দর্পহরন পর্ব-৬৩+৬৪+৬৫

0
438

#দর্পহরন
#পর্ব-৬৩

“আম্মা, আপনে আমার হইয়া প্রচারনা করবেন। নির্বাচনে জিতা ওই মা পোলারে শায়েস্তা করুম। গতবার আপনাকে আটকাইয়া থুইয়া আমারে নির্বাচন করতে দেয় নাই। এইবারও আমারে হারাইতে আপনারে ব্যবহার করতেছে। ডিভোর্স লেটার পাঠাইছে যাতে আমি নির্বাচনে প্রচারনা না করি। আপনে কি চান আম্মা? আমি হাইড়া যাই?
বলেন আম্মা, বাপের জন্য করবেন না এইটুক?”
শুভ্রা গাঁট হয়ে বসে ছিলো। মুহুর্তের জন্য একবার বাপের মুখ দেখলো। সালিম সাহেব থামলেন না-“আমার সোহেলকে ইচ্ছা কইরা গুলি কইরা মারছে। তবুও আপনের কথা ভাইবা চুপ কইরা আছিলাম। কিন্তু সেই আপনেই যদি সুখে না থাকেন তাইলে আমি চুপ থাকুম কেন? গতবার আপনের লাইগা নির্বাচন করি নাই এইবার আপনে আমারে নির্বাচনে জিতাইবেন আম্মা। আমার হারানো গৌরব ফেরত আনবেন।”
শুভ্রা চুপচাপ বসে ছিলো। চমকে বাবাকে দেখে ধীরে সুস্থে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো-“ঠিক আছে আব্বা। আপনে যা চান তাই হবে। তবে আমার শর্ত আছে একটা।”
সালিম অবাক হয়ে বললো-“নিজের বাপকে শর্ত দিতেছেন আম্মা?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। সালিম সাহেব শ্বাস ফেলেন-“কি শর্ত?”
শুভ্রা শান্ত ধীরস্থির ভাবে নিজের শর্ত বললো। সালিম সাহেব মাথা নাড়েন-“ভুল করতেছেন আম্মা। এইরকম কাম আমি করবো না কিছুতেই।”
“নিজের মেয়ের জন্য এতোটুকু পারবেন না আব্বা? আর আপনে দাবি করেন আমাকে ভালোবাসেন। আপনে আসলে নিজেরে ছাড়া কাউরে ভালোবাসেন না। আপনের কাছে আপনের মানসম্মানই বড়।”
সালিম সাহেব চুপ করে যান। মেয়ের এই রুপ দেখা হয়নি আগে। তার সহজ সরল মেয়েটা এতোটা পাল্টে গেলো কবে?

*****

সুমনা আর সালিম সাহেবের প্রচারনা যুদ্ধ খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেলো যখন সুমনার কিছু ব্যক্তিগত ছবি মিডিয়ায় তোলপাড় হলো। ইউনিভার্সিটি জীবনের বিশেষ মানুষের সাথে তোলা ছবি নিয়ে সুমনার চরিত্র তুলোধুনো করা হলো। সেই সাথে তার বিবাহিত জীবন প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো। এমন একজন মানুষ যার ব্যক্তিজীবন ঠিক নেই সে কি করে একজন যোগ্য জনপ্রতিনিধি হতে পারে সে প্রশ্ম তোলা হলো সমাবেশগুলোতে।

সালিম সাহেবের উপর পাল্টা আঘাত এলো। শুভ্রার বিদেশ জীবনের কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেলো। ছেলে বন্ধুদের সাথে বারে নাচানাচি, শর্ট ড্রেস পরে ছবি। সালিম সাহেবের দূর্নিতীর কিছু চিত্র। কিভাবে সোহেল মেয়েদের তুলে নিতো যত্রতত্র তার নানা তথ্য। বলা যায় রনাঙ্গন গরম হয়ে গেলো। তবে যেটা হলো শুভ্রা কান্ডে রণ ভীষণ আপসেট হলো। সে এমনিতেই মানসিক ভাবে লো ছিল৷ তারউপর এসব দেখে ভীষণ রেগে গেলো। সরাসরি সুমনাকে চার্জ করে বসলো-“এসব কি সুমনা আপা? আপনাকে তো ভালো ভেবেছিলাম। নেত্রীর কাছে আপনার নাম আমিই রেকমেন্ড করেছিলাম আর আপনি কিনা আমার ব্যক্তিজীবন নিয়ে টানা হেচরা করছেন?”
সুমনাকে বিচলিত দেখালো-“সত্যি বলছি রণ, আমি এসব করিনি। কিভাবে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।”
রণর মেজাজ চড়া-“কিভাবে বিশ্বাস করি আপা? আপনি না করালে কে করাবে এসব। শুভ্রাকে নিয়ে তো কারো ব্যক্তিগত আগ্রহ থাকার কথা না।”
“রণ, সত্যি বলছি এসব আমি করিনি। আমার কি মনেহয় জানো, সালিম সাহেব নিজেই এসব করছেন। উনি এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চান। এক নির্বাচনে জিততে চান দুই তোমার আর শুভ্রার ডিভোর্স চান। তুমিই বলো, আমি এসব কেন করবো যেখানে তুমি আমাকে সবরকম সাহায্য করলে নির্বাচন করতে। চাইলে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো। তাহলে হয়তো বিশ্বাস হবে।”
রণর মাথা দিপদিপ করছে। সে জানে শুভ্রার অতীত কেমন তবুও কেন যেন এসব মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। আফটারঅল শুভ্রা এখন তার বউহয়। রণর বুকে চিনচিনে ব্যথা হয়৷ এই মেয়েটার জন্য আর কতো ভুগতে হবে কে জানে।

নিজের ছবি আর ভিডিও ফাঁস হওয়ার ঘটনা নিয়ে টিভি মিডিয়ায় একের পর এক তথ্য বিশ্লেষণ চলছে। শুভ্রা মন দিয়ে সেসব দেখে। রণর বক্তব্য চাওয়া হয়েছে অনেকবার। প্রতিবার সে নো কমেন্ট বলে এড়িয়ে গেছে। শুভ্রা সেসবও দেখে চুপচাপ। তাকে যেন আর কিছুই ছুঁয়ে যায় না।

*****

“ভাবি, আপনে ডিভোর্স পেপারে সাইন কইরেন না।”
শুভ্রা চমকে তাকায়। দেখলো সামনে ফাহিম দাঁড়িয়ে। ফাহিম আড়চোখে আসপাশ তাকিয়ে দেখলো। শুভ্রা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে আছে-“কি বলছেন বুঝতে পারছি না। আপনি ভাবির ভাই না?”
ফাহিম মাথা দুলায়-“আপনে ডিভোর্স পেপারে সাইন দিয়েন না। ভাই খুব কষ্ট পাবে।”
শুভ্রার মেজাজ খারাপ হলো। নিজে না পেরে চামচা পাঠিয়েছে রণ। সে রুঢ় ভাষায় বললো-
“সেটা আপনার ভাই এসে বলছে না কেন?”
ফাহিম ফিসফিস করলো-“বলার অবস্থা নাই। তাছাড়া ডিভোর্স পেপার তো সে পাঠায় নাই। তাকে ভুল বুঝে আপনি কাগজে সাইন দিয়েন না।”
“তাহলে কে পাঠিয়েছে?”
শুভ্রার বিস্মিত নজর। ফাহিম আরও একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে ফিসফিস করলো-“এইসব আপনাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আপনাদের ডিভোর্স নিয়ে বেশ বড় ডিল হইছে।”
“কি বলছেন এসব? মাথা ঠিক আছে আপনার? কিসের ডিল কার সাথে ডিল?”
ফাহিম মাথা নাড়ে, কিছু বলবে তার আগেই তুহিন এলো। সন্দিহান নজরে তাকিয়ে রইলো ফাহিমের দিকে-“তুমি এইখানে কি করো?”
ফাহিম শুকনো ঠোঁট চেটে নিলো জিভ দিয়ে-“বোনটাকে একটু দেখতে আসছিলাম। মা খাবার রান্না করে পাঠাইছে।”
তুহিনের চোখ থেকে সন্দেহ গেলোনা। তবে কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বললো-“খাবার রেখে যাও। বউমা তো শরীফের সাথে ডাক্তারের কাছে গেছে।”
“আচ্ছা।”
ফাহিম স্বাভাবিক ভাবেই ফিরে গেলো। ওর যেটা কাজ ছিলো সেটা করা হয়েছে বলে খানিকটা সন্তুষ্ট দেখালো ওকে। বোনকে নিয়ে তার অতোটা ভাবনা নেই। কেন যেন শরীফকে ভরসা করছে মন। শরীফ মোটেও সোহেলের মতো নয়। সে ঠিক সামলে নেবে তুলতুলকে। তার চিন্তা সালিম সাহেবকে নিয়ে। এই লোকটাকে কিছুতেই পুনরায় ক্ষমতায় আসতে দেবে না সে।

*****

“চাচা, দিলশাদকে চিনছেন?”
“কার কথা কছ? ওই ওসি?”
সালিম সাহেব তুহিনকে দেখলো। তুহিন মাথা দুলিয়ে বললো-“সোহেলরে গুলি করছিল।”
সালিম সাহেবের চোয়াল শক্ত হলো। তুহিন বুঝেই বললো-“আপনের জামাই এর সহচর। ওর মা টা পাগল। শিকলে বাইন্ধা রাখতে হয়।”
“বাপ কেডা?”
“চিনি না।”
“হুমমম। তুই হঠাৎ ওরে নিয়া পড়লি কেন? হইছেটা কি?”
“কালকা সতন্ত্র দলের সাথে গন্ডগোল হইছে আমাগো পোলাগো। ওসির নির্দেশে আমাগো পাঁচ ছয়জনকে তুইলা নিছে পুলিশ। আপনের পোস্টার ছিড়া ফালাইছে। কয়, আচরণবিধি লংঘন হইছে।
সুমনার হইয়া কাজ করতাছে সরাসরি।”
“কস কি? ওসির সাহস তো ভালোই।”
তুহিন একটু মাথা চুলকায়-“আপনের মনে নাই মনেহয়, ওয় সোহেলরে গ্রেফতার করছিল ছাড়তে চায় নাই। লাগে নিজের ব্যক্তিগত আক্রোশ দেখায়।”
সালিম সাহেবকে চিন্তিত দেখায়। তুহিন গলার স্বর আরও একটু নিচু করলো-“আমাগো ব্যবসায় কড়া নজর রাখছে। কোন বেতাল পাইলেই ধইরা ফালায়। বেচাবিক্রি মেলা কম।”
“আইজকা রাতে দেখা করতে যামু ওসির লগে ওর বাসায়। ব্যবস্থা কর।”
“আরেকটা কথা চাচা। ফাহিমকে শুভ্রার লগে কথা কইতে দেখছি। কেন জানি মনে হইলো, ফাহিম ওরে গোপনে কিছু কইছে।”
চমকে তুহিনকে দেখলো-“তুই কইতে চাস ফাহিম আমার হইয়া কাজ করতেছে এইটা আইওয়াশ?”
“শিওর না। তবে হইতে পারে। ও হঠাৎ কইরা আপনের লাইগা কাজ করতে চাইছে এইটা তো স্বাভাবিক না।”
সালিম সাহেব হাসলেন। উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পর্দা সরিয়ে বাইরেটা দেখলেন। আনমনা হয়ে বিরবির করলো-“সবাই দেখি আমার লগে খেলা শুরু করছে? আচ্ছা, ক দেখি তুহিন আমি কেমন আছিলাম? সবাই কি ভুইলা গেছে আমি কি করতে পারি? মনে হইতেছে অতীতের সালিমকে ফিরায় আনা লাগবে। এই নির্বাচনে জয়ের লাইগা দরকার হইলে তাই করুম।”
তুহিন সালিম সাহেবকে দেখলো ভয়ে ভয়ে। আবছা আলোয় তাকে দেখে তুহিনের ভয় লাগে।

*****

আজ বাড়ি ফিরতে একটু বেশি রাত হয়ে গেলো দিলশাদের। নির্বাচনের চক্করে ব্যস্ততা বেড়েছে। নির্বাচন না হওয়া অবধি এই ব্যস্ততা থাকবে। এমনিতেই ডিউটি দিতে তার কোন সমস্যা নেই কিন্তু মায়ের জন্য চিন্তা হয়। সে খাবার না দিলে মায়ের খাওয়া হয় না। দুপুরে আজ খাবার খাইয়ে দিয়ে গেছিল। এখন রাত সাড়ে বারোটা। নিশ্চয়ই মানুষটা খিদের জ্বালায় ছটফট করছে? অস্থির হয়ে গাড়ি থেকে নামে দিলশাদ। কলিংবেল বাজাতে গিয়ে টের পেলো দরজা ভেজানো। ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। কাজের খালাটা কি নেই? দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই গো গো আওয়াজটা কানে এলো। এরকম আওয়াজ তো মা ভয় পেলে বা বাথরুম এলে করে। দিলশাদ ছুটে মায়ের ঘরে আসতেই ওর পা জোড়া থমকে গেলো। ঘরের মধ্যে দু’জন মানুষকে দেখে। ওর মায়ের মুখটা যন্ত্রণায় কালচে হয়ে আছে। সামনের মানুষটা কুৎসিত হাসি দিচ্ছে। মাথার বাঁকা রগটা চিনচিন করে উঠলো। দিলশান চেচিয়ে উঠলো-“আপনি! আমার বাসায়? ঢুকলেন কি করে?”
চমকে দিলশাদের দিকে ফিরলো সালিম। মুখের কুৎসিত হাসি ফিরে এলো-“আরে! আইসা পড়ছো? তোমারে খুব চেনা চেনা লাগতেছিল কিন্তু কই দেখছি মনে করতে পারতেছিলাম না। তাই ভাবলাম তোমার পরিবারকে দেইখা যদি কিছু মনে আসে। এখন তোমার মাকে দেইখা মনে পড়লো। চুকচুক, তোমার মাকে দেইখা খুব কষ্ট পাইলাম। কবে হইছে এমন কও তো? তোমার বাপ ভাই মরার পর? খুবই দুঃখজনক ঘটনা। তোমার জীবন তো বহুত কষ্ট কাটছে দেখা যায়।”
দিলশাদ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। রাগে দিগবিদিক শুন্য লাগছে তার। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“আমার মায়ের কাছ থেকে উঠে আসেন। কি চান আপনে? কেন আসছেন? আর বিনা অনুমতিতে একজন পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় ঢোকা গর্হিত অপরাধ।”
সালিম শয়তানের মতো হো হো করে হাসতে লাগলো। তার উচ্চ কন্ঠের হাসি শুনে দিলশাদের মা কেঁপে উঠলো। কো কো করে কাঁদতে লাগলো। দিলশাদের খুব মন চাইলো সালিম সাহেবের কপাল বরাবর গুলি করে মাথা ফাটিয়ে দিতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো। সালিম সাহেব বললো-“আমার এলাকায় আমিই আইন এইটা তুমি ভালো মতোই জানো ওসি। শুধু তুমি না তোমার পাগল মাও জানে। দেখো কেমনে কাঁপতেছে। আমাকে দেইখা মুইতা দিছে তোমার মা৷ দেওয়ারই কথা, আমি মানুষটাই এমন ভয়ংকর।”
দিলশাদের হাত পা কাঁপে, শরীর থরথর করে। কথা বলতে চাইলেও পারলো না অতি রাগে। সালিম উঠে এসে দিলশাদের সামনে দাঁড়ায়। তার মুখ থেকে হাসি মুছে গেছে। হিংস্র মুখটায় নিষ্ঠুরতার চিন্হ স্পষ্ট-“তোর ভাইটা বাড়াবাড়ি করছিল তার ফল সে পাইছিল। তোর বাপ মা বাড়াবাড়ি করছিল। অনেকবার ভদ্র ভাষায় মানা করার পরও শোনে নাই। বাধ্য হইয়া তোর মাকে সমাজের সামনে নেংটা করছিলাম। সেই অপমানে তোর বাপ মরছে। সব মনে আছে না তোর? তুই জানোস আমি কি করতে পারি। তুই কি ভাবছেস, আমারে শেষ করবি? এই সালিমরে শেষ করবি? আমার পোলার বুকে গুলি চালাইছোস না তুই? তোর দিন গুনতে থাক। যেদিন আমার মন চাইবো সেই দিন এই দুনিয়ায় তোর শেষ দিন হইবো। তারপর তোরে হারায়া তোর পাগল মা নেংটা হইয়া রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো। হাহাহা।”

চলবে।

#দর্পহরন
#পর্ব-৬৪

আজকের দিনের ভাইরাল ভিডিও হলো, সুমনার সাথে সরকারি দলের একাধিক মন্ত্রীর গোপন বৈঠক। সেখানে পরিকল্পনা হচ্ছে, সুমনা সতন্ত্র থেকে নির্বাচিত হলে তাকে দলে টেনে নেওয়া হবে। যেহেতু সে মেয়র হবে তাই এলাকায় তার দাপট বাড়াতে সকলে তাকেই সাপোর্ট দেবে, দলের অলিখিত কান্ডারী সেই হবে এবং রণকে একঘরে করে দেওয়া হবে। কারণ প্রথমবার হিসেবে রণ খুব বেশি নেত্রীর এটেনশন সিক করে নিয়েছে। ফলে বাকীরা নেত্রীর কাছে পাত্তা পাচ্ছে না। বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে রণর সাথে পরামর্শ করে যা বর্শীয়ানরা পছন্দ করছে না। এবং যা দলের ভারসাম্য নষ্ট করছে। কাজেই সময় এসেছে রণকে কোনঠাসা করার।

রণ হতভম্ব হয়ে গেলো। হুট করে কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সুমনা সতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে কেন গেলো সরকারি দলের কোন মন্ত্রীর বাসায় রণর বুঝে এলো না। সুমনার তো এমন করার কথা না? সে কি রণকে এভয়েড করতে চাইছে? লিয়াজো করে কি করতে চাইছে সুমনা? রণর মাথা গরম হয়ে গেলো। এই মুহূর্তে এমনিতেই তার এলোমেলো হাল এখন নতুন মাথাব্যথা হলো সুমনা। এ যেন হাতে ধরে বিপদ ডেকে আনা।

চারিদিকে তুমুল আলোচনা সমালোচনায় পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইর চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সুমনা চলে এসেছে রণর আস্তানায়-“রণ, কিছু করো ভাই।”
রাগে দিগবিদিক শুন্য রণ নিজের মেজাজ সামাল দিতে দিতে বললো-“আমার কাছে কেন এসেছেন সুমনা আপা? যাদের সাথে বলো আলোচনা করে আমাকে কোনঠাসা করার পরিকল্পনা করছিলেন তাদের কাছে যান। তারা আপনাকে সাহায্য করবে।”
সুমনাকে অসহায় দেখালো-“কি বলবো রণ, আমি সত্যিই জানতাম না ওখানে তোমাকে নিয়ে আলোচনা হবে। ওনারা খুব ফোর্স করলেন আমাকে যাওয়ার জন্য। তারপর নিজেরাই এটা সেটা বললেন। আমি না বুঝে তাদের কথায় সায় দিয়েছি। তবে এতটুকু বিশ্বাস রাখতে পারো এই সুমনা আপা তোমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করবে না।”
“বিশ্বাস! আপনাকে? আর মনেহয় সম্ভব না আপা। আপনি জানেন ওরা সালিম সাহেবের লোক। ওরা ওনাকে সাপোর্ট দিচ্ছে। তারপরও কেন গেলেন আপা। ওখানে গেছেন মানে আমার উপর ভরসা নেই আপনার।”
“কিন্তু ওরা চায় আমি জিতি।”
সুমনা নিজেকে বাঁচাতে চাইলো। রণ অস্থির হয়ে চেচিয়ে উঠলো-“আর আপনি বিশ্বাস করলেন? হতে পারে এটা আপনাকে বিতর্কিত করতে কোন চাল।”
সুমনা কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়। কিছুক্ষণ থেমে ম্লান গলায় বললো-“তুমি বিশ্বাস করবেনা হয়তো তবুও বলি। আমি এ ধরনের কোন মানুষের কাছে যেতে চাইনি। বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছে। কিভাবে বাধ্য হয়েছি সে বিষয়ে খোলামেলা বলতে পারছি না। তবে কেন যেন মনেহচ্ছে সবাই চায় সালিম সাহেব ক্ষমতায় আসুক।”
“আপা, উনি পুরনো মানুষ ওনার কিছু সাপোর্টার তো থাকবেই। সব দলেই দু’টো পক্ষ থাকে এটা কোন বড় ব্যাপার না। কে কাকে চায় না চায় এটা কি খুব চিন্তার ব্যাপার? আপনি এটা নিশ্চিত থাকুন নেত্রী তাকে চায় না। আর নেত্রী যাকে না চায় তার পক্ষে নির্বাচনে জেতা অসম্ভব ব্যাপার যদি জনগণ পাশে না থাকে। আপনার মোটেও উচিত হয় নাই ওনাদের সাথে দেখা করার। তাহলে আজকে ভিডিও লিক হইতো না। বোঝাই যাচ্ছে কাছের কেউ ইচ্ছা করে ভিডিও লিক করছে আপনাকে কালার করতে। আপনার সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট করতে। এতটুকু না বুঝলে তো আপা আপনার পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব হবে না। যেখানে আপনার প্রতিপক্ষ সালিম সাহেবের মতো কেউ।”
“না যেয়ে কি করতাম রণ? ওনাদের ক্ষমতা কিন্তু কম নয়। আমার তো রাস্ট্রের সব কর্মকর্তার সাপোর্ট লাগবে। কেউ বেঁকে বসলো তো পারবো না ভাই। তুমি একটা জিনিস ভাবো রণ সালিম সাহেব হুট করে এতোটা জ্বলে উঠলো কেন? নিশ্চিত উপর মহলের কেউ তাকে সাহস দিয়েছে। তা না হলে তার হুট করে এতোটা বাড়াবাড়ি করার কথা না। উনি দিলশাদকে কাল রাতে ভীষণ ভাবে মেরেছে জানো এটা? একজন পুলিশের গায়ে হাত তোলা যেনতেন কথা নয় রণ তাও আবার উনি যখন ক্ষমতায় নেই।”
রণ অবাক হলো-“দিলশাদকে? কখন হলো এসব? আমাকে কেউ জানায়নি কেন?”
“কাল রাতের ঘটনা রণ। গতদিন সালিম সাহেবের ছেলেদের সাথে আমার ছেলেদের বচসা হয়েছিল। দিলশাদ সালিম সাহেবের লোকদের গ্রেফতার করেছে। তারপর কাল রাতে এই অবস্থা। এখন বুঝে নাও কি হয়েছে।”
শুনতে শুনতে হুট করে রণ ব্যস্ত হয়ে গেলো। মনটা কেন যেন কু ডাকছে তার। সে সুমনাকে বিদায় দিলো-“আপা, আপনি আর কারে সাথে কোন ধরনের যোগাযোগ করবেন না। ভিডিও নিয়েও কোন স্টেটমেন্ট দেবেন না। আপনি শুধু নিজের মতো প্রচারনা করতে থাকেন। আমি আপনার পেছনে আছি। আপাতত আমার জরুরি কাজে যেতে হবে আপা। আমি আপনার সাথে পরে কথা বলে নেব। ঠিক আছে?”
সুমনা মাথা দুলিয়ে বিদায় নিলো। রণ চেচিয়ে মিহিরকে ডাকে-“দিলশাদের ঘটনা জানোস? ফাহিম কই?”
মিহির মাথা নিচু করলো-“জানি। ওর বাসায় ঘটছে এই ঘটনা। দিলশাদ ঠিক আছে আপাতত কয়েকদিন ছুটি নিয়ে রেস্টে আছে। ফাহিম তো ওইখানে যায়।”
“আমাকে জানাস নাই কেন মিহির?”
রণ চেচিয়ে উঠলো। মিহির ভয় পেলো রণর এমন রুপ দেখে-“আপনে এমনিতেই অনেক টেনশনে তাই আর জানাই নাই ভাই।”
“ফাহিমকে তাড়াতাড়ি ফোন দে। আমার কাছে আসতে বল এখনি।”
মিহির এবার বিস্মিত হয়ে বললো-“কেন? কি হইছে?”
“কথা বাড়াইস না। তাড়াতাড়ি কল দে ফাহিমকে।”
রণ তাড়া দিতেই মিহির দ্রুত হাতে ফাহিমের নাম্বারে কল দিলো। না ফোন ধরছে না ফাহিম। দুইবার তিনবার। রণ ধমকে উঠলো-“ধরছে ফোন?”
মিহির মাথা নাড়ে। রণ নিজের ফোন বেড় করলো দ্রুত হাতে। তার হাত কাঁপছে। কোন অঘটন না ঘটে যায়। কিছু হলে নিজেকে মাফ করতে পারবেনা রণ। তার কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে টপটপ করে। মাথার শিরা দপদপ করে। ফোনটা বেজে যাচ্ছে। ওপাশ থেকে কেউ ধরছে না কেন?

*****

সালিম সাহেব আজ ফাহিমকে সাথে নিয়ে খেতে বসেছেন। সচরাচর এমনটা করেন তিনি। দুপুরে বাসায় খাওয়া হয় না। আজ কি মনে করে খেলেন সাথে ফাহিমকে ডেকে নিলেন। তুলতুল ভাইকে দেখে খুশি হলো আবার হলো না। ফাহিমকে শশুরের ডোরায় দেখে খুব একটা খুশি হয় না সে। শশুর কেমন মানুষ তা সে আর তার পরিবার ভালো জানে। তবুও কেন ফাহিম আগ বাড়িয়ে এ বাড়িতে আসে সেটা সে বোঝে না। শশুরই বা কেন হুট করে তার ভাইয়ের সাথে ভাব করছে সেটাও বোঝে না তুলতুল। এতটুকু বোঝে এখানে হয়তো বিশাল স্বার্থ জড়িয়ে আছে। তা নয়তো ফাহিমকে কাছে টানবে কেন শশুর। সেই চিন্তা থেকেই সে ভাইকে বলেও ফেলেছিল-“ভাইয়া, কেন আসিস? ওনার মতো মানুষের সাথে তোর কিসের কাজ?”
ফাহিম স্বস্নেহে উত্তর দিয়েছে-“তোর জন্য আসি পাগলি। তোকে দেখতে পাই এটাও তো কম না।”
“আমাকে দেখতে হবে না ভাইয়া। তুই আসিস না এখানে। আমার ভালো লাগে না।”
“শরীফ ভাই মানুষটা ভালো তাই নারে বোন? লাগে ওনার সাথে তুই সুখে থাকবি।”
তুলতুল ভাইকে দেখলো কিছু সময় তারপর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জবাব দিলো-“আমাকে দেখছিস ভাই আর আসিস না। তুই বরং মায়ের খেয়াল রাখিস।”
ফাহিম তুলতুলের কথা কানে তোলেনি। সে বারবার আসছে সালিম সাহেবের কাজ করছে।

আজ খাওয়ার টেবিলে তুলতুলের ডাক পড়লো। ভারি পেট নিয়ে ভীষণ সংকোচে তুলতুলে ডাইনিং এ এলে সালিম সাহেব তাকে বলে-“বউমা, তোমার ভাই প্রথমবার আমাদের সাথে খাইতেছে তাই তোমারে ডাকলাম। ওকে একটু আপ্যায়ন করো। হাজার হোক তোমার শশুরের বাড়িতে প্রথমবার খাইতেছে।”
তুলতুল কথা না বাড়িয়ে ভাই আর শশুরের প্লেটে এটা সেটা তুলে দিলো। সালিম সাহেব আচমকা প্রশ্ন করলো-“বউমা তোমার ডেট যেন কবে?”
“বারো তারিখ।” তুলতুল নিস্প্রভ হয়ে জবাব দিলো।
“নির্বাচনের পরে। ভালোই হইছে। একলগে ডাবল খুশি সেলিব্রেট করবো। শোন ফাহিম, বাচ্চা হওয়ার পর চল্লিশ দিন পার হইলে বউমার লগে শরীরের বিয়া দিমু ধুমধাম কইরা। ঠিক আছে না? তুমি কি কও?”
ফাহিম হাসে-“ঠিক আছে।”
ওদের কথা শুনে খেতে আসা শরীফ খুকখুক কাশে আড়চোখে তুলতুলকে দেখে। মেয়েটা ভাবলেশহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন কোন কিছুতে কিছু আসে যায় না তার।

শুভ্রা নিজের ঘরেই ছিলো। একবার কি কারনে যেন ডাইনিং এ এলো। ফাহিমকে দেখে এগুলো না। চুপচাপ ঘরে ফিরে গেলো। কিছুক্ষন পরে কি মনে করে ফিরে এলো। সালিম সাহেব তখন খাবার শেষ করে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শুভ্রাকে দেখে জানতে চাইলো-“আম্মাজান, কি হইছে? কিছু কইবেন?”
“আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন আব্বা?”
“হহহ। জরুরি কাজে যাইতেছি। কেন?”
শুভ্রাকে অস্থির দেখালো-“আমার কেমুন জানি লাগতাছে আব্বা। আজকে কোথাও যাইয়েন না আপনে।”
সালিম সাহেব চমকে উঠে মেয়ের দিকে তাকালেন। মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করলেন কিছু একটা। মেয়ে কি তার মনের কথা কিছু বুঝতে পারলো? তিনি হাসার চেষ্টা করে বললো-“ডাক্তার ডাকুম? কি হইছে আপনের? আচ্ছা শরীফকে কইতাছি ডাক্তার ডাকতে। আমি এই যামু আর আমু।”
শুভ্রা পাগলের মতো চেচিয়ে উঠলো-“নাহ আব্বা, আপনে যাইয়েন না। আমার মনে হইতেছে আমি বাঁচবো না। আব্বা, আব্বা।”
বলতে বলতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো শুভ্রা। সালিম সাহেবকে হতবিহ্বল দেখায়। সে ‘আম্মাজান’ বলে চেচিয়ে উঠে মেয়েকে ধরার জন্য ছুটলো।

চলবে।

#দর্পহরন
#পর্ব-৬৫

“আব্বা, বসেন আমার কাছে। কোথাও যাবেন না আপনি।”
শুভ্রার আবদারে সালিম সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন-“আপনে ইচ্ছা কইরা নাটক করছেন আম্মাজান?”
“হ্যা, কারণ আমি চাই না আপনে আর একটাও অন্যায় করেন।”
“কিসের অন্যায়ের কথা কইতেছেন আম্মাজান?”
“যে মেয়েটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনার ছেলের সন্তান তার পেটে ধরছে আপনে তার ভাইকে মাইরা ফেলতে চান? কেন আব্বা? এতো নিষ্ঠুরতা কেমনে করতে পারেন?”
সালিম চমকে উঠলো-“এইগুলা কি কন আম্মাজান?”
শুভ্রা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাঙা গলায় বললো-“আপনের বিরুদ্ধে কত অভিযোগ শুনছি, পত্র পত্রিকায় কতো লেখা পড়ছি আব্বা তাও বিশ্বাস হয় নাই। গতকালই আপনারে আর তুহিন ভাইকে কথা কইতে শুইনা ফেলছিলাম। কথাগুলা বিশ্বাস করতে মনচায় না কিন্তু নিজের কানকে অবিশ্বাস করি কেমনে? আমার আব্বা এমন খারাপ মানুষ কেমনে বিশ্বাস করি আব্বা?”
“আম্মাজান, থামেন।”
“কেন থামবো আব্বা? ফাহিমকে কেন মারবেন? ও আপনার জন্য কাজ করে না তাই নাকি আপনার জামাই এর হয়ে কাজ করে তাই? নিজের স্বার্থের জন্য মেয়ের সুখের পথে কাটা হইতেও বাঁধবে না আব্বা?”
শুভ্রার কাটা কাটা কথায় সালিম সাহেবের মেজাজ চড়েছিল। সে হুঙ্কার দিলো-“না বাঁধে না। আপনে কইছিলেন প্রতিশোধ নিতে বিয়া করতেছেন। এখন জামাই জামাই কইরা মরতেছেন। এইদিকে বাপের ইজ্জত নিলামে উঠতেছে তার কোন পরোয়া নাই আপনের। এই আপনের বাপের প্রতি ভালোবাসা?”
শুভ্রা বিস্ময়ে মুক হয়ে গেলো। বাবার এমন রুপ আগে দেখেনি সে। সালিম সাহেবের মেজাজ চড়েছে। সেই চড়া মেজাজ নিয়ে সে বলে উঠলো-“আপনার কথা ভাইবা শত্রুর পোলার লগে আত্মীয়তা করতে রাজি হইছিলাম। আপনার কারণে আমার পোলা মরছে। আপনে আমাগো না জানায়ে দেশে না আসলে এই যে এতোকিছু হইছে এইসবের কিছুই হইতো না। আমি এতোদিনে মন্ত্রী থাকতাম। আপনে দায়ী সবকিছুর জন্য আপনে দায়ী। আপনার কারনে আমি আমার পোলা হারাইছি।”
সালিম সাহেব উঠে দাঁড়ান-“ওই ফকিরের বাচ্চাকে মারবো আমি। বহুত ভদ্রতা দেখাইছি আর না।”
শুভ্রা কিছু না ভেবে পথ রোধ করে দাঁড়ায়-“না আব্বা, এই পাপ আপনাকে করতে দেব না আমি। কোনমতেই না। আপনার পাপের কারনে আমি সাজা পাইছি আর কেউ এই সাজা না পাক আব্বা।”
“পথ ছাড়েন আম্মাজান। আমার কাজে বাঁধা দিয়েন না।”
সালিম সাহেবের হুঙ্কার শুনেও শুভ্রা অটল হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে-“কিছুতেই না আব্বা। আজকে যদি আপনে চলে যান তাহলে আপনার মেয়ের লাশের উপর দিয়ে যাইতে হবে।”
সালিম সাহেব থেমে যান। হেসে দিলেন শুভ্রার আচরণ দেখে-“আপনে চান আমি না যাই? ফাহিম বাঁইচা থাক?”
শুভ্রা মাথা দুলায়। সালিম সাহেব গম্ভীর হয়ে বললো-“তাইলে ডিভোর্স পেপারে সাইন কইরা দেন। বেশি কিছু চায় না আপনের আব্বা।”
“আব্বা!” শুভ্রা আর্তনাদ করে উঠলো।
“বলেন দিবেন কিনা? নাইলে আইজ অথবা কাইল ফাহিমকে মরতেই হইবো।”
শুভ্রা নিরব হয়ে গেলো। বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। তার বাবা এমন শর্ত আরোপ করতে পারে ভাবেনি কোনদিন। শুভ্রা কাতর গলায় বললো-“কেমন শর্ত দিতেছেন আব্বা? আপনার মেয়ের জীবনের খুশি কাইড়া নিতে চান? কেমন বাপ আপনে?”
“আমি কেমন বাপ তা আপনে জানেন আম্মা। এখন কথা বাড়ায়া লাভ নাই। আপনে যা কিছু করেন না কেন লাভ নাই। হয় ডিভোর্স পেপারে সাইন করেন নয়তো পথ ছাড়েন। আপনে মহান সাজতে চান তো সাজেন। কিন্তু মহান সাজা খুব কঠিন আম্মাজান। এর জন্য অনেক মুল্য চুকাইতে হয়।”
“আব্বা এমন কইরেন না। জেদ কইরা বিয়া করলেও মানুষট ভালো আব্বা। সে তার ভালোবাসা আর ভদ্র ব্যবহার দিয়ে আমাকে পাল্টায়া দিছে। এমন কইরেন না। আমাকে কষ্ট দিয়েন না।”
শুভ্রা কাতর গলায় আকুতি জানায়। ওর চোখ দিয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে এরইমধ্যে। সালিম সাহেব জবাব না দিয়ে ডিভোর্স পেপার খুঁজে সামনে মেলে ধরেন-“সাইন করেন নয়তো পথ ছাড়েন। আমি খুব কঠিন মানুষ আম্মাজান। আমাকে এখনো আপনি চেনেন নাই পুরাপুরি।”
শুভ্রাকে হতবিহ্বল দেখায়। কতদিন ধরে এই কাগজটাকে এড়িয়ে যাচ্ছে সে। অথচ আজ আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তুলতুলের সেদিনের বলা কথাগুলো কানে বেজে উঠলো। এই মেয়েটাকে আরও একবার কষ্ট দেওয়ার চিন্তা করাও পাপ হবে। এই পাপ করা তার পক্ষে সম্ভব না।
তুলতুলের মুখটা ভেবে শুভ্রা কাগজ টেনে নিলো। শেষবারের মতো আশায় তাকালো বাবার দিকে-“ভুল করতেছেন আব্বা।”
“আমি ঠিক করতেছি না ভুল তা তাড়াতাড়ি জানবেন আম্মা। সাইন করেন।”
শুভ্রা অশ্রুসিক্ত নয়নে কলম ধরে। কাগজে কলম চেপে ধরতেই বুকটা হুহু করে উঠলো তার।

*****

তুলতুল ভয়ে কাঁপছিল থরথর করে। সোহেল মা*রা যাওয়ার পর ভয়ের জীবন থেকে খানিকটা মুক্তি পেয়েছিল সে। বাচ্চার উসিলায় খানিকটা ভালো জীবন পেয়েছে। আজ হুট করে সব মিছে মনেহচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে টের পাওয়া সত্যিটা তাকে ভীষণ অস্থিরতায় পোড়াচ্ছে। বারবার মা আর ভাইয়ের চেহারা ভাসছে চোখের সামনে। হুট করে তার অসুস্থ লাগতে লাগলো। সে বিছানায় শুয়ে হাসফাস করছে। মালা কয়েকবার করে জানতে চাইলো কিন্তু তুলতুল জবাব দিলো না। কিছুক্ষণ পরে উঠে বসে বমি করে ঘর ভাসিয়ে ফেললো তুলতুল। মালা আতঙ্কিত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে শরীফকে ডাকতে গেলো-“ভাইজান, ভাবি জানি কেমন করে?”
শরীফ ছুটে এসে দেখে তুলতুলের এই অবস্থা। আতঙ্কিত হয়ে সে তুলতুলকে ধরে-“কি হয়েছে তুলতুল? খারাপ লাগছে?”
তুলতুল বিরবির করলো-“আমার ভাইটাকে ডাকেন তাড়াতাড়ি। ওর কিছু হইলে মা বাঁচবে না। আপনি আমার ভাইটাকে বাঁচান। আপনার পায়ে পড়ি। কথা দিতেছি বাচ্চাটা হইলেই আমি আপনাকে বিয়ে করলো, বাচ্চাটাকেও ভালো বাসবো। সত্যি বলতেছি। আমি শুধু আমার ভাইটাকে বাঁচান।”
শরীফ হতভম্ব হয়ে গেলো-“কি বলো এইসব আবোলতাবোল। হইছেটা কি? শরীর বেশি খারাপ লাগে? দাঁড়াও ডাক্তার ডাকতেছি।”
তুলতুল শরীফের হাত আঁকড়ে ধরলো-“আমার ভাইটাকে ডাকেন। ওকে দেখতে চাই আমি। প্লিজ।”
শরীফ মালাকে বললো-“মাকে ডাক। আর ফাহিম আছে কিনা দেখ। তুহিন ভাইকে এম্বুলেন্স ডাকতে বল।”
মালা ছুটে বেড়িয়ে এলো। মুহূর্তেই সালিম নিবাসে হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো। তুলতুল জ্ঞান হারিয়ে ফেললো তখনই। এম্বুলেন্সে যেতে যেতে তুলতুল আঁধবোজা চোখে দেখলো ফাহিম ওর হাত জড়িয়ে ধরে আছে। তুলতুল চোখ দুটো মেলতেই ফাহিম হাউমাউ করলো-“তুলতুল, বোন আমার। আমি এই যে এখানে। তোর কাছে বসে আছি। কিছু ভাবিস না তুই। তুই সুস্থ হয়ে যাবি।”
তুলতুল শুনলো আবারও চোখ বুঁজলো। বিরবির করে কিছু বললো। ফাহিম কান লাগিয়ে কথা শুনতে চাইলো। তুলতুলে বারবার একই কথা বিরবির করছে-“আমার মা বাঁচবে না। মাকে বাঁচাও।”

*****

সালিম সাহেব বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন। নিজের অফিস ঘরে বসে আছেন তিনি। সামনে শুভ্রার সাইন করা কাগজ। পা দোলাতে দোলাতে মোবাইল হাতে নিয়ে হাসলো। একটু বুদ্ধি করে না চললে মুসকিল আসলে। এই যে যখন মনেহচ্ছিল তার নির্বাচনে জেতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে তখনই আচমকা এই পথটা সামনে এলো। এখন নিজের কাজে নিজেরই ভীষণ গর্ব অনুভব হচ্ছে। সালিম সাহেব পা দোলাতে দোলাতে ফোন করলেন। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশের মানুষটার কথা শোনা গেলো-“কাজ হয়ে গেছে?”
সালিম হাসলো-“আপনি যা চাইছেন করলাম। এইবার আপনের কথা রাখার পালা। আমার পদ পাক্কা তো?”
“অবশ্যই। কথার নড়চড় হবে না সালিম। তবে তোমাকেও কথা দিতে হবে, রণর পিছু লাগা বন্ধ করবে তুমি। ঠিক আছে?”
“লাগবো না।”
“আর নির্বাচনে উল্টো পাল্টা কিছু করো না।”
“করবো না।”
“তাহলে আর কি। এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও। বাকীসব কাজ হয়ে যাবে। আর হ্যা, কাল মনে করে কাগজটা পাঠিয়ে দিয় বাকী কাজ শেষ করার জন্য।”
ওপাশের জন ফোন নামিয়ে রেখেছে। সালিম সাহেব তৃপ্তির হাসি হাসেন। অবশেষে নির্বাচনটা তার হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে জিতে প্রথম কাজ হবে ওই দিলশাদকে শেষ করা। শত্রুকে বাঁচিয়ে রাখতে নেই। নয়তো সুযোগ মতে ফনা তুলে ফেলে৷ সালিম সাহেব খ্যাকখ্যাক করে হাসেন। অবশেষে জীবনটা আগের মতো হতে যাচ্ছে দেখে মনটা তুষ্ট। রণ, সুমনা, নেত্র্রীসহ এক ঢিলে কতগুলো পাখিকে শায়েস্তা করা যাবে তা ভেবেই মনটা বাকবাকম করতে চাইছে তার।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে