#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_১২
#Writer_Fatema_Khan
গাড়ি এসে থামলো একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। মেহের জোরপূর্বক আয়াতকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে। কারণ সকাল থেকে আয়াত এখন অবদি কিছুই খায় নি। আয়াত মুখে না বললেও মেহের ঠিক বুঝতে পেরেছে। মেহের আর আয়াত রেস্টুরেন্টে ঢুকে দুইজনেই কিছু খেয়ে নেয়। রেস্টুরেন্টে থাকাকালীন সময়ে বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়। আয়াত আর মেহের দুইজনে তাড়াতাড়ি গাড়িতে গিয়ে বসলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আয়াত একটা শপিং মলের সামনে গাড়ি থামায়।
“মেহের তুমি একটু বসো আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।”
“কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যে আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?”
“আসছি, শুধু মিনিট দশেক অপেক্ষা করো।”
মেহের আর কথা বাড়ালো না। আয়াতও আর কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলো। গাড়িতে মেহের বসে অপেক্ষা করছে। গাড়ির গ্লাস কিছুটা নামিয়ে নেয় মেহের। বৃষ্টির পানি ছিটকে তার মুখে পারছিল। মেহের চোখ বন্ধ করে তা অনুভব করছিল। বাইরে ভেজা মাটির গন্ধ যেনো তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাচ্ছে। বৃষ্টি বরাবরই মেহেরের পছন্দ। হঠাৎ গাড়ির শব্দে মেহের চোখ খুলে তাকায়। পাশে তাকিয়ে দেখে আয়াত গাড়িতে বসেছে।
“গ্লাস লাগিয়ে নাও, পরে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
“হুম।”
মেহের গ্লাস বন্ধ করে নিলে আয়াত গাড়ি স্টার্ট দেয়৷
“মেহের।”
“বলুন।”
“তুমি কি আমার উপর এখনো রেগে আছো?”
“আমি সত্যি কারো উপর রেগে নেই।”
“তাহলে এতটা দূরত্ব কেন আমার সাথে, এভাবে কথা বলো মনে হয় আমাকে চেনোই না।”
মেহের কোনো উত্তর দিল না। চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াতও আর কথা বাড়ালো না। ড্রাইভে মন দিল।
“ভাবি আমি সব ঠিক করে এসেছি। সবাই এলেই সবজি পাকোড়া আর চা বসিয়ে দিব চুলায়।”
“ভালো করেছিস, জানিসই তো আয়াত আর কাসফি এই বৃষ্টির সময় পাকোড়া খুব পছন্দ করে। এসেই যদি এসব পায় খুব খুশি হয়ে যাবে।”
“হ্যাঁ ভাবি। আমিতো খুব চিন্তায় আছি।”
“কেনো রে!”
“আয়াত আর মেহেরকে নিয়ে। আমরা তো ওইদিন বিয়ের কথা বলে দিয়েছি কিন্তু এরপর থেকে ওরা দুইজন যেনো আরও আলাদা হয়ে গেছে। কেমন দূরে দূরে থাকে।”
“এইজন্যই তো তাদের একসাথে পাঠালাম। একসাথে গেলে টুকটাক কথা তো হবে দুইজনের।”
“আমরা তো এটাই চাই আমাদের বাচ্চা দুটো যেনো সবসময় সুখে থাকে।”
“মেহেরের একটু সময় লাগবে কিন্তু দেখিস ও একদিন আয়াতকে মেনে নিবে।”
গাড়ির শব্দে বারান্দা থেকে নিচের দিকে তাকালো আয়াতের মা আর মেহেরের মা। আয়াত আর মেহেরকে একসাথে গাড়ি থেকে নামতে দেখে তারা। আয়াতের হাতে কয়েকটা ব্যাগও আছে। তাদের একসাথে দেখেই দুই জা হেসে উঠে।
“ওই দেখ আমাদের আয়াত আর মেহের একসাথে ফিরছে। দুইজনে তেমন দূরত্বও নেই।”
“হুম। কিভাবে মেহেরকে আগলে ভেতরে নিয়ে আসছে আয়াত যেনো বৃষ্টি মেহেরকে ছুতেও না পারে।”
“ওরা যেনো খুব সুখী হয় রে।”
আয়াত মেহেরের এত কাছাকাছি এসে ব্যাগ দিয়ে মেহেরের মাথার উপর দিয়ে আছে যাতে মেহের ভিজে না যায়। আয়াতের শ্বাস মেহেরের মুখে পরছিল। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহের আয়াতের দিকে তাকাতে পারছে না। আয়াতের গায়ের কড়া স্মেল মেহেরের নাকে অবদি আসছে। তাড়াতাড়ি বাসার সামনে আসতেই মেহের কলিং বেল বাজানো শুরু করলো। আয়াত অনেকটাই ভিজে গেছে। হাত দিয়ে চুলের পানি ঝেরে ফেলছিল। মেহের আড়চোখে একবার আয়াতকে দেখে নেয়৷ দরজা খুলে আয়াতের মা দাঁড়ায়।
“কিরে তোরা একসাথে ফিরবি বলিস নি তো!”
অবাক হওয়ার ভংগিতে আয়াতের মা জিজ্ঞেস করলো৷ যেনো তিনি উপর থেকে কিছুই দেখেন নি।মেহের আর আয়াত ভেতরে ঢুকে গেলো।
“আসলে চাচী আমার আসার পথেই আয়াতের ভার্সিটি তাই নিয়ে আসলাম।”
আর কিছু না বলে মেহের তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে গেলো। আয়াতও তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে মানে ছাদে যেতে নিলে তার মা আটকে বলে,
“ছাদে যেতে হবে না আজ। তোর ঘরে কয়েকটা কাপড় রেখে দিয়েছি ওইখানেই যা। বৃষ্টি কমলে না হয় চলে যাবি উপরে।”
“ঠিক আছে।”
“আর ফ্রেস হয়ে নিচে আয়। তোর বাবা আর বড় চাচা এক্ষুনি চলে আসবে। তারপর পাকোড়া আর চা করছি খেয়ে নিস।”
“হুম। আমি উপরে যাই তাহলে।”
আয়াত সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। আয়াতের মা ছেলের এমন হাসি মুখ দেখে খুশিতে ভরে উঠলেন। এদিকে আয়াত নিজের ঘরে এসে বিছানার একপাশে হাতে থাকা ব্যাগগুলো রেখে দিলো৷ আয়াত বিছানার উপর তার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস দেখতে পেয়ে হেসে দিল।
“এই মা আর চাচী যে কি করতে চায় নিজেও জানে না৷ তাদের মেহের তো আমার থেজে দূর দূর ভাগে আর এরা আমাকে তার কাছে রাখার চেষ্টা করছে।”
খাটের উপর থেকে টি-শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো আয়াত৷ আধা ঘণ্টা পর আয়াত নিচে নেমে এলো। বসার ঘরে নিজের বাবা আর চাচাকে বসে কথা বলতে দেখে আয়াত তাদের সামনে থাকা সোফায় গিয়ে বসলো৷ বসার ঘর আর রান্নাঘর পাশাপাশি থাকায় আয়াত দেখতে পেলো তার মা আর চাচী চুলায় কিছু তৈরি করছে। তাদের পাশেই মেহেরও টুকটাক কাজ এগিয়ে দিচ্ছে। আয়াত এক পলক তাদের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে স্ক্রল করতে থাকলো। মেহেরের বাবা আয়াতের উদ্দেশ্যে বললেন,
“আয়াত।”
আয়াত চাচার ডাকে মোবাইল থেকে চোখ সড়িয়ে চাচার দিকে তাকিয়ে মোবাইল অফ করে সামনে থাকা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে চাচার কথায় মনোযোগ দিলো।
“জি চাচা বলুন।”
“আজকে তোমার ভার্সিটিতে প্রথম দিন ছিলো, তা কেমন ছিলো আজকের দিন?”
“খুব ভালো চাচা। আর বিশেষ করে স্টুডেন্টরা অনেক আগ্রহী। এটার জন্যই আরও ভালো লেগেছে।”
মেহের সেই সময় পাকোড়ার ট্রে নিয়ে বসার ঘরে আসলে আয়াতের মুখে স্টুডেন্টদের সুনাম শুনে আড়চোখে একবার তাকায়। আয়াত প্রথমে মেহেরের এভাবে তাকানোটা বুঝতে না পারলেও মেহের মুখাবয়ব দেখে বুঝতে বাকি রইলো না গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলা মেয়েদের জন্য সে এমন মুখ শক্ত করে আছে। আয়াত মাথা নিচু করে হাসতে লাগলো৷ আয়াতের এই হাসি যেনো মেহেরের দৃষ্টি এড়ালো না আর মেহের আরও রেগে রান্নাঘরে চলে গেলো। মিনিট দুই একের ভেতর মেহের আবার ট্রে করে চা নিয়ে আসলো। চা টেবিলের উপর রেখে যেতে নিলে আয়াতের মা মেহেরকে ডেকে তাদের সাথে বসতে বললো। মেহের কিছু না বলে চুপচাপ একটা সোফায় বসে পরলো। কাসফি উপর থেকে তাড়াতাড়ি ছুটে এলো কারণ তার পাকোড়া খুব প্রিয়। আর সে কিছু না ভেবে গরম পাকোড়া হাতে নিয়ে আয়াতের পাশে ধপ করে বসে পরলো৷ মেহের তার বাবার কোল থেকে মাহিকে নিয়ে তার কোলে বসালো। সবাই অনেক কথা বলছে। আয়াত তো কাসফির হাতের পাকোড়া নিয়ে বারবার খেয়ে নিচ্ছে আর তার জন্য কাসফি মুখ ফুলিয়ে আবার আরেকটা হাতে নিচ্ছে। আয়াতের দিকে বারবার রাগী দৃষ্টিতে কাসফি তাকাচ্ছে। আর তা দেখে আয়াত কাসফির চুল ধরে টেনে দিচ্ছিলো আর কাসফির গাল টমেটোর মতো ফুলছিলো৷ তাদের ভাই বোনের এই ঝগড়া দেখে সবাই হাসাহাসি করছে। এতে যেনো কাসফি আরও রেগে গেলো৷ তাই পাকোড়ার পুরো প্লেট নিয়ে বসে পরলো। মেহেরের সবসময় তার পুরো পরিবারকে এভাবে একসাথে হাসি খুশি দেখতেই ভালো লাগে। আজ অনেক দিন পর তার পরিবার এভাবে আনন্দে মেতে উঠেছে। কিন্তু মেহের যেনো নিজেকে খুব গুটিয়ে নিয়েছে এসব থেকে। না হলে এদের সাথে এখন সে নিজেও মারামারি করা শুরু করতো। নিজের এমন পরিবর্তনে মেহের নিজেই হেসে উঠলো।
নিজের ঘরে মেহের সেই অনেক আগেই এসেছে। রাতের খাবার খেয়ে প্রায় সবাই এখন নিজ ঘরে৷ রাত ১২টার উপরে বাজে। কিন্তু মেহেরের চোখে ঘুম নেই। মাহিকে ঘুম পাড়িয়ে সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি দেখছে। যদিও অন্ধকারে চারদিকের পরিবেশ সে দেখতে না পারলেও তার শীতল অনুভূতি মেহেরের শিরায় শিরায় উপলব্ধি হচ্ছে। বৃষ্টির পানি বারান্দার মেঝেতে পরে মেঝে ভিজে আছে৷ খালি পায়ে মেহের দাঁড়িয়ে আছে। হালকা ঠান্ডা বাতাসে মেহের কিছুক্ষণ পর পর কেপে উঠছে। হঠাৎ নিজের পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পেরে মেহের পেছনের দিকে তাকালো।
চলবে,,,,,,
#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_১৩
#Writer_Fatema_Khan
কৃষ্ণ কালো অন্তরীক্ষের দিকে নজর মেহেরের। আজ অন্তরীক্ষে কোনো তারা নেই। মেঘের চাদরে সবটা ঢেকে গেছে অনেক আগেই৷ গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির শব্দ আর দুইটি মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। মেহের নিজের পেছনে কারো অস্তিত্ব বুঝতে পেরে দেখে আয়াত দাঁড়িয়ে আছে। আয়াতও তার ন্যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহের আর কিছু না বলে পুনরায় বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। দুইজনেই নিরবতা পালন করতে ব্যস্ত। নিরবতা ভেঙে মেহের বললো,
“কিছু বলবেন?”
“কিছু বললেই বুঝি আসা যাবে, না হলে আসা যাবে না?”
“এত রাতে যেহেতু এসেছেন অবশ্যই কিছু বলবেন তাই এসেছেন, ঠিক বলি নি আমি।”
“তুমি আমাকে সেদিন থেকে আপনি করে কেন ডাকো মেহের? আমি কি এতটাই পর হয়ে গেলাম?”
“তুই বলে সম্মেধন করা এখন আর সাজে না। আগে আপনাকে আমি ছোট চাচার ছেলে হিসেবে তুই বলে ডাকতাম কারণ আপনি বয়সেও আমার ছোট। কিন্তু ওইদিন বাবা আর চাচার প্রস্তাবের পর আমি আপনাকে তুই করে বলতে পারছি না।”
আয়াত আবার চুপ হয়ে গেলো। মেহেরের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ছিটা এসে মেহেরের মুখে এসে পরছিলো আর হালকা ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। মৃদু বাতাসে শাড়ির আচল হালকা উড়ছে। যা মেহেরকে আরও মোহনীয় লাগছে। খোলা চুলের এক গাছি চুল চোখের সামনে আসছিলো যা মেহেরকে খুব বিরক্ত করছিলো৷ আয়াত কিছুটা এগিয়ে মেহেরের হাত ধরে নিজের সামনে দাড় করায়৷ তারপর হাত দিয়ে মুখের উপরে থাকা চুল সরিয়ে কানের পেছনে গুজে দেয়। মেহের আয়াতের এমন স্পর্শে কেপে উঠে। কোমরের দুই পাশে হাত দিয়ে মেহেরকে আরও কাছে আনে আয়াত৷ মেহের আয়াতের এমন স্পর্শ সম্পর্কে অবগত নয়। তাই অনেকটা অবাক হয়েই আয়াতের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে ছিল অন্যরকম এক অনুভূতি, যা মেহেরের কাছে পুরোপুরি অচেনা।
“ভিজে যাচ্ছ তা কি দেখতে পাও না। নাকি আমাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দেওয়ার জন্য এমন করো৷ তোমার একটু কষ্ট হলেও আমার কেমন লাগবে তা ভেবেছ একবার৷ আর একটা কথা, আর কখনো যেনো শাড়ি পরতে না দেখি তোমাকে। এই বাকানো কোমড় কেউ দেখুক তা আমার সহ্য হবে না। তাই আজ থেকে আর শাড়ি পরে কোথাও যাবে না তুমি৷ কথাটা যেনো মনে থাকে৷ আর বিছানার উপর তোমার জন্য কিছু ড্রেস আছে আজ থেকে এসব পরবে। কাল থেকে তোমায় আমি শাড়ি পরা না দেখি। আজ আমার সারাটাদিন কেটেছে তোমায় ভেবে। ওই এক মুহূর্ত আমার চোখের সামনে থেকে সরতেই চায়নি, তাহলে ভাবতে পারো অন্যদের কি অবস্থা হবে এমন দেখে৷ বেশি ভেব না ঘুমিয়ে পরো, সকালে অফিস যেতে হবে। আর আমার দেওয়া ড্রেস গুলোই যেনো গায়ে থাকে। শুভরাত্রি মেহের।”
মেহেরের কানের কাছে এসে এসব বলে আয়াত সোজা মেহেরের ঘর থেকে বেড়িয়ে ছাদের দিকে চলে গেলো। মেহের যেনো পুরো জমে গেছে। এই আয়াত পুরোপুরি অন্য এক আয়াত। এতদিন ধরে যাকে জানত সেই আয়াতের সাথে এর কোনো মিল নেই। আয়াত কখনো মেহেরকে কিছু বলা তো দূর জোরে কথাও বলত না। আর আজ কিনা সেই আয়াত মেহেরকে শাসনের সুরে কিছু কথা বলে গেলো। এ কেমন অনুভূতি মেহেরের জানা নেই। তবে আয়াতের চোখের দিকে তাকানো কষ্টকর মনে হচ্ছিলো৷ যেনো এক নেশা ওই চোখের মধ্যে। মেহের নিজেকে ধাতস্থ করে বারান্দা থেকে ঘরের ভেতর চলে আসলো৷ বিছানায় মাহি ঘুমিয়ে আছে। তার মাথার অনেকটা উপরেই কয়েকটা শপিং ব্যাগ যেগুলো আজ আসার পথে আয়াত কিনেছিলো। কিন্তু এর ভেতর যে তার জন্যই কিছু ছিল তা কখনো মাথাতেও আসে নি মেহেরের৷ ব্যাগ গুলো হাতে নিয়ে পাশের টেবিলে রেখে মাহির পাশে শুয়ে পরলো মেহের। ক্লান্ত চোখ দুটি আজ বন্ধ করতে মানা৷ ঘুমেরা আজ পালিয়েছে মেহেরের চোখ থেকে। আয়াতের এমন হঠাৎ কাছে আসা তার স্পর্শ বারবার কাপিয়ে দিচ্ছিলো মেহেরকে। এতটা কাছে আসার পরও যখন আয়াত মাথা নামিয়ে মেহেরের কানের কাছে নিয়ে তার ঠোঁট জোড়া ঠেকালো মেহের তখন জমে গেছিলো। বারবার সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে লাগে। চোখ খিচে বন্ধ করেও কোনো লাভ হয়নি৷ ঘুম যে আজ আর ধরা দিবে না।
অন্ধকার ঘরে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে আয়াত৷ বিদ্যুৎ চমকানোতে কিছু সময় অন্তর অন্তর পুরো ঘরটা আলোকিত করে দিচ্ছে। তার চোখেও আজ আর ঘুম নেই।
“কি বলতে গিয়েছিলাম আর কি করে এলাম৷ শুধু মেহেরকে ড্রেস গুলো দিতে গিয়েছিলাম আর আমি কিনা ওকে এতটা কাছে এনে থ্রেট দিয়ে এলাম যেনো আর শাড়ি না পরে৷ এখন আবার আমাকে নিয়ে কতকিছু ভাববে মেহের৷ ওর মন পাওয়ার কত চেষ্টায় থাকি সাথে বাসার সবাইও তাই চায়। আর আমি কিনা নিজের উলটা পালটা কাজের জন্য ওর মন থেকেই উঠে যাব। ড্রেস গুলো দিয়ে চলে না এসে কথা বলার কি প্রয়োজন ছিল। আর মেহেরের ভেজা মুখ দেখে ওকে এতটা মায়াবী লাগছিল আমিই বা কি করতাম। যত দূরে যেতে চাই ততটাই কাছে এসে যাই আমি ওর।”
এসব ভাবতে ভাবতেই কেটে যায় দুইটি মানুষের নির্ঘুম রাত। পুরো রাত কেউই আর দুচোখের পাতা বন্ধ করতে সক্ষম হয় নি৷
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ কোরআন শরিফ পড়ে নিল মেহের৷ তারপর বারান্দার দরজা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখে স্নিগ্ধ এক সকাল৷ ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া পুরো শরীর শীতল করে যাচ্ছে তার। মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে বাইরের শান্ত পরিবেশ দেখে ঘরের ভেতর চলে আসে। আলমারি থেকে একটা সুতির শাড়ি বের করে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো মেহের। গোসল সেড়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে নিয়ে কাল রাতের কথা মনে পরতেই একরাশ লজ্জা এসে ভর করে তার রক্তিম মুখশ্রীতে।
“আয়াত কাল রাতে আমাকে শাড়ি পরতে মানা করেছে যেনো আমার বাকানো কোমড় কারো নজরে না আসে। ছিঃ তারমানে আয়াতের নজরে পরেছে তাই তো আয়াত এমনটা বললো। আজ তো আয়াতের সামনে যেতেও লজ্জা লাগবে। কি একটা লজ্জাজনক ব্যাপার।”
বিছানার পাশের টেবিলে রাখা ব্যাগ গুলোর দিকে নজর পরতেই মেহের ব্যাগ গুলো হাতে নিলো। একটা একটা করে খুলে সবগুলো ড্রেস দেখে নিল মেহের। ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ফুটে ওঠে মেহেরের।
“এই ধরনের ড্রেস তো আমি সবসময় পছন্দ করতাম। আর বিয়ের আগে এমন ড্রেসই তো পরতাম।”
হলুদ রঙের একটা ড্রেস নিয়ে পরে নিল মেহের। সাথে ছোট কানের দুল, হাতে ঘড়ি, চুলগুলো পেছন দিকে ছোট ক্লিপ দিয়ে আটকানো। যার দরুন কয়েক গাছি চুল মুখের সামনে এসে পরেছে৷ ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে তৈরি মেহের৷ নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিজের আগের মেহেরকে খুঁজে পেলো মেহের। আয়নার সামনে থাকতে থাকতেই পেছনে মাহির শব্দ শুনে পেছনে তাকালো মেহের।
“আম্মু আম্মু খুব সুন্দর।”
মাহি যে মেহেরকে দেখতে সুন্দর লাগছে সেটাই বুঝাতে চাইছে৷ সেটা দেখে মেহের মাহিকে কোলে তুলে নিয়ে ফ্রেশ করিয়ে নিচে নেমে আসে। মেহের মাহিকে কোলে নিয়ে নিচে নামার সময় সবার নজর মেহেরের দিকেই নিবদ্ধ। আজ যেনো সবাই তাদের সেই পুরোনো মেহেরকে দেখতে পাচ্ছে। সবাই বসার ঘরেই ছিলো। আয়াত এক নজর মেহেরের দিকে তাকিয়ে চোখ নিচে নামিয়ে ফেলে। এই মেহেরের দিকে তাকানোও যেনো এখন নিষিদ্ধ আয়াতের জন্য। নিজেকে আর দূূর্বল করতে চায় না মেহেরের সামনে। মেহেরকে এই রূপে দেখে মেহেরের মায়ের চোখে পানি এসে গেলো। মেহের নিচে এসে খাবার টেবিলে বসে আর দেখে সবাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তবে কেউ কিছু বলছে না। মেহের মাহিকে পাশে বসিয়ে নিজে খেতে লাগলো। মেহের খুব বুঝতে পারছে তার হঠাৎ নিজেকে পরিবর্তনে সবাই অনেকটাই অবাক। মেহেরের মা এগিয়ে গিয়ে মাহিকে কোলে তুলে নিলেন।
“মা আমার খাওয়া শেষ। কাসফি তুই স্কুলে যাবি না, চল আমি পৌঁছে দিয়ে আসব তোকে। আর এমন বৃষ্টির দিনে আমাদের কারো না কারো সাথেই যাবি। আর হ্যাঁ অবশ্যই ছাতা নিয়েই বের হবি৷”
“ঠিক আছে আপু। আমি ব্যাগ নিয়ে আসি।”
কাসফি নিজের স্কুল ব্যাগ আনতে নিজের ঘরে চলে যায়। মেহের একবার আয়াতের দিকে তাকায়। আয়াত মাথা নিচু করে বসে আছে। তার দিকে একবার তাকায় নি অবদি৷ কাসফি নিচে এলে মেহের আর কাসফি দুইজনেই বের হয়ে পরে।
চলবে,,,,,