তোর ছায়ার সঙ্গী হব পর্ব-২৭

0
1421

#তোর_ছায়ার_সঙ্গী_হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২৭

৬২
গত দুইদিন ধরে যত কিছু দিয়ে বাড়িটা সাজানো হয়েছিলো সব কিছু খুলে ফেলা হচ্ছে। সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে লোকজন। ইভান সেগুলই দেখছে। আশে পাশে চোখ ফেরাতেই চোখ পড়লো ঈশার বাবা এক পাশে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে শুন্যতা। বাবার কাছে মেয়েরা একটু বেশিই আদুরে হয়। মেয়েদের বিদায় একজন বাবাকে ভিতর থেকে কতটা শুন্য করে দিতে পারে তা ইভান এই মুহূর্তে আন্দাজ করতে পারছে। সে ধির পায়ে পাশে দাড়িয়ে বলল
–বড় বাবা তোমার কি মন খারাপ?
ঈশার বাবা ভাবনায় ডুবে থাকায় একটু চমকে উঠলো। ইভানের দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে বলল
–এই বাড়িতেই আমার দুই মেয়ে বড় হয়েছে। সারা বাড়ি জুড়ে দুজনের খুনসুটি। কিন্তু আজ পুরো বাড়ি শুন্য হয়ে গেলো।
ইভান ঈশার বাবার কাধে হাত রেখে বললেন
–মন খারাপ করোনা। রিহাব খুব ভালো ছেলে। ইরা খুব সুখে থাকবে বাবা। তোমার ওকে নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না।
ঈশার বাবা তার আবেগ ধরে রাখতে পারল না। ইভান কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। ইভানও তাকে জড়িয়ে ধরল। কাদ কাদ কণ্ঠে বলল
–আজ থেকে ৬ বছর আগে আমি ঈশার বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম অন্য কোথাও। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি সেই সময় ঈশাকে নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারিনি। খুব ভয় ছিল মনের মাঝে। কিন্তু তুই যখন ঈশাকে বিয়ে করলি তখন আমি একদম নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম। আর কোনদিন ঈশাকে নিয়ে আমার মধ্যে ভয় হয়নি। তুই ওর কাছ থেকে দূরে চলে গেলি তখনও আমার একটুও ভয় হয়নি। কারন আমি জানতাম তুই যেখানেই থাক নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমার ঈশাকে ভালো রাখবি।
ইভান কে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে দাড়িয়ে বলল
–আমাকে মাফ করে দিস। আমি তোর সাথে অন্যায় করেছি। অনেক বড় অন্যায়।
কথাটা বলেই তিনি আর দাঁড়ালেন না। ইভান দাড়িয়ে দেখছে। উনি চলে যাওয়ার পর চোখ বন্ধ করে একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল
–তুমি হয়ত জাননা বড় বাবা তোমার এই কথার মানে আমার কাছে স্পষ্ট। তোমার এই অপরাধ বোধ কেন আর ঠিক কোথায় থেকে তৈরি হয়েছে তা আমার অজানা নয়। আমি এটার শেষ করেই ছাড়ব তুমি ভাবিওনা। আমি বেঁচে থাকতে কারও কোন ক্ষতি হতে দিবনা।

৬৩
হালকা ঘুমে বন্ধ থাকা চোখের উপরে মাঝে মাঝেই একটা ছায়ার মতো নড়াচড়া করছে। রিহাব একটু ভ্রু কুচকে নিয়ে পিটপিট করে তাকাল সামনে। ইরা নিজের ভেজা চুলগুলো আঁচড়াতে ব্যস্ত। কিন্তু বার বার চিরুনি সেটার গিট্টুর মাঝে আটকে যাচ্ছে। আর সে বেশ বিরক্তি নিয়ে খোলার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে চিরুনি রেখে হাত দিয়ে খোলার চেষ্টা করছে। রিহাব ঠোটের কোণে ক্ষীণ হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। এবার ইরা বিরক্ত হয়ে জোরে টানতেই একটা চুল ছিঁড়ে যায়। ব্যথায় আহ শব্দ করতেই রিহাব একটু ভারি গলায় বলে
–সব চুল কি টেনে ছিঁড়ে ফেলবে নাকি?
ইরা চমকে উঠে। পিছন ঘুরে তাকায়। রিহাবের চোখে চোখ পড়ায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আবার সামনে তাকায়। রিহাব একটু হেসে উঠে বসে। নেমে ধির পায়ে ইরার কাছে যায়। হাত থেকে চিরুনি নিয়ে বলে
–আর চিরুনি করতে হবে না।
ইরা বিরক্ত মুখে বলে
–কাল অতো গুলো কাঁটা লাগানোর পরেই চুলের এই অবস্থা হয়েছে।
রিহাব চিরুনি টা রেখে ওয়াশ রুমের দিকে যেতে যেতে গম্ভীর গলায় বলল
–কি দরকার ছিল অতো সাজগোজ করার। অতো মেকাপ খাওয়ার পরে আমি কতটুকু সুস্থ থাকতে পারব সেটা নিয়েই এখন ভাবছি।
বলেই ওয়াশ রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। ইরা চোখ বড় বড় তাকাল সেই দিকে। আর কোন কথা না বলে নিচে চলে গেলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখল তার শ্বশুর শাশুড়ি দুইজনি টেবিলে বসে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। একটু লজ্জা পেলো। দেরি করে ফেলেছে। আর একটু আগে উঠলেই এই লজ্জায় পরতে হতোনা। শাড়ীর আচলটা মাথায় টেনে দিয়ে মাথা নিচু করেই নেমে এলো। সালাম দিয়ে এক পাশে দাঁড়ালো। রিহাবের বাবা বুঝতে পারলেন মেয়েটা অস্বস্তি বোধ করছে। তাই একটু স্বাভাবিক করতে বললেন
–বস।
ইরা সামনে চেয়ারে বসে পড়লো। শান্তা নামের মেয়েটা খাবার নিয়ে এলো। রিহাবের মা উঠতে যাবে তখনি ইরা বলল
–আপনি বসেন মা। আমি দিচ্ছি।
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ালো। আর কারও কথার অপেক্ষা না করেই সবার প্লেটে খাবার দিয়ে দিলো। রিহাবের মা বলল
–তুমি বস। রিহাব কোথায়?
কথাটা কানে আসতেই কেন জানি লজ্জা ঘিরে ধরল ইরাকে।মাথা নত করে ধির কণ্ঠে বলল
–আসছে।
তাদের কথা শেষ হওয়ার আগেই রিহাব নামছে। তার মা দেখে বলল
–ওই তো এসে গেছে।
ইরা চোখ তুলে উপরে তাকাল। মেরুন রঙের একটা টি শার্ট পরে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। সামনের চুল গুলো হালকা উড়ছে। রিহাব চোখ তুলতেই ইরা চোখ নামিয়ে নিলো। ইরার পাশের চেয়ারে এসে বসলো। ইরা তার প্লেটে খাবার দিলো। রিহাব মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে। রিহাবের দিকে তাকিয়ে তার বাবা বলল
–আজকেও কি হসপিটালে যাবে?
রিহাব খেতে খেতেই বলল
–নিজের মরার আগে পর্যন্তও আমাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
তার কণ্ঠের অসহায়ত্ব শুনে বাবা মা দুজনি মুখ টিপে হাসতে লাগলো। কিছুক্ষন পর রিহাবের মা বলল
–না গেলে হয়না? খুব বেশি কাজ কি?
রিহাব একটু ভ্রু কুচকে বিরক্তি নিয়ে বলল
–বেশি না। তাড়াতাড়ি চলে আসবো।
খাবার শেষ করে ঘরে এসে রিহাব রেডি হচ্ছে। ইরা ঘরের এক কোনায় বসে একবার রিহাবের দিকে তাকাচ্ছে আবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। রিহাব কে কিছু বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারছে না। রিহাব আয়নায় তার দিকে ভালো করে দেখে নিলো। কিন্তু কিছু বলল না। কারন মেয়েটার মধ্যে এখনো জড়তা আছে। সে চায় এইসব জড়তা ইরা কাটিয়ে উঠুক। তাদের সম্পর্ক টা স্বাভাবিক হোক। তাই তার সাথে একটু অস্বাভাবিক আচরণ করছে। রিহাব এপ্রনটা হাতে নিয়ে বের হতে যাবে তখন ইরা পিছন থেকে বলল
–কখন আসবেন?
রিহাব তার কথা শুনে থেমে গেলো। একটু হেসে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে পিছনে ঘুরে বলল
–জানিনা। কেন?
ইরা ভাবেনি যে সে এমন প্রশ্ন করবে। তাই একটু অপ্রসতুত হয়ে গেলো। মাথা নামিয়ে বলল
–এমনি।
রিহাব আর কিছু না বলে চলে গেলো। নিচে নামতে নামতে ভাবল এমন আচরণ না করলে মেয়েটা এমনি থেকে যাবে। তাই এমন কিছু করতে হবে যাতে সে নিজে নিজেই তার মনের কথা বলতে পারে। নিচে নেমেই তার বাবা বলল
–তাড়াতাড়ি আসো ইরা একাই আছে।
ইরাও পিছন পিছন নামছিল। আড় চোখে ইরাকে দেখে নিয়ে বলল
–বাড়িতে এতো মানুষ একা থাকবে কেন?
ইরার খুব মন খারাপ হল। একদিনেই মানুষটা কেমন বদলে গেলো। এমন তো ছিলোনা। চোখ ছল ছল করে উঠলো। রিহাব বের হয়ে গেলো। ইরা রান্না ঘরে গেলো। তার শাশুড়ি রান্না করছে। রান্না ঘরে পা দিতেই উনি বললেন
–তুমি এখানে কেন? নতুন বউ রান্না ঘরে আসেনা।
ইরা মাথা নিচু করে বের হয়ে যেতেই উনি আবার পিছন থেকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন
–রিহাব চলে গেছে?
ইরা মাথা নাড়াল। উনি বুঝতে পারলেন রিহাব চলে যাওয়ায় ও একা হয়ে গেছে। তাই এখানে এভাবে দাড়িয়ে আছে। উনি ইরাকে ভিতরে ডাকলেন। ইরা মাথা নিচু করেই ভিতরে গেলো। একটু হেসে বললেন
–তুমি রান্না করতে পার?
ইরা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। উনি হেসে বললেন
–আমি যখন থাকবনা তখন তাহলে তোমার কোন অসুবিধা হবেনা।
ইরা মাথা তুলে বলল
–কবে যাবেন মা?
–পরশুদিন।
–যেতেই হবে?
অসহায়ের মতো মুখ করে ইরা জিজ্ঞেস করলো। তার শাশুড়ি মাথায় হাত দিয়ে বলল
–হ্যা মা যেতেই হবে। তোমার বাবার কাজ আছে। শেষ করেই আবার চলে আসবো।
ইরা মন খারাপ করে মাথা নিচু করে ফেললো। সবাই চলে গেলে এই বাড়িতে একা হয়ে যাবে সে। রিহাবও থাকবে না। রিহাবের মা আবার বলল
–শান্তা থাকবে। কোন অসুবিধা হলে ওকে বলবে।
তারপর একটু দুষ্টুমির সূরে বলল
–আর চেষ্টা করবে রিহাবকে বাসায় রাখার।
ইরা লজ্জা পেয়ে একটু হেসে ফেললো।

