#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০৫
#Writer_Fatema_Khan
বসার ঘরে আয়াতের বাবা আর মেহেরের বাবা সোফায় বসে আছে মুখ ভার করে। আর তাদের পেছনেই আয়াতের আর মেহেরের মা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বরাবর সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে আয়াত। মেহের আর কাসফি মেহেরের মায়ের রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনছে সবার কথা। সবার মুখ থমথমে।
আজ সকাল বেলায় আয়াত বাসা থেকে বের হয়ে সারাদিনে ঘরমুখো হয় নি। অনেক বার সবাই কল দেওয়ার পরেও কারো কল রিসিভ করে নি আয়াত। সন্ধ্যার দিকে বাসায় এসেই নিজের রুমে চলে যায় সে। আয়াতের মা আর চাচী কয়েকবার খাবার জন্য ডেকে গেলেও আয়াত মানা করে দিয়েছে। তবে রাতে তার বাবা আর চাচা বাসায় আসার পর আয়াত সবাইকে বসার ঘরে ডাকলো কথা বলতে। সবাই উপস্থিত হলেও সবার মুখে ছিলো দুশ্চিন্তা। কারণ সকাল থেকেই আয়াতের মনের মধ্যে কি চলছে কেউ বুঝতে পারছে না। আয়াতের বাবা সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার মা বললো তুমি নাকি সারাদিন বাসায় ছিলে না আর সন্ধ্যায় এসেও রুমে দরজা লাগিয়ে বসে ছিলে কোনো সমস্যা তোমার? যদি কোনো সমস্যা হয় আমাদের জানাতে পারো আমরা তোমার পাশেই আছি।”
আয়াত তার বাবার দিকে চেয়ে আছে তবে মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। তাই মেহেরের বাবা বললেন,
“কোনো ঝামেলা হয়েছে আয়াত, তুই টেনশন করিস না আমাদের বল কি হয়েছে।”
আয়াত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তোমরা ওইদিন আমাকে বিয়ের কথা বলছিলে না, আমি এখন বিয়ে করতে চাই।”
সবাই খুশি হয়ে গেলো আয়াতের কথা শুনে।
“এটা তো ভালো কথা। কিন্তু তুমি বলেছিলে কাউকে পছন্দ করো তা সে কে?”
“বাবা আমি কোনো হেয়ালি না করেই বলতে চাই কথাটা। আমি মেহেরকে বিয়ে করতে চাই।”
বাসার সবার মাথায় যেনো বাজ পরলো আয়াতের কথা শুনে। মেহেরের বাবা বলে উঠলেন,
“আয়াত দেখ বাবা মেহেরের তো বিয়ে হয়ে গেছে আর বাচ্চাও আছে আর তুই তো জানিস বছরখানেক আগেই ওর ডিভোর্স হয়েছে৷ মেহের আমার মেয়ে হলেও আমি তোকেও নিজের ছেলের মতোই দেখি। তাই আমি চাই না তুই আবেগে পরে নিজের জীবনটা নষ্ট করে দে।”
“আমি আবেগে নয় আমি সত্যি মেহেরকে পছন্দ করি আর বিয়ে করতে চাই।”
আয়াতের বাবা রেগে বললেন,
“ছেলে খেলা পেয়েছো তুমি মেহেরের জীবনটাকে? ও এমনিতেই অনেক কষ্টে থাকে তার উপর এসব বলে কি বুঝাতে চাচ্ছো তুমি মেহেরের উপর খুব দয়া করছো।”
“বাবা তুমি ভুল বুঝতেছো আমাকে। আমি মেহেরকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করি। যার জন্য বাইরে যাওয়ার দুই বছর পর একবার আসার কথা থাকলেও মেহেরের বিয়ের কথা শুনে আমি আর দেশেই আসি নি৷ এখনো আসতাম না যদি না আমার পড়া শেষ না হতো। আর এখন যখন এসেই গেছি আর মেহেরের সাথেও একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে তাই আমি চাই আমরা নিজেদের আরেকবার সুযোগ দেই।”
আয়াতের বাবা এবার চুপ করে গেলেন। তবে চারপাশের মানুষের কথা আত্মীয় স্বজনরা কি ভাববে তার চিন্তা তার মাথায় জায়গা করে নিয়েছে। আয়াতের বাবা আবার বললেন,
“যখন মেহেরের বিয়ে ঠিক হলো তখন তুমি কিছু বলো নি কেনো?”
“মেহের নিজে থেকে আবিরকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে সেই জায়গায় আমি কি করে বলি?”
“মেহের যে তোমার থেকে দুই বছরের বড় সেই খেয়াল কি তোমার আছে? সমাজ কিভাবে দেখবে এই সম্পর্ককে, এর উত্তর তোমার কাছে আছে?”
“বাবা আমি কখনোই মেহেরকে নিজের বড় বোনের চোখে দেখি নি, তাই এখনও এসব নিয়ে ভাবছি না। কে কি বললো এসব নিয়ে ভাবলে চলা যায় না। আর তোমরা তো আজ না হয় কাল মেহেরকে কোথাও না কোথাও বিয়ে দিবেই তাহলে আমি কেনো নই?”
ছেলের কথার কোনো জবাব দিতে পারলেন না আফজাল সাহেব। সোফা ছেড়ে উঠে চলে গেলেন নিজের রুমে। মেহেরের বাবা সোফায় স্থির হয়ে বসে আছেন। আয়াত বললো,
“আমার যা বলার ছিলো তা বলা হয়ে গেছে। আশা করছি এই বিষয় নিয়ে সবাই একটু ভেবে দেখবে। আর যদি তোমাদের এই বিয়েতে অমত থাকে তাহলে আমাকে কখনো বিয়ের কথা বলতে এসো না।”
বলেই আয়াত সিড়ি দিয়ে উপরে নিজের রুমে চলে গেলো। কাসফির চোখের কোণে পানি জমে আছে, তা মেহের দেখার আগেই মুছে ফেললো কাসফি। মেহেরের দিকে তাকিয়ে দেখে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে চোখের পানি ফেলছে। সেই সময় মেহেরের মা ঘরে ঢুকলেন আর দুই মেয়েকে দেখেই বুঝলেন ওরা সব শুনেছে। মেহেরের মা মেহেরকে বললেন,
“মেহের রাত অনেক হয়েছে যা গিয়ে মাহিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দে আর তোরাও খেয়ে নিস। আমার খিদে নেই আমাকে ডাকিস না। আর কাসফি তোর পরীক্ষা চলছে না, খেয়ে পড়তে বসবি।”
তারপর তিনি বিছানার এক পাশ ফিরে শুয়ে পরলেন। মেহের আর কাসফি মেয়ের রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। কাসফি আজ নিজে থেকেই নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পরলো। আর মেহের রান্নাঘরে গেলো মাহির জন্য খাবার আনতে। ছোট বাচ্চাটাকে
তো আর না খাইয়ে রাখা যায় না। মেহের রান্নাঘরের দিকে যেতেই দেখে তার বাবা এখনো সোফায় বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে আর তার চাচীও আছে সেখানে। মেহের এগিয়ে গিয়ে বাবাকে বললো,
“বাবা খাবার টেবিলে দিয়ে দিব?”
মাথা তুলে মেয়ের দিকে তাকালেন মেহেরের বাবা। দাঁড়িয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“খেতে মন চাইছে না মা। তোরা খেয়ে ঘুমিয়ে পর।”
মেহেরের বাবাও রুমে চলে গেলেন। চাচী উঠে মেহেরের কাছে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমি জানি আমার আয়াত কখনো ভুল হতে পারে না।”
তারপর সেও নিজের ঘরে চলে গেলেন। মেহের আর কিছু না ভেবে মাহির জন্য খাবার নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। সেখানে গিয়ে মেহের আরেকটা ধাক্কা খায়। খাটের উপর আয়াত মাহিকে নিয়ে খেলছে। কিন্তু এই মুহূর্তে মেহের কোনোভাবেই আয়াতের সামনে আসতে চায় নি, তবু্ও নিয়তি তাকে আয়াতের সামনে এনেই দাড় করায়। আয়াত মেহেরকে দেখে মাহিকে খাটে বসিয়ে নিজেও ঠিক করে বসে। মেহের আয়াতের সাথে কোনো কথা না বলে মাহিকে কোলে তুলে খাওয়ানো শুরু করে। আয়াত খুব ভালো করেই জানে মেহের এখন কোনো কথাই বলতে চায় না আয়াতের সাথে। তাই সে আয়াতকে না দেখার মতো নিজের কাজ করে যাচ্ছে।
বিছানার উপর শুয়ে অনেক্ষণ কান্না করার ফলে কাসফির মাথা ব্যাথা করছে। তাই সে ভাবলো মেহেরের কাছে গিয়ে ঘুমাবে। তাই সে মেহেরের রুমে যেতেই দেখে ওইখানে আগে থেকেই আয়াত বসে আছে৷ কাসফি তাড়াতাড়ি নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো।
“তাহলে আয়াত ভাইয়া ওইদিন আপুর কথা বলছিলো। সে মেহের আপুকে ভালোবাসে। কিন্তু আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেনো? ভাইয়া তো বলেছিলো আমার এই বয়সে সবার সাথেই এমনটা হয়। আর তা হলো আবেগ। কিন্তু আবেগের বসে কি মানুষের এত কষ্ট হয়, হয় হয়তো। কিন্তু আমি চাই মেহের আপু খুব ভালো থাকুক আর আয়াত ভাইয়াও। তারা দুইজন যদি একসাথে থাকলে ভালো থাকে তাহলে তো আমারও খুব ভালো লাগবে। তাই আমি এখন থেকে এসব ভাববো না, আয়াত ভাইয়া আমার বড় ভাইয়ের মতো আর কিছুই না। দরকার হলে আপুকে ইমপ্রেস করতে আয়াত ভাইয়াকে আমি সাহায্য করব।”
মেহের মাহিকে খাইয়ে প্লেট রেখে হাত ধুয়ে মাহিকে ঘুম পাড়াতে লাগলো। আয়াত এখনো বিছানার একপাশে বসে আছে। আয়াত বললো,
“মেহের আমার কিছু কথা বলার ছিলো তোমার সাথে।”
চলবে,,,,