ত্রিভুজ প্রেম পর্ব – ২০

0
1301

ত্রিভুজ প্রেম
জান্নাতুল ফেরদৌস সূচনা
পর্বঃ২০

বরযাত্রী সবাই গাড়িতে ওঠে পড়েছে, শুধু পুষ্প বাকি। গাড়ির সামনে পুষ্প এক এক করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। চারপাশে ভিড় জমে গেছে। পুষ্প আফিয়া বেগমের কাছে যেতেই মা মেয়ে কান্না শুরু করে দিলো। পুষ্প কাঁদতে কাঁদতে বলছে
– মা, পাপড়ির সাথে একবার দেখা করে যেতে পারলাম না।
হঠাৎ দাদী চিৎকার দিয়ে বলে ওঠলো
– পুষ্প, পাপড়ি চলে এসেছে।
পুষ্প কথাটা শুনতেই পাগলের মতো ভিড়ের মধ্যে পাপড়িকে খুজতে থাকে।

রিকশা থেকে এক লাফে নেমে পাপড়ি আর নীল চারপাশের ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকছে। পাপড়িকে দেখে পুষ্প পাপড়িকে একদম জড়িয়ে ধরে দুবোন কাঁদতে লাগলো। পাপড়ি কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-আপু, তুই চলে যাচ্ছিস? তোকে ছাড়া যে আমি একদম থাকতে পারবো না। তোর সাথে আমার অনেক কথা বলার এখনো বাকি আছে। তুই চলে গেলে আমাকে কে বকবে? কে শাসন করবে? কার সাথে আমি ঝগড়া করবো?
– আমি চলে গেলে তো ভালোই হবে তোর জন্য। কেউ তোকে বকবে না, ঝগড়া করবে না, শাসন করবে না। কারো সাথে রুমটা আর শেয়ার করতে হবে না। মা দাদী এখন তোকে বেশি আদর করবে।
– না আপু, আমার কিছু লাগবে না। তুই শুধু আমাকে ছেড়ে যাস নে।
– যেতে তো আমাকে হবেই। তুই মা দাদীর খেয়াল রাখিস।  দুজনে যেন ঔষধগুলো ঠিক মতো খায় সেসবের খেয়াল রাখিস। আমি সবকিছুর দায়িত্ব তোকে দিয়ে যাচ্ছি।

রাইয়ান গাড়ির গ্লাস নামিয়ে পাপড়িকে দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু চারপাশের ভিড়ের জন্য পাপড়ির চেহেরাটা দেখতে পারছে না। শুধু পাপড়ির কন্ঠটা তার পরিচিত মনে হচ্ছে।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

পুষ্প পাপড়িকে ছেড়ে এবার নীলকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– নীল, আমার বোনটার দায়িত্ব আমি তোকে দিয়ে যাচ্ছি। ওর ঠিক মতো খেয়াল রাখিস।ওর সাথে কম ঝগড়া করিস।
পুষ্পের এসব কথার গভীরতা কেউ না বুজলেও নীল ঠিকই বুজেছে। কারণ পুষ্প তো নীলের পাপড়ির প্রতি তার অনুভূতি গুলোর খবর জানে। পাপড়িকে যে নীল কতটা ভালোবাসে সেটা আর কেউ না বুজলেও পুষ্প ঠিকই বুঝে গেছে অনেক আগে।
পুষ্পর কথা শুনে নীল বললো,
– তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি সবার খেয়াল রাখবো। তোর এই ভাইটার ওপর ভরসা রাখিস চিরদিন।
বলেই পুষ্পকে নীল ধরে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়।
আর গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি স্টাট দিয়ে চালাতে শুরু করে।

– কিভাবে পারলে তোমরা, আমাকে ছাড়া আপুর বিয়েটা এভাবে দিয়ে দিতে? আমাকে কি তোমরা এ পরিবারের কোন সদস্যই মনে করো নাহ?
পাপড়ি এমন কথা শুনে মা দাদী দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
– কি হলো, কোনো কথা বলছো না কেন? আমি থাকলে কি বিয়ে ভেঙে দিতাম যে আমাকে ছাড়াই আপুর বিয়েটা এভাবে দিয়ে দিলে? আমার কথাটা একবার চিন্তা করলে না? মানলাম আপু বিয়ে করতে রাজি ছিলো না, তাই বলে ভালো সমন্ধ এসেছে আর তোমরা জটপট বিয়ে দিয়ে দিলে? ছেলের সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর না নিয়েই বিয়ে দিয়ে দিলে? এতো কিসের তাড়াহুড়ো ছিলো তোমাদের আপুর বিয়ে নিয়ে যে আমার আসার অপেক্ষাও করলে নাহ?

পাপড়ির এসব প্রশ্নের উত্তর আফিয়া বেগম দিতে পারবে না, তাই নিরবে কান্না করতে করতে তার রুমে চলে গেলো। হঠাৎ দাদী বলল ওঠলো,
– আহ! এতো রাগ হচ্ছিস কেনো? কোন কারণ ছাড়া তো বিয়েটা এতো তাড়াতাড়ি দেই নি। একটু শান্ত হ। আমি তোকে সব খুলে বলছি।

বাড়ির ভিতর গাড়ি প্রবেশ করতেই গাড়ি থেকে জলদি নেমেই বাড়ির ভিতর যেতে লাগলো মিসেস মাহমুদা। পেছন থেকে তার হাতটি ধরে মি. রাশেদ বললো
– কোথায় যাচ্ছো? বউমাকে বরণ করবে নাহ?
– কিসের বউমা? আমি ঐ মেয়েকে কখনো বউ হিসেবে মেনে নিবো না। আর আমার ছেলের কথা রাখতে শুরু এ বিয়েতে এন্টেট করেছি তাই বলে ভেবে নিও না আমি আমার কথা ভুলে গেছি। আমি আর কোন কিছুতেই এন্টেট করছি না।(রেগে)
বলেই নিজের হাতটা ছাড়িয়ে হনহনিয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেলো মিসেস মাহমুদা।

মি. রাশেদ মুখটা কালো করে গাড়ি থেকে নেমে তার মেয়ে নুরীকে বললো
-বউমাকে তুমি বরণ করবে নুরী। যাও সবকিছু রেডি করো।
– কিন্তু বাবা…
– যা বলেছি, তাই করো যাও।

শায়ন পুষ্প আর রাইয়ানকে গাড়ি থেকে নামিয়ে বাসার সামনে নিয়ে যাচ্ছে। নুরী তাদের বরণ করে বাড়ীর ভিতরে নিয়ে গেল। পুষ্প চারপাশ তাকিয়ে দেখলো বিশাল বড় তার শ্বশুরবাড়ি। সবকিছুই সাজানো গোছানো।
পুষ্পকে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়েই সবার আগে রাইয়ানের দাদা রুমে নিয়ে যায় মি. রাশেদ। রুমে নিয়ে পুষ্পকে রাইয়ানের দাদার সামনে বসিয়ে মি. রাশেদ বললো,
-দেখো বাবা, তোমার নাতবৌকে নিয়ে এসেছি।
রাইয়ান দাদাভাই পুষ্প তাকিয়ে হেসে ওঠে পুষ্পের মাথায় হাত রেখে বললো
– এ আমার নাতবৌ?
পুষ্প ওঠে দাদার পায়ে ধরে সালাম করে। পুষ্প দেখে দাদার চোখের কোনে পানি জমে যায় আর বলে
– আজ আমার আর কোন কষ্ট নেই। এখন আমি নিশ্চিন্তে আমার চোখ দুটো বন্ধ করতে পারবো।
রাইয়ান বললো,
– এসব কি বলছো দাদাভাই? তুমি আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবে না।
রাইয়ান কথা শুনে দাদাভাই রাইয়ানকে কাছে ডেকে বললো,
– ওর দায়িত্বটা ঠিকমতো নিবি দাদাভাই। আমার নাতবৌকে কোন কষ্ট দিবি না। ওকে অনেক ভালোবাসবি।
-হ্যা বাবা, সে তো রাইয়ানকে নিতেই হবে। এখন সবাই নিজ নিজ রুমে যাও। বাবা তুমিও একটু বিশ্রাম নাও।

মি. রাশেদের কথা শুনে সেখানে উপস্থিত সবাই নিজ নিজ রুমে যেতে লাগলো।

দাদীর কাছ থেকে বরের সব বিরবণ শুনে পাপড়ি একদম অবাক হয়ে রইল। তার মনে একটা ভয় কাজ করতে শুরু করছে। মনে মনে বারবার বলতে লাগলো
– আমি যা ভাবছি তা যেন কোনদিনও না হয়। এমনটা হলে আমার সব শেষ হয়ে যাবে।
আপুর বরটাকে একবার দেখতে পারলে সবকিছু একবার ক্লেয়ার হয়ে যেতো।

রাইয়ানের রুমে খাটের মাঝে ঘোমটা টেনে চুপচাপ বসে আছে পুষ্প। এতোক্ষণ মেকাপ,গয়নাগাটি আর শাড়ির ভারে খুব অস্থির লাগছিলো তার। কিন্তু চেঞ্জ করে এখন খুব ভালো লাগছে পুষ্পর। খুব ক্লান্ত সে।
হঠাৎ দরজা খুলার আওয়াজ। রাইয়ান রুমে ভিতরে ডুকেছে। রাইয়ানকে দেখে মায়ের কথা মতো সালাম করতে এগিয়ে যায় পুষ্প। রাইয়ান পুষ্প বাধা দিয়ে বললো,
– সালামের দরকার নেই। আমি তোমার থেকে খুব একটা বয়সে বড় না।
রাইয়ান পুষ্পর কাছে গিয়ে বসে বললো,
-আসলে কিভাবে কথা শুরু করবো বুঝে পাচ্ছি না। অফিসে প্রথমদিন তোমাকে দেখেই আমার খুব ভালো লেগেছিলো। তোমার ব্যবহার-আচরণ সব কিছুতেই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।
রাইয়ানের এসব কথা শুনে পুষ্প খুব আশ্চর্য হচ্ছে। মনে মনে বলছে,
– অফিসে কখন দেখলো আমায়? আমি তো এনাকে আজই প্রথম দেখছি? কার কথা বলছেন ওনি?
পুষ্পকে কিছু বলতে না দেখে রাইয়ান বললো,
– কি হলো কিছু বলছো না যে? আমি ভাবতাম হয়তো আমারি একটু লজ্জা বেশি। কিন্তু এখন তো দেখছি আমার থেকে তুমিই বেশি লজ্জা পাচ্ছো। অফিসে তো আগে কখনো এতটা লজ্জা পেতে দেখে নি তোমায়?

পুষ্প আর থাকতে না পেরে ঘোমটা ওঠিয়ে বললো,
– আপনি এসব কি বলছেন? আমি তো কিছুই বুজছি না। আমি আপনার অফিসে গেলাম কখন? আমি তো আজই প্রথম দেখছি আপনাকে। আপনার নামটাও তো আমি এখনো জানি না।
রাইয়ান আশ্চর্য হয়ে বললো,
-এসব কি বলছো? তুমি কি সব ভুলে গেলে নাকি? তুমি আমার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে অফিসে কাজ করতে। আমি তোমার বস রাইয়ান চৌধুরী, চৌধুরী গ্রুপস অফ কোম্পানির মালিক।
রাইয়ান কথা শুনে এতোক্ষণে সব বুজতে পারলো পুষ্প। সব শুনে এখন ভয় পেতে লাগলো সে। আমতা আমতা করে বললো,
– আপনি যাকে অফিসে দেখেছেন সে আমি নই, সে আমার যমজ বোন পাপড়ি।
কথাটা শুনতেই রাইয়ানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সে কিছুই বুজতে পারছে না সে।
– এসব কি বলছো তুমি পুষ্প? আমি তো কিছুই বুজতে পারছি না।
পুষ্প রাইয়ানকে সব খুলে বললো।

পুষ্প কাছ থেকে সব শুনে রাইয়ান নির্বাক হয়ে গেলো। কাছ থেকে পুষ্পকে দেখে চেহেরার পার্থক্যটা এখন বুঝতে পারছে সে।আর কিছু না বলেই সে রুম থেকে হনহনিয়ে চলে গেলো। পুষ্প রাইয়ানকে ডাক দিতে চেয়েও ডাক দিতে পারলো না। বসে বসে কাঁদতে লাগলো।

রাতে কিছুতেই ঘুম হচ্ছে না পাপড়ির। এক চিন্তায় তার মাথায় ঘুরছে। ওপরওয়ালার কাছে বারবার প্রার্থনা করছে যা সে ভাবছে তা যেন সত্যি না হয়।

সকাল হতেই বাড়ি ফিরে রাইয়ান। সারারাত বাহিরেই কাটিয়েছে সে। সকালে রাইয়ানকে বাহির থেকে আসতে দেখে মিসেস মাহমুদা সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
– কি ব্যাপার রাইয়ান, এতো সকালে কোথায় থেকে আসছো? দেখে তো মনে হচ্ছে সারারাত বাহিরেই ছিলে। নিজের পছন্দে বিয়ে করার পর সারারাত বাহিরে থাকার কারনটা জানতে চাচ্ছি?
মায়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে সে বললো,
– মা সবাইকে ৫ মিনিটের মধ্যে নিচে আসতে বলো। সবার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
বলেই রাইয়ান হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

সারারাত পুষ্পও ঘুমায় নি। এখনো খাটের মাঝখানে বসে কাঁদছে সে। রাইয়ানকে আসতে দেখে চমকে ওঠে সে। রাইয়ান তার দিকে এগিয়ে এসেই তার হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নিয়ে গেল। পুষ্পকে রাইয়ান এভাবে টানতে দেখে নিচের সবাই অবাক। মি. রাশেদ রেগে বললো,
– কি করছো কি তুমি? নতুন বউয়ের সাথে এমন আচরণ কেনো করেছো রাইয়ান?
রাইয়ান রেগে বললো,
– এই মেয়ে সেই মেয়ে নয় যাকে আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। এ তার যমজ বোন। আমাদের সাথে অনেক বড় ধোঁকা হয়েছে বাবা।
– এসব কি বলছো তুমি আমি তো কিছুই বুজতে পারছি না।
রাইয়ান সবাইকে সব খুলে বললো।

সারারাত ঘুম হয়নি পাপড়ির। চিন্তায় মাথাটাও তার ধরে ওঠেছে।
-আপুর বরকে একবার না দেখলে আমার মনে শান্তি আসবে না। অফিসেও যেতে হবে। ফ্রেশ হয়ে মাকে একটু দেখে নিই। তারপর আপুকে কল করব।

রাইয়ানের কাছ থেকে সব শুনার পর সবাই অবাক হয়ে যায়। মিসেস মাহমুদা বললো,
– আমি তো প্রথম থেকেই এদের ওপর সন্দেহ  হয়েছিলো। এসব মিডিলক্লাস ফেমেলিগুলো ধনী পরিবার পেলেই তাঁদের নিজেদের জালে আটকানোর প্লেন করে বসে।
মি. রাশেদের দিকে তাকিয়ে আবার মিসেস মাহমুদা বললো,
– হলো তো শান্তি এবার। তোমার জেদের কারণে আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। রাইয়ান তুই এখুনি এই মেয়েকে ওদের বাসায় দিয়ে আয়। তোকে আমি আরো ভালো কোন মেয়ের সাথে বিয়ে দেবো। আর এই মেয়ের পরিবারকে আমি জেলে ভাত খাওয়াবো। আমাদেরকে ধোকা দেওয়া।
পুষ্প মিসেস মাহমুদার কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে হাতজোড় করে বললো,
-প্লিজ এমন করবেন না। আমার মা, দাদীর কোন দোষ নেই তারা এ সম্পর্কে কিছুই জানতো না। 
-এ্যাহ! এসব ন্যাকা কান্না দিয়ে আর আমাদের মন গলানোর চেষ্টা করো না। রাইয়ান তুই এখুনি এই মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়ে আয়।
মায়ের কথামতো রাইয়ান পুষ্পকে টানতে টানতে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টাট দেয়। তাদের পেছন পেছন গাড়িতে মি. রাশেদ ও মিসেস মাহমুদাও গেলো।

পাপড়ি ফ্রেশ হয়ে মায়ের রুমে যায়। আফিয়া বেগম এখনো ঘুমচ্ছে। তাকে ঘুমাতে দেখে পাপড়ি আর ডাক দিলো না।  আস্তে করে মায়ের ফোনটা নিয়ে বাহিরে চলে এসে পুষ্পকে কল দিতে যাবে এমন সময় দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়।
পাপড়ি দরজা খুলেই অবাক হয়ে বললো,
-স্যার আপনি?

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে