#তোমাতেই_বিমোহিত
#পর্বঃ২
#লেখিকা আরোহি জান্নাত। (ছদ্মনাম)
অনেক সকালে ঘুম ভাঙে আরোহির কিন্তু নিজের দিকে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় আরোহির।
নিজেকে বিছানায় দেখে বেশ অনেকটায় অবাক হয় আরোহি। আরোহির স্পষ্ট মনে আছে সে কালকে সোফাতে ঘুমিয়েছিল তাহলে এখানে এলো কখন।তখনই সোফার দিকে চোখ যায় আরোহির।ইহান সোফাতে ঘুমাচ্ছে। তারমানে ইহান আরোহিকে বিছানায় নিয়ে এসেছে।আর নিজে সোফায় ঘুমিয়েছে। ইহান এর দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে আরোহি।ঠিক আগের মতোই আছে। এক বছর আগে যেমনটা ছিল ঠিক তেমনটা শুধু মনুষটার ভেতরটা বদলেছে।এই এক বছর আগে এই মনুষটার মনের কোথাও একটা আরোহি ছিল কিন্তু এখন সেই জায়গায় আয়ানের মায়ের বসবাস। না আর ভাবতে চায় না আরোহি। ভাবতে চায় না সেই অতীত।
নিজেকে কিছু টা সামলে নিয়ে আয়ানের দিকে তাকালো আরোহি। ছেলেটা বড্ড শান্ত। এই ৩ মাসে আরোহিকে একটু ও সমস্যায় ফেলে নি।প্রথম এক মাস আরোহির একটু অসুবিধা হয়েছিল তবে এখন একটু ও অসুবিধা হয় না। আর এর বড় কারন হলো আয়ান মাঝ রাতে কান্না করে না। একটু পরেই আয়ান উঠে যাবে তাই তারাতাড়ি ফ্রেশ হতে গেল আরোহি। ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখে আয়ান উঠে গেছে। মুচকি হাসলো আরোহি আয়ানকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল সে।বাড়িতে থাকতে ও আরোহি ঘুম থেকে ওঠার পরে আয়ানকে ঘরের বাইরে নিয়ে যেত, আজ ও তার ব্যাতিক্রম করলো না।বাইরে যাওয়ার আগে আরো একবার ইহানের দিকে তাকালো আরোহি কিন্তু অভিমানগুলো যে বড্ড বেশি তাই তারাতাড়িই চোখ ফিরিয়ে নিল আরোহি।
রান্নাঘরে লতা বেগম সকালের নাস্তা বানাচ্ছেন। আজ প্রায় ৩ বছর ধরে লতা বেগম এই বাড়িতে আছেন।আরশি বেগম অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই তিনি এই বাড়িতে কাজ করেন। লতা বেগম কে দেখে সৌজন্য হাসলো আরোহি এই মানুষটিকে বেশ পছন্দ করে আরোহি। আরোহিকে দেখে লতা বেগম ও হাসলো বলে উঠল,
“আরে আরোহি মামুনি তুমি উঠে পড়েছ।আায়ান বাবা ও তো উঠে পড়েছে দেখছি।”
আরোহিও হাসি মুখে বলল,
“হ্যাঁ লতা ফুফু উঠে গেছি আমরা। আচ্ছা আমাকে এক কাপ চা আর একটু গরম পানি করে দাও তো আয়ানের খাওয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে।”
মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো লতা বেগম। আরোহি ও আয়ানকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসল। তখনই আরশি বেগম ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হন। আরোহি আর আয়ানকে দেখে মুখে আপনাআপনি হাসি ফুটে ওঠে তার। হাসিমুখেই আরোহির পাশে এসে বসেন তিনি।আয়ানকে আরোহির কোল থেকে নিয়ে আদর করতে থাকেন। এই প্রথম আয়ান নিজের বাড়িতে রাত কাটিয়েছে।দাদি হিসেবে তৃপ্তির হাসি যেন সরছে না আরশি বেগমের মুখ থেকে। আয়ানকে মন ভরে আদরের পর আরোহিকে জিজ্ঞেস করেন আতশি,
“মা রাতে তোর কোনো অসুবিধা হয়নি তো? নতুন জায়গায় ঘুম ভালো হয়েছে তো?”
খালামনির কথায় হাসিমুখে জনায় আরোহি তার কোনো অসুবিধা হয় নি।
আরশি বেগম ইহান এর কথা জিজ্ঞেস করতে চায়লেন তবে তা আগেই ইহান ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসতে বসতে বলল,
“ফুফু আমার চা টা দাও।”
সকলের উপস্থিতি টের পেয়ে একেবারে সকলের জন্য চা বানিয়ে আনলো লতা বেগম।সকলকে চা এগিয়ে দিয়ে আরশির কাছ থেকে আয়ানকে কোলে তুলে নিলেন তিনি। বললেন,
“আপামনি আপনারা চা খেয়ে নাস্তা করে নিন।ততক্ষণ আয়ান বাবা আমার কাছে থাকুক।”
লতা বেগমের কথা শুনে কেউ না করল না।ইহান চা খাচ্ছে আর খবরের কাগজ পড়ছে তবে তার মনোযোগ আরোহির দিকে কাল সারারাত এই মেয়েটার সাথে একই ঘরে ছিল সে ভাবতেই মনের মধ্যে কেমনটা অনুভূতি কাজ করছে।
আজ ১ বছর ১ মাস ১৩ দিন মেয়েটা তার সাথে কথা বলে না। এমনি ঠিক করে ইহানের দিকে দেখে ও না।আজ এই মেয়েটা তার স্ত্রী কিন্তু তাও কত দূরত্ব তাদের মধ্যে। মেয়েটা তাকে এখোনো ক্ষমা করতে পারেনি সে জন্যই তো কাল রাতে ওভাবে সোফায় ঘুমিয়েছিল। হঠাৎই কালকে রাতের কথা মনে পড়ে গেল ইহানের। গতকাল রাতে ইহান কিছুতেই ঘরের ভিতরে যেতে পারছিল না। কোথাও একটা বাধছিল।কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পর নিজের সাথে যুদ্ধ করে অনেক রাতে ঘরে ঢোকে ইহান। ঘরে ঢুকে দেখে আয়ান বিছানায় ঘুমাচ্ছে আর আরোহি সোফায়।আরোহিকে সোফাতে দেখে ভ্রু কুচকে যায় ইহানের।তবে আরোহি যে তার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে চায় না সেটা ও বুঝে নেয় ইহান। তাই আরেহিকে সোফা থেকে উঠিয়ে খাটে শুয়িয়ে দেয় ইহান আর নিজে সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে।
ব্রেকফাস্ট সেরে ইহান রেডি হচ্ছে অফিসে যাবে বলে।তখনই আরশি বেগম ঘরে ঢোকেন ইহানকে অফিসের উদ্দেশ্য তৈরি হতে দেখে ভ্রু কুচকে তাকায় ইহানের দিকে।তারপর এগিয়ে এসে বলে,
“তুই আজ অফিসে যাবি ইহান?”
“হুম।” তৈরি হতে হতে উত্তর দেয় ইহান।
“আজ অফিসে না গেলে হয় না?” ( আতশি)
ইহান জানে তার মা তাকে কেনো যেতে দিচ্ছে না। তিনি চাচ্ছেন আজ যেনো ইহান বাড়িতে থেকে আরোহিকে সময় দেয়।কিন্তু তিনি তো জানেন না যে ভাঙ্গন একবার ইহান আরোহির মধ্যে ধরেছে তা সহজে মিটবে না।
“আসলে মা অফিসে তো আগে থেকে জানানো হয় নি। আর এভাবে হুট করে ছুটি নেওয়া ও সম্ভব না। তাই আমাকে অফিসে যেতেই হবে।”
মায়ের কথা কাটাতে এই কথাগুলো বলে উঠল ইহান।
আরশি বেগম ও দেখলেন ইহানের কথায় যুক্তি আছে তাই আর ইহানকে আটকালেন না।ইহানকে এতদিন ভাই হিসাবে দেখেছে আরোহি আর ইহান ও আরোহিকে বোন হিসাবে দেখেছে এটায় ধারনা আরশি বেগমের তাই এই সম্পর্ক টা যে সহজে স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতো হবে না এটা জানেন আরশি।তবে তিনি ও তাড়াতাড়ি করতে চান না।সব কিছু ধীরে ধীরে ঠিক হবে এটায় তার বিশ্বাস।
ড্রয়িং রুমে আরোহি আর আয়ান কেউই নেয়।ইহান এর খুব ইচ্ছা করছে আয়ান আর আরোহিকে একবার দেখে তারপর অফিস যেতে কিন্তু সে আরোহিকে ডাকতে পারছে না।যে মেয়েটির সাথে এতদিন কথা বলে না তাকে এভাবে হুট করে ডাকা যায় না।তখনই ইহান বলল,
“মা আয়ান কোথায়? একটু ডাকো তো?”
ইহানের ধারনা আয়ানকে ডাকলে আরোহি ও আসবে ফলে দুজনকেই দেখা হবে ইহানের।তবে ইহানের সে ধারণা ভুল প্রমান করে আরশি বেগম আয়ানকে নিয়ে বাইরে এলেন।আশানকে দেখে ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠল ইহানের। কিন্তু আরোহি বাইরে না আাসায় বেশ খারাপ ও লাগল।আয়ানকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর করে তাকে মায়ের হাতে তুলে দিল ইহান।তারপর বেরিয়ে গেল সে।
এতক্ষণ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ইহানকে দেখছিল আরোহি।ইহান যে আায়ানকে আদর করার সময় বারবার এই ঘরের দিকে তাকাচ্ছিল সেটাও বুঝতে পারছিল সে, তবে ইচ্ছা করেই বাইরে আসিনি আরোহি।
বছর খানেক আগে ও এই বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল আরোহির।আর এই বাড়িতে সব থেকে কাছের ছিল ইহান। আরোহির ছোট খাটো সব বিষয়ে ইহান থাকত।তেমনি ইহানের ও প্রতিটা বিষয় ও আরোহির মতামত নিত। কিন্তু এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ইহান আরোহির জীবনটাকে পাল্টে দিয়েছিল।
বছর খানেক আগে ও বাড়িটা যেমন ছিল আজ ও তেমনই আছে। তেমন কোনো কিছুর বদল ঘটেনি। তাই আরোহির ও অসুবিধা হচ্ছে না।
সারাটা দিন ভালোই কাটল আরোহির। পরিচিত বাড়ি আর পরিচিত লোকজন হওয়ায় কোনো অসুবিধা হলো না।
এই বাড়িতে পুরো একদিন কাটিয়ে দিল আরোহি কিন্তু এখোনো ইহানের সাথে কথা বলেনি সে।শুধু তাই নয় ইহান আয়ানকে দেখতে গেলে আরোহি ঘরের মধ্যে থাকত কথা বলা তো দূর সামনে অবদি আসত না। তাও মাঝে মধ্যে ছোটো খাটো কারনে ইহানের সামনে আসলে ও কথা বলেনি সে।
সন্ধার একটু পরেই বাড়ি ফিরে এলো ইহান। অন্য দিনের তুলনায় অনেক তারাতাড়ি এসেছে আজ।আরশি বেগম ও বেশ খুশি হলেন ইহান তারাতাড়ি ফেরায়।
আরোহি ইহান এর ঘরে বসে আয়ানকে ফিডার খাওয়াচ্ছিলো। ইহানকে ঘরে ঢুকতে দেখে তাকালো তার দিকে।ইহান এর চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।তবে কোনো কথা বলল না।এক মুহূর্তের জন্য ভাবল ইহানকে একটু পানি এনে দিলে সে সেটা খেয়ে তৃপ্তি পেত তবে নিজের ইচ্ছে টাকে সাথে সাথেই মাটি চাপা দিল সে। ভাবল সে এখানে আয়ানের মা হয়ে এসেছে। ইহানের বউ নয়।
তবে ভালোবাসা জিনিস টা যে বড্ড খারাপ। প্রমিক পুরুষের একটুখানি কষ্ট যে হাজার রাগ হাজার অভিমান সাথে সাথেই ভাঙতে সক্ষম।
ঘরে ঢুকেই আয়ান আর আরোহিকে দেখে যেনো নিমিষেই ক্লান্তি টা দূর হয়ে গেল ইহানের। ওদেরকে একটু দেখে নিয়ে ইহান ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে গেল।
আয়ানের খাওয়া শেষ হলে তাকে নিয়ে ঘরের বাইরে গেল আরোহি।আয়ানকে লতা বেগমের হাতে দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে শরবত বানাতে লাগল।আজ অনেক দিন পর সেই শরবতটি বানাচ্ছে আরোহি।শরবতটি একদম সাধারন লেবুর শরবত কিন্তু ইহান এর খুব প্রিয়। আরোহি এই বাড়িতে আসলেই ইহান এই শরবত বানাতে বলত আরোহিকে।এই শরবত নাকি সকল শরবত এর থেকে বেস্ট।পুরানো সেই কথাগুলো ভাবতেই ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল আরোহির।
শরবত বানানো শেষ। তবে, সেটা কি নিজে ইহানকে দেবে নাকি লতা বেগমের হাত দিয়ে পাঠাবে সেটায় ভাবছে আরোহি।অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো
চলবে,