#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২৪
#Writer_Fatema_Khan
আয়াতের ঘরের দরজার সামনে এসে কয়েকবার কড়া নাড়লো মেহের৷ কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই। আরও দুইবার কড়া নাড়তেই আয়াত বললো,
“মা আমার খিদে নেই। আমাকে ঘুমাতে দাও।”
মেহের এবার বললো,
“আয়াত আমি এসেছি দরজাটা খুলুন।”
মেহেরের গলার আওয়াজ শুনে আয়াত ঘরের দরজা খুলে দিলো। দরজা থেকে সরে গিয়ে বিছানায় বসলো। মেহের ভেতরে ঢুকে টেবিলের উপর খাবারের প্লেট টা রেখে আয়াতের উদ্দেশ্যে বললো,
“আজ বাসায় আসার পর নিচে আসেন নি কেনো? চাচী কয়বার করে ডেকে গেলো খাওয়ার জন্য। তবুও আসলেন না। এটা মোটেও ঠিক না। চাচী আপনার মা তার চিন্তা হয়। এখন এই নেন খাবার টুকু শেষ করেন জলদি।”
আয়াতের দিকে তাকিয়ে দেখে সে চোখ বন্ধ করে নিচে তাকিয়ে আছে। মেহের এগিয়ে এসে বলে,
“কি হলো উঠুন, খেয়ে নিন আমাকে আবার নিচে যেতে হবে। চাচী নিজেই আসতে চেয়েছিল কিন্তু গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে এখনো বাইরে তাই চাচীকে বারণ করে আমিই আসলাম।”
প্লেট টা খাটের উপর রাখলো মেহের। আয়াত এখনো চোখ উপরে তুলে তাকায় নি। মেহের আয়াতের হাত ধরে উঠাতে চাইলে আতকে উঠে। চোখ বড় বড় করে আয়াতের কপালে গালে ছুয়ে দেখলো।
“একি আয়াত আপনার তো গায়ে প্রচন্ড জ্বর এসেছে। আর এই জ্বর নিয়ে আপনি কিনা ঘরের দরজা আটকে বসে আছেন।”
মেহের বেসিন থেকে হাত ধুয়ে আয়াতের সামনে বসে প্লেট হাতে নিয়ে এক লোকমা ভাত ধরে আয়াতের মুখের সামনে। আয়াত ভ্রু কুচকে মেহেরের দিকে তাকায়।
“আমার দিকে পরে তাকালেও হবে, এখন খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন।”
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না আর সবচেয়ে বড় কথা আমার খিদেই নেই। তুমি নিচে যাও মেহে..”
আয়াতের কথা সম্পুর্ণ হওয়ার আগেই তার মুখে খাবার পুরে দিলো মেহের। না চাইতেও আয়াত খেয়ে নিলো। তবে সব খাবার শেষ করতে পারলো না। অল্প কিছু ভাত খেয়েই আর খেলো না আয়াত। মেহেরও আর জোর করে নি। হাত ধুয়ে এসে টেবিলের ড্রয়ারে ওষুধ খুজতে লাগলো। জ্বরের দরুন কিছু না খাওয়ার ফলে শরীর খুব দূর্বল হয়ে পরেছিল। এখন খাওয়ার ফলে কিছুটা ভালো লাগলেও অনেক জ্বর গায়ে। আয়াত চোখ তুলে মেহেরের দিকে তাকালো। বেশকিছু সময় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে অনেকটাই ভিজে গেছে মেহের।
“তুমি নিচে যাও মেহের তোমার কাপড় অনেকটাই ভিজে গেছে। আবার ঠান্ডা লেগে যাবে। আমি ঠিক আছি।”
“কি যে ঠিক আছেন তা তো দেখতেই পাচ্ছি। চোখ অবদি ভালো করে খুলে রাখতে পারছেন না। এখন চুপ করে বসে থাকেন। আমি নিচে গিয়ে আমার ঘর থেকে ওষুধ নিয়ে আসছি।”
মেহের তাড়াতাড়ি নিচে চলে গেলো। নিজের ঘরে এসে ওষুধের বাক্সটা নিয়ে আবার ছাদের দিকে হাটা ধরলো৷ আজ আকাশ নিকষ কালো। চাদের লাইট না জ্বললে হয়তো পরিবেশটা এখন অনেকটা ভূতুড়ে টাইপ হতো৷ মেহের প্লাস্টিকের ওষুধের বাক্সটা মাথার উপর দিয়ে আয়াতের ঘরে আবার ঢুকলো৷
“বৃষ্টি বেড়ে গেছে আবার, কেনো খামখা আবার ছাদে আসতে গেলে?”
“আপনার অবস্থা দেখেছেন, জ্বরে পুরাই কাবু হয়ে গেছেন। আবার বলছেন আমি খামখা এখানে এসেছি৷ তবে সাথে একটা ছাতা নিয়ে আসতে ভালো হতো৷ যাওয়ার সময় কাজে দিত। কি আর করার তাড়াহুড়োয় ছাতার কথা মাথাতেই আসে নি। যাক গে এই নিনি ওষুধ। খেয়ে ঘুমিয়ে পরেন তাড়াতাড়ি। তাহলে জ্বর সেড়ে যাবে।”
“তুমি আর আমি এক ঘরে একা আছি আর তুমি ভাবছো আমি ওষুধ খেয়েই ঘুমিয়ে যাব। ঘুমের ওষুধ খেলেও এখন ঘুম আসবে কিনা সন্দেহ আছে আমার।”
আয়াতের এমন ঠোঁট কাটা কথাত অপ্রস্তুত হয়ে পরে মেহের। আর কথা না বাড়িয়ে ওষুধ গুলো আয়াতের হাতে দিয়ে এক গ্লাস পানি দিলো সে৷ আয়াতও আর কথা বাড়ায় নি। চুপচাপ ওষুধ খেয়ে নিলো। আয়াত উঠে দাঁড়ায় তারপর মেহেরের হাত ধরে খাটের উপর বসায়। চেয়ারের উপর থাকা টাওয়েলটা নিয়ে মেহেরের ভেজা চুলগুলো মুছে দেয় সে। মেহের কিছুই বলে না। মোছা শেষে আয়াত মেহেরের সামনে বসে পরে। মেহেরের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে,
“তোমাকে ভেজা চুলে অপরূপা লাগছে৷ এতটা স্নিগ্ধ আর নিষ্পাপ লাগছে কেনো তুমি জানো? তোমাকে এভাবে দেখে আমার যে নিষিদ্ধ চাওয়া গুলো জাগ্রত হয়।”
মেহেরের কান গরম হয়ে গেলো আয়াতের কথায়। এমন লাগামহীন কথা এর আগে আয়াত তার সাথে কখনোই বলে নি।
“তোমার প্রতি যখনই এমন নিষিদ্ধ চাওয়া গুলো জাগ্রত হয়েছে ততবার আমি তোমার থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছি। কারণ আমি তো জানি তুমি এসব একদম পছন্দ করো না। তাই আমিও এসবের ধারে কাছেই যাব না৷ এমনকি আজকেও না। তবে মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে তোমাকে জড়িয়ে ধরে তোমার গালে অনেক বড় একটা চুমু দেই। কিন্তু তুমি সারাদিন যেভাবে থাকো মনে হয় এখনই বুঝি কার উপর বোম ব্লাস্ট হবে। তাই এসব মাথায় আসলেও টুপ করে ফেলে দেই।”
আয়াতের কথা শুনে মেহেরের যেমন লজ্জা লাগছে, তেমনি অবাক হচ্ছে, সাথে অনেক হাসি পাচ্ছে৷ অন্য সময় হলে রাগ হত। কিন্তু এখন এযব আয়াত জ্বরের ঘোরে বলছে তা মেহের খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে৷ মেহেরের ভাবনার মাঝেই আয়াত মেহেরকে জড়িয়ে ধরে। মেহের কিছু বুঝে উঠার আগেই আচমকা জড়িয়ে ধরাতে মেহের আধশোয়া অবস্থা হয়ে যায়৷ আয়াতের ঠোঁট মেহেরের কানের কাছে। আয়াত মেহেরকে কি বলছে মেহের তা ভালো করে শুনছে।
“মেহের আমি সত্যি বলছি আরশির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ও আমাকে পছন্দ করে শুধুমাত্র। আর আজ এমন কিছু করবে তা আমার ধারণার বাইরে ছিলো। ভালোবাসা কি বুঝেছিই তো তোমার থেকে। সেখানে এতবছরে যখন কেউ জায়গা নিতে পারে নি, তাহলে আজ কি করে আরশি সেখানে জায়গা দখল করে নিবে৷ তুমি কি ভাবো আমি বুঝি না, তুমিও যে আমাকে ভালোবাসো৷ আমি সবকিছুই বুঝি তোমার মনে এখন কি চলে আর সেটা তুমি নিজেও জানো। কিন্তু মুখে স্বীকার করতে চাও না। না আমার কাছে আর না নিজের কাছে। তবে তোমার মনের কথা যদি আমিই বুঝতে না পারি তাহলে কেমন ভালোবাসি তোমাকে বলো৷ আজ তুমি কতটা কষ্ট পেয়েছো তা তোমার চোখে আমি দেখতে পেয়েছি। কিন্তু আমারই ভা কি করার ছিলো, এমন একটা পরিস্থিতিতে নিজের পক্ষে কি ই বা বলতাম আমি। তবুও তো বলার চেষ্টা কম করি নি, কিন্তু সেই তুমি আমাকে ভুল বুঝলে। এতে যে আমি আরও বেশি কষ্ট পেয়েছি। তার খবর কি তুমি রাখো প্রেয়সী। তুমি আমার এতটা কাছে যে আমার সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। কেমন যেনো লাগছে আমার। খুব ঘুম পাচ্ছে জানো তো।”
মেহের আয়াতের সব কথা মন দিয়ে শুনলো৷ মেহেরের নিজেরও খারাপ লাগছে আয়াতের ব্যাপারে সে একটু বেশিই করে ফেলেছে। আর তার জন্যই আয়াতের এত জ্বর এসেছে। মেহেরের ভাবনার মাঝেই মেহের কেপে উঠলো আয়াতের ছোয়ায়। আয়াত তার ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছে। তার শুকনো ঠোঁট জোড়া মেহেরের ঘাড়ে বিচরন করছে। মেহের সরে আসতে চাইলে আয়ার তাকে আরেকটু কাছাকাছি এনে জড়িয়ে ধরে। মেহেরের এবার অজানা ভয় কাজ করছে৷ এই মুহূর্তে আয়াত সুস্থ নয়, আর সে একটা ছেলের শক্তির কাছে খুবই সামান্য। ভয়ে আয়াতের বুকে হাত দিয়ে সরাতে যাবে এমন সময় আয়াত বললো,
“প্রেয়সী আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, খুব খুব খুব ভালোবাসি। প্লিজ আমাকে কখনো ভুল বুঝো না। তাহলে আমি যে সহ্য করতে পারি না। আমার সবকিছু এক মুহূর্তে শেষ হয়ে যায় তোমার অবহেলায়। ভালোবাসি প্রেয়সী।”
চলবে,,,,
#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২৫
#Writer_Fatema_Khan
মাহিকে ঘুম পাড়িয়ে নিচে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় মেহের। হাতে পানির বোতল৷ বোতলে পানি না থাকায় সেটাই পূর্ণ করতে নিচে আসতে হলো তাকে। পানি ভরে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে নিলেই শুনতে পায় তার মা আর বাবার কণ্ঠ। তার মায়ের কান্নামিশ্রিত কণ্ঠ শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
“আহা এত রাতে কান্না শুরু করে দিলে কেনো? আমার কি চিন্তা হয় না মেয়েটাকে নিয়ে? আমরা আর কতকাল আছি, আজ না হয় কাল বুড়ো বুড়ি আর থাকব না। কিন্তু মেহেরের কি হবে একা জীবন কি করে কাটাবে মাহিকে নিয়ে। কাসফিকে নিয়ে চিন্তা নেই আগে বড় হোক লেখাপড়া শেষ হলে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তারপর বিয়ে দিতে পারলেই হলো। কিন্তু মেহের যে একরোখা আর গম্ভীর নিজের কথার হেরফের করে না। একবার তো তবুও মুখে বলেছিল সে আয়াতের সাথে বিয়েতে রাজি, কিন্তু তারপর না আয়াত কথা বাড়ালো আর না মেহের। আমরাই বা কি করে বলতে পারি বলো, ছেলেটা তো আমাদেরই। এখন হয়তো আবেগে ভাসছে তাই মেহেরকে বিয়ে করতে চাইছে, কিন্তু আবেগ কেটে গেলে যদি মেহেরকে মেনে না নেয় তখন আমার ভেঙে যাওয়া মেয়েটা যে পুরোপুরি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সাহস নিয়ে নিজের ভাইয়ের কাছেও বলতে পারি না।”
“তুমি শুধু শুধু আয়াতকে নিয়ে ভাবছো। আমেনা আমাকে বলেছে আয়াত মেহেরের উপর পুরোপুরি দুর্বল, শুধুমাত্র তোমার মেয়ের এমন দূরে দূরে থাকার কারণে আয়াত নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে যাতে তোমার মেয়ের কষ্ট না হয়। আয়াত চায় না মেহেরের সাথে জোর করে কিছু হোক। সে মেহেরকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায় নাকি জোর করে। এমন সোনার টুকরো ছেলে কই পাব আমরা বলো? আর একবার ভুল মানুষ জীবনে আসলে কি মানুষ বেচে থাকা ভুলে যায়, না তাকে এগিয়ে যেতে হয় বাচতে হয় নিজের জন্য। নিজের চিন্তা না করুক অন্তত মাহির চিন্তা তো তোমার মেয়ে করতেই পারে। এই বাচ্চাটা কি সারাজীবন তার বাবার স্নেহ ভালোবাসা ছাড়াই বড় হবে, যখন জানবে তার মা চাইলেই তাকে একটা সুস্থ সুন্দর জীবন দিতে পারত তখন কি মাহি তার মাকে ক্ষমা করবে?”
“তুমি একটু ঘুমাও মেহেরের মা, এত চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমি না হয় ঘুমাব আর তুমি যে মেয়ের চিন্তায় রাতভর ঘরে পায়চারি করো সেই বেলায়।”
“কি আর করার মেয়েটাকে একটু সুখে দেখতে চাই। মেয়েটা যে অল্প একটু সুখ পেয়েই দুঃখেরঅথৈ সাগরে পরে গেছে।”
“হয়েছে আর কথা বলো না, এমনিতেই ওইদিন মাথা ঘুরে পরে গেছিলে অফিস থেকে আসার সময়। ছোট ভাইয়া না বললে তো জানতেই পারতাম না। সে ই তো বললো তুমি টেনশন করো কি নিয়ে আর ব্লাড প্রেশারটাও নাকি হাই। ছোট ভাইয়াও সেদিন তোমার অসুস্থতা দেখে বললো মেহেরকে একটু বুঝাতে। তাদের তো কোনো আপত্তি নেই শুধু মেহের রাজি হলেই আয়াত আর মেহেরের চার হাত এক করে দিত তারা।”
“কিছু ভালো লাগছে না মেহেরের মা লাইট টা বন্ধ করে দাও তো, দেখি এই দুই চোখে ঘুম এসে ভর করে কিনা?”
ঘরের লাইট বন্ধ হতেই মেহের আস্তেধীরে উপরে উঠে এলো৷ ঘরের দরজা বন্ধ করে খাটের উপর বসে পরে। গালে পরে থাকা নোনা পানি টুক মুছে নিলো সে।
“মা বাবা আমার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছে। আর আমি কিনা নিজের জেদ নিয়ে পরে আছি। যেখানে আমি নিজেও জানি আয়াতের প্রতি আমি ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পরছি। আজ আয়াতের অসুস্থতার কারণ আমি, বাবা মায়ের চিন্তার কারণ আমি, সবার ভেতর যে দোটানা কাজ করছে তার কারণও আমি। আমি চাইলেই আমার মেয়েকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে পারি কিন্তু আমি কিনা এসব না ভেবে একজনকে নিয়েই পরে আছি। যে কিনা আরও অনেক আগেই এগিয়ে গেছে, নিজের জীবনে সুখে আছে। তাও যখন আমি তার জীবনে ছিলাম তখন থেকেই। আর আমি কিনা সেই ছেড়ে যাওয়া জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি৷ সবার প্রতি অন্যায় করছি। অন্তত বাবা মায়ের কষ্ট আমার সহ্য হবে না। এতটা স্বার্থপর নই আমি।”
মাহির পাশে শুয়ে পরলো মেহের। গায়ের উপর কাঁথা টেনে মাহিকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো মেহের। আর কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবতে লাগলো। জ্বরের ঘোরে আয়াত তার কতটা কাছাকাছি ছিলো৷ আয়াত মেহেরের কাছে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি কতই সহজভাবে করছিলো। করতে করতে হঠাৎ চুপ করে যায়৷ মেহের আয়াতের পিঠে হাত দিয়ে আয়াতকে ডাকতে ব্যস্ত। কিন্তু আয়াতের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে জোরপূর্বক আয়াতকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। ততক্ষণে আয়াত ঘুমিয়ে পরেছে৷ জ্বরের জন্যই অনেকটা দূর্বল সে। তাই বসা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে গেছে৷ মেহের ধীরে বিছানায় শোয়ায় আয়াতকে। তারপর গায়ে হাত দিয়ে দেখে এখনো জ্বর কমে নি। তাই টেবিলের উপর থাকা একটা রুমাল আর বাটি নিয়ে পানি এনে অনেকক্ষণ জল পট্টি দিয়ে দেয়। তারপর একটা গামছা নিয়ে ভিজিয়ে আয়াতের হাত, গলা, মুখ আর পা মুছে দেয়। এখন শরীরের তাপমাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক। আয়াতের গায়ের উপর পাতলা কাঁথাটা টেনে বুক অবদি দিয়ে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে যায় মেহের৷ দরজা বাইরে থেকেই আটকে দেয় মেহের। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, বাতাসে যদি দরজা খুলে যায় তখন পানি এসে ঘরে প্রবেশ করবে তাই৷ আর এত রাতে আয়াতের ঘরে থাকাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। শত হলেও আয়াত একজন ছেলে তার ঘরে রাত্রি যাপন করা মেহেরের পক্ষে কখনোই সম্ভব না। তাই মেহেরের তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নেমে এলো। ছাদ থেকে নেমেই আবার রান্নাঘরে গেলো এটো প্লেট বাটি নিয়ে। সেগুলো রান্নাঘরের বেসিনে ধুয়ে আবার উপরে চলে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখে কাসফি আর মাহি দুইজন খেলা করছে। মাহিকে কোলে তুলে নিয়ে কাসফিকে ঘুমিয়ে পরতে বলে কাসফির ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো মেহের। নিজের ঘরে এসে মাহিকে ঘুম পাড়িয়েই নিচে পানি আনতে গিয়ে মা বাবার কথা শুনে নেয় মেহের৷ এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ লেগে আসে তার। আজানের শব্দে ঘুম উড়ে যায় তার। নামাজ আদায় করে খাটের উপর বসে। সেই সময় আয়াতের কথা মাথায় আসতেই নিচে গিয়ে স্যুপ বানায় সে৷ একটা স্যুপের বাটিতে স্যুপ নিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে যায় মেহের। ছাদে গিয়ে আয়াতের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সে। ঢুকেই আয়াতকে খাটের উপর মাথার চুল টেনে ধরে বসে থাকতে দেখে খুব অবাক হয় মেহের।
“একি আপনি এত সকাল উঠে বসে আছেন কেনো, আপনার এত জ্বর ছিলো রাতে আরেকটু বিশ্রাম নেওয়ার দরকার ছিলো। তা না করে এত সকাল সকাল উঠে বসে আছেন।”
“বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে গেছে কে?”
“ঘুমিয়ে ছিলেন আপনি, আর বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিলো তাই আমি ভাবলাম বাইরে বন্ধ না করলে ভেতরে পানি আসবে তাই আমিই বন্ধ করে গেছি।”
আয়াত মেহেরের চোখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়ায়। সামনে এসে বলে,
“কে বলেছিলো রাতে আমার ঘরে আসতে?”
“কেউ বলে নি। আমি শুনলাম আপনি বাসায় আসার পর থেকে কিছুই খান নি এমনকি নিচেও যান নি তাই আমি নিজে থেকেই খাবার নিয়ে এসেছিলাম।”
“আমার মতো চরিত্রহীনের জন্য এত দরদ না দেখালেও চলতো। যে কিনা বাসায় একজনকে ভালোবাসি বলে বলে মাথা খেয়ে ফেলে আর বাইরে গেলে অন্যজনের সাথে প্রেমলীলায় মেতে উঠে। তাই না মেহের।”
মেহেরের নত দৃষ্টি। আয়াতের চোখ রক্তিমা আবরণে ছেয়ে গেছে৷ সেই চোখের দিকে তাকাতে মেহের ভয় পাচ্ছে। আয়াত মেহেরের সাথে কখনোই এভাবে কথা বলে নি। শুধুমাত্র কাল মেহের তাকে বিশ্বাস করে নি বলেই আজ এভাবে কথা বলছে আয়াত। মেহের তবুও সাহস নিয়ে আয়াতকে পাশ কাটিয়ে খাটের উপর স্যুপের বাটি রেখে আয়াতের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর আয়াতের কপাল আর গলায় হাত ছুইয়ে দেখে জ্বর আছে কিনা। আয়াত বিরক্ত হয়ে মেহেরের হাত সরিয়ে দেয়।
“এখন জ্বর নেই আয়াত। আপনি হাত মুখ ধুয়ে নিন তারপর এসে গরম স্যুপটা খেয়ে নিন ভালো লাগবে। আর আজ ভার্সিটি যাওয়ার দরকার নেই। কাল পুরোপুরি সুস্থ হলেই যাবেন।”
“তোমার কথায় চলবে নাকি?”
“যদি বলি আমার কথাতেই চলবে, তাহলে কি শুনবেন না?”
মেহেরের এমন জবাবে আয়াত কি প্রতিত্তোর করবে তার জানা নেই। তাই সে হাত মুখ ধুতে চলে গেলো। হাত মুখ ধুয়ে খাটের এক কোণায় বসে পরলো। স্যুপের বাটি হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। মেহের এক দৃষ্টিতে আয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আয়াত মেহেরের দিকে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাকাচ্ছে না। স্যুপ শেষ করে বাটি টা আগের জায়গায় রেখে দেয় আয়াত৷ মেহের হাতে থাকা পানির গ্লাসটা আর তার সাথে কয়েকটা ওষুধ আয়াতের দিকে এগিয়ে দেয়। আয়াত সেগুলো নিয়ে খেয়ে নেয়। মেহের হাসি মুখে খাটের উপর থাকা স্যুপের বাটিটা নিয়ে টেবিলে রাখতে যায়। বাটি নেওয়ার সময় মেহেরের গলায় থাকা ওড়না কিছুটা সরে যায় আর আয়াতের নজর গিয়ে আটকায় মেহেরের গলার কাছে। আর সাথে সাথে চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। মেহের টেবিলের কাছেই ছিলো আয়াত তার হাত ধরে তার দিকে ফেরালে মেহের ভয় পেয়ে যায়। হঠাৎ করে টান দেওয়ায় মেহের আয়াতের হাতের দুই পাশে থাকা টি-শার্টটা আকড়ে ধরে।
“কি হচ্ছে কি আয়াত?”
চলবে,,,,