দর্পহরন পর্ব-৫৮+৫৯

0
401

#দর্পহরন
#পর্ব-৫৮

ইব্রাহিম নিবাস মৃত্যুপুরীর চাইতেও শান্ত হয়ে আছে। এ যেন ঝড় ওঠার আগের মুহূর্ত। কাজের লোকগুলোও ত্রস্ত পায়ে কাজ সাড়ে। সামান্য আওয়াজে চমকে ওঠে। বাড়ির সবার খাবারে অনিয়ম হলেও এক তুলতুলের জন্য নিয়ম করে উনুন জ্বলে। বাকি কেউই ঠিকঠাক খায় না। সালিম সাহেব আজকাল বাড়িতেই থাকছেন না। মেয়র নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জোরেশোরে। সেই সু্যোগে মেয়ের চোখের সামনে থাকতে হচ্ছে না তার। জানে, মেয়েকে দেখলে মাথা এলোমেলো হবে।

আর শুভ্রা একেবারেই চুপ মেরে গেছে। আসার পর থেকে কারো সাথে কোন কথা নেই। চুপচাপ নিজের ঘরে বসে থাকে। ঠিক যেমনটা ছিল বিয়ের আগে থাকতো। সালিম সাহেব মনেকরে ফোন কিনে এনেছেন পরদিনই। কিন্তু শুভ্রা তা ছুঁয়েও দেখেনি। যে নাম্বারে রণ ফোন দেবে সেটা তো ফেলেই এসেছে। আর নিজ থেকে রণকে ফোন দেওয়ার ইচ্ছে বা সাহস কোনটাই নেই তার৷ রণ যদি মায়ের মতো তাকে ভুল বোঝে অপমান করে তাহলে মেনে নিতে পারবে না শুভ্রা। হতাশা ঘিরে ধরে তাকে। রণর সাথে তার সম্পর্কটা কতটা গভীর হয়েছে সেসব ভাবার সুযোগ কখনো হয়নি। শুধু এতোটুকু বিশ্বাস ছিলো, রণ ওকে কাছে টেনেছে মানে সম্পর্কটা নিয়ে সে সিরিয়াস। কিন্তু এখন কয়দিনে একবারও রণর ফোন না পেয়ে সেই বিশ্বাসটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। টিভি চালিয়ে বসলো শুভ্রা। ইউটিউব খুঁজে খুঁজে রণর খবরগুলো দেখে সে। তার ফেরার খবরটাও এভাবেই পেয়েছে। তারপর মনে মনে প্রতীক্ষা করেছে রণ হয়তো ওকে নিতে আসবে। ধীরে ধীরে বুঝে গেছে রণ আসবে না। সেও হয়তো মায়ের কথা শুনে শুভ্রাকে দোষী ভেবে বসেছে। শুভ্রা টিভির সাউন্ড মিউট করে দিয়ে একদৃষ্টিতে রণকে দেখতে লাগলো। কালকের কোন একটা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছে। রণকে দেখতে দেখতে শুভ্রার চোখ ঝাপসা হলো।
“আপা, কি করছো?”
তুলতুলের কন্ঠ শুনে দ্রুত হাতে চোখ মুছলো শুভ্রা। টিভির রিমোট হাতে নিলো কিন্তু তার আগেই তুলতুল টিভিতে চলা রণর ভিডিও দেখে ফেললো। হেসে এগিয়ে এসে শুভ্রার সামনে বসলো-“ভাইয়াকে দেখছো?”
শুভ্রা টিভি বন্ধ করে দিলো। তুলতুল বললো-“তুমি কি কাঁদছিলে নাকি আপা?”
শুভ্রা এবারও জবাব দিলো না। তুলতুলের হাতের বইটা দেখলো একবার। হুমায়ুন আহমেদের এলেবেলে বইতা ওর হাতে। তুলতুল শুভ্রার দৃষ্টি লক্ষ্য করে হাসলো-“এটা পড়বে? ভীষণ হাসির বই। তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।”
শুভ্রা ক্ষীণস্বরে বললো-“আমার মন খারাপ কে বললো?”
“আচ্ছা, মন ভালো? তাহলে তো ভালোই হলো। শোন, আজ আমার সাথে যাবে?”
শুভ্রা অবাক হলো-“কোথায়?”
“ডাক্তারের কাছে। আজ আমার রেগুলার ভিজিট ডে।”
শুভ্রা মিইয়ে গেলো-“নাহ, তুমি যাও ভাবি। আমার ভালো লাগে না বাইরে যেতে।”
“তুমি বুঝি দুলাভাইকে ভালোবাসো?”
শুভ্রার ভ্রু কুঁচকে গেলো-“হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?”
“এমনিতেই। ভালোবাসা জিনিসটা কেমন সেটা খুব বুঝতে ইচ্ছে করে।”
শুভ্রা থমকে গেলো। তুলতুল এমনভাবে বললো যে উত্তর যোগালো না শুভ্রার মুখে। তুলতুল মৃদুস্বরে বললো-“তোমার ভাই তো আমাকে তুলে এনেছিল তারপর দিনভর রে*প করলো। তখন খুব হট্টগোল হচ্ছিল বলে বাঁচার জন্য তোমার বাবা জোর করে বিয়ে করয়ে দিলো। তারপর প্রতিদিন বৈধ ভাবে রে*প হতাম। মজার না ব্যাপারটা?”
বলতে বলতে তুলতুল খিলখিলিয়ে হাসে। শুভ্রা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। তুলতুল হাসতে হাসতে পেটে হাত দেয়-“তোমার ভাইয়ের আবার মরার আগে শখ জেগেছিল। আমাকে প্রায়ই বলতো, আমি কেন নিজ থেকে তার কাছে যাই না। বলো দেখি, কে সেধে সেধে নিজের ইজ্জত খোঁয়াতে চাইবে? আমার তো তাকে ঘৃনা হতো নিজ থেকে কিভাবে কাছে যাব? সত্যি বলতে তোমার ভাইটা মরার পর আমি খুব খুশি হয়েছিলাম জানো। মনে হয়েছিল এবার আমি মুক্তি পেলাম। অথচ কপাল দেখো, মানুষটা যেতে যেতে ঠিকই আমার পায়ে শিকল পরিয়ে দিলো। হা হা হা। শয়তান যে সহজে পিছু ছাড়ে না সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। হিহিহি।”
তুলতুল হাসতে হাসতে মুখে আঁচল চাপা দিলো। শুভ্রা অস্ফুটে চেচিয়ে উঠলো-“ভাবি!”
তুলতুল থেমে যায়, পেটের দিকে ইশারা করলো-“যদি ছেলে হয় তাহলে নিশ্চিত বাবা দাদাদের মতো গুন্ডা বদমাশ হবে। আর মেয়ে হলে তোমার মতো। হিহিহি।”
শুভ্রা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-“কি বলছো এসব? আমার মতো হলে কি খারাপ হবে?”
“তুমি কি ভালো? আমার কথা কখনো ভেবেছ? একটা মেয়েকে জোর করে আঁটকে রাখতে দেখেও চুপ করে থাকতে। তোমার বাবা আর ভাইরা মিলে কত মানুষের জীবন নরক করেছে সেসব কিছুই কি জানো না তুমি? আমার মনেহয় তুমি সব জানো কিন্তু না জানার ভান করে থাকো। তুমি নিজেও তো ওদের মতই। প্রতিশোধ নিতে বিয়ে করেছিলে। জামাইয়ের ক্ষতি করবে জেনেও বাবাকে তার কথা বলতে। সেদিন তোমার ভাইয়ের গুলিটা মিস না হলে কি হতো ভেবেছ কোনদিন? তুমি মাথামোটা, স্বার্থপর একটা মেয়ে। জানো তোমার বাবা ভাই কেমন কিন্তু তবুও কোনদিন তাদের কিছু বলোনি। নেহাত তোমার জামাই ভালো মানুষ বলে তোমাকে সহ্য করেছে।”
তুলতুলের এমন কঠিন কথা শুনে শুভ্রা বাকহারা হয়ে গেলো। তুলতুলের তখনো যেন কথা বলা শেষ হয়নি। সে শান্ত গলায় বললো-“এ বাড়ির মানুষের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেছে বুঝলে? এখন সাজা পাওয়া শুরু হয়েছে। তোমার এই হাল সেই সাজার একটা অংশ। ভেবে দেখ, তোমার এই হালের জন্য কে দায়ী? তোমার পরিবারই কিন্তু দায়ী। আমার বিশ্বাস এসব কেবল শুরু। আরও অনেক কিছু ঘটবে এই পরিবারের সাথে।”
“ভাবি!”
শুভ্রা আর্তনাদ করে উঠলো। তুলতুল হাসলো-“পরের মেয়ের সাথে কতকিছু হয়েছে এ বাড়ির কারো চোখে সহানুভূতি দেখিনি। এখন যখন নিজের মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে তখন সবার নাওয়া খাওয়া বন্ধ। এমন দ্বিচরিত দেখে ঘেন্না লাগে আপা। তবুও তো তোমার বর তোমাকে ভালোবেসে আগলে রেখেছে শত্রুর মেয়ে জেনেও। তোমার ভাগ্য বটে। কিছু মনে করো না আপা, অনেকদিনের জমানো রাগ তোমার উপর ঝেড়ে ফেললাম। মাফ করে দিয়।”
তুলতুল বইটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। শুভ্রা ঠায় বসে রইলো বিছানায়। কেন যেন তার মধ্যে কোন অনুভূতিই আসছে না। না রাগ না দুঃখ কিছুই না।

****

রণ আছে বিশেষ মিটিং এ। ওর এলাকায় মেয়র নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে কি দান খেলা হবে সে বিষয় গোপন মিটিং। বুকের মাঝে অহর্নিশ তীব্র জ্বালা তবুও ওর মুখ দেখে সেকথা বোঝার উপায় নেই। আজকাল মেজাজ খুব খিচিয়ে থাকে। সেই মেজাজ দেখানোর জায়গা নেই বলে বেশির ভাগ সময় তার রেশ রাজিব আর মিহিরের উপর দিয়ে যায়। আজ মেজাজ অতিরিক্ত খারাপ কিন্তু মিটিং বাদ দেওয়ার উপায় নেই। আজ এখানে বিশেষ একজন মানুষ উপস্থিত আছে। ওনার কথা অনেকবার শুনলেও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। মাজহার আমিন নাম তার। বলা হয়ে থাকে নেত্রী যত বড় বড় সিদ্ধান্ত নেন তার পেছনে উনার হাত থাকে। রণ চুপচাপ বসে দেখছে মানুষটাকে। নেত্রীর পাশে বসে নিচু স্বরে কথা বলছে। ছোটখাটো মানুষটার চেহারা বেশ সৌম্য দর্শন। বিশেষ কিছু বলতে গেলে অবশ্যই তার তীক্ষ্ণ নজরের কথা উল্লেখ করতে হবে। যেন কাউকে একবার দেখলেই তার মন পড়তে পারেন। আজ এখানে আরও কয়েকজন উপস্থিত আছে। সালিম সাহেবের বিপরীত পক্ষের আব্দুস সবুর, ইমাদ করিম আছেন।
“রণ।”
নিজের নামটা শুনে চমকে উঠলো রণ। দেখলো মাজহার আমিন হাসি মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রণ আড়ষ্ট হয়ে হাসলো-“জ্বি।”
“তুমি বলেছিলে শেষ মুহুর্তে সামলে নেবে। তুমি কি ভেবেছ শেয়ার করবে কি? সালিম এবার আটঘাট বেঁধে নেমেছে। খুব সহজে হাল ছাড়বে না। মনোনয়ন জমা দিয়ে দিয়েছে। সতন্ত্র হিসেবে দু’জন দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু ওরা কেউই সালিমের প্রতিপক্ষ হিসেবে মানানসই নয়।”
রণ বিচলিত হলো। ইদানীং মনের ক্ষত ব্রেনকে চিন্তা করতে বাঁধা প্রদান করে। অনেককিছু ভেবেছিল সে কিন্তু সত্যি বলতে এখন কোন কিছুতে উৎসাহ পাছে না। তবুও কিছু একটা বলতে হবে ভেবেই মুখ খুললো-“আমি ভেবেছিলাম এলাকায় প্রবীন রাজনীতিবিধ সিরাজ আহমেদের মেয়ে সুমনা আপাকে সতন্ত্র হিসেবে দাঁড়াতে বলবো। উনি একদম ফ্রেশ মুখ, শিক্ষিত মহিলা। সুযোগ পেলে ভালো করবে মনে হয়েছে।”
মাজহার অবাক হলো-“কিন্তু তার পূর্বের কোন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই।”
রণ হাসলো-“সেজন্যই ভেবেছি। সালিম সাহেব তাকে প্রতিদন্দী হিসেবে কখনোই চিন্তা করবে না। আর ভদ্রমহিলাকে যতদূর দেখেছি কথার মারপ্যাচ বেশ ভালো পারে। আপনারা কি বলেন ইমাদ ভাই?”
“সে তো সরাসরি রাজনীতি করে নাই। এই পদ সামলাতে পারবে?”
ইমাদ দ্বিধা নিয়ে উত্তর দিলো। রণ আশ্বাস দিলো-“আমার মনেহয় আপনারা সমর্থন দিলে পারবে। বাকীটা নেত্রীর বিবেচনা।”
মাজহার হাসলেন-“তোমাকে বিচক্ষণ মনে হয়েছিল। এখন দেখছি তুমি আমার ভাবনার চাইতে বেশি বুদ্ধিমান। তুমি কি রণর সাথে একমত?”
নেত্রীর দিকে তাকাতেই তিনি মাথা দুলালেন-“ওর উপর আস্থা আছে আমার।”
রণ বললো-“আপনি ভাববেন না ফুপু, সালিম সাহেব বাদে বাকি সবাই ওনার জন্য কাজ করবে। আমি কথা বলে রেখেছি সবার সাথে।”
“কিন্তু সুমনা কি রাজি হবে?”
“হবে। গতবার ওনার বাবার সাথে যা হয়েছিল তাতে উনি কষ্ট পেয়েছিলেন। সুযোগ পেলে দলের হয়ে কাজ করতে চান।”
“তাহলে তো হয়েই গেলো। ওনাকে একদম শেষ মুহূর্তে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে বলবে। বাকী কাজ আমরা দেখে নেব। এলাকায় কি করতে হবে সেসব তুমি ম্যানেজ করে নেবে।”
“ঠিক আছে। আজ আসছি ফুফু।”
রণ বিদায় নিতেই নেত্রী প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-“কেমন দেখলে?”
“চন্দ্রর জন্য একেবারে পারফেক্ট। দলের জন্যও বটে৷ ও চন্দ্রের সাথে জুড়ে গেলে তোমার দলের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে হবে না। কিন্তু একটা ভ করেছ। ওকে বিয়েটা করতে দেওয়া উচিত হয়নি।”
“বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার কাছাকাছি। ওর মা খুব রাজি চন্দ্রকে বউ বানাতে। তখন বিয়েটা না করলেও চলছিল না। সালিমকে চোখে চোখে রাখা জরুরি ছিলো।”
নেত্রী জবাবদিহিতা করলো। মাজহার সন্তুষ্ট হলো কিনা বোঝা গেলো না। সে মৃদুস্বরে বললো-“সালিমের মেয়ে ওকে ছেড়ে দেবে?”
“ছেড়ে গেছে অলরেডি।”
“তাহলে দেরি করো না। শুভ কাজ তাড়াতাড়ি সারতে হয়।”

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৫৯

“তুলতুল, আসবো?”
শরীফ দরজায় টোকা দিলো। তুলতুল এলেবেলে পড়তে পড়তে খিলখিলিয়ে হাসছিল। শরীফের আওয়াজ পেয়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো-“আসুন।”
বলেই আবারও মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে লাগলো। শরীফ রুমে ঢুকলো, তার হাতে স্ট্রবেরি ভর্তি বাটি। তুলতুলের দিকে বাড়িয়ে দিলো বাটিটা-“সেদিন খেতে চেয়েছিলে।”
তুলতুল অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে বাটিটা নিলো-“এতো অরিজিনাল মনেহচ্ছে। কোথায় পেলেন?”
“খুঁজলে পাওয়া কঠিন না। খেয়ে দেখো কেমন।”
শরীফ চেয়ার টেনে বসলো। তুলতুল একটা স্ট্রবেরি তুলে মুখে দিলো-“দারুন মজা। আপনিও খান না।”
মাথা নাড়লো শরীফ-“তুমি খাও।”
তুলতুল খেতে খেতে বইয়ে ডুবে গেলো আবার। শরীফ ওকে দেখলো চেয়ে চেয়ে। মাঝে মাঝেই হাহা হিহি করে হেসে উঠছে। শরীফের ভালো লাগছে দেখতে। সে হঠাৎ ডাকলো-“তুলতুল একটা কথা বলি?”
“হ্যা, বলুন না।”
“শুভ্রাকে ওসব বলা উচিত হয়নি তোমার। এমনিতেই ওর মনটা খারাপ তার উপর তুমি উল্টো পাল্টা বলে ওর মন আরও খারাপ করে দিয়েছ।”
তুলতুল থতমত খেলো। বইটা বন্ধ করে পাশে রেখে শরীফের দিকে তাকালো-“মাঝে মাঝে অনুচিত কাজ করতে হয়।”
“আমি তোমার কথা মেনে নিচ্ছি কিন্তু সেটা সবসময় নয়। শুভ্রা বরাবরই বাসা থেকে দূরে থেকেছে। বাবার হয়তো ওর উপর দূর্বলতা ছিলো তাই চাইতো না ও কিছু জানুক বা বুঝুক। এমনকি স্কুল বা কলেজের বন্ধেও ওকে বেশি বাসায় থাকতে দিত না আব্বা। ও হয়তো বড় হয়ে সব বুঝে গেছে কিন্তু বুঝলেও বলার উপায় ছিলো না। এখন যখন বাড়িতে আসে আব্বা ওকে ভালোবাসে সেটা বুঝেই কিছু বলতে পারে না। সবসময় দূরে থাকাতে এই ভালোবাসাটা হয়তো ওর ভালোলাগে। কিন্তু সেজন্য এসব কথা ওর শোনার কথা না৷ ও দোষী না আসলে। মানলাম তোমার উপর অন্যায় হয়েছে। কিন্তু আমি তো সেই অন্যায়কে শোধরাবার চেষ্টা করছি।”
তুলতুল চুপচাপ শরীফের কথা শুনলো। ও থামতেই তুলতুল বিচিত্র ভাবে হাসলো-“কিছু কিছু অন্যায়ের বদলা অন্যায় করেই নিতে হয়। জানেন, আপনার ভাই কি পরিমান অন্যায় করেছে তার তিরিশ বছর জীবনে? আমার আব্বাকে তুলে আনছিল। তারপর তিনদিন পরে আব্বার লাশ পাওয়া গেছিল শীতলক্ষ্যায়। আর আমার কপাল দেখেন, আব্বার খুনির সাথে সংসার করা লাগছে। এখন তার বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরতেছি। আপনের কাছে হয়তো কোন ব্যাপার না এসব কিন্তু ভাবলে আমার মাথা ঘুরায়। জীবনটাকে কেমন যেন অর্থহীন মনেহয়। মাঝে মাঝে আমার পেটের বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে মনচায়, ভীষণ মনচায়।”
শরীফ চুপ করে রইলো। সত্যি বড্ড লজ্জা লাগে তার। সেই সাথে তুলতুলের মানসিক অবস্থা ভেবে গা শিউরে ওঠে। তুলতুল হাসলো-“ভয় পাবেন না, এমন কিছু করবো না আমি। আর হ্যা, আপাকে ওসব বলেছি তার ভালোর জন্য। মানুষটার মন নরম। নরম না হলে তন্ময় ভাইকে আগেই থামাতে পারতেন। তার জন্য নিজের বিবাহিত জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতো না। কে ভুল কে ঠিক এই বুঝটা হওয়া দরকার আছে আপার। সঠিক মানুষ চিনতে না পারলে তার জীবন অন্ধকার হয়ে যাবে।”
“কিন্তু শুভ্রা বুঝলেই হবে? আরেকদিকের মানুষটাকেও তো বুঝতে হবে। এভাবে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার পরে কি ফিরে যাওয়া উচিত হবে ওর?”
“সেসব তো আমি জানি না। তবে মেয়েরা কত কিছু করে জীবনে। ভালোবাসার মানুষের জন্য কিছু করতে পারাও ভাগ্য।”
“তুমি বলতে চাইছো শুভ্রা রণকে ভালোবাসে?”
“অবশ্যই।”
শরীফ অবাক হয়ে জানতে চাইলো- “এতো শিওর হয়ে বলছো কি করে?”
“বোঝা যায়। এমন কঠিন কিছু না।”
“আচ্ছা! আমি কেন বুঝি না? তুমি কি কাউকে ভালোবেসেছ জীবনে? অভিজ্ঞতা আছে?”
হঠাৎ শরীফ বেফাঁস প্রশ্ন করে। তুুলতুল ভ্যাবাচ্যাকা খায়-“এসব বোঝার জন্য বুঝি ভালেবাসতে হয়? কি জানি? আমি তো যা মনে এলো তাই বললাম।”
বলতে বলতে আনমনা হলো তুলতুল। সামনে বসে থাকা শরীফকে এমনভাবে দেখলো যেন বহুদূরের মানুষকে দেখছে। তারপর বিরবির করলো-“কাউকে ভালোলাগার ভালোবাসার সু্যোগ পেলাম কোথায়? তার আগেই জীবনে কালিমা লেপন হয়ে গেলো।”

*****

ক্লান্ত শ্রান্ত রণ ঘরে ঢুকতেই জলির মুখোমুখি হলো। রণ বুঝলো মা রেগে আছে। সে হাসার চেষ্টা করলো-“মা, কেমন আছো তুমি? শরীর ঠিক আছে তো? ওষুধ ঠিকঠাক নিচ্ছ?”
জলি সে প্রশ্নের ধার দিয়ে গেলো না। সে গম্ভীর মুখে বললো-“বাবাই, কি শুরু করেছিল বলতো? ভোরে বেড়িয়ে যাস গভীর রাতে ফিরিস। বাসায় মা আছে বোন আছে কারো কোন খোঁজ রাখার প্রয়োজন নেই তোর?”
রণ অনেক কিছু বলতে চাইলেও শেষ মুহূর্তে কি মনে করে চুপ রইলো। ছেলের উত্তর না পেয়ে জলির মেজাজ চড়ে যাচ্ছে। সে গম্ভীর হয়ে বললো-“তুই একটু বোস আমার কাছে জরুরি কথা আছে।”
রণ হতাশ চোখে তাকালো-“কাল কথা বলি মা?”
জলি গোঁয়ারের মতন মাথা নাড়ে-“না, এখনই। আয় বোস।”
রণ হার মেনে বসলো মায়ের কাছে-“কি বলবে বলো।”
জলি ভনিতা করলো না-“শোন, উকিলের সাথে কথা বলেছি। ভাইয়া আলাপ করিয়ে দিয়েছে। তোর কাগজ তৈরি করতে বলেছি।”
রণ অবাক হয়ে তাকায়-“কিসের কাগজ!”
“কিসের আবার? ডিভোর্স পেপার। আমি তোর জন্য একজনকে পছন্দ করেছি। কথাও এগিয়ে রেখেছি।”
রণ বিস্মিত হয়ে মাকে দেখলো তারপর হেসে দিলো-“বাহ! দারুণ তো? আমি জানতাম না পাত্র হিসেবে আমি এতো দামী।”
“তুই অনেক দামী বাবাই। যাইহোক, কাগজ এসে যাবে দুই একদিনের মধ্যে। আশাকরি ভনিতা না করে সাইন করে দিবি। আমি ওই খুনিটাকে কোন সুযোগ দিতে চাই না।”
“কার সাথে বিয়ে ঠিক করেছ মা?”
“চন্দ্রানী। সারাদিন ওর সাথেই তো ঘুরিস।”
রণ হতবিহ্বল হয়ে তাকালো-“আর চন্দ্র রাজি হলো? নাকি সে জানেই না?”
“তার আমি কি জানি? স্বয়ং নেত্রী রাজি হয়েছেন প্রস্তাবে।”
রণ বাকরুদ্ধ। জলি অবস্থা এতোকিছু ভাবলো না-“শোন বাবাই, এবার তোর বিয়ের পর হাসি খুশির বিয়ে দেব। বলা যায় না ওই ছেলেটা আবার কোন ঝামেলা না করে। তুই ওদের জন্য ভালো পাত্র খুঁজে বের কর।”
রণ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সামনে বসে থাকা মানুষটা তার মা। কেমন যেন অচেনা লাগে জলিকে। সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-“আমি কাল এলাকায় যাচ্ছি মা। কয়েকদিন থাকতে হবে। নির্বাচনের কাজ আছে।”
জলি সন্দিহান নজরে তাকাতেই রণ মৃদু হাসে-“ভয় পেয়ো না মা, আমি শুভ্রার সাথে কোন যোগাযোগ করবো না। তাছাড়া আমি যোগাযোগ করতে চাইলেও শুভ্রা হয়তো করবেনা। ওকে এতোটাও হ্যাংলা ভেবো না মা। আর একটা কথা, শুভ্রাকে আমি ডিভোর্স দেব না কোনদিন। বাকী তুমি কি করবে করো।”
“ওই খুনির মেয়ে আর এ বাড়িতে ঢুকবে না বাবাই।”
“ও তো ঢুকে গেছে মা। অনেক আগে ঢুকেছে। তুমি ওকে ঢুকিয়েছ এ বাড়িতে। তাছাড়া দোষ ওর বাবার। ও কোন দোষ করেনি মা। তাই ওকে শাস্তি দেওয়াটা আমি মানতে পারলাম না। তুমি ওকে বের করে দিয়েছ আমি মেনে নিয়েছি কিন্তু এর বেশি কিছু করবো না আমি।”
রণ উঠে দাঁড়ায়। রুম থেকে বেরুবে এমন সময় জলি ক্রুদ্ধ স্বরে বললো-“যদি ও তোকে ডিভোর্স দেয় তাহলে কি করবি?”
রণর পা থেমে গেলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো পনের সেকেন্ড তারপর জবাব না দিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলো। বিছানার এসে বসলো চুপচাপ। শুভ্রার পাশটাতে ফিরে তাকালো একবার। আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তারপর নিজের জায়গায় শুয়ে পড়লো। শুভ্রার মাথার বালিশটা টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো, গন্ধে শুকলো চোখ বুঁজে। বার কয়েক গভীর শ্বাস টানলো তারপর বিরবির করলো-“ভালোবাসি তো বোকা মেয়ে।”

চলবে।
©Farhana_Yesmin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে