#তুমি_আছো_হৃদয়ে
#পর্ব-৮
আমি রোদেলার এমন করাটা মেনে নিতে পারছি না,সে কেনো এমন করছে সেটাও বুঝতে পারছি না। সে না আমাকে ভালোবেসে নিজের স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে,না আমার থেকে ডিভোর্স চাইছে। সে আমার সাথে থাকতে চায় অথচ আমাকে স্বামী হিসেবে মানতে চায় না। শুধু নিজের সুবিধার জন্য সে এমন করছে নাকি ভবিষ্যতে তাঁর কোনো মাস্টার প্ল্যান আছে সেটাও আন্দাজ করতে পারছি না। কোনো এক উপন্যাসে পড়েছিলাম,একজন মানুষের যে কোনো সময়ে,যে কোনো বয়সে,যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কারো জন্য নিজের হৃদয়ে মন্দিরে ভালোবাসার জন্ম হতে পারে। ভালোবাসা সময় মানে না,বয়স মানে না,লজ্জা মানে না। যুগে যুগে অনেক মানুষের বিয়ের পরে নিজের স্বামীর জন্য কিংবা নিজের স্ত্রীর জন্য নিজের ভিতরে প্রেম সৃষ্টি হয়েছে। খুঁজলে অনেক মেয়ে পাওয়া যাবে যারা বাবা মায়ের ইচ্ছেতে নিজের পছন্দের মানুষ না হওয়া সত্ত্বেও,অনিচ্ছা থাকার পরেও বিয়ের পিরিতে বসেছেন,শুধুমাত্র আপন মানুষদের মুখের দিকে তাকিয়ে। সেসব মেয়েরাই একসময় নিজের স্বামীকে মন প্রাণ উজার করে ভালোবাসে। তারা বাবা মায়ের সিদ্ধান্তটাকেই সঠিক মনে করে। কারণ পৃৃথিবীর কোনো মা বাবাই হয়তো চায় না তাঁর মেয়েকে খারাপ কোনো ছেলের হাতে চিরজীবনের জন্য তুলে দিতে। সব বাবা মায় মেয়ের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ চায়।
আমি ভাবতাম মেয়েরা তাঁর হাসবেন্ডকে ভালো না বেসে থাকতে পারে না। দেরিতে হলেও তারা বুঝতে পারে হাসবেন্ড ছাড়া তাদেন জীবন অধরা,অপূর্ণ। হয়তো রোদেলাও একসময় বুঝতে পারবে,সব ভুলে আমাকে হাসবেন্ড হিসেবে ভালোবাসবে। কিন্তু এমনটা হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না আমি। তাকে ইমপ্রেস করার জন্য কতো কি করেছি আমি কিন্তু আমার মনে হয় সে আমার কাজ কর্মে ইমপ্রেস হয় না বরং বিরক্ত হয়। এই পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা কখনো কারো প্রতি সহজে ইমপ্রেস হয় না,তাদের কাছে সবকিছু সিম্পল মনে হয়,এমনকি পৃৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যময় বিষয়টাও তাদের কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হয়। রোদেলাও হয়তো তেমন। বিয়ের পরে প্রায় দিনই অফিস থেকে ফেরার পথে আমি তাঁর জন্য একটা করে গোলাপের গুচ্ছ নিয়ে এসে বিছায়নায় রাখতাম। কিন্তু সে ইমপ্রেস হতো না,খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিতো বিষয়টা। তাঁর কাছে মনে হতো একটা গোলাপের গুচ্ছই তো,চাঁদটা তো আর এনে দেয়নি। তাকে ইমপ্রেস করার জন্য নিজের বাবা মাকে ছেড়ে তাঁর সাথে ঢাকায় বাসা নিলাম,শুধুমাত্র তাঁর জন্য। যাতে করে সে তাঁর পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারে কিন্তু এটাতেও আমি ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়েছি।
আজ রোদেলার জন্ম দিন। আমি কখনো তাকে জিগ্যেস করিনি,সেও আমাকে কখনো জানায়নি আজ তাঁর জন্মদিন। তবে যখন জানলাম তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। তাই আমি তাকে কোনো উপহার দিতে পারিনি। বিয়ের পর নিজের বউ এর প্রথম জন্মদিনে কোনো উপহার না দেওয়া হাসবেন্ড আমি এটা ভাবতেই মনে হলো মানুষ হিসেবে আমি সফল হলেও একজন আদর্শ হাসবেন্ড হিসেবে হয়তো ব্যর্থ। রোদেলার জন্মদিনে তাঁর ভার্সিটি লাইফের সব বান্ধবীরাই এসেছে,এতো এতো খারাপ লাগার মাঝেও একটা ভালো লাগার বিষয় আছে। রোদেলার কোনো ছেলে বন্ধু আসেনি। তবে নুসরাত এসেছে। যেটা আমার ভালো লাগে নি। কারণ আমি চাই না আমার প্রাক্তন কখনো জানুক আমি আমার বর্তমানের সাথে ভালো নেই। কিছু সময় পর আমার প্রাক্তন প্রেমিকা আমার স্ত্রীর সাথে একসাথে কেক কাটবে দৃশ্যটা চমৎকার না? তবে আমার কাছে এই দৃশ্যটা অনেক কষ্টের,অনেক বেদনার। নুসরাতের জায়গায় সেতো আমাকে নিয়েও কেক কাটতে পারতো। কিন্তু তাঁর কাছে এটা গুরুত্বহীন মনে হয়েছে। তাই আমি দূরে দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আছি। অবশ্য ভালোই হয়েছে। এতোগুলো মেয়ের মাঝে থাকলে নিজেকে আনইজি মনে করতাম। একাই ভালো অাছি।
কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম,কারো কথা শুনে তাকাতেই দেখতে পেলাম আমার পাশে নুসরাত দাঁড়িয়ে আছে। আমি এতোটাই অমনোযোগী ছিলাম যে একজন মানুষ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে অথচ আমি বুঝতেই পারিনি। নুসরাতকে দেখে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম আমি।
কেমন অাছো?
-ভালো আছি, অনেক ভালো।
-কিন্তু তোমাকে দেখে তো মনে হয় তুমি ভালো নেই।
-মানুষের বাহিরে দিকটা দেখে কখনো কোনো কিছু বিবেচনা করা উচিত না। পৃৃথিবীর সবাই এক না। কেউ চায় নিজের হ্যাপিনেসটাকে সবার সাথে শেয়ার করতে,সবাইকে দেখাতে চায় সে খুব ভালো অাছে। আবার কেউ তাঁর দুঃখগুলোর মতো নিজের ভালো থাকার দিনগুলোকেও একাকিত্ব দান করে।
-তোমার ভিতরটা ভালো নেই আমি জানি। রোদেলা তোমাকে পছন্দ করে না।
-হাহাহাহা,হাসালে। তুমি অনেক বেশি হিংসুটে। আমি তোমার থেকে ভালো কাউকে নিজের জীবন সঙ্গীনি হিসেবে পেয়েছি এটা তোমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে, সহ্য হচ্ছে না তোমার। তাই এমন বলছো তুমি। আচ্ছা তোমরা মেয়েরা এমন কেনো বলো তো? ব্রেকআপ এর সময় খুব মমতা ভরা আকাশ সমান ভালোবাসা নিয়ে বলো,”ভালো থেকো,তুমি আমার থেকে বেটার কাউকে পাও এটাই চাইবো আমি।” আসলে কি তোমরা মন থেকে এই জিনিসটা চাও? যদিও তুমি আমাকে এমন কিছু কখনো বলোনি। তবে আমার মনে হয় এটা তোমরা নিজের ভিতর থেকে চাও না,জাস্ট সান্ত্বনার জন্য বলো। আসলে তোমার চাও তোমাদেরকে থেকে খারাপ কাউকে যেনো নিজের জীবনে পাই আমরা। যাতে করে তোমাদেরকে না পাওয়ার জন্য সবসময় আফসোস করি।
– তোমার হাসিটা তুমি ইচ্ছে করে হেসেছো সেটা কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি। আমি তোমার খারাপও চাই না,ভালোও চাই না। তবে তোমার সাথে হুট করে ওভাবে সম্পর্কটা শেষ করা উচিত হয়নি। তবে যা হয় সবার ভালোর জন্যই হয়।
– যাক অন্তত একটা জিনিসের জন্য হলেও তুমি আফসোস করো। হয়তো আমাকে না পাওয়ার জন্যও একদিন আফসোস করবে। আর এজন্য আমি মনে প্রাণে চাই তুমি আমার থেকে খারাপ কাউকে নিজের জীবনসাথী হিসেবে পাও।
– অভিশাপ দিচ্ছো নাকি দোয়া করছো বুঝতে পারছি না।
– কোনো টাই না,আমি শুধু আমার মনের ভাবটা প্রকাশ করলাম।
– তোমার কথা আমার কাছে কেমন জানি অস্বাভাবিক মনে হয়। বিয়ের পর থেকে হয়তো তুমি ডিপ্রেশনে ভুগছো। তোমার ভালো একজন সাইকায়ট্রিস্ট দেখানো উচিত।
– ওরে বাবা,আমার জন্য দেখি এখনো তোমার অনেক চিন্তা। তো তুমি তো ডাক্তার। তুমি দেখলেই পারো।
– ডাক্তার বলেই মানুষের ভিতরটা পড়তে পারি। তোমার ভিতরের সত্ত্বাটা বলে দিচ্ছে তুমি ভালো নেই।
– সেদিন তাহলে আমার ভিতরটা কেনো পড়তে পারোনি। যদি পড়তে পারতে তাহলে এতো সহজেই তিন বছরের সম্পর্কটা শেষ করতে না। সো এসব আজাইরা লজিকের কথা বাদ দাও। কিছু কিছু জিনিস থাকে যেগুলো অন্য মানুষ তো দূরের কথা নিজেই কখনো বুঝতে পারে না কেনো সে এমন করে।
– দুদিন আগে হোক আর পরে হোক তোমাদের সম্পর্কটার পরিসমাপ্তি ঘটবে। রোদেলাকে আমি চিনি,সেই ছোট থেকে তাঁর সাথে থেকে এসেছি। তাঁর প্রথম যে জিনিসটা পছন্দ হয় না,সেটা পরেও কোনোদিন পছন্দ হয় না। সো ভবিষ্যতে তোমাদের ডিভোর্স নিশ্চিত। অথচ ভবিষ্যতে আমি আমার হাসবেন্ড কে নিয়ে যুগ যুগ ধরে সুখে শান্তিতে বসবাস করবো। তাহলে ভেবে দেখে আফসোস টা কার হবে? তোমার নাকি আমার। তুমি তোমার বউকে ভালোবেসে ধরে রাখত পারবে না,বাট আমি আমার হাসবেন্ডকে ভালোবাসার সমুদ্রে ডুবিয়ে রাখবো। আর একটা কথা সবসময় মনে রাখবে। রোদেলা কিন্তু আমারই বোন। তাকে আমি তোমার কথা কিছুই বলিনি। এমনিতেই সে তোমাকে চায় না। আর যদি আমি তাকে বলি তুমি আমাকে ঠকিয়েছো তাহলে সে তোমাকে কতোটা ঘৃণা করবে আন্দাজ করতে পারো?
– কিন্তু আমি তো তোমাকে কোনো ধোঁকা দেইনি,তোমাকে ঠকায়নি।
– সেটা তো তুমি আর আমি জানি। রোদেলা তো জানে না। সে আমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। আমি যা বলবো সেটা মিথ্যা হলেও কোনো যাচাই বাচাই না করেই সে সত্য ভেবে নিবে। তবে ভয় পেয়ো না,আমি এমন কিছু বলবো না।
– তবে আর যাইহোক আমাদের ডিভোর্স হবে না। তোমার এই স্বপ্নটা কোনোদিন পূরণ হবে না।
– তুমি কি কখনো কোনোদিন দেখেছো কিংবা শুনেছো পাথরে ফুল ফুটে? ফুটে না। রোদেলাও তোমার জন্য ঠিক পাথরের মতো। তাঁর মনে কোনোদিন তুমি ভালোবাসার ফুল ফোটাতে পারবে না।
– সে তোমার কাজিন হলেও, তোমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করলেও সে কিন্তু আমার বিয়ে করা বউ এই কথাটা সবসময় মনে রাখবে।
– সেজন্যই বুঝি নিজের জন্মদিনে তোমাকে এভাবে এতোটা দূরে রেখেছে?
– দূরে থাকলেই যে দুজন মানুষের মাঝে ভালোবাসা নেই এটা ভাবা চরম বোকামি। তোমাকে একটা গোপন কথা বলি শোনো। আমি রোদেলাকে চুমু খেয়েছি,কোথায় জানো? ঠোঠে চুমু খেয়েছি। তারপরেও কিন্তু সে আমার ওপর রাগ করে থাকতে পারে নি। কাল তো বলল তোমার যখন ইচ্ছে তখন তুমি চুমু খেতে পারো। আমার কোনো সমস্যা নেই। তাহলে ভাবো কতোদূর গড়িয়েছে। অথচ এটার জন্য তুমি কতোবার চেষ্টা করেছো কিন্তু আমার কাছ থেকে পাওনি।
– আমিনুল,চুপ করো। কি জঘন্য তুমি। কোনোকিছুই তোমার মুখে আটকায় না?
– রাগ করছো কেনো? আচ্ছা বলবো না। এতো হিংসা করা ভালো না। রোদেলা আসছে। যদি বিশ্বাস না হয় জিগ্যেস করে দেখতে পারো। তবে আমি জানি তুমি এসব বলবে না। এসব গোপন কথা কাউকে বলতে নেই।
রোদেলাকে দেখে আমরা দুজন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম।
চলবে………..
লেখাঃ আমিনুর রহমান।