দহন পর্ব-২৩

0
586

দহন_২৩

নীলার মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে আকাশের মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। আকাশ কে কেউ কোনো বিষয়ে বাধা দিতে পারেনা। আকাশ মনে করে নীলা এখনো বেঁচে আছে। আকাশের কথা কেউ যে বিশ্বাস করেনা, এমন হাভভাব কেউ দেখায় না। সেদিন দাফনের সময় আকাশ বলেছিলো নীলা বেঁচে আছে। কিন্তু সবাই উত্তজিত হয়ে বলে বউ শোকে আকাশ পাগল হয়ে গেছে। এই কথার শোক সহ্য করতে না পেরে দ্বিতীয়বারের মতো আকাশ স্ট্রোক করে। ডক্টর বলে দিয়েছে আকাশ যেই বিষয় ডিপভাবে ভাববে ওই বিষয়গুলো ভূল হলেও আপনারা তাকে শায় দিবেন। কোনোভাবে রোগীকে উত্তেজিত করলে গোমায় চলে যাবে। আকাশের স্নায়ুতন্ত্র কাজ করবেনা। ছেলের কথা ভেবে এই বাড়িতে রেহেনা কখনো নীলা যে মৃত দ্বিতীয় বার উচ্চারণ করে নাই। কারণ তিনি মনে করেন নীলা বেঁচে আছে আমাদের স্মৃতির অন্তরে। চাইলেও ভোলা সম্ভব নয়। মা হিসাবে ছেলেকে ভালো রাখার জন্য বলে, নীলা কানাডা গেছে আকাশ। দ্রুত ফিরে আসবে। আপাতত এইভাবে আকাশকে শান্ত রাখছে রেহেনা শিকদার। এই বিষয়গুলো ভাবতে ভাবতে রেহেনার চোখের দুফোটা পানি টপ টপ করে আকাশের কপালে পড়ে।

আকাশ সোফা থেকে উঠে বসে বলে ___

” আম্মা তুমি কাঁদছো। কি হয়েছে তোমার? কেউ কিছু বলছে তোমাকে? একবার তার নাম বলো মাথা ফেটে দিয়ে আসবো। আমার আম্মার চোখের পানি আর নীলা দূরে যাওয়ার কষ্ট কিভাবে একসঙ্গে সহ্য করি। ”

রেহেনা শিকদার ছেলেকে শান্ত রাখার জন্য দ্রুত নিজের আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে বলে ___

” কিছু হয় নাই আকাশ আমার। আসলে চোখে উড়ি পোকা পড়ছিলো তো তাই জ্বালা করছে একটুখানি। তারজন্যই সম্ভবত চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ”

” কি বলছো মা তুমি। নিজের যত্ন নেওয়া বন্ধ করে দিছো। একবার ভেবে দেখলা না তুমি ছাড়া আমি শূন্য। নীলা নেই আমার কাছে, এখন তুমি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ো। তাহলে আমার মাথা ব্যাথা উঠলে কে টিপে দিবে। চোখের ড্রপ গুলো কই রাখছো দেখি আমি নিয়ে আসি। ”

” কিছু করতে হবেনা আকাশ তোকে। তোর মাথা ব্যাথা কমেছে নাকি আরেকটু টিপে দিবো? ”

” আমার চিন্তা করতে হবেনা তোমাকে। নিজের শরীরের ঠিকমতো যত্ন নেওয়া বন্ধ করে দিছো। এখন যদি নীলা বাড়িতে এসে তোমার আমার এই অবস্থা দেখে, তাহলে তোমাকে আর আমাকে কত বকবে। এইদিকে তুমি আমাকে অফিসেও যেতে দেওনা। অফিস না যেয়ে আমার অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্কার গুলোও আমাকে ফোন দেয়না। শেষ বয়সে আর কতো চাপ নিবে তুমি। ”

” আমি তোকে মানা করছি না। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত অফিসের নাম নিবি না। তাহলে এসব বলছিস ক্যান। এরআগেও আমি অফিস সামলিয়েছি তোর বাবার সঙ্গে। নাকি তোর মায়ের উপর ভরসা নেই। ”

” ভরসা আছে বলে তো কিছু বলতেও পারছিনা। আচ্ছা আম্মা চোখে ড্রপ দিয়ো আমি আসি। সাফা আবার ঘুম থেকে উঠে আমাকে দেখতে না পেলে কান্না করতে পারে। ”

” হ্যা যা আকাশ। ”

নীলার ডেড বডি দাফনের আগে আকাশের কথা যখন কেউ বিশ্বাস করতেছিলো না। তখন আকাশ স্ট্রোক করে দ্বিতীয়বারের মতো। জ্ঞান ফিরলে আকাশের পাগলামো বাড়ে। শুধু নীলাকে দেখতে চাইতো। তখন ডক্টর রেহেনা শিকদার কে বলেছে। একসঙ্গে দুবার স্ট্রোক করার আকাশের স্মৃতি বড়শোকের দুঘর্টনা মুছে গিয়েছে। কেউ তাকে এসব বিষয় মনে করার চেষ্টা করাইয়েন না। সত্যি টা নেওয়ার অবস্থায় নেই পেসেন্ট। আস্তে আস্তে ভালো হলে ক্লিয়ার করবেন। কিন্তু চারমাস হয়ে গেলো এখনো আকাশের স্মৃতিতে নীলাই বিরাজ করছে। অফিস যেতে চাইলে রেহেনা শিকদার এইভাবে নাটক সাজায়। বলে আমি অফিস করবো এখন থেকে তোর ফুল রেস্ট। প্রথমে আকাশ মানতে রাজি না হলেও পরে মায়ের জেদের কাছে হার মানে। আকাশের স্মৃতিতে এখনো শিকদার কোম্পানি বিরাজ করছে।

_______

” এসআই আরিয়ান ভিতরে আসুন। ”

এসআই আরিয়ান ভিতরে ঢুকে নীলাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। কি ব্যাপার ম্যাডাম আপনি জীবিত আছেন? তাহলে আমি সেইদিন কার জানাযায় শরীক হয়েছিলাম।

” সে অনেক লম্বা গল্প আরিয়ান স্যার। সেগুলো নাহয় পরে জানবেন। তবে আপনি এই কথাটা শুনে রাখুন। আমার যখন জ্ঞান ফিরে তখন জানতে পারি শিকদার কোম্পানি অগ্নিদহনে পুড়ে গেছে। সংবাদ মাধ্যমে জানি তথ্যমতে ওইখানে ১৯ জন উপস্থিত ছিলো। কিন্তু ভিতর থেকে উদ্ধার কর্মীগণ ১৮ জনকে উদ্ধার করছে। একজন নিখোঁজ ছিলো আর সেই নিখোঁজ হওয়া ব্যাক্তি টি আমি। সংবাদ মাধ্যমে এইটাও প্রকাশ হয় নিখোঁজ হওয়া সেই ব্যাক্তি এই আগুন ধরিয়েছে। পুলিশ তাকে খুজছে। এখন আমি যদি হুট করে আমার বাড়িতে যেতাম। এই সমাজ আমার দিকে আঙুল তুলতো। নিজের শশুড়বাড়ির দিকে তাকাতে লজ্জা পেতাম। আমি যেই ভূল কখনো করিনাই সেই ভূলের যন্ত্রণা ক্যান বয়ে নিয়ে বেড়াবো। সো আমি যখন সবার কাছে মৃত।মৃত হয়ে থেকেই অপরাধ দমন অব্দি গেলাম। ”

” আপনার অনেক ধৈর্য শক্তি ম্যাম? সেদিন আকাশ স্যার ঠিক ছিলো। ওনি কিছুতেই কাউকে বিশ্বাস করাতে পারছিলো না পুড়ে যাওয়া মেয়েটি আপনি নন। কিন্তু আপনি চরম ভূল করলেন এতোবড় মাস্টার প্লান গেইম সাজাতে গিয়ে আকাশ স্যারকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন? ওনি মানসিক ভাবে অসুস্থ। যতদূর জানি আপনি কানাডায় কাজে গিয়েছেন এই কথা বলে রেহেনা শিকদার তার ছেলেকে সুস্থ রাখছে। কারন আকাশ স্যার দুইবার ঘনঘন স্ট্রোক করাতে মাথায় সমস্যা হয়ে গিয়েছে। ”

” সত্যির সঙ্গে মোকাবিলা করা অনেক কঠিন আরিয়ান স্যার। আমাদের চারপাশে সবাই মুখোশ পড়ে ঘুড়ে বেড়ায়। সব মানুষের ভিতরে আলাদা একটা রুপ থাকে। কারো রুপ সুন্দর কারো রুপ নোংরা। কখনো কি ভেবেছিলাম সরষের মধ্যে ভূত রয়েছে। যার জন্য এতোকিছু করলাম আমি আর আমার স্বামী। সেই পিছন দিক থেকে আক্রমণ করলো। ”

” প্রতিশোধের নেশা বড্ড খারাপ ম্যাডাম। এরা আসলেই মানুষরুপী একেকটা জানোয়ার। এদের কাছে থাকলে কখনো সত্যি অব্দি পৌছাতে পারতেন না। কারণ এরা আপনাকে বিভ্রান্তিতে ফেলতো। সত্যি অব্দি যাওয়ার জন্য আসলেই একটা ছদ্মবেশ দরকার। আপনাকে স্যালুট জানাতে ইচ্ছে করছে। এতোটা ধৈর্যগুণ সব নারীর ভিতরে থাকুক। তাহলে পৃথিবীতে অপরাধগুলো নাম পাবে। ”

” ধন্যবাদ স্যার। আজ চারটা মাস স্বামী হারা হয়ে আছি। স্বামী মানসিক ভাবে অসুস্থ। যে চারদিকে শুধু আমাকে খুঁজছে কিন্তু পরিস্থিতির চাপে তাকে কাছে নিয়ে একটিবার হাগ করেও তার যন্ত্রণা লাঘব করতে পারি নাই। কতোটা অসহায় হলে মানুষ এরকম করে। আর এসব কিছু সম্ভব হয়েছে জয় ভাইয়ার কারণে। বিগত ০৪ টি মাস আমাকে মানসিক ভাবে সাপোর্ট দিয়ে সত্যির সঙ্গে লড়াই করার সাহস জুগিয়েছে এই একটি মানুষ। আল্লাহ তালা আমার ভাই দেয় নাই কিন্তু জয় ভাইয়াকে কাছে পেয়ে সেই স্বাদ উপভোগ করছি। ”

” আচ্ছা ম্যাম এসব নিয়েও পরে ডিসকাস করবো আগে এই অপরাধী দুইটাকে তুলি। আপনি ভালো থাকবেন। দেখা হবে আবারো আপনার বাড়িতে। আল্লাহ হাফেজ। ”

বেলাল ও মাসুদ আরমান শিকদারকে গাড়িতে তুলে। বৃষ্টিকে গাড়িতে তুলে মহিলা পুলিশ।

____

টিভিটা অন করে রেহেনা শিকদার। সাফাকে সোফায় বসিয়ে পায়েস খেতে দেয়। বৃষ্টির ফোনটা লাগছে না। তাই একাই ড্রয়িংরুমে বসে বসে চ্যানেল ঘুরাঘুরি করছিলো। আকাশ নিজের রুম থেকে দ্রুত বের হয়ে আসে। কারণ আজকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ম্যাচ আছে।

” আম্মা রিমোট টা দাও তো। বাংলাদেশ পাকিস্তান ম্যাচ শুরু হয়েছে। খেলা দেখবো? ”

রেহেনা শিকদার ছেলের হাতে রিমোট দিয়ে আকাশের জন্য ফ্রিজে রাখা পায়েস আনতে গেলো। কারণ আকাশ ক্রিকেট ম্যাচ দেখার সময় কিছু না কিছু খায়।

” আম্মা আম্মা কই গেলে তুমি? দেখো দেখো তোমার পছন্দের ক্রিকেটার লিটন দাস ব্যাট হাতে মাঠে দাড়িয়ে আছে। ”

রেহেনা পায়েস টা এনে দ্রুত আকাশের সামনে রেখে বললো ___

” ছেলেটার ফিফটি দেখি না বহুদিন হলো। আজকে যেনো একটা ফিফটি করে। ”

” হুম মা! করবে বলেই পায়েস খাওয়া শুরু করে দিলো। ”

” আকাশ আকাশ লিটু ৬ মারলো তাও আবার শাহিন শাহ আফ্রিদির বলে। ”

” আজকে তুৃমি খেলা দেখছো না। দেখো আজকে ফিফটি হয়েই যাবে। আম্মা পায়েসটা দারুণ লাগলো। আরেকবাটি হবে? ”

রেহেনা শিকদার অবাক হয়ে যায়। কারণ আকাশ অনেকদিন হলো কোনো খাবার এক বাটি উপর দুই বাটি খায়না। বেশ কিছু টা অবাক হলেও আবার ভালো লাগছে। খুশিতে দৌড়ে আনতে গেলো পায়েসের বাটি। খেলার ভিতর এড আসাতে আকাশ নিউজের চ্যানেল দেয়।

” আজকের ব্রেকিং নিউজ শিকদার কোম্পানিকে অগ্নিদহনে পুড়িয়েছে। রেহেনা শিকদারের মেয়ে বৃষ্টি শিকদার ও আমজাদ শিকদারের ভাই আরমান শিকদার। আজকে বাদী পক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি বৃষ্টি শিকদার তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শিকদার কোম্পানিকে পুড়িয়েছে। আরমান শিকদার ভাইয়ের থেকে সবকিছু কেড়ে নেওয়ার মতলবে এসব করেছে। আজকে পুলিশ তাদের এরেস্ট করেছে। দীর্ঘ চারমাসের পর এসকল চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আনলো আকাশ শিকদারের ওয়াইফ নীলা শিকদার। আমরা এতদিন ধারণা করেছিলাম নীলা শিকদার অগ্নিদহনে মারা গেছে। কিন্তু সে আসলে মারা যায় নাই। মুখোশের আড়াল থেকে অপরাধীদের সামনে নিয়ে আসছে। প্রত্যেকটা ঘরে ঘরে নীলা শিকদারের মতো ধৈর্যশীল মেয়ে বউ হোক। ”

রেহেনা শিকদারের পায়েসের বাটি মাটিতে পড়ে যায়। আকাশ অবাক হয়ে যায় ভ্রু কুচকে মায়ের দিকে চোখে চোখে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এমন সময় রেহেনা শিকদারের সদর দরজার কলিং বেল বাজে। রেহেনা শিকদার আকাশের সঙ্গে কথা না বলে দৌড়ে সদর দরজার কাছে যায়। দরজা খুলতেই চোখগুলো বিশাল বড় বড় হয়ে যায়। এবং প্রশ্ন করে তুমি এখানে?

চলবে,,,
®️রিয়া_জান্নাত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে