#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_১৯
#Writer_Fatema_Khan
বিথীর কথা শেষ তাই সে বালিশের কাছে মোবাইল রেখে পাশ ফিরে শুয়ে পরলো৷ মেহের মোবাইল চেক করে দেখলো রাত ১টা বাজতে চললো। হঠাৎ মেহেরের ফোনে একটা মেসেজ আসলো। হঠাৎ মোবাইলে এত রাতে মেসেজ আসাতে মেহের চমকে উঠে। উপরে আয়াতের নাম উঠে আছে৷ কি আছে মেসেজে লেখা দেখার জন্য মেহের নামের উপর ক্লিক করার আগেই আয়াতের কল আসে মেহেরের ফোনে৷ এত রাতে আয়াতের কল দেখে মেহের বিছানা থেকে উঠে বসে। বিথীর দিকে এক নজর তাকায়৷ না সে ঘুমাচ্ছে৷ কলটা রিসিভ করে মেহের। মেহের হ্যালো বলার আগেই ওই পাশ থেকে আয়াত বলে উঠলো,
“সারাদিন তোমায় একবারের জন্যও চোখের দেখা দেখি নি। একবার বাইরে আসবে?”
মেহের যেনো আশ্চর্যের শেষ সীমানায়। কি বলে এই ছেলে! একটা দম নিয়ে মেহের বললো,
“এত রাতে আসা সম্ভব না। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”
“মানা করো না প্লিজ, আমি পুকুর ঘাটের কাছে অপেক্ষা করছি তাড়াতাড়ি এসো।”
বলেই কল কেটে দিল আয়াত৷ মেহের আবার হ্যালো বলতেই বুঝতে পারলো আয়াত লাইন কেটে দিয়েছে৷ মেহের চিন্তায় বিভোর।
“এত রাতে কি যাওয়া ঠিক হবে, কেউ দেখে ফেললে খুব খারাপ ভাববে আমাদের। কিন্তু আয়াত যে অপেক্ষা করছে৷ এখন কি করব আমি? কিছুই ভালো লাগছে না। তবে এত রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে আছে। কেউ উঠবে বলে মনে হয় না। আয়াত কি বলতে চায় সেই কথা কিছুক্ষণ শুনেই চলে আসব।”
যেই ভাবনা সেই কাজ৷ আরেকবার বিথীর দিকে তাকিয়ে মাহির গাছে কাঁথা টেনে দিয়ে দিল। খাটের উপর রাখা ওড়না মাথায় আর গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে দরজা খুলে বের হলো মেহের৷ বাড়ির সদর দরজা খোলা তবে চাপিয়ে দেওয়া। টিনের ঘর হলেও ভেতরেই টয়লেটের ব্যবস্থা আছে। তাই কেউ উঠলেও বাইরে বের হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই মেহের ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে গিয়ে দরজার খিল লাগিয়ে দিল। আস্তে আস্তে পুকুর ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলেও বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে তার৷ তবে তা অবশ্যই ভয়ে। কারণ কেউ দেখে না নেয় সেই ভয় গ্রাস করে আছে মেহেরকে। কারণ এর আগেও অনেকবার রাত করে আয়াত আর মেহেরের কথা হয়েছে৷ কিন্তু আয়াত এমন পাগলামি কেন করছে তা মেহেরের মাথায় আসছে না। পুকুরের কাছে এসে একটা মানুষের অবয়ব দেখতে পায় মেহের৷ অবয়ব টা যে আয়াতের তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না মেহেরের। এগিয়ে গিয়ে আয়াতের পাশে দাঁড়ায়। আয়াত পাশে কারো অস্তিত্ব বুঝতে পেরে পাশে তাকায়। মেহেরকে নিজের পাশে দেখতে পেয়ে মুচকি হেসে আবার পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। দুইজনেই কিছুক্ষণ নিরব ভূমিকা পালন করে। নিরবতা ভেঙে মেহের বলে, “কিছু কি বলবেন? এত রাতে ডাকার কোনো মানেই হয় না। কেউ দেখে ফেললে খুব খারাপ ভাববে আমাদের। আর এটা শহর নয় যে এত রাতে দুইটা প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ে দেখা করা যাবে। তাও আবার বাইরে। এতটা ছেলেমানুষী ঠিক নয়।”
আয়াত আবার মেহেরের দিকে তাকালো। মেহেরের এক হাত আরেক হাতের ভাজে ছিল। হাতের দিকে তাকিয়ে আয়াত মেহেরের হাত ধরে নিচে নামাতে লাগলো।
“আয়াত আপনি পাগল হলেন নাকি, নিচে নামছেন কেন? আমার কিন্তু ভয় করছে।”
“এই মেয়ে তুমি কি ভূতে ভয় পাও নাকি! এমন বাঘিনী রূপ নিয়ে সারাদিন ঘুরো মনে তো হয় দুনিয়ার সব বোঝা তোমার মাথার উপর। সব টেনশন তোমার একার। আর এখন কিনা ভয় করছে। তা ভয় কি ভূতকে করছে নাকি আমাকে?”
মেহের আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ আয়াতের সাথে নিচে নেমে এলো। পুকুর ঘাটের নিচে এসে আয়াত পুকুরে পা ভিজিয়ে বসে পরলো। সাথে মেহেরকেও বসালো। তবে মেহের পা উপরেই রেখে দিল। এত রাতে পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আড্ডা দেওয়ার মতো মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না তার। সে বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে কেউ না জেগে যায়। আয়াত মেহেরের অস্বস্তি বুঝতে পেরে বলে,
“ভয় নেই এত রাতে কেউ আসবে না।”
“কিভাবে ভয় না পাই কেউ উঠে গেলে মা বাবা চাচা চাচীর মান সম্মান কিছুই থাকবে না।”
আয়াত মেহেরের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলে,
“কেউ আসবে না সত্যি।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আয়াত আবার বললো,
“আজ পরিবেশটা কত সুন্দর না! আকাশে গোল চাঁদ উঠেছে সাথে আকাশ ভরা তার৷ থালার ন্যায় গোল চাঁদটা পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে কি দারুণ লাগছে৷ এমন একটা রাত কবে থেকে পার করার ইচ্ছে ছিল মনের মানুষের সাথে। সারারাত তার হাতে হাত রেখে দুজন মনের সব কথা বলব। ক্লান্ত হয়ে সে আমার কাধে মাথা রেখে চাঁদ দেখায় ব্যস্ত থাকবে। তার মনের সকল অনুভূতি সে আমার সামনে তুলে ধরবে, আমার মনের যত কথা আমি তাকে বলব৷”
“সারাদিন কোথায় ছিলেন?”
আয়াত মেহেরের অনেকটা কাছে এসে,
“কেন, মিস করছিলে বুঝি?”
“না মিস করতে যাব কেন? সারাদিন বাড়িতে দেখি নি তাই জিজ্ঞেস করলাম। আপনার ভালো না লাগলে আর কখনোই জিজ্ঞেস করব না।”
“বিহানের সাথে ছিলাম। ওর অফিসে। ওর বিজনেস সম্পর্কে বললো অনেক কিছু। ওর সাথেই কাটিয়েছি মূলত সারাদিন। তারপর তো আর যাওয়া হবে না বিথীর বিয়ের আয়োজন শুরু হবে।”
“ওহ। কিন্তু বিহান ভাই তো দুপুরে খেতে এসেছিল আপনি তো আসেন নি।”
হাসলো আয়াত। মেহের আয়াতের হাসি দেখে মনে মনে নিজেকে বকতে লাগলো।
“এত কেন প্রশ্ন করিস কে জানে?”
“সকালে তোমাকে কাপড় আনতে বলেছিলাম আনিকাকে দিয়ে কেন পাঠালে? আমার এতটুকু কাজ কি তুমি করতে পারতে না?”
“আনিকা নিজেই বললো সে নিয়ে দিয়ে আসবে, তাই আর আমি যাই নি।”
“আমিতো ভেবেছি তুমি আসবে। তোমার জায়গায় আনিকাকে দেখে সকাল থেকে যে ফ্রেশনেস টা ছিল সেটাও দূর হয়ে গেছে। তাই নিজের মন ঠিক করার জন্য সাঁতার কাটি অনেকক্ষণ। তবে কাসফি আর কনিকার জন্য অবশেষে তুমি আসলে।”
হালকা শীতল হাওয়া বইছে। বাতাসে ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূতি। মেহেরের মনটা এখন অনেকটাই হালকা৷ ভয় কিছুটা কমেছে৷ মনে হচ্ছে কেউ এত রাতে আসবে না। নিজেকে ফুরফুরে লাগছে৷ মৃদু বাতাসে মেহেরের মাথার ওড়না কিছুটা সরে গেছে। সামনের ছোট ছোট চুলগুলো চোখে মুখের সামনে চলে আসছে। মেহের সেগুলো সরানোর বিন্দুমাত্র আগ্রহ করছে না৷ আনমনেই নিজের দুই পা পানিতে ভিজিয়ে নিল৷ ঠান্ডা পানি পায়ে লাগতেই হালকা কেঁপে উঠে মেহের।
“ইস কি ঠান্ডা পানি! কিভাবে পা রেখেছেন এতক্ষণ?”
“ভালো লাগছে আমার। তোমার ঠান্ডা লাগলে তুমি ভিজিও না। পরে জ্বর এসে যাবে।”
“না আমারও ভালো লাগছে।”
মেহের পুকুরের স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি নিয়ে আছে। আয়াত তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মেহের আয়াতের দিকে তাকালে দুই জনের চোখাচোখি হয়ে যায়৷ মেহের তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে সামনে তাকায়৷ আয়াত নিজের হাত এগিয়ে নিয়ে মেহেরের মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে কানের পিছে গুজে দেয়।
“তোমার চুল বরাবরের মতোই আমাকে বিরক্ত করে৷ আমার সাথে তোমার চুলের কি শত্রুতা বলবে একটু? আমিতো ভেবেই কুল পাই না তোমার সাথে সাথে তোমার এই চুলও আমার থেকে তোমাকে লুকিয়ে রাখে৷ মন ভরে একটু দেখতেও দেয় না। এমনিতে তো দেখার সুযোগ পাই না আমি। না এখানে না শহরে। এখন নিজে একটু সুযোগ করে নিয়েছি সেটাতেও এই চুলের যন্ত্রণা।”
“আমাদের ঘরে যাওয়া উচিত অনেক রাত হয়ে গেছে।”
“আরেকটু থাক না আমার সাথে। তোমার কি আমার কাছে থাকতে ভালো লাগে না? আমার তো মন ই ভরে না।”
চলবে,,,,,
#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২০
#Writer_Fatema_Khan
“ভালোবাসি!”
মেহের তাকিয়ে ছিল আয়াতের মুখপানে। তার দিকে চেয়েই বললো,
“ভালোবাসি বলা যতটা সহজ, শেষ অবদি টিকিয়ে রাখা ততই কঠিন। নতুন কারো আগমনে সহজেই বদলে যায়।”
“আমার ভালোবাসা বছরের কোনো ঋতু নয় যে তা দুই মাস অন্তর অন্তর ঝতু বদলে যাওয়ার মতোই বদলে যাবে। মন থেকে ভালোবাসা সহজে শেষ হবার নয়। আর আমার ভালোবাসা যখন এত বছর এতটা দূরে থেকেও কোনো যোগাযোগ না রেখেও টিকে আছে তাহলে তা সহজে বদলে যাবে এটা ভাবাও ভুল।”
“হুহ! এসব কথার কথা। এসবে এখন আর বিশ্বাস হয় না।”
“একটা গল্প শুনবে, বেশি না ছোট্ট একটা গল্প।”
“শুনতে আপত্তি নেই।”
আয়াত মৃদু হাসলো।
“মাধ্যমিক পাশ করে সবেমাত্র কলেজে পা দিয়েছিল ছেলেটি। কিশোর থেকে যৌবনের দিকে পা বাড়ানো ছেলেটির আশেপাশে মেয়ের কমতি ছিল না। সহজেই যে কাউকে মন দেওয়া যেত। তবে তার মন আটকে গেছিলো এক গম্ভীর মেয়েকে হঠাৎ করে এতটা চঞ্চলা হয়ে উঠতে দেখে। সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ। সাধারণ সকল কলেজ ভার্সিটিতেই এই দিনটি উদযাপন করা হয়। তবে ছেলেটির এসবে আগ্রহ বরাবরই কম ছিল। তাই সে কলেজ যায় নি। ছাদে তার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ চারপাশে বাতাস শুরু হলো। এ যেনো ঝড়ের আগমন। কিন্তু এই ঝড় যে ছেলেটির জীবনেও ঝড় বয়ে আনবে কে জানত। আজ পহেলা বৈশাখ, আর এই দিনে বৃষ্টি হবে তা স্বাভাবিক। কিন্তু এই বৃষ্টি তার বুকে ঝড় তুলে আনবে সে যদি জানত তাহলে তৎক্ষণাৎ ছাদ থেকে নিচে চলে আসত! সিড়িতে নজর দিতেই চোখ যায় দ্রুত ছুটে আসা এক তরুণীর দিকে। বৃষ্টিতে ভিজে এক তরুণী সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠে যাচ্ছে। গায়ে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, হাতে লাল কাচের চুড়ি আর মাথায় লাল আর সাদা ফুলের গাজরা। তরুণীটি একবার যেনো তাকালো তার দিকে, কাজল মাখা চোখ দুটি বৃষ্টির পানিতে ভিজে লেপ্টে গেছে। আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ছেলেটি৷ কারণ খোলা লম্বা লতানো চুলগুলো রমনীর সৌন্দর্য ঢাকতে ব্যস্ত। যা ছেলেটিকে খুবই বিরক্ত করতে সক্ষম। কিন্তু সেই রমনীকে না দেখেই ছেলেটি বলতে পারে এই তরুণী তার স্বপ্নে আসা সেই প্রেয়সী। এই বৃষ্টিতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও যেনো তার কথা ভালো করে বুঝা যাবে না, কিন্তু ছাদে থাকা রমনীর নুপুরের শব্দ যেন তার বুকে গিয়ে লাগছে৷ দু’মিনিটের জন্য চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয় ছেলেটি।
“মেহের কাপড় নিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে আয়, তুই তো পুরাই ভিজে যাবি রে মা।”
কারো ডাকে হুশ আসে ছেলেটার। চোখ খুলে সামনে তাকায় সে। ছেলেটা যেনো সবকিছু গুলিয়ে ফেলে এ কি ভাবছিল সে! এ তো তারই বড় চাচার মেয়ে মেহের। যে কিনা এবার অনার্স ১ম বর্ষে পড়ে। সে তো তার ভার্সিটির অনুষ্ঠানে গিয়েছিল, তাহলে কি বাসায় এসেই ছাদে এসেছে? তার ব্যাপারে এসব কি করে ভাবতে পারে! অবাকের শেষ সীমায় পৌঁছে যায় ছেলেটা। এক মুহূর্তের জন্য আর ছাদে অবস্থান না করে ছেলেটা নিচে চলে যায়।”
“তারপর।”
“ছেলেটার রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার জন্য তো ওই কয়েক মিনিটই যথেষ্ট ছিল। রাতে খেতে গিয়েও ছেলেটা মেয়ের দিকে তাকাতে পারে নি। তবে কয়েকবার আড় চোখে দেখেছে। মেয়েটা আজ বড্ড খুশি খুশি। যে মেয়েটা এতটা গম্ভীর থাকে সেই মেয়েটা এতটা খুশি খুশি লাগছে ব্যাপারটাই ভালো লাগার মতো। তবুও ছেলেটা কোনমতে খেয়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো৷ ছেলেটার আর রাতে ঘুম হলো না। জানো তো মেহের তরুণীটি তুমিই ছিলে আর ছেলেটা আমি৷ ওইদিনই প্রথম আমি তোমার প্রেমে পরেছিলাম। জানিনা কি করে, কি ভাবে! কিন্তু ওই এক মুহূর্তেই আমি প্রেমে পরেছিলাম। জানি না তুমি কখনো বুঝবে কিনা আমার ভালোবাসা তোমার জন্য ঠিক কতটা সত্যি, কিন্তু আমি ভালোবেসেই যাব তোমাকে। তোমাকে কখনো নিজের করে পাব সেটা এখন ভাবি না, তবে দেশে আসার পর ভেবেছি তোমাকে পাবার একটা সুযোগ তো আমার পাওয়ার দরকার তাই না। সেই প্রচেষ্টায় আছি, আর শেষ পর্যন্ত থাকব। তবে তোমার বিচ্ছেদের কথা শোনার পর কষ্ট লেগেছে। ওই সময় ভেবেছি ছুটে আসি তোমার কাছে, তোমার সব কষ্ট আমার হোক, তুমি সুখে থাক। কিন্তু আমি পারি নি ছুটে আসতে তোমার কাছে, আমি যে বাধা ছিলাম। কি বলব তোমাকে ভালোবাসি। আমি যে ভীষণ ভয় পাই তোমাকে হারিয়ে না ফেলি। সেজন্য সাহস হয় নি কখনো। তবে এখন আর ভয় করে না।”
“কেনো?”
“আমার মনে হয় শেষটা বোধহয় আমারই জিত হবে।”
“আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো, তবে এতটাও না।”
“সেসব জানি না, কিন্তু এতটুকু জানি আমি আশেপাশে থাকলে সেই তরুণীর চোখে মুখে আমি আবার সেই আগের চঞ্চলতা দেখতে পাই। সে আমাকে দেখে লজ্জা পায়। যেটা আগে কখনোই ছিল না। তাই এতটুকু আত্মবিশ্বাস জোগাড় করে নিয়েছি নিজের ভেতর।”
মেহের চুপ করে পুকুরের স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো কথা মুখে নেই। আয়াত মেহেরের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
“সত্যি ভালোবাসি, নিজের থেকেও বেশি। তুমি আমার জীবনের প্রথম আর শেষ ভালোবাসা। যা ভুলার নয়। তুমি না হও আমার তবুও ভালোবাসা রয়ে যাবে আজীবন। তোমার এই হাতে হাত রেখে সমুদ্র দেখা বাকি আছে, পাহাড়ের উঁচু চূড়ায় বসে প্রকৃতি দেখা বাকি আছে, মেঘের আনাগোনা দেখা বাকি আছে। সব হবে একদিন দেখে নিও।”
“আমি আসি আয়াত মাহি ঘরে বিথীর সাথে একা আছে। ও উঠে গেলে বিথীও জেগে যাবে আর জেনে যাবে আমি ঘরে নেই। আর সবাই জেনে যাবে আমি আপনার সাথেই আছি।”
“কেনো আমার সাথে তোমার বুঝি নিজেকে নিরাপদ মনে হয় না?”
“আমি এমনটা কখন বললাম আয়াত? আমিতো কেউ দেখলে আমাদের দুইজনকেই খারাপ ভাববে সাথে আমাদের পরিবারকেও দুই কথা বলতে পিছ পা হবে না। ভুলে যাবেন না এটা একটা গ্রাম। এখানে সন্ধ্যার পর একটা ছেলে আর মেয়ে একা দেখা করাও দৃষ্টিকটু দেখায়।”
“আচ্ছা যাও।”
মেহের উঠে গেলো। সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে আয়াতের ডাকে আবার থেমে গেলো।
“মেহের।”
মেহের পিছনে ফিরে আয়াতের দিকে তাকালো। আয়াত পানি থেকে পা উঠিয়ে জুতা পরে উপরে উঠতে লাগলো৷ মেহেরের বরাবর এসে দাড়ালো৷ মেহের প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে আয়াতের দিকে।
“কিছু বলবেন?”
আয়াত কোনো কথা না বলে আচমকাই মেহেরকে জড়িয়ে ধরলো। মেহের এটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মেহেরের যেনো শ্বাস রোধ হওয়ার উপক্রম হয়ে উঠেছে৷
“ভোরের স্নিগ্ধতা ফুরিয়ে তা তোমার মুখশ্রীতে এসে ভর করেছিল, তা যদি তুমি জানতে তাহলে ভোরে আমার সামনে এমন অগোছালো হয়ে আসতে না। রাতের জোৎস্না তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে তোমাকে দেখে। কারণ তা যে তোমার সৌন্দর্য দেখে লজ্জা পেয়েছে। জোৎস্না দেখতে এসে তোমাকেই দেখে রাত কেটে গেলো। যাও ঘরে যাও আর কিছুক্ষণ পর ফজরের আজান দিবে, গ্রামের সবাই ঘুম থেকে উঠে যাবে। এর আগেই ঘরে চলে যাও। আমি চাই না আমার সাথে তোমাকে একা দেখে খারাপ ভাবুক। তবে এমন একটা দিন আসবে যেদিন তুমি আমার সাথে এক ঘরে থাকলেও কেউ খারাপ বলার সাহস পাবে না। সেদিন বেশি দূরে নয়, তা খুব শীঘ্রই আমাদের জীবনে আসবে।”
আয়াত মেহেরকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। মেহেরের যেনো শ্বাস ফিরে এলো। আরেকটু হলেই শ্বাসকষ্টে মারা যেত। কোনোদিকে না তাকিয়ে মেহের এক ছুটে ঘরের দিকে চলে গেলো। দরজার কাছে এসে মেহের আরেকবার পুকুর পাড়ের দিকে তাকালো৷ এক হাত পকেটে গুজে মেহেরের দিকেই তাকিয়ে আছে আয়াত। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে নিজের ঘরে এসে জোরে জোরে শ্বাস নিল মেহের। মেহের ঘরে ঢুকার কিছু মুহূর্ত পরেই আয়াত ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো৷ আজানের শব্দে বিথীর ঘুম ভেঙে গেলো। মেহেরকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বিথী বললো,
“কি হলো আপু এভাবে বসে আছো কেনো, নামাজ পড়বে বুঝি?”
মেহের হঠাৎ বিথীর কথা শুনে ভড়কে যায়। তবে কি বিথী কি তাকে দেখে নিয়েছে এই ভয়ে। পর মুহূর্তে বিথীর ঘুম জড়ানো চোখ মুখ দেখে বুঝলো মাত্রই ঘুম ভেঙেছে তার। তাই নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো,
“হুম নামাজ পড়ব, তুমি পড়বে না উঠে পর।”
“উঠছি আপু। জানো আজ না আমার কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।”
“কেনো?”
“আজ আমার গায়ে হলুদ। এক রাতের ব্যবধানে আমি কাঙ্খিত মানুষটির আপন হয়ে যাব আবার একটা রাতের ব্যবধানে আমি আমার পরিবার ছেড়ে চলে যাব।”
“টেনশন নিও না সব মেয়ের জীবনেই এমন একটা দিন আসে। আর সবাইকে নিজের পরিবার ছেড়ে অন্য একটা পরিবারকে আপন করে নিতে হয়।”
“আচ্ছা আপু তুমি কি নিজের জীবনটাকে আবার গুছিয়ে নিতে পারো না? নিশ্চয় তোমার জীবনে এমন কেউ আসবে যে তোমার সকল দুঃখ ভুলতে সাহায্য করবে।”
মেহের বিথীর কথা শুনে রাতে বলা আয়াতের প্রতিটি কথা কানে বাজতে লাগলো।
চলবে,,,,,
#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২১
#Writer_Fatema_Khan
সময় নদীর স্রোতের মতন বহমান। কারো জন্য অপেক্ষা করে থাকে না। ঠিক তেমনি আয়াত আর মেহেরের জীবনও থেমে নেই।
আজ দুই সপ্তাহের মতো গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে তারা৷ সবাই নিজের কর্ম জীবন নিয়ে ব্যস্ত এখন৷ বিথীর বিয়ে খুব ধুমধাম ভাবে হয়ে গেছে। বিথীর চোখে মুখে হাসির ঝিলিক ছিল। যেনো প্রতীক্ষিত মানুষের কাছে যাওয়ার আনন্দ। মেহেররা নিজেরাও খুব আনন্দ করেছে বিয়েতে। বিথীর বিয়ের এই কয়টা দিন আর আয়াত আর মেহের আলাদা করে কথা বলতে পারে নি৷ কথা বলার সুযোগ হয় নি কথাটি ভুল। আসলে মেহের আয়াতের থেকে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে৷ আয়াত ওই রাতের পর কয়েকবার মেহেরের সাথে আলাদা কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু মেহের তা বুঝতে পেরে নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত। তবে বিয়ের সকল অনুষ্ঠানের মাঝেও দুইজনের চোখাচোখি হয়ে যেত প্রায়ই। মেহের যেখানে আয়াতকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করতো, আয়াত সেখানে মেহেরের দিকেই তাকিয়ে থাকত৷ এমন সাদামাটা চলাফেরার মেয়েটা যখন সেজেগুজে সামনে আসে তখন এতটা আবেদনময়ী লাগতে পারে তা আয়াতের জানা ছিল না। বিয়ে বাড়ি বলে সবার সাথে মিল রেখে না চাওয়া সত্ত্বেও সাজতে হয়েছে মেহেরকে৷ আর আয়াতের চোখ আটকে রয়েছে সেই মায়াবী মুখশ্রীতে। মেহের না তাকালেও বুঝতে পারত আয়াত যে তার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ আনিকেকেও অনেক সুন্দর লাগছিল৷ বলতে গেলে বিথীর পর আনিকাকেই সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগছিল৷ আনিকা বারবার খুটিয়ে খুটিয়ে নিজেকে দেখে সব মেয়েদের কাছেই জিজ্ঞেস করছিল তাকে কেমন লাগছে দেখতে। সবাই সুন্দর বললেও তার মন ভরতো না। কারণ যার জন্য এত সাজ সে তার দিকে ফিরেও তাকাতো না৷ একদিন তো আয়াতের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছে৷ ভাইয়া আমাকে কেমন লাগছে৷ আয়াত মুচকি হেসে শুধু সুন্দর বলেই চলে গেছে৷ এতে আনিকার মনক্ষুণ্য হলেও কিছুই করার ছিল না। সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে। প্রথম দিকে না বুঝলেও বিথীর বিয়ের সব অনুষ্ঠানে আয়াতকে খুব ভালো করে খেয়াল করেছে সে৷ আর আয়াত যে মেহেরে আবদ্ধ সেটাও খুব ভালোই বুঝেছে সে। তাই তো ফেরার দিন মেহেরের হাত ধরে বলেছিল,
“তুমি খুব ভাগ্যবতী আপু। এমন একজনকে দূরে ঠেলে দিও না, আগলে রেখো। অনেক সুখী হবে।”
তারপর জড়িয়ে ধরে মেহেরকে। মেহের কথার সারমর্ম না বুঝলেও এটা বুঝেছে আনিকা কিছু একটা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে। তবুও আনিকাকে জিজ্ঞেস করলো তার কি কিছু হয়েছে? আনিকা হেসে জবাব দিল কিছুই হয় নি, তবে সবার সাথে অনেকদিন ছিল তাই মন খারাপ হচ্ছে৷ এই বলেই বেড়িয়ে পরলো নিজ গন্তব্যে। তার কিছুক্ষণ পরেই মেহেররাও নিজেদের গন্তব্যে বেড়িয়ে গেলো।
আজ দুই সপ্তাহ নিজেদের বাড়ি ফিরে এলেও মেহের নিজেকে আয়াতের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেই চলে৷ কারণটা তার নিজেরও অজানা৷ অফিস থেকে ক্লান্ত শরীরে বাসায় আসে মেহের। আয়াত, কাসফি এতক্ষণে বাসায় এসে গেছে৷ মেহেরের বাবা আর চাচা গেছেন কোনো এক কাজে। মেহের নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গেলো। নিজের জন্য এক কাপ কড়া চা করে নিল। মাথা ব্যাথা করছে তার। মাথা ব্যাথা হলে লিকার বেশি দিয়ে অনেকক্ষণ জাল দিয়ে চা তৈরি করে মেহের। তবে তাতে চিনি দেয় না। তার ধারণা চিনি দিলে কড়া ভাবটা চলে যাবে আর এটি একটি অতি সাধারণ চায়ে পরিণত হবে। তাই চিনি ছাড়া লিকার বেশি সাথে অনেকটা সময় ধরে জাল দেওয়া গরম গরম চা খেলেই বোধহয় তার মাথা ব্যাথা কমবে এটাই তার ধারণা। তবে এটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত এটার কোনো ধারণা নেই, এটা মেহেরের নিজস্ব ধারণা বলা যায়। চুলায় চা বসিয়ে আরেক চুলায় এক প্যাকেট নুডলস বসালো মেহের। মাহি তার নানুর সাথে খেলছে। আসার সাথে সাথে আগেই নিজের মেয়ের খবর নিয়েছে সে৷ মাহিকে খেলতে দেখে নিজের ঘরে চলে যায় সে। নুডলস আর চা হয়ে গেলে একটা বাটিতে নুডলস আর একটা কাপে চা নিয়ে উপরে চলে গেলো মেহের। কাসফির ঘরের সামনে এসে দরজা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো। মেহের ভেতরে গিয়ে দেখে কাসফি বারান্দায় বসে আছে। হাতের ট্রে টা খাটের এক সাইডে রেখে সে নিজেও বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো। কাসফি কে ডাক দিয়ে মেহের বললো,
“কাসফি আছিস?”
বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো কাসফি একটা ছোট্ট চারাগাছ এনেছে। সেটাই তার বারান্দায় রাখছে৷
“আরে আপু তুমি কখন এলে? এই দেখো আয়াত ভাইয়া আজ স্কুল থেকে আসার পথে আমাকে কি কিনে দিয়েছে, একটা গোলাপ গাছের চারা। কি সুন্দর না! একটা ছোট কলিও আছে। ভাইয়া বলেছে দুই একদিনের মাঝেই কলিটা ফুল হয়ে যাবে। আর যত্ন করলে এই গাছে আরও অনেক ফুল ফুটবে।”
মেহের কাসফির কাছে গিয়ে বসে দেখলো কাসফি খুব যত্নে গাছটাকে এক কোণায় রেখে দিয়েছে৷ মেহের কাসফির মাথায় হাত রেখে বললো,
“খুব সুন্দর গাছটা। এখন উঠে চল আমার সাথে তোর জন্য গরম গরম নুডলস বানিয়েছি। হাত ধুয়ে খেয়ে নিবি। আর তোর ফুল গাছ খুব পছন্দ নাকি? কই আমাকে তো কখনো বলিস নি?”
কাসফি উঠে দাঁড়ায় আর ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে,
“তোমায় কি করে বলি একটু বলবা, যেই রাগী মুড নিয়ে সারাদিন থাকো কিছু বলতেও ভয় করে। তাই আগে ডেইলি তোমার সাথে বাসায় আসলেও কিছুই বলা হত না।”
কাসফি ওয়াশরুমের ভেতর গিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে খাটের সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে পরলো। মেহেরও তার পাশেই বসলো। মেহের চায়ের কাপে চুমুক দিলো বার কয়েক। আর কাসফি খুশি মনে নুডলস খেতে লাগলো। মেহের কাসফির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
“আমি কি খুব রাগ দেখাই তোর সাথে?”
“রাগ দেখাও বলি নি তো রাগ রাগ মুড নিয়ে সবসময় থাকো। তুমিতো আমাকে বকও না। কিন্তু এদিকে আয়াত ভাইয়া আমাকে বকাবকি করে কিন্তু রাগী মুডে থাকে না। সবসময় হাসাতে থাকে।”
“ওহ।”
“আপু তুমি কি রাগ করলে?”
“কই নাতো রাগ করবো কেনো!”
“আর আমিতো আয়াত ভাইয়ার কাছেও গাছের কথা বলি নি, যে কিনে দিতে। কিন্তু ভাইয়া নিজে থেকেই আমাকে নার্সারি নিয়ে গেছিলো তারপর আমি খুব খুশি হয়ে যাই। তারপর ভাইয়া এই গাছটা কিনে দিয়েছে। তারপর বলেছে এটা যদি যত্ন করে বড় করতে পারি তাহলে আরও কয়েকটা কিনে দিবে৷ ভাবতে পারো আপু আমারও একটা বাগান বারান্দা হবে৷ আমিতো সেই এক্সাইটেড। জানো তো আমি আমার গোলাপের চারার খুব যত্ন করব যাতে ভাইয়া আরও কয়েকটা কিনে দেয়। আর তুমি রাগ করো না আমি তোমাদের দুইজনকেই খুব ভালোবাসি।”
মেহের কথা না বাড়িয়ে চায়ে দ্রুত চুমুক দিতে লাগলো৷ চা শেষ করে কাসফিকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর না গ্রামে যাওয়ার আগে এক্সাম হয়েছিল, ওইটার রেজাল্ট দিয়েছে কি?”
কাসফির মুখটা ছোট হয়ে গেলো, মুহূর্তেই হাসি মুখটা কালো মেঘে ঢেকে গেলো। মেহের কাসফির দিকেই তাকিয়ে ছিল।
“আজ তোদের স্কুলের ক্লাস টিচার কল দিয়েছিল আমাকে। তোর রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছে। আগেও যে ভালো ছিল তা নয়, তবে এবার তুলনামূলক অনেক খারাপ হয়েছে৷ তুই নিনেই জানিস তোর রেজাল্টের কি অবস্থা আমাকে আর বলতে হবে না। বাসায় এসে কাউকে বলেছিস তোর রেজাল্ট দিয়েছে?”
“ইয়ে মানে না আপু। সবাই খুব বকবে।”
“বকার ভয়ে বাসায় তোর রেজাল্টের কথা বলবি না, এটা কেমন কথা। আর রেজাল্ট খারাপ হলো কেনো আমাকে বল, তোকে সবকিছু আগে আগে এনে দেওয়া হচ্ছে। টিচারের গাইড হতে শুরু করে বই। কোনটার কমতি নেই। তাহলে খারাও কেন হলো৷ একটু মনোযোগ দে পড়ায়। আমাদের সবার অনেক আশা তোকে নিয়ে। আমি চাই না তোকে বকা দিতে, তবুও তোর এই অবস্থা দেখে বলতে হচ্ছে। আর শোন আয়াতকে ফলো করিস সব ব্যাপারে। আয়াত কি করে না করে ওকে ফলো করে চলিস ভালো কথা, কিন্তু ওর যেই দিকগুলো বেশি ভালো সেদিক গুলো অনুসরণ করলে বেশি খুশি আমি হব। ও কখনো স্কুল কলেজে খারাপ রেজাল্ট করেনি, তোর মতো বাসায় রেজাল্ট লুকিয়ে বেড়ায় নি।”
“আপু আমি সত্যি খুব ভালো করে পড়ব। তুমি প্লিজ কাউকে বলো না।”
“ঠিক আছে।”
বলেই ট্রে হাতে নিয়ে মেহের কাসফির ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো৷ আয়াত নিচে মোবাইল হাতে নিয়ে নামতে নামতে দেখলো কাসফি মন খারাপ করে নিচে বসে আছে। আয়াতের খটকা লাগলো কিছুটা। যে কিনা স্কুল থেকে আসার পর এত খুশি ছিল গাছের চারা পেয়ে তার এখন মন খারাপ। আয়াত ঘরের মধ্যে ঢুকে কাসফির মাথায় চাটা মেরে বিছানায় শুয়ে বললো,
“কিরে পিচ্চি মন খারাপ কেনো, কেউ বকেছে?”
কাসফি আয়াতের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বকেছে আবার বকেনি এই ধরনের আর কি।”
“দুইটা আবার একসাথে কি করে হয়!”
“এসব তুমি মেহের আপু থেমে শিখে নিও। সে তো এসবে এক্সপার্ট।”
আয়াত কাসফির কথা শুনে জোরে হেসে বললো,
“মানে মেহের বকেছে। কিন্তু কেন?”
কাসফি চুপ করে বসে আছে। কোনো উত্তর দিচ্ছে না। কাসফিকে চুপ থাকতে দেখে আয়াত কাসফির সামনে বসে বললো,
“তারমানে তুই কিছু করেছিস। কিন্তু হঠাৎ আবার কি করলি যে মেহের তোকে বকলো।”
“জানো ভাইয়া অফিস থেকে এসে আমার জন্য নুডলস বানিয়ে আমার ঘরে নিয়ে এসেছে। তারপর আমাকে আদর করে খাওয়ালো, আমার চারাগাছের প্রশংসা করলো বললো অনেক সুন্দর। এসব বলার পর, আমার খাওয়া শেষ হওয়ার পর নিজের আসল রূপে ফিরে এলো।”
“আসল রূপে ফিরে এলো মানে?”
হাসতে হাসতে বললো আয়াত।
“আসল রূপ মানে রাগী রাগী মুডে ফিরে এলো।”
“সব বুঝলাম কিন্তু হঠাৎ এমন কি হলো যে মেহের তার রাগী মুডে ফিরে এলো?”
“তুমি আবার বকবে নাতো আমাকে?”
“একদম না। আমি তোর ওই মেহের আপুর মতো নির্দয় নাকি যে রাগ দেখাব।”
“গ্রামে যাওয়ার আগে আমার একটা এক্সাম হয়েছে না, ওইটার পরশু রেজাল্ট দিয়েছে। কিন্তু আমি কাউকে বলি নি। আজ মনে হয় আমাদের ক্লাস টিচার আপুকে কল দিয়ে বলে দিয়েছে তাই তো এত খাইয়ে দাইয়ে রাগ দেখিয়ে শাষিয়ে গেলো৷”
“তোর কথা শুনে আমার খালি হাসি পাচ্ছে৷ তবে এটা বুঝা হয়ে গেছে পিচ্চির রেজাল্ট ভালো হয়নি। আমি ঠিক বলছি তো?”
“আমি কি করব ভাইয়া তুমিই বলো আমার যদি পড়ায় মন না বসে।”
“আমার কাছে তোর জন্য একটা বড়সড় অফার আছে।”
“কি অফার!”
“যদি তুই এবারের এক্সামে ৭০% নাম্বারও তুলিস তাহলে তোকে আমি একটা বিড়াল কিনে দিব। আর সেটা রেজাল্ট যেদিন দিবে সেদিনই।”
কাসফির চোখ মুখে হাসি ফুটে ওঠে বিড়ালের কথা শুনে। সে উৎফুল্ল হয়ে বলে,
“সত্যি ভাইয়া তুমি আমাকে একটা বিড়াল এনে দিবে!”
“হুম, তবে ৭০% নাম্বার আসার পর। এর কম আসলে তো দিব না। এখন যা সন্ধ্যা হয়ে আসছে পড়ার প্রস্তুতি নে।”
“আচ্ছা ভাইয়া, এবার দেইখো সত্যি সত্যি আমি ৭০% এর উপর নাম্বার আনব। আমাদের সব ফ্রেন্ডদের কিছু না কিছু পেট আছে। কারো বিড়াল, কারো বা পাখি। অনেক কিছু। শুধু আমারই নেই। এবার আমি নাম্বার বেশি পেলে আমারও একটা বিড়াল হবে।”
“হুম। সেটাই। এবার যা পড়তে বস।”
তারপর আয়াত নিজের ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। নিচে এসে দেখে মেহের মাহিকে নিয়ে বসে আছে আর মেয়ের সাথে টুকটাক কথা বলছে। মাহি তার মায়ের সাথে কথা মিলিয়ে মিলিয়ে কথা বলছে আবার মাঝে মাঝে জবাব দিচ্ছে৷ আয়াত বসার ঘরে তার মাকে আর চাচীকেও দেখতে পেলো। তাদের মাঝে গিয়ে বসে বলে,
“মা আমার একটু আসতে দেরি হবে। আর বন্ধুদের সাথেই খেয়ে আসব। তাই তোমরা আমার জন্য অপেক্ষা করে থেকো না। আর বাসার চাবি তো আমার কাছেই আছে তাই জেগে থাকার দরকার নেই। আমি নিজেই লক খুলে আসতে পারব৷ দেরি হলে টেনশন নিও না।”
“তবুও বাবা তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করিস।”
“তাড়াতাড়ি আসতে পারব না বলেই তো বলে যাচ্ছি তাই না মা। তোমরা খালি চিন্তা করো।”
বলেই আয়াত মেহেরের দিকে তাকালো। মেহেরও তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। আয়াত মাহির কাছে গিয়ে কোলে নিয়ে গালে আদর দিয়ে বেড়িয়ে গেলো।
রাত প্রায় দেড়টার উপরে বাজে। আয়াতের এখনো আসার নাম নেই। সে দেরি করে আসবে বলেই গেছে তাই বাসার সবাই ঘুমিয়ে গেছে হয়তো। মেহের নিজের ঘরেই বসে একটা বই পড়ছিল। কয়েকবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে অনেক রাত হয়ে গেছে কিন্তু আয়াত এখনো আসেনি। চিন্তা করতে মানা করলেও তার চিন্তা হচ্ছে৷ আরও ঘন্টা খানেক পর বাইকের শব্দ শুনে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো মেহের। আয়াত এসেছে। আয়াত নিজেই বাসার লক খুলে ভেতরে ঢুকে। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে ছাদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় মেহের পেছন থেকে ডেকে উঠে,
“এত রাত অবদি কোনো ভদ্র ঘরের ছেলেরা বাইরে থাকতে নেই। বাবা আর চাচা শুনলে ব্যাপারটা নিয়ে খুব মন খারাপ করবেন। এভাবে আর রাত বিরাতে বাসায় আসবেন না। চেষ্টা করবেন আরও তাড়াতাড়ি আসার।”
মেহেরের কথা শুনে আয়াত পেছনে ফিরে তাকালো মেহেরের দিকে।
চলবে,,,,