তোর ছায়ার সঙ্গী হব পর্ব-১১

0
1627

#তোর_ছায়ার_সঙ্গী_হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১১

২৫
ঈশা নিজের ঘরে তার কাপড় গুছিয়ে রাখছে। অনেক দিন আলমারিতে হাত দেয়নি সে। সমস্ত জিনিস পত্র এলোমেলো হয়ে আছে। এক এক করে সব ঠিক করছে। একটা কাপড় টানতেই পাশ থেকে একটা ওড়না পড়ে গেলো। ঈশা সেটা পরম যত্নে হাতে তুলে নিলো। এক দৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক দিন আগে এই ওড়নাটা ইভান তাকে দিয়েছিলো। সেদিন এই ওড়নাটা ইভান পরম যত্নে তার মাথায় পরিয়ে দিয়েছিলো। আর বলেছিল
–এই রঙটা শুধুই তোর জন্য। তোকে অসম্ভব লাগে এই লাল রঙটায়।
সেই কথাটার মানে সেদিন ঈশা না বুঝলেও কোথায় যেন সেটা ঈশাকে আঘাত করেছিলো। আজও সেই আঘাতের ক্ষত হিসেবে নিজের অপছন্দের লাল রঙটা নিজের সব থেকে প্রিয় হিসেবে জিবনের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কথাটা ভেবে ঈশার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কারও উপস্থিতি বুঝতে পেরে পিছনে ঘুরে দাড়াতেই দেখল ইভান দাড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে ইভান কে দেখে তার মুখের হাসি আরও প্রশস্ত হয়ে গেলো। কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষন স্থায়ী হলনা। ইভান সজোরে ঈশার গালে একটা থাপ্পড় মারল। ঈশা ছিটকে পড়ে গেলো। গালে হাত দিয়ে থমকে গেলো কিছু মুহূর্তের জন্য। এই প্রথমবার ইভান তাকে থাপ্পড় মারল। কিন্তু কারণটা তার জানা নেই। ইভান ওর উপরে যত বেশি রাগ করুক না কেন হয় নিজেকে কষ্ট দেয় আর নাহলে তার সাথে খারাপ ব্যাবহার করে কিন্তু ঈশার গায়ে কখনও হাত তোলেনি। ইভান ঈশার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। তারপর এক হাতে ঈশার দুই গাল চেপে ধরে দাতে দাঁত চেপে বলল
–তোর সাহস কি করে হয় আমার কথা অমান্য করার।
ঈশা ইভানের কথা বুঝতে পারলনা। হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঈশার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো সে ব্যাথা পাচ্ছিলো। বুঝতে পেরে ইভান ঈশাকে ছেড়ে দিলো। তারপর ঈশার সামনে একটা লকেট সহ চেন ধরে খুব শান্ত ভাবে বলল
–কেন খুলেছিস এটা?
ঈশা সেটার দিকে দেখে চমকে উঠলো। ইভান আবার বলল
–তুই আমাকে কোনদিনও বুঝবিনা তাই না। সব সময় নিজের জেদ আর ইচ্ছা টাকেই প্রাধান্য দিবি। আমার কোন কিছুর কোন মুল্য তোর কাছে নেই।
ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–আমি ইচ্ছা করে খুলিনি। বিশ্বাস কর।
ইভান তার দিকে তাকিয়ে করুন সূরে বলল
–তুই জানিস ঈশা আমি আমার ভালোবাসা সব সময় তোর কাছে প্রকাশ করি তাই সেটাকে তুই তুচ্ছ ভাবিস। ভুলে যাস না। আমার এই ভালোবাসা শুধু একটা শব্দ না। আমার জীবন। আমার অস্তিত্ব!
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ালো। দরজা পর্যন্ত যেতেই পিছনে ঘুরে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–ইউ নো ঈশা! তুই নিজেই জানিস না তুই আসলে কি চাস। আমার ভালোবাসা অনুভব করতে চাস। কিন্তু আমি জখন আমার ভালোবাসার অনুভুতি তোর কাছে প্রকাশ করি তখন সেগুলো তোর কাছে অসহ্য হয়ে যায়। আবার জখন আমি তোর কাছ থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখি তখনও তুই কষ্ট পাস। আমি তোর উপরে যত অধিকার খাটাই সব কিছু তোর কাছে অত্যাচার মনে হয়। কিন্তু তুই জানিস আমি কখনও কারন ছাড়া কোন কাজ করিনা। ভেবেছিলাম তুই আমাকে বিশ্বাস করিস।
একটু হেসে বলল
–এই অত্যাচারের পিছনেও অনেক কারন আছে। আমি চাইনা সেগুলো কখনও তোর কানে আসুক। কিন্তু যদি কোন ভাবে এসেই যায় তাহলে সেদিন বুঝতে পারবি আমার কোন আচরণ তোর উপরে কখনও অত্যাচার ছিলোনা। সবটাই আমার ভালোবাসা। তুই আমাকে ঘৃণা করিস তাই না। কিন্তু আমি তোকে নিজের জীবনের থেকেও ভালোবাসি। আমার ভালোবাসা যদি তোকে এতোটাই কষ্ট দেয় তাহলে আমি দূর থেকেই তোকে ভালবাসব। শুধু তুই ভালো থাকিস। তাহলে তোর এই ঘৃণাটা নিয়েই আমি সারা জীবন কাটিয়ে দিবো। ভালবাসতে হবেনা আমাকে।

কথা শেষ করে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো। ঈশা সেখানে বসে ভাবতে লাগলো। সকালে চেনটাতে চুল আটকে গিয়েছিলো আর সেটা খুলতে গিয়ে চেনটা গলা থেকে খুলে ফেলেছিল ঈশা। পরে সেটা পরতে ভুলে গিয়েছিলো। কিন্তু ইভান কিভাবে জানলো? ঈশার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ইভান কে কষ্ট দিতে চায়নি ঈশা। আজ সে খুব কষ্ট পেয়েছে।

ইভান যখন পড়াশুনা করতে এই শহর ছেড়ে বাইরে যায় তখন সে ঈশার গলায় এই চেনটা নিজে হাতে পরিয়ে দিয়েছিলো। আর বলেছিল
–যা কিছু হয়ে যাক এটা গলা থেকে কখনও খুলবি না। আমি বেঁচে থাকতে অন্তত না। আমি মরে গেলে তোর যা ইচ্ছা হয় করিস। কিন্তু প্লিজ আমার কথার অমান্য করিস না।
তারপর থেকে ঈশা সেটা কখনও খুলেনি। নিজের সাথে সব সময় রেখেছে যত্ন করে। কিন্তু আজ ঈশার মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো সেটার কথা। সে হয়ত নিজের অজান্তেই ইভান কে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। ঈশা মেঝেতে বসেই কাঁদছে। তার কান্না আজ বাধ মানছে না। কেন জানি আজ তার ভিতরে খুব কষ্ট হচ্ছে। ইভান বাইরে দাড়িয়ে দেখছিল। ঈশার কান্না সে সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু আজ দাতে দাঁত চেপে সহ্য করছে। ঈশাকে কাঁদতে দেখে ইভান মনে মনে বলল “সরি জান। আমাকে মাফ করে দিস। আমি তোকে আঘাত করতে চাইনি। কিন্তু তুই আমাকে আজ বাধ্য করলি। আজ যা করেছিস খুব বেশি করেছিস। এটার শাস্তি তোকে একটু হলেও পেতে হবে জান।” কথা গুলো ভেবেই ইভান নিজের ঘরে চলে গেলো। ঘরে বসে গভীর ভাবনায় ডুবে আছে ইভান। সে এই প্রথম ঈশার গায়ে হাত তুলেছে। নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। নিজের উপরে এখন ইভানের খুব রাগ হচ্ছে। কিন্তু ঈশা আসলেই তাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। ইভান ঈশার ছোট ছোট পছন্দ অপছন্দ এসবের খেয়াল রাখে। ঈশারও উচিৎ ছিল ইভানের কথার গুরুত্ব দেয়া। কিন্তু ইভানের অনুভুতি গুলো সে সব সময় সহজেই প্রকাশ করেছে। তাই হয়ত ঈশা সেগুলোর মর্ম বুঝতে পারেনি। সেগুলো হয়ত ঈশার কাছে অতি সস্তা হয়ে গেছে।

২৬
সকাল থেকেই ইভান কে দেখা যাচ্ছেনা বাসায়। দুইদিন ধরে ঈশা ইভান কে মানাতে চেষ্টা করছে কিন্তু ইভান তার সামনেই আসছেনা। এমন কি ঈশাকে দেখলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে ঈশা। ভাবছে কিভাবে ইভান কে মানাবে। ইভান কে মানানো এতো সহজ না। কিছু একটা ভেবে ঈশা একটু হাসল। তারপর আলমারি থেকে একটা লাল রঙের শাড়ী বের করে নিলো। তারপর মনে মনে বলল “এবার দেখি তুমি কিভাবে আমার কাছ থেকে দূরে থাকো।“ ওয়াশ রুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে শাড়ীটা পরে বের হল। ঈশা ওয়াশ রুম থেকে বের হয়েই দেখে তার চাচি দাড়িয়ে আছে। ঈশা কে লাল শাড়ী পরতে দেখে তিনি ভালো একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলেন। তারপর বললেন
–কোথাও যাচ্ছিস?
ঈশা মাথা নাড়িয়ে না বলল। তার চাচি একটু এগিয়ে গিয়ে বলল
–তাহলে?
–আলমারি গোছাতে গিয়ে এই শাড়ীটা চোখে পড়লো। তুমি দিয়েছিলে আমাকে। পরতে ইচ্ছা করলো তাই পরে ফেললাম।
ঈশার চাচি তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। ওনার চোখে পানি এসে গেলো। ঈশা বুঝতে পেরে কাছে গিয়ে বলল
–কাদছ কেন চাচি?
তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন
–আমি তোদের দুজনকে সুখি দেখতে চেয়েছি। তোরা দুজন সুখে থাকবি এটাই আমার শেষ চাওয়া। জানিস ঈশা এই শাড়ীটা ইভান পছন্দ করেছিলো তোর জন্য। ওর ইচ্ছা ছিল তুই এই শাড়ী পরে আমাদের বাসায় বউ হয়ে আসবি। আমি মন থেকে দোয়া করি তোরা সুখি হ।
ঈশা তার চাচির হাত ধরে একটু হেসে বলল
–আমার জন্য দোয়া কর চাচি তোমার ওই জেদি ছেলেটাকে যেন সারাজীবন সামলাতে পারি।
ঈশার কথা শুনে তার চাচি হেসে ফেললো। তাদের কথার মাঝখানে কলিং বেল বেজে উঠলো। ইরা দরজা খুলে দেখে ইভান দাড়িয়ে আছে। ইভান কে দেখেই ইরা বলল
–ভাইয়া তুমি এতো দেরি করলে কেন?
ইভান খুব শান্ত ভাবে বলল
–সরি রে একটু দেরি হয়ে গেলো।
ইভানের আওয়াজ শুনে তার মা ঈশাকে বলল
–ওই যে এসে গেছে। দেখ তার রাগ ভাঙ্গাতে পারিস কিনা।
ঈশা একটু হেসে বলল
–এটা শুধু আমিই পারব চাচি। তুমি ভেবনা।
বলেই দুজন হেসে দিলো। ইভানের মা বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। ইভান ডাইনিং টেবিলে এসে পানি গ্লাসে ঢেলে খেতে যাবে তখনি সামনের বেসিনের আয়নায় চোখ পড়তেই থেমে গেলো। ঈশা নিজের ঘরের দরজায় দাড়িয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান নিস্পলক সামনের আয়নায় তাকিয়ে আছে। পিছনে ঘুরে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা তার তাকানো দেখে একটু মুচকি হেসে ঘরে চলে গেলো। ইভান বুঝতে পারল ঈশা তার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য এসব করছে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে। তারপর হাতে থাকা গ্লাসটার পানি শেষ করে গ্লাসটা সামনে রেখে মুচকি হাসল। হেসে চারপাশে ভালো করে দেখে নিলো। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। তারপর ধির পায়ে ঈশার ঘরের দিকে গেলো। দরজায় হেলানি দিয়ে দাঁড়ালো। ঈশা উলটা ঘুরে জানালায় দাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ভালো করে ঈশাকে দেখে নিলো। আজ ঈশাকে একদম নিজের স্বপ্নের মতো লাগছে ইভানের। আজ চাইলেও সে নিজেকে ঈশার কাছ থেকে দূরে রাখতে পারবেনা। তাকে কিভাবে কন্ট্রোল করতে হয় সেটা ঈশাই ভালো করে জানে। ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিলো। ইভানের মা বাইরে দাড়িয়ে দেখছিল। ইভান কে ঈশার ঘরে যেতে দেখে তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। দরজা লাগানোর শব্দে ঈশা পিছনে ঘুরে তাকায়। ইভান নেশা ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়েই বলল
–কেন এসেছ এখানে?
ঈশার কথা শুনে ইভান ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকাল। ঈশা আবার বলল
–কি বলেছি শুনতে পাওনি?
ইভান এবার ঈশাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে এক হাতে গাল চেপে ধরে দাতে দাত চেপে বলল
–তোকে কোন কইফিয়ত দিতে আমি বাধ্য না।
ঈশা ইভানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান ঈশার চোখের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারলনা সে। ঈশার ঠোঁট দুটো নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো। ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেললো। বেশ কিছুক্ষন পর ঠোঁট দুটো ছেড়ে ঈশাকে উলটা দিকে ঘুরিয়ে তার পিঠ নিজের বুকের সাথে ঠেকিয়ে দিলো ইভান। তারপর পিঠের চুল গুলো সরিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছুয়ে দিলো। ঈশা একটু কেঁপে উঠলো। তারপর সামনে হাত দিয়ে তার গলায় স্লাইড করতে শুরু করলো। কিন্তু গলায় হাত পড়তেই ঈশার গলা ফাকা দেখে তার চেনের কথা মনে পড়ে গেলো। সে ঈশাকে এবার একটু শক্ত করে ধরে বলল
–কি ভেবেছিস এসব করে আমাকে ভুলিয়ে রাখবি। আমি এতো সহজে ভুলিনা সেটা তুই ভালো করেই জানিস।
বলেই ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো। ইভান যাওয়ার পর ঈশা একটু হেসে বলল
–ভুলে তো গিয়েছিলেই। আমিও দেখি কতদিন মনে রাখতে পার।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে