#দর্পহরন
#পর্ব-৩৭
রণর ভ্রু জোড়া বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। শুভ্রার কথা শুনতে শুনতে তার মুখটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো-“একমিনিট।”
শুভ্রা থতমত খেয়ে বললো-“কি?”
“কি বললেন আপনি? আপনার বাবা কিছুতেই এমন কিছু করতে পারে না?”
শুভ্রা মাথা দুলায়। রণর মুখে হাসি ফুটলো-“তার মানে আপনার ভাইয়েরা পারে?”
শুভ্রা রণর গেঞ্জি ছেড়ে দাঁড়ায়-“এ কথা কখন বললাম?”
“আপনি বেশ চালাক মেয়ে। অভিনয়ও ভালো করেন।”
শুভ্রা ভরকে গেলো-“মমমম মানে? কি বলতে চাইছেন?”
“বলতে চাইছি আমার উপর হামলা হবে সেটা আপনি আগে থেকেই জানতেন। তারপরও হাত পা গুটিয়ে বসে ছিলেন। আমার ধারণা আপনি আপনার পরিবার সম্পর্কে সম্পুর্ন ওয়াকিবহাল। তারা কেমন কি সব। কিন্তু সব না জানার ভাব ধরে থাকেন। তাই না?”
“কেমন কথা বলছেন? তন্ময় ভাইয়ের মুখ থেকে কথাটা শোনা মাত্রই কতবার ফোন দিয়েছি আপনাকে। আপনার নাম্বার বন্ধ পাচ্ছিলাম। মিহির ভাইকেও ফোন দিয়েছি। শেষে শরীফ ভাইকে ফোন দিয়ে অনুরোধ করেছি যেন সে আপনার খোঁজ করে। বিশ্বাস না হলে ফোন দিয়ে শুনতে পারেন।”
রণ হতাশ হয়ে শ্বাস ছাড়ে-“আপনাকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না শুভ্রা। আমি শুধু ভাবছি প্রতিশোধ স্পৃহা আপনাকে কতটা নিচে নামিয়ে দিয়েছে?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। রণ হাসলো-“আমি আপনাকে অপহরণ করেছিলাম এটা নিয়ে ব্লাকমেল করে আমাকে বিয়ে করেছেন। অথচ এটা জানেন না যে আপনার ভাবিকে আপনার ভাই সোহেল তুলে এনে রে*প করেছে। শুধু আপনার ভাবি কেন ওর মতো কয়েকটা মেয়েকে তুলে নিয়ে রে*প করে মে*রে ফেলেছে। আর আপনার বাবা ছেলের সব কুকীর্তি গোপন করতে সিদ্ধহস্ত। আমাকে যদি অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করান তাহলে নিজের ভাইয়ের ব্যাপারে কি বলবেন? বলুন?”
শুভ্রা অটল গলায় বললো-“আপনি মিথ্যে বলছেন। প্রমান আছে কোন? এমন কোন মেয়েকে দেখান যাকে ভাই রে*প করে মেরে ফেলেছে। প্রমান ছাড়া আইনত কাউকে অপরাধী বলা যায় না, এটা জানেন না?”
“জানবো না কেন? কিন্তু মে*রে ফেললে প্রমান পাবো কোথায়? একমাত্র প্রমান হিসেবে যে বেঁচে আছে সে আপনার ভাবি তুলতুল। তাকে জিজ্ঞেস করুন সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
“জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন উত্তর পাইনি। আপনি অযথা মিথ্যে অভিযোগ দিচ্ছেন। বাংলাদেশে রাজনীতি করা মানেই মিথ্যে অভিযোগ, বদনামি তারপর দিনশেষে জেলে পঁচে ম*রা। আর কোন পরিবার যদি আমাদের মতো তিনপুরুষ ধরে রাজনীতি করা হয় তাহলে তাদের তো শত্রুর অভাব হবে না।”
শুভ্রার কথা শুনে রণ হাসবে না কাঁদবে বুঝে পেলোনা। সে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো-“আমার কি দায় পড়েছে মিথ্যে বলার? আচ্ছা আপনি বলুন, আপনার ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়নি কেন। আপনার ভাবি তার বাবার বাড়ি যায় না কেন? কিংবা তার বাড়ির কেউ আপনাদের বাড়িতে আসে না কেন? একটাও উত্তর আছে আপনার কাছে? আমার মনেহচ্ছে সব জেনে বুঝে আপনি অবুজপনার নাটক করছেন।”
শুভ্রা নিশ্চুপ। রণ যেয়ে সোফায় বসলো-“আমি আপনাকে তুলেছিলাম তার বিশেষ কারন ছিলো। কিন্তু এটা তো বলতে পারবেন না আমি আপনার বিন্দুমাত্র অসন্মান করেছি। পারবেন বলতে? এই যে বউ হয়ে এসেছেন তবুও কি আপনার সাথে অশোভন আচরণ করেছি কখনো? কিন্তু দেখুন আপনি সবসময় আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে গেছেন। এতোদিনেও আপনার মধ্যে বিন্দুমাত্র বদল আসেনি।”
রণ হতাশ হয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“আমার ক্লান্ত লাগছে শুভ্রা। বাবার কথা শুনে আমার সাথে সহজ হওয়ার অভিনয় করছেন, আমাকেও পাল্টা অভিনয় করতে হচ্ছে। এসব আর ভালো লাগছে না।”
শুভ্রা চমকে উঠলো। অবাক চেয়ে থেকে বললো-“আমার কাছাকাছি আসা আমাকে ছুঁয়ে দেওয়া এসব অভিনয় ছিলো আপনার কাছে!”
রণ উত্তর দিতে পারলোনা সাথে সাথে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো-“এই অভিনয় আর নিতে পারছি না শুভ্রা। আমাকে সারাদিন সিরিয়াস ইস্যু নিয়ে ডিল করতে হয়। বাসায় এসেও সাংসারিক ইস্যু নিয়ে ভাবতে হয়। নাও আই এম ফেডআপ। বাইরের জগতের সাথে যুদ্ধ করা যায় কিন্তু ঘরে কতক্ষণ? দিনশেষে মানুষের একটা আশ্রয় দরকার হয় যার কাছে সে নিশ্চিতে মনের কথা বলতে পারে। শুভ্রা আপনার যদি এখনো আমার উপর রাগ থেকে থাকে তাহলে আমি বলবো সম্পর্ক এখানেই শেষ হোক। বিয়েটা আপনার কাছে হয়তো ক্ষনিকের জেদ হতে পারে কিন্তু আমি বিয়ে নিয়ে এরকম কখনো ভাবিনি। অথচ আমাকেই আপনার মতো করে চলতে হচ্ছে। এখন সত্যিই আর ভালো লাগছে না। আর আপনার জেদ তৈরীর পেছনে যেহেতু আমার হাত আছে তাই আমি আপনাকে সরি বলতে চাই। আমি আমার কাজের জন্য অত্যন্ত লজ্জিত শুভ্রা। এর বেশি আর কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই।”
শুভ্রা খুব ধীর স্থির হয়ে বসলো রণর সামনে-“আপনি কি চান আমি আপনার জীবন থেকে চলে যাই? তাহলে খুশি হবেন আপনি?”
রণ এবার হেসে দিলো-“এবার বাচ্চাদের মতো কথা বলছেন শুভ্রা। আমার খুশি হওয়া না হওয়ার কথা এখানে হচ্ছে না। কথা হচ্ছে আপনি কি চান। আপনার যদি আমার সাথে জীবন কাটানোর ইচ্ছে থাকে তাহলে কিছু বিষয়ে স্ট্রং ডিসিশন নিতে হবে আপনাকে। নিজের মা আর বোনদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চাই না আমি। বুঝতে পেরেছেন?”
শুভ্রা নত মুখে বসে ছিলো। মাথা উঁচু করে জানতে চাইলো-“কেমন ডিসিশন?”
“দেখুন, আমি চাইলে সিকিউরিটিকে বলে যেতে পারতাম তন্ময়কে যেন ঢুকতে না দেয়। কিন্তু বিষয়টা আমি আপনার উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। আপনি কি সিদ্ধান্ত নেন সেটা দেখতে চাইছিলাম। বলা যায় আপনার জন্য পরীক্ষা ছিলো এটা। এবং বুঝতেই পারছেন পরীক্ষায় আপনি ফেল করেছেন খুব ভালো ভাবে। আপনি প্রতিবারই সুযোগ দিয়েছেন তন্ময়কে।”
রণ থামলো। খানিকটা সময় চুপ করে থাকলো। শুভ্রার আচরণ বুঝতে চাইলো। তারপর লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বললো-“আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে হলে আপনার পরিবারকে ছাড়তে হবে শুভ্রা। তাদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখা যাবে না।”
শুভ্রা চমকে মুখ তুলে তাকায়। ওর চেহারা ফ্যাকাশে, রক্তশুন্য। আতঙ্কিত গলাতে বললো-“এসব কি বলছেন? নিজের পরিবারের সাথে কি সম্পর্ক ত্যাগ করা যায়?”
রণ হাতের উপর চিবুক ঠেকিয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। মৃদুস্বরে বলে উঠলো-“যায় কিনা জানি না তবে আপনার যে কোন একটা বেছে নিতেই হবে শুভ্রা। হয় আমার সাথে থাকবেন না হয় সব শেষ করে দিয়ে পরিবারের কাছে ফিরে যাবেন। আমার সাথে থাকলে আমি আপনার একশোভাগ লয়ালটি দাবি করবো। কোন ভাগ মেনে নেব না। আর না থাকলে তো কোন দাবী করার প্রশ্ন নেই। এখন সিদ্ধান্ত আপনার। আপনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন আমি বিনা প্রশ্নে মেনে নেব।”
শুভ্রাকে দ্বিধান্বিত দেখায়। রণ ওর অবস্থা বুঝে ওকে আশ্বস্ত করলো-“দুই একদিন সময় নিন আপনি। ভেবে আমাকে জানান কি করতে চান। চাইলে বাড়িতে যেতে পারেন আমার কোন আপত্তি নেই। শুধু একটা অনুরোধ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর যেন তাতে অটল থাকেন।”
শুভ্রা নিশ্চুপ বসে রইলো। রণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে গেল।
*****
রাতে শুভ্রার ফোনে ফোন এসেছিল। সালিম সাহেব ফোন করে সোহেলের খবর দিয়েছে। কাল হাসপাতালে একবার শুনেছিল রণর উপর নাকি হামলা হয়েছে। কিন্তু তন্ময়ের ভয়ে কিছু মাথায় ছিলো না শুভ্রার। বাবার ফোন পেয়ে অবাকই হলো। সালিম সাহেব পুরো ঘটনা খুলে বলেনি। উল্টো মেয়ের কাছ থেকে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করেছে। রণ কিছু বলেছে কিনা তা জানতে চেয়েছে। যখন দেখেছে শুভ্রা কিছুই জানে না তখন একদিকে ভীষণ অবাক হয়েছে আরেকদিকে খুশি। অবাক হয়েছে রণ শুভ্রাকে কিছু জানায়নি দেখে। খুশি হয়েছে শুভ্রা যেহেতু জানে না তাই তাকে নিজের মতো করে বুঝ দেওয়া যাবে এটা ভেবে। কাঁদো কাঁদো গলায় নিজের অসহায়তা জাহির করে মেয়েকে বাসায় আসতে বললেন। শুভ্রা জানালো সকাল হলেই সে রওনা দেবে। ভাইকে দেখতে আসবে।
সকালে শুভ্রা যখন তৈরি হচ্ছিল রণ অবাকই হলো। তার অফিস যেতে হবে, আজ নেত্রী মিটিং ডেকেছে। তার উপর কাজের লিষ্ট অনেক লম্বা। পুলিশ ফোর্সের একটা অনুষ্ঠানে আজ সে চিফ গেস্ট। তবুও জানতে চাইলো-“সাতসকালে কোথায় যাচ্ছেন?”
“বাবা ফোন করেছিল। সোহেল ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। কান্নাকাটি করছিল বাবা। তাকে দেখতে যাচ্ছি।”
রাগে রণর চোয়াল শক্ত হলো। সে শুভ্রার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকাল-“আপনি জানেন তো সোহেল কি করেছে? কাল ও সরাসরি ব*ন্দুক তাক করেছিল আমার উপর। না না অবাক হবেন না। প্রমান আছে আমার কাছে। আপনি তো আবার প্রমান ছাড়া কিছু বিশ্বাস করেন না তাই না। ওয়েট।”
রণ নিজের ফোনটা বের করে ভিডিওটা দেখায় শুভ্রাকে। শুভ্রা চুপচাপ দেখলো, বললো-“আমরা যা দেখি সবসময় তা সত্যি হয় না। ও আপনাকে গু*লি করতো কিনা তা বোঝার আগেই পুলিশ ওকে গু*লি করেছে। হতে পারে আপনার পাশে কেউ ছিল যে ওর টার্গেট ছিলো। হতে পারে সে আপনাকে বাঁচাতে চেয়েছে।”
রণ মোবাইল ছুঁড়ে দিলো বিছানায়-“আর ইউ ম্যাড? চোখের দেখাও বিশ্বাস করছেন না? এখন কি আমার ম*রে প্রমান করতে হবে? ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল।”
শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো। রণ অধৈর্য্য হয়ে বললো-“কথা বলছেন না কেন?”
শুভ্রা শান্ত গলায় জবাব দিলো-“আপনি অযথা হাইপার হচ্ছেন। আমি আমার ভাইকে দেখতে যাবো এতে আপনার আপত্তি থাকার কথা না। মানলাম সে আপনার দোষী। আমি তার বোন, অসুস্থ ভাইকে দেখতে যাওয়া আমার কর্তব্য।”
রণ অস্থির পায়চারি করলো ঘরময়। তারপর আবার শুভ্রার সামনে এসে দাঁড়ালো-“আশাকরি ঘুরে এসে সিদ্ধান্ত জানাবেন। আমি আর অপেক্ষা করতে রাজি না শুভ্রা। আমি জীবনে এগিয়ে যেতে চাই। এভাবে ঝুলে থাকতে রাজি না আর।”
বলেই মোবাইল হাতে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। শুভ্রা কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। আজ বাসায় যাওয়া খুব জরুরি তার জন্য। তার জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু কি সিদ্ধান্ত নেবে সে?
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#দর্পহরন
#পর্ব-৩৮
“আব্বা, আপনারা ওনাকে মেরে ফেলতে চান? ওনার সাথে যে আপনার নিজের মেয়ের জীবন জড়িয়ে আছে সেটাও কি ভুলে গেছেন?”
শুভ্রার কথা শুনে সালিম সাহেব চমকে গেলেন। তাহলে কি রণ শুভ্রাকে সব বলে দিলো? তিনি মেয়েকে কি বলে বুঝ দেবেন সেটা ভাবলো কয়েকমুহুর্ত। আমতা আমতা করে বললো-“আম্মা, এইটা কি বললেন? আপনের আব্বাজানকে চিনেন না আপনে? এমুন কাম আমি করুম আপনে ভাবলেন কেমনে? আমি খুব কষ্ট পাইলাম আম্মাজান। আপনের আব্বারে আপনে বিশ্বাস করেন না। এই দুঃখ কই রাখমু?”
সালিম সাহেবের নাকি কান্না দেখে শুভ্রা বিচলিত হলো না। সে এবার কন্ঠ খানিকটা নরম করে বললো-“আমি সোহেল ভাইয়ের ভিডিও দেখছি আব্বা। ভাই ওনার উপর গুলি চালাইতে গেছে তখনই ভাইকে পুলিশ গুলি করছে। এখন বলেন চোখের দেখা অবিশ্বাস করি কেমনে?”
সালিম সাহেব মেয়েকে তাকিয়ে দেখলো। শুভ্রাকে কেমন ধীরস্থির দেখাচ্ছে। সালিম সাহেব বোঝার চেষ্টা করলো মেয়ের মনে কি চলছে। তিনি মেয়ের হাত ধরে সামনের চেয়ারে বসিয়ে দিলো-“অবিশ্বাস তো করতে কই নাই আম্মাজান। তাই বইলা এইটাও বিশ্বাস কইরেন না আমি এমুন কাম করাইছি। সোহেল সবসময়ই একটু তার ছিঁড়া এইটা তো জানেনই। এইজন্য ওরে আমি এখন সবকিছু থিকা দূরে রাখি। কালই কেমনে কেমনে সমাবেশে আইছে আমি জানিও না। আপনে এইটা ভাবেব তো, আপা ছিলো কালকের অনুষ্ঠানে। আমি কি এমুন কোন কাম করুম যেইটাতে আপা রাগ করবো? আপনেই বলেন দেখি?”
শুভ্রাকে সাথে সাথে মাথা নাড়তে দেখে সালিম সাহেব স্বস্তি পেলো-“আম্মাজান, কালকের ঘটনার পরে দল থিকা আমাকে বহিস্কার করতে পারে। নিজের এতোদিনের গড়া মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হইতেছে। আপার সামনে লজ্জায় দাঁড়াইতেই পারুম না। এই সোহেইল্লারে নিয়া কিযে করুম ভাইবা পাই না। আমারে শেষ কইরা দিলো এই পোলা।”
সালিম সাহেবের কন্ঠ আর্দ্র হলো। চোখ দুটো মুছে নিলো আলতো হাতে। বাবার ভেজা চোখ শুভ্রার হৃদয় আন্দোলিত করে। সে বাবার পিঠের উপর হাত রাখলো-“ডাক্তার কি বলে আব্বা? ভাইয়া ভালো হয়ে যাবে?”
সালিম সাহেব মাথা নাড়লো-“কালইকা পর্যন্ত দেখবো। জ্ঞান না ফিরলে…”
সালিম সাহেব ঝরঝর করে কাঁদেন। শুভ্রা মন খারাপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলো। সালিম সাহেব ভেজা কন্ঠে বললো-“আপনেরা যে যাই বলেন আমার সোহেলের আমার জন্য অনেক ভালোবাসা। শুধু আমাকে সঙ্গ দিব দেইখা আমার খিতা দূরে যাইবোনা বইলা বেশিদূর পড়ালেখা করলোনা। এখন পোলা আমার বাঁচা মরার মাঝখানে। কেন এমুন করলো সোহেলে? আম্মাজান, কনতো কেন এমুন করলো?”
এবার শুভ্রার চোখদুটোও ভিজে যায়। সালিম সাহেবের কথা সত্য। সোহেল বাস্তবিক বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। শুভ্রা বাবাকে শান্তনা দিলো-“নিজেকে সামলান আব্বা। ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে।”
কিছুটা সময় দু’জন চুপ করে রইলো। শুভ্রা উঠে দাঁড়ায়-“বাসায় যাই আব্বা। আম্মার কি হাল দেখি। আমি আছি কয়েকদিন।”
সালিম সাহেব ধীরলয়ে মাথা দুলালেন।
*****
ইব্রাহিম নিবাস ভুতুড়ে বাড়ির মতো নিস্তব্ধ। সবসময় জমজমাট হয়ে থাকা বাড়িটা আজ মৃতপ্রায়। শুভ্রা অন্যমনস্ক হয়ে কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরলো। বাড়িতে আজ প্রায় সবাই আছে তবুও কোন আওয়াজ নেই। মায়ের কাছে বসলে খুনখুন করে কাঁদে। শুভ্রা কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে এসেছে। শরীফ বাবার সাথে হাসপাতালে। শুভ্রা ছোট চাচার ঘরে উঁকি দিলো। তাহের শুয়ে শুয়ে মোবাইল কিছু একটা দেখছিলো। শুভ্রাকে দেখে অবাক হলো-“তুই কখন এলি?”
শুভ্রা ভেতরে ঢুকে হাসলো-“দুপুরের আগেই এসেছি। হাসপাতাল ঘুরে এলাম তাই দেরি হলো।”
তাহেরের মুখটা অন্ধকার হলো-“তুই তাহলে সব জেনেই এসেছিস। তোর বর আসতে দিলো?”
শুভ্রা হেঁটে এসে চাচার বিছানায় বসলো। তাহের উঠে বসেছে ততক্ষণে। শুভ্রা মাথা নাড়লো-“আসতে দিতে চায়নি। ক্যাওয়াজ করে আসতে হয়েছে।”
তাহের ভাগ্নিকে মন দিয়ে জড়িপ করলো-“ছেলেটা কিন্তু ভালো। শুধু শুধু ওর সাথে ঝামেলা করিস না।”
শুভ্রা ভাবুক হয়ে চাচার পানে চাইলো-“সত্যি বলছো? তোমার মনেহয় সে ভালো মানুষ?”
তাহের হাসলো-“এই পরিবার ওমন জামাই পাওয়ার যোগ্য না। তোরা হচ্ছিল ডাকাবুকো, সে ভদ্রলোকের ছেলে। কোনভাবেই ম্যাচ হয় না।”
শুভ্রা খিলখিল করে হাসলো কিছুক্ষণ-“তোরা বলছো কেনো? তুমি এমনভাবে বলছো যেন তুমি এ পরিবারের কেউ না। তাছাড়া নিজের পরিবারকে ডাকাবুকো বলছো। বাবা চাচ্চু কি করেছে বলো তো?”
তাহের গুম হয়ে বসে রইলো। শুভ্রা চাচাকে দেখছে চুপচাপ। তাহের ওদের চোখে ভীষণ রহস্যময় একজন। বিয়ে থা করেনি কখনো, বাড়ির কেউ বলেওনা। নির্ঝন্ঝাট থাকতে পছন্দ করে। শুভ্রা হঠাৎ করে জানতে চাইলো-“চাচ্চু, একটা সত্যি কথা বলবে?”
তাহের অবাক চেয়ে মাথা নাড়লো। শুভ্রা বললো-“তুমি বিয়ে করলে না কেন? কাউকে পছন্দ করতে?”
তাহের চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলো। ধীর স্বরে বললো-“ঘর সংসারের ঝামেলা ভালো লাগে না। বিয়ে মানেই ঝামেলা। একা একা বেশ আছি। কোন পিছুটান নেই ঘ্যানঘ্যানানি নেই।”
শুভ্রা কথা বাড়ায় না। জানে চাচার কথাগুলো সত্য না। কিন্তু কথা বাড়াতে মন চাইলো না বলে নিজের কামড়ায় ফিরে এলো।
সোহেলের অবস্থা পরিবর্তন হয়নি। সালিম সাহেব কাল থেকে হাসপাতালেই আছেন। রিমা ক্ষণেক্ষণে ছেলের কথা বলে মুর্ছা যাচ্ছে। বড় চাচী তাকে সামলাতে ব্যস্ত। একমাত্র তুলতুল খুব বেশি স্বাভাবিক। সে তিনবেলা নিয়ম করে খাবার খাচ্ছে। নিজের রুমে ঘুমাচ্ছে। তাকে বেশ সুখী দেখায়। সকাল সকাল শুভ্রাকে দেখে বললো-“আপা, যদি কিছু মনে না করেন আপনার ফোনটা আমাকে দেবেন? মার সাথে একটু কথা বলতাম।”
শুভ্রা অবাক হলেও সাথে সাথে ফোন বের করে দিলো। তুলতুল দ্রুত হাতে মায়ের নাম্বারে ফোন দিলো। কয়েকবার চেষ্টা করার পর ওপাশ থেকে যখন কেউ ফোন তুললো তুলতুল হড়বরিয়ে উঠলো। কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে যা বললো তাতে শুভ্রার চোখ কপালে উঠলো। দশ মিনিট কথা বলে লজ্জিত মুখে শুভ্রাকে ফোন ফিরিয়ে দিলো। শুভ্রা হতচকিত হয়ে ফোন হাতে নিয়ে বললো-“ভাবি, ভাইয়া হাসপাতালে থাকার পরেও তুমি এতো স্বাভাবিক? ভাইয়া কি তোমাকে জোর করে তুলে এনেছে? প্লিজ ভাবি, আজ কোন মিছে কথা বলো না।”
তুলতুল অসহায় হাসলো-“বেশি কিছু বলবো না। শুধু বলবো, আপনার ভাইকে আমি আমার জীবনের চাইতে বেশি ঘৃনা করি। এতোটাই ঘৃনা করি যে সে মারা গেলে আমি একটুও দুঃখ পাবো না। বাকীটা আপনি বুঝে নেন আপা।”
শুভ্রা হতবুদ্ধি হয়ে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে রইলো। রণর কথাগুলো তাহলে সত্যি? সে কি করে এতোটা অবুঝ হয়ে থাকে? আব্বা কি তাহলে এই কারনেই ওকে সারাজীবন দূরে দূরে রেখেছে? ও যাতে কিছু টের না পায়? শুভ্রা নিজের কামরায় ফিরে এলো ধীর পায়ে।
সন্ধ্যা নাগাদ সোহেলের কোমায় চলে যাওয়ার খবর এলো। বাড়ির পরিবেশ আরও ভারী হয়ে উঠলো। আত্মীয়স্বজনরা ভীড় করতে শুরু করলো। সালিম সাহেব বিদ্ধস্ত চেহারা নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। তাকে হতবিহ্বল লাগে। শুভ্রার হাসফাস লাগছে এমন গুমোট পরিস্থিতি। মন চাইছে ঢাকায় ফিরে যেতে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে ঢাকায় যাওয়া খারাপ দেখায়। আসলে তার বাবাকে এরকম অবস্থায় আগে কখনো দেখেনি সে। তাই কোথায় যেন হাহাকার টের পায়। সোহেল যত খারাপ হোক তার ভাই হয়।রক্তের সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই। সবকিছু মিলিয়ে ভীষন হিজিবিজি পরিস্থিতি। এমন অবস্থায় হুট করে রণর ফোন-“শুভ্রা, কি অবস্থা সোহেল ভাইয়ের?”
শুভ্রা ফিসফিস করলো-“ভাইয়া কোমায় চলে গেছে মিস্টার রণ। এবার আপনি খুশি তো?”
রণ চুপ করে থেকে বললো-“কারো দুঃখে দুঃখবিলাস করার মতো মানুষ আমি না এটা আপনার জানা উচিত। যা হোক আপনাকে এসব বলা অর্থহীন। কাজের কথা বলি। আপনার বাবাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করার দাবী উঠেছে। কালকের মধ্যে হয়তো ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। আফটারঅল উনি আমার শশুর তাই কথাটা আপনাকে জানানো। ধাক্কাটা ওনার জন্য বেশি হতে পারে। ভাবলান আগেভাগে জানিয়ে রাখলে আঘাত কম পাবে।”
শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করলো-“এই মহান কাজটা নিশ্চয়ই আপনি করছেন?”
রণ প্রথম অবাক তারপর উচ্চস্বরে হো হো করে হাসলো-“সত্যি মাথা খারাপ আপনার। নিজের বাপ ভাইয়ের আগে কিছু দেখেন না দেখছি। কোথায় আপনাদের ভালো ভাবলাম বলে কৃতজ্ঞতা দেখাবেন তা না সবসময়ের মতো আমাকেই দোষী বানানোর পায়তারা।”
রণর কথা শুনতে শুনতে শুভ্রা দ্রুত বাবাকে দেখলো। চুপচাপ শুয়ে আছে বিছানায়। মানুষটা এমনিতেই ছেলের দুঃখে কাতর। এমন অবস্থায় পার্টির খবর শুনলে কি হতে পারে ভেবে ভয় পেলো শুভ্রা। মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছে সব ভাবনারা। শুভ্রা দ্রুত গতিতে ভেবে চলেছে-“শুনুন, বাবাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করার ব্যাপারটা আপনি দেখুন। এই মুহুর্তে এমন কিছু হলে বাবাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারবেন না।”
রণর গম্ভীর স্বর শোনা গেলো-“আর এসব আমি কেন করবো? কি লাভ আমার?”
“লাভ!” শুভ্রা যেন স্বগতোক্তি করলো।
“হ্যা, আমার কি লাভ এসব করে। কেনইবা করবো?”
রণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। শুভ্রা ঠোঁট কামড়ে ধরলো। রণ এমন কিছু বলবে আগে বোঝেনি। সে কিছু একটা ভেবে নিলো-“আপনার শর্ত মেনে নেব। পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছেদ করবো আমি। আপনি বাবাকে এবারের মতো বাঁচিয়ে নিন আমি আমার পরিবারের সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করবো।”
রণর কন্ঠস্বর ভারী হলো-“ভেবে বলছেন তো?”
শুভ্রা ঠোঁট দু’টো চেপে ধরে রাখলো তিরিশ সেকেন্ড। তারপর মাথা দুলায়-“হ্যা, ভেবে বলছি।”
“ঠিক আছে। ঠেকিয়ে নেব এবারের মতো। আপনি কাল সকাল সকাল চলে আসবেন এ বাড়ি। মা আপনার কথা বলছিল আজ। আপনাকে কাল বাসায় দেখতে চাই।”
একবার মানা করতে যেয়ে থমকে গেলো শুভ্রা, বললো-“ঠিক আছে। কাল চলে আসছি।”
রণ শেষ বারের মতো জানতে চাইলো-“ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তো শুভ্রা? পরে আবার নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যাবেন নাতো?”
“একদম না। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকবো। আপনি ভাববেন না। আর যদি না থাকতে পারি তাহলে আপনার যা সাজা দেবেন মাথা পেতে নেব।”
রণ অবাক গলায় বললো-“সত্যি তো!”
“সত্যি সত্যি সত্যি। তিনবার বললাম। চলবে?”
শুভ্রার কথায় চুপ করে গেলো রণ। খানিকক্ষণ বাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“রাখছি।”
চলবে।
#দর্পহরন
#পর্ব-৩৯
“রাগীব, তুমি এতো রাতে? কোন বিশেষ দরকার?”
নেত্রী অবাক কন্ঠ শুনে রণ চুপ করে রইলো। উনি সাধারণ ঘরোয়া পোশাকে দাঁড়িয়ে। রণ খানিকটা নার্ভাস হলো-“ফুপু, একটা বিষয়ে কথা ছিলো।”
নেত্রী বুঝলেন রণ কোন বিষয় নিয়ে কথা বলবে। উনি সোফায় বসে রণকে হাতের ইশারায় ডাকলেন-“বসো। কি বলবে বলো।”
“ইব্রাহিম সালিমের বহিস্কারের চিন্তা বাদ দেওয়া যায় না ফুপু? উনি দীর্ঘদিন আপনার সাথে আছে। তাছাড়া ওনার ছেলে সোহেল তো কোমায় চলে গেলো। মনেহয় না সে বেঁচে ফিরবে। আর ছেলেকে হারাতে হলে এটাই ওনার জন্য বড় শাস্তি হবে। এরচেয়ে বড় কোন শাস্তি হয় না আর।”
নেত্রী চুপ করে রইলো কিছু সময় তারপর বললো-“আমি তো তোমার জন্য ওকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। আজ মারার জন্য হামলা করেছে কাল হয়তো মেরেই ফেলবে। ও সাংঘাতিক মানুষ, ওর কাছে সম্পর্কের কোন ভ্যালু নেই। নিজের প্রয়োজনে ছেলেমেয়েকেও তুচ্ছ করতে পারে। তবুও তুমি যখন বলছো তখন বিষয়টা আপাতত মুলতবি রাখবো। ওর এ্যাকটিভিটি দেখবো। খারাপ কিছু পেলে এ্যাকশন নেব। তখন কিন্তু কিছু বলা যাবে না?”
রণর মুখে হাসি ফুটলো-“থ্যাংক ইউ ফুপু।”
নেত্রী হাসলেন। হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন-“চন্দ্রের কাজ কেমন লাগছে? ও কি পারছে প্রজেক্ট হ্যান্ডল করতে?”
“পারছে ফুপু, বেশ ভালো ভাবেই পারছে। এ ব্যাপারে চন্দ্রর দক্ষতা আছে।”
রণর কথা শুনে নেত্রীর মুখ পরিতৃপ্তির হাসি দেখা গেলো-“ও তোমার কথা খুব বলছে। তুমি যে ভীষণ ধৈর্য্য নিয়ে ওকে সব শিখিয়ে দিচ্ছ সেটাও বলেছে ও।”
রণ লাজুক হাসলো-“আমি শুধু আমার কর্তব্য করেছি ফুপু। চন্দ্র এমনিতেই সব পারছে।”
“ওটা তোমার বড়ত্ব। তারপর বলো বউ কেমন আছে? বউয়ের সাথে সব ঠিক আছে তো?”
হুট করে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ আসায় রণ সংকোচ বোধ করে। কি বলবে ভেবে পেলো না। নেত্রী বললেন-“বেশি সমস্যা মনে করলে সমস্যা সমুলে উপরে ফেলো। এসব বিষয়ে মায়া করতে নেই। মায়া করলে সারাজীবন ধরে পস্তাতে হয়। না বনলে জোর করে ধরে রাখবে কেন? সব ছেড়ে নতুন করে সব শুরু করো।”
“আর কিছুদিন দেখবো ফুপু৷ তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারবো আশাকরি। আপনি তো জানেন সবই। সালিম সাহেবকে আমি আসলে কোনভাবেই সহ্য করতে পারি না। কিন্তু কি আর করা।”
নেত্রী আশ্বস্ত হলেন-“বেশ ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছ।”
রণ বিদায় নিতে উঠে দাঁড়ায়-“আজ আসি ফুপু। আপনাকে এতো রাতে বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত।”
“এর শাস্তি পেতে হবে তাহলে। শুধু দুঃখ প্রকাশ করলে হবে না।”
“জ্বি ফুপু। যা বলবেন করবো।”
“ভেবে বলছো তো? না হলে কিন্তু এই কথা দেওয়ার জন্য বিপদে পড়বে।”
নেত্রীর কন্ঠে কৌতুক। রণকে কিছুটা বিভ্রান্ত লাগে। তা দেখে নেত্রী হাসলো-“বাড়ি যাও। না হলে মা টেনশন করবে আবার।”
রণ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সে প্রায় পালিয়ে এলো তার ফুপুর কাছ থেকে।
*****
সকাল হতেই শুভ্রার তৈরি হয়ে বাবার সামনে দাঁড়ায়-“আব্বা, আমি যাচ্ছি।”
সালিম সাহেব ঘোলা চোখে তাকায় মেয়ের দিকে-“কই জান আম্মা?”
“বাসায় যেতে হবে আব্বা। ওনার কোথাও যাওয়ার কথা আছে। আমাকে ডেকেছেন উনি।”
ভ্রু কুঁচকে শুভ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সালিম সাহেব। কথা বুঝতে পেরে স্তিমিত কন্ঠে বললো-“আব্বাকে এই অবস্থায় ফেলে চলে যাবেন?”
বলে থেমে গেলেন সালিম সাহেব। তারপর কি ভেবে বললেন-“যান। কারো জন্য তো জীবন থাইমা থাকো না। তবে আপনি কাছে থাকলে আপনার আব্বা সাহস পায়।”
শুভ্রা কম্পিত গলায় জবাব দিলো-“শরীফ ভাই আছে, চাচা আছে। আপনি চিন্তা করবেন না আব্বা। তাহের চাচা বললো সোহেল ভাইকে সিঙ্গাপুর নেওয়ার ব্যবস্থা করছে। ভাই ভালো হয়ে যাবে।”
সালিম সাহেব চুপ করে থাকলেন। তার মাথা নিচে ঝুঁকে আছে। বাবাকে ওরকম অসহায় অবস্থায় দেখে বুকটা হুহু করে উঠলো শুভ্রার। নিজেকে অতি দ্রুত সামলে নিয়ে বাবার নিকটে এসে দাঁড়ায়-“আমি যাই আব্বা। দোয়া করবেন আমার জন্য।”
“আব্বাকে মাঝে মাঝে দেখতে আইসেন আম্মা। এই বুড়া সন্তানকে ভুলে যাইয়েন না।”
শুভ্রা অনেক কষ্টে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আঁটকালো। তার কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। বাড়ির মানুষদের চাইলেও আর দেখতে পাবে না সেই কষ্টে নাকি আর কোনদিন এ বাড়ি আসতে পারবে সেই কষ্টে কান্না আসছে সেটা সে জানে না। শুভ্রা বাবার পা ছুঁয়ে উঠে দাঁড়ায়-“আব্বা, আপনার মেয়ে খুব ভালোবাসে আপনাকে। যত দূরেই থাকি না কেন আপনার কথা সবসময় স্মরনে থাকে। আপনি আমার জন্মদাতা, নিজেকে ভোলা গেলেও আপনাকে ভোলা সম্ভব না৷ আসি আব্বা।”
শুভ্রা ছুটে বেড়িয়ে এলো বাপের রুম থেকে। কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা নিচে নেমে গাড়িতে উঠে বসলো। তার চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরছে। না পেরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।
*****
শুভ্রাকে দেখে মোটেও খুশি হলো না জলি। মুখে অন্ধকার নেমে এলো। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করা দূর শুভ্রার সালামের উত্তরও দিলো না। মুখ ফিরিয়ে নাস্তা করায় মন দিলো। শুভ্রা বাসা থেকে নাস্তা না করেই বেরিয়েছিল। এখন খাবার দেখে ওর খিদে পেয়ে গেলো। কাপড় না পাল্টেই ডাইনিং এ বসলো। প্লেট টেনে পরোটা আর আলুভাজি নিয়ে খেতে শুরু করলো। জলি ওকে খেতে দেখে মুখ বাঁকাল। অন্য সময় হলে নিজ থেকেই ওকে খেতে দিত। শুভ্রার খটকা লাগলেও পাত্তা দিলো না। হঠাৎ জলি বললো-“তা এবার কি পরিকল্পনা করে এলো?”
“জ্বি!”
জলির কথার মানে না বুঝতে পেরে শুভ্রা অবাক হয়ে তাকায়। জলি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো-“একেবারে নাদান। এমন ভাব করছো যেন কিছু বোঝ না?”
শুভ্রা মুখ হা করে জানতে চাইলো-“মানে কি? কি বুঝবো? আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না।”
জলি কঠিন মুখ করে তাকিয়ে থেকে বললো-“বলছি বাবা ভাইদের সাথে বসে কি পরিকল্পনা করে এলে? গুলি করে মারবে নাকি তুমি নিজে খাবারে বিষ মিশিয়ে মারবে আমার ছেলেকে?”
শুভ্রা হতভম্ব, ও চোখ গোল করে তাকিয়ে আছে-“এসব কি বলছেন উল্টো পাল্টা?”
“কেন? ভুল কিছু বলেছি? আমার ছেলেকে মেরে ফেলতে চাও না তোমরা?”
শুভ্রা কি বলবে ভেবে পেলো না। শান্তশিষ্ট জলির এমন কঠিন রুপ সে আগে দেখেনি। সে হতবিহ্বল হয়ে বললো-“আন্টি, এসব কি বলছেন? উনাকে কেন মেরে ফেলতে চাইবো আমি? আপনার কোথাও বুঝতে ভুল হয়েছে।”
জলি তীক্ষ্ণ নজরে শুভ্রার পানে চেয়ে থেকে বললো-“এতোদিন ভুল বুঝলেও এখন ঠিকঠাক বুঝতে পারছি তোমাকে। জোর করে কান্নাকাটি করে নিজেকে অসহায় প্রমান করে কেন আমার ছেলেকে বিয়ে করেছিলে তা এখন আয়নার মতো পরিস্কার আমার কাছে। আমি ভেবেছিলাম, হাজার হোক মেয়ে তুমি। বাবা ভাইদের মতো হবে না। নিজের স্বামীকে আগলে রাখবে, ভালোবাসবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আমার রণ কিছুতেই বিয়ে করতে চায়নি তোমাকে। কি কুক্ষণে তোমার মায়ায় পড়েছিলাম। ছেলেটাকে বাধ্য করলাম বিয়ে করতে। ছেলেকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে তোমার সাথে বিয়ে দিলাম এখন ঘরের মধ্যে শত্রুর বাস। আমার ছেলেটার জীবন আমি নিজ হাতে আরেকজনের হাতে সঁপে দিয়েছি। মা হয়ে এই দুঃখ কোথায় রাখি।”
শুভ্রা নিশ্চুপ বসে থাকে। সে এতোটাই অবাক জলির আচরণে যে কোন কথাই মাথায় আসছে না। নিজেকে কেমম বোকা বোকা লাগে। জলি হঠাৎ পাল্টে গেলো কেন? সেদিন পর্যম্ত তো ঠিকই ছিলো। আজ শুভ্রাকে বিশ্বাস করছে না কেন? শুভ্রা নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো-“আন্টি, আপনি কেন এসব উল্টোপাল্টা বলছেন? কি করেছি আমি?”
জলি প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়ায়-“আর সাধু সেজো না মেয়ে। তোমার ভাইয়ের কীর্তি দেখে ফেলেছি আমি। এবার নিশ্চয়ই তোমার বাবা তোমার উপর দায়িত্ব দিয়েছে আমার ছেলেকে মেরে ফেলার? জেনে রাখো এমনটা করার সুযোগ তুমি কিছুতেই পাবে না। আমি যেমন নিজ থেকে তোমাকে আমার ছেলের জীবনে এনেছিলাম ঠিক তেমন করে তোমাকে ওর জীবন থেকে দূরে ঠেলে দেব। আমার ছেলের জীবন নিয়ে আর কাউকে খেলার সুযোগ দেব না। বুঝলে মেয়ে?”
জলি উঠে চলে গেলো। শুভ্রা ঠায় বসে রইলো টেবিলে। এসব কি কি বলে গেলো আন্টি ওকে! নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। পেটে খিদে থাকলেও মুখে রুচি নেই। নাস্তা করার ইচ্ছেই উবে গেছে। শুভ্রা প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। মাথা ফাঁকা লাগছে। বুক ঠেলে কান্না উগলে আসছে। রণর শর্ত মেনে মনে মনে বাবার বাড়ি থেকে চিরবিদায় নিয়ে এখানে এসেছে। এখন এখানে এমন উল্টো পাল্টা শুনে মাথা ঘুরছে ওর। কি হচ্ছে ওর সাথে এসব? কোন গোলকধাঁধার চক্করে পড়ে গেছে সে? ভালো লাগছে না কিচ্ছু। শুভ্রার হঠাৎ উথালপাথাল কান্না এলো। সে ছুটে রুমে ঢুকে বিছানায় আছড়ে পড়ে হুহু কান্নায় ভেঙে পড়লো।
রণ আজ অন্যদিনের চেয়ে কিছুটা আগেভাগেই বাড়ি ফিরেছে। মনে ক্ষীন আশা আজ শুভ্রাকে দেখতে পাবে। মেয়েটার সাথে খুনসুটি বেশ মজা লাগে রণর। কিন্তু বাসায় ঢুকে মনে হলো শত্রু শিবিরের দূর্গে ঢুকেছে। এতো নিরব হয়ে আছে বাড়ি। সাধারণত শুভ্রা বাসায় থাকলে হাসিখুশিও আনন্দে থাকে। কিন্তু আজ যেন সবাই চুপচাপ। মায়ের সাথে দেখা করে নিজের কামরায় ফিরলো রণ। ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। বাতি জ্বালাতেই দেখলো শুভ্রা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। হাতটা চোখের উপর রাখা। পুরো মুখটা দেখা যাচ্ছে না। রণ বিস্মিত হলো। শুভ্রা ইদানীং তার জন্য জেগে থাকত। আর আজ তো আরও ঘুমানোর কথা না। কেন ঘুমিয়ে পড়লো। রণর মন চাইলো ওকে ডেকে তুলতে। কিন্তু শুভ্রা যদি আবার রাগ করে এই ভয়ে ডাকলো না। উল্টো পায়ের কাছে রাখা চাদরটা ওর গায়ের উপর টেনে দিয়ে দীর্ঘশ্বাষ ফেলে উঠে দাঁড়ায়। কোথায় ভেবেছিল আজ শুভ্রাকে জ্বালাবে কিন্তু না ম্যাডাম ঘুমিয়ে গেছেন।
শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখলো শুভ্রা বিছানায় উঠে বসেছে। ওকে দেখে ঘুমঘুম চোখে একবার তাকালেও কোন কথা বললো না। রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো। কিছু কি হয়েছে শুভ্রার? কথা বলছে না কেন ওর সাথে? রণ এগিয়ে শুভ্রার কাছাকাছি দাঁড়ায়-“কখন এসেছেন?”
তবুও জবাব দেয় না শুভ্রা। ঘোলাটে দৃষ্টিতে রণর দেখছে যেন ওকে চিনতে পারছে না। রণ টের পেলো শুভ্রার গালে শুকনো জলের রেখা। মেয়েটা ঘুমানোর আগে কাঁদছিল নাকি? শর্ত অনুযায়ী আর বাড়ি যাওয়া হবে না শুভ্রার এই ভেবেই কাঁদছিল কি? মন বিগলীত হলো রণর, শুভ্রার কাছাকাছি এসে বসলো-“কি হয়েছে শুভ্রা? কথা বলছেন না কেন?”
শুভ্রা কিছু না বলে মাথা নাড়লো। রণ অস্থির হয়ে উঠলো-“আরে হলো কি আপনার? কথা বলছেন না কেন? সারাদিন কাজ করে বাসায় এসে কি একটু শান্তি পাবো না? কি চাইছেনটা কি আপনি? কি হয়েছে বলবেন তো?”
“আন্টি আন্টি আজকে…”
শুভ্রার গলা কেঁপে উঠলো। আবারও কান্না পাচ্ছে তার, কথা আঁটকে আসছে। জলির বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। কেন ওসব বললো আন্টি? রণ শুভ্রাকে দেখে বিস্মিত হয়ে-“মা! মা কি করেছে? সে তো ঠিক আছে দেখলাম।”
শুভ্রার চোখ ছলছল হয়। সে রণর মুখের দিকে তাকায়। ঠোঁট দু’টো চেপে আছে। রণ বিরক্ত হয়ে বললো-“কাঁদছেন কেন? বাড়ি ছেড়ে আসার প্রথমদিনই এই অবস্থা? তাহলে বাকী দিনগুলো কিভাবে কাটাবেন?”
বলতে বলতে হেসে দিলো রণ। শুভ্রা এবার অদ্ভুত একটা কাজ করলো। রণকে ভীষণ রকম চমকে দিয়ে আচমকা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।
চলবে—
©Farhana_Yesmin