#তুমি_আছো_হৃদয়ে
#পর্ব-৬
আমার পেছনে আমার প্রাক্তন এবং বর্তমান বসে আছে। হ্যাঁ আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছি আমার পেছনের সিটে বসেছে নুসরাত আর রোদেলা। তাদের কথাগুলো কেনো জানি আমার বিরক্ত লাগছে। কি এমন বলছে যা আমি শুনতে পাচ্ছি না। রোদেলা কি নুসরাতের কাছে আমার কথা বদনাম করছে কিংবা নুসরাত রোদেলার কাছে। এই দুইজন মানুষের কাছে তো আমি ভালো মানুষ না। এই দুইজন মানুষ আমাকে কেনো জানি আপন ভাবতে পারে না। অথচ আমি দুজনকেই আপন ভাবতে চাই। নুসরাতকে একসময় কতোই না ভালোবাসতাম,নিজের করে চাইতাম কিন্তু সে আমাকে বুঝেনি তাই তাকে আমার খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিয়েছি। আর এখন রোদেলাকে যখন নিজের মনের খাঁচায় বন্দী করতে চাইছি,তখন সে ডানামেলে আকাশে উড়তে চাইছে।
সবুজ ঘাস,লতাপাতা সবকিছু ভেদ করে পিচ ঢালা কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে অনবরত এগিয়ে চলেছে গাড়িটা। গন্তব্য ঢাকা। কিন্তু আমাদের যাত্রা পথে যে এতোটা বিরতি নিতে হবে কখনো ভাবিনি। প্রথমে জ্যাম দেখে ভাবলাম হয়তো বেশি সময় থাকবে না। কিন্তু যখন দুপর থেকে বিকেল হয়,বিকেল থেকে সন্ধ্যা হয় কিন্তু ট্রাফিক জ্যাম কমে না তখন কেনো জানি চিন্তা হতে লাগলো। দুইটা মেয়ে নিয়ে এই অন্ধকারে রাত কাটানোটা হয়তো অনেক বেশি ঝামেলায় ফেলবে। যদিও আমার বাসা টাংগাইল তবে আফসোস এর বিষয় হলো টাংগাইলের মির্জাপুরে আমার তেমন পরিচিত কেউ নেই যার বাসায় রাতটা কাটানো যাবে। সকাল দশটার আগের গাড়ি এক চুলও নড়বে না। কুয়াশার কারণ কয়েকটা গাড়ি একসাথে এক্সিডেন্ট করেছে যার কারণে পুরো রাস্তায় জ্যাম লেগে গিয়েছে। যখন চিন্তা করছিলাম আজকের রাতটা কিভাবে কোথায় কাটাবো তখন রোদেলা বলল তাঁর নাকি এখানে এক আত্মীয় বাড়ি আছে তবে তাদের কারো ফোন নাম্বার নেই। শুধু জানে মির্জাপুরের হাঠুভাঙাতে বাড়ি।
আমরা যেখানে এখন আছি সেখান থেকে খুব বেশি দূরে নয় রোদেলার আত্মীয় বাড়ি। তাই গাড়ি থেকে নেমে গেলাম সবাই। অনেক খোঁজার পর প্রায় রাত এগারোটার সময় সেই কাঙ্ক্ষিত ঠিকানাটা পেয়ে যাই। আমরা যে বাড়িতে এসেছি সে বাড়িতে খুব বেশি মানুষ নেই। দুইজন বয়স্ক মানুষ ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের অনেক আদর যত্ন করলো। আমাদেরকে পেয়ে তারা অনেক খুশি হয়েছে। কারণ এতো বড় বাড়ি সবসময় ফাঁকা থাকে। আমাদের পেয়ে হয়তো কিছুটা হলেও বাড়িটা পূর্ণতা পেয়েছে।
রোদেলার বিয়ে হয়েছে যেহেতু তারা জানে তাই রোদেলার কাছে যখন জানতে চাইলো আমিই তাঁর স্বামী নাকি তখন রোদেলা অনেকটা বিরক্তি নিয়ে হ্যাঁ বলল।
আমি আর রোদেলা এক রুমে থাকলেও নুসরাতকে থাকতে হলো আলাদা রুমে। রোদেলা হয়তো বলতে চেয়েছিলো সে আমার সাথে ঘুমাবে না,নুসরাতের সাথে ঘুমাবে। কিন্তু কোনো এক কারণে কথাটা বলতে পারেনি। কিন্তু যখন দেখলাম এক বিছানায় এক কাথার নিচেই ঘুমাতে হবে তখন অনেক বড় বিপদে পড়ে গেলাম। যেহেতু এখন শীতের দিন তাই কাথা ছাড়া ঘুমানো কখনোই সম্ভব না। আমি চুপচাপ কথা না বলে লেপের নিচে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
সমস্যা কি আপনার? আমি আপনার সাথে এক লেপের নিচে ঘুমাবো?
– তাছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।
– আপনারা পুরুষরা কি সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন নাকি। মেয়েদেরকে কি মনে করেন?
– একটু বেশি বলেছেন। আমি আপনার থেকে যদি সুযোগ নিতে চাইতাম তাহলে প্রথম রাতেই নিতাম,এতোদিন অপেক্ষা করতাম না।
– আমি নুসরাতের সাথে ঘুমাবো।
– সেটা আগে বললেন না কেনো? তাহলে তো আর এতো ঝামেলায় পড়তে হয় না।
– ওনারা তো জানেন আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে। এখন যদি হাসবেন্ড এর সাথে না ঘুমাই তাহলে হয়তো নেগেটিভ কিছু ভাববে।
– ওনারা নেগেটিভ ভাবলেই কি না আর না ভাবলেই কি?
– ওনারা কে জানেন?
– কে?
– আমার মায়ের আপন খালা আর খালু,মানে আমার নানা-নানী। কোনো সমস্যা দেখলেই মাকে ফোন দিয়ে সব বলবে। বলবে মেয়ের হাসবেন্ড পছন্দ হয়নাই। নতুন বিয়ে হওয়ার পরেও হাসবেন্ড এর সাথে থাকতে চায় না।
– একটা রাতই তো এমন কিছু ভাবতো না।
– আপনি এখন চলেন নুসরাতকে ডেকে তুলবো। ওর সাথে ঘুমাবো।
– পাগল নাকি। ওর রুমে যেতে হলে তো আপনার নানা-নানীর রুমের ভিতর দিয়ে যেতে হবে।
– বলবো আমাদের রাগারাগি হয়েছে তাই আজ আলাদা ঘুমাবো।
– এই বুদ্ধি আগে কোথায় ছিলো?
– মনে ছিলো না।
– আপনি নুসরাতের সাথে ঘুমাতে পারবেন না।
– কেনো?
– সমস্যা আছে।
– কি সমস্যা?
– বলবো না। আপনি ওপরেই ঘুমান, আমার কষ্ট হলেও আজকের রাতটা কোনোমতে পাড় করে দিবো,তবুও আমি আপনাকে নুসরাতের সাথে ঘুমাতো দিবো না।
রোদেলা আমার কথা চিন্তা না করেই আরাম করে ঘুমিয়ে যায়। একজন মানুষ যে তাঁর জন্য সারারাত শীতে কষ্ট করবে এইদিকে তাঁর কোনো মনোযোগ নেই। সেদিন রাতটা আমার অনেক কষ্ট হয়েছিলো। তবুও আমি রোদেলাকে নুসরাতের রুমে যেতে দেইনি। কারণ আমি নুসরাতক বুঝাতে চেয়েছি আমি তাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে অনেক সুখে আছি। আমি তাকে মনে রাখিনি। তাঁর জন্য চোখের জল ফেলি না। জানি না আমি সফল হয়েছি কিনা। তবে আমি নুসরাতের কাছে সবসময় নিজেকে সুখী মানুষ হিসেবে প্রতিস্থাপন করতে চাই।
দুপুরের দিকে আমরা গাড়িতে উঠি। আমি গাড়িতে উঠেই ঘুমানোর চেষ্টা করি। যেহেতু সারারাত ঘুমাইনি। তাই হয়তো ঘুম আসছিলো না। একটা জিনিস ভেবে খুব খারাপ লাগছে। আমি এমন একজন মানুষের জন্য শীতের রাতটা এতো কষ্ট করে কাটিয়েছি যে মানুষটা আমাকে ধন্যবাদ পর্যন্ত জানায়নি। হ্যাঁ আমি রোদেলার কথা বলছি। সকালে ভেবেছিলাম তাঁর ঘুম ভাঙলে আমি কিছু সময় ঘুমিয়ে নিবো কিন্তু তাঁর ঘুম ভাঙেনি। আমারও আর ঘুমানো হয়নি। একসময় গাড়িতেই আমি ঘুমিয়ে যায়। অনেকটা সময় ