#দহন_ফুল ৭
শাশুড়ীর অসম্ভব রকমের চুপচাপ থাকা আমার মোটেও ভালো ঠ্যাকছে না, মনে হচ্ছে প্রচন্ড ঝড়ের পূর্বাবস্থা। যে মানুষ সারাক্ষণ কুটচাল নিয়ে থাকে সে যখন চুপচাপ থাকে তখন বুঝতে হবে বড় কোনো জট পাকাচ্ছে ভেতরে ভেতরে।
আজ এক দেড়মাস যাবত বাসায় কোনো ক্যাঁচাল হচ্ছে না, আমার খালি হিন্দী সিনেমার ডায়লগ মনে পড়ে, ইধার ইতনি সান্নাটা কিউ হ্যায় ভাই। নিজেই হাসি আবার নিজেকে শাসন করি, মানুষ তো বদলাতেই পারে।
কতটা বদলেছে টের পাওয়া গেলো মাসখানেক পর। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ এক ছুটির দিনে বাপি মা এসে হাজির।
আমিতো পুরাই সারপ্রাইজড! ঘরে খাসির মাংশ ভুনা করা ছিলো ভাবী তাড়াতাড়ি ইলিশ মাছ, মুরগী ফ্রিজ থেকে নামিয়ে রান্না করলো। টেবিল ভর্তি করা হলো যৎসামান্য যা আছে তা দিয়ে, আমার কেনো জানি ভেতরে ভেতরে ভয় লাগছিলো, কেউ আবার নালিশ টালিশ করলো না তো? ইদানীং একটু বেশি সাহস দেখিয়ে ফেলেছি যার খেসারত দিতে হতে পারে।
দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই বৈকালিক আড্ডায় বসলো। বাপি সামিরকে ডেকে নিয়ে কাছে বসালেন তারপর হাতে একটা চাবির রিং তুলে দিলেন। সামির জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বাবা বললেন,
— প্রভার কাছে শুনেছি তোমার একটা মার্সিডিজ বেঞ্জ ব্র্যান্ডের গাড়ির খুব শখ, এটা আমার তরফ থেকে তোমাকে উপহার।
— না না বাবা, এটা আমি নিতে পারবো না, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করবেন।
— কেনো বাবা, আমার যা আছে সবই তো দিবা আর প্রভার তারমানে তোমাদেরও। নিতে আপত্তি কিসের?
— না বাবা এ হয় না, ওদের সম্পত্তি ওরা যা করার করবে তাতে আমার বা আমাদের নাক গলানো ঠিক হবে না।
শাশুড়ী মা সবার সাথে এই আড্ডায় বসে থেকে সব শুনছেন, একসময় বললেন,
— উনি ভালোবেসে দিচ্ছে নিয়ে নে বাবা।
— মা তুমি এই বিষয়ে কথা বলো না প্লিজ।
শাশুড়ীর মুখ গভীর কালো হয়ে গেলো, আর চোখ ঠিকরে যেনো আগুন বেরুবে। কখনো উনার মুখের উপর কেউ কথা বলেনি, আজ ছেলের সাহস দেখে মাথায় আগুন জ্বললো বোধহয়।
উনি উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
বাপি আবার বললেন,
— সামির তুমি কি বাবা আমার উপর কোনো কারণে রাগ হয়েছো। প্রভা কিছু বলেছে?
— না না বাবা, আসলে আমি চাচ্ছি নিজের যোগ্যতায় এসব জিনিস অর্জন করতে, এ যাবত যা দিয়েছেন তা অনেক।
বাকী সব নিজ যোগ্যতায় অর্জন করতে চাই নিজের আত্মতুষ্টির জন্য।
বাপি উঠে সামিরকে বুকে জড়িয়ে নিলেন,
— বাবা আজ আমি ভীষণ খুশি হলাম, আমার মেয়েটা সঠিক মানুষের হাতেই দিয়েছি।
মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন মাথায় স্নেহের হাত রাখলেন। আমার আনন্দে চোখে পানি চলে আসলো, সামিরের প্রতি মন ভালো লাগায় ভরে গেলো।
রাতে খেতে বসে শ্বশুর বাবা সামিরকে বললেন,
— আই এম প্রাউড অফ মাই সান। এমনটাই হওয়া উচিত।
সামির খুশিমনে বললো,
— ধন্যবাদ বাবা, দোয়া করো কথা যেনো রাখতে পারি।
— ইনশাআল্লাহ পারবি বাবা।
শাশুড়ী ফোঁড়ন কাটলেন,
— তা বটে, গর্ববোধ করো যত খুশি, এদিকে মাকে যত খুশি অপমান করুক।
সামির বললো,
— মা আমি তোমাকে মোটেও অপমান করিনি, শুধু ব্যাপারটাতে জড়িত হতে মানা করেছি।
— হ্যা দিনদিন সাহস ও বাড়ছে মায়ের মুখের উপরও কথা বলো।
শ্বশুর বাবা বললেন,
— পারুল তোমার ছেলের সেলফ রেসপেক্ট দেখে খুশি হবার বদলে উল্টাপাল্টা কথা বলছো? তুমি আর বদলালে না?
শাশুড়ীর দিকে মাংসের বাটিটা এগিয়ে দিলাম, বেশ খানিকটা তরকারি ও ভাত নিলেন। আয়েশ করে মেখে মুখে লোকমা তুললেন। তারপর বললেন,
— বাদ দাও, আমিতো চিরকালই খারাপ, এখন যে জরুরী কথাটা বলতে যাচ্ছি তা মনোযোগ দিয়ে শোনো সবাই।
— হুমম বলো শুনছি (শ্বশুর বাবা বললেন)
— মজিদের মেয়ে সাবিহার কথা তো মনে আছে তোমাদের।
— হ্যা আছে, সাবিহার কি হয়েছে?
— ওর মাস ছয়েক আগে তালাক হয়ে গেছে, শাশুড়ীটা বড্ড পাজী ছিলো, এতো ভালো একটা মেয়ে খুব জ্বালাতন করতো মেয়েটাকে, শেষ পর্যন্ত সংসারটা আর টেকেনি।
— হুমম, তোমার মতো ভালো বুঝেছি।
— কিছু বললে নাকি?
— না তেমন কিছু না তুমি বলো?
— আমি চিন্তা করেছি?
— কি চিন্তা করেছো?
— চিন্তা করেছি সাবিরের সাথে তার বিয়ে দেবো?
ঘরে হঠাৎ করে যেনো বাজ পড়লো, উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো, কারো মুখে কোনো কথা নেই। ভাবী আমাকে দু’হাতে খামছে ধরলো। আমি ভাবীর দিকে তাকিয়ে আছি।
— হোয়াট? তোমার মাথা ঠিক আছে? সাবির বিবাহিত একথা কি ভুলে গেছো?
— আমার মাথা ঠিকই আছে.. বিবাহিত একথা ভুলবো কেনো? পাঁচ বছর হতে চললো এখনো সন্তান সন্ততি হয়নি আর হবার আশাও নেই। ও বউ বাঁজা ওর বাচ্চা কাচ্চা হবে না।
সাবির ভাইয়া ক্ষেপে গেলেন,
— মা এমন কথা তুমি বলতে পারলে? আমার জীবন থাকতে আমি এই কাজ করতে পারবো না।
— সাবির!! তুমি আমার মুখের উপর কথা বলছো?
— হ্যা বলছি, তুমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো?
— কি সীমা ছাড়াচ্ছি? আমি তো বউ ছেড়ে দেবার কথা বলিনি? দুই বিয়ে কি মানুষ করে না?
— আমি এই কাজ কখনোই করবো না।
বলে খাবার ফেলে রেগেমেগে নিজের রুমে চলে গেলেন।
শাশুড়ী নির্বিকার চিত্তে খেতে লাগলেন, শ্বশুর তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন,
— তুমি কি মানুষ? কদিন ঘরে শান্তি বিরাজ করছিলো দেখে ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় বদলে গেছো? কিন্তু কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না।
— যত যা খুশি বলো আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না, সাবিহাকে আমি সাবিরের বউ করে ঘরে আনবোই। নাতিপুতির মুখ তো আমারও দেখতে ইচ্ছে করে নাকি?
— অসভ্য মহিলা…. বাপ হয়ে আমাকে বলতে হচ্ছে, মাঝরাতে যখন তোর হাত পায়ে কড়কড়ি মড়মড়ি ব্যথা উঠে বউকে তুলে এনে হাত পা টেপাস। ছেলেকে বউকে সময় কাটাতে না দিলে বাচ্চা কি আকাশ থেকে পড়বে? জন্তু কোথাকার! আমারই ভুল হয়েছে ওইসময় তোকে পিটিয়ে তখন তোর হাত পা লুলা করে দেওয়া উচিত ছিলো। যাতে সারাজীবন বিছানায় পড়ে থাকিস? আর যেনো এমন অলুক্ষুণে কথা এই ঘরে না শুনি, আর যদি শুনি খুব খারাপ হবে বলে রাখলাম।
বলেই ভাতের প্লেট মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, রুমে চলে গেলেন। শাশুড়ী কিছুই হয়নি ভাবে খেতে লাগলেন।
আর ভাবী এদিকে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন।
আমাদের কারো আর রাতে খাওয়া হলো না।
হাসিখুশি আনন্দময় পরিবেশটা গোরস্থানের নীরবতায় পরিণত হলো।
পরদিন খাবার টেবিলে সবাই বসেছে মরা বাড়ির মতো শোকের পরিবেশ, ভাই ভাবী সারারাত ঘুমায়নি তাদের চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ভাবীর চোখ দুটো ফুলে টকটকে লাল হয়ে আছে। চুপচাপ সবাই খাবার খাচ্ছে, হঠাৎ শাশুড়ী বললেন?
— কি সিদ্ধান্ত নিলে সাবির?
— কোন বিষয়ে?
— সাবিহাকে বিয়ের ব্যাপারে?
— এই কাজ আমি জীবনেও করবো না।
— তবে শুনে রাখো, সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি এটা আমি করেই ছাড়বো।
শ্বশুর বললেন,
— খারাপ মহিলা.. তুই আর ভালো হবি না।
এবার শাশুড়ী রেগে গেলেন,
— কাল থেকে যা খুশি তাই বলছো? আমি অন্যায় কি বলেছি?
— ছেলের সংসারে আগুন লাগাচ্ছিস? আর অন্যায়ের বাকী আছে কি?
— কি আগুন লাগাচ্ছি, আমি কি বউকে ছেড়ে দিতে বলেছি? দুই বিয়ে কি কেউ করে না? তাছাড়া পুরুষ মানুষ দুই বিয়ে করলে কিছু হয় না। দুই বউ একসাথে মিলেমিশে থাকলেই হয়। মেনে নিলেই তো শান্তি।
— যা বলছিস ভেবে বলছিস তো?
— হ্যা ভেবেই বলছি।
সাবির খাবার ফেলে উঠে পড়ে, শাশুড়ী জোর গলায় চিৎকার করে বলেন,
— আমার কথা যদি মেনে নেয়া না হয় তবে আমি আজ থেকে এখন থেকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করলাম। নিজেকে রুম বন্দি করলাম, যতক্ষণ আমার দাবী মানা না হয় ততক্ষণ আমি খাবোও না, রুম থেকে দরকার হলে আমার লাশ বের হবে।
— তাহলে তুই মর!
সাবির ভাইয়া সামির, শ্বশুর উঠে চলে গেলেন।
হঠাৎ ঠাশ করে কিছু পড়ার শব্দে সবাই দৌড়ে রান্নাঘরে গেলাম। গিয়ে দেখি মাসুমা ভাবী মাথাঘুরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন।
শাশুড়ী ফোঁড়ন কাটলেন
— ঢং শুরু হয়েছে বিয়ে আটকানোর জন্য, কোনো কাজ হবে না।
শ্বশুর বললেন,
— জানোয়ার কোথাকার!
চলবে।
#শামীমা_সুমি