#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখাঃ মুনিরা সুলতানা।
পর্বঃ ৪ ।
————
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে যেতেই আমি বিরক্তি সহকারে চোখ দুটো মেললাম। হালকা সবুজাভ আলোয় পুরো কামরাটা কেমন অপার্থিব অলৌকিক জগতের আবেশ তৈরি করেছিল যেন। আমি বোঝার চেষ্টা করলাম ঠিক কয়টা বাজে। এখনো ফজরের ওয়াক্ত হয়নি। সেলফোনে এলার্ম সেট করে রেখেছিলাম নামাজ পড়তে উঠব বলে। কিন্তু তার আগেই কেন ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল? অবশ্য নতুন জায়গায় অচেনা কামরায় নতুন বিছানায় শুয়ে অনেক রাত পর্যন্ত কেবল এপাশ ওপাশ করেই কাটিয়াছিলাম। কিছুতেই ঘুম আসছিলনা। সারাদিনের এতো ধকল তার উপর গতরাতে জার্নির ধকল, সব মিলে শরীর মন ভিষণ ক্লান্ত হয়ে পরেছিল। ঘুমে চোখ দুটো জড়িয়ে আসছিল। কিন্তু কেন জানিনা তন্দ্রা মত আসতেই কাঁচা ঘুম বারবার ছুটে যাচ্ছিল। হসপিটাল থেকে বাসায় আসার পর থেকেই একটা অদ্ভুত অস্বস্তি আমাকে জড়িয়ে রেখেছিল। কেমন যেন অন্য রকম অনুভুতি। ঠিক একই রকমের অনুভূতি আমার দাদা মারা যাওয়ার সময়ও হয়েছিল। কামরানের দাদাকে দেখার পর থেকে সেই অনুভূতি হচ্ছিল। আজ রাতটা পার করতে পারবেন না বলেই মনে হয়েছিল। তবে কি…?
রাতের কথা মনে পড়ছিল। কি অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে চলেছে গত কয়দিন ধরে। যা কখনও কল্পনাতেও তাই ঘটে চলেছে একের পর এক। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য যখন কামরান ও আমি কামরার বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলাম তখন দেখেছিলাম ওর খালা এবং খালাতো বোন আমার শাশুড়ি মায়ের সাথে বেশ উচ্চস্বরে কথা বলছিল। ওর খালা অভিযোগের সুরে বলছিলেন,
” কিভাবে পারলি এভাবে হুট করে ছেলের বিয়ে দিতে? আমাদের একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলিনা? ”
কামরান এগিয়ে গিয়ে বলেছিল, ” এটা কি ধরনের কথা খালামনি? তুমি সিচুয়েশন দেখছনা? দাদার শেষ ইচ্ছে ছিল এটা। আমি দাদার জন্য এটুকু করতে পারবনা? তাছাড়া সবকিছু এত দ্রুত গতিতে হয়ে গেল, আর তোমরাতো এখানে ছিলেই না। কিন্তু খালু তো জানেন। উনিতো বিয়ের সময় ছিলেন। ”
মহিলাটি শাশুড়ি মায়ের দিকে ফিরে আবারও বললেন, ” কিন্তু তুমি কথা দিয়েছিলে আপা। আমার মেয়ের স্বপ্ন ভেঙে গেল। তোমার কি কিছুই বলার নেই? ”
কামরান ঝট করে প্রশ্ন করলো, ” খালামনি কি কথা দেয়ার ব্যাপারে বলছে আম্মা? ”
শাশুড়ি মা তটস্থ ভঙ্গিতে বললেন, ” তেমন কিছুনা আব্বা। ” তারপর বোনের দিকে ফিরে বললেন, ” আর তোকে সিরিয়াসলি কোন কথা দেইনি আমি। বোনে বোনে কথায় কথায় মানুষ কত কি তো বলে। সেটাকে কথা দেয়া বলেনা। নিয়তিতে যা লেখা থাকে সেখানে আমাদের কারও কোন হাত থাকেনা। তাই তোর কাছে আশা করি এই ব্যাপারে আর কোন কথা বলবিনা।
তখন মেয়েটা কথা বলে উঠেছিলো, ” আম্মু এসব কথা এখন থাকনা। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন দাদাজানের সুস্থ হয়ে ওঠা বেশি জরুরি। ”
কামরান বলেছিলো, ” তোর মাকে বোঝা পিউ। আমাদের মন মেজাজ এমনিতেই ভালো নেই। ”
এর মধ্যে আরমান এসে ভাইয়ের উদ্দেশ্য বলেছিল, ” চল ভাই তুমি রেডিতো? ”
কামরান বলেছিল, ” হ্যা আমি রেডি। চল।”
পিউলি, পরে জেনেছিলাম মেয়েটির নাম পিউলি। সে বলেছিল, ” আমিও যাব তোমাদের সাথে। ”
কামরান বলেছিল, ” তুই কি করবি গিয়ে? বাসায় থাক।”
পিউলি জেদি গলায় বলেছিল, ” না আমি যাব। কিছু নাইবা করতে পারি, তোদের পাশে থাকতে পারবো অন্তত। ”
আমার শাশুড়ি মা বললেন, ” হসপিটালে এত মানুষের ভীড় করার পারমিশন নেই। তুমি বরং বাসায় থাকো পিউলি।”
কিন্তু না। পিউলি নাছোড়বান্দা হয়ে উঠেছিল। আমি বুঝতে পারছিলামনা মেয়েটা কেন হসপিটালে যাওয়ার জন্য জেদ ধরেছিল? যাইহোক অবশেষে ওকে নিয়েই দুই ভাই হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গিয়েছিল।
আমি হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশে ডেস্কের ওপরে রাখা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম সারে তিনটা বাজে তখন। আমি আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসেছিলাম। বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে নিয়েছিলাম। মনের অস্হিরতা কমানোর জন্য সেলফোনে কোরআন তেলাওয়াত করেছিলাম ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়া পর্যন্ত। তারপর ফজরের ওয়াক্ত হলে ফজরের নামাজ পরে নিয়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম। তখনও কেউ উঠেনি। আমি ডাইনিং রুম থেকে লিভিং রুমে পায়চারি করে আবার কামরায় ফিরে এসেছিলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেছিলাম।
ঘন্টা দুয়েক বোধহয় ঘুমিয়ে ছিলাম। তারপর আবারও বাইরে শোরগোলের আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আমি আস্তে ধীরে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিয়েছিলাম। শাড়ির আচল ভালো করে মাথায় জড়িয়ে নিয়ে কামরার বাইরে চলে এসেছিলাম। শুনেছিলাম ভোরবেলায় দাদা দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে উনাকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসবে। তারমানে আমার যখন ঘুম ভেঙেছিল তখনই…।
এরপরে সবকিছু কেমন দ্রুত গতিতে বয়ে চলেছিল। বাড়ির ভিতরে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছিল। জোহরের ওয়াক্তে সবকিছু সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। তবে রাত পর্যন্ত বাড়ি ভর্তি ছিল। এরপরে সবাই চলে গেলেও আত্মীয় স্বজনরা অনেকেই থেকে গিয়েছিল।
আমি আমার সারাজীবনে এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে কখনও পরিনি। নতুন বউ হিসেবে আমার ঠিক কি করনীয় আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। বাড়ির মানুষ গুলোর সাথে আমার যে তখনও সেভাবে কোন বন্ডিং গড়ে ওঠেনি। আমি সবার সামনে অনেকটাই সংকোচ নিয়েই মুখোমুখি হয়েছিলাম। তাও সেদিন প্রায় সারাদিন আমার আম্মু আব্বুরা, মামারা এখানে ছিল বলে আমার একা মনে হয়নি। কিন্তু যখন উনারা চলে গিয়েছিলেন তাও আবার তামান্নাকে সাথে নিয়ে তখন আমার দম বন্ধ লাগছিল। আমি ভিষণ ভাবে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে কিছু করার নেই। ভিষণ অসহায়ত্ব আমাকে দুর্বল করে ফেলেছিল।
সেদিন কামরান সারাদিন একা হাতে ছুটাছুটি করে সব কিছু সামলেছিল। রাতের বেলা বাইরে থেকে কারও পাঠানো খাবার কোন রকমে নাকে মুখে গুজে সবাই যার যার মত ঘরে ঢুকে পরেছিল। সত্যি বলতে সেদিন শারিরীক ও মানষিক ভাবে ভিষণ ক্লান্ত ছিল সবাই। মনটাও ভারাক্রান্ত ছিল। তাই আার প্রতিদিনের মত গল্প গুজব করে কিংবা কাজকর্ম করার মত শক্তি বা মন কোনটাই ছিলনা। আমিও তাই চুপচাপ কামরায় ফিরে গিয়েছিলাম। বেশ কিছুটা সময় বেলকনিতে বসে কাটিয়েছিলাম। তারপর ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে সেলফোনে গল্প পড়তে শুরু করেছিলাম। অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলেও কামরান ঘরে আসেনি। বাসায় তো ছিল। তাহলে কামরায় কেন আসছিল না? আমি সেলফোন রেখে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম। সারা বাড়ি ঘুরে অবশেষে দাদার ঘরের সামনে এসে দেখলাম ভিতরে আলো জ্বলছিল। দরজাটা অর্ধেক ভেজানো ছিল। তাই ভিতরে বিছানায় কামরানকে শুয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু সেখানে পিউলিকে কামরানের শিয়রের পাশে বসে থাকতে দেখে আমার বুকটা কেমন অজানা আশংকায় কেঁপে উঠেছিল। যদিও মাত্র একদিন হলো বিয়ে হয়েছে তবুও এই মধ্য রাতে স্বামীর শিয়রের পাশে অন্য নারীকে দেখে কোন মেয়ে সহ্য করতে পারে। বুকের ভিতরটা কেমন জ্বলে উঠেছিল। কিছু একটা হৃৎপিণ্ডটাকে মুচড়ে ধরেছিল যেন। জানিনা আসলে ভাগ্যে কি আছে সামনে। ওদের দিকে নির্বাক হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানিনা। পিউলি কামরানের কপালে ম্যাসেজ করে দিচ্ছিল। বোধহয় গতকাল সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে আবার সারাদিনের ব্যস্ততার ধকলের কারনে মাথা ব্যাথা করছিল। যদিও বউ হিসেবে এই কাজটা আমার করার কথা। কিন্তু সেই রকম সহজ সম্পর্ক তো আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি তখনও। আমি অনিশ্চিত বুকে চাপা কষ্টের অনুভব নিয়ে আবারও কামরায় ফিরে এসে চুপচাপ শুয়ে পরেছিলাম।
ভোরবেলায় ফজরের নামাজ পড়তে উঠে দেখেছিলাম কামরান আর রাতে আসেনি। আমি অজু করে এসে নামাজ আদায় করে নিয়ে একবার দাদার কামরার সামনে গিয়ে দেখে এসেছিলাম। সে ঐ ঘরেই ঘুমিয়ে পরেছিল। আমি নিশ্চুপ আবার ঘরে এসে শুয়ে পরেছিলাম।
এরপরে যে কয়দিন শশুর বাড়িতে ছিলাম কামরান একদিনও আমাদের কামরায় এসে থাকেনি। কেবল গোসল ও কাপড় পাল্টানোর সময় আসত। আমার সাথে বলতে গেলে তেমন কোন কথাই হতোনা। অবশ্য সারাদিন বাসায় থাকতো কোথায়? সেই সকালে বেরিয়ে যেত আর ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত আটটা নয়টা বেজে যেত। বাসায় এসে গোসল করে সোজা ড্রয়িং রুমে কিছুক্ষণ অন্যদের সাথে সময় কাটাতো। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে দাদার ঘরে গিয়ে ঢুকতো। ওখানেই ঘুমিয়ে পরত। আর পিউলী তো ঐ কটাদিন ঐবাড়িতেই ছিলো। কামরান যতক্ষণ বাসায় থাকত সারাক্ষণ মেয়েটা ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করত। দেখে যে কারও মনে হতেই পারে কামরানের বউ আসলে আমি নই ঐ পিউলিই। আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগতো ঐ অজানা অচেনা মানুষটার এমন নিরুত্তাপ উদাসীনতা দেখে। তার কি তবে এই বিয়েতে একেবারেই মত ছিলনা? শুধু মাত্র দাদার শেষ ইচ্ছে পুরন করতে বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করেছিল? আমিও তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিলাম। আমিতো মেনে নিয়েছিলাম আমার ভাগ্যকে। তাহলে কামরান কেন আমার সাথে এমন অবিচার করছিল?
দাদার কুলখানির দিনে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। সেদিনও সারাদিন বাসায় মানুষের ভীড়ে গমগমে পরিবেশ ছিল। আমার আব্বা আম্মা, মামারা এসেছিলেন। বলেছিলেন পরের দিনের প্লেনের টিকেট কাটা হয়েছে। তাই শুনে আমি কান্না আটকে রাখতে পারলামনা। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল ওদের চলে যাওয়ার কথা শুনে। সামনে পরীক্ষা। বই পত্র কিছুই সাথে নিয়ে যাওয়া হয়নি তখন। আমি কিভাবে বাড়ি যাব? এসব ভেবে আমার কান্নার দমক আরও বেড়ে গিয়েছিল। আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মামা সেদিন বলেছিলেন,
” বিয়ের আগে তো কথা হয়েছিল, বিয়েটা হয়ে গেলে হীবা ওর মায়ের বাড়ি ফিরে যাবে। পরীক্ষা হয়ে গেলে তবেই আবার ও ফিরে আাসবে। ”
শাশুড়ি মা জবাবে বলেছিলেন, ” কথাতো তেমনই ছিল। কিন্তু বাড়ির পরিবেশ এই মুহূর্তে একটু শোকাবহ। তাই ও আর কয়দিন থেকে গেলে ভালো হতো।”
এবার আমার আব্বা মুখ খুলেছিলেন, ” এমনিতেই কয়দিনে পড়াশোনায় বেশ ক্ষতি হয়ে গেছে। আর মাত্র কদিন আছে মেয়েটার পরীক্ষার। তাছাড়া ও মেন্টালি প্রস্তুত ছিলনা বিয়েটার জন্য। এখন এভাবে ওকে রেখে কিভাবে যাই বলেন? ”
কামরান হঠাৎ এসে বলেছিল, ” আম্মা ওকে যেতে দাও। সব কিছুতে জোর জবরদস্তি ঠিক না। এক্সামের সময় পড়াশোনার পাশাপাশি মাইন্ড ফ্রেশ থাকাটাও দরকার। এখানে থাকলে ওর পড়াশোনায় ক্ষতি হয়ে যাবে। এক্সামটা হয়ে যাক আগে। তারপর তো আসবেই। জাস্ট কিছুদিনের ব্যাপার।”
শাশুড়ি মা ছেলের কথা মেনে নিয়ে বলেছিলেন, ” ঠিক আছে। নিয়ে যান। কিন্তু পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে চলে আসতে হবে। ”
আব্বা আস্বস্তের সুরে বলেছিলেন, ” তা আর বলতে। নিশ্চয়ই আসবে। ওতো এখন আপনাদেরই। ” বলেই মৃদুভাবে হেসেছিলেন তিনি।
আমার যাওয়া ঠিক হয়ে গিয়েছিল। খুব খুশি লাগছিল। কিন্তু সেই সাথে একটু রাগও হচ্ছিল। কামরান যেভাবে আমার যাওয়ার পক্ষে কথা বলেছিল তাতে আমি সত্যি খুশি হতে পারিনি। যদিও উনার জন্যই সহজে যাতে পারছিলাম। কিন্তু অন্য দিকে মনে হচ্ছিল, আমি চলে গেলেই সব থেকে বেশি খুশি বোধহয় সেই হয়েছিলে। এসব ভেবে আমার মনটা আবার তিক্ততায় ভরে উঠেছিল। এই কদিনে তাসমিয়ার সাথে আমার সবচেয়ে সুন্দর সময় কেটেছিল। শাশুড়ি মায়ের সাথেও মোটামুটি ভালোই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তিনি একটু গম্ভীর স্বভাবের হলেও আমার সাথে প্রায় এটাসেটা নিয়ে কথা বলতেন। আরমানকে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। খাওয়ার সময় ছাড়া তাকে তেমন একটা দেখা যেতনা। বাসায় যখন থাকত সে নিজের কামরা থেকে খুব দরকার না পরলে বেরোত না। তবে সে বেশ মিশুক এটুকু তার সাথে কথা বলেই বোঝা যায়। কিন্তু কেন সে এভাবে সবাইকে এড়িয়ে চলে বুঝতে পারিনি। আর তিয়ানাও নিজের ক্লাস, পড়াশোনা বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে ভিষন ব্যাস্ত থাকতো। তবে দেখা হলে টুকটাক কথা হতো ওর সাথে। কিন্তু যেই মানুষটার উছিলায় এই বাড়িতে আমার আসা হয়েছে তার সাথেই আমার কোন রকমের আলাপচারিতার সুযোগই হয়নি।
সবাই একসময় বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিল। এমনকি পিউলিও সেদিন রাতে চলে গিয়েছিল। অবশেষে আমি কামরায় গিয়ে নিজের লাগেজ গুছিয়ে নিয়েছিলাম। অবশ্য তেমন কিছু গোছানোর ছিলোনা। আমার কাপড় চোপড় ব্যাগেই রেখেছিলাম। সেগুলো আর বের করিনি। গোছানো শেষে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে আলো নিভিয়ে দিয়ে সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম৷ শুয়ে শুয়ে কামরার চারিদিকে একবার চোখ মেলে দেখেছিলাম। এই কদিন এই কামরা একান্ত আমার ছিল। পরেরদিন চলে যাবো মনে হতেই মনটা কেমন করে উঠেছিল। সেটা কি মায়া? আমার জানা নেই সেটা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেলফোনটা হাতে নিয়ে তাতে মনোনিবেশ করেছিলাম।
কতক্ষণ সেলফোনে ডুবে ছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেয়ে আমি চমকে উঠেছিলাম। চট করে ফোন বন্ধ করে বালিশের পাশে রেখে দিয়ে চোখ বুজে মটকা মেরে শুয়ে ছিলাম। কয়েক মুহূর্ত পরে ঘরে কেউ আছে বুঝতে পেরে একটা চোখ সামান্য ফাঁক করে দেখলাম কামরান ওয়াশরুমের ভিতরে চুকল। আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। এই কামরার বাথরুমে কেন গেল সে? এই কদিন তো রাতে এই রুমে আসেনাই। ভাবতে ভাবতে আমি উল্টো দিকে ঘুরে ঠিক ঠাক হয়ে শুয়েছিলাম। কামরান একটু পরেই বেরিয়ে এসেছিল। তারপর আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে সেইদিন প্রথমবারের মত ঐ কামরায় একই বিছানায় আমার পাশে এসে শুয়ে পরেছিল। আমি ঘাবড়ে গিয়ে কি করব বুঝতে পারছিলাম না। তাই ঘুমের ভান করে প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে চুপচাপ ঘাপটি মেরে পরে ছিলাম।
ভোর বেলায় এলার্মের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আমি হাত বাড়িয়ে সেলফোনে বাজতে থাকা এলার্মটা বন্ধ করে দিয়ে উঠে বসতে গিয়ে বাঁধা পেলাম। অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে অনুভব করতে পারছিলাম আমি কারও হাতের বাঁধনে আটকে ছিলাম। পিছনে দেখতে না পেলেও কামরানের একটা হাত আমার কোমর জড়িয়ে ধরে রেখেছিল দেখতে পাচ্ছিলাম। ওর বুকে আমার পিঠ ঠেকে আছে। এই বাড়িতে আসার পর এই প্রথম মানুষটা আমার এতো কাছে এসেছিল। সেইদিন প্রথম আমাকে ওভাবে ছুয়ে দিয়েছিল। আমার নেত্রপল্লব ভিজে উঠেছিল আপনাআপনি। কিছু সময় কামরানের হাতের উপর আমার হাতটা পরম সন্তর্পণে ছুয়ে রেখেছিলাম। আমার বুকের গহীনে এক অচেনা অনুভূতির স্রোত কলকলিয়ে বয়ে চলেছিল। আমি আস্তে করে কামরানের দিকে ঘুরে শুয়েছিলাম। ওর মুখের দিকে অপলক নেত্র মেলে মন ভরে তাকে দেখে নিয়েছিলাম। জানিনা আবার কবে দেখব তাকে। কিছুক্ষণ পরে আস্তে করে ওর হাতটা সরিয়ে আমি উঠে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম অজু করতে।
চলবে ইনশাআল্লাহ