দুই পৃথিবী পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

1
930

#_দুই_পৃথিবী_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_৫_( অন্তিম পর্ব )

দর্শন বিছানার উপর আধশোয়া হয়ে ফোনে কিছু একটা করছে। রিহান কোনো কিছু না বলেই রুমে আসাতে দর্শন কিছুটা অবাক হয়ে যায়। রিহান কে স্বাভাবিক লাগছে না।

দর্শন উঠে দাড়ায়। রিহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দর্শনের দিকে। দর্শন হালকা ভ্রু কুচকায় রিহানের দিকে তাকিয়ে। তারপর বলে ওঠে,
–” কি হয়েছে? তুই এখন এখানে কেন?”

–” তাহলে,, কোথায় থাকার কথা ছিলো ভাইয়া? রাস্তায় রাস্তায় দেবদাস হয়ে ঘুরার কথা ছিলো বুঝি?”

দর্শন গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
–” মানে?”

–” এইটা কেন করলে ভাইয়া? কি ক্ষতি করেছিলাম আমি তোমার? আমাকে এইভাবে নিজের শত্রু কেন বানিয়ে নিলে? মাম্মামের জন্য? আমি মাম্মাম বা বাবাই কাউকেই বলিনি তোমরা বিয়ে করো। ওনারা নিজে থেকে করেছে। আমি তো শুধু একটু মায়ের ভালোবাসা পেতে চেয়েছি,, তাই তোমার মাকে একটু মা ডেকেছি। এই কারনেই এইভাবে আমাকে নিজের শত্রু বানিয়ে নিলে?”

দর্শন বিরক্তিকর কন্ঠে বলে ওঠে,
–” এই কি বলছিস তুই এইসব? এইসব বলার মানে কি?”

রিহান নিজেকে শক্ত গলায় বলে ওঠে,
–” এইসব বলছি,, এই জন্য যে,, তুমি আমার সব পছন্দ কেড়ে নিতে নিতে আজ আমার ভালোবাসার মানুষের দিকে হাত বাড়িয়েছাে। তুমি জারিফাকে ভালোবাসাে না,, শুধু মাত্র আমাকে অসহায় করার জন্য,, আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এই কাজ করেছো তুমি। তাই না,, ভাইয়া?”

রিনানের এমোন কথা শুনতেই দর্শন চমকে উঠে। রিহান আবার বলে ওঠে,
–” তুই জারিফাকে বেশিদিন চিনোই না। সর্বোচ্চ গেলে তিন সপ্তাহ বা তার কিছুদিন বেশি চিনো। আমাকে এইভাবে নিজের শত্রু কেন বানিয়ে নিলে বলোতো? ছোট বেলা থেকে আমি যা যা পছন্দ করেছি,, সব তুমি নিয়ে গেছো,, পরে জানতে পারি ঐগুলো তোমার পছন্দ না। আসলে,, আমার কাছের থেকে কেড়ে নেওয়ার জন্যই তুমি নিয়ে যাও ঐগুলো। কিন্তু,, সেইগুলো তো সামান্য জিনিসপত্র ছিলো। আমিও তোমাকে দিয়ে খুশি হয়ে যেতাম। আর আজ তুমি আমার সব থেকে বড় খুশিটাই কেড়ে নিতে চাচ্ছো ভাইয়া?”

দর্শন চুপ করে আছে। রিহানের চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ছে। রিহান নিজের চোখ মুছে আবার বলে ওঠে,
–” তুমি যদি জারিফাকে সত্যিই ভালোবাসতে,, তাহলে হয়তো আমি সব কিছুকে পিছে রেখে সব মেনে নেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু,, তুমি তো জারিফাকে ভালোইবাসো না। ছোটবেলা থেকে আমার কাছের থেকে কেড়ে নেওয়া সব জিনিস তুমি নষ্ট করে ফেলতে। কে জানে,, জারিফাকে হয়তো ছুড়ে ফেলে দিতে কিনা।”

দর্শন গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
–” রিহান!”

–” কি ভাইয়া? বলো,, কি বলবে? আমি শুনতে চাই ভাইয়া,, আমি জানতে চাই,, আমার দোষটা কি? আমি কি অন্যায় করেছি? কেন আমি তোমার কাছে শত্রু হয়ে গেছি?”

দর্শন অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। রিহান বলে ওঠে,
–” কি হলো ভাইয়া? বলছো না কেন? উত্তর নেই,, তাই না ভাইয়া? বলা লাগবে না তোমার,, তুমি নিজে নিজে ভাবো তুমি কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছো। আর আমার একটা দোষ আমাকে বের করে দাও। কিন্তু,, ভাইয়া রিকোয়েস্ট,, জারিফাকে আমার কাছের থেকে আলাদা করার চেষ্টা করো না,, প্লিজ! অনুরোধ করছি আমি।”

কথাগুলো বলে রিহান দরজার দিকে ঘুরতেই চমকে উঠে। মায়া চৌধুরী আর কোয়েল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। রিহান কম্পিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
–” মাম্মাম!”

রিহানের এমোন কথায় চমকে দরজার দিকে তাকায় দর্শন। মায়া চৌধুরী রিহানকে রেখে দর্শনের দিকে এগিয়ে আসে। দর্শন মায়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে আছে। আজ কেন যেন,, নিজের মায়ের এই দৃষ্টিকে ভয় পাচ্ছে দর্শন। মায়া চৌধুরী কোনো কিছু না বলেই ঠাস করে দর্শনকে একটা থাপ্পড় মারে।

রিহান আর কোয়েল কেপে উঠে। দর্শন অবাক হয়ে নিজের মায়ের দিকে তাকায়। মায়া চৌধুরীর চোখ ছলছল করছে। মায়া চৌধুরী দর্শনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আমি কোনোদিনও তোর গায়ে হাত তুলিনি। বরং তুই যা যা বলতি,, যা যা করতি,, সব কিছুতে অন্যায় থাকা সত্ত্বেও আমি কখনো তোকে কিছু বলিনি। আর যার জন্য তুই এতোটাই বেপরোয়া হয়ে গেছিস,, একটা মানুষের কাছের থেকে কোনো কারন ছাড়াই তার ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নিতে চাইছিলি।”

–” মাম্মাম!”

–” চুপ! একদম ডাকবি না আমাকে। লজ্জা করছে আমার,, তোকে আমি গর্ভে ধারন করেছি। তুই কার সাথে এমোন করিস? তুই জানিস,, তুই যে বেচে আছিস,, হয়তো আল্লাহ বাচিয়ে রেখেছে তাই,, কিন্তু রিহানের মাধ্যমে তুই বেঁচে আছিস।”

দর্শন অবাক হয়ে মায়া চৌধুরীর দিকে তাকায়। রিহান এগিয়ে এসে বলে ওঠে,
–” মাম্মাম! প্লিজ!”

মায়া চৌধুরী বাঁধা দিয়ে বলে ওঠে,
–” রিহান চুপ। এতোদিন আমি তোর জন্য চুপ করে ছিলাম। আজ তুই একটা কথাও বলবি না।”

থেমে যায় রিহান। আজ যেন কোনো কিছুতে সে আর আটকাতে পারছে না। মায়া চৌধুরী দর্শনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” মনে পড়ে দর্শন,, তোর যখন বিশ বছর বয়স,, তখন তোর দুইটা কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছিলো। ডক্টর বলেছিলো,, কিডনি ম্যানেজ না হলে তুই বাঁচবি না,, মনে পড়ে? পরে কোনোদিন ভেবে দেখেছিস,, এই কিডনি কোথা থেকে আসলো? তুই সুস্থ হলি কিভাবে? ভাবিসনি তাইনা? নাকি প্রয়োজনই মনে করিসনি?”

দর্শন একভাবে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। রিহান মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। কোয়েল ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে দর্শনের দিকে। মায়া চৌধুরী নিজের চোখ মুছে বলে ওঠে,
–” তুই যখন হসপিটালে তিনদিন সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলি,, আমি কি করবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আমি তোকে কিডনি দিতে চেয়েছিলাম,, কিন্তু ম্যাচিং হচ্ছিলো না। কি করবো কিছু মাথায় আসছিলো না। সব সময় আল্লাহকে ডাকতাম,, আর বলতাম,, আমাকে নিয়ে যাও কিন্তু আমার সন্তানকে সুস্থ করে দাও। ডক্টর বলেছিলো,, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা না গেলে তোকে বাঁচানো যাবে না। তখন রিহান এগিয়ে এসে তোকে কিডনি দেয় একটা। ওর কিডনির সাথে ম্যাচ হয়ে যায় তোর। রিহান কোনো কিছু না ভেবেই নিজের একটা কিডনি তোকে দিয়ে দেয়।”

দর্শন অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকায়। রিহান একপলক দর্শনকে দেখে আবার মাথা নিচু করে নেয়। দর্শন আবার মায়া চৌধুরীর দিকে তাকাতেই মায়া চৌধুরী বলে ওঠে,
–” আমি এই কথা গুলো তোকে অনেক আগেই বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু,, কেন বলতে পারিনি জানিস? কারন,, রিহান আমাকে বলতে দেয়নি। ও কখনো চাইনি,, ওর ভাইয়ের ভালোবাসা কোনো বিনিময়ের মাধ্যমে হোক। ও এমনিই তার ভাইয়ের ভালোবাসা পেতে চেয়েছিলো।”

মায়া চৌধুরী দর্শনের মুখ ধরে কান্নারত কন্ঠে বলে ওঠে,
–” এমোন করিস না বাবা! ওদের একটু কাছে টেনে নে। দেখ তোর কাছে তোর মা আছে,, ওর তো নেই। ওকে এইভাবে দুরে সরাস না বাবা! ও তোকে অনেক ভালোবাসে। ওকে ভালোবেসে কাছে টেনে নে। এমোন করিস না। এই স্বার্থের পৃথিবীতে ও তোকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে। একটু বুঝ বাবা!”

কথাটা বলে মায়া চৌধুরী দর্শনের কপালে একটা চুমু একে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। দর্শন আর কোনোদিকে না তাকিয়ে বারান্দায় চলে যায়। রিহানও আস্তে আস্তে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। কোয়েলও নিজের রুমে চলে যায়।


#_১_সপ্তাহ_পর_

বেশ রাত। চারিদিকে অন্ধকার হলেও বিভিন্ন রকমের আলোকসজ্জা দিয়ে ভরে আছে চৌধুরী ম্যানশন। বিয়ের বাজনা,, টুরি বাল্ব,, নেট,, রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো আছে চারিদিকে।

এরই মাঝে ছাদের এক কোনায় দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে দর্শন। আকাশে ছোট ছোট তারা উঠেছে। চৌধুরী ম্যানশনের মতো আকাশও যেন সেজে উঠেছে।

কিছু সময় আগে দর্শন নিজে গিয়ে রিহানকে বাসর ঘরের সামনে দিয়ে এসেছে। রিহান আর জারিফার বিয়ে হয়েছে আজ। সেইদিনের পর দর্শন পুরো একদিন একদম নিজেকে ঘর বন্দি করে রেখেছিলো। তারপর থেকে দর্শন সবার সাথেই একটু একটু করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছে।

এখনো সবার সাথে একদম ফ্রি না হলেও,, সে যে চেষ্টা করছে তাতেই অনেক খুশি সবাই। দর্শনের হঠাৎ মনে হচ্ছে তার পেছনে কেউ দাড়িয়ে আছে। দর্শন তাড়াতাড়ি পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখে,, কোয়েল তার দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে।

দর্শন আবার সামনে ঘুরে আকাশের দিকে তাকায়। কোয়েল এগিয়ে এসে রেলিং এ হাত রেখে দাড়ায়। কিছু সময় পর কোয়েল বলে ওঠে,
–” রিহান ভাইয়ার ভালোবাসার মানুষকে এনে দিলে,, জারিফারও ভালোবাসার মানুষকে এনে দিলে। আমি কি অন্যায় করেছি,, যে আমাকে এনে দিচ্ছো না?”

দর্শন কোয়েলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” মানে? তোমারও ভালোবাসার মানুষ আছে নাকি?”

–” আছে তো।”

কথাটা শোনা মাত্রই দর্শনের বুকের ভেতর কেমন জানি মুচড় দিয়ে উঠে। তাও নিজেকে সামলিয়ে বলে ওঠে,
–” বলো কে সে? এনে দিবো।”

–” দাও তাহলে।”

–” কিন্তু,, কে সে? তাকে তো চিনিই না আমি।”

–” কে বলেছে তুমি চিনো না? তুমি তো আরও সবার থেকে ভালো চিনো।”

দর্শন হালকা ভ্রু কুচকিয়ে বলে ওঠে,
–” মানে?”

কোয়েল দর্শনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আমি তোমাকে ভালোবাসি!”

দর্শন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কোয়েলের দিকে। কোয়েল হালকা হেসে বলে ওঠে,
–” অনেক অনেক ভালোবাসি তোমাকে! অতিরিক্ত ভালোবাসি!”

দর্শনের বুকের ভেতর যেন অদ্ভুত এক শান্তি বয়ে যাচ্ছে। কোয়েল এগিয়ে এসে দর্শনকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে,
–” এইবার আমার ভালোবাসা আমাকে এনে দাও।”

দর্শন হালকা হেসে কোয়েলকে জড়িয়ে ধরে। কোয়েল আরও শক্ত করে দর্শনকে জড়িয়ে ধরে। দর্শন আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে ওঠে,
–” শুকরিয়া!”

………………🌹সমাপ্ত🌹……………..

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে