দমকা হাওয়া পর্ব-১০

0
632

#দমকা_হাওয়া
#ঝিনুক_চৌধুরী
#পর্ব-১০

সকালে ঘুম ভাঙলে চোখ মেলতে ইচ্ছে করে না পিউর। বলা যায় না আজ আবার সরি বলে কিনা স্বচ্ছ। দেখা গেল পা ধরে ঝুলে আছে।
এক চোখ খুলে দেখে স্বচ্ছ মুখোমুখি বসে আছে ওরই দিকে চেয়ে। পিউ ঝটপট চোখ বন্ধ করে ফেলে।
–পিউ ওঠো। ঘুমোনোর অভিনয় করার দরকার নেই।
খুব স্বাভাবিক ভাবে আড়মোড়া ভেঙে হেলেদুলে ওঠে পিউ। যেন গতরাতে কি হয়েছে কিছুই মনে নেই তার।
স্বচ্ছ ভরাট কণ্ঠে বলে, সুপ্রভাত!
পিউ থতমত খেয়ে বলে, কী?
-বললাম, সুপ্রভাত! রাতে ভালো ঘুম হয়েছে?
চোরের মতো মুখ করে ওয়াশরুমে পালায় পিউ। স্বচ্ছর ওভার কনফিডেন্সের কারণ খুঁজে পায় না।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে চমকে ওঠে। স্বচ্ছ এখনও চেয়ারে বসা, মিটমিট করে হাসছে।
পিউ পাশ কাটিয়ে বের হতে নিলে পথ আটকে দাঁড়ায়।
–তুমি গতকাল কাকে বলেছিলে আমি তিমি মাছ?
–ন..নয়নকে।
–তিমি মাছ যখন পছন্দ না তখন হাঙর হয়ে দেখাবো। সামলাতে পারবে তো?
পিউ নির্বিকার থাকার চেষ্টা করে কিন্তু ফিক করে হাসি বেরিয়ে পড়ে।
খাবার টেবিলে স্বচ্ছ মুচকি হাসি হাসে। পিউর গাল বার বার রং বদলায়।
মিজান সাহেব জেসমিন আরাকে ইশারায় বোঝান, দেখো, সব ঠিক আছে।
জেসমিন আরা গল্প তুলেন রুবিনা ও দিলু ফুপির। দুজনকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। দিলু কত ধীরস্থির মহিলা। তার একমাত্র মেয়ে জামাইসহ সুইডেনে আছে অথচ তিনি পিউর কাছেই রয়ে গেছেন। ওদিকে রুবিনা কত স্মার্ট মহিলা। পিউর প্রতি কী গভীর মায়া! পিউর পড়াশোনার দেখভাল করেছেন নিজ দায়িত্বে।
জেসমিন আরা বলেন, শুধু মাত্র মা হতে পারেনি বলে রুবিনাকে তার স্বামী ছেড়ে দিল? মানুষ কত পাষাণ হয়!
–মা, দিলু ফুপি আর আমি মিলে একটা প্ল্যান করেছি। আমরা রুবিনা ফুপিকে আবার বিয়ে দেবো।
–তাই নাকি? এটা তো খুবই ভালো খবর। রুবিনা জানে? কার সাথে দিবে, পাত্র দেখেছো?
–হ্যাঁ, আব্বুর সাথে বিয়ে দেব।
ডাইনিংয়ে বসা বাকি তিনজন খাওয়া থামিয়ে হা হয়ে পিউর দিকে তাকায়।
জেসমিন আরা বলেন, সব কিছু এতো সোজা নাকি? তুমি ঠিক করলেই হবে? তোমার আব্বু রুবিনাকে পছন্দ করেন? মানে ওভাবে পছন্দ করেন ?
-তা জানি না। কিন্তু আব্বুকে ম্যানেজ করতে হবে।আমার বিয়ে হয়েছে। আমি এখন এখানে থাকবো। দিলু ফুপির নাতি হয়েছে। তার মন চায় মেয়ের কাছে বেড়াতে যেতে। রুবিনা ফুপি কোথায় যাবে। তার তো কেউ নেই। আব্বুরও কেউ নেই। দুজন কেউ নেই মানুষ এক হয়ে যাবে। তারা তো একসাথে অফিস করে, মিটিং করে, যে কোনো সিদ্ধান্তে একমত হয় তাহলে বিয়ে করলে দোষ কি?
স্বচ্ছ বলল, তুমি যেভাবে হিসেব কষছো তারা হয়তো সেভাবে ভাবছেও না।
— তাদেরকে ভাবাতে হবে।
জেসমিন আরা বলেন, তুমি বললেই তো হবে না। কে তাদের সাথে আলাপ করবে?
–কেন,আপনারা করবেন?
মিজান সাহেবের গলায় খাবার আটকে খেক খেক করে কেঁশে ওঠেন।
জেসমিন আরা হা হয়ে পিউর দিকে চেয়ে বলেন,আমরা কেন রাজি করাবো? মাত্র দুদিন হলো আত্মীয় হয়েছি, তোমার আব্বু কি ভাববেন আমাদের?
মিজান সাহেব হেসে বলেন, না না দরকার হলে রাজি করাবো। জেসমিন, উনি তোমার বড় ভাইয়ের মতো। ভাই কি সারা জীবন এভাবে একা কাটাবে? অন্যের হাত ধরে কান্নাকাটি করবে? তারচেয়ে নিজের একজন জীবন সঙ্গী থাকা উচিত। জীবনটা পরিপূর্ণ হবে সাথে আমার টেনশনও থাকবে না। কি বলো পিউ?
পিউ দাঁত বের করে হাসে। আব্বু আপনি অনেক ভালো!
জেসমিন আরা মুখ বাঁকিয়ে বলেন, তা তো ভালোই। তোমার আব্বুর একাকী জীবন দেখে কত দুঃখিত তোমার এই নতুন আব্বু। আচ্ছা, ভাই সাহেব বলল ছেলেটা কি যেন নাম নয়ন, সে নাকি তোমার বেস্ট ফ্রেণ্ড ছিল, তাহলে বিয়ের দিন পালালো কেন? ওকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছিল কি?
পিউ খালি প্লেটে আঙুল ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে চোর গলায় বলল, ও আসলে একজনকে ভালোবাসে।
-তুমি জানতে? তাহলে তুমিই বা বিয়ে করতে চাইলে কেন?
পিউ ঢোঁক গিলে বলল, আমি জানতাম না। কেউ জানতো না। ও যাকে ভালোবাসে তাকে কেউ মেনে নেবে না।
জেসমিন আরা বলেন, কেন? এযুগে প্রেম ভালোবাসা তো সবাই করে। মেনে না নেয়ার কি আছে? মেয়েরা কি ভিন্ন ধর্মের ?
–ও…. আসলে….. ও….মেয়ে নয়।
ওমনি স্বচ্ছ খাবি খেয়ে খুক খুক করে কাঁশতে থাকে।
মিজান সাহেব বড় বড় চোখে পিউর দিকে তাকায়।
জেসমিন আরা বলেন, কে মেয়ে নয়?
পিউ বলে, নয়নের প্রেমের শুরু দেশের বাইরে পড়তে গিয়ে। ওখানের কালচার তো জানেন। কতশত মেয়ে, সকলের সাথেই কত মেলামেশা! কিন্তু নয়নের পছন্দে কোনো মেয়ে না এসে ছেলে এসেছে। নয়ন পুরোই অবসেসড ওকে নিয়ে। বিয়ে করলে ওকেই করবে, সংসার করলে ওর সাথেই করবে, বাচ্চার বাপ হলে ওর …..
স্বচ্ছর সাথে এবার মিজান সাহেবও কাঁশতে শুরু করেন। বাপ ছেলে খুক খুক করে বেতালে কেঁশেই যাচ্ছে।
জেসমিন আরা বিরক্তি মুখে দুজনকে পানি এগিয়ে দিয়ে বলেন, এতো কাঁশির কি হলো? তোমাদের ধারণা আমি বিশ্ব জ্ঞান রাখি না? এখন যে এসব ঢং বিশ্ব বাজারে চলছে জানি না?
মিজান সাহেব পানি খেয়ে হাঁপাতে থাকেন। অভিনয় করে কাঁশতে গিয়ে শরীরের এনার্জি নষ্ট হয়েছে তবু বউ শাশুড়ীর প্যাচপ্যাচানী বন্ধ হচ্ছে না। কে সামনে আছে, কি বিষয়ে কথা হচ্ছে, তাদের কোনো যায় আসে না।
স্বচ্ছ পিউর কনুই ধরে ঝাঁকাতে থাকে চুপ করার জন্য। কে শুনে কার কথা।
মিজান সাহেন বলেন, মামনি, থামো এবার। সব কথা সবার সামনে বলতে নেই রে মা। তোমার শাশুড়ী তোমার বন্ধু হয়েছে, ভালো কথা। তাকে আলাদাভাবে ডেকে তোমার ঠাকুরমার ঝুলি শোনাও। কোনো অসুবিধা নেই। এখন থামো প্লিজ।
__________
স্বচ্ছ পিউ ড্রইং রুমে বসে কুট কুট গল্প করছে, খুনসুটি করছে। জেসমিন আরা কিচেন থেকে আধো আধো শুনতে পাচ্ছেন। মাত্র তিনজন মানুষ, ইচ্ছা না থাকলেও কথা কানে আসে। শুনতে মন্দ লাগছে না।
এক ফাঁকে কাঁচা আম কেটে দিয়ে আসলেন দুজনকে। পিউ খেল না, বলল, পেট ব্যাথা করছে।

_______
পিউকে টিপনি কেটে স্বচ্ছ বলল, তুমি গতকাল বললে নয়ন সম্পর্কে জানলে আমি তাকে খুশিতে জড়িয়ে ধরবো। আজ বলছো নয়ন মেয়ে নয় ছেলে পছন্দ করে। এমন একটা ছেলেকে আমি জড়িয়ে ধরবো? তোমার মাথা ঠিক আছে?
-আছে? তুমি ঠিক নয়নকে জড়িয়ে ধরবে।
-জীবনেও না। জড়িয়ে ধরার প্রশ্নই আসে না। ছিঃ!
-দেখে নিও। আমি যা বললাম তাই হবে।

দুপুরের খাওয়া শেষে জেসমিন আরা শুনতে পান পিউ স্বচ্ছকে বলছে, বিকালে ফার্মেসী যেও।
স্বচ্ছ মোবাইলে কি যেন মনোযোগ দিয়ে দেখছে। কিছু না বুঝেই হু বলল।
জেসমিন আরা স্পষ্ট বুঝলেন পিউ কেন যেতে বলেছে। কিন্তু স্বচ্ছ গাধাটাই বুঝেই নি।
সকালে পেট ব্যাথা করছিল পিউর। নিশ্চয়ই পিরিয়ড হয়েছে বা হবে।

পিউর কাছ থেকে স্বচ্ছ সরে গেলে জেসমিন আরা সুযোগ পেয়ে পিউর কাছে এগিয়ে আসেন। নিচু সুরে বলেন, আমি একটু পর বাইরে যাবো। তোমার কিছু আনতে হবে ?
–না মা।
-থাকলে বলো আমি নিয়ে আসবো।
– না মা, কিছু লাগবে না।
– আহা, লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ফার্মেসী থেকে এনে দেবো আমি। নাম কি বলো?
পিউ স্বচ্ছর দিকে তাকালো। স্বচ্ছ ডাইনিংয়ে দাঁড়িয়ে পানি খাচ্ছে। এদিকে মনোযোগ নেই।
পিউ বলল, না মা কিছু লাগবে না।
-আহা পিউ, লজ্জার কিছু নেই। আমি শাশুড়ী বলে লজ্জা পাওয়া লাগবে না। আমি তো তোমার মা এখন। তুমি নাম বল, আমি নিয়ে আসছি। আমারটা মাঝে মাঝে স্বচ্ছ এনে দিত। আমি ওকে বুঝিয়েছি, এটা প্রকৃতির নিয়ম।
পিউ হা হয়ে বলে, স্বচ্ছ এনে দিত?
— হ্যাঁ। মাঝে মাঝেই আনতো। এটা লুকানোর কিছু নেই।
তুমি নাম বল।
–মা, আমি তো নাম জানি না।
–নাম জানো না মানে?
–মানে আগে তো ইউজ করি নি। নাম জানবো কি করে। বিয়ের আগে খামাখা নাম জেনে কি করবো?
দূর থেকেই পিউর কথা শুনে স্বচ্ছর কান লাল হয়ে ওঠে। ঘটনা কোন দিকে গড়াচ্ছে তা বুঝে কাঁশতে শুরু করে। মাকে থামাবে নাকি পিউকে থামাবে বুঝে উঠতে পারে না।
জেসমিন আরা বিরক্ত চোখে স্বচ্ছর দিকে তাকায়। সারাক্ষণ খুকখুক কাঁশিস কেন, কি সমস্যা তোর?
পিউর দিকে ফিরে তিনি বলেন, পিউ এতোটা দায়িত্বহীন হওয়া তো ঠিক নয়। সব কি তোমার ফুপিরা সামলাবে? নিজের ব্যক্তিগত জিনিস গুলো ….
–না না মা, ওরা কেন সামলাবে? ওটা তো স্বচ্ছর দায়িত্ব।
আসন্ন বিপদ বুঝে স্বচ্ছ দ্রুত পা চালিয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটল কিন্তু চেয়ারে পা আটকে উপুত হয়ে পড়ল। চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো।
এদিকে পিউ বলে চলল, আমি দায়িত্বহীন নই মা। আমি অনেক দায়িত্বশীল তাই তো স্বচ্ছকে কিনতে বলেছি। স্বচ্ছ এখনো ছাত্র, আমিও এখন মা হওয়ার জন্য প্রস্তত নই। প্রোটেকশন কেনা জরুরি। এই দায়িত্ব তো স্বচ্ছর, আর নাম কিভাবে জানবো, ব্যবহার না করলে…..
স্বচ্ছ উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়েছে। হামাগুড়ি দিয়েই কোনোরকমে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকালো।
পিউ মায়ের দিকে মুখ তুলে চেয়ে দেখে সেখানে কেউ নেই। সে একাই কথা বলছে।

জেসমিন আরা নিজের রুমের দরজা আটকে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। নিজের গালে দুটো চড় দিলেন। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে। মিজান জানলে নির্ঘাত হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে। কেন আগ বাড়িয়ে এতোটা বোকা বনতে গেল! মিজান বার বার মানা করেছে স্বামী স্ত্রীর মাঝে নাক গলাতে না। কেন কথাটার মূল্য দিল না? কি বোকামীটা হলো এবার! এখন স্বচ্ছর সামনে কি করে দাঁড়াবে? ইস, আজকের দিনটা যদি তারিখ থেকে নিখোঁজ হয়ে যেত!
মা-বেটা দুজনই দীর্ঘ সময় রুম থেকে বের হচ্ছে না। পিউ একবার ভাবে মায়ের রুমে যাবে। বলবে মা এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে! আমি কিছু মনে করি নি।

মত পালটে নিজের রুমে ঢুকতেই স্বচ্ছ তেড়ে এলো।
— এটা তুমি কি করলে? এভাবে কেউ শাশুড়ীকে বলে? মিনিমাম লাজ লজ্জা নেই?
— আশ্চর্য! আমি কী করেছি? মা ই বার বার বলছিল নাম বল, নাম বল। আমি কী নাম জানি?
— তুমি কথাটা ঘুরাতে পারতে।
— আমি তো মাকে কিছু বলিনি। তোমাকে বলেছিলাম কিনতে মা বলল লজ্জার কিছু নাই। এসব প্রকৃতির নিয়ম।
— পিউ, আম্মু মেয়েদের পিরিয়ডের কথা ভেবেছে আর তুমি…
— আমি কি করে বুঝবো? তুমি আমাকে রাগ দেখাছো কেন? তুমি একটা নষ্ট ছেলে!
— কি? আমি নষ্ট ছেলে?
— হ্যাঁ! আর একবার যদি আমার কাছে এসেছো তাহলে হাড্ডি গুড়ো করে কবুতরকে খাইয়ে দিবো বলে দিলাম।
স্বচ্ছর হাসি চলে আসে। তুমি পুরাই একটা কার্টুন।
–হ্যাঁ আমি কার্টুন। আমাকে দেখে হি হি করে হাসো।
পিউর কমোড় জড়িয়ে কাছে টেনে আনে স্বচ্ছ। বলে, হাসবো না ভালোবাসবো।
-না, ছাড়ো, ফালতু ছেলে, মাকে বলে দিবো।
স্বচ্ছ হেসে বলে, যাও বলে দাও। বাকি রেখেছো কিছু বলার? অস্থির ঠোঁটে গভীর চুমু খেয়ে বলে, যাও এবার গিয়ে বল, মা, স্বচ্ছ আমাকে চুমু খেয়েছে।
পিউ ধাক্কা দিয়ে সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বলে, তুমি আসলেই একটা নষ্ট ছেলে।
-তাই না? নিজে কি? শাশুড়ীর চামচী! বলো গিয়ে, মা আপনার ছেলে একটা নষ্ট ছেলে!
-বলবোই তো। পিউ থপ থপ শব্দ তুলে জেসমিন আরার রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
পেছন ফিরে দেখে বেয়াদব ছেলে ইশারায় বলছে থামলে কেন, যাও?
অসহায় চোখে জেসমিন আরার বন্ধ দরজার দিকে তাকায় আবার স্বচ্ছর দিকে তাকায়।
বেয়াদব ছেলেটা দুষ্ট হেসে এবার কাছে ডাকছে।

চলবে।।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে