#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ০৭
🍁
.
.
.
.
সকালবেলা বেশ আরামে ঘুমোচ্ছিলাম তখনই চাচি এসে আমাকে টেনে তুলে দিলো আমার আরামের ঘুমটা হারাম করে। আমি আড়মোড়া ভেংগে উঠে বসি। চাচি একবার হলরুম থেকে ঘুড়ে আবার আমার রুমে আসে। আমি এখনো ঘুম ঘুম চোখে সেখানেই বসে আছি দেখে চাচি আবার আমাকে টেনে তুলে ঠেলে ওয়াসরুমে পাঠিয়ে দেয়। কি আর করার ফ্রেশ হয়ে আমি এসে পরি। এসেই দেখি চাচি আর আম্মু এক প্রকার ছোট খাটো মিটিং বসিয়ে দিয়েছে। তাদের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি ৩ থেকে ৪ টা ব্যাগ। আমি টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছছি আর কপাল কুচকে তাদের দিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই আম্মু খুশিতে গদগদ হয়ে বলে উঠলো….
কনিকা;; এই নাও এসে গেছে। মেহরু মা এদিকে আয়।
মেহরাম;; আসলাম।
আতিয়া;; এগুলো দেখ তো।
আম্মু আর চাচি আমার সামনে এত্তো ভারি ভারি শাড়ি খুলে বসলো, সাথে মেচিং গহনা। যেগুলো নিতান্তই আমার কাছে বেশ বিরক্তিকর লাগলো।
কনিকা;; দেখ তোর যেটা ভালো লাগে সেটাই পর।
আতিয়া;; আর শোন একটু ভালো হয়ে সুন্দর হয়ে রেডি হবি। দেখতে যে আসছে তোকে।
চাচির কথায় আমি এক রকম ঝটকাই খেলাম।
মেহরাম;; মানে কি? আম্মু হাত থেকে দয়া করে শাড়ি টা রাখো। আর আমার কথা শোন আগে তোমরা দুইজন কি পাগল হয়েছো!
কনিকা;; এমা পাগল হতে যাবো কেন?
মেহরাম;; কাল বলেছি যে বিয়ের জন্য আমি প্রস্তুত আছি কিন্তু এটা বলি নি যে আজই ছেলেদের ডাকো।
আতিয়া;; আরে মা কিন্তু যে ছেলেকে তোকে দেখতে বলেছিলাম সে তো আজই আসতে চেয়েছে। আর দেখলেই কি বিয়ে হয়ে গেলো নাকি। তারা আসুক, কথা বলুক, তোকে দেখুক, তুই দেখ। সবকিছু কেমন লাগে আগে দেখ তারপর না হয় ঠিকঠাক করবো।
মেহরাম;; তোমাদের জ্বালায় আমি পাগল হয়ে যাবো। উগান্ডা চলে যাবো আমি।
কনিকা;; বরকে নিয়েই যাস।
মেহরাম;; এইই মা থামো তো।
আতিয়া;; মেহরু মা তুই কোনটা পরবি দেখলি না তো।
মেহরাম;; চাচি শোন ওই যে মেয়ে ছোটখাটো একটা বধূ বেশে, সামনে ইয়ায়ায়ায়া বড়ো এক লম্বা ঘোমটা টেনে, হাতে শরবত বা চায়ের ট্রে নিয়ে গিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে যাবে। হাল্কা লজ্জা পাবে এমন।
আমি আমার দুপাশে তাকিয়ে দেখি আম্মু আর চাচি কল্পনার দেশে ডুব খাচ্ছে। তাই ঝট করে বলে ওঠি…
মেহরাম;; আমি না ই আদিম যুগের এমন কোন রীতি ফলো করবো। না ই ওই সব শরবত বা চা টার ট্রে নিয়ে যাবো কিচ্ছু করবো না আমি। আমি যেমন আমি তেমন। প্রতিদিন যেভাবে থাকি আজও সেম। রুপের গুণ নিয়ে আমাকে বিয়ে করতে হবে না। এই এইসব শাড়ি টারি গহরা নিয়ে যাও আমি গোল জামা পরে নিচে যাবো। যে আমাকে পছন্দ করবে সে এমনিতেই করবে এগুলোর দরকার নেই। আমি রেডি হচ্ছি।
আমার এমন কথায় চাচি আর আম্মুর মুখ টা কেমন শুকিয়ে গেলো। আমি ঘুড়ে গিয়ে তাদের দিকে তাকালাম। তাদের সামনে গিয়ে দুহাত ভাজ করে এক ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে আছি। চাচি আর আম্মু এবার হেসেই দিলো। সাথে আমিও।
কনিকা;; আল্লাহ জানে তোকে কোন ছেলে নিজের বউ বানাবে তার জীবন তেজপাতা।
আম্মু আর চাচি শাড়ি টাড়ি সব নিয়ে চলে গেলো। আমি সাদা আর হলুদের একটা কম্বিনেশনের মধ্যে জামা পরে নিলাম। আর কিচ্ছু করি নি। আয়নাতে তাকিয়ে দেখি চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট। মন চাইলো কালি দিয়ে আরো একটু গাঢ় করে নিই। কিন্তু করলাম না তাহলে আমাকে ভয় পেয়ে আমার বাড়ির লোকজনই পালাবে। চুল গুলো আচড়াচ্ছিলাম খানিক পরে নিচে বেশ শোরগোলের আওয়াজ পেলাম। আমি পেছনে ঘুরে কপাল কুচকালাম। ছেলেপক্ষ এলো না তো। যাজ্ঞে আমার কি। আবার নিযের চুল ঠিক করাতে মন দিলাম। তার প্রায় দশ মিনিট পর আকাশ দৌড়ে আমার ঘরে এলো। বিছানার ওপর জোরেই বসে পরলো। আমি আইনাতে তাকিয়ে দেখি সে ফাটা নয়নে আমাকে দেখছে।
মেহরাম;; কিরে ছোটু এভাবে কি দেখছিস, বেশি বাজে লাগছে আমায়?
আকাশ;; আরে না মেহেরাপু তুমি তো বরাবরই কিউট। কিন্তু আমি টাসকি খেয়েছি। তাও অনেক বড়ো।
মেহরাম;; হাহাহা,, কি দেখি খেলি?
আকাশ;; তোমার হবু বরকে দেখে।
আকাশের কথায় আমি কাজ ছেড়ে তার দিকে তাকাই।
মেহরাম;; মানে?
আকাশ;; মেহেরাপু কি পরিমাণ যে লম্বাচওড়া, আমাকেই মাথা তুলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হয়েছে।
মেহরাম;; ওহহ এই বেপার, শালা খাম্বা নাকি?
আকাশ;; তুমি তো বউ হবে শালা হলো কিভাবে?
মেহরাম;; হাহাহাহাহা, বাদ দে ভাই। আচ্ছা আর কি দেখলি (কাজ করতে করতে)
আকাশ;; শুনেছি ছেলে নাকি আর্মিতে জব করে। কি বডি রে বাবা মনে হয় স্টীল।
আমি আর কি বলি আকাশের এমন বিবরণ শুনে আমার অনেক হাসি আসতাছে।
যাই হোক আমি ওরনা টা ঠিক ভাবে পরে আকাশ কে নিয়ে নিচে নামি। সিড়ি দিয়ে নামার সময় আকাশ আমার এক হাত শক্ত করে ধরে।
মেহরাম;; কিরে আমার হাত ধরেছিস কেন এভাবে?
আকাশ;; মেহেরাপু আমি শুনেছি বউকে নাকি এভাবে ধরে ধরে নিচে নামাতে হয় এখন আমি তোমাকে নামালাম। তুমি যদি পরে যাও।
মেহরাম;; হ্যাঁ, কি কস। ভাই দুধের দাত পরছে তোর😆।
আমি আর আকাশ নিচে নামি। তখনই আম্মু এসে আমাকে নিয়ে বসিয়ে দেয়। আমি মাথা নিচু করে রাখি নি। সামনে তাকিয়ে আছি। চুপচাপ বসেই আছি কিন্তু একটা বারও ছেলের দিকে তাকাই নি। দেখার ইচ্ছে নেই আমার। বাকি সবাই অনেক কথা বলছে। একটা জমজমাট ভাব এখন। হঠাৎ একজন বয়স্ক মহিলা বলে ওঠেন…
কুসুম বেগম;; মা তোমার নাম কি?
মেহরাম;; জ্বি মেহরাম আফরিন।
কুসুম বেগম;; ভারি সুন্দর তুমি দেখতে। মুখখানায় অনেক মায়া লেগে আছে।
আমি মুচকি হাসি। এবারও আমি ছেলেকে দেখি নি।
কুসুম বেগম;; মেহরাম মামনি আসলে জানি না তুমি কেমন পরিবার আশা করো। কিন্তু এটা সিওর থাকো যে আমাদের পরিবারে আসলে তোমাকে নিজের ছেলের বউ না বরং আমি আমার মেয়ে মনে করবো। আর পরিবার বলতে শুধু আমার এই ছেলে টাই। আমার স্বামী নেই, আমার ছেলেটা যখন ক্লাস নাইনে থাকে তখনই চলে যান। আমার আর কোন সন্তানও নেই তাই আমার পুরো দুনিয়া আমার এই ছেলেই। আমি এখানে আমার ছেলের বউ খুজতে আসি নি আমি আমার একটা মেয়ে কে নিয়ে যেতে এসেছি।
আমি এতোক্ষণ সেই মহিলাটার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সারাজীবন কি কষ্ট দিয়ে পারি দিয়ছেন তা উনার মুখে স্পষ্ট ফুটে ওঠেছে। কেন জানি না উনাকে আমার অনেক ভালো লাগলো। মূলত টিপিকাল শাশুড়ী রা এমনই হয়। মুখে মিষ্টি অন্তরে বিষ। কিন্তু সবাই তো আর এক না। এবার চাচি বলে ওঠে..
আতিয়া;; তা বাবা তুমি কি করো?
সোহেল (ছেলে);; জ্বি আমি আর্মিতে জব করি। সত্যি বলতে বেশির ভাগ বাইরেই থাকি আর যতটুকু সময় বাসায় তা সম্পূর্ণ আমার মায়ের। মা যখন বললো যে মেয়ে দেখবো আমি কোন কিছু বলি নি কারণ আমার মা যা বলবে তাই।
কুসুম বেগম;; না সোহেল এভাবে বললে সবাই ভাববে এখনো মায়ের আচল ধরে থাকিস।
তাকালাম ছেলের দিকে। মুচকি হাসলো সে আমি তাই। আমি তাকিয়ে দেখলাম কুসুম বেগম আর আমার পরিবারের লোকজনের মাঝে ভালোই খাতির জমে গেছে। ওহ হ্যাঁ আব্বু চাচ্চুও আছেন।
সবার মুখে খই ফুটছে। এবার কুসুম বেগম বলে উঠলেন…
কুসুম বেগম;; আব..আপা যদি কিছু মনে না করেন তাহলে কি মেহরাম মামনি আর সোহেলকে একসাথে একটু একা কথা বলতে দেওয়া যায় না।
আমি তো বোকা বনে গেলাম। আমি এই খাম্বার সাথে কি কথা বলবো। আর আকাশ ঠিকই বলেছিলো অনেক বেশি লম্বাচওড়া, এটা পালোয়ান তা দেখেই বোঝা যায়। একটা ব্লেক পেন্ট আরেকটা নেভি ব্লু শার্ট পরে আছে। আর আর্মিতে যেহেতু তো এমনই তো হবে। আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো ছাদে। ছাদের দেওয়ালের ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে সেও আছে। তবে মাঝখানে কমপক্ষে ৪ ফুটের দূরত্ব। আমি একদম চুপ করে আছি। হঠাৎ গলা খাকারি দিয়ে সোহেলই বলে ওঠে…
সোহেল;; কিসে পরছেন আপনি?
মেহরাম;; অনার্সে।
সোহেল;; জ্বি বিয়ের পর কি আপনার পোড়াশোনার ইচ্ছে আছে?
আমি পাশে সোহেলের দিকে তাকাই।
মেহরাম;; আপনি সিওর যে এই বিয়ে টা হবেই?
সোহেল;; আমি আমার মা কে অনেক ভালোভাবে চিনি। মা আপনাকে অনেক পছন্দ করেছেন। আপনি সত্যি অনেক মিষ্টি দেখছে।
মেহরাম;; দেখুন।
সোহেল;; মা কেমন হবে, স্বামীই বা কেমন হয়। একটা আলাদা পরিবার কিভাবে নিজেকে মানিয়ে নিবেন। বউ-শাশুড়ী তে ঝগড়া হবে কিনা। কি এই গুলোই তো?! (মেহরামের দিকে তাকিয়ে)
মেহরাম;; না আসলে।
সোহেল;; আপনি পড়াশোনা করতে পারেন। চাইলে জবও করতে পারবেন যা হেল্প লাগে আমি করবো। আপনার পরিবারের কথা মনে পরলে যখন ইচ্ছে চলে আসতে পারবেন কারণ একটা মেয়ে শুধু কিছু কাপড় আর দুমুঠো খাবারের জন্য নিজের পরিবারকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় না। বেশি কিছু না শুধু এটাই চাই যে আপনি যেন আমার পরিবার টাকে পূর্ন করেন ব্যাস।
উনি খুব গুছিয়ে সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারেন। যা বুঝলাম সোহেলের মাঝে খুব হাবলা হাবলা একটা ভাব আছে যা উনি উনার শক্ত মুখের পেছনে লুকিয়ে রাখেন। আর মেয়েদের সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতা খুব কম আছে উনার। অনেক বার আটকে পরেছিলেন কথা বলতে গিয়ে আমার সাথে। আমার আর কি বলার কারণ আমার সব কথা সোহেলই বলে দিয়েছেন। আমি মুচকি হেসে বলে উঠি…
মেহরাম;; আমরা এখন নিচে যাই!
সোহেল;; জ্বি।
আমার আগে সোহেল যেতে ধরলেন, যেতে ধরলেই আবার পেছন ঘুড়ে আমার দিকে তাকিয়ে একবার বলে ওঠেন…
সোহেল;; বাই দি ওয়ে, আপনি আপনার চুলগুলো খোলাই রাখবেন। দেখতে ভারী সুন্দর লাগে।
এই কথা বলেই উনি চলে গেলেন। আমি ঠাই দাঁড়িয়ে থাকলাম। তবুও পরে নিচে নেমে পরি৷ আমাদের একসাথে নামতে দেখে চাচি বলে উঠলেন…
আতিয়া;; এই নাও এসে গেছে।
কুসুম বেগম এতো টা মিশে গেছে বাবা মা চাচি চাচ্চুর সাথে যা বলার বাইরে। উনারা চলে গেলেন। তাদের এগিয়ে দিয়ে আসতে আমি প্রথমে যেতে চাই নি। কিন্তু চাচ্চু জোর করে নিয়ে যায়। গাড়িতে উঠে পরে সোহেল আর তার মা। সোহেল ড্রাইভিং সীটে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে…
সোহেল;; আবার দেখা হবে।
আমি মৃদু ভাবে মাথা নাড়াই। সোহেল আর তার মা চলে যায়। তারপর সবাই হলরুমে আসি। এসেই সবার কি খুশি। কার খুশি কে দেখে। অবশেষে শুনি যে বিয়ের কথা এইদিকে পাকাপাকি হয়ে গেছে। আমি তো অবাক।
মেহরাম;; মানে কি কথা ছিলো দেখতে আসবে, এখন বিয়ে ঠিক?
কনিকা;; কেন ছেলেকে তোর কি পছন্দ হয় নি। এতো সুন্দর দেখতে ছেলেটা। পরিবার বলতে শুধু তার মা।
মেহরাম;; কিন্তু মা।
আতিয়া;; আরে আর কিছু বলিস না তো বিয়ে ঠিক।
আমি ছেড়ে দিয়েছে। যা হবার হোক, হ্যাঁ তবে আমার মতে সত্যি সোহেল আর তার মা অনেক ভালো মানুষ। সহজেই যে কাউকে মানিয়ে নেয়। আম্মু নাচতে নাচতে তনুকে ফোন দিলো।
কনিকা;; হ্যালো তনু
তনু;; হ্যাঁ বড়োমা বলো, কেমন আছো তুমি?
কনিকা;; এত্তো খুশি যে তা বলার বাইরে।
তনু;; এমা কি বলো এতো খুশি কেন কি হয়েছে?
আতিয়া;; ভাবী আমাকে দাও ফোন। হ্যালো তনু রে মেহরুর বিয়ে ঠিক।
তনু;; হ্যাঁ ভালো,, হ্যাঁ কি মা কি বললা। মেহরু, মেহরুর বিয়ে ঠিক। কি বলো, আমার তো নাচ আসছে। মেহরু কই আরে ওকে দাও তো।
আতিয়া;; নে নে কথা বল।
মেহরু;; হ্য.. হ্যালো
তনু;; মেহরু আয় হায় কি শুনছি ঘটনা সত্য নাকি। ছেলের নাম কি রে, কি করে আর দেখতে কেমন?
মেহরু;; সোহেল শেখ, আর্মিতে আছে। দেখতে খাম্বা।
তনু;; এ্যা,, আচ্ছা আমাকে ছবি পাঠাস।
মেহরু;; হুমম।
তনু;; মেহরু।
মেহরাম;; হ্যাঁ
তনু;; মেহরু তুই খুশি তো?
মেহরাম;; আরে হ্যাঁ আমি খুশি, সবাই অনেক পছন্দ করেছে সোহেলকে। আর সোহেলও অনেক ভালো। আমি তো কিছুই বলি নি আমার মনের কথা গুলো সব আমার আগে সেই বলে দিয়েছে। আর উনার মা হলেন একজন পছন্দের মানুষ, সব কিছুই অনেক ভালো রে।
তনু;; যাক আলহামদুলিল্লাহ।
সবাই তনুর সাথে আর তার শশুড় বাড়ির লোকদের সাথে অনেক কথা বলে, সেদিকেও এক প্রকার খুশির রেশ পরে গেছে। আমি হলরুম থেকে উঠে এসে ওপরে আমার রুমে যেতে ধরলাম হঠাৎ কি যেন মনে করে ওপর থেকে নিচে একবার তাকালাম। সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠেছে। হয়তো যে খুশি এখন আমার হবার কথা সে খুশি এখন আমার পরিবারের লোকজনদের হচ্ছে। তাই কি তাদের খুশিই আমার খুশি। আমি হেসে দিয়ে রুমে চলে আসি।
।
।
তনুর শশুড় বাড়িতে~~
তনু বসে বসে ফোন চালাচ্ছিলো,তখনই দরজা লাগানোর শব্দে পেছন ঘুড়ে তাকায়। দেখে যে আয়ুশ। তনু লাফ দিয়ে নিচে নেমে পরে আয়ুশের কাছে চলে যায়। আয়ুশ হেসে তনুকে বলে ওঠে..
আয়ুশ;; কি হলো এভাবে লাফাচ্ছো কেন?
তনু;; লাফাবো না। আমার কলিজার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?
আয়ুশ;; মানে?
তনু;; আরে মেহরু, মেহরুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। এই দেখো এই যে মেহরু আমাকে ছেলের ছবি পাঠিয়েছে। হায় কি সুন্দর আমার দুলাভাই টা। দেখো দেখো।
আয়ুশ ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে।
আয়ুশ;; হুম।
এই হুম বলেই আয়ুশ চলে আসে তনুর সামনে থেকে।
তনু;; আরে কি হলো কিছু তো বলো কেমন?
আয়ুশ কাবার্ড থেকে নিজের জামা বের করতে করতে বলে ওঠে…
আয়ুশ;; ভালো।
তনু;; আমি জানতাম ভালোই হবে।
আয়ুশ ফ্রেশ হতে চলে যায়। ওয়াসরুমে গিয়েই বেছিং-এ হাত রেখে কিছুটা ঝুকে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা নিচের দিকে দিয়ে আছে। হুট করেই মাথা তুলে সামনে থাকা আইনার দিকে তাকায় আয়ুশ। চোখ গুলো রক্ত লাল হয়ে গিয়েছে। টুপটাপ করে পানি পরছে চোখ দিয়ে। নাকের ডগা লাল হয়ে গিয়েছে। তখনই দরজাতে তনুর ডাক পরে।
তনু;; এইযে তোমার ফোন হয়তো অফিস থেকে ফোন এসেছে।
আয়ুশ;; হ্যাঁ হ্যাঁ রাখো আমি আসছি।
তনু চলে যায়। আর আয়ুশ তার মুখে একের পর এক পানির ছিটা দিয়েই যাচ্ছে। যেন বুঝা না যায় সে কেদেছে। এতোই জোরে জোরে পানির ছিটা দিয়েছে যে গায়ে থাকা শার্ট টা ভিজে গেছে। ২০ মনিট পর আয়ুশ ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে পরে। রাতের খাবার পর্যন্ত সে খায় না। তনু জিজ্ঞেস করলে বলে ওঠে অফিসে খেয়ে নিয়েছে তাই খিদে নেই। রুমে এসে পরে। তনুর খুব পা ব্যাথা করছে নাকি তাই সে ঘুমিয়ে পরে। তবে আয়ুশ উঠে গিয়ে রুমের বাইরে করিডরে এসে পরে। হাতে এক পেকেট সিগারেট। সিগারেটের দিকে তাকিয়ে আয়ুশ হেসে দেয়। এই সিগারেট টা খেতে গিয়ে মেহরাম কতোই না বকা বকেছে তাকে। একদিন তো জিদ করে বসলো যে আয়ুশ সিগারেট খেলে মেহরামও খাবে। একদিন আয়ুশ ইচ্ছে করেই মেহরামের সামনে দিগারেট খাচ্ছিলো মেহরাম রাগের চোটে আয়ুশের হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে নিজেই ঠোঁটে লাগিয়ে টান দিয়েছিলো। সে কি কাশি, কাশতে কাশতে দম বন্ধ প্রায়। আয়ুশ তড়িঘড়ি করে সামলে নিয়েছিলো। সেটাই লাস্ট ছিলো আয়ুশের সিগারেট খাওয়া। আর আজ কেন জানিনা আয়ুশের মেহরামের কথা অনেক মনে পরছে। হয়তো মেহরাম কাছে থাকলে তাকে শেষ বারের মতো জোরে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছে মতো চিল্লিয়ে কাদতো। কিন্তু হায়রে ভাগ্য, সেই সুযোগ টুকুও নেই। সারারাত নির্ঘুম কেটেছে আয়ুশের। সিগারেট খেতে খেতে পারি দিয়েছে,, ভোরের দিক রুমে গিয়ে তনুর পাশে শুয়েছে।
।
ধীরে ধীরে দিন গড়িয়ে যায়, এর মধ্যে দুবার সোহেল আর তার মা এসেছে আবার মেহরামও একদিন তাদের বাসায় গিয়েছিলো। অনেক সুন্দর তাদের পরিবার আর বাসাটাও। তবে সোহেলের সবকিছু দেখে মনে হলো সে অনেক গোছালো প্রকৃতির। বাড়ির প্রায় সবদিকেই সোহেলের ছবি টাংানো। আর্মির গেটাপে, ফরমাল গেটাপে। তার মাকে নিয়ে অনেক ছবি তোলা।
মেহরাম;; আপনি আপনার মাকে অনেক ভালোবাসেন তাই না!!
সোহেল;; হ্যাঁ তোমার মতোই।
মেহরাম;; হুমম।
সোহেল আর মেহরাম একে ওপরের সাথে অনেকটা মিলেমিশে গেছে। মেহরাম আপনি বলেই ডাকে কিন্তু সোহেল তুমি। বিয়ের দিন তারিখ সব এগিয়ে আসে দুইদিন বাদে মেহরামের বিয়ে। বাড়িতে রমরমা একটা ভাব। সোহেল কে দেখেই বুঝা যায় যে সে মেহরামের সাথে এই বিয়েতে কত্তো খুশি। মেহরাম যেন পুতুল। সবার খুশিতেই তার খুশি। দুইদিন কখন যে চোখের পলকেই পেরিয়ে গেছে টেরই পাওয়া যায় নি। তনু এসে পরেছে। পুরো বাড়িতে বিয়ের সাজ। মাঝে মাঝেই সবাই অনেক ইমোশনাল হয়ে পরে। কিন্তু মেহরাম যখন রেগে যায় তখন আবার সবাই চুপ। মূলত মেহরাম রাগ করে না সবাইকে হাসানোর জন্য এমন করে। তনুর শশুড় বাড়ির লোকেরা সবাই এসেছে। কণা ও এসেছে। তবে আয়ুশ আসেনি। তাকে তনু অনেক বলে কিন্তু আয়ুশ কাজের অজুহাত দিয়ে আসে নি। বাড়ির সবাই আয়ুশকে অনেক আসার জন্য বলে কিন্তু আয়ুশ আসবে না।
বিয়ের দিন মেহরাম কে বধূ বেশে সাজানো হয়। খুব বেশি সুন্দর কাগছে তাকে। তনু তো সোজা কালো টিকা লাগিয়ে দিয়েছে তার কানের পেছনে যাতে নজর না লাগে কারো। রুমে বসেই তনু-মেহরাম-কণা সবাই অনেক ছবি তুলে। উর্মি আর বাবলিও এসেছে মেহরামের বিয়ে তে। তনু মেহরামের বউ সাজে একটা ছবি আয়ুশকে পাঠিয়ে দেয়। আয়ুশ বসে বসে ফাইল দেখছিলো ফোনে নোটিফিকেশন আসলে সে সেটা অন করে দেখে মেহরামের বউ বেশে ছবি। মূহুর্তেই গাল বেয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পরে আয়ুশের। ফোনে তনুর ফোন আসলে জলদি নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোন ধরে।
তনু;; কি কেমন লাগছে মেহরামকে?
আয়ুশ;; অনেক সুন্দর ❤️।
তনু;; তোমাকে কতো করে বললাম এসে পরো। তুমি আসলে না।
আয়ুশ;; আরে বাবা কাজ আছে তো অনেক নইলে তো গেতামই। (হেসে)
তনু;; তোমার গলা এমন লাগছে কেন? কি হয়েছে?
আয়ুশ;; আরে ওইতো ফ্রিজের ঠান্ডা পানির রিয়েকশন।
তনু;; তুমিও না আচ্ছা শুনো আমি রাখি। বাড়িতে অনেক মানুষ আর আমি মেহরুর কাছে যাবো। রাখলাম।
আয়ুশ;; হুমম।
তনু ফোন কেটে দিয়ে চলে যায়। আর আয়ুশ সে তার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরে। সামনে ফাইল গুলো রাগে টেনে ছিড়ে সব লণ্ডভণ্ড করে ফেলে। এবার দুহাতে মাথা চেপে ধরে নিচে বসে পরে সে। চিৎকার দিয়ে ওঠে। অঝোরে কেদে দেয়।
আয়ুশ;; মেহরাম (চিল্লিয়ে)
ওদিকে মেহরামকে নিচে নামানো হয়, এনে সোহেলের পাশে বসিয়ে দেয়। সোহেল হাল্কা ঝুকে মেহরামের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে ওঠে “মাশআল্লাহ”। মেহরাম হেসে দেয়। অতঃপর তিনবার কবুল বলে ইসলাম এবং আইনের মতে সোহেল আর মেহরাম স্বামী-স্ত্রী হয়ে যায়। মেহরামের বিদায়ের সময় সবার সে কি কান্না। তবে মেহরাম কাদে না। তার মুখ থেকে যেন হাসি সরার নামই নেই। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেহরাম চলে আসে।
.
মেহরাম আর সোহেল একই ঘরে রয়েছে। সোহেল এসেই দেখে রুমে কেউ নেই সে বারান্দায় গেলে দেখতে পায় মেহরাম বউ বেশে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সোহেল কেশে ওঠে ইচ্ছে করেই। মেহরাম তাকিয়ে দেখে সোহেল। সে রুমে চলে যায়।
সোহেল;; তুমি ওখানে…
মেহরাম;; দেখুন এই দিনে এক হাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে বিছানার ওপর বসে থাকবে তেমন না আমি। আমার ভালো লাগে না তাই সেখানে চলে গিয়েছিলাম।
সোহেল;; এখন মনে হচ্ছে যে আমি সঠিক কাউকে বিয়ে করেছি।
মেহরাম;; মানে?
সোহেল;; আমারও এইসব পছন্দ না মোটেও।
সোহেল আর মেহরাম হেসে দেয় একসাথে। এবার তারা দুজনেই চুপ থাকে হঠাৎ সোহেল বলে ওঠে…
সোহেল;; মেহরু।
মেহরাম;; জ্বি
সোহেল;; সবাই তো তোমাকে এভাবেই ডাকে তাই আমিও ডাকলাম।
মেহরাম;; হুমম (হেসে)
সোহেল;; কাউকে ভালোবাসতে?
সোহেলের কথা আমি তার দিকে তাকাই। কি বলবো খুঁজে পাই না। তবুও বলি…
মেহরাম;; না। আপনি?
সোহেল;; বাসতাম, কিন্তু কখনো বলাই হয়নি। তাও স্কুল লাইফে থাকতে। একদিন হঠাৎ করেই তাকে দেখতে পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে আমার মন মস্তিষ্ক থেকে মুছে যায়। এইতো শেষ।
মেহরাম;; আহা, এটা ভুল যদি ভুলেই যেতেন তাহলে আর তাকে আজকে মনে করতেন না। (দুহাত ভাজ করে সোহেলের দিকে তাকিয়ে)
সোহেল;; কিন্তু এখন তোমাকে ভালোবাসি।
সোহেল মেহরামের মাথায় চুমু একে দিলো। মেহরাম তার হাতের মুঠি শক্ত করে ধরে। তার কেমন যেন লাগছে। কিন্তু তবুও হাসে। আর সত্যি সোহেল মানুষ হিসেবে পারফেক্ট একদম পারফেক্ট।
এভাবেই মেহরাম আর সোহেলের দিন যেতে থাকে। বিয়ের ১ মাস পার হয়ে যায়। মেহরাম তো নিজের মায়ের থেকেও নিজের শাশুড়ির সাথে এখন বেশি ফ্রী। সে যে তার শাশুড়ি মেহরাম তা মনেই করে না।
তবে একদিন তনু কণার জন্য আচার নিয়ে যাচ্ছিলো হঠাৎ সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে গেলে তনু সিড়ি থেকে অনেক জোরে নিচে পরে যায়। মাথা পুরো ফেটে গেছে পেটে অনেক ব্যাথা পেয়েছে আর পা পুরো ছুলে গেছে। তনুর চিৎকারে যেন বাড়ির সবার আত্মা কেপে উঠলো। তনুর কোন হুশ নেই। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। চারিদিকে রক্তে ভেসে গিয়েছে। সবাই ছুটে চলে যায় তনুর কাছে। কণা তাড়াতাড়ি করে আয়ুশকে ফোন দেয়। আয়ুশ তনুর কথা জেনে ছুটে আসে বাড়িতে। সবাই তনুকে নিয়ে হস্পিটালে যায়। সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়। তবে যেহেতু সেটা হস্পিটাল তাই বেশি একটা ভীড় না করাই ভালো। মেহরামের শশুড় বাড়ি থেকে শুধু মেহরামই আসে। বাকিরা যেতে চাইলে মেহরাম তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে এসে পরে। মেহরাম তো কাদতে কাদতে এক রকম হিচকি তুলে ফেলেছে। দ্রুত হস্পিটালে গিয়ে দেখে সবাই বসে আছে। সবার মুখেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মেহরামকে দেখেই তার চাচি মানে তনুর মা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কেদে দেয়। আয়ুশ মাথা নিচু করে বসে আছে। তার মনেও যে অশান্তি চলছে তা তাকে দেখেই বোঝা যায়। তখন একজন নার্স বের হয়ে আসে তাকে দেখেই সবাই চিন্তা নিয়ে নার্সের কাছে যায়। কিন্তু তখন নার্স বলে ওঠেন….
নার্স;; পেসেন্টের হাসবেন্ড কে?
আয়ুশ;; জ্বি আমি।
নার্স;; আপনি চলুন।
আয়ুশ দ্রুত নার্সের সাথে চলে গেলো। ডাক্তারের কেবিনে গিয়ে আয়ুশ বসে। ডাক্তার তার মুখে অতি মাত্রায় চিন্তা নিয়ে আয়ুশের দিকে একটা রিপোর্ট কার্ড এগিয়ে দেন। আয়ুশ শুধু ডাক্তারের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু তিনি কিছু বলছেন না। এবার আয়ুশ চোখ রিপোর্টের দিকে দেয়। আর তাতে আয়ুশ যা দেখে তাতে তার পুরো দুনিয়া উলটে যায়।
“তনু কখনো মা হতে পারবে না”।
।
।
।
🌷চলবে~~