দুই পৃথিবী পর্ব-০২

0
486

#_দুই_পৃথিবী_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_২_

#_১০_বছর_পর_
দর্শন অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে নামতেই মায়া চৌধুরী এগিয়ে এসে বলে ওঠে,
–” তুই এসে গেছিস,, আই ব্রেকফাস্ট করে নে।”

দর্শন ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখে রিহান ব্রেকফাস্ট করতেছে। রিহান খাওয়া থামিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দর্শন মায়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আমি অফিসে গিয়ে খেয়ে নিবো। আমার লেট হয়ে যাচ্ছে।”

কথাটা বলে দর্শন চলে যেতে নিলেই রিহান বলে ওঠে,
–” ভাইয়া!”

থেমে যায় দর্শন। রিহান খাওয়া রেখে তাড়াতাড়ি একটা ফাইল নিয়ে এগিয়ে এসে বলে ওঠে,
–” আমি একটা নতুন ডিল সাইন করতে চাচ্ছিলাম,, এখানে সব ডিটেইলস আছে। তুমি যদি একটু দেখে দিতে,, তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হতাম।”

দর্শন রিহানের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
–” তোর আর আমার অফিস আলাদা। আর তুই কার সাথে ডিল করবি এইটা তোর ব্যাপার। এইসব নাটক আমার সাথে করতে আসবি না।”

–” ভাইয়া! আমাদের অফিস আলাদা ঠিকই। কিন্তু,, তুমি তো আমার থেকেও এইসব ভালো বুঝো। তাই,, তুমি যদি একটু দেখে দিতে তাহলে,, আমার আর কোনো চিন্তা থাকতো না।”

–” মিস্টার জিহাদ চৌধুরী আছে তো,, অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যাক্তি,, ফাইলটা তাকেই দেখিয়ে নিস।”

কথাটা বলেই দর্শন চলে যেতে নিলেই রিহান বলে ওঠে,
–” ভাইয়া! খেয়ে যাও।”

দর্শন রাগী কন্ঠে বলে ওঠে,
–” কি বললাম,, তখন শুনতে পাস নি? আর তাছাড়া এইসব ন্যাকামি আমার সামনে করবি না। মাইন্ড ইট!”

কথাটা বলে দর্শন বেরিয়ে যায়। রিহান আহত চোখ নিয়ে দর্শনের চলে যাওয়া দেখে। দর্শন চলে যেতেই রিহান মায়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দেখে,, তার চোখ ছলছল করছে। রিহান মায়া চৌধুরীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে,
–” আই এ্যাম সরি,, মাম্মাম!”

মায়া চৌধুরী রিহানের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” তুই কেন সরি বলছিস বাবা?”

–” ভাইয়া আমার জন্যই বাসা থেকে খেয়ে গেলো না। আমি যদি ডাইনিং এ বসা না থাকতাম,, তাহলে ভাইয়া বাসা থেকেই ব্রেকফাস্ট করে যেতো। আমি ছিলাম জন্যই খাবার খেলো না বাসা থেকে।তাহলে তো,, আমিই দোষী বলো।”

–” ও অন্যায় করছে। এতে তোর কোনো দোষ নেই। এখনো ছেলেটা তার নিজের ভালোটা বুঝেই উঠতে পারলো না।”

রিহান কিছু সময় চুপ করে থেকে বলে ওঠে,
–” আমি আসি মাম্মাম! আমার অফিসের লেট হয়ে যাচ্ছে।”

মায়া চৌধুরী রিহানের মুখ কাছে নিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে ওঠে,
–” সাবধানে যাস বাবা!”

–” হুম!”

রিহান বেরিয়ে যায় নিজের অফিসের উদ্দেশ্যে। মায়া চৌধুরী একটা জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।

…………….জিহাদ চৌধুরী কিছু ফাইল ঘাঁটছে। মায়া চৌধুরী রুমে আসতেই জিহাদ চৌধুরী তার দিকে তাকিয়ে দেখে মায়া চৌধুরীর মুখটা একটু ভার ভার হয়ে আছে। জিহাদ চৌধুরী ফাইল গুলো একপাশে সরিয়ে রেখে মায়া চৌধুরীর দিকে এগিয়ে এসে বলে ওঠে,
–” কি হয়েছে মায়া? তোমার মন খারাপ মনে হচ্ছে।”

মায়া চৌধুরী জিহাদ চৌধুরীর দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” জিহাদ! আমার দর্শনটা কি সারাজীবন এমনই থেকে যাবে?”

–” এমোন কেন বলছো?”

–” তো আর কি বলবো বলো,, ওর এই মনোভাব কবে পাল্টাবে বলতে পারো? এতো গুলো বছর হয়ে গেলো,, এখনও তোমাকে বা রিহানকে মেনে নিতে পারে নি। রিহান কতো ভালোবাসে ওকে। আল্লাহ যে রিহানের মাধ্যমেই ওকে বাচিয়েছে। তাও ছেলেটাকে সহ্য করতে পারে না।”

জিহাদ চৌধুরী একটু শান্ত ভাবে বলে ওঠে,
–” ঠিক হয়ে যাবে মায়া! দেখো,, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর রিহানের জন্য দর্শন বেঁচে আছে,, এইটা কিন্তু দর্শন জানে না। কোনো কিছুই জানে না দর্শন। তাহলে,, হয়তো দর্শনের মনোভাব ঘুরে যেতো।”

–” আমি তো কতোবার বলতে চেয়েছি,, কিন্তু রিহানই তো বলতে দেয় না।”

–” কারন,, রিহান কোনো কিছুর বিনিময়ে তার ভাইয়ার ভালোবাসা পেতে চাই না। রিহান চাই,, এমনিই তার ভাইয়া তাকে ভালোবাসুক।”

–” কিন্তু,, এই পাগল ছেলে কবে বুঝবে সেইটা?”

–” বুঝবে। তুমি চিন্তা করো না।”

মায়া চৌধুরী জিহাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” এতো কিছুর পরও কিভাবে পারো,, দর্শনের হয়ে কথা বলতে?”

–” পারি! কারন,, দর্শন আমাকে বাবা হিসাবে না মানলেও,, আমি ওকে নিজের সন্তান মনে করি।আর সন্তান যাই করুক না কেন,, বাবা কি কখনো সন্তানের বিরুদ্ধে যেতে পারে?”

মায়া চৌধুরী নেতিবাচক মাথা নাড়িয়ে জিহাদ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে। জিহাদ চৌধুরীও আগলে নেয় তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে। মায়া চৌধুরী জিহাদ চৌধুরীর বুকে মাথা রেখে মনে মনে বলে ওঠে,
–” দর্শন! বাবারে! এই মানুষগুলো কে নিজের জীবন থেকে হারাস না বাবা! এই স্বার্থের দুনিয়ায় এই মানুষগুলো তোকে যে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে।”


সারাদিন গিয়ে সন্ধ্যা লাগবে লাগবে করছে। অফিসের মানুষ গুলো বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরেছে। রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্ট গুলো জ্বলে উঠেছে। দোকানের লাল,, নীল,, হলুদ,, বিভিন্ন রঙের বাতি জ্বলে উঠেছে।

সন্ধ্যার সময় প্রকৃতি অন্ধকার হয়ে গেলেও,, শহর মুখী মানুষ নতুন রং বয়ে নিয়ে যায়। পার্কগুলো বেশি সেজে উঠে। ফুটপাত গুলো যেন জীবন ফিরে পায়।

এমন পরিবেশে পার্কের এক পাশে একটা বেঞ্চে বসে এই ব্যাস্ততা উপভোগ করছে,, আর কারোর জন্য অপেক্ষা করছে জারিফা। জারিফা বার বার ফোনে সময় দেখছে। কিছু সময় পেরিয়ে যেতেই জারিফার পাশে কেউ ধপ করে বসে পড়ায় কিছুটা কেঁপে উঠে জারিফা।

জারিফা তাড়াতাড়ি পাশে তাকিয়ে দেখে রিহান। জারিফাকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে রিহান একটা হাসি দেয়। রিহানের পুরো মুখ ঘেমে আছে,, ক্লান্তও দেখা যাচ্ছে। জারিফা কিছু না বলে,, নিজের ওড়নার কোনা দিয়ে রিহানের মুখের ঘাম মুছিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
–” এতো লেট?”

–” সরি,, নতুন ডিল সাইন করেছি,, অফিসে অনেক প্রেশার ছিলো।”

–” সেইসব তো বুঝলাম,, তা মিস্টার রিহান চৌধুরী,, আমাকে মিসেস কবে বানাবেন?”

–” বানাবো,, খুব তাড়াতাড়ি।”

জারিফা কোনা চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” নিজের বাসায় বলছো না কেন আমাদের কথা?”

–” আরে বাবা,, কিভাবে বলবো বলোতো? ভাইয়ার এখনো বিয়ে হলো না,, আর আমি ছোট ভাই হয়ে আগে আগে বিয়ের কথা বলবো বাসায়। এইটা কি ভালো দেখায়?”

–” ওহ,, হ্যা! তোমার ভাইয়ার তো এখনো বিয়ে হয় নাই। আচ্ছা,, তোমার ভাইয়াকে বিয়ে দিচ্ছো না কেন? তোমার থেকে এক বছরের বড়,, তাহলে বিয়ের বয়স তো হয়ে গেছে।”

–” ভাইয়াকে রাজি করানোই একটা বড় ব্যাপার বুঝছো।”

–” তাড়াতাড়ি রাজি করাও। নাহলে,, তোমার মাথার চুল টেনে ছিড়ে ফেলবো আমি।”

রিহান অবাক হয়ে বলে ওঠে,
–” কি? আমার এতো সুন্দর স্টাইলিশ চুল টেনে তুমি ছিড়ে ফেলবা?”

–” হ্যা!”

–” শাঁকচুন্নি!”

–” তুমি শাঁকচুন্না!”

জারিফার কথা শুনে রিহান জোরে হেসে দিয়ে বলে ওঠে,
–” শাঁকচুন্না আবার কি?”

–” শাঁকচুন্নির মেল ভারসন।”

–” পাগলী একটা!”

–” ভালো হইছে।”

জারিফা কিছু সময় চুপ থেকে বলে ওঠে,
–” ফুচকা খাবো।”

–” এই অখাদ্য টা না খেলে তোমার হয় না?”

–” না হয় না! চলো ফুচকা খাওয়াবা।”

রিহান কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে,
–” এইসব খাওয়া ঠিক না।”

–” ধুর! চলো তো।”

জারিফা জোর করে রিহানকে ফুচকার দোকানে নিয়ে যায়,, তারপর বলে ওঠে,
–” মামা বেশি করে ঝাল দিয়ে দুই প্লেট ফুচকা দেন।”

রিহান এগিয়ে এসে বলে ওঠে,
–” ঐ আমি খাবো না।”

–” তোমাকে খেতে কে বললো?”

–” তাহলে,, দুই প্লেট কেন?”

–” আমি খাবো।”

–” আল্লাহ! বাঁচাও আমাকে।”

জারিফা রিহানের কথা শুনে হেসে দেয়। আর রিহান জারিফার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অদ্ভুত শান্তি অনুভব করে এই হাসির মাঝে,, রিহান।


দর্শন নিজের রুমে বসে ড্রইং করছে। মায়া চৌধুরী দর্শনের রুমে আসতেই দর্শন এক পলক মায়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। মায়া চৌধুরী এগিয়ে এসে বলে ওঠে,
–” বাসায় থাকলে সব সময় রুমে থাকিস। একটু তো নিচে যেতে পারিস,, সবার সাথে গল্প করতে পারিস।”

দর্শন কিছুই বলে না,, চুপ করে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। মায়া চৌধুরী দর্শনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠে,
–” কথা বলিস না কেন তুই? শেষ কবে আমার হেসে কথা বলেছিস মনে আছে তোর?”

দর্শন আকা থামিয়ে দাড়িয়ে মায়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আমি তোমার সাথে হেসে কথা বলবো? কেন বলবো বলো?”

মায়া চৌধুরী অবাক হয়ে বলে ওঠে,
–” মানে?”

দর্শন গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
–” মানে,, তোমার জীবনে আমার অবস্থান কোথায় মাম্মাম? তোমার জীবনে তো শুধু জিহাদ চৌধুরী আর ওনার ছেলে রিহান চৌধুরী। আমি কোথায় আছি তোমার জীবনে?”

মায়া চৌধুরী ছলছল চোখে বলে ওঠে,
–” তুই এইসব কি বলছিস বাবা?”

–” তো কি বলবো? আজ পর্যন্ত আমার কোন কাজকে তুমি সাপোর্ট করেছো তুমি বলতে পারবে? কিন্তু,, রিহানের সব ব্যপারে তুমি কেয়ার ফুল। আমি তো তোমার জীবনে আমার নিজেকে খুজেই পাই না।”

–” চুপ কর,, দর্শন! কি করিনি আমি তোর জন্য? শুধু আমি কেন,, রিহান তোর বাবা….”

কথা শেষ করতে পারে না মায়া চৌধুরী,, তার আগেই দর্শন রাগী কন্ঠে বলে ওঠে,
–” স্টপ মাম্মাম! ওনি আমার বাবা না। আর কতো বার বলতে হবে তোমাকে?”

মায়া চৌধুরী নিজের চোখ মুছে এগিয়ে এসে বলে ওঠে,
–” তুই বুঝবি দর্শন! আজ তুই যে মানুষ গুলোকে এইভাবে দুরে সরিয়ে দিচ্ছিস,, যদি তুই সবটা জানতি,, তাহলে নিজেও তাদের কাছে টেনে নিতি। কিন্তু,, আমি বলতে পারছি না। কারন,, আমি কথা দিয়েছি।”

দর্শন হালকা ভ্রু কুচকিয়ে বলে ওঠে,
–” মানে?”

মায়া চৌধুরী দর্শনের দিকে এগিয়ে এসে বলে ওঠে,
–” মানেটা বলতে পারবো না বাবা! কিন্তু,, আমার বিশ্বাস,, তুই ওদের একটা সময় অনেক ভালোবাসবি। আমি সেইদিনের অপেক্ষায় আছি।”

দর্শন কিছু বলে না,, মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। মায়া চৌধুরী দর্শনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে দর্শনের কপালে একটা চুমু দিয়ে রুম থেকে চলে যায়। দর্শন মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।

#_চলবে_ইনশাআল্লাহ_🌹

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে