#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২৮
#Writer_Fatema_Khan
“জীবনে চলার পথে আমরা অনেক কিছুর সম্মুখীন হই। এই যেমন ধর শিশুরা যখন প্রথম হাটতে শিখে তারা তো প্রথমেই হাটা শিখে যায় না। প্রথম দিকে হোচট খায়, ব্যাথা পায়, তারপর আবার চেষ্টা করে। পূনরায় আবার হোচট খায়। তাই বলে কি তারা হাটা ছেড়ে দিবে? কখনোই না। তখন তাদের হাতটা ধরে হাটা শেখায় তাদের মা কিংবা বাবা। শিশুরা তাদের মা বাবার হাতটাকে বিশ্বাস করে আকড়ে ধরে, কারণ তারা জানে এই হাত তাদের ধোকা দিবে না। ঠিক তেমনি আয়াত তোর জীবনে বিশ্বস্ততার আরেক নাম। আয়াত আগে থেকেই তোকে ভালোবাসে বলেই তোর খুশি চেয়ে দূরে সরে গেছে। এখন যখন তুইও একবার হোচট খেয়ে পরেই গেছিস বিশ্বাসের সাথে আয়াতের হাতটা ধরাই যায়। আমার পূর্ণ আস্থা আছে আয়াতের উপর। আর এভাবে হাল ছেড়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না, নিজের জীবনকে আরেকটা সুযোগ দে। তোর জীবনের সাথে তুই একা না মা সাথে মেহেরের জীবনও জড়িয়ে আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো ছেলেটা অপেক্ষা করে আছে এই বুঝি তুই তাকে ভালোবেসে আগলে নিবি। এভাবে ছন্নছাড়া জীবন যাপনের ছেয়ে একটু ভেবে দেখ অনেক সুখ তোদের জীবনে অপেক্ষা করছে। যা হাত দিয়ে কুড়িয়ে নেওয়ার পালা শুধু। আর যদি তুই বয়স নিয়েও ভেবে থাকিস সেটা নিয়ে আমাদের কারোই কোনো মতবিরোধ নেই, আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আয়াতের নিজের কোনো সমস্যা নেই। তাহলে সেখানে ভাবনার কি আছে! মাত্র তো দুইটা বছর সে এমন কি বেশি বল। আর সমাজের কথা ভেবে থাকলে এই ব্যাপারে আমি আর তোর চাচাও ভেবেছি। যেখানে আমার মেয়ে এতগুলো বছর কষ্ট করেছে সেখানে সমাজ কথা বলতে আসে নি তাই এখন আসলেও আমরা এসবে কান দিব না। আর এদের কোনো অধিকারও নেই কারো ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপ করার। কিছুদিন ভেবে দেখ তোর মন কিসে সায় দেয়, তোর উপর কারো জোর নেই। না আমরা তোকে কোনো সিদ্ধান্তে জোর করব আর না আয়াত করবে। তুই সময় নে কিছুদিন, নিজেকে বুঝার চেষ্টা কর। দেখবি তোর মন ভালো কিছুর আভাস দিবে। আরেকটা কথা আয়াত শুধু আমাদের সামনে না তোর সামনেই থেকেছে ছোটকাল থেকে তাই তোর জানা আছে সে কেমন। বাকিটা তুই ভালো বুঝিস। অনেক রাত হলো ঘুমিয়ে পর, মাহি না হয় আজ আমাদের সাথেই ঘুমিয়ে পরুক।”
গতকাল রাতে বাবার বলা কথাগুলো বারবার কানে বারি খাচ্ছিলো। মেহের চোখ বন্ধ করে রাখে কিছুক্ষণ। সে ভাবনায় মগ্ন। উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রিলে হাত রেখে কপাল ঠেকিয়ে দেয় লোহার গ্রিলে। আজ অফিস যায় নি তাই আরও মনমরা লাগছে তার। হাতে থাকা মুঠোফোনটার লক খুলে আয়াতের নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে আছে।
“আচ্ছা একটা কল কি দিব? কি করছে, এখন জ্বর আছে কিনা এসবও জানা নেই। ছেলেটা এমন কেনো, নিজের ভালো নিজে বুঝতে পারে না। থাক এখন আর কল দিব না হয়তো ব্যস্ত থাকবে।”
এই ভেবেই আবার মোবাইলটা লক করে দিলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। জ্বলজ্বল করছে চারিপাশ, রোদ্র যেন উপচে পরছে। এই কয়দিনের বৃষ্টির পর আবার পৃথিবী আগুনের মতো উত্তাপ দিচ্ছে। ওড়নার এক কোনা দিয়ে কপালের আর গলার ঘাম মুছে আবার মোবাইলটা হাতে নিলো মেহের।
অনেকক্ষণ ধরে আয়াতের ফোন বেজেই যাচ্ছে, কিন্তু আয়াত এখনো ওয়াশরুম থেকেই বের হয়নি। বিরক্ত হয়েই আহনাফ উঠে মোবাইলটা হাতে নেয়। স্ক্রিনের উপরের নাম্বার সেইভ করা নেই তাই মুখের ভঙ্গিমা কিছুটা বিকৃত করেই কল রিসিভ করলো আহনাফ। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠস্বরে বলে উঠলো,
“ভাইয়া তোমার নাকি জ্বর, এই জ্বরের ভেতর কেনো ঘুরতে গেলে? নিজের একটু খেয়াল তো রাখা দরকার। আচ্ছা খালামনির কেমন লাগে বলো তুমি যদি এমনটা করো?”
ওইপাশে থাকা রমনীর গলার শব্দ শুনেই আহনাফের কথা বন্ধ হয়ে গেছে সেই অনেক আগেই। কানে মোবাইল রেখে চুপ করে তার কথা শুনে যাচ্ছে আহনাফ। যেনো জবাব দিলেই এই মিষ্টি কন্ঠের কথা আর শোনা যাবে না। আয়াত ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আহনাফকে এভাবে দেখে ভাবে কে কল করলো আহনাফ কথাই বলছে না। তাই এগিয়ে গিয়ে কাধে হাত রাখলো। আহনাফকে চোখ দিয়ে প্রশ্ন করলো কে কল দিয়েছে? আহনাফ কথার উত্তর না দিয়ে আয়াতকে মোবাইল দিয়ে বিছানায় বসে পরলো। আয়াত ভ্রু কুচকে তাকায় আহনাফের দিকে। কিছু না বুঝে কানে মোবাইল রেখে জিজ্ঞেস করে,
“কে?”
“এতক্ষণ পর জিজ্ঞেস করছো আমি কে? ভাইয়া আমি আনিকা।”
আনিকা কল দিয়েছে বলে আহনাফ এমন হাসফাস করছে দেখে আয়াতের ভ্রু জোড়া আরও সংকুচিত হলো। কিছুক্ষণ আনিকার সাথে কথা বলে আয়াত ফোন রেখে দেয়। তারপর চুল মুছতে মুছতে আহনাফের দিকে এগিয়ে যায়।
“কিরে তোর আবার কি হলো! ঠিকই তো ছিলি হঠাৎ করে এমন দেখাচ্ছে কেনো?”
“কই নাতো, সব ঠিক আছে।”
“আনিকা কি তোকে কিছু বলেছে?”
“না তোর বোন তো জানেই না আমি কল রিসিভ করেছিলাম তুই না। সে নিজের মতো বকবক করেই গেছে। আর তোর ফোনে তোর বোনের নাম্বারই সেইভ নেই কেনো?”
“আসলে দেশে আসার পর কারো নাম্বারই সেইভ করা হয়ে উঠে নি। যাদের গুলো খুব জরুরি তাদের গুলাই করেছি।”
“আচ্ছা। এক কাজ কর একটু রেস্ট নে, তারপর সবাই খাওয়া দাওয়া করে কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে বের হব।”
“হুম একটু রেস্ট নেওয়া দরকার। এমনিতেও জ্বর থেকে উঠেছি সবেমাত্র, এখনো শরীরের দূর্বলতা কাটে নি।”
আয়াত হাতে থাকা টাওয়েল টা ছড়িয়ে দিয়ে আহনাফের পাশে শুয়ে পরলো।
মেহের ছাদে আসলো আছরের নামাজ আদায় করে। ছাদে তেমন একটা আসা হয় না মেহেরের। কারণটা হলো আয়াত। আয়াতের জন্যই মূলত মেহের ছাদে আসে না। তবে আজ আয়াত বাসায় নেই তাই মেহের ছাদ টা ঘুরে ঘুরে দেখছে। ছাদে কাসফির লাগানো অনেক গাছ আছে। যেগুলোতে রোজ কাসফি এসে পানি দেয়, আগাছা পরিষ্কার করে, খুব যত্ন নেয়৷ এখানের বেশির ভাগ গাছই আয়াতের কিনে দেওয়া। কিছু গাছে ফুল ধরেছে কিছুতে ধরেনি। আকাশটাও আজ রক্তিম আভা দিয়ে সূর্য অস্ত যাবার জন্য প্রস্তুত। মেহের ছাদে থাকা একটা বালতি আর মগে পানি নিয়ে গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেলো। এসব গাছে কাসফি আর আয়াতই পানি দেয়। আজ ওদের দুইজনের একজনও নেই তাই মেহের ভাবলো সে ই না হয় দিয়ে দিবে। মেহের সবগুলো গাছে পানি দেওয়া শেষ হলে ছাদের এক সাইডে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা শীতল হাওয়ার সাথে এই একাকিত্ব তাকে ভেতর থেকে স্পর্শ করছে খুব। চোখ বন্ধ করেই তার বাবার কথা, মায়ের কথা, আয়াতের আবেগের কথাগুলো তার কানে বাজছে।
“আপু এখানে একা একা কি করছো, আর আমি কিনা তোমায় পুরো বাড়ি খুঁজে বেরাচ্ছি৷”
কাসফির হঠাৎ করে ডেকে উঠায় চমকে পাশে তাকায় মেহের। কাসফিকে দেখে হেসে তাকে কাছে টেনে নেয়।
“কিছু করছিলাম না। তোর গাছগুলো দেখছিলাম আর তাতে পানি দিয়ে দিয়েছি৷ তারপর একটু শীতল হাওয়ায় দাড়ালাম৷ তা আমাকে খুজছিলি কেনো?”
“আপু তুমি কত ভালো। আমার গাছগুলোতে পানি দিয়ে দিয়েছো। আসলে আয়াত ভাইয়া থাকতে তো ভাইয়াই দিয়েছে। কিন্তু দুইদিন ভাইয়ার জ্বর আর আজ তো ভাইয়াই নেই তাই এই কয়দিন দেওয়া হয় নি৷ আর আজ তুমি দিয়ে দিলে৷”
“আচ্ছা নিচে চল।”
“আরেকটু থাকি, তারপর যাই।”
মেহের আর কিছু বললো না। কাসফির সাথে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ পরিবেশ দেখছে। সচরাচর নিজের বারান্দা থেকে যতটুকু দেখা যায় ততটুকুই দেখে। কিন্তু আজ পুরো অন্তরীক্ষ তার সামনে। এই দুইদিন ঠান্ডা ভাব কমে আবার গরমের দিকে পদার্পন করেছে। ভ্যাপসা গরমে কপাল, গলা, নাক ঘেমে গেছে মেহেরের। আকাশে সাদা মেঘ ঘুরে ঘুরে বেরাচ্ছে। তবে বৃষ্টি হওয়ার আশংকা নেই বললেই চলে।
“আপু আয়াত ভাইয়ার ঘরে যাবে?”
এমন ধরনের কথায় মেহের চোখ বড় বড় করে তাকালো কাসফির দিকে।
“এগুলো কি ধরনের কথা কাসফি! কারো ঘরে যাওয়ার আগে তার থেকে পারমিশন নিতে হয়। কিন্তু আয়াতের অবর্তমানে তার ঘরে ঢুকা একদম উচিত না। চল নিচে চল।”
বলেই কাসফির হাত ধরে নিচে চলে গেলো মেহের। সূর্য ডুবেছে সে আরও কিছুক্ষণ আগেই। আকাশে গোল চাঁদটাও উঠে গেছে। কাসফিকে তার ঘরে দিয়ে মেহের নিজের ঘরে গেলো। অফিসের কাজ করতে বসে পরে মেহের। আজ সারাদিন বাসায় থেকে মা আর চাচীর সাথে গল্প গুজব, কাজে সাহায্য করা আর মাহিকে নিয়ে খেলা করা এসব নিয়েই ছিলো। অফিসে যায় নি তাই অনেক কাজ পেন্ডিং রয়ে গেছে৷ তবে মেহেরের আজ সবচেয়ে খারাপ লাগছে তার চাচীকে দেখে। যতই সবার সামনে হাসিখুশি থাকুক না কেনো উনি যে মনে মনে আয়াতকে নিয়ে চিন্তিত তা তার হাসির মাঝে মন খারাপটা দেখেই বুঝা যায়। এতদিন অফিস নিয়ে পরে থাকাতে মেহের খেয়াল না করলেও আজ সারাদিনে তার বুঝতে অসুবিধা হয় নি। তাই হয়তো মেহেরের মাও মেহেরকে আয়াতের ব্যাপারে সারাক্ষণ বলতে থাকে। আসলে দুইজন সারাদিন একসাথে সময় কাটায়, বোনের থেকেও বেশি গভীর সম্পর্ক তাদের। একজনের কষ্টে আরেকজন যে কষ্ট পাবে স্বাভাবিক। মেহের বড় একটা শ্বাস ফেলে সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো৷ রাতের ভেতর অনেকগুলো কাজ শেষ করতে হবে, কিছু ফাইলও রিচেক করতে হবে। রাতের জন্যই সব ফেলে রেখেছে মেহের। এখন কাজ শেষ না করলে কাল অফিসে বসে বসে কাজ করতে হবে। প্রায় ৩ ঘন্টার মত কাজ করে উঠে দাঁড়ায় মেহের। নিচে গিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে আবার ঘরে এসে কাজে মনোযোগ দেয় মেহের। কিছুটা রিফ্রেশমেন্টের জন্যই চা বানিয়ে আনা। না হলে একঘেয়েমি লাগবে। আরও ঘন্টা খানেক কাজ করার পর নিচে থেকে ডাক পরলো খেতে যেতে। এর ভেতর মেহেরের কাজও শেষ। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে যায় রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। রাতের খাবার শেষ সবারই, কিন্তু টেবিল ছাড়ে নি কেউ এখনো। মেহের সবার উদ্দেশ্যে বললো,
“বাবা, চাচা তোমাদের সবার সাথে কিছু কথা ছিল। খাবার পরে যদি কিছুক্ষণের জন্য বসার ঘরে সবাই বসতে তাহলে আমি কিছু কথা বলতাম।”
মেহেরের চাচা চিন্তার রেখা কপালে এনে বললো,
“কি হয়েছে আম্মু, জরুরি কোনো কথা নাকি! এভাবে সবাইকে থাকতে বলছো।”
“জি চাচা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা না হলে এত রাতে সবাইকে থাকতে বলতাম না।”
চলবে,,,,,