুমি যা চেয়েছিল তা তো পেয়েছই।’
আমজাদ বেরিয়ে গেলেন। বাবার যাওয়ার পথে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে সম্মুখে দৃষ্টি স্থাপন করল রাজন। হাটু গেড়ে বসল তিহার সামনে। মুখে পিশাচসুলভ হাসি। তিতিক্ষার নিস্পন্দ মুখ একবার দেখে নিয়ে ফিসফিস করে তিহাকে বলল,’খুব শখ ছিল না বোনের বিয়ে দেবার? এবার দে দেখি। এখন তো ও সবার কাছে একটা বে*। এখন না আমি তাকে বিয়ে করব না অন্য কেউ।’ বলে বিকৃত একটা হাসি দিয়ে চলে গেল।
সেই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত তিতিক্ষা নির্বাক ছিল। চোখের দৃষ্টি ছিল শূন্য। নিজেকে নিয়ে রাজনের শেষ মন্তব্যটা শুনে সে একবার একটু কেঁপে ওঠে মাত্র। তারপর এই প্রথম দুচোখের কূল ভেঙে অশ্রুর ফোয়ারা নামতে শুরু করে।
.
একদা এক গহীন বনমধ্যে লোকচক্ষুর অন্তরালে স্বচ্ছ সরোবরে ফুটেছিল একটি পদ্মফুল। অহোরাত্রি হাজারো সর্প তারে পাহারা দিত। কোনদিন কোনো মনষ্যচক্ষু দেখেনি সে ফুলের মাধুর্য। যে ফুলের উজ্জ্বল কান্তিতে আলোকিত হত অরণ্যপ্রভা। তারপর হঠাৎ একদিন কোথা থেকে এক হিংস্র শ্বাপদের আগমন ঘটলো বনে। গভীর অরণ্য মধ্য হতে সে এসে পদ্মফুলের শোভা দেখে থমকে গেল। লোভে চকচক করে উঠল তার চোখজোড়া। অতঃপর নিজের তীক্ষ্ণ ধারালো নখ দিয়ে সকল প্রহরিণী সর্পকে হত্যা করে সে অবশেষে নাগাল পেল পদ্মফুলের। দুমড়ে মুচড়ে বিধস্ত করে ফেলল ফুলটিকে। একে একে অত্যুজ্জ্বল সকল পাপড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল ফুল। গহীন অরণ্য মধ্যে কি ঘটে গেল কেউ জানল না। কেউ কি আছে যে সেই পদ্ম ফুলের দুঃখ বোঝে? বুঝলে সে জানতো কেন মরনো সেই যন্ত্রণার চেয়ে বেশি কাম্য। আজ থেকে যেমন তিতিক্ষা জানে….
চলবে…….