#তোমাতে_মত্ত_আমি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#শেষ_পর্ব
যে ভ’য়’টা আলফা পেয়েছিলো সেটাই হলো, হামজা মানলেও হামজার পরিবার ওকে মানবে না এটা আগেই আ’শ’ঙ্কা করেছিলো আর আজ সেই আ’শ’ঙ্কা’ই হামজার বাবা এসে সত্য প্রমাণ করে দিলো।
“দেখো আলফা, তোমার সঙ্গে আমার কোনো পূর্বশ’ত্রু’তা নেই কিংবা এমন নয় যে আমি তোমাকে পছন্দ করিনা। কিন্তু ছেলের বউ হিসেবে হয়তো আমি তোমায় মানতে পারবো না”
মিস্টার শাহ্ এর কথা শুনে বিশেষ অবাক হলো না আলফা, কারণ এমনকিছু হতে পারে সেটা আগে থেকেই ধারণা করেছিলো ও তাই হামজার বাবার কথাগুলো স্বাভাবিকভাবেই নিলো..
“আর তোমাদের সম্পর্কের প্রতি আমার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ আশা করি তুমি বুঝতে পারছো?”
“আমি বুঝতে পারছি, আর আমি এটাও জানি যে সব বাবাই তার সন্তানের জন্যে সেরা কিছু চায়। আপনিও তাই চাইছেন, আপনার চাওয়া ভুল নয়”
“হামজার নিজের কিছু রূলস ছিলো, ও সেভাবেই সবসময় চলে এসেছে কিন্তু তোমার জন্য নিজের পুরোনো সব নিয়ম বদলে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত ও কর্মক্ষেত্র দুই জায়গাতেই স’ম’স্যা’য় পড়ছে। নিজের ভা’লো’ম’ন্দ বিচার করছে না”
মিস্টার শাহের কথায় আলফা স্প’ষ্ট বুঝে গেছে যে হামজার বাবা ওকে কখনো মানবে না, আলফাও বাবা ছেলের মাঝে স’ম’স্যা’র কারণ হতে চায় না।
“আমি আশা করি আপনার ছেলেকে আপনি আবার আগের মতো ফিরে পাবেন, এই ব্যাপারে আমার যা করার করবো”
“তুমি কিন্তু এখনও আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাওনি”
“কোন প্রশ্ন?”
“তুমি কি আমার ছেলেকে পছন্দ করো?”
“আপনার ছেলে আমায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো আর আমি আপনার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, এর থেকে নিশ্চয়ই আপনি নিজের করা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন?”
আলফার কথায় কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন মিস্টার শাহ্, বুঝলেন আলফার মনে হামজার জন্যে কোনো অনুভূতি হয়তো সত্যিই নেই। আলফাও মিস্টার শাহ্কে নিশ্চিন্ত করলেন যে ও হামজাকে নিজের জীবন থেকে সরিয়ে দেবে। রাতে, ব্যালকনিতে দাড়িয়ে হামজার বাবার বলা কথাগুলো ভাবছিলো আলফা। মিস্টার শাহ্ এর কথা শুনে আলফার বিন্দুমাত্র ক’ষ্ট হয়নি কারণ এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে চায়না বলেই সকলে এতোবার বলার পরও হামজার বিয়ের প্রস্তাবে ও রাজি হয়নি। হামজার প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়েছে বটে কিন্তু তা এখনও অতো গভীর পর্যায়ে পৌঁছায়নি ভেবে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আলফা। জীবনে কোনোকিছুর প্রতি আর কোনো চাওয়া নেই আলফার, এখন সব বাদ দিয়ে নিজের জীবনটা নিজের মতো করে চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আলফা। খানিকক্ষণ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভেতরে চলে এলো আলফা, আলমারিটা এলোমেলো হয়ে আছে। তাই ভাবলো ঘুমানোর আগে আলমারিটা গুছিয়ে নেওয়া যাক, আলমারি থেকে সবকিছু বিছানায় নামালো আলফা। পুরো খালি করে ফেললো, শেষে ভেতরের দিকে কোনায় থাকা একটা রুমাল টান দিতেই ছোট্ট একটা পেন্ডেন্ট বক্স মাটিতে পড়লো। পেন্ডেন্ট বক্সটা হাতে তুলে বিছানায় বসলো আলফা, পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো এটা ওর নয়!
“এই পেন্ডেন্ট বক্স তো আমার নয়, তাহলে এখানে কিভাবে এলো?”
ভাবতে ভাবতেই বক্সটা খুললো আলফা, একটা কিউট ডায়মন্ড পেন্ডেন্ট এটা। কিন্তু পেন্ডেন্টটা দেখে বেশ চেনা চেনা লাগলো আলফার, যেনো কোথাও দেখেছে। অনেকক্ষণ ভাবার পর হঠাৎ মনে পড়লো এটা ও কোথায় দেখেছিলো!
ফ্ল্যাশব্যাক….
কদিন পরেই ফাহাদের ফুপাতো বোনের বিয়ে, তারজন্যে গিফট্ কিনতে হবে। গিফটের দায়িত্বটা মিস্টার খান ছেলে আর ছেলের বউয়ের ওপর দিয়েছেন। আলফার পরামর্শমতো ডায়মন্ড শপে এসেছে দুজনে। অনেক ঘুরে ঘুরে এরপর একটা ডায়মন্ড ব্রেসলেট কেনে ওরা, ফেরার সময় একটা শপের সামনে এসে দাড়িয়ে পড়ে আলফা। ডিসপ্লেতে রাখা একটা পেন্ডেন্ট দেখে ভীষন পছন্দ হয় আলফার।
“দাঁড়িয়ে পড়লে কেনো?”
পেন্ডেন্টটার দিকে ইশারা করে আলফা বলে..
“ফাহাদ, এটা দেখুন এটা সুন্দর না?”
“হ্যাঁ, সুন্দর কিন্তু তোমাকে মানাবে না”
“আমি কখন বললাম আমার জন্যে নেবো?”
“নিশ্চয়ই তোমার জন্যে নেবে বলেই তো দাড়িয়েছ”
“ফাহাদ, একটা জিনিষ দেখে চোখে ভালো লাগল কি সেটা দাড়িয়ে একটু দেখাও যাবেনা?”
“যে জিনিস কিনবে না, সেটা দাড়িয়ে দেখে কি লাভ?”
“উফফ, এখন তো দেখছি আপনার সঙ্গে আমি কথায়ও পেরে উঠবো না”
“সব তোমার থেকেই শিখেছি, এতদিন আমি তোমার সঙ্গে কথায় পেরে উঠতাম না কিন্তু আস্তে আস্তে তোমার কৌশল র’প্ত করেছি এবার থেকে আমি তোমায় কথায় হারাবো”
“বাচ্চাদের মতো কথা বলছেন!”
“হোয়াট এভার! চলো এবার”
ফ্ল্যাশব্যাক শেষ…
পুরোনো কথা মনে পড়তেই চোখ দুটো ভিজে এলো আলফার, বুঝলো সেদিন ফাহাদ মুখে যাই বলুক কিন্তু আলফার পছন্দের পেন্ডেন্ট ঠিকই কিনে এনেছিলো। এতোদিন পর ফাহাদের আনা উপহারটা নজরে পড়লো আলফার, হুট করেই ফাহাদের কথা ভীষন মনে পড়ছে ওর। চোখে পানি, তবুও মুখে হাসি রেখে আলফা বললো..
“তার মানে আপনি সেদিন সত্যিই এটা কিনে এনেছিলেন!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেন্ডেন্টটা হাতে তুললো আলফা, স্টারফিশ ডিজাইনের পেন্ডেন্টতার এর পেছনের দিকে তাকাতেই আলফার নজরে কিছু পড়লো। ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলো ছোট্ট ছোট্ট করে “A+F” লিখা। আলফা বুঝলো ফাহাদ অর্ডার দিয়ে ওর পছন্দ করা ওই পেন্ডেন্ট এর মতোই একটা পেন্ডেন্ট বানিয়েছে যার মধ্যে ফাহাদ নিজের এবং আলফার নামের অক্ষর লিখিয়েছে। এটা চোখে পড়া মাত্রই বুকটা মো’চ’ড় দিয়ে উঠলো আলফার, বুঝলো ফাহাদ হয়তো কখনো সুযোগ পেলে ভালোবাসার স্মৃতি হিসেবে আলফাকে এটা গিফট্ করতো। কিন্তু ভাগ্যের নি’র্ম’ম পরিহাস যে সেই সুযোগ ছেলেটা পেয়ে ওঠেনি। চোখ দুটো উপচে বেয়ে পড়তে শুরু করলো লোনাজল, ভেতরটা শা শা করছে আলফার। হুট করেই মনে প্রশ্ন ঝেঁকে বসলো এর মানে কি ফাহাদ আমায় ভালোবেসেছিলো?
“ফাহাদ, আপনি এটা কিনে আনতে পেরেছিলেন আমায় দিতে কি স’ম’স্যা হয়েছিলো? আপনি নিজে আমায় কেনো দিলেন না এটা..! আর যদি আমায় ভালোবাসলেন, কেনো আগে বললেন না!”
কা’ন্না’র’ত কন্ঠে ফাহাদের প্রতি অ’ভি’যো’গ প্রকাশ করলো আলফা, আজ হয়তো অনেক কাঁ’দ’বে মেয়েটা। এ সময় ফাহাদ থাকলে হয়তো আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতো মেয়েটার মাথায়, অ’স’ম্ভ’ব জেনেও এই মুহূর্তে আলফা সেটাই চাইছে। মাথায় অদ্ভুত চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, প্রকৃতির নিয়ম খ’ন্ডি’য়ে যদি সত্যিই এখন কোনোভাবে ফাহাদ চলে আসতো? এমন আরও নানান অদ্ভুত ভাবনার বাসা বাঁ’ধ’তে শুরু করেছে। নাহ, এ মুহূর্তে আর কিছু ভাবতে পারছে না আলফা
____________________
সর্বদিক বিবেচনা করে আলফা একলা ভাবেই সম্পূর্ন নতুন করে নিজের জীবন শুরু করতে চায়। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে একা থাকবে। শহরের বাইরে আলফাদের একটা বাড়ি আছে, আলফা ঠিক করেছে সেখানে গিয়েই থাকবে। ওই বাড়ির কাছেই একটা কলেজ আছে সেখানে চাকরির ব্যাপারেও কথা বলেছে। নিজের শ্বশুরবাড়ি ও বাপের বাড়ি উভয় পক্ষের সঙ্গেই কথা বলেছে। শুরুতে তারা রাজি হননি, একলা আলফা কিভাবে থাকবে? কিন্তু আলফার অনুরোধে তারা রাজি হয়। আলফা যেভাবে ভালো থাকতে চায় সেভাবেই থাকবে বলে তারা রাজি হয়। কয়েকদিন পর এক রাতে হামজাকে কল করে আলফা..
“আপনি আগামীকাল ফ্রি আছেন?”
“হ্যাঁ, কেনো?”
“তাহলে, আগামীকাল চলে আসুন। দুজনে দেখা করি”
আলফা নিজে থেকেই দেখা করতে চাইছে শুনে বেশ অবাক হয় হামজা, তবে খুশিও হয়েছে বটে! তবুও নিশ্চয়তার জন্যে আরেকবার জিজ্ঞাসা করলো..
“আর ইউ সিরিয়াস?”
“কেনো? আপনার বিশ্বাস হচ্ছেনা বুঝি?”
“সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছেনা, মানে আপনি নিজে থেকেই আমাকে দেখা করতে বলছেন এটা তো রেয়ার একটা ব্যাপার তাইনা?”
“ইয়েস, আর ধরে নিন এটা আমাদের প্রথম ডেট”
“হোয়াট! ডেট? আলফা, আপনি মজা করছেন না তো আমার সঙ্গে? আপনি নিজে আমায় ডেটের ইনভাইট করছেন?”
“হ্যাঁ, কাল তো বন্ধের দিন আর আপনি জানেন আমি কোথায় থাকবো। চলে আসবেন সময়মতো”
“ডো’ন্ট ওরি, চলে আসবো আমি। থ্যাংক ইউ আলফা”
পরেরদিন ছুটির দিন ছিলো, সেদিনও হামজা এসেছে। লাইব্রেরী থেকে শুরু করে সারাদিন তারা সময় কা’টি’য়ে’ছে। হামজা অনেক খুশি ছিলো, ভেবেছিলো হয়তো আলফা ওর ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিচ্ছে কিন্তু আলফার তরফ থেকে তেমন কিছুই ছিলো না। সন্ধ্যায় ফেরার সময় হলো, তখন…
“আলফা, থ্যাংক ইউ সো মাচ আমাকে এতোটা সময় দেওয়ার জন্যে। এর মানে কি আমি ধরে নেবো যে আমরা..”
“হামজা আমার আপনাকে কিছু বলার আছে”
“হ্যাঁ বলুন”
“আমি ঠিক করে নিয়েছি কিভাবে আমার ভবিষ্যৎ জীবন কা’টা’বো। নিজের জন্যে আমি কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর তাতে আমার পরিবার রাজি হয়েছে”
“বেশ তো, আপনার সকল সিদ্ধান্তে আমিও রাজী। আপনার জীবনসঙ্গী হিসেবে আমি সবসময় আপনার পাশে..”
“নাহ হামজা, আমার চলার পথে আপনি আমার সঙ্গী হবেন না। এটা আমার জীবন, যা আমি একাই চলতে চাই। সেখানে আমার কোনো সঙ্গীর প্রয়োজন নেই”
আলফার প্র’ত্যা’খ্যা’ন সেদিন হামজার হৃদয় ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত করে দিয়েছিলো কিন্তু তবুও হামজা আলফা কে কোনো বিষয়ে জো’র করেনি কারণ আলফা কেনো কাউকে নিজের জীবনে চায়না তার কারণ হিসেবে বলেছিলো ফাহাদকে ভালোবাসার কথা। সেদিন শেষবারের মতো হামজাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো আলফা, তার সঙ্গে নিজের মনে হামজার জন্যে তৈরি হওয়া স্বল্প অনুভূতিও ত্যা’গ করেছিলো সঙ্গে ঠিক করে নিয়েছিলো কারো জন্যে, কারো পরিচয়ে বা কারো সঙ্গে নয়, বরং নিজের জীবন একাই কা’টা’বে নিজের পরিচয়ে নিজের সঙ্গে।
____________________
আট বছর পর…
কয়েকদিন আগে হামজার নবম মৃ’ত্যু’বা’র্ষি’কী ছিলো, তাই “খান ম্যানশনে” এসেছে আলফা। এ বাড়ির সবার সঙ্গে আলফার সম্পর্ক এখনও ঠিক তেমনি আছে যেমন আগে ছিলো। ফারহান এখন একাই ব্যবসার কাজ সামলাচ্ছে, মিস্টার ও মিসেস খান দুজনেই বাড়িতে থাকেন। বাড়ির সম্পূর্ন দায়িত্ব অহনার ওপর, শ্বশুর শাশুড়িসহ বাড়ির সবকিছু ও নিজেই সামলাচ্ছে। ফারহান অহনার দুজন ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ সুখেই সংসার করছে। আলফাও নিজের ছেলেকে নিয়ে ভালো আছে। ছেলে শুনে অবাক হচ্ছেন তো? আলফা এখান থেকে যাওয়ার পরপরই সদ্য জন্মানো এক বাচ্চাকে দত্তক নিয়েছিলো হাসপাতাল থেকে, যার মা জন্মের সময় মা’রা হয় এবং ওই পরিবারের আর কেউ ছিলো না। সেই বাচ্চাকে আলফা নিজের পরিচয়ে বড় করছে নিজের সন্তান হিসেবে। এখন আলফার জীবনে তার ছেলে ফায়জান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেকে নিয়ে ভালো থাকা এবং মানুষের মতো মানুষ করাই এখন একমাত্র উদ্দেশ্য আলফার! কালকেই আবার ফিরে যাবে আলফা, মিসেস খান তাই বৌমার জন্যে অনেককিছু গুছিয়ে দিচ্ছেন নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
“আন্টি, এতোকিছু লাগবেনা!”
“নিয়ে যাও আলফা, ফায়জান এগুলো খেতে ভালোবাসে তো। ও খাবে সব। তুমি তো অনেকদিন পর পর আসো, তাই আমি এবার আগেই ফারহানকে দিয়ে সব আনিয়ে রেখেছিলাম”
“আন্টি, আমি কদিন পর এসে আপনাকে আর আঙ্কেলকে নিয়ে যাবো। আমার বাড়িতে থেকে আসবেন কিছুদিন, ভালো লাগবে”
তখনই হুট করে কোত্থেকে যেনো দৌড়ে এলো ফায়জান, এসেই মিসেস খানের গলা জড়িয়ে ধরে বললো..
“দাদু, এতোকিছু তুমি আমার জন্যে দিয়ে দিচ্ছ?”
“হ্যাঁ দাদুভাই, এই সব তোমার জন্যে। কিন্তু এখানে মিষ্টি জিনিস বেশি আছে তাই অল্প অল্প করে অনেকদিন ধরে খাবে কেমন?”
“থ্যাংক ইউ দাদু, আম্মু তো আমাকে মিষ্টি জিনিস খেতেই দেয়না”
“হয়েছে হয়েছে ফায়জান, দাদুর কাছে আর আমার নামে না’লি’শ করতে হবেনা। তুমি যাও, বাইরে গিয়ে খেলো”
“আম্মু, কালকেই তো আবার আমরা চলে যাবো। দাদুকে সেই কবে আবার দেখবো, আজ একটু থাকি দাদুর সাথে?”
“হ্যাঁ আলফা, থাকুক আজ আমার কাছেই। আর ও আমায় একটুও বি’র’ক্ত করেনা। আমার তো দাদুভাইয়ের সঙ্গে থাকতে অনেক ভালো লাগে”
নিজের নাতি না হওয়া সত্বেও ফায়জানকে মিসেস খান এতোটা ভালোবাসেন যা বলে বোঝানো যাবেনা, ফায়জানকে দত্তক নেবার পর শুরুতে আলফা ভেবেছিলো হয়তো ফাহাদের মা বাবা ওকে মানবে না কিন্তু ওর ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সকলেই ফায়জানকে অনেক ভালোবাসে। দুপুরের খাওয়া শেষে অহনা খাবার টেবিল গোছাতে ব্যস্ত, আলফা এসে তখন ওকে সাহায্য করতে শুরু করে..
“জানো তো ভাবী, পুরোনো দিনগুলো মনে পড়ে গেলো। একসময় আমরা দুজনে এভাবেই হাতে হাতে একে অপরকে সাহায্য করতাম তাইনা? তখন অবশ্য আমি এতকিছু পারতাম না”
“অহনা, মানুষ তো আস্তে আস্তে শেখে সব তাইনা? এই দেখো তুমি এখন সব শিখে গেছো। একা হাতে পুরো সংসার সামলাচ্ছো”
“হুমম, কিন্তু ভাবী তোমার ওপর আমার অনেক অ’ভি’মা’ন জমে আছে”
“আমি আবার কি করলাম?”
“কি করলে? এইযে প্রায় ছয় মাস পর এসেছিলে তুমি বাড়িতে আবার কালকেই চলে যাচ্ছো। আমাদের কথা বুঝি তোমার মনেই পড়েনা”
“অহনা, জানোই তো যে কলেজে চাকরি করছি তার প্রিন্সিপাল অনেক কড়া। ছুটি পাওয়া মু’শ’কি’ল”
“তবুও ভাবী, একটু ঘনঘন আসার চেষ্টা করো। আম্মু আব্বু ফারহান আমি, আমরা সবাই তোমাকে অনেক মিস করি”
“হুমম, চে’ষ্টা করবো”
“আব…ভাবী একটা কথা বলবো?”
“বলো”
“ভাইয়া তোমার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাইছিলো”
“হুমম, আসতে বলো না। আমারও অনেকদিন হলো দেখা হয় না হামজার সঙ্গে”
বিকেলের দিকে ফায়জানকে নিয়ে একটু বেরিয়েছিলো আলফা, সেখানে একটা পার্ক ছিলো। অনেক বাচ্চারা খেলা করছিলো, তা দেখে ফায়জান বলে..
“আম্মু, আমি একটু খেলি?”
“সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে বাবা, আমাদের তো কালকে আবার বাসায়ও যেতে হবে। গোছগাছ বাকি এখনও”
“আম্মু প্লিজ প্লিজ, দশ মিনিট”
ছেলের কথা শুনে হাসলো আলফা, ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো..
“আচ্ছা যাও, আমি এখানে বসছি। খেলা শেষ হলে সোজা এখানে আসবে কেমন?”
মায়ের অনুমতি পাওয়া মাত্রই একগাল হাসলো ফায়জান, এরপর ছুটে চোখে ফেলো ভেতরে। আলফাও পার্কের ভেতরে এলো, ওখানে একপাশে একটা বেঞ্চ ছিলো। এক কাপ চা কিনে নিয়ে সেখানে বসলো, যাতে ফায়জানকে ভালোভাবে দেখতে পায়। একটু পরেই টুং করে ফোনটা বেজে উঠলো, বহু বছর পর পরিচিত একজনের মেসেজ এসেছে। মেসেজকারী জানতে চেয়েছে আলফার বর্তমান অবস্থান, আলফাও উত্তর পাঠালো। প্রায় মিনিট পনেরো পর এলো সেই ব্যক্তি। বেঞ্চের এক প্রান্তে বসে আছে আলফা, আরেক প্রান্তে এসে বসলো হামজা। হামজা এক নজর তাকালো আলফার দিকে দেখলো। আলফার গায়ে হালকা রঙের সুতির একটি শাড়ি, চুলগুলো উচু করে খোঁপা করা, হাতে দুটো চিকন চুড়ি আর গলায় সেই পেন্ডেন্ট। যদিও হামজা আজও জানেনা পেন্ডেন্টটা ফাহাদের দেওয়া, তবে আলফাকে কখনো এটা খুলতে দেখেনি। যাই হোক, আলফার সাজসজ্জায় তাকে পুরো এক সম্পূর্না লাগছে। বেশ একটা মা মা ব্যাপার, ভুল তো নয়। আলফা তো এখন এক ছেলের মা ই বটে! সেদিন আলফা চলে যাওয়ার পর আজ অব্দি হামজা কখনো আলফার সঙ্গে যোগাযোগের চে’ষ্টা করেনি, বলতে গেলে এতগুলো বছরে দুজনের সেভাবে দেখা বা কথা হয়নি। সে হিসেবে আজ বহু বছর পর কাছ থেকে আলফাকে দেখার সুযোগ পেয়েছে হামজা। হামজাকে দেখামাত্রই হুট করে আলফা বলে উঠলো..
“আপনি কি চির কুমার সমিতিতে নাম লেখানোর চিন্তাভাবনা করছেন?”
“কেনো?”
ভ্রু কুঁ’চ’কে তাকালো আলফা, হামজাকে দেখে বললো..
“বু’ড়ো হয়ে যাচ্ছেন সে খেয়াল আছে? আপনার বয়সী সবার ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলো। আমার ফায়জানের ও সাত বছর হয়ে গেছে”
“হুমম, সবাই সবার মতো করে ভালো আছে। আমিও তো এভাবেই ভালো আছি, বিয়ের কি দরকার?”
“অবশ্যই দরকার আছে, সেটা বিয়ে না করা অব্দি বুঝবেন না”
“আলফা, আমাকে ফিরিয়ে নেওয়া যায়না?”
হামজার প্রশ্নে প্রথমে থ’ত’ম’ত খেয়ে গেছিলো আলফা। এতো বছর পরও হামজার কণ্ঠস্বর, কথা বলার ধরনে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। আলফার সঙ্গে পূর্বে যেভাবে কথা বলতো, আজও সেভাবেই কথা বলছে। আজও সেই পুরোনো আর্জি করতে ভোলেনি..
“হামজা, আমি আপনাকে কখনো বলিনি যে আমি আপনাকে ভালোবাসি। তাহলে কেনো নিজের এক তরফা অনুভূতি নিয়ে নিজেকে এভাবে শে’ষ করছেন? জে’দ ছেড়ে দিন”
“আপনি আমার জে’দ নন আলফা, যেটা যখন মন চাইবে ছেড়ে দিতে পারবো”
“চাইলেই সব হয়, এইযে আমাকেই দেখুন না। ফাহাদ যাওয়ার পর সবাই আমায় নিয়ে চিন্তায় ছিলো। ভবিষ্যতে আমার কি হবে, একা কিভাবে কি করবো কিন্তু আজ আমি আর একা নই। জীবনের অবলম্বন পেয়ে গেছি আমি, আপনিও চাইলেই সব করতে পারবেন”
“আপনার মাঝে যে এখনও আমি মত্ত হয়ে আছি, মনে হয় না সব এতো সহজে ভুলতে পারবো”
“এটা মন্দ বলেননি, কারো প্রতি মত্ততা সত্যিই সহজে ছাড়া যায়না। এই আমাকেই দেখুন আমি ফাহাদের উপস্থিতিতে ভালোবাসার সুযোগ পাইনি, বলতে পারেন ওর ওপর এতো রে’গে ছিলাম যে কখনো চেষ্টাই করিনি কিন্তু এখন ও নেই কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসছি আর সারাজীবন বাসবো। ফাহাদের ভাবনায় মত্ত থেকেই বুঝে নেবো ও আমাদের সঙ্গেই আছে”
আলফার কথায় স্প’ষ্ট যে সে ফাহাদকে ভালোবাসে, হয়তো অনেকটা বেশিই ভালোবাসে নাহলে যে মানুষটার অ’স্তি’ত্ব’ই পৃথিবীতে নেই তাকে নিয়ে এতো তী’ব্র চিন্তাভাবনা সম্ভব নয়। যদিও আলফা বহু আগেই হামজার থেকে সরে এসেছে কিন্তু আজ আলফার সঙ্গে দেখা করার হামজার মনে হচ্ছে আলফা সত্যিই অনেকটা এগিয়ে গেছে, শুধু ওই থেমে আছে। খেলার ফাঁকে মায়ের দিকে হাত তুলে ইশারায় নিজের উপস্থিতি জানান দিলো ফায়জান, আলফাও হাসিমুখে ছেলের ইশারায় সাড়া দিলো। মা ছেলের এই দৃশ্য দেখে হামজা বুঝলো এটাই এখন আলফার জীবন তবুও কৌতূহলবশত হামজা প্রশ্ন করলো..
“আপনি ভালো আছেন আলফা?”
“হুমম, আমি আমার ছেলেকে নিয়ে বেশ ভালো আছি। নিজেকে নিয়ে ভালো কিভাবে থাকতে হয় তা শিখে গেছি, আর এখন তো আমার কাছে ভালো থাকার কারণও আছে। জানেন, ফাহাদ যাওয়ার পর অনেকের কাছেই শুনেছি মেয়েদের জন্যে নাকি এমন একটা পরিচয় দরকার হয় যা অন্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। আমার বর্তমান পরিচয় আমি ফায়জানের মা। যাই হোক, আমার মনে হয় আপনার উচিত অতীত ভুলে নতুন করে সবটা শুরু করা”
“বেশ, এবার না হয় তাই করবো কিন্তু এখনও একটা কাজ যে বাকি রয়ে গেছে?”
“কি?”
“আপনি এখনও আমার কফির অফার অ্যা’ক’সে’প্ট করেননি..”
হামজার কথায় হাসলো আলফা, আলফার হাসি দেখে হামজাও হাসলো। এরপর চললো দুজনের টুকটাক আলাপন। ধীরে ধীরে সময় ফুরিয়ে এলো, ছেলেকে নিয়ে ফেরার পথ ধরলো আলফা, যাওয়ার সময় হামজাকে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যে শুভ কামনা জানিয়ে গেলো। আজ আলফাকে দেখার পর হামজার মনে হলো সত্যিই হয়তো জীবনটা নতুন করে শুরু করা দরকার…
___________________
ছেলেকে নিয়ে সকালে ফিরেছে আলফা, বাড়িতে অনেক কাজ ছিলো। সেগুলো করতে করতে সারাদিন পার হয়ে গেছে। ছেলেও মায়ের কাজে সাহায্য করেছে, বেচারা এখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। রাতের খাবার শেষে সব গুছিয়ে ঘরে এসে আলফা দেখলো ছেলে ঘুমিয়ে গেছে। আলতো করে ছেলের কপালে চুমু দিয়ে লাইট বন্ধ করে দিলো আলফা এরপর ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানার পাশের জানালার ধারে গিয়ে বসলো। আজ সুন্দর চাঁদ উঠেছে, তারাগুলোও জ্ব’ল জ্ব’ল করছে। ফোন স্ক্রল করতে করতে একনজর ছেলের দিকে তাকালো। এরপর আকাশের দিকে তাকালো আলফা, হেসে বললো..
“ফাহাদ, তোমার ছেলেবেলা সম্পর্কে আন্টির থেকে জেনেছি। আমিও ফায়জানকে তোমার মতোই বড় করার চেষ্টা করছি। ছেলে কিন্তু আমাদের বেশ ব্রিলিয়ান্ট, ঠিক তোমার মতো। তুমি নিশ্চয়ই সবটা দেখছো? দেখে নিও, ছেলেকে আমি ঠিক তোমার মতো করেই বড় করবো। আমি ঠিকমতোই এগোচ্ছি তো, তাইনা?
কথাগুলো বলেই স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ফেললো আলফা।জীবনটা সুন্দরভাবে কা’টা’তে শিখে গেছে আলফা। নিজের অ’তী’ত ও জীবনের প্রতি ওর কোনো অ’ভি’যো’গ নেই ফাহাদের স্মৃতি এবং ফায়জান এই দুই নিয়েই এখন আলফার জীবন সম্পূর্ন..!!
____সমাপ্ত ____