৬৪
দুপুরের খাবার শেষ করে ইরা ঘরে চলে এলো। তার শাশুড়ি বলেছে রেস্ট নিতে। রিহাব এখনো আসেনি। ইরা বিছানায় বসে ভাবছে। ফোনের শব্দে তাকিয়ে দেখে ইভান। খুশি হয়ে ফোনটা রিসিভ করলো
–হ্যালো ভাইয়া।
–কি করছিস?
–কিছুনা রেস্ট নিচ্ছি।
–খাওয়া দাওয়া করেছিস?
–হ্যা করেছি।
–তুই ঠিক আছিস তো?
–হ্যা ভাইয়া আমি একদম্ ঠিক আছি।
–রিহাব কোথায়?
ইরা একটু হতাশ হয়ে বলল
–হসপিটালে গেছে।
–ওহ আচ্ছা!
বলেই শান্ত গলায় বলল
–ইরা তুই ভালো আছিস তো?
ইভানের কথার মানে বুঝতে পেরে ইরা একটু হেসে বলল
–আমি ভালো থাকব তুমি জানতে ভাইয়া। আর না জানলে তুমি এই বিয়েতে কখনও সম্মতি দিতে না।
ইরার কথা শুনে ইভান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল
–ঠিক আছে রাখছি। পরে আবার ফোন দিবো।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো। ইরার শরীরটা ঝিমিয়ে আসছিল। ঠিক হয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলো। রিহাব এসে ঘরে ঢুকেই দেখে ইরা ঘুমাচ্ছে। সে নিঃশব্দে ওয়াশ রুমে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে ইরার পাশে বসে তাকে দেখেছে। হালকা একটু গালে হাত দিতেই সে চমকে উঠে রিহাব কে জড়িয়ে ধরল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। রিহাব একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সে ইরার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–কি হয়েছে? ভয় পেয়েছ?
রিহাবের গলা শুনে ইরা স্বস্তি পেলো। একটা জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল
–স্বপ্ন দেখেছিলাম।
রিহাব কে এভাবে জড়িয়ে ধরায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকে ছেড়ে দিলো। রিহাব একটু হাসল। ইরা মাথা নামিয়েই বলল
–কখন এসেছেন?
রিহাব গম্ভীর গলায় বলল
–অনেকক্ষণ হল।
–আমাকে ডাকেন নি কেন?
–তুমি কি আমার অপেক্ষা করছিলে? করলে তো শুয়ে পড়তে না। আমি কখন আসবো সেটা ভেবে বসে থাকতে।
ইরা ভ্রু কুচকে তাকাল। রাগ করে বলল
–আমাকে ব্লেম করার আগে নিজেই একটু ভেবে দেখেন। বিয়ের পরের দিনে বউকে রেখে কাজে গিয়েছিলেন। একবার ফোনও করেন নি।
–তুমিও তো করনি? দায়িত্ব টা কি আমার একার?
রিহাবের এমন কথা শুনে ইরা উলটে কাদ কাদ গলায় বলল
–বিয়ের আগে তো কত মিষ্টি কথা। আমার সব দায়িত্ব নিবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শত্রুকে বিয়ে করেছি আমাকে আর সহ্যই করতে পারছেনা।
ইরার কথা শুনে রিহাব একটু হেসে তাকে এক টানে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো। ইরা একটু অপ্রস্তুত হয়ে উঠতে গেলে আরও জোরে চেপে ধরে। কোমল সরে বলে
–এক্সপেকটেশন প্রকাশ করতে হয় নাহলে কিছুই পাওয়া যায়না।

চলবে………।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে