দহন পর্ব-১৪

0
718

#দহন
#রিয়া_জান্নাত
#পর্ব_১৪

আমজাদ শিকদার আপনি সাংবাদিক শাজাহান কে কেনো মারলেন?

” স্যার ধরা যেহেতু পড়েছি। লুকুচুরি করে লাভ নেই। স্যার সবকিছু বলার আগে আমি ১ গ্লাস পানি খেতে চাই। আসলে গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে তো। ”

আরিয়ান হাবিলদারকে ইশারা করে পানি আনার জন্য। হাবিলদার ঠান্ডা এক ক্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে আমজাদ শিকদারের সামনে দেয়। আমজাদ শিকদার ঢোক ঢোক করে দ্রুত পানি পান করে।

আরিয়ান জিজ্ঞেস করে___” কি আমজাদ শিকদার এক্ষুনি গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ”

আমজাদ করুণ মুখে তাকায় এসআই আরিয়ানের দিকে __

” অফিসার জীবনে কি করলাম আমি। এই আত্মগ্লানি নিয়ে বাচবো কি করে? ছেলে বউকে মুখ দেখাবো কি করে? অপরাধ কোনোদিন চাপা থাকেনা অফিসার। ”

” অপরাধ করার আগে এসব যদি একবার ভাবতেন তাহলে এতো অপরাধ সংগঠিত হতো না। এখন বলেন শাজাহানকে কেনো মারলেন আপনি? ”

” স্যার গুলশানের কোয়ালিটি ইন ( আবাসিক হোটেল) এর মালিক আমি। এই কথা শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া কেউ জানতো না। এমনকি আমার স্ত্রী, ছেলে ও না। কারণ সবাই জানতো হোটেলে খাওয়া দাওয়া থাকার ব্যবস্থা করা হয়। যারা দূর দূর থেকে আসতো তাদের সুন্দর ভাবে আপ্যয়ন করতো আমার স্টাফগণ। কিন্তু এই হোটেলের দ্বিতীয় ফ্লোরে আমি অন্য ব্যবসা করতাম। সবাইকে সেফটি দিয়ে কাপলদের রাত কাটানোর ব্যবস্থা করানো হতো। আবার অনেক দূর দূরান্ত থেকে লোক আসতো। তাদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করানো হতো। এরজন্য ২৪ মেয়ে এই কাজের সঙ্গে জড়িত আছে। তো একদিন শাজাহান এই হোটেলে রাত কাটাতে আসে। শাজাহান তৃতীয় ফ্লোরের ৩২নম্বর রুম বুকিং করে। কিন্তু সে রাতে শাজাহান দ্বিতীয় ফ্লোরে আসে। এসে দেখতে পায় এসব অবৈধ মেলামেশার আয়োজন চলে
কোয়ালিটি ইন আবাসিক হোটেলে। সাংবাদিক হওয়া দরুণ তার কাছে ক্যামেরা ছিলো। সেই মূহুর্তে শাজাহান দ্বিতীয় ফ্লোরের কুকীর্তি ক্যামেরাবন্দি করে। এরপরে আমার স্টাফকে ব্ল্যাকমেইল করে সেই রাতে। স্টাফ আমাকে ফোন করে জানায় সম্পূর্ণ ঘটনা। আমি টাকা দিয়ে স্টাফকে ম্যানেজ দিতে বলি। কিন্তু শাজাহান টাকার প্রস্তাবে রাজি হয় নাই। এরজন্য বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে রওনা হই হোটেলে। আমি শাজাহানের সাথে কথা বলি। কিন্তু শাজাহান আমার কথার মূল্য দেয়না। আমি প্লানমতো ওয়েটার দিয়ে শাজাহানকে খাবার পরিবেশন করি। শাজাহান সেই খাবার গপ গপ করে খায়। কারণ সেই খাবারকে কেউ না করতে পারেনা। আমি এই খাবার শুধু স্পেশাল লোকদের পরিবেশন করি। যারা আমার পথের বাধা হয়ে দাড়ায় শুধু তাদের এই খাবার আপ্যয়ন করি। ”

” খাবারে কিছু মেশান নাকি আমজাদ শিকদার। যে খাবারকে কেউ না বলতে পারেনা? ”

” আসলে আমি খাবারে কিছু মেশাই না। কিন্তু খাবার টা খুবই স্বাদ যুক্ত ডিস বানাই। খাবারের পর যে চা বা কফি খাওয়াই সেই চা বা কফিতে ইথিলিন গ্লাইকল বিষ মিশিয়ে দেই। ইথিলিন গ্লাইকল বিষ হলো তরল পদার্থ। এই বিষের নানান রঙ থাকে। আমি চা বা কফিতে সাদাটা ব্যবহার করি। সর্বশেষ বড়কথা হলো ইথিলিন গ্লাইকল বিষ সুগার হিসাবে ব্যবহার হয়। চা বা কফি অনেক মিষ্টি হয় এরজন্য। কোনো লোক যদি ইথিলিন গ্লাইকল বিষ পান করে তাহলে ১৬ ঘন্টার মধ্যে সে মারা যাবে। তারচেয়ে বড় কথা হলো এই বিষ শরীরে প্রবেশ করার সাথে সাথে আধঘন্টা স্থায়ী থাকে। পড়ে শরীরের সাথে মিশে গিয়ে কিডনি ফেলুয়ার হয়। ল্যাবে যদি বডি পরীক্ষা করা হয় নিখুঁত ভাবে তাহলে ডক্টর রা বলবে ডেডবডি কিডনি ফেলুয়ার হয়ে মারা গেছে। শাজাহানের সাথে ঠিক সেরকম করেছিলাম। ইথিলিন গ্লাইকল খাওয়ার পর শরীর দুর্বল দুর্বল লাগে। শাজাহানেরো তাই লেগেছিলো। গাড়ি ড্রাইভ করতে পারে নাই। মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়েছে। যাতে পুলিশরা এটা মনে করে ডেড বডি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কিন্তু আমার এই প্লান বিফল করে দিলেন আপনারা। আমি ভয় পেয়েছিলাম যদি সত্যি সামনে আসে তাহলে স্ত্রী ও ছেলেকে মুখ দেখাবো কি করে। আরেকটা কথা আছেনা পৃথিবীতে পারফেক্ট ক্রাইম বলে কিছু হয়না। আমার অন্তরের ভয় আমার কাল হয়ে দাড়ালো। ভয়ের কারণে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মর্গে লাশ চুরি করার ফালতু প্লান করে ফেসে গেলাম। আসলে ৩০ বছরে এরকম হয়নিতো। ”

” তারমানে ৩০ বছরে যত সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে সবকিছুর মূলে তাহলে আপনিই রয়েছেন। ”

” ধরা যেহেতু পড়েছি। দোষ গোপন করবো না। হ্যা আমিই করেছি সব। অনেক ভূল করেছি আমি। একটা পাপ ঢাকার জন্য ২৮ হত্যা করেছি। কি পেলাম জীবনে। এই অবৈধ ব্যবসার জন্য শেষ বয়সে মান সম্মান পতিপত্ত সব হারালাম। ”

রেহেনা পুলিশ কাস্টোডিতে আসে। আমজাদের শেষের কথা শুনতে পায়। আমজাদ শিকদার ২৮ টা সাংবাদিকদের হত্যা করেছে এই কথা শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। রেহেনা চোখের নোনাজলে শাড়ির আচল ভিজে উঠলো। রেহেনা এসে জিজ্ঞেস করলো তারমানে রায়হানকেও তুমি হত্যা করেছো।

রেহেনার মুখ দেখে আমজাদ মাথা নিচু করে ফেলে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আমজাদ দ্বিধায় পড়ে গেলো রেহেনার প্রশ্ন শুনে?

এমন সময় নীলা ও আকাশ কাস্টোডিতে ঢুকলো। পুলিশের কাছে আমজাদের স্টেটমেন্ট শুনে আকাশ বললো ___

” ছি! তোমাকে আমি এতদিন বাবা ডেকেছি। তুমি আদৌও বাবা হওয়ার যোগ্য। তোমার একটা ভূল ঢাকার জন্য কতগুলো মানুষের বুক উজার করেছো তোমার ধারণা আছে বাবা। ছি! বাবা আমি মানুষ কে মুখ দেখাবো কি করে? আম্মা তোমাকে এরজন্যই বোধহয় মন থেকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারেনাই। কারণ ওনি তোমার কলুষিত রুপ সম্ভবত আগেই দেখে নিছিলো। ”

আরিয়ান ধমক দিলো সবাইকে। আপনারা সকলে শান্ত হোন। আপনারা বাড়াবাড়ি করলে কাস্টোডি থেকে আপনাদেরকে বের করতে বাধ্য হবো। এই মূহূর্তে আমি অপরাধীর স্টেটমেন্ট নিবো শুধু

রেহেনা বলে ___

” স্যার আমাকে কথা বলতে দিন। আমাকে জানতে হবে। এইটা আপনার কেইসের অংশ হবে। অবান্তর কথা বলবো না! ”

” আচ্ছা বলেন। ”

” কি ব্যাপার আমজাদ কথা বলছো না কেনো? বলো তুমি কি রায়হান কে মারছো! ”

আমজাদ এবার নিজের প্রেয়সীর দিকে মুখ তোলে। মনে মনে বলে আর কত অপরাধ বয়ে নিয়ে বেড়াবে। একবার যেহেতু স্ত্রী ও ছেলের সামনে মুখোশ খুলে গেছে তো সবটাই এবার বলে দিই।

“হ্যা রেহেনা আমি রায়হানকে ইথিলিন গ্লাইকল বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলি। ও আমার কোয়ালিটি ইন আবাসিক হোটেলের রহস্য জেনে গেছিলো। সবকিছু ও ক্যামেরাবন্দি করেছিলো। আমি অনেক অনুনয় বিনয় করি। কিন্তু সে আমাকে পাত্তা না দিয়ে চলে যায়। আমিয়ো নিশ্চিতে ছিলাম কিছু হবেনা আমার। রায়হান ১৬ ঘন্টা পর বিষের বিষক্রিয়ার মারা যায়। মারা যাওয়ার আগে ও গাড়ি এক্সিডেন্ট করে। আমি ওকে অনুকরণ করেছি ১৬ ঘন্টা থেকে। সড়ক দুর্ঘটনায় তুমি আহত হয়ে যাও। রায়হান মারা যায়। কিন্তু রায়হানের মেয়ের কিছু হয়নাই। আমি বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিই কারণ বাচ্চাটিকে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু পথিমধ্যে আমার পিপাসা পায় মিনারেল ওয়াটার নিতে দোকানে যাই। পানি নিয়ে এসে দেখি গাড়িতে মেয়েটি নেই। আমি অনেক খুঁজি কিন্তু তাকে আর পাইনা। রেহেনা তোমার বাচ্চা মারার ইনটেশন ছিলো না। ”

” ছি! আমি এক হত্যাকারীকেই বিয়ে করেছি। লুইচ্ছার মতো আমার স্বামীকে মেরে আমার বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। আপনার আসলেই মন নাই। ”

” আমি তোমাকে মন থেকে ভালোবাসিছিলাম রেহেনা। তাই সেইদিনকার দেখায় তোমার খোজ নিয়ে তোমার ভাইয়ের কাছে প্রস্তাব পাঠাইছিলাম। ”

” রাখুন! আপনার ভালোবাসা। আপনি আমার স্বামীকে মারার সঙ্গে সঙ্গে আমার নবজাতক কেউ ছাড় দেন নাই। এইরকম বিশ্বাসঘাতকের সাথে কিভাবে ২৯ বছর সংসার করলাম। আপনার ভূলের দোষে আমি আমার নিঃপাপ ছেলে মেয়ের জীবন নষ্ট করতেছিলাম। আপনাকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না। আর হ্যা বেঁচে থাকতে এরকম স্বামীর মুখ দেখতে চাইনা। কখন আপনার পাপী মুখ আমাকে দেখাবেন না। ”

আরিয়ান বলে ___

” আপনার পাপের লিষ্ট অনেক বড় আমজাদ শিকদার। লোভ আপনাকে অমানুষ বানিয়ে দিছে। এই পাপের শাস্তি ফাঁসি ছাড়া কিছু হতে পারেনা। ”

” আমিয়ো ফাঁসি চাই! নিজে বারবার আত্যহত্যা করতে চেয়েছি পারিনাই। রেহেনাকে দেখে রাখিস আকাশ। আমাকে মাফ করিস। ”

” খুনীর কখনো মাফ হয়না। আপনি জেনেবুঝে অনেক সন্তানের বুক খালি করেছেন। চলো মা এই খুনীর আমাদের মাঝে জায়গা নাই। ”

আকাশ,রেহেনা,নীলা কাস্টোডিতে থেকে বেড়িয়ে সোজা বাড়ি রওনা হয়। সবাই চুপচাপ কেউ কারো সাথে কথা বলছে না।

নীলা মনে মনে বললো __ সবার পেটে রহস্য মানুষ এতো অপরাধ কিভাবে ধামাচাপা রাখতে পারে।

” নীলা তুমি বলেছিলে আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবে? তুমি কি সত্যি পারবে। ”

” নীলা ফুপির মুখ দেখে কেঁদে ফেলে। কারন মানুষটা শক্ত পুতুলের মতো বসে আছে। কাছের মানুষের আঘাত পেয়ে একটিবারো তার অবিশ্বাসের কথা মনে পড়ছে না। ”

” নীলা মা কাদিস না। তোর ফুপি ওদের মতো খারাপ না তুই আমার কাছে মেয়ের মতো থাকবি। ভালোই হয়েছে রহস্য গুলো ফাশ হয়ে। অনেকদিন পর শান্তির ঘুম দিতে পারবো। কারন আমার সন্দেহ আমার ঘুম কেড়ে নিছিলো। অবশেষে সত্যিটা জানতে সক্ষম হলাম। সবটা তোর জন্য। বলনা আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে পারবি। ”

” ফুপি তুমি ওকে ছোটবেলায় হারিয়েছো। জানিনা ও বেঁচে আছে কিনা। তবে বেঁচে থাকলে অবশ্য তোমার কোলে ফিরিয়ে দিবো। ”

আকাশ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। তার মা এতোটা স্বাভাবিক।আকাশের বুক ফেটে যাচ্ছে। আকাশ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা তার বাবার দ্বিতীয় রুপ এরকম জঘন্য হতে পারে। আকাশ তার আম্মাকে বলে।
” মা তুমি কি করে এতোটা ধৈর্য নিয়ে আরেকটা বিষয় নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করতে পারছো । আমিয়ো তো তোমার ছেলে আমাকে কিছু ধৈর্য শিক্ষার গুন দাও। ”

রেহেনা বলে ____

আমি হাসতে ও হাসাতে শিখে গেছি,
তবো বাঁচতে ও বাঁচিয়ে রাখতে শিখে গেছি।

রাতের অন্ধকারে একা হাঁটতে শিখে গেছি-
দূর্গম ভূবনে নীরঘুম চোখে ঘুরতে শিখে গেছি।

পৃথিবীতে ভিষন্নতার মাঝে একা থাকতে শিখে গেছি,
নিত্য যন্ত্রণা অচিরেই লাঘব করতে শিখে গেছি।

বাস্তবতার ভিত্তিকে অটল রাখতে শিখে গেছি,
জীবনে দন্ডায়মান ষোলের আঘাত শইতে শিখে গেছি।

নোনা জলে কাঁদতে ভুলে কাজল পরতে শিখে গেছি,
হ্যা,আমিও একদিন অনেক বড় হবো বিশ্বাস রেখেছি।

বিশ্বাস রাখো আকাশ মন যা চায় তাই হয়। আমি আগে থেকে মনে করেছিলাম রায়হানকে কেউ হত্যা করেছে আসলেই তা আজকে প্রমাণ হলো। আমি বিশ্বাস করি আমার মেয়ে বেচে আছে। ইনশাআল্লাহ এই বিশ্বাসের জোড়ে তাকে ফিরিয়ে পাবো। মন থেকে তোমার বাবাকে কখনো ভালোবাসতে পারিনাই। রোবটের মতো ২৯ বছর সংসার করেছি তোমার মামা নানু ও শেষে তোমার মুখ দেখে। আজকে বিশ্বাসে পরিণত হলো সে আসলেই আমার যোগ্য ছিলো না।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে