#তোমাতেই_বিমোহিত
#পর্বঃ১৯
#লেখিকা আরোহি জান্নাত (ছদ্মনাম)
ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে রাফসান। ভিতরে রিনিকে দেখছে ডাক্তার।তখন বাইরে চেঁচামেচির শব্দে রাফসান বাইরে বেরিয়ে আসে এবং দেখে রিনিকে ধরে বসাচ্ছে কয়েকজন মেয়ে।ওখানে গিয়ে জানতে পারে রিনি নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাই রাফসান তাকে নিয়ে পাশের একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে এসেছে।
রাফসান চাইলে অন্য কলিগদের দিয়ে রিনিকে হসপিটালে পাঠাতে পারত তবে রাফসানের বারবার মনে হচ্ছে রিনির অসুস্থতা রাফসানের জন্য। তাই রাফসান নিজে নিয়ে এসেছে রিনিকে।রাফসান বসে বসে এসব ভাবছিল তখন ডক্টর এসে হাজির হয়।ডক্টর নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলে,
“চিন্তার কোনো কারণ নেই। আপনার ওয়াইফ সুস্থ আছে। তবে ওনি হয়তো ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করেন না। তাই এমন টা হয়েছে। আমি একটা স্যালাইন দিয়ে দিয়েছি। ওটা শেষ হলে ওনাকা বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন।”
ডাক্তার এর কথা শুনে রাফসান কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ডক্টর তো রিনিকে ওর ওয়াইফ ভাবছে।কিন্তু সেটা তো ঠিক নয়।তাই রাফসান বলে উঠল,
“মেয়েটা আমার ওয়াইফ না।আমরা একই অফিসে জব করি।ও আমার জুনিয়র। ব্যাস এটুকুই।”
রাফসানের কথা হয়তো ডক্তরের পছন্দ হলো না।কেমন করে যেন দেখল রাফসানের দিকে। রাফসান একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল ডক্টর এর এমন চাহনিতে। তবে মুখের ভাবে সেটার প্রকাশ ঘটতে দিল না।তখন ডক্টর বললেন,
“আচ্ছা ঠিক আছে। ওনি ভেতরে আছেন।একটু পরই জ্ঞান ফিরে আসবে। আর স্যালাইনটা শেষ হলে ওনাকে নিয়ে যাবেন।”
রাফসান ডক্টর এর ফিস মিটিয়ে দিয়ে ভেতরে চলে গেল যেখানে রিনি আছে।
চুপ করে শুয়ে আছে রিনি।নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখে প্রথম এ অবাক হলে ও পরে কিছু টা আন্দাজ করতে পেরেছে। তবে এখানে তাকে কে এনেছে আর কি ভাবে এনেছে এটাই জানে না রিনি।
তখনই কেবিনে প্রবেশ করে রাফসান। রাফসানকে দেখে একটু অবাক হয় রিনি।মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে তাকে এখানে কি রাফসনই এনেছে।জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে রিনির তবে একটা সংকোচ ও কাজ করছে। এসব ভাবছিল রিনি।তখন রাফসান রিনির বেডের পাশে রাখা টুল টা তে বসল।নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আর ইউ ফিল বেটার নাও?”
অপ্রস্তুত হলে ও সৌজন্য হেসে রাফসানকে বলল,
“হ্যাঁ এখন ঠিক আছি।”
“ডক্টর বলল তুমি নাকি ঠিক ঠাক খাওয়া দাওয়া করো না।এটা কিন্তু ঠিক না মিস.রিনি।তোমার এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আজ অফিসের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গেছিলে যদি রাস্তায় ঘাটে এমনটা হতো কত বিপদ হতে পারত তুমি জানো।সো বি কেয়ারফুল ফ্রম নাও।”
রাফসানের কথা শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছে রিনি।এই কি সেই রাফসান যে গতকাল তাকে এত অপমান করল।তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে বলেছিল।অথচ আজ সেই কিনা রিনির সাথে এত সাবলীল ভাবে কথা বলছে যেন কালকে কিছুই হয় নি।কিন্তু না রাফসান সব ভুলে গেলে ও রিনি এত সহজে ভুলবে না।সে কখনোই আর রাফসানের কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে যাবে না। এমনকি কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখবে না ভেবেছি রিনি।কিন্তু আজ সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। যে রাফসানের থেকে দূরে যেতে চাইছিল সেই রাফসানই আজ তাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে। নিজের ওপর আজ প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে রিনির।
রিনি চুপচাপ আছে। রাফসানের কথায় উত্তর দিলো না।রাফসান বুঝল কালকের বিষয় টা নিয়ে হয়তো রিনি এখনো আপসেট। তাই হয়তো কথা বলল না।রাফসান হঠাৎ বলে উঠল,
“আম সরি রিনি।কালকের ব্যাবহারের জন্য আমি সত্যি দুঃখিত।”
রিনি রাফসানের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। রাফসান তাকে সরি বলছে। কিন্তু রিনি যতটুকু জানে রাফসান খুব হার্ড পারসোনালিটির তাহলে কি সে সত্যি অনুতপ্ত। রিনিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাফসান বুঝে যায় যে রিনি কেন অবাক হয়ে গেছে তাই বলে,
“আজ অফিস থেকে আমাদের দুজনের জন্যই ছুটি নিয়েছি।স্যালাইন শেষ হলে আমার সাথে এক জায়গায় যাবে রিনি!”
রাফসানের অনুরোধ ফেলতে পারে না রিনি।তাই রাফসানের কথায় সায় জানায় সে।
_____________________
সকাল থেকে নিজের ঘরে মুখ গোমড়া করে বসে আছে আরোহি। ইহান এভাবে চলে গেছে এটা মানতে পারছে না সে।আরোহি জানে তার দোষেই ইহান চলে গেছে। কিন্তু আরোহি তো এটা চায়নি।সে চেয়েছিল ইহান যেন তার ওপর জোর দেখায়, তাকে বলে আরোহি যেন না যায়।
নারী চরিত্র বড়ই বিচিত্র। বড়ই আহ্লাদিত। আর আরোহি সেটা আবারও প্রমান করে দিল।
তবে আর নয়।এখন তো দুজনের কাছেই সব পরিষ্কার তাহলে এই দূরত্ব অযাচিত দুজনের কাছে। যে কোনো একজন এগোলেই সম্পর্ক টা স্বাভাবিক হবে।আর আরোহি সিদ্ধান্ত নিলো সেই এগিয়ে যাবে।অনেক তো হলো কষ্ট দেওয়া নেওয়া, অনেক তো হলো মান অভিমান। এবার না হয় অভিমান, রাগ ইগোটাকে দূরে সরিয়ে ভালোবাসা টাকে বেশি গুরুত্ব দিল।
এসব কথাই মনে মনে ভাবছে আরোহি। তখনই আরশি বেগম আয়ানকে নিয়ে আরোহির কাছে এলেন।তার বউমা নামক মেয়েটার যে অভিমান হয়েছে সেটা বুঝতে পারলেন তিনি। তবে তিনি সবটা ওদের দুজনের ওপর ছেড়ে দিলেন।স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মান অভিমান হবে, আবার মিটে ও যাবে কিন্তু সেটার মধ্যে বারবার বড়দের ঢোকা ঠিক না।তাই তিনি আরোহিকে একটা কথা বলতে এসেছেন। আরশি বেগম আরোহির পাশে বসলেন।বললেন,
“এত ভাবিস না মা।একটু রাগ হয়েছে।সময় মতো ঠিক ফিরে আসবে।ফোন করেছিল একটু আগে।সন্ধ্যায় ফিরবে বলেছে। ”
খালামনির কথায় আলতো হাসল আরোহি যদিও সেটা দেখানো হাসি। আরশি বেগম তখন বলে উঠল,
“আমরা আজ একটু গ্রামের বাড়িতে যাবো আরোহি।ইহানের দাদি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ইহানের বড় চাচু ফোন দিয়েছিল। তোকে নিয়ে যেতাম তবে তোর বড় বাবা ভার্সিটিতে ভর্তির ব্যাপারে কথা বলেছেন।কালকেই ভর্তি হতে হবে তোকে। এরপর আর সিট পাওয়া যাবে না। ইহানকে আমি যা বলার বলে দেব।তোকে ওই তোকে কাল ভর্তি করিয়ে দেবে।তারপর ইহানের সাথে গ্রামের বাড়িতে চলে যাস।আর ওখান থেকে ফিরে ক্লাস শুরু করিস।কেমন!”
খালামনির কথায় হ্যাঁ বলল আরোহি। কারণ খালমনির কথা বা পরিকল্পনা যথাযথ।আরোহিকে সবটা বুঝিয়ে দুপুরের দিকে রওনা হলেন ইদ্রিস সাহেব আর আরশি বেগম।সাথে আায়নকে ও নিলো।আরোহি বলেছিল আয়ানকে রেখে যেতে কিন্তু আরশি বেগম এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেছেন আয়ানকে।আর আয়ান ও এখন আরশি বেগম এর কাছে থাকে।
হয়তো ইহান আর আরোহি একটু একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে পারবে এটা ভেবে আয়ানকে জোর করে নিজেদের সাথে নিয়ে গেছেন তিনি। আরোহি ওনাদের বিদায় দিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেল।
_____________________
রাফসানের বাড়িতে এসে অবাক হয়ে গেছে রিনি।একটা ব্যাচেলার ছেলে যে এতটা পরিপাটি হতে পারে সেটা জানা ছিল না রিনির।রিনি চারিদিক মুগ্ধ হয়ে দেখছিল।রাফসান তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায় শুনে একটু অবাক হলে ও খুশি হয়েছিল রিনি।রাফসানের মুখে সরি শোনার পর রাগগুলো যেন নিমিষেই ভেনিস হয়ে গেছে।হয়তো এটাই ভালোবাসা।
হঠাৎই দেওয়ালে একটা মেয়ের হাস্যজ্জল ছবি দেখে ভ্রু কুচকে গেল রিনির।রাফসানের বাড়িতে এমন ছবি হয়তো আশা করেনি রিনি।আবার পাশে একটা বাচ্চা ছেলের ছবি ও আছে।রিনি এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে মায়াবী চেহারার অধিকারি সেই মুখটার দিকে। অনেক কিছু ভেবে ও ঠিক বুঝতে পারছে না ছবিটি কার।রাফসান রিনিকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে কিচেনে গিয়েছিল কফি বানাতে। এসে দেখে রিনি এক দৃষ্টিতে দেওয়ালে টানানো ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। রাফসান হালকা শব্দ করতেই রিনি পিছনে ফিরে দেখতে পেল রাফসান কফি হাতে দাড়িয়ে আছে। রিনি সৌজন্যে হেসে কফিটা নিল।সোফায় বসে কফির মগে চুমুক দিতে লাগল।তখনই রাফসান বলে উঠল,
” ওই ছবিটা আমার ওয়াইফ এর।”
রাফসানের কাছ থেকে এমন অপ্রত্যাশিত কথা শুনে বিষম খেল রিনি।রিনির অবচেতন মন একটাবারের জন্য ও আন্দাজ করতে পারেনি রাফসান বিবাহিত। এখন রিনি খুব ভালো করে বুঝতে পারছে রাফসান কেন তাকে এখানে এনেছে। তখনই রাফসান আবার ও বলে উঠল,
“পাশের ছবিটা আমার ছেলের।নাম আয়ান।”
এবার যেন রিনি দ্বিতীয় ধাক্কা টা খেল।রাফসানের দিকে এমন করে তাকালো যেন বলতে চাইছে,
“মন ভাঙবি ভালো কথা। কিন্তু এভাবে হার্ট অ্যাটাক করিয়ে মারার প্লান কেন করেছিস?”
রাফসান নিজের ফোন টা বের করে রিনির সামনে ধরল সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বধু বেশে সেই রমনি দাঁড়িয়ে আছে আর পাশে বরবেশে রাফসান দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণে মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ অবিশ্বাস থাকলে ও এখন আর সেটার উপায় নেই। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল রিনির।
চলবে,