#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০৪
#Writer_Fatema_Khan
“আরে মেহের তুমি এখানে?”
নিজের সামনে নিজের প্রাক্তন স্বামী আবিরকে দেখে থমকে গেলো মেহের। প্রায় বছরখানেক পর আবিরকে দেখছে মেহের। অবশ্য আবির একা নয় তার সাথে তার বর্তমান স্ত্রীও রয়েছে।
“কেমন আছো মেহের?”
“আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। আর আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও বেশ আছি৷ তোমাকে অনেক দিন পর দেখে ভালো লাগলো। আর তোমার সাথে কে? নতুন জীবন শুরু করছো বুঝি!”
“আমারও আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগলো। আর আপনি হয়তো ভুলে গেছেন ও আমার কাজিন আয়াত।”
“ওহ হ্যাঁ, মনে পরেছে আয়াত। তা কেমন আছো আয়াত? তোমার সাথে কখনো আলাপ হয়নি, আজ সরাসরি দেখে ভালো লাগলো।”
আয়াতের দিকে হাত বাড়িয়ে। আয়াতও হাত বাড়িয়ে হাত মিলালো আবিরের সাথে। তারপর দুইজনে কিছুক্ষণ কথা বললো।
“মেহের মাহি কেমন আছে?”
আবির আরও কিছু সময় কথা বলতে চেয়েও পারলো না মেহেরের জন্য। মেহের আবিরের কথার জবাব না দিয়ে আয়াতকে তাড়া দিয়ে বললো,
“আয়াত আমার ভিষণ মাথা ব্যাথা করছে আমরা এক্ষুনি বাসায় যাব।”
“বেশি খারাপ লাগছে নাকি?”
“হুম তাড়া চল, আমার একমুহূর্তও ভালো লাগছে না এখানে।”
আয়াত আবিরের কাছে বিদায় নিয়ে একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পরলো। রিকশার চাকা ঘুরা শুরু হলো। আবির রিকশা যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো সেদিকেই তাকিয়ে ছিলো।
“মেহের তোমার কি সত্যি খারাপ লাগছে নাকি অন্য কোন ব্যাপার? আর এই লোকটাই বা কে?”
মেহের কোনো জবাব দিলো না। তার চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। বাসার সামনে আসতেই মেহের রিকশা থেকে নেমে সোজা বাসার ভেতর চলে গেলো। আয়াত অনেকটাই অবাক হলো মেহেরের আচরণে। ভাড়া মিটিয়ে সে বাসায় চলে গেলো। সারাদিনে আর কেউ মেহেরকে নিজের ঘর থেকে বের হতে দেখে নি। এমনকি কিছু খায় নি পর্যন্ত। আয়াত বুঝতেই পারলো না মেহেরের কি হলো। মাহিকে মেহেরের মা খাইয়ে দিয়েছেন মেহেরের মন খারাপ বলে। রাতে কাসফি বসে পড়ছিলো ঠিক সেই সময় আয়াত এসে রুমে হাজির হলো। কাসফিকে আয়াত বললো,
“কিরে পিচ্চি কি পড়ছিস?”
“ভাইয়া কাল তো আমার ক্লাসে পরীক্ষা আছে তাই পরীক্ষার পড়া পড়ছি। তুমি বলো কিছু বলবে?”
“এই পিচ্চি এটা কি তোর রুম নাকি?”
“হুম আমার রুম খুব সুন্দর না, আমি নিজে সাজিয়েছি।”
“পুরাই বাচ্চাদের রুমের মতো লাগছে।”
“উফ ভাইয়া তুমিও বললে এটা বাচ্চাদের রুমের মতো।”
“আচ্ছা খুব সুন্দর। আর তুই মেহেরের রুমে থাকিস কেনো এত সুন্দর রুম থাকতে?”
“আসলে আমার একা ঘুমাতে ভয় লাগে তাই আপুর সাথে ঘুমাই। কিন্তু আজ তো আপুর মন খারাপ তাই আমার রুমে চলে এলাম। মন ভালো হলে চলে যাব।”
” ওহ বুঝলাম। আচ্ছা পিচ্চি বলতো এই আবির কে?”
কিছুটা অবাক হয়েই কাসফি বললো,
“কেনো তুমি আবির ভাইয়াকে চেনো না!”
“আসলে ঠিক মনে করতে পারছি না কখনো দেখেছি কিনা। তবে নামটা কেমন শুনেছি শুনেছি মনে হয়।”
“আবির ভাইয়া হলো মেহের আপুর যার সাথে বিয়ে হয়েছিলো সেই ভাইয়াটা।”
“মেহের আপু আর আবির ভাইয়ার কি যেনো হয়েছিলো তারপর আপু মাহিকে নিয়ে চলে আসে। সেদিন আপু অনেক কান্না করেছিলো কিন্তু আপু আর আবির ভাইয়ার বাড়ি যায় নি।”
“ওহ!”
“কিন্তু তুমি চেনো না কেনো তোমাকে তো আপুর বিয়ের সব ছবি দেওয়া হয়েছিলো?”
আয়াত মনে মনে ভাবলো,
“আমিতো ছবিই দেখি নি, তার আগেই সব ডিলেট করে দিয়েছি। আসলে দেখার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না তাই মোবাইলে রাখার প্রয়োজনও ছিলো না।”
কিন্তু কথা কাটাতে আয়াত বললো,
“কাল তোর পরীক্ষা না মন দিয়ে পড়, কালকেও আমিই স্কুলে নিয়ে যাব।”
কাসফি মন খারাপ করে আবার পড়তে লাগলো। কাসফির কাছে পড়া আর পরীক্ষা এই দুইটা শব্দ সবচেয়ে বিরক্তিকর। আর এদিক ওদিক না ভেবে কাসফি পড়ায় মনোযোগ দিলো। আয়াত কাসফির কাছ থেকে চলে এলো। আয়াত নিচে নেমে দেখে মেহের মা আর চাচীর সাথে টুকটাক কাজ করছে। আয়াত এগিয়ে গিয়ে তার মাকে বলে,
“মা তোমাদের হয়েছে, আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে।”
“এই তো হয়ে গেছে বস তুই। তোর বাবা আর চাচা এক্ষুনি চলে আসবে।”
কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির বাকি সবাই খাবার টেবিলে হাজির হলো৷ আর রাতের খাবার শেষ করলো। রাতের খাবার শেষ করে যে যার রুমে চলে গেলো।
রুমে আসার কিছুক্ষণ পর আয়াত রুম থেকে বের হলো। তার ঘুম আসছে না। সত্যি বলতে মেহেরের কথা ভেবেই আয়াতের ঘুম আসছে না। তাই সে বের হলো রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু যাওয়ার সময় দেখতে পেলো মেহেরের রুমের লাইট জ্বলছে। তা দেখে আয়াত মেহেরের রুমের দিকে এগিয়ে দেখে মেহের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আর মাহি ঘুমাচ্ছে। আজ কাসফি মেহেরের রুমে নেই। আয়াত কিছু না বলেই নিচে রান্নাঘরে চলে গেলো। নিজের জন্য এক মগ কফি বানিয়ে মেহেরের জন্য এক কাপ চা বানালো৷ তারপর মেহেরের রুমে গিয়ে মেহেরের পেছনে দাড়ালো। মেহেরের পাশে গিয়ে দাড়াতেই দেখে মেহের রাতের অন্ধকারে আকাশে থাকা গোল চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেরের সামনে চায়ের কাপ ধরতেই মেহের চমকে পাশে তাকায়। পাশে আয়াতকে দেখে হালকা হাসে। তারপর বলে,
“এত রাতে তুই এখানে!”
“ঘুম আসছিলো না, তাই ভাবলাম কফি খেলে হয়তো ভালো লাগবে। তারপর দেখি তুমি জেগে আছো তাই তোমার জন্য চা নিয়ে এলাম।”
“এত কষ্ট করার কি ছিলো। আমি এমনিতেই ঠিক ছিলাম।”
“তুমি ঠিক নেই মেহের তা আমি জানি।”
মেহের নিজের দৃষ্টি আয়াতের দিকে রেখে বললো,
“ঠিক আছি আমি। তুই রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পর।”
“চা টা খাও। কত কষ্ট করে এত রাতে বানালাম।”
“ঠিক আছে দে।”
আয়াতের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে চায়ে চুমুক দিলো মেহের। আয়াতও নিজের কফিতে মনোযোগ দিলো। দুজনেই নিশ্চুপ। দুইজনেই বারান্দার গ্রিল দিয়ে আকাশের ওই চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। নিরবতার মাঝেই আয়াত বলে উঠলো,
“অনেক ভালোবাসতে বুঝি তাকে?”
বিষ্মিত নয়নে আয়াতের দিকে চেয়ে রইলো মেহের।
“এখন আর বাসি না। ভালোবাসা সেদিনই ফুরিয়ে গেছে যেদিন আমার সাথে সাথে সে তার নিজের মেয়েকেও ছেড়ে দিয়েছিলো। আমাদের সংসার তো খুব ভালো যাচ্ছিলো। ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম দুইজনে। বিয়ের ছ’মাসের মাথায় জানতে পারলাম আমি মা হতে চলছি। সে বাবা হবে জানতে পেরে কত খুশি। অফিসের সবাইকে ট্রিট দিয়েছিলো সে বাবা হবে তাই। এমন কোনো চাওয়া নেই যা সে পূরণ করে নি আমার। আমি যখন যা বলতাম তাই হাজির করতো আমার জন্য। প্রেগ্ন্যাসির সাত মাস অবদি সব ঠিক ছিলো। তারপর আমাদের ভালোবাসায় কারো নজর লেগে গেলো হয়তো। সে লেইট করে বাসায় আসা শুরু করে। আসার পর আমার সাথে তেমন কথাও বলতো না। আমার একবারও মনে হয় নি সে বদলে গেছে। ভাবতে লাগলাম কয়দিন পর তো আমার ডেলিভারি তাই সে টেনশনে আছে। প্রচন্ড খারাপ লাগতো তার অবহেলা তবুও নিজেকে বুঝাতাম সবকিছু আগের মতোই আছে। কিন্তু আগের মতো কিছুই ছিলো না, তা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগে গেলো। আমার ডেলিভারির দিন সবাই আমার কাছে থাকলেও যার থাকা সবচেয়ে জরুরি ছিলো সে ই ছিলো না আমার কাছে। মাহি হওয়ার পর আমি তিনদিন হসপিটালে ছিলাম আর সে মাত্র একবার এসে দেখা করে গেছে। তার নাকি অফিসে অনেক কাজ তাই সে আসতে পারছে না। তখন কিছুটা খটকা লাগলেও আমার কি করার ছিলো। মাহির বয়স তখন তিন মাস। একদিন আবির এসে আমাকে বললো তার নাকি আমার সাথে থাকা আর পসিবল না, তাই সে ডিভোর্স চায়। আমার মাথায় সেদিন আকাশ ভেঙে পরেছিলো। তাকে প্রতি উত্তরে কি বলা দরকার ছিলো তখন আমার জানা ছিলো না। তাই চুপচাপ ব্যাগ গুছিয়ে এখানে চলে আসি মাহিকে নিয়ে। তার কিছুদিন পর ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমার কাছে। কিছুই না ভেবে সাইন করে দেই। তার এক সপ্তাহ পরেই শুনলাম আবির তার এক কলিগকে বিয়ে করেছে। আর আজ তাকে দেখার সৌভাগ্যও হয়ে গেলো। এতদিন পরে দেখা হয়েও তার চোখে কোনো অনুশোচনা নেই। আমার জন্য না হোম ওই ছোট্ট মেয়েটার জন্যও নেই। যে মেয়েটা তার নিজের।”
কান্নায় ভেঙে পরলো মেহের আর আয়াত মেহেরের অশ্রুসিক্ত নয়নের দিকে চেয়ে আছে। দুইজনের মাঝে আর কোনো কথা হলো না। দুইজনেই বারান্দার ফ্লোরে বসে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। হঠাৎ আয়াতের কাধের উপর ভারি কিছু পরতেই আয়াত চেয়ে দেখে মেহের তার কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। আয়াত নিজের হাত দিয়ে মেহেরের মুখের উপর আসা চুলগুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুজে দিলো। আর ভাবতে লাগলো,
“এত নিষ্পাপ, এত স্নিগ্ধ, এত পবিত্র একটা মেয়েকে কি করে কেউ এভাবে ঠকিয়ে কষ্ট দিতে পারে!” মেহেরকে ভালো করে ধরে আয়াত বারান্দায় বসে রইলো। দেখতে দেখতে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই একটা জিনিস আয়াত খুব মিস করতো দেশের বাইরে। আজ অনেক বছর পর শুনতে পেলো। আয়াত মেহেরের দিকে তাকিয়ে দেখে কেদে কেদে চোখ দুইটা ফুলে গেছে। পাজাকোলে তুলে মেহেরকে রুমে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আয়াত রুমের দরজা চাপিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
চলবে,,,,