তোমার আকাশে হব প্রজাপতি
পর্ব ০১+২+৩
Writer Tanishq Sheikh
মিঞা বাড়ির বড় ছোট সবাই মনের মধ্যে হাজারো খুশির স্বপ্ন নিয়ে লঞ্চে ওঠার জন্য প্রস্তুত নিচ্ছে।এ বাড়ির জীবনেও যারা ঢাকা যায় নি তারাও আজ যাচ্ছে স্বপ্নের শহরে।চারদেয়ালের গন্ডির বাইরে এই প্রথম দূরে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে মিঞা বাড়ির বউ ঝি রা।এজন্য অবশ্য মিঞা বাড়ির ছোট মিয়া ইমন মিঞার মেয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ তারা।কারন আজ ইমন মিঞার একমাত্র মেয়ের বিয়ে উপলক্ষেই তাদের সে সুযোগ হচ্ছে।কট্টর রক্ষণশীল পরিবার মিঞা পরিবার।বাড়ির বউ ঝি সবাইকেই পর্দা এবং কঠিন অনুশাসন মেনে চলতে হয়।বড় মিঞা আফতাব আহমেদ এবং তার মেঝো বোন শাহনুরের কথা এ বাড়ির জন্য অলঙ্ঘনীয় নিয়ম।এর হের ফের মিঞা বাড়িতে কোনোদিনই হয় নি।এ বাড়ির মেয়েদের ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।ইমার গত মাসে ১৮ হয়েছে এবং ঐ দিনই পূর্বনির্ধারিত ছেলের সাথে আংটিবদলও হয়ে গেছে।বিয়ে হতে একসপ্তাহ বাকি।ছেলেপক্ষের অনুরোধ ছিল তারা বিয়ের ভেন্যু ঢাকার বড় কোন কমিউনিটি সেন্টারে রাখতে চাই।একমাত্র ছেলে বলে তাদেরও কিছু খায়েশ আছে।বড় মিঞা কুটুমদের কথা গুরুত্বের সাথে নেন।মেয়ের কুটুমের পা ধুয়ে খাওয়া ছাড়া সকল আর্জিই তিনি রাখেন।এ ক্ষেত্রে তার পার্সোনালিটি কিছুটা ব্যতিক্রম হয়ে যায় যা বাড়ির লোকের কাছেও আশ্চর্যের।ইমা এই জিনিসটারই সুযোগ নিয়েছে।কৌশলে আবিরকে বুঝিয়ে তার পরিবারকে দিয়ে বড় আব্বাকে রাজি করিয়ে ঢাকায় বিয়ের ভেন্যু করিয়েছে।ইমা চাই মা চাচিদের একটু আনন্দ দিতে।পৃথিবী না ঘোরাতে পারুক অন্তত ঢাকা শহরটাই দেখাবে।যাত্রা পথের এই আমেজ,খুশি,মুক্ত হাওয়া সবকিছুর আস্বাদন দিতে চাই তাদের।কালো সাদার প্রিন্টের বোরকা পড়া নেকাবের মাঝের এক জোড়া চোখ দিয়ে ইমা মা চাচি ফুপুদের চোখের ঝলমলে খুশিটা দেখছে।ইমার চোখে জল এসে যায় ওদের খুশি দেখে।
“- কি রে দাড়িয়ে আছিস কেন এভাবে?
হঠাৎ পেছন থেকে শাহানুর ফুপুর ঝাঝালো গলার আওয়াজে ইমা চমকে ওঠে। চোখের কোনের জল মুছে পেছন ঘুরে তাকিয়ে ফুপুকে সালাম দেয়।অতি মোলায়েম স্বরে বলে,
“- জ্বী! লঞ্চ আসে নি তাই একটু হাটছি এদিকে।
“-বিয়ে না হতেই পাখনা ফড়ফড়াও? তুমি যে কি করতাছো তা মনে করো বুঝি নাই।শাহানুরের চোখ ফাঁকি দেওয়া?ইমা ফুপুর কথা শুনে ভয়ে শিওরে ওঠে।আমতা আমতা করে বলে,
“- কি করেছি ফুপু!
“- একটা চটকানি দিয়ে পদ্মার জলে ফেলে দেবো যদি নাটক করিস।হবু জ্বামাইরে নাচাও? ঢাহা দেখবার শখ জাগছে মা চাচি গো নিয়া।মনে করো এসব জানি না আমি।
“-ফুপু বিশ্বাস করুন! আপনি যা ভাবছেন তা নয়?
“- চুপ কর! হারামজাদী বদ!কমু ভাইজান রে? ইমার বাহু চেপে ধরতেই ইমা ব্যথায় আহ করে ওঠে।
“- ফুপু আপনার পায়ে পড়ি।বড় আব্বারে বলবেন না।আমি শুধু,,
“- তোর শুধু আমি বুঝছি ছেমরি।দুইদিনের ছেমরি হইয়া মোর চক্ষে ধুলা দাও।এই ছেরি এই!মোরে কি তোর পাগল লাগে?
“- না ফুপু! ব্যথায় কাঁদতে কাদতে বলে ইমা।
“- তালি পরে এসব করার সাহস কেমনে পাও?আবিরের জোরে? কিন্তু তোর আবির তো সব বলে দিল মোরে।মনে রাখবি বিয়া তুই করলেও জ্বামাই আমাগের হাতের পুতুলই।যে ফিলি চালাবো সেই ফিলিই চলবো।বিয়ের আগে কি পরে।পাঙ্খা তোর কোনোদিনই গজাবে না।আর যদি চালাকি করছিস তুই,,
“- আর করবো না ফুপু! আপনার পায়ে পড়ি।
“- ওঠ! খাড়া! সোজা ফিলি কচ্চি কানে ঢুকায় নে। এই বার তোরে মাফ করে দিলাম পরের বার তা হবে না।গলায় কলসী বাধে পদ্মার জলে ফেলে দেবো।বুঝছিস?
শাহানুরের ধমকে ইমা ভয়ে কেপে ওঠে। হিচকি টানতে টানতে বলে,
“- আর করবো না ফুপু।আর না।
“- যা! এই শোন! চোখ মুছে চুপচাপ গিয়ে লঞ্চের জন্য দাড়ায় থাকবি।
“- জ্বী!
ইমা তাড়াতাড়ি চলে যায় কান্না চেপে।বাহুটা ব্যথায় টনটন করছে ইমার।শাহানুর ইমাকে ভয় পাইয়ে বিজয়িনীর হাসি হেসে পান খাওয়া লাল ঠোঁট বাকিয়ে ইমার পিছু পিছু আসতে থাকে।
পূর্বে রিজার্ভ করা লঞ্চ অবশেষে আসে।বাড়ির সবাই উঠে গেলে ইমাও উঠতে চাই কিন্তু শাহানুর ইমার হাত শক্ত করে চেপে নিজের সাথে নিয়ে পাশাপাশি বসে।ইমা ভীতু চোখে চুপচাপ মাথানিচু করে ফুপুর পাশে বসে থাকে।ছোটরা সবাই লঞ্চে মজা করছে।ইমাকে কয়েকবার চাচাতো ছোট ভাই মৃদুল ডাকতে আসলেও শাহানুরের সাড়া না পেয়ে ইমা যায় নি।লঞ্চ এখন পদ্মার মাঝামাঝি। ইমার মন চাচ্ছে উছলে পড়া পদ্মার জলে সলিল সমাধী হতে।না পাবে দেহ কেউ না পাবে খোঁজ। এমন কাঁটাতারে আটকে থাকা প্রজাপতির মতো বন্দী হয়ে ধুকে ধুকে কার ই বা বাঁচতে ইচ্ছা হবে।ভেবেছিল আবিরের সাথে নতুন করে জীবন শুরু করবে কিন্তু সেই আবিরও তো এদের হাতের পুতুল।ইমার আর মুক্তি নেই।কোনোদিন না।ইমা ভবিষ্যত ভেবে আরেকদফা কেঁদে ভাসায় সবার আড়ালে।সবার চোখে ধরা না পড়লেও বড় মায়ের চোখে ঠিকই ইমার কান্নাভেজা চোখ দুটো ধরা পড়ে।এগিয়ে এসে শাহানুরকে বলে,
“-শাহানা! ইমাকে সাথে নিয়ে গেলাম।
“- ক্যা! এখানে বসে আছে ভালো আছে।তুমি তোমার কাজ করো গে।
“-আজ বাদে কাল পরের বাড়ি চলে যাবে।এখন তো এমন করো না।ছাড়ো মেয়েটাকে একটু ঘুরুক গিয়ে উপরে।
বড় ভাবির কথার পাল্টা জবাব দেওয়ার আগেই বড় বউ মোমেনা শাহানার কাছ থেকে জোর করে ইমাকে উঠিয়ে উপরে যেতে বলে।ইমা ফুপুর আজ্ঞা ছাড়া যায় না।চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে।শেষমেশ শাহানুরও গম্ভীরমুখে বলে,
“- যা! যতো আলো বাতাস খাওয়া লাগে খেয়ে আয়।ইমা আস্তে আস্ত সিড়ি বেয়ে লঞ্চের ছাঁদে এসে দাঁড়ায়। চারিদিক থেকে হু হু করে বাতাস এসে গায়ে লাগছে। ইমার একবার মনে হলো ঝাঁপ দেই এই গভীর জলে।কিন্তু সে সাহসও পেল না।মরতেও যে সাহসের দরকার হয়। তাছাড়া মা বাবা অহন ভাই যে ওকে ছাড়া মরেই যাবে।দুবাহু বুকে ভাজ করে ইমা নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। হঠাৎ কেউ এসে গলা পেচিয়ে ধরে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।ইমা অশ্রু ভেজা চোখে সেদিক তাকাতেই অহন ইমার গলা ছেড়ে দেয়।বোনের মুখ থেকে নেকাব সরাতেই ইমা ঝাপিয়ে পড়ে ভাইয়ের বুকে।ডুকরে কেঁদে ওঠে।অহনের রাগে চোয়াল শক্ত হয়।ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“- আবার বকেছে ফুপু?
ইমা জবাব না দিয়ে শুধু কাঁদতেই থাকে।অহন বোনের মুখটা আজলা ভরে উঁচু করে চোখ মুছিয়ে কপালে চুমু দেয়।তারপর বুকে ইমার মাথা ঠেকিয়ে বাহু ধরে বলে,
“- কাদিস না! আর তো কটা দিন।বিয়ের পর তুই তো ঢাকা চলে আসবি।মুক্ত স্বাধীন জীবন তখন।আমিও তোকে দেখতে আসবো দু একদিন পরপরই।তোকে সব জায়গা ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন,টিএসসিতে, আহসান মঞ্জিল,পুরানো ঢাকার বুড়িগঙ্গার পাড় আরও অনেক জায়গা।আবিরকে বলে ঢাকার বাহিরেও ঘুরবো হুমম।আবিরকে তো বলেছি আমার বোনের মতো মেয়ে ও ঢাকা শহর ফালাফালা করলেও পাবেনা ।ঠিক বলেছি না?
ইমা মৃদু হেসে ভাইয়ের দিকে চেয়ে আবার ভাইয়ের হাতে মাথা ঠেকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে দূর আকাশের শূন্যে চেয়ে থাকে।ভাই কে আবিরের সত্যিটা বললে ভাইও চিন্তা করবে।বিয়ে ভাঙা নিয়ে সবার সাথে ঝগড়া করবে।বড় আব্বার মার খেতে হবে তখন ভাইকে।না! ইমা তার প্রিয় ভাইকে কখনোই আঘাত পেতে দেবে না।ইমা লঞ্চের ছাঁদে ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে বসে দূরের অথৈ জলের উপর রোদের খেলা দেখছে।মনটা এখন কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে।আশেপাশে কাজিনরা বসে গল্প করছে। ইমার ছোট ফুপুর ছেলে মৃদুল এসে অহনের গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করে বসে।
“- ও অহন ভাইয়া একটা গান শোনাও না।
“- তোর বড় খালা শুনলে কল্লা কেটে গাঙে ভাসিয়ে দেবে মনু।
“- মোরা বরিশাইল্লা মনু।মোগো কইলজ্জা বাঘের মতোন।ওসব মাইয়্যা মাইনষেরে কি ডরাই নি?
মৃদুলের পাকা পাকা কথা শুনে অহন ইমা ভ্রু সরু করে ফিরে তাকায়।অহন মৃদুলের কান ধরে বলে
“- আচ্ছা!ডাকবো ফুপুজানকে?
“- ওরে সুবহানাল্লাহ!না!না!মুই তো একসের মজা করছি।হি হি হি।মৃদুলের দাঁত কেলিয়ে হাসা দেখে ইমা খিলখিল করে হেসে ওঠে।অহন মুগ্ধ হয়ে বোনের হাসি দেখে।ইমা হাসলে গালের দুপাশে সামান্য টোল পড়ে তাতে ইমাকে আরও মায়াবী লাগে অহনের।বোনের মুখটা কাছে এনে কপালে চুমু দিয়ে বলে
“- আমার বোনের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তোর আবদার মেনে নিলাম যা গিটার নিয়ে আয়।এটা অহনের পক্ষ থেকে গিফট বুঝেছিস বরিশাইল্লা মনু।
“- ইয়েএএ! এই তোরা সবাই এদিকে এসে বস।ভাই আমি দৌড়ে নিচ থেকে গিটারটা নিয়ে আসি।
“- যা!মৃদুলের দৌড়ে নিচে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ইমা মুচকি হাসে।তা দেখে অহন ইমারকে বলে”- বাবু!
“- হুম!ভাইয়া
“- কোনটা গাবো বল বাবু।
“- ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে এটা।
“- বাহ! আবিরের সঙ্গতে এ কদিনেই এতো রোমান্টিক হয়েছিস।কিপ ইট আপ বাবুটা আমার।ইমার এক গাল টেনে হেসে বলে অহন।
“- যা! তুই না ভাইয়া।লজ্জা নেই তোর।
“- হা! হা! হা! আরে কই যাস।বস আর কিছু বলবো না।ইমার হাত টেনে পাশে বসায় অহন।
“- হুমম!
মৃদুল দৌড়ে গিটার এনে অহনের হাতে দিল।অহন চোখের চশমাটা ঠিক করে গিটারে ঝঙ্কার তুলে গাইতে শুরু করলো।ইমা লজ্জায় নত মস্তকে নিচে তাকিয়ে আবিরকে স্মরণ করে গানের প্রতিটি লাইন অনুভব করছে।
“-ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে,
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে..
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো তোমার চরণমঞ্জীরে,
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে..
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি তোমার প্রাসাদপ্রাঙ্গণে,
মনে করে সখী বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী তোমার কনককঙ্কণে..
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে,
আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো তোমার অলকবন্ধনে..
আমার স্মরণ শুভ সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো তোমার ললাটচন্দনে,
আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো তোমার অঙ্গসৌরভে..
আমার আকুল জীবনমরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো তোমার অতুল গৌরবে,
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে..
|
|
লন্ডনের একটি বিলাসবহুল হোটেলে বিছানা সঙ্গীনির বাহুডোরে অতি ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত কাটিয়ে শাওয়ার নিয়ে হোটেল রুমের ব্যালকনিতে কফি হাতে এসে দাঁড়ালো ঢাকার টপ বিজনেসম্যান শান নিহান খান।হাত দিয়ে ব্যাক ব্রাশ করা রেশমের মতো এলোমেলো ভেজা সিল্কি চুল,একজোড়া কালো সরু ভ্রুর নিচে বাজের মতো তীক্ষ্ণ চোখ,লম্বা নাকের নিচে হালকা গোলাপি ঠোট,খোঁচা খোঁচা ঘন চাপ দাড়ির এই সুদর্শন পুরুষের বিছানা সঙ্গী হতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবতীই মনে করছে শানের বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে থাকা ব্রিটিশ তরুণীটি।শান কফি খেতে খেতে দূরের সুউচ্চ ইমারত,টেমস নদীর ধারা দেখতে লাগলো তীক্ষ্ণ কঠিন নয়নে।মোবাইলের রিংটোনের শব্দে রুমে ফিরে এসে মোবাইল রিসিভ করে আবার আগের জায়গায় এসে দাঁড়ায়।মোবাইলের ওপাশ থেকে চাচাতো ছোট ভাই শৌখিনের স্ত্রী ইরা কিছুটা ভয় নিয়ে শান্ত গলায় বলে,
“- আসসালামু আলাইকুম ভাই!
“- ওয়ালাইকুম আসসালাম ইরা! কেমন আছ তোমরা?
“- জ্বী ভাই আলহামদুলিল্লাহ! ভাই একটা সমস্যার জন্য আপনাকে কল করলাম।ডিস্টার্ব হোন নি তো?
“- ইভরিথিং ইজ ওকে ইরা? তোমার কাজিনের বিয়ে নিয়ে কোনো সমস্যা?
“-ব্যাপারটা তা নয় ভাই।আসলে সমস্যা সানা কে নিয়ে।
“- সানা! কি হয়েছে ওর।ইরা আমার বোন ঠিক আছে তো? শান মুহুর্তে অধৈর্য হয়ে ওঠে।চিৎকার করে ওঠে ইরার উপর।
“- ভাই রিলাক্স! সানার কিছু হয় নি। আসলে
“- আসলে কি!
“- ভাই আপনি কি ভাবে নেবেন?
“- ইরা এভাবে কথা বলা কিন্তু আমি পছন্দ করি না।যা বলবে স্ট্রেইট বলো।
শানের ধমকে ইরা আমতা আমতা করে বলে,
“- জ্বী! ভাই সানাকে ইদানিং খুব আপসেট লাগছে।কাল সারাদিনে বহু বলে কয়ে এক গ্লাস জুস খাওয়াতে পেরেছি আজ দুপুর হতে চললো অথচ রুমের দরজা বন্ধ করে না খেয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। ভাই আপনি প্লিজ তাড়াতাড়ি আসুন।সানা আমাকে কিছুই বলছে না।
সানার অস্বাভাবিক আচরনের কথা শুনে শানের হাত কাঁপতে থাকে।বোনকে জীবনের অধিক ভালোবাসে শান।কাঁপা গলাটা ঝেড়ে নিজেকে সামলে নিল শান।ইরা শানের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করে বললো,
“- ভাই আর ইউ ওকে?
“- ইয়াআ! আ’ম ফাইন।শোনো ইরা।সানাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করো না।আমি আজ রাতের ফ্লাইটেই ঢাকা ফিরছি।
“- জ্বী! আচ্ছা ভাই রাখি তাহলে।
“- হুমম।
শান দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে নিল।সানাকে কয়েকবার কলও করলো এর ফাঁকে কিন্তু সানা রিসিভ করলো না।শানের বুক কাঁপছে।শান পৃথিবীর সবার কাছে ইস্পাতের হলেও সানার সামান্য কিছুতেই গলে মোম হয়ে যায়।বোনই যে একমাত্র আপন শানের।এতো পরিশ্রম করে জমানো অঢেল সম্পদ গড়েছে সবই বোন আর পরিবারের জন্য।সেই বোনের মনে শান্তি নেই? না এটা মেনে নেবে না শান।বোনের মনের শান্তির জন্য দরকার হলে দুনিয়া উলোট পালট করে ফেলবে।তবুও সানাকে খুশি দেখতে চাই শান।শানের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে সানার মনের অবস্থা ভেবে।সম্ভব হলে এখনই ছুটে যেতো কলিজার টুকরা বোনের কাছে।বডিগার্ড দের মোবাইল করে সব রেডি করতে বলে। একরাতের মূল্য চুকিয়ে শান বিছানায় শোয়া ব্রিটিশ তরুনীকে একপ্রকার জোর করে রুম থেকে বের করে দিয়ে প্যাকিং শেষ করালো কর্মচারী দিয়ে।তারপর বডিগার্ড সহ বের হয়ে আসলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে,,,
চলবে,,,তোমার আকাশে হব প্রজাপতি
পর্ব ০২
Writer Tanishq Sheikh
ইমাদের লঞ্চ ঘাটে এসে থামলো।বড় মিঞার আদেশে ইমন মিঞা, অহন, বড় ফুপা আলিম,ছোট ফুপা মনিরের তদারকিতে সবাই নেমে ঘাট থেকে উপরে উঠলো অপেক্ষমান গাড়ির জন্য।রাস্তায় এসে সবাই বিস্মিত হলো।মৃদুল হা করে সারি দেওয়া ওডি গুলো গুনলো
“- ১,২,৩,৪,৫,ওরে সুবহানাল্লাহ এ দি ৬টা গাড়ি।ও ইমা আপু আবির দুলাভাই দেহো গাড়ি পাডাইছে।
“- কি বলছিস? আমাকে তো এসব কিছু বলে নি।ইমা নিজেও আশ্চর্য হয়।
“- সারপ্রাইজ দিলো। ফিল্মে দেখো নাই হিরো হিরোইনকে এভাবেই তো সারপ্রাইজ দেয়।
“- চুপ কর।বেশি পেকে গেছিস।
বাড়ির ছেলেরা কপাল কুঞ্চিত করে এগিয়ে যেতেই বড় জামাতা শৌখিন এসে বড় মিঞা আফতাব সহ বাড়ির বড়দের সালাম করে কুশল বিনিময় করে।জামাতাকে এ সময় এখানে মোটেও আশা করে নি বড় মিঞা। বড় মিঞা মনের বিস্মিত ভাব গোপন করে শৌখিনকে জিজ্ঞেস করলো,
“- তা জামাই বাবাজি এখানে আপনি?
শৌখিন সৌজন্যের হাসি হেসে উত্তর দিলো,
“-আপনাদের নিতে আসলাম।চলুন।
“- এ কি বলছ বাবা!আমরা তো আগেই গাড়ি ঠিক করেছি।হয়তো জ্যামে আটকে গেছে চলে আসবে।
“- সব ক্যান্সেল। আমি তাদের না করে দিয়েছি।এখন চলুন আব্বা! ইরা সহ বাড়ির সবাই আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
“- না! এসব কি করে সম্ভব। তুমি জানো বাবা আমরা আগে থেকে সব ভাড়া করে রেখেছি।হোটেল, গাড়ি, কমিউনিটি সেন্টার সব বুকিং করা।
“- হুমম জানি আব্বা।কিন্তু ভাইয়ের আদেশ আপনারা ঢাকা ভাড়া বাসা বা হোটেল কোথাও থাকতে পারবেন না।আমাদের সাথে থাকবেন যতোদিন ইমার বিয়ে না হয়।বিয়ের সকল আয়োজন আমাদের বাংলো বাড়িতেই হবে।
“- এ হয় না বাবা! মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে এতো লোক থাকবে।না! বাবা।বড় মিঞা ইতস্তত হয়ে বলে।
“- আব্বা প্লিজ।আমি তো আপনার ছেলের মতো।আর বাবাও বলেছে শৌখিন! বেয়াই সাহেবদের না নিয়ে বাড়ির তৃ সীমানায় ঢুকবি না।আপনি তো জানেন আব্বা! শান ভাই কতো রাগী।তার কথা না রাখলে মাইন্ড করবে।প্লিজ আব্বা এই জামাইকে ছেলে হওয়ার সুযোগ দিন।না করবেন না প্লিজ।
শৌখিনের পিড়াপীড়িতে বড় মিঞা অনিচ্ছা স্বত্বেও রাজি হলো।বাড়ির বউ বাচ্চাদের এজন্য খুশির সীমা নেই।যদিও মুখে এ খুশি প্রকাশ করার সাহস তাদের নেই। কারন ইরার সাথে সময় কাটাতে পারবে।বাচ্চারা খুশি কারন বড় আব্বা কুটুম বাড়ির লোকের সামনে কখনোই তাদের বকবে না।ইচ্ছা মতো আনন্দ করতে পারবে।সবাই গাড়িতে উঠে বসে।ইমা, অহন, মৃদুল, শিখা গাড়িতে ওঠে।শিখাকে অহন কিছুইতেই সাথে নিতে চাচ্ছিল না কিন্তু বড় ফুপুর আদেশে নিরুপায় হয়ে নিতেই হলো সাথে।গাড়িতে ওঠার মিনিট দুয়েক বাদেই অহনের মোবাইলে কল আসে।অহন ইমাকে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা আবিরের নামটা দেখি ভ্রু নাচায়।ইমা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে হাসে।অহন মোবাইল রিসিভ করে বলে
“- কি খবর আবির সাহেব! এতোক্ষনে আমাদের কথা মনে পড়লো?
আবির লজ্জিত গলায় জবাব দেয়,
“- আরে ভাই কি যে বলেন?আপনাদের কথা তো সবসময়ই মনে পড়ে।
“- আচ্ছা! এ তো খুব ভালো কথা তাহলে।তারপর কি হালচাল তোমার?
“- এই তো ভাই আলহামদুলিল্লাহ।আপনি কেমন আছেন।বাড়ির সবাই কেমন আছে?
“- হ্যাঁ বাড়ির সবাই তো ভালো শুধু একজন? ইমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে অহন।
“- কোনো সমস্যা ভাই?
“- আরে না! না! নাও ইমার সাথে কথা বলো।
আবিরের সাথে কথা বলার জন্য মোবাইল টা কানে নিতে বুকে ধুকপুকানি শুরু হলো ইমার।অস্থিরতা বাড়ে সাথে অস্বস্তিও কারন আশেপাশে সব ভাই বোন বসা।ইমা জানালার দিকে মুখ করলেও এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে গাড়ির সবাই ওর দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
“- ইমা! কেমন আছো?
“- জ্বী আসসালামু আলাইকুম।আলহামদুলিল্লাহ।
“- ওয়ালাইকুম আসসালামু। তুমি জানো তোমাকে আমার কেন এতো পছন্দ হয়েছে?
“- উ হু! কাজিনদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে জড়তা নিয়ে জবাব দেয় আবিরকে।
“- তোমার ধার্মিকতা দেখে।মিথ্যা বলবো না তোমাকে প্রথমবার দেখেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।তোমাকে তো আগেই বলেছি জীবনে কখনোই কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলেও দেখি নি।অথচ তোমাকে ঐ দিন দেখতে এসে তাকিয়েই ছিলাম।আস্তে আস্তে তোমার শান্ত, নমনীয় স্বভাব,মিষ্টি ভাষা আর এই ধার্মিকতা দেখে জাস্ট প্রেমে পড়ে গেছি।সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানায় তোমার মতো একটা লক্ষি বউ আমার মতো অধমকে উপহার দিল।সত্যি আমি লাকি।
আবিরের কথা লজ্জায় ঠোঁট চেপে রেখেছে ইমা।কি বলতে হয় এমন কথার জবাবে ইমার জানা নেই।তবে সত্যি অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে মনে।আচ্ছা এটাই কি ভালোবাসার আগমনি সংকেত।
“- হ্যাঁলো ইমা শুনছ?
“- জ্বী!
“- আমিই সবসময় বকবক করি আর তুমি চুপ থাকো এটা তো ঠিক না। আমারও তো ইচ্ছা জাগে হবু স্ত্রীর মুখ থেকে রোমান্টিক কথা শুনতে।বলো না।
“-কিভাবে বলবো।আশেপাশে সবাই বসে আছে তো।
ইমা আবিরকে কথাটা ফিসফিসিয়ে বললেও ইমার বড় ফুপুর মেয়ে শিখা এতোক্ষন আড়ি পেতে সব শোনার চেষ্টা করছিল।ইমার শেষ কথা শুনে মুখ বাঁকিয়ে হেসে বলে ওঠে,
“- ওওওও বর কনের রোমান্টিক কথা বলতে বুঝি ডিস্টার্ব হচ্ছে। অহন ভাই গাড়ি থামাও আমরা নেমে যাই।আমাদের কনে আরামসে সংগোপনে বরের সাথে ভালোবাসার কথা বলুক।শিখার কথা শুনে ইমার মুখটা মলিন হয়ে যায়।অহন চোয়াল শক্ত করে শিখার দিকে তাকাতেই শিখা মুখ ভেংচে চুপ হয়ে যায়।কিন্তু ইমার মন খারাপ হয়ে যায়।চুপ করে বসে থাকে মোবাইল কানে নিয়ে।
“- ইমা বলো কিছু!
“- আমি পৌঁছে কল করি আপনাকে?
“- লাগবে না।ভালো থাকো।আবির একপ্রকার রাগ করে কল কেটে দেয়।ইমা দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকে।অহন সারারাস্তায় অনেক মজা মাস্তি করেও ইমার মন ভালো করতে পারে না।গাড়ি একসময় খান প্যালেসে এসে থামে।বিশাল বড় দ্বিতল ডুপ্লেক্স বাড়ি দেকে বাচ্চারা ওয়াও বলে ওঠে।তারা এমন বাড়ি মুভিতেই দেখেছে।ইরার মা,ছোট কাকির খুশির সীমা নেই তাদের মেয়ে এমন জমিদারি বাড়ির বউ হয়েছে ভেবে।এই প্রথম মেয়ের শ্বশুরবাড়ি আসলো ইরার মা কাকিরা।বিয়ের পর বাড়ির পুরুষরা আর ইমার বড় ফুপুই শুধু এসেছিল এ বাড়িতে। ইরা গাড়ির হর্ণের শব্দে সদর দরজার সামনে এসে দাড়ায়।আজ ৬ মাস পর পরিবারের লোকদের দেখে ইরা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে।ইমাদের বাড়ি থেকে ২০/২২ জনের মতো লোক এসেছে।বাড়িতে থাকার জায়গা হলেও শ্বশুরবাড়ির লোকের সুবিধার্থে পাশের গেস্ট বাংলো খুলে দিয়েছে শৌখিন।সবাই একসাথে বাড়ির মতোই যার যার রুম ঠিক করে নিয়েছে।যে যার মতো রেস্ট নিচ্ছে। ইরা সবার খোঁজ খবর নিয়ে ইমার রুমে এসে দেখলো ইমা ব্যালকনিতে দাড়িয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।ইরা ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে টেনে নেয়।
“- এতো কাঁদিস কেন রে তুই?
“- আমার কাঁদার কপাল হলে কি করবো বল আপা।
“-কাঁদার কপাল না ছাই! চুপচাপ সয়ে যাস দেখেই সব পাগল পায়।অহন সব বলেছে আমাকে।শিখা তো ওর মায়ের মতোই অন্যের সুখ সহ্য করতে পারে না।আমার বিয়ের সময় কি নাটক টা করেছিল আমার ভাসুরকে নিয়ে মনে নেই।
“- ওর কি দোষ আপা! সব কপালের দোষ।তা না হলে সবার বকা কেন আমাকেই শুনতে হয়।আমিই কেন বার বার ভুল করে বসি।আসলে আমিই বলদি।ফুপু তো ঠিকই বলে আমি অচল সবার মাঝে।আল্লাহ দয়া করে একটু সুরৎ সুন্দর করেছে বলেই আবিরের মতো ছেলে জুটছে নয়তো রাস্তার ফকিরও আমাকে বিয়ে করতো না।আপা বল না এতো বোকা কেন আমি?কেন সব ঠিকঠাক করতে পারি না কিছু।ইমা শব্দ করে কেদে দেয় ইরার গলা জড়িয়ে।
“-হুশশ! চুপ কর বোন আমার।তোর শুধু সুরৎই সুন্দর না সিরতও সুন্দর। সবাই সেটা দেখতে পায় না।কারন সবার সিরত তোর মতো সুন্দর পবিত্র না।কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিস।আর কাদিস না।নিজের উপর আত্মবিশ্বাস রাখ দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে আর আমাদের আবির সাহেব তো আছেই তোর হাত ধরে পথ চলার জন্য।দেখবি আর কোনো কষ্ট থাকবে না তোর কপালে।
“- সত্যি বলছিস আপা! আবির আমাকে সামলে নেবে?
“- হুমম।আমাকে দেখ।শৌখিনের বউ হয়ে ওর সংস্পর্শে এসে কতো বদলে গেছি।আমার সকল খেয়াল রাখে।আমি জীবনেও ভাবিনি ঐ বন্দী জীবনের পর এমন সুন্দর একটা জীবন পাবো।এতো ভালো একজন স্বামী পাবো।শুকরিয়া আল্লাহর কাছে।আচ্ছা অনেক কেদেছিস এবার আমাকেও কি কাদিয়ে ছাড়বি।চল আমার সাথে।
“- কোথায়?
“- আমার রুম দেখতে।শিখা ব্যস্ত আছে চল এই ফাঁকে সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনবো।আর অনেক কিছুই বলার আছে তোকে।চল।
“- আচ্ছা ঠিক আছে।
ইমাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ির বাসার সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় ইরা।সবাই ইমার সাথে ভালো ব্যবহার করলেও ইরার মামী শ্বাশুড়ি মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।ইরা ইমাকে নিজের ঘরে নিয়ে অনেক গল্প করলো।ইমাকে এটা ওটা দেখাতে লাগলো।বোনের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখে ইমা বললো
“- শৌখিন ভাই অনেক ভালোবাসে তোকে তাই না আপা?শৌখিন ভাই সত্যি ভালো মনের মানুষ সাথে ভালো স্বামীও।
ইমার মনের অব্যক্ত ব্যথা কিছুটা আন্দাজ করে ইরা হেসে ইমার গাল টেনে বলে,
“- আবিরও তোকে অনেক ভালোবাসবে দেখিস।আমার মতো তুইও ভুলে যাবি সকল কষ্ট, অপমান।ইমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঠোঁটে সামান্য হাসি ফোঁটায়। ইরার দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হতেই ইরা বলে
“- দরজা খোলা আছে।
একজন মেড ঘরে ঢুকে ইরাকে বলে
“- ছোট ভাবি!শান ভাইয়ের রুমটা গুছিয়ে রাখতে বলেছে শৌখিন ভাই।
“- হায় আল্লাহ! খুশিতে তো আসল কথায় ভুলে গেছি।আচ্ছা তুমি যাও আমি যাচ্ছি।
কাজের মেয়ে চলে যেতেই ইরা চিন্তিত মুখে উঠে দাঁড়ায় বিছানা থেকে।ইরাকে চিন্তিত হতে দেখে ইমা বলে,
“- কি হয়েছে আপা!
“-আমার ভাসুর আসছে আজ রাতের ফ্লাইটে।তার ঘরটা গোছ গাছ করে রাখতে হবে।তুই এক কাজ কর রুমে গিয়ে রেস্ট কর।আমি ভাইয়ের রুমে যাই।
“- আমিও আসি আপা!
“- আসবি? আচ্ছা চল।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে করিডোরের শেষ মাথার রুমটায় ঢোকে ইরার সাথে।অনেক সুন্দর রুমটা।বেশি কিছু নেই রুমে তবুও রুচিসম্মত একটা রুম।রুমের ছাদটা ব্যালকনির দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে।রুমে থাকার মধ্যে একটা বেড,আলমারি,বুক সেলফ, বল সোফা আর ফুলদানি রাখার একটা ছোট্ট টেবিল।পুরোটা রুম সুন্দর পরিপাটি তবুও ইরা আরেকদফা ভালো করে ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার রাখছে।ইমা ঘুরে ঘুরে ঘরটার সব ছুঁয়ে দেখছে।
“- আচ্ছা আপা! বাড়িতে এতো কাজের লোক থাকতে তুই কেন এ রুম পরিষ্কার করছিস?
“-শান ভাই এ রুমে ঢোকার অনুমতি কাওকে দেয় না।আগে নিজেই পরিষ্কার করতো আমিই বলেছিলাম ভাইকে একদিন ভাই এ ঘর আমি পরিষ্কার করে রাখবো।একটা মানুষ সারাদিন কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে রুম পরিষ্কার করবে কেমন দেখায় না বল? বাড়ির বউ হয়ে আমার খারাপ লেগেছিল বিষয়টা।
“- যে কাউকে রুমে ঢোকার অনুমতি দেয় না সে তোকে রুম গোছানোর অনুমতি দিল? তাও আবার তার অনুপস্থিতিতে?
“-সহজে কি দিয়েছে?বহু কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে।অবশেষে রাজি হয়েছে।সত্যি কথা বলতে কি শান ভাইয়ের কাজ করে দিতে পারলে নিজের কাছেই ভালো লাগে।
“- আপা! ব্যাপার কি? শৌখিন ভাইকে ছেড়ে তার ভাইয়ের উপর ফিদা হলি যে?
“- আরে যা ভাবছিস তা নয়।তবে হ্যাঁ তার উপর ফিদা আমি এটা সত্যি। তবে সেটা অন্য রকম।
“- কি রকম?
“-তার জন্য আমার আলাদা মায়া কাজ করে মনে।তুই জানিস ইমা! বিয়ের পর এ বাড়ি এসে একা হয়ে গিয়েছিলাম আমি।সব কিছুই নতুন ছিল আমার জন্য।আমি সবসময় মন খারাপ করে থাকতাম আর কাঁদতাম। শান ভাইয়ের কানে কি ভাবে যেন বিষয়টা যায়।উনি আমাকে ডেকে নিয়ে কি বলেছিল জানিস?
“- কি!
“- ইরা মন খারাপ করে কেন থাকো? কেউ কি কিছু বলে তোমাকে? শৌখিনের কোনো আচরণে কষ্ট পাও তুমি? বলো ভয় নেই।আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মাথায় হাত রেখে বলে ইরা তুমি আমার বোনের মতো। এ বাড়িতে সানা যেভাবে আছে তুমিও সেভাবে থাকবে।তোমার মন খারাপ দেখলে আমি শৌখিন কে বাড়ি থেকে বের করে দেব।ভাইকে কষ্ট দেবে কেঁদে?
একটা অপরিচিত মানুষ যাকে দেখলে সবসময়ই ভয় পেতাম সে যখন এতো আবেগ নিয়ে ভালোবেসে বোন ডাকলো।বোনের মর্যাদা দিলো সত্যি মনে হলো আমি একা নই।আর এটা আমারই বাড়ি।
এরপর প্রতিদিন আমার খোঁজ নিতো।আমি তার কাছে ভাইয়ের ভালোবাসা পেয়েছি ইমা।তাহলে তার বোন হয়ে তার কষ্ট বুঝবো না কেন বল? আমার ভাই এতোদিন বাদে বিদেশ থেকে সফর করে এসে রুম গুছাবে তাই আমি হতে দিতে পারি বল?
“- বুঝলাম!তবে যাই বলিস আপা! তোর ভাসুর যেন কেমন? মানে তোর বিয়ের সময় দেখেছিলাম মুখটা কেমন রাগী রাগী করে রাখে।যেন হাসলে পাপ হয়ে যাবে।আমার তো ভীষণ ভয় লাগে তার চোখের দিকে তাকালে।বাজের মতো করে তাকায়।কলিজা কাঁপে তখন।
“- সত্যি বলতে আমি এখনও ভাই কে ভয় পাই।তবে তিনি মানুষটা ওতোও নিষ্ঠুর না।এখন চল কেউ দেখার আগেই রুম থেকে বেরোয়।তুই ঢুকেছিস শুনলে আমারও এ রুমে ঢোকা বন্ধ হয়ে যাবে।ইরা ইমাকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
রাত ১০ টায় শানের গাড়ি প্যালেসের গেটে ঢোকে।শান সোজা উপরে বোনের রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়।
“- সানা জান আমার! দেখ ভাই এসে গেছে।দরজা খোল।
সানা দরজা খুলে বাচ্চাদের মতো ভাইয়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কাদতে থাকে।
“- ভাই আই ওয়ান্ট টু ডাই।ভাই প্লিজ আমাকে মেরে ফেলো।আমার কষ্ট হচ্ছে ভাই।
সানার কথা শুনে এতোক্ষন যতোটুকু শক্ত ছিল শান মুহুর্তেই দূর্বল হয়ে গেল।কন্ঠ আড়ষ্ট হয়ে আসলো।সানাকে বিছানায় বসিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললো
“-সানা! এমন করে কেন বলছিস? কি হয়েছে বল? তুই এভাবে বললে ভাই যে সত্যি মরে যাবে। বল আমাকে কে তোকে কষ্ট দিয়েছে?
সানা ভাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে চুপচাপ কাঁদতে লাগলো।বোনকে চুপ থাকতে দেখে শানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।দাড়িয়ে হাতের মুঠ শক্ত করে লম্বা শ্বাস নিয়ে চিৎকার করে বলে
“-ওকে ফাইন বলবি না তো? বলিস না। তোর ভাই আছে কি জন্য? ঠিক খুজে বের করবো আমি।তারপর কি হবে সেটা তুই ভালো করেই জানিস সানা।
“- ভাই প্লিজ শান্ত হও।আমি ঠিক আছি।কাওকে খুজবে না তুমি।
“- অনেক দেরি হয়ে গেছে সানা!তোর চোখের জল কতোটা মূল্যবান সেটা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে না?শান নিহান খানের বোন সাধারণ কোনো মেয়ে না সেটা সবার জানা।তবুও কার কলিজা এতো বড় তোর দিকে নজর দেয়?খুশি হতাম যদি তুই নিজে তার নামটা বলতি। সমস্যা নাই এটা তোর ভাইয়ের জন্য কোনো ব্যাপারই না।হুমম! ইরা!
“- জ্বী ভাই!
“- সানাকে রেডি করে খাবার টেবিলে নিয়ে আসো।সানা! তুই যতো কম চোখের জল ফেলবি তার জন্য মৃত্যু ততই সহজ হবে।আমি আমার বোনের চোখের জল দেখতে চাই না।কোনো অবস্থাতেই না।বুঝেছিস তুই? তাড়াতাড়ি নিচে আয়।
সানা ভাইয়ের চিৎকারে চমকে ওঠে।চোখ মুছে কাঁপা গলায় বলে,
“-জ্বী ভাই!
শান রুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে ঝুলে থাকা পান্সিং ব্যাগে সজোরে লাথি দেয়।ব্লেজারটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে বেসিন পানিতে ভরে সম্পূর্ণ মুখ ডুবিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করে।
শানের রাগী মুড দেখে বাড়ির সবার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ পরে।এই থমথমে পরিস্থিতির জন্য মামী মনে মনে সানাকে সবরকমের খারাপ গালী দিতে লাগলো।
চলবে,,৷তোমার আকাশে হব প্রজাপতি
পর্ব ০৩
Writer Tanishq Sheikh
খান বাড়ির হল রুমে পিনপতন নীরবতা এই মুহূর্তে। শান শাওয়ার শেষে কালো পাঞ্জাবি গায়ে নিচে নেমে খেতে বসলো।বাড়ির অন্যান্য রা খেলেও পাশের সোফায় বসে রইল।সানা চুপচাপ ভাইয়ের পাশে বসে আছে।শান একবার বোনের দিকে তাকিয়ে খাবার প্লেটে তুলে দিয়ে বললো
“- খেতে শুরু করো সানা!
“- ভাই এতো খেতে পারবো না।
“- সরি! শুনি নাই জোরে বলো।
“- কিছু না ভাই।
“- গুড! চুপচাপ খেয়ে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ো।
“- জ্বী!
“- চাচা! আপনারা খেয়েছেন?
“- হ্যাঁ শান বাবা!
“- তাহলে বসে আছেন কেন এভাবে। ঘরে গিয়ে আরাম করেন যান।
“- হুমম!সবাই ঘরে যেতে পেরে হাফ ছেড়ে বাচলেও সানা আর ইরা চোখাচোখি করলো।শানের রাগে কঠিন হওয়া মুখ আর লাল চোখ দেখে মুখ ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে তাকালো একে অপরের দিকে।শান খাবার ধীরে ধীরে চাবাতে চাবাতে সেদিকে তাকিয়ে বললো
“-কেউ যথার্থই বলেছিল ভাবিয়া করিও কাজ তারপরের লাইন যেন কি সানা?
“- করিয়া ভাবিয়ো না।
“- তাহলে তুমি কেন ভাবছ এখন? কার বোন তুমি ভুলে গেছ? সাহস কি করে হয় তোমার সানা?আন্সার মি!
হঠাৎ আকাশে বজ্রপাত হলে মানুষ যেমন আৎকে ওঠে সানা, ইরা, শৌখিন সহ কাজের লোকেরাও আৎকে ওঠে শানের চিৎকারে। সানার সামনে থেকে খাবার প্লেট ছুড়ে ফেলে সানার বাহু ধরে দাড় করায়।
“- ভাই ব্যথা লাগছে আমার।
“- খুব ব্যথা লাগছে? আমার থেকেও বেশি। কেন কাদবি তুই? কিসের অভাব তোর বল? তোকে বুকে আগলে বড় করেছি সানা তাহলে এমন কাজ কি করে করতে পারিস?
“- ভাই আমার ভুল হয়েছে।ক্ষমা করে দাও ভাই।
সানার কান্না দেখে শৌখিন ইরা এগিয়ে আসতে চাইলেও শান হাতের ইশারায় ওদের থামিয়ে দেয়।
“-খুব ভালোবাসিস ছেলেটাকে?
“- হ্যাঁ ভাই!
“- আমার থেকেও বেশি?যে পালিয়ে যাওয়ার প্লান কষেছিলি।আমার কাছ থেকে মুক্তি চাস? ঘৃণা করিস আমাকে তাই না?
সানা চমকে তাকায় ভাইয়ের রুক্ষ কঠিন গলার স্বরে।
“- না ভাই!
“- বল আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসিস তাকে? এতোই যখন ভালোবাসলি কাদালো কেন তোকে? বল?
“- তুমি কেন কাদাচ্ছ তাহলে?
“- আমার সাথে কম্পেয়ার করছিস?শান নিহান খানের সাথে।
“- ভাই আমি কম্পেয়ার করছি না।বলছি ভালোবাসা এক এক জনের কাছে এক এক রকম।কেউ কষ্ট দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করে কেউ সুখ দিয়ে।প্রকাশের মাধ্যম ভিন্ন হয় ভাই।
“- বাহ! দেখেছিস শৌখিন আমাদের সানা ভালোবাসা বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছে।বড় ভাইকে বোঝাচ্ছে ভালোবাসা কি?ওকে! তো ডাক তোর ভালোবাসাকে আমিও দেখি সেই মহান মানুষটাকে যে আমাদের সানা ম্যাডামকে কে আপন কে পর এই বিষয়ের সঠিক জ্ঞান দিয়েছে।ডাক!
“- ভাই আমার ভুল হয়েছে বললাম তো? ভুল মানুষকে বিশ্বাস করেছি আমি।ধোঁকা দিয়েছে আমাকে ভাই।ধোঁকা।
শান নিজের রাগকে আর দমিয়ে রাখতে পারলো না ঠাস করে সানার গালে চড় বসিয়ে দিল।মনে হলো হঠাৎ ভূমিকম্পে কাপলো বাড়িটা।মামী পর্দার আড়াল থেকে সব দেখে হাসছে।সানা গালে হাত দিয়ে নিরবে কেঁদে যাচ্ছে। শৌখিন এবার শানের বারন উপেক্ষা করে সানাকে কাছে টেনে আনল।
“- কি করলি তুই ভাই? সানার গায়ে হাত তুললি।
“- হ্যাঁ তুললাম।দরকার হলে কেটে মাটিতে পুতে রাখবো। ওর সাহস কি করে হয় এসব প্রেম ভালোবাসা করার।আমার মান সম্মানের কথা ভুলে গেল কি করে ও?তুই কি ভেবেছিলি আমি জানতে পারবো না তোর পালিয়ে যাওয়ার কাহিনি।রুবি আমিন হয়ে গেলি অবশেষে।হবিই বা না কেন? সন্তান বলে কথা।যা তার কাছেই চলে যা।
“- ভাই সরি!ভাই আমি ভুল করে ফেলেছি ক্ষমা করে দাও ভাই।আর এমন ভুল হবে না।
“- চুপ! একদম চুপ।বোন বলে প্রানে মারলাম না।তবে হ্যাঁ যে তোকে ফুসলে ছে তাকে আমি ছাড়বো না।ইরা ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও।ইরা সানাকে নিয়ে উপরে চলে যায়।শৌখিন শানকে শান্ত করতে চেয়েও পারে না। শান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।গার্ডদেরও সাথে নেয় না।শান অতিরিক্ত রাগ হলেই বাবার কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকে।আজও গেল।
|
|
ইমা অহনের মোবাইল নিয়ে এসে কয়েকবার আবিরকে কল দিলো কিন্তু একবারও রিসিভ করলো তো নাই উল্টো মোবাইল সুইচড অফ করে রেখে দিল।ইমার কান্না পাচ্ছে আবিরের ব্যবহারে।সব তো জানেই তবুও এমন কেন করে ইমা ভেবে পায় না।ইমা অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারলো না।অবশেষে পা টিপে বিছানা ছেড়ে উঠে ব্যালকনিতে এসে বসলো।
দূর আকাশের মিটিমিটি জ্বলা তারাদের দেখতে লাগলো।একটু দূরেই খান প্যালেস।কি সুন্দর বাড়িটা। চারপাশে বাহারি গাছের সারি। ইমা গেটে দিকে তাকাতেই দেখলো কালো পাঞ্জাবি পড়া একটা লোক উদভ্রান্ত বেশে গেটের ভেতরে ঢুকে পায়চারি করছে।ইমা ভালো করে লক্ষ করে মানুষটাকে চিনতে পেরে ভয়ে ঢোক গিলে দৌড়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে।পাশে শোয়া শিখার ঘুমের ডিস্টার্ব হওয়ায় বিরক্ত হয়ে ইমাকে বকতে লাগলো। ইমা চুপচাপ শুয়ে ভাবছে এতো কেন ভয় লাগে লোকটাকে দেখলে।একটা মানুষই তো?বাঘ ভাল্লুক তো নয়। না! ইমা আর ভয় পাবি না।সাহস রাখ বুকে।
ইমা সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে যায় মনেও নাই।নতুন জায়গা হওয়ায় ফজরের পরপরই উঠতে পারে নি তবুও নামাজ পড়া বাদ দেয় নি।নামাজ পড়ে আবার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। রোদটা হালকা গায়ে লাগছে।ইমার বেশ লাগছে! চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে এই মিষ্টি অনুভূতি।ঠোটে এক ফালি হাসি টেনে চোখ খুলে সামনের ব্যালকনিতে পরতেই ইমার হাসি ফুরর হয়ে যায়।নগ্ন ফর্সা গাত্র, কপালে দুষ্টুমি করা এলোমেলো চুল সামলানোর বৃথা চেষ্টা করা মানুষটা ইমার হার্ট বিটের গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে।ইমা ভয়ে এতোটাই ঘাবড়ে গেছে যে নিজের চোখটাও কন্ট্রোলে নেই।শান চুল ব্রাক ব্রাশ করতে করতে উষ্ণ কফির মগে চুমুক দিচ্ছে।হঠাৎ বাংলোর মুখোমুখি ব্যালকনিতে চোখ পড়তেই কপাল কুচকে গেলো।এক দৃষ্টিতে রোবটের মতো ওর তাকিয়ে আছে একটা মেয়ে।মেয়েটা যেন চলন বলন শক্তি সব হারিয়ে ফেলেছে।শানের চোখে চোখ পড়তেই ইমা ভো দৌড় দিয়ে বিছানায় বালিশ মুখে চেপে বসে কাঁপতে থাকে।শান কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করে রুমে চলে আসে।খোঁচা খোঁচা দাড়ি ক্লিন শেভ করে কালো টিশার্ট গায়ে দিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে চলে আসে।সবাই চুপচাপ খাবার খাচ্ছে। সানা ভাইয়ের দিকে বার বার তাকালেও শান তাকাচ্ছে না।শানের সাথে এ বাড়ির কেউ খেতে চাই না।চুপচাপ রোবটের মতো কেই বা চাইবে খেতে।শান খাওয়া শেষে সোফায় এসে বসে বাড়ির বাকি মেম্বার রাও সাথে বসে। শান ইরা কে ইশারায় সানাকে চলে যেতে বললে সানা কাঁদতে কাদতে উপরে চলে যায়।
শান গম্ভীরমুখে শৌখিন কে উদ্দেশ্যে করে বলে
“- তোর শ্বশুরবাড়ির লোকের কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?
“- না ভাই!
“- খোঁজ খবর রাখিস বিন্দুমাত্র সমস্যা যেন না হয় তাদের।চারজন মেড সবসময়ই যেন সেখানে থাকে।
“- জ্বী ভাই! ভাই একটা কথা ছিল
“- হুমম শুনছি বল!ম্যাগাজিনে মনোযোগ দিয়ে।
“- ভাই আজ তো ইমার গায়ে হলুদ। তো আব্বারা আমাদের এ কদিন দাওয়া করেছে রাতের ডিনার তাদের সাথে করার জন্য।বাংলোর সামনের জায়গায় এজন্য ডেকোরেটিং করা হবে।
“- হুমম।ঠিক আছে।তখনই তোর শ্বশুরবাড়ির লোকের সাথে দেখা করে নেব।
“- আচ্ছা ভাই!
“- ওকে! তাহলে আমি অফিসের জন্য বের হচ্ছি আপনারাও বের হোন।( চাচা,মামা,শৌখিন কে উদ্দেশ্য করে)বিশেষ মিটিং আছে আজ।শান রুমে চলে আসলো।কালো সুট পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলো।
বাংলোর সামনে স্টেজ সাজানো হয়েছে।ইমার কাজিনদের মধ্যে মেয়েরা হলুদ শাড়ি ছেলেরা হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে গানবাজনা নিয়ে ব্যস্ত আছে।শান আজ তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরেছে শৌখিনের শ্যালিকার গায়ে হলুদে এটেন্ড করবে বলে।কালো পাঞ্জাবি গায়ে রেডি হয়ে বড় মিঞা সহ পরিবারের সবার সাথেই পরিচিত হতে থাকে।ইমাকে পার্লার থেকে গায়ে হলুদের সাজ দিয়ে নিয়ে এসেছে।ইমার মন ভিষণ রকমের খারাপ।আবির সকাল সকাল খুব কঠিন কঠিন কথা বলেছে ইমাকে।ইমা মুখটা ভার করে স্টেজে বসে আছে অন্যমনস্ক হয়ে।ইরার ডাকে সামনে তাকিয়ে শানকে দেখে টুস করে দাড়িয়ে পড়ে।যেন ভূত দেখেছে।শান কপাল কুচকে ইমার মুখের ভাব বোঝার চেষ্টা করলো।ইরার ঠেলায় ইমা কাঁপা গলায় আস্তে করে নত মস্তকে বললো
“- আসসালামু আলাইকুম শান ভাই
“- ওয়ালাইকুম আসসালাম।ব্রাইডের মন খারাপ নাকি?
“- না তো!
“- মনে হচ্ছে। আচ্ছা যা হোক কংগ্রাচুলেশনস।
“- জ্বী শুকরিয়া।
শান কিছুক্ষণ ইমার দিকে তাকিয়ে শৌখিন কে ডেকে ১০ হাজার টাকা ইমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
ইমার বুকের ভেতর থেকে মনে হচ্ছে কলিজাটা বের হয়ে আসবে।হাত কাঁপছে।গলা দিয়ে কথা বের করতেও যুদ্ধ করা লাগছে।তবুও ভাঙা ভাঙা শব্দে বললো,
“- লাগবে না ভাই।আপনি দুআ করলেই হবে।
“- এটাই আমার দুআ রাখো।ইমার হাত টা টেনে টাকাটা দিয়ে বড়দের সাথে এসে বসলো শান।ইমা তখনও ওভাবে রোবটের মতো দাড়িয়ে আছে।শিখা ছোবল দিয়ে টাকাটা নিয়ে মায়ের কাছে দিয়ে আসে।ইমা কাঁপা দৃষ্টিতে চেয়ারে বসে বুকের বা পাশে হাত দিয়ে নিজের হার্ট বিট শুনে নিজেই চমকে যায়।ধাম ধাম করে বাজছে এমন মনে হচ্ছে। শান বড় মিঞাদের কথা শুনতে শুনতে এদিক ওদিক তাকালো দৃষ্টি আটকে গেল স্টেজে বসা হলুদ শাড়ি পড়া মেয়েটাকে দেখে।মেয়েটা এখনও ভূত দেখার মতো ভয় পেয়ে আছে।সকালেও দেখে দৌড়ে পালিয়েছিল। শান দৃষ্টি সরাতে চেয়েও পারে না।কি এক নিষিদ্ধ আকর্ষণে শানের দৃষ্টি অকারণেই ইমার দিকে নিবদ্ধ হচ্ছে বার বার।দ্বিতীয়বার তাকানোই শানের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। দ্বিতীয়বারে দৃষ্টি বিনিময়েই যে সকল সর্বনাশের শুরু হয়।
চলবে,,