#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০৬
#Writer_Fatema_Khan
নিস্তব্ধ রাত, কিছুক্ষণ পর পর রাত জাগা পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ সাথে কিছু শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ। আজ আকাশের চাঁদটাও গোল আর বড় দেখাচ্ছে। চাঁদের আলোয় পুরো ছাদ আলোকিত হয়ে আছে৷ মেহের আয়াতের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আয়াত তুই কি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিস এভাবে চুপ করে চাঁদ দেখার জন্য? যদি এমনটাই হয় তাহলে আমি নিজের ঘরে যাচ্ছি।”
মাথা নিচু করে হালকা হেসে আয়াত মেহেরের দিকে তাকালো। আজ আয়াতের চাহনীকেও মেহেরের অপরিচিত লাগছে। মেহের ভাবলো,
“আয়াত যদি এসব সবাইকে না বলতো তাহলে হয়তো আয়াত আমার কাছে ঠিক আগের মতোই লাগত। কিন্তু এখন আয়াত আর আমার সম্পর্কটা ঠিক আগের মতো নেই। আমাদের মাঝে অনেক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণ শুধুমাত্র আয়াত।”
“কি হলো কি ভাবছো? আমি হয়তোবা জানি তুমি কি ভাবছো৷ দেখো তোমার ব্যাপারটা এমন নয় যে আমি আজকেই প্রথম ভেবেছি৷ আমি দেশের বাইরে যাওয়ার আগে থেকেই তোমার প্রতি আলাদা অনুভূতি কাজ করে আমার মাঝে। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি ভালোবাসার অনুভূতি সম্পর্কে তখন থেকে তোমাকেই ভেবেছি৷ জানি না এটা আমার উচিত হয়েছে কিনা, তবে আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকেই ভাবতে পারব না। তোমার কাছে হয়তো এসব শুনে অনেক অবাক লাগছে, কিন্তু আমিতো আমার অনুভূতিকে অস্বীকার করতে পারি না।”
“আয়াত দেখ তুই যা ভাবছিস তা কখনোই সম্ভব না।”
“কিন্তু কেনো?”
“আমি একজন তালাক প্রাপ্তা মেয়ে, যার এই সমাজে কোথায় অবস্থান এটা সবাই জানে। সাথে আমার একটা মেয়েও আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা তোর আর আমার বয়স। আর আমাদের সম্পর্কটা তো দেখবি আমরা ভাই বোন। কোনোভাবেই আমার আর তোর বিয়ে সম্ভব না।”
“অনেকেই নিজের থেকে বড় মেয়েদের বিয়ে করে তো সেখানে তো তাদের সমস্যা হচ্ছে না। আর রইলো ভাই বোনের কথা। আমি আর তুমি কি আপন ভাই বোন, না তাই তো? তাহলে এখানে ভাই বোনের সম্পর্ক কোথা থেকে আসছে। আমি সবসময় তোমার মাঝে আমার প্রেয়সীকে দেখেছি। আমার প্রেয়সী।”
“আয়াত আমি ঘরে যাচ্ছি তোর এসব শোনার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।”
মেহের যেতে নিলেই আয়াত মেহেরের হাত ধরে নেয়।
“এগুলো কি ধরনের অসভ্যতা আয়াত। হাত ছাড় আমার। তুই আমার রাগ উঠাস না আয়াত হাত ছাড়।”
“মেহের আমি অসভ্যতা কোথায় করলাম ওইটা আগে বলো? আচ্ছা তুমি সবসময় আমার অনেক ক্লোজ ছিলে তাহলে তুমি কি কখনো আমার চোখে তোমার জন্য ভালোবাসার অনুভূতি দেখতে পাও নি নাকি আবিরের ভালোবাসায় এতটাই মগ্ন ছিলে যে, যে সত্যিকারের তোমাকে মন দিয়ে ভালোবাসে তার টাই চোখে পরে নি?”
“হাত ছাড় আয়াত, এখন কিন্তু খুব রাগ লাগছে।”
“তুমি আমাকে একটুও বুঝো না মেহের। তোমার চোখের কোথাও আমি আমার জন্য ভালোবাসা তো দূর একটু মায়াও দেখছি না। যা আগে কিছুটা হলেও দেখতে পেতাম। আর আজ সেই মায়াটাও নেই। সেই মায়াটা হয়তোবা আমি নিজেই কেড়ে নিয়েছি।”
“তোর কথা শেষ হলে আমি নিজের ঘরে যাই?”
“একটা অনুরোধ করবো যদি রাখো?”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মেহের আয়াতের চোখের দিকে তাকালো। কিন্তু বেশিক্ষণ সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে নি মেহের। কারণ চোখের কোণে চোখের পানি স্পষ্ট চিকচিক করছে। চোখ সরিয়ে মেহের বললো,
“কি অনুরোধ?”
হালকা হেসে আয়াত মেহেরের হাত ছেড়ে তার দিকে কিছুটা এগিয়ে বললো,
“রাতটা আমায় দিবে আয়াত? শুধু আজকের রাতটা। আর কিন্তু বেশিক্ষণ নেই সকাল হতে, তোমার সাথে সূর্যোদয় দেখতে চাই। ভয় নেই তোমার হাতটাও ছুয়ে দেখবনা। সবাই ঘুম থেকে উঠার আগেই চলে যেও।”
“মাহি একা আছে ঘরে, আমাকে যেতে হবে।”
বলেই আয়াত আর পেছনে ফিরে তাকালো না সোজা সিড়ি বেয়ে নিচে চলে গেলো। নিজের ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে হাটু মুড়ে কাদতে লাগলো।
“কেনো আয়াত এমন করলি আমার সাথে, আমি এখন কারো সামনে যেতেও পারছি না। নিজের মাঝেই কেমন ছোঁয়া হয়ে আছি আমি। নিজের বাড়িতেও চোরের মতো থাকতে হচ্ছে আমাকে। কখনো ক্ষমা করবো না তোকে, কখনো না।”
তারপর ফ্লোরের উপর শুয়েই কাদতে লাগলো। তারপর ধীরে ধীরে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এলো।আর ছাদের রেলিং ধরে আয়াত দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। এক রক্তিম আভা পূর্ব আকাশে দেখা যাচ্ছে, যেনো এই আভা সবকিছু জ্বালিয়ে দিতে সক্ষম। আয়াতের চোখ দুটোও আকাশের ন্যায় লাল হয়ে আছে। টলমল করছে চোখের উপরে ভেসে বেড়ানো লোনা পানি। চোখ বন্ধ করলেই বুঝি এরা টুপ করে বেয়ে পরবে। আয়াত তাদের বাধা দিলো না চোখ বন্ধ করেই তাদের মুক্তি দিলো। ঝাপসা দুটি চোখ যেনো আবার তাদের প্রাণ ফিরে পেলো। চারপাশে পাখিরা ডাকা শুরু করলো, ভোরের আলো ফোটে উঠেছে পূর্ব দিগন্তে। আয়াত চোখ খুলেই একটা বড় শ্বাস নিলো আর মেহেরকে কোনো ভাবেই কষ্ট দিবে না সেটা ভেবে নিলো। ছাদে ছোট একটা রুম আছে। এখানে অবশ্য কেউ থাকে না। আগে এখানেই আয়াত থাকত কিন্তু এবার সে নিজের রুমেই থাকে। কারণ নিচে থাকলে মেহেরের দেখা বারবার পাওয়া যায়। ছাদের ঘরটার দেয়াল ঘেঁষে বসে পরলো আয়াত। মিনিট কয়েকের ভেতর আয়াতের চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। চাইলেও সে চোখ আর আয়াত খুলে রাখতে পারলো না।
দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙলো মেহেরের। বাইরে কাসফির ডাক শুনে মেহের বললো,
“খুলছি।”
নিজেকে ফ্লোরে আবিষ্কার করে বুঝলো রাতে এসে এখানেই ঘুমিয়ে পরেছে। উঠে আয়নায় নিজেকে দেখে সে অবাক। চোখ মুখ ফুলে নাক লাল হয়ে রয়েছে। ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে নিলো মেহের। এখন কিছুটা স্বাভাবিক লাগছে। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখতে হবে সবার সামনে। না হলে সবাই আন্দাজ করে ফেলবে মেহের সারারাত কান্না করেছে। বাইরে এসে মোটামুটি সবাইকেই কাল রাতের চেয়ে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। তাই মেহের তাদের দিকে এগিয়ে গেলো। খাবার টেবিলে সবাই থাকলেও আয়াত নেই৷ সবার আড়ালে লুকিয়ে বারবার মেহের আয়াতের ঘরের দিকে তাকাচ্ছে। মেহেরের মা আয়াতকে টেবিলে না দেখে কাসফিকে বললো,
“কাসফি তোকে না বললাম মেহের আয়াত সবাইকে ডেকে আনতে। তাহলে আয়াতকে ডাকিস নি?”
“মা আয়াত ভাইয়া তো নিজের ঘরেই নেই।”
“এই ছেলেটা আবার সকাল সকাল কোথায় চলে গেলো?”
আয়াতের বাবা বললেন,
“তোমরা নিজেদের খাবার খেয়ে নাও। আয়াত এসে পরবে একটু পরেই। আর মেহের মা তোর কি হয়েছে, কেমন যেনো আজ লাগছে তোকে?”
“আসলে মাহি রাতে ঘুমায় নি তো তাই আমাকেও জেগে থাকতে হয়েছে। সকালের দিকে একটু ঘুমিয়েছিলাম, তাই এমন দেখাচ্ছে।”
“ওহ! আচ্ছা। তাহলে আজ এক কাজ কর আজ আর তোর অফিস যেতে হবে না, তুই বরং বাসায় রেস্ট নে।”
মেহেরেরও আজ অফিসে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তাই মেহেরও না যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলো।”
সবার খাওয়া শেষে যে যার ঘরে চলে যায় অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে। আর কাসফি গেলো স্কুলের জন্য তৈরি হতে। আয়াত আর মেহেরের মা গেলো রান্নাঘরে। এই সুযোগে মেহের সোজা ছাদে চলে গেলো। ছাদে গিয়ে আয়াতকে কোথাও না দেখে মেহের কিছুটা চিন্তিত হয়ে গেলো। ফিরে আসতেই দেখলো দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মেহের এগিয়ে গিয়ে আয়াতের সামনে বসলো। রোদের আলোয় কুচকানো চোখ আর কপাল স্বাভাবিক আকার নিলো। কপালের উপর ঘামে ভিজে থাকা চুলগুলো মেহের সরিয়ে দিতেই আয়াত চোখ খুলেই মেহেরের হাতটা ধরে ফেলে। আকস্মিক এমনটা হওয়াতে মেহের কিছুটা ঘাবড়ে যায়। মেহেরের হাত ছেড়ে আয়াত নিচে নেমে এলো।
চলবে,,,,,