তোমার আকাশে হব প্রজাপতি পর্ব ২৫+২৬+২৭

0
1847

তোমার আকাশে হব প্রজাপতি
পর্ব ২৫+২৬+২৭
Writer Tanishq Sheikh

রুবিনা ইমা ও সানাকে ভেতরে নিয়ে আসল।সানার ভেতরটা অস্থির লাগছে ফারহাকে দেখে।সে তার ভাইয়ের জীবনের এই বিধ্বংসী কাল সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত।এই মেয়ে আসা মানে ওর ভাইয়ের জীবন নরক পরিনত হওয়া।দু’দু বার এই ই তো করেছে।সানা নিজেকে এই অস্থিরতার মধ্যে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে না পেরে উঠে দাঁড়ায়। সানাকে অমন ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়াতে দেখে রুবিনা সবটা আন্দাজ করে নেয়।ইমা কৌতূহলি চোখে শুধু চেয়ে থাকে দু’জনের দিকে।রুবিনা জোর করে হেসে সানার হাতটা টেনে পাশে বসিয়ে বলে
” এতো ছটফট করছিস কেন বলতো?”
” খালা আমি ভাইয়ের কাছে যাব।”সানার কন্ঠ স্বরে ইমা স্পষ্ট অস্থিরতা খুঁজে পায়।রুবিনা সেদিকে লক্ষ্য করে আবারও হাসে।বলে
” আরে বোকা! এতো বড় হয়েও ভাই ছাড়া একমিনিট চলতে পারিস না।দেখেছ বউ মা! কেমন বাচ্চা এখনও সানা?”ইমা ঠোঁট প্রসস্থ করে কিছুটা হাসার চেষ্টা করে সানার দিকে তাকিয়ে থাকে।খালার শেষ কথায় সানার বুদ্ধি খোলে।ইমার চোখে চোখ রেখে দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে খালার দিকে তাকায়।ইমার একটু ভালো লাগছে না এদের ইশারা ইঙ্গিতে বলা কথাবার্তা। কিছু তো গোলমেলে আছে! কিন্তু কি? ফারহা! ইমার অবচেতন মন ফারহাকে নিয়ে চিন্তা শুরু করতেই, শান হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে খালাকে একপ্রকার টেনেই অন্য রুমে নিয়ে যায়।শানের মন, মস্তিষ্কে এতোক্ষন ইমা ছিলই না।সে ইমার দিকে ভ্রুক্ষেপই করলো না। কিন্তু যখন দরজা বন্ধ করতে গেল তখনই চোখাচোখি হলো ইমার সাথে।শান নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিল ইমার চোখের জল থই থই দেখে।সে নির্বিকার ইমাকে দেখে,কিছুই বলতে পারলো না । কিছু বলার ভাষা সে হারিয়ে ফেলেছে। দরজা ইমার সামনেই লাগিয়ে দিল।ইমার মনটা কেঁপে উঠলো সে আওয়াজে।স্থির দৃষ্টিতে বন্ধ দরজার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল।
” ভাবি তুমি কাঁদছ কেন?” সানার গলার স্বরে ইমা চোখের নিচে হাত দেয়।হ্যাঁ সে কাঁদছে। দ্রুত চোখটা মুছে হাসির চেষ্টা করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলে,
” কি জানি?আমি কাঁদছি কেন সানাপু!”
সানা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ইমাকে।সেও কেঁদে দেয় নিঃশব্দে। তারপর বলে,
” কিছু হবে না ভাবি।প্লিজ তুমি ভাইকে ভুল বুঝো না।সে তোমাকে ছাড়া আবার অতলে তলিয়ে যাবে।তাকে বাঁচাও তুমি ভাবি।”
ইমার মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে শীতল জল গড়িয়ে পড়ে।শিওরে ওঠে শরীরের লোম লোম।সে বুঝে গেছে যেন, কি বলতে চাচ্ছে সানা।তবুও তার ভাবনারা আজ কুয়াশাচ্ছন্ন।একমাত্র শান পারবে সে কুয়াশা কাটাতে।
শান দরজা বন্ধ করে হুঙ্কার করে ওঠে ছোট খালার উপর,
” রক্ত যে সব এক ধারায় চলে বুঝিয়ে দিলে তো? করলে তো বাকি দু’ বোনের মতো কাজ।কেন করলে আমার সাথে এমন তুমি? তোমাকে তো বিশ্বাস করতাম আমি।আপন ভাবতাম।”
রুবিনা ঘাবড়ে গিয়ে কাচুমাচু হয়ে বলে,
” শান শান্ত হ।একবার আমার কথাটা তো শোন।
” কি শুনব? বলো কি শুনাবা তুমি? আবার আমাকে ঐ পিশাচীনির কাছে যাওয়া উচিত।ওকে গ্রহণ করা উচিত সেটা?”পাশে থাকা তানিন প্লাস্টিকের চেয়ারটা আছরে ভাঙে শান।রুবিনা ভয়ে আৎকে ওঠে।কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে
” বাপ আমার! বিশ্বাস কর আমি এমনটা কোনোদিন চাই নি, এখনও চাচ্ছি না।আমি নিজেও জানতাম না ফারহা দেশে ফিরেছে। তোরা আসার ৫ মিনিট আগে ও এখানে এসেছে।”
” মিথ্যা বলছ তুমি খালা।মিথ্যা! ওর ভাব দেখে কেউ বলবে ও আচমকা এসেছে এখানে।ও জানত আমি আসব আর সেজন্য এসেছে।”
” হ্যাঁ ভুল টা আমার।পরশু বড় আপা মোবাইল করেছিল।কথায় কথায় তোদের কথা জিজ্ঞেস করেছিল আমিও সরল মনে বলে দিয়েছি আজ আসবি তোরা।বিশ্বাস কর আমি ঘূর্ণাক্ষরেও জানতাম না ফারহা এসেছে।”শানের হাত টা টেনে অপরাধী চেহারায় বলে কেঁদে দেয় রুবিনা।শান চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খালাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
” আমি তোর ক্ষতি চাই না রে শান।আমি চাই তুই, সানা ভালো থাক।”রুবিনা শব্দ করে কেঁদে ওঠে।
” ইটস ওকে খালা।কান্না থামাও।সরি আমি রাগের মাথায় তোমার সাথে বেয়াদবী করে ফেলেছি।”রুবিনাকে বিছানায় বসিয়ে মাথায় হাত বোলায়।রবিনা চোখের জল মুছে বলে
“তুই বউ মাকে সব বলে দে।দ্যাখ মেয়েটাকে গোমরাহ করিস না, এতে ও সন্দেহ করবে।আর জানিস তো সন্দেহ কতো ভয়াবহ জিনিস?”
শান মুখ ঢেকে হাঁটু মুড়ে নিরুত্তর বসে থাকে।রুবিনা সাহস করে শানের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
” যা ওকে বলে দে।”
” ও সহ্য করতে পারবে না খালা।আমার অনেক খারাপ অতীত ও না চাইতেও মেনে নিয়েছে কিন্তু চোখের সামনে ফারহাকে দেখে ও যদি না মানে? যদি আমাকে ভুল বোঝে?”শানের চোখের কোনে অশ্রু চিকচিক করে।রুবিনা কিছু বলতে যাবে তখনই দরজায় টোকা পড়ে।ইমার গলার স্বরে রুবিনা,শান চোখাচোখি করে।শান উঠে দাঁড়াতে পারে না।তার সে শক্তি নেই।রুবিনা ধীর পায়ে উঠে দরজা খুলে দেয়।সামনে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে ইমা।খালাকে দেখেও সে কিছু বলে না। পিঠ এদিক করে বসা শানকে দেখে সে এগিয়ে যায়।রুবিনা চুপচাপ দরজা লাগিয়ে বাইরে চলে আসে।ইমা ধীর পায়ে শানের পাশে এসে বসে।শানের বাহু ধরে মাথা ঠেকিয়ে আহ্লাদিত স্বরে বলে,
” কি হয়েছে আপনার? কাঁদছেন কেন?”
শান কোনো জবাব দেয় না।সে চুপচাপ মাথা নুইয়ে বসে আছে।শানকে বিমর্ষ দেখে ইমা সোজা হয়ে বসে রাগে ফুঁসে ওঠে,
” কি হলো বলছেন না কেন? বলেন ঐ মেয়ে কে? কেন তাকে দেখামাত্র আপনার চেহারা রক্ত শূন্য হয়ে গেল? বলুন।”
শান দুটি ভয়ানক লাল চোখ দিয়ে ইমার দিকে তাকালো।ইমার মনে হলো এখনি বুঝি এ চোখ দিয়ে লাভা গলে পড়বে।কিন্তু না সে চোখ দিয়ে বেরোলো কষ্টের অশ্রু। ইমা স্বামীকে এমন অবস্থায় দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল,
” বলেন না আমাকে।আমি যে পারছি না।এই দেখুন আমার হৃদপিণ্ড কেমন করছে?”শানের হাতটা ইমা বুকের বাঁপাশে চেপে ধরে।শান ইমার চোখে চোখ রেখে ইমাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।ইমার মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে বলে,
” শুনবে তুমি? সহ্য করতে পারবে তো?”
ইমার বুকটা ধক করে ওঠে।শানের মুখোমুখি তাকিয়ে শানের গালে হাত রেখে বলে,
” আমার অনেক সহ্য ক্ষমতা।আমি তো নারী! নারীরা আর কিছু পারুক না পারুক সহ্য মাত্রারিক্ত করতে পারে।আমিও পারব।”
শান ইমা চোখের দৃঢ়তার পরিমাপ করতে চাইল।কিন্তু পারল না।সম্ভবও না।দৃষ্টি সামনে রেখে বলে,
” আমার আব্বুর নাম ছিল সাদেক খান। একজন সাধারণ স্কুল কেরানি ছিল।আব্বু, আমি, সানা আর,, কিছুটা থেমে শান আবার বললো,” আমাদের মা! আমাদের পরিবার ছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত তবে সুখী পরিবার।আব্বুর চোখের মনি ছিলাম আমি। আমাকে নিয়ে তার স্বপ্ন ছিল খুব।আমার যখন ১০ বছর বয়স তখন সানার জন্ম।সানাকে প্রথম কোলে নিয়ে আমি আর আব্বু খুশিতে কেঁদেই দিয়েছিলাম।আমি কেঁদেছিলাম কারন আমার ইচ্ছা পূরন হয়েছে। সবার মতো আমারও একটা ছোট বোন হয়েছে।সানা আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো।সাথে সাথে আমি লক্ষ করলাম আমার মায়ের পরিবর্তন। সে যেন দিনকে দিন কেমন নিষ্ঠুর হতে লাগল।একদিন স্কুল থেকে এসে দেখি সানাকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পিটিয়েছে।বেচারির গায়ে লাল দাগ হয়ে গিয়েছিল। ভয়ে জড়সড় হয়ে ভাত খাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করতে সব বলে ফুঁপাতে লাগল।আমার খুব রাগ হলো। তুমি জানো তখন আমি এতোই ভিতু টাইপ ছিলাম যে মা’ কে সাহস করে বলতেও পারি নি মা বোনকে মেরেছ কেন?সানা আমাকে বলে দিয়েছে শুনে মা মুখ ভেংচে কি বলেছিল জানো? বলেছিল! ও গাধাকে বলে কি করবি? ওর সাহস আছে আমাকে জিজ্ঞেস করার।যে ছেলে ১৫/১৬ বছর বয়সেও তার চেয়ে অর্ধেক বয়সের ছেলেদের হাতে মার খায় সে ছেলে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করবে।আগে নিজেকে বাঁচানো তো শিখুক তারপর না বোনকে বাঁচাতে আসবে।কি এক অপদার্থ পেটে ধরেছি!মায়ের কথায় আমার কষ্ট হয় নি কারন মা সবসময়ই এসব বলতো।আমি স্বভাবতই বই পড়ুয়া ঘরকুনো প্রকৃতির ছিলাম।আব্বু চাইতো না কারো সাথে মিশি।আমি আব্বুর বাধ্য ছেলে তাই আব্বু যা বলতো তাই শুনতাম।মারামারি, ধরাধরি এসব আমাকে আমার আব্বু কোনোদিন শেখায় নি।করার সাহস, সুযোগও দেয় নি।বুকে আগলে লালন পালন করেছেন ভেবেছেন হয়তো এভাবেই সারাজীবন চলবে।কিন্তু চললো না।আমার আব্বুর কিডনি সমস্যা ছিল।ক্রমশ সেটা চরম রূপ নিল।এদিকে সামনে আমার এসএসসি পরীক্ষা। আমি দিনরাত এক করে পড়ছি।আব্বুর অসুস্থতা আব্বু কাওকে বুঝতে দিল না।আমার ভবিষ্যতের জন্য জমা পুঞ্জি হয়তো তিনি ভাঙতে চাননি তাই নিজের জীবনঘাতি রোগটা আড়ালে চেঁপে গেলেন।আমি সাইন্সের স্টুডেন্ট ছিলাম।আমার ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার।সব ভুলে সারাদিন শুধু পড়তাম।এমনও দিন গেছে একবেলা খেয়েছি পরেরবেলার কথা আর মনে থাকতো না।থাকলেও মা’ কে ডিস্টার্ব করার সাহস পেতাম না।আর আব্বু তো অসুস্থতায় শুয়ে থাকতেন যতোক্ষণ বাসায় থাকতেন।আব্বুকে এতো নিস্তেজ দেখে আমার বুকটা কেমন করত কিন্তু চাপা স্বভাবের বলে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারতাম না।মৃত্যুর রাতে আমার ঘরে এসে পাশে বসলো আব্বু।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,আব্বা! আমাকে ছাড়া কি তুই চলতে পারবি না? আমি অবাক হয়ে বললাম।”এমন কথা কেন বলছ আব্বু? হেসে কপালে চুমু দিয়ে বললো
” কিছু না আব্বা, এমনি! তুমি পড়। মনোযোগ দিয়ে পড়।আব্বু উঠে দাঁড়ালেন। তার শরীর যেন দুলছিল। আমি বোকা বোকা তার দিকে চেয়ে আছি দেখে মুখটা মলিন করে বললেন,” তোকে মনে হয় এতো নরম বানানো আমার উচিত হয় নি রে।একটু ছেড়ে বাস্তবতা বোঝানো উচিত ছিল।” শেষ কথাটা বলে আব্বু চলে গেলেন।তার শরীর শুকিয়ে গেছে এ কদিনে পেটটা ফুলে উঠেছে।আমার কেন যেন কাঁদছে ইচ্ছা করলো আব্বুকে এ অবস্থায় দেখে।হয়তো কেঁদেওছিলাম।তারপর এলো সেই নিষ্ঠুর ভোর।আমি পড়তে পড়তে টেবিলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ভোরের দিকে হঠাৎই মা আর্তনাদ করে উঠল।মায়ের চিৎকারে দৌড়ে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি আমার আব্বুর প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে।শান আর বলতে পারল না নির্বাক হয়ে রইল শোকে।ইমা শানের হাতটা দু’হাত মুঠোবন্দি করে শানের বুকে মাথা রাখল।ইমার কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে শান নিরবে অশ্রু ফেললো।তারপর নিজেকে সামলে বলতে লাগলো,
” আমি তখনও জানতাম না এ পৃথিবী আমাকে কি দেখাতে চলছে?বাস্তবতা কতোটা ভয়ানক হয় আমাকে বোঝানোর জন্য যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রকৃতি।আমার এই শান্ত, সরল রূপ যেন তার আর সহ্য হচ্ছে না।আব্বুর লাশ দাফন হলো।আমি জানাজায় কোনমতে শরীক হয়ে আবার ঢলে পড়লাম।এই নিয়ে চারবার মূর্ছা গেলাম।আমার সবকিছু অন্ধকার হতে লাগল।আব্বু নেই এ কথা যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল।তখনও আব্বুর শেষ কথার মর্মার্থ বুঝে উঠতে পারি নি আমি।আব্বুর মৃত্যুর তিনদিনের মাথায় আমাদের বাসায় বাড়িওয়ালা আনোয়ার আমিনের আসা যাওয়া যেন বাড়তে লাগল।আমি কোচিং থেকে এসে তাকে পেতাম।সকালে ঘুম থেকে উঠে তাকে পেতাম এমনকি মধ্যরাতেও মায়ের বিছানায় তাকে পেয়েছিলাম আপত্তিকর ভাবে।আমার মধ্যে ম্যাচুরিটি কম থাকলেও আমার বয়সে আমাকে বুঝিয়ে দিল আমার মা কি করছে।ঘৃণা ধরে গেল মায়ের উপর।সকালে উঠে না খেয়েই চলে এলাম কোচিং এ।এখানেও শান্তি নেই ফারহার কারনে।মাকে ঐ অবস্থায় দেখে আমার মাথা গরম হয়েছিল। প্রতিবাদ করতে না পারার জ্বালা যে কতো তীব্র তা সেদিন হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছিলাম।এই জ্বালা বারুদ হয়ে সেদিন আমার হাতে শক্তি জুগিয়েছিল পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য। তাইতো এতোদিন ফারহার টিজ গুলো সহ্য করলেও সেদিন করিনি। কষে চড় মেরেছিলাম ওর গালে।ও সহ কোচিং এর সবাই হতভম্ব বনে গিয়েছিল আমার সাহস দেখে।ফারহা আমার বড় খালার আদুরে বখে যাওয়া মেয়ে।ও আমার দু’বছরের জুনিয়র ছিল।এরপরেও ওকে আমি ভয় পেতাম কারন ও আমাকে যেখানে সেখানে জ্বালাতন করতো।আমার ব্যাগ টেনে ধরা,লাভ লেটার দেওয়া,নির্জন কোচিং ক্লাসে আমাকে জড়িয়ে ধরে লিপ কিস করা, ওর গ্রুপ নিয়ে ঘিরে আমার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেওয়া এসব যেন তার নিত্যদিনের রুটিন ছিল।আমাকে ভীত সন্ত্রস্ত করাই যেন ওর লক্ষ্য ছিল।আব্বু বেঁচে থাকতে কম করত কিন্তু মারা যাওয়ার পর যেন ওর এসব অত্যাচার বাড়তেই লাগল।আমার কাঁধ সমান একটা মেয়ে অথচ ওর কারনে সর্বক্ষণ একটা আতঙ্কে থাকতে হতো আমায়।সেদিন চড় দিয়ে বাসায় এসে আম্মুকে পায় নি।সানা ক্ষুধায় কান্না করছিল ঘরে বসে।ওকে কোনোমতে কিছু খাইয়ে আমি পড়তে বসলাম।কিন্তু মন বসলো না।সন্ধ্যার দিকে হঠাৎই বাড়িওয়ালার বউ এসে ঘরে ভাঙচুর করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল।আমি ঠেকাতে গেলে বাড়িওয়ালার ছেলে অনিক বেদম পেটালো আমাকে।কেউ এল না ঠেকাতে।সানাকেও মেরেছিল।মাথা ফেটে গিয়েছিল হয়তো, একদিন পর হুশ ফিরল।কাকা, কাকি পাশে বসেছিল। কাকি খুব কাঁদছিল। হাসপাতালে যে’কদিন ছিলাম কাকা কাকি ছিল।তারা আমাদের গ্রামে নিয়ে যেতে চাইল কিন্তু বড় খালু বাঁধা দিল।কেন দিয়েছিল পরে বুঝেছিলাম।কাকা অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল।হাসপাতাল ছেড়ে চলে এলাম আরেক জাহান্নামে। এখানে এসেই বড় খালার মুখে শুনতে পেলাম আমার মা বাড়িওয়ালার সাথে পালিয়েছে।আর সেজন্যই বাড়িওয়ালি খেঁপেছিল।মায়ের কুকর্মের শাস্তি আমরা দু’ভাই বোন পেলাম।লজ্জায় আমি যেন আরও কুকিয়ে গেলাম।কারও সামনে মুখ তুলে তাকাতে পারতাম না।আব্বুকে খুব মনে পড়তো সেই দিনগুলোতে।মনে হতো মরে যাই।নদীর জলে মরতে গিয়েও ফিরে এসেছি ভয়ে।কতোটা কাপুরুষ ছিলাম আমি?
শান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোয়াল শক্ত করলো।ইমা শানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে শানের মুখে তাকিয়ে রইল।এই পুড়ে কয়লা হওয়া মানুষটাকে কি ভাষায় স্বান্তনা দেবে ইমা বুঝে উঠতে পারে না।দু’চোখে জল ভরে আসে ইমার। শান আবার বলা শুরু করে,
” ফারহাদের বাসায় ছিল আমার একমাত্র আশ্রয়। কাকা কাকির সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল বড় খালু।আমার নামের রাখা মোটা অংকের টাকাটা উনি ব্যাংক থেকে তুলে আনলেন জমা রাখার নাম করে। টাকাটা পাওয়ার পরপরই তার ব্যবহার আমাদের দু’ভাই বোনের প্রতি খারাপ হতে লাগল।ছোট খালার একবছর হয়েছে বিয়ের।এরমধ্যে একদিন এসে দেখে গিয়েছিল আমাদের।তার সামনে বড় খালারা এমন ভাব করলেন যেন আমরা ভালো আছি।তা দেখে ছোট খালা নিশ্চিন্ত মনে চলে গেলেন। তারপর আস্তে আস্তে সবাই কেমন পর হয়ে গেল।যেন ভুলেই গেল আমাদের। এই সুযোগটা নিল বড় খালা, খালু আর ফারহা।ফারহা আমাকে পছন্দ করত।পাগলের মতো চাইতো কিন্তু সেই চাওয়ায় শুধুই নোংরামি ছিল।একটা কিশোরী মেয়ের মন মানসিকতা এতোটা নিচ হতে পারে ফারহাকে না দেখলে হয়তো আমি জানতাম না।ফারহার নোংরা মেন্টালিটির কারনে ওকে আমি সবসময় ভয় পেতাম।এ বাড়ি এসে সে ভয়টা আমার আরও বেড়ে গেল।খালা খালু প্রায় সময়ই বাইরে থাকত আর আমি ফারহার সামনে।তবে আমাকে আশ্চর্য করে ফারহা আমার কাছে খুব একটা ঘেঁষত না তবে তার চোখে তৃষ্ণা দেখতাম আমি।আমাকে পাওয়ার তৃষ্ণা।হয়ত ঐদিনের চড় খেয়ে ও শুধরে গিয়েছিল ভাবতাম।এভাবেই চলতে লাগল।আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হল।কিন্তু তেমন আশানুরূপ হল না দেখে খুব কাঁদলাম আমি।আমি দূর্বল প্রকৃতির যুবক ছিলাম।যার ভেতর ভয়, সংকোচে ভরা থাকত সবসময়।থাকবেই বা কেন?কি ছিল আমার? কিছুই না। না সম্মান, না পরিবার।উদ্বাস্তুর মতো খালার সংসারে পড়ে ছিলাম।মুখ ফুটে কিছু বলতে গেলেই মায়ের অপকর্ম, এতিম হওয়ার কথা শুনতে হতো।একদিন মাত্র কাজ শেষে ফিরেছি সন্ধ্যায়। ফারহা আমাকে টেনে আড়ালে আনল।আমি বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলাম,
” এখানে আনলি যে?”
” তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না শান ভাই।প্লিজ একটু বোঝো।আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”ফারহার চোখে মুখে অনুনয় ভরা আকুতি।আমি থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বললাম,
” দ্যাখ ফারহা! তুই ছোট মানুষ।তোর জন্য এসব ঠিক না।পড়ালেখা করে বড় হ তারপর যা হওয়ার হবে।তাছাড়া বোন ছাড়া তোকে আমি কিছুই ভাবি না”
ফারহার চোখ যেন রাগে জ্বলে উঠল আমার প্রত্যাখ্যানে।আমার কলার চেঁপে ধরে বললো
” এই তুমি আমাকে বার বার ফিরিয়ে দাও কেন? কিসের এতো অহংকার তোমার? সুন্দর,লম্বা, মেধাবী এজন্য? আমিও তো কম সুন্দরী না।তাহলে আমার সাথে প্রেম করতে সমস্যা কি তোমার বলো?”
” ছাড় আমার কলার।তুই আগেও শয়তান ছিলি এখনও তাই ই আছিস।এই তোর বয়স কত? এসব প্রেম টেমের কি বুঝিস তুই?”
আমার গলায় কাঁপন ধরল ওর রাগ রেখে।তবুও ভয়ে ভয়ে ওকে জবাব দিলাম।কিন্তু ও যেন আজ মানবেই না পণ করেছে।
” আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। যথেষ্ট বয়স হয়েছে আমার।তোমার মতো ভ্যাবলাকান্ত না। সব বোঝো তুমি তবুও এমন করো।প্লিজ আমাকে একটু ভালোবাসো।একটু!”
আমাকে জাপটে ধরল কালনাগিনীর মতো।আমি সর্বস্ব দিয়ে ঠেলে ওকে দূরে সরিয়ে দিলাম।তাতে যেন ওর রাগ আরও বেড়ে গেল।ছুটে এসে আমার হাত কামড়ে ধরল।আমি চিৎকার দিতেই ছুটে পালাল।কেউ সেদিন এসব দেখল না শুধু ছোট্ট সানা জানালা দিয়ে দেখল।আমি ওর দিকে তাকিয়ে কাঁদতে গিয়েও কাঁদলাম না।ধীরে ধীরে যেন পাথর হতে লাগলাম।সব মুখ বুঝে সহ্য করার অসীম ক্ষমতা আগেও ছিল এখন অত্যাচারটাও সহার ক্ষমতাও হতে লাগল।
এভাবে একটা বছর কেটে গেল।খালু আমাকে কলেজে ভর্তি করালেন না
তার দোকানে বসিয়ে দিলেন।সারাদিন দোকান শেষে রাতে শান্তি পেতাম না ফারহার অত্যাচারে।কিছু বললেই ওর বাবা মার কাছে মিথ্যা বলে বকা শুনাত।প্রতিবাদ করতে গিয়ে একদিন তো খালুর চড়ও খেলাম।গালে হাত দিয়ে মুখটা অসহায় করে ফারহার দিকে তাকালাম।দয়া হলো না উল্টে এতে যেন ফারহার সাহস আরও বেড়ে গেল।সে আমাকে জোড় করল তাকে বিয়ে করার জন্য। আমি খালুকে বলতেই খালু আমার উপর চড়ে উঠলেন।মারলেন খুব। সাহস না হলেও সেদিন ইচ্ছা হল এই জাহান্নাম থেকে পালিয়ে যেতে কিন্তু পারি নি। খালু ধরে এনে বন্দী করে রাখলো।আমার নামে জিডিও করে রাখে।খুব শাসায় আমাকে।বিনা পয়সায় কামলা পেলে কে ছাড়তে চাই?তিনি হুমকি দিলেন কোনোদিন আমি পালানোর সাহস করলে সানাকে মেরে ফেলবেন।আমাকে বিশ্বাস করাতে আমার ঐ টুকু বোনকে খুব মারল।
আমি সেদিন রাতে বুঝেছিলাম আব্বুর বলা শেষ কথার মর্ম।আমারও মনে হতে লাগল আমি এতো অসহায় কেন? কেন সব ছেড়ে পালাতে পারছি না।কিসের ভয় আমাকে গ্রাস করে প্রতিনিয়ত?
শান চুপ হয়ে যায়।চোখে জল নিয়েই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,তোমার হয়ত শুনে অবাক লাগছে একটা১৬/১৭ বছরের ছেলে এতো বোকা আর অসহায় কেন তাই না? ইমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে শান।ইমা কিছুই বলে না প্রতিউত্তরে।শুধু মানুষটার দুঃখ উপলব্ধি করে কাঁদতে থাকে।কি বলবে? সমাজ,পরিবেশ, পরিস্থিতির কাছে মানুষ কতোটা অসহায় ইমা নিজেও তো দেখেছে।না চাইতেও যখন শানের কাছে তাকে ফিরতে হয়েছিল।পরিবার পরিজন থাকতেও আবিরের অশ্রাব্য ভাষা শুনেও তাকে স্বামী হিসেবে মানতে বাধ্য ছিল। শান তো এতিম,ম্যাচুরিটি কম একটা ছেলে ছিল।তারজন্য ঐ পরিবেশে মুখ থুবড়ে টিকে থাকা ছাড়া ভিন্ন কি আর পথই বা ছিল?

তোমার আকাশে হব প্রজাপতি
পর্ব ২৬
Writer Tanishq Sheikh

শান ইমার কোলে মাথা রেখে সামনের শূন্য দেয়ালে দৃষ্টি মেলে রেখেছে।ইমা অন্য মনস্ক হয়ে শানের চুলে বিলি কেটে যাচ্ছে আর বিরতি দিয়ে গড়ানো চোখের জল নিভৃতে মুছে ফেলছে।ইমার মন জুড়ে ঝড় উঠেছে। ফারহা নামক কালবৈশাখী ঝড়।এ ঝড়ের ভয়াবহতা আন্দাজ করেই শিওরে উঠছে ইমা।ইমাকে নাক টানতে শুনে শান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“এরপর যা বলবো তা শুনে তুমি আমাকে হয়তো মন থেকে নাও মানতে পারো।তবুও আমি বলব।তোমাকে নিজের সকল গোপন কথা বলব আজ।তারপর তোমার যা সিদ্ধান্ত হয় তাই মেনে নেব।” শানের কথা শুনে ইমার হাত থেমে যায় বিলি কাটতে কাটতে।শান ইমার দিকে না ফিরেই ইমা হাতটা টেনে বুকের সাথে শক্ত করে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে।
” এখনই ভালোবাসা থামিয়ে দিও না।আরেকটু সময় দাও আমায়।নিজেকে, নিজের ব্যথাগুলোকে তোমার সম্মুখে উন্মোচিত করার সুযোগ দাও।”
ইমার এবার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।কি বলতে চাইছে শান ইমা জানে না।তবে যায় বলুক ইমা কি পারবে সেটা সহ্য করতে? ইমার মনের ঝড়টা যেন ভাঙতে লাগলো ভেতরটা।ইমা কান্নার জল ঠেলে বিষন্ন মুখে বললো,
” ফারহাকে আপনি বিয়ে করেছিলেন?
কথাটা শুনে শান চমকে গেল কিন্তু মুখ তুলে ইমার মুখোমুখি হতে পারল না।শূন্য দেয়ালে কিছুক্ষণ নিরব তাকিয়ে থেকে শুকনো গলায় বলতে লাগল,
“হ্যাঁ! ” শানের হ্যাঁ সূচক জবাব ইমার হৃদয় বিদীর্ণ করল।দাঁত কামড়ে কান্না সংবরণ করল।কিন্তু শ্বাস প্রশ্বাসের গতি কন্ট্রোল করতে পারল না।দ্রুত গতিতে বাড়তে কমতে লাগল শ্বাস প্রশ্বাস।শান কান্না ঠোঁটে চেঁপে কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বললো,
” পরের বছরই গোপনে খালু আমাদের বিয়ে দিয়ে দেয়।এতো কম বয়সে বিয়েতে ফারহার মত ছিল না।কারন সে বরাবরই উচ্চাকাঙ্খী।তার ইচ্ছা বড় কোনো চাকরীওয়ালা ছেলেকে বিয়ে করার।আমাকে যখন চাইত তখন আমি আর এখন আমির অনেক তফাত। এই আমিকে ফারহার পছন্দ না।সে আমার সাথে সংসার না করার জন্য রোজ রোজ তুচ্ছ বিষয়কে নিয়ে ঝগড়া করত আর খালুর রাগ আমার উপর পড়ত।আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম ফারহার মন যোগানোর কিন্তু যার মনই আমাকে চাই না তার মন যোগানো কোনোদিন সম্ভব না।একে তো আমরা দু’জনই অপরিনত ছিলাম তারউপর হঠাৎই ফারহা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে।এতে করে ওর রাগটা আকাশ সমান হল।আরও খিটখিটে হয়ে গেল।চুন থেকে পান খসলেই মাইর, বকা যেন ওর অভ্যাসে পরিনত হল।আমি সন্তানের আশায় সব মুখ বুঝে সয়ে যেতাম।চেষ্টা করতাম ফারহাকে ভালোবাসতে।হয়ত ভালোবাসাটা হয়েও যেত ওর স্বামী হিসেবে কিন্তু হল না।ফারহা ওর মায়ের সাথে গিয়ে বাচ্চা এবোর্ট করে আসে।আব্বু মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার এতো কেঁদেছিলাম আমি।অনাগত বাচ্চাটার আসার আগেই যেন আমি নিজেকে পিতা বানিয়ে ফেলেছিলাম ওর।সন্তান হারানো পিতার মতো কেঁদেছিলাম।ঐ রাতে আমার মনটা কঠিন হয়ে গেল।এর পর বহুবছর আর কাদিনি আমি।এর কিছুদিন পর খালা যখন ডিভোর্স পেপার সাইন করতে বললো সেদিনও নির্বিকার ছিলাম।চুপচাপ সাইন করে দিয়েছিলাম।খালু এখন আর আমাকে কিছুতেই বাড়িতে রাখতে চাই না।আমার মামা ছিল চোরাকারবারি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমার খোঁজ নিতে এসে দেখে এই অবস্থা আমাদের। তিনি খালুর উপর ফুঁসে ওঠেন। খুব ঝগড়া হয় দুজনের মধ্যে। বড় মামা আব্বুর জমানো টাকার কথা জানতেন সেকথা তুলতেই বড় খালু রেগে যায়।বলেন
” এতোদিন বাড়িতে রেখেছি,পড়িয়েছি,মেয়ের বিয়ে পর্যন্ত দিয়েছি এই হাবাটার সাথে।মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিল বলদ টায়।আবার টাকা চাও।টাকা তো তোমরা দিবা। আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করার দাম দিবানা?”
মামা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,
” বোনের স্বামী না হলে তোরে এই খানেই পুঁতে রাখতাম হারামির বাচ্চা। এতিম বাচ্চা দু’টোরে এমনে কষ্ট দিছোস আল্লাহ তোর বিচার করবো। ”
” আরে বের হও আমার বাড়ি থেকে।উপকারীরে বাঘে খায়।তোমার মতো চোরাকারবারির দুয়ায় আমার বাল হইব।যা বাড়ি থেকে।”
বড় খালি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলেন।মামা রাগারাগি করে নিয়ে আসলেন নিজের বাসায়।জহুরা মামী আগে থেকেই সহ্য করতে পারত না আমাদের। এখনও পারলেন না কিন্তু মামার ভয়ে টু শব্দও করলেন না।মামা বাড়ি থেকে বেরুলেই যা নয় তাই বলতেন।না খাইয়ে রাখতেন।সানাকে দিয়ে সব কাজ করাতেন।আমি যেন নিরব দর্শককে পরিণত হলাম।মামার চোখে আমার এহেন অবস্থা পড়তেই উনি টেনে উনার গদিতে নিয়ে গেলেন।রেগে দুগালে চড় বসিয়ে বললেন,
” ব্যাটা তুই আমার ভাগ্নে মানুষ জানলে থু থু দিব তো? তুই না পুরুষ মানুষ? ঐ ব্যাটা পুরুষ মানুষ হইয়া মুখ নিচু করে থাকোস কেন? পুরুষ মানুষ আল্লাহ ছাড়া কারু নিচে মুখ নিচু করে না।তুই করবি না।করবি ক? রাশেদ মামা চুল টেনে মুখ উঁচু করে ধরলেন আমার।ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলাম।মামা হ্যাঁ না শুনে ছাড়লেনই না।হ্যাঁ বলতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
” আমার পোলা নাই।আজ থেইকা তুই আমার পোলা।আমার ব্যবসা তুই দেখবি।ঠিক আছে?” মামা নিজের গদিতে বসিয়ে দিলেন।সাথে ভর্তিও করে দিলেন কলেজে।মা এসেছিল দেখা করতে এর মাঝে কয়েকবার।একবার সামনে গিয়ে ফিরে এসেছিলাম।এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায়ই আসতেন মামা বাড়ি না থাকলে।আমরা যেতাম না।মা আসে মামা জানতে পেরে মামীকে খুব মেরেছিল।এরপর আর আসেনি মা।তবে তিনি লোক পাঠাতেন মাঝেমধ্যে আমাদের এটা ওটা দিতে।আমরা কিছুই নিতাম না।মামার ব্যবসার হাল ধরলাম আমি।শুরু হল নতুন জীবন।ছোট খালা সব শুনে খুব কাঁদেন। খালু খালা মিলে সানাকে সাথে করে নিয়ে যায়।সানা যাওয়ার সময় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিল।হয়ত জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল কিন্তু আমার কঠিন চেহারা দেখে সে সাহস পায় নি।আমাদের দু’জনের মধ্যে এখন আর আগের মতো সম্পর্ক নেই।চাইলেই ভাইয়া বলে বুকে ঝাপিয়ে পড়তে পারত না।কি এক বাঁধা আমাদের দুরে ঠেলতে লাগল!পাশাপাশি বসেও আগের মতো কথা বলতে পারতাম না।জড়তা এসে গেল দুজনের মাঝে।এরপর সানাকে আমি বুকে জড়িয়ে বলতে পারতাম না ” বোন আমার কাঁদিস না।ভাই আছে তোর সাথে।” সানা চলে যেতেই আমি মুক্ত স্বাধীন হতে লাগলাম।সঙ্গদোষে পড়ে নেশা,মেয়ে এসব যেন অভ্যাসে পরিণত হতে লাগল।মামার যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠলাম তিন বছরের মধ্যে।মানবিকতা, মনুষ্যত্ব নামক শব্দ জীবনের অভিধান থেকে বাদ দিয়ে দিলাম।সবটা জুড়ে শুধু নিষ্ঠুরতা রয়ে গেল।সব রকম অপকর্মের সাথে জড়িয়ে টাকার পাহাড় বানাতে লাগলাম।এর মধ্যে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংএর কোর্সও করে ফেললাম।তখনই রিফাতের সাথে পরিচয়।তারপর খুব ভালো বন্ধুত্ব, রিফাতের মাধ্যমেই এলিনার সাথে পরিচয়।এদের কাছে গেলে একাকিত্বটা দূর হতো আমার।তোমার আর রিফাতের মতো কেউ বোঝে না আমাকে।শান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলে,”মামার ব্যবসা থেকে বেরিয়ে নিজের নামে ব্যবসা শুরু করলাম।বাড়িও করলাম।কাকি- কাকি, মামা- মামিদের নিয়ে উঠলাম সে বাড়িতে।শৌখিনকে আমার বৈধ ব্যবসার সাথে জড়ালাম।সবঠিকঠাক চলছি কিন্তু দুর্ভাগ্যের কপাল আমার।সব ঠিকঠাক কি করে চলে? ফারহা ফিরে আসল।অনুশোচনা কেঁদে কেটে কাকা,মামার পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইল।বড় খালাও আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে বললো।আমি কোনো জবাব দেই নি।ফারহাকে আমি চরম ঘৃণা করতাম।আমার শরীর বিষিয়ে উঠত ওকে দেখলে।বড় কাকা-কাকি সহজ সরল মানুষ, তারা ফারহাকে আরেকটা সুযোগ দিতে বললেন।মুরুব্বিদের কথা রাখতে আবার বিয়ে করলাম ফারহাকে।কিন্তু সংসার ওর সাথে আমার করা হল না এবারও।দু’দিন যেতেই আবার আগের রূপ দেখাতে লাগল।উচ্শৃঙ্খলতা, বেহায়াপনা শুরু করল বাড়িতে।আমি যাই ছিলাম বাড়ির বাইরে ছিলাম।কিন্তু ফারহা বাড়িতেই শুরু করল।পার্টি, আড্ডা, ড্রিঙ্ক এসব চলতেই লাগল।বড় কাকা লজ্জায় ঘর থেকে বেরুনো বন্ধ করল।তাতে ফারহা আরও জমিয়ে নিল অধিকার।এক পর্যায়ে মামীর অনুরোধে আমি ওকে নিষেধ করি এসব করতে।কিন্তু ও মানে না।তার এক কথা ভালো না লাগলে ছেড়ে দাও।তবে বনানীর ফ্লাট আর ৫০ লাখ টাকা তাকে দিতে হবে।ওর কথা শুনে খুব হেঁসেছিলাম সেদিন। কারন ওর ফিরে আসার মতলব অবশেষে বুঝলাম।রাতে বিছানায় যে ভালোবাসা দেখাত এই কথা না বললে আমি হয়ত আর কিছুদিন গেলেই ওর প্রতি আবার দূর্বল হয়ে যেতাম।ভাগ্যিস সেদিন নেশার ঘোরে বলেছিল আসল কথাটা!আমার টনক নড়ল দ্বিতীয়বার।সংসারী হওয়ার অতৃপ্ত বাসনা জাগার আগেই আবার দাফন করে দিলাম।মনকে বোঝালাম সবার কপালে সংসার সুখ হয় না।ফারহাকে ছেড়ে দিলাম।ছাড়ার সময় মুখটা এমন করেছিল যেন চিরদুঃখী ও।বাড়ির সবাই বুঝাল আমাকে কিন্তু আমি আর বুঝতে চাইলাম না।মিথ্যা মায়ায় জ্বলে পুড়ে মরার চেয়ে পাপে জ্বলায় ঠিক মনে করলাম।আবার আগের জীবনে ফিরে গেলাম।একাকি জীবন যার রাতের সঙ্গী নেশা আর মাঝে মাঝে নারী।ডুবেই গিয়েছিলাম মরননেশায়।তুমি জানো ইমা! রাত হলেই বুকের পাঁজরে চাপ অনুভব করতাম।কান্না আসত খুব।নিরবে কাঁদতাম দূর আকাশে চেয়ে।আমার চোখের জল দেখে আল্লাহর দয়া হল।তোমাকে আমার জীবন সাজাতে পাঠিয়ে দিল।যেদিন রাতে তোমাকে প্রথম স্পর্শ করলাম ঐরাতই ছিল আমার জীবনের শেষ অন্ধকারের রাত।ওয়াদা করেছিলাম আর কোন পাপ স্পর্শ করবো না এ পবিত্র হাতে।তোমাকে ছুঁয়ে নিজের পাপ ধুয়েছি আমি।নিজের পাপে জমানো মান সম্মান, অর্থ সবটা ঢেলেছি ধুলোয়।মিডিয়াকে দিয়ে নিজের পাপমোচন করেছি।ভেবেছিলাম তুমি আমাকে মানবে না কিন্তু আমার সব ভাবনা ভুল করে তুমি মেনে নিলে আমাকে।আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন তোমাকে নিজের করে পাওয়া।সব ভুলে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখছিলাম কিন্তু দেখো আবার দূর্ভাগ্য আমাকে ঘিরে ধরল।ফারহাকে আজ এখানে দেখে তোমাকে হারানোর ভয় আমাকে আগের মতো ভীতু সন্ত্রস্ত করে দিল।সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেল ওকে আবার ফিরতে দেখে।আমি জানতাম ও কোনোদিন আমাকে সুখী হতে দেবে না কোনোদিন না।শানের চোখে জল টলমল। ইমার সোজাসুজি নতজানু হয়ে বসে ইমার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললো,
আমি জানি না সব শুনে তোমার সিদ্ধান্ত কি হবে? তবে যাই হোক আমি মেনে নেব।তুমি আমাকে ছাড়তে,,শানের গলায় কথা আঁটকে যায়।ইমা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। শান মুখ তুলে তাকায় না।সাহস পায় না তাকালেই অসহায়ের মতো কেঁদে ফেলবে সে।ইমাকে জোড় করে আজ আর আপন করবে না শান।দরজা খোলার শব্দে বিরবির করে বলে,
” বলেছিলাম না খালা! ইমা সব শুনে মানবে না আমাকে।কোনোদিনই না।” মুখে হাত ঢেকে শব্দ করে কেঁদে ওঠে শান।

মিঞা বাড়ির সবার মুখে একরাশ চিন্তা আর রাগের ছাপ।অহনের কথায় তারা হতবাক।ইমন খেঁকিয়ে ওঠে ছেলের উপর,
” তোর সাহস হয় কি করে এ কথা বলার? ঐ মেয়ে কি করেছে জানিস না?”
” বাবা ও ভালোবেসে ধোঁকা খেয়েছে। ওর কি দোষ বলো? আরেকজনের দোষে ওকে দোষি করো না।”অহনের ব্যাকুল কন্ঠ উপস্থিত কারও মন গলাতে পারল না।সবাই ধিক্কার জানাল অহনের সিদ্ধান্ত শুনে।অহন বড় মিঞার মুখের দিকে তাকালে বড় মিঞা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বলে,
” ঐ মেয়ের আশা ছেড়ে দে তুই নয়ত আমাদের সাথে এই তোর শেষ দেখা।শিখার সাথে তোর বিয়ে হবে।এর অন্যথা হলে তোমাকে আমি ত্যাজ্য করতে বাধ্য হব অহন।” বড় মিয়া চলে গেলেন ঘরে।সাথে ইমন, শাহানুরও।রাগে সবার মাথা টগবগ করছে।ইমনের তো ইচ্ছা করছে ছেলেকে এখানেই মেরে ফেলতে।অহন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।চারপাশে আবার অন্ধকার ঘিরে ধরেছে।আলো কই পাবে সে! বাঁচার আলো হাতরে মরছে অহন।

তোমার আকাশে হব প্রজাপতি
পর্ব ২৭
Writer Tanishq Sheikh

রুবিনা টেবিলে খাবার সাজিয়ে সবাইকে নিয়ে খেতে বসেছে।শান, ইমা পাশাপাশি বসে অথচ কেউ কারও দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছে না।শানের কিছুই ভাল লাগছে না।প্লেটের ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।হঠাৎ আবার কোথা থেকে ফারহা এসে হাজির।শান ছাড়া সবাই বিরক্ত নিয়ে ওর দিকে তাকালেও ও সেটা ভ্রুক্ষেপ করলো না সোজা গিয়ে শানের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।শান ফারহার দিকে না তাকিয়ে ইমার মুখের দিকে বিষন্ন মুখে তাকালো।ইমা মুখটা শক্ত করে দুজনের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হাসি মুখে বললো ফারহাকে বলে,
” আপনি এখানে বসুন।”ফারহা যেন ঈদের চাঁদ হাতে পেল এমন ভাব করল।খুশিতে ডগমগ করতে করতে বসে পড়ল।ইমা সেদিকে তাকিয়ে আবার শানের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায়।শান রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ইমা সেটা উপেক্ষা করে হেসে চুপচাপ সানার পাশে বসতেই শান চেয়ারে লাথি মেরে উঠে রুমে চলে যায়।পিছু পিছু ফারহাও যায়।ইমা দাঁত কটমট করে ভাত চ্যাটকে রাগে হাঁফাতে থাকে ওদের দিকে তাকিয়ে।
শান রুমে এসে চুল মুঠ করে রাগে চিৎকার করে, বিছানায় মাথা নিচু করে বসে।ফারহা তখনই হাসি মুখে পাশে বসে শানের বাহুতে মাথা রাখে।শান ঘাড় ঘুরিয়ে ফারহার মুখটা দেখে ফারহার চুলের মুঠ ধরে তুলে সজোরে থাপ্পড় দেয়।ফারহা ভয়ে থতমত খেয়ে যায়।কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে শান ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দেয় ফারহাকে।তারপর ফারহার মুখের উপর বিকট শব্দে দরজা লাগিয়ে দেয়।
ফারহা গালে হাত দিয়ে পেছন ফিরতেই টেবিলে সবার দিকে তাকিয়ে মুখটা কাচুমাচু করে ফেলে।ইমা ছাড়া বাকি সবাই মুখ ঝামটা দিয়ে উঠে চলে যায়।ইমা মুচকি হেসে ফারহার সামনে দাড়িয়ে বলে,
” থাপ্পড় মেরেছে? ”
ফারহা রাগে কিড়মিড়িয়ে বলে,
” না তো?”
” আরে বইন চিল মার।সত্যি কথা বললে কি হবে? আমি আরও আপনাকে হেল্প করতে পারব।”
ইমার কথা শুনে ফারহা ভ্রুকুটি করে বলে,
” ফাজলামি করো?তুমি তো ওর বউ তুমি আমার কি হেল্প করবা?”
” ও মা! বউ হইছি তো কি হইছে তাই বলে হেল্প করতে পারব না? তাছাড়া আম্মেরে মোর জবর লাগছে। শানের পাশে আপনাকেই মানায়।আমি ঠিক সুট করি না ওর পাশে।”
ইমা মুখ ভঙ্গি দেখে ফারহা কপাল কুঁচকায়। মনে মনে ভাবে এই মেয়ে বলে কি? নিজের পায়ে নিজের কুড়াল মারছে দেখি।নিজের খুশি চেঁপে ধমকে বলে,
” তুমি মজা নিচ্ছ আমার সাথে তাই না? ”
” আরে আফা! মজা তো আপনি নিতাছেন।”
ফারহা রেগে ওঠে বলে,
” কি বলতে চাচ্ছ তুমি?”
” রিল্যাক্স রে বইন।শান কে আমি পছন্দ করি না।ও আমার সাথে চিট করে বিয়ে করেছে আমিও সুযোগ খুঁজছিলাম ওকে শিক্ষা দেওয়া।এই দেখো পেয়েও গেলাম।ও সরি আপনাকে তুমি বলে ফেললাম।”ইমা অপরাধী সুরে ফারহার হাত ধরে চোখ টিপটিপ করে বলে। ফারহা মুখটা স্বাভাবিক করে বলে,।
“ইটস ওকে।তুমিই বলো।বয়স কতোই বা আমার?”
ইমা ভেটকি মেরে বলে,
” হ্যাঁ সেটাই।যেটা বলছিলাম আপনি শানকে আবার চান তাই তো?
ফারহা দৃঢ়তার সাথে জবাব দিল,
” হ্যাঁ অবশ্যই। আপোষে না হলে ভিন্ন উপায়ে হলেও ওকে আমার চাই।”
” গুড! কনফিডেন্স চরম আপনার।ধরে রাখেন সামনে কাজে লাগবে।ইমার প্রশংসায় ফারহা খুশিতে গদগদ হতে গিয়েও মুখটা কঠিন করে বললো
” তুমি কি সিরিয়াসলি আমাকে হেল্প করবা, না মজা নিচ্ছ?চালাকি করে আমার সাথে পারবা না বুঝলা?”ইমা আবার ভেটকি দিয়ে বলে,
” জ্বী আমি জানি আপনি বহুত সেয়ানি।”
” সরি! ইমার কথা শুনে ফারহা চোখ গরম করতেই ইমা হেসে ফারহাকে জড়িয়ে ধরে।
” আরে বইন এইবার সত্য সত্য মস্করা করছি।তুমি তো আমার জামাইর এক্স বউ ছিলা তাই একটু মস্করি করলাম।মাইন্ড খাইও না হুমম।”
ফারহা নিজেকে ইমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে টেবিলে গিয়ে পানি খেল।তারপর ঘুরে দাড়িয়ে বলে
” কাজের কথা বলো।তোমার আজাইরা মস্করি আমার পছন্দ হচ্ছে না।”
” শানের চটকানি তোমার পছন্দ হয়? ইমার ঘার বাকিয়ে বলা তীর্যক কথাটা শুনে ফারহা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে,
” হোয়াট! কি বলতে চাচ্ছ তুমি দেখো মেয়ে,, ইমার দিকে আঙুল তুলতেই ইমার আঙ্গুল আস্তে করে নামিয়ে বলে,
” তুমি তো দেখছি মাথা গরম মাইয়্যা মানুষ।ঐ ব্যাটাও সেইম।তোমরা তো মাথা ফাটাফাটি করে মইরা যাইবা।সংসার কেমনে করবা? ”
” সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।আপোষে কেটে পড় নয়তো ফারহা জানে কি করে কাটাতে হয়।”ফারহার গলায় হুমকির সুর।ইমা তাতে দমে যাওয়ার পাত্রী না।এগিয়ে এসে বলে,
” আমি তো বলেই ছি তোমার সাথে তারে আমি ফিক্স করে দেব।তাই ত বললাম শানের চটকানি অর্থাৎ থাপ্পড় খেতে পারবা কি না?সে তো আগের মতো ভেদা মাছ নাই রে বইন।এখন কথায় কথায় খালি মারে।আমিও খেয়েছি। ইমা মুহূর্তে মুখে একরাশ মেঘ জমিয়ে আনে।সেটা দেখে ফারহা কিছুটা চিন্তিত হয়ে যায়।ইমা বিষয়টা খেয়াল করে স্বান্তনার সুরে বলে,
” চিন্তা করো না আমি তো আছি।বাঁশ কোনদিক দিয়ে যাবে আর বেরুবে কেউ টেরই পাবা না। তুমি শুধু আমার পরামর্শ মেনে চলো।শান লাথি উস্টা দিলেও ওরে একা এক মিনিটের জন্যও ছাড়বা না।যাও এখন গিয়ে দরজা নক করো।”
” আরে এখন না।এখন খুব রেগে আছে গেলে খুব মারবে আমাকে।”ফারহার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে দেখে ইমা আশ্বস্ত করে বলে,
” এমা! আমি ভেবেছিলাম তুমি সাহসী কিন্তু না;তুমি তো খুব ভীতু টাইপ মেয়ে।”
” মানে! কি বলতে চাচ্ছ তুমি?”
” বলতে চাচ্ছি এতো চিন্তা ভাবনা করে ওর কাছে গেলে ওরে পাবা? জীব্বনেও না ঐটা আস্ত একটা ঘাড়ত্যাড়া। ওরে বশ করতে হলে আগে ওর রাগ কমাতে হবে।আর তারজন্য তোমার উচিত সারাক্ষণ ওর পেছন পেছন ঘুরঘুর করা।”
” তুমি ঠিক বলছ তো? ফারহা চোখ ছোট করে ইমার দিকে তাকায়।ইমা চেয়ার টেনে বসে বলে,
” যাচাই করেই দেখো।হ্যাঁ এজন্য কিছু ত্যাগস্বীকার করতে হবে। যেমন ওর মাইর,বকা সব হজম করতে হবে।পারবে তো?
” অবশ্যই পারব।ওকে বশ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার আছে বুঝেছ।শুধু একবার রাগ টা কমাতে পারলেই হলো।তবে এখন আমার কাজ আছে।রাতে আবার আসব।”
” হুম আমিও তো সেটাই বলছি।ওর রাগকে বশ করো।তার জন্য যা করা লাগে করো।তারপর ও তোমার আর আমি মুক্ত স্বাধীন। ইমার ঠোঁটের কোনে হাসি দেখে ফারহা জিজ্ঞেসু চোখে প্রশ্ন করে,
” তুমি শানকে ভালোবাসো না?”
” একটু ও না।আমি চাই তোমরা এক হও।আমি কালই গ্রামে ফিরে যাব।তোমাদের জন্য আমার শুভ কামনা। ইমার চোখ মুখ স্থির, কঠিন হয়ে আসে।মন্থর গতিতে উঠে চলে যায় বাইরে।ফারহার মনে এখন শান্তি লাগছে।শানকে পাওয়া এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার ওর জন্য। পথের কাটা আপনিতেই সরে গেছে বিষয়টা খুবই এক্সাইটিং ফারহার জন্য।
রাতে সবাই খেলেও শান খেল না।সে দরজায় খুললোই না রুমের।খাওয়া শেষে যে যার রুমে শুতে চলে গেল।ইমা দেখল ফারহা বাড়ি চলে যাচ্ছে। ইমা ফারহাকে টেনে এনে বললো,”কই যাচ্ছ আমার স্বামীর এক্স বউ?”
” বাড়িতে! আবার সকালে আসব।”
ইমা কপাল চাপড়ে বলে,
” তুমি এতো বোকা কেন বলোতো? তোমার এক্স স্বামী মানে হবু স্বামীকে এভাবে একা ফেলে চলে যাবা?”
ফারহা যেন ইমার ইশারা বুঝতে পেরে হেসে বললো,” হ্যাঁ তাই তো? তো কি করা উচিত এখন আমার? ”
” দরজায় নক করো।খুললেই ডিরেক্টর ভেতরে চলে যাবা। অল দ্যা বেস্ট! গো।”ফারহা দু’সেকেন্ড না ভেবেই শানের দরজায় কড়া নাড়ল।শান সাড়াশব্দ করল না দেখে ফারহা ঘাড় ঘুরিয়ে ইমার দিকে মুখ চুপসে তাকাল।ইমা ইশারায় অনেক জোরে জোরে ননস্টপ নক করতে বললো।ফারহাও তাই করল।শান বিরক্ত হয়ে দরজা সামান্য খুলে মুখ বের করে ফারহাকে দেখে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে।ফারহা ইমার ইশারায় শানের হুঙ্কারের তোয়াক্কা না করেই ভেতরে ঢুকতে চাইল কিন্তু সেখানেই ঘটল বিপত্তি। শান আবার কষাল চড় ফারহার গালে।ফারহা চড় খেয়ে দূরে ছিটকে পড়ল।ইমা ছুটে গিয়ে উঠাতে উঠাতে বিশাল দুঃখী ভাব নিয়ে বললো,
” দেখলে তো কেমন জালিম এইটা।মনে একটু দয়া মায়াও নেই।ঘরে একটু রাখলে কি হতো?” ইমাকে ফারহার সাহায্য করতে দেখে শান এগিয়ে আসে। রেগে ইমার মুখোমুখি দাঁড়ায়।
” ওর সাথে এতো মাখামাখি কিসের তোমার?”
শানের আচমকা জেরার মুখে ইমা আমতা আমতা করে বলে,
” মানবিকতা বলতে তো কিছু আছে নাকি? আপনি এই অসহায় মেয়েটাকে,,ইমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শান ব্যাঙ্গ করে বলে,
” অসহায় মেয়ে! ওহ রিয়েলি?ইমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ফারহার দিকে তেড়ে গিয়ে বলে,”তুই বাড়ি না গিয়ে এখানে কি করছিস? আমার সাথে ঘুমাবি এজন্য নক করেছিস?”
শানের কথা শুনে ফারহা মুখে হাসি এনে মাথা নাড়ায়।শান ঠোঁট বাকিয়ে হেসে পরক্ষনেই চোয়াল শক্ত করে ফারহার বাহু এতোজোরে ধরে যে ফারহা ব্যথায় আহ করে ওঠে।
” আমার সাথে ঘুমানোর খুব শখ তোর? চল! শান ফারহাকে টানতে টানতে সদর দরজার বাইরে ছুড়ে ফেলে বলে,
” চুপচাপ বাড়ি চলে যা।নয়ত এখনই তোকে খুন করে ফেলব। যা! শানের চিৎকারে ইমা চমকে ওঠে।ফারহা সামনে ঘুরে দ্রুত প্রস্থান করে সেখান থেকে।শান দরজা লাগিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে ইমার সামনে এসে বলে,
” খুব মানবিকতা দেখানো শিখেছ দেখছি।এরপর ওর সাথে মানবিকতা দেখাতে দেখলে তোমার খবর আছে।”
“কথায় কথায় হুমকি দেবেন না তো!আমাকে ভয় দেখানোর দিন শেষ আপনার বুঝলেন।বেশি ধমকাবেন তো সব লিখে নিয়ে আপনাকে ফকির বানিয়ে দেব।ইমা অন্য দিকে মুখে ঘুরিয়ে বলে আড়চোখে তাকায়।তা দেখে শান মৃদু হেসে চোয়াল শক্ত করে বলে,
” তোমাকে কষ্ট করতে হবে না সেজন্য। আমার যা তার ৬০% তোমার নামেই উইল করা।যখন খুশি নিয়ে মুক্ত হতে পারো।”
ইমা নাক ফুলিয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলে,
” এক্স বউকে দেখে তর সইছে না বুঝি?”
” সরি!আবার বলো কি বললে?”শান রাগে নাক মুখ কুঁচকে এগিয়ে আসে।
“বলতে ভয় পায় নাকি? ” ইমা ঢোক গিলে জবাব দিতেই শান একদম মুখোমুখি এসে বলে,
” হ্যাঁ তো বলো!”
” বলেছি এক্স বউকে সামনে পেয়ে আমাকে মুক্ত করার জন্য খুব উতলা হয়ে যাচ্ছেন দেখছি? সহ্য হচ্ছে না বুঝি?”
শানের কপালের রগ দপদপ করছে রাগে।কপাল টিপতে টিপতে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার ইমার মুখোমুখি দাঁড়ায়।
” ছি! ইমা ছি! এতো নীচ হয়ে গেলাম আজ আমি তোমার কাছে।এতোই খারাপ বানিয়ে দিলে? ভেরি গুড।”শান আর দাঁড়ায় না।রাগে ক্ষোভে মাথা ধরে আসছে শানের।দ্রুত রুমে চলে যায়।ইমা নিঃশ্বাস থামিয়ে এতোক্ষন চুপচাপ দাড়িয়ে ছিল।শান যেতেই জোরে জোরে শ্বাস প্রশ্বাস ছাড়ে।ঠোঁট উল্টে শানের দরজায় তাকিয়ে বলে,
” উচিত কথা বললে ছি!হু।আমাকে ছাড়ার জন্য নিজে যে মরে যাচ্ছে তাতে কিছু না।”
রুম থেকে তা শুনে গর্জন করে ওঠে শান
” ইমা ফর গড সেক জাস্ট শাট আপ।”
ইমা শানের ধমকে ভেংচি কেটে তাড়াতাড়ি সানার রুমে চলে আসে।ইমাকে এ ঘরে দেখে সানা ব্যথিত সুরে বলে,
” ভাবি এমন কেন করছ আমার ভাইয়ের সাথে?আর কতো পরীক্ষা নেবে তোমরা তার।সেও তো একটা মানুষ।আর কতো সহ্য করবে সে? এমন করো না প্লীজ ভাবি।”
” আরে তুমি এসব ইগনোর করো তো! আমাদের পারসোনাল বিষয় তুমি বুঝবা না।তুমি আমাকে বলো অহন ভাই কল করেছিল?”
” না ভাবি।”
সানার মলিন মুখটা দেখে ইমা সানার কাঁধে হাত রেখে বলে,
” তুমি কল করেছিলে?”
” হুমম! সে ধরে নাই।তুমি তাকে কল করে বলো আমার জন্য যেন সে নিজের পরিবারের সাথে সম্পর্ক নষ্ট না করে।”ইমা সানার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
” তোমরা দুই ভাইবোনই এক ধাঁচের। নূন্যতম স্বার্থ তোমাদের মধ্যে আমি দেখি না।এজন্যই শিক্ষা দরকার তোমাদের। আর শোনো তুমি আমার ভাবি হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে থাকো তো।বাকিটা আমি দেখছি।দাও মোবাইলটা দাও।”ইমা মোবাইল নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।সানা সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসে থাকে স্থির দৃষ্টিতে।

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে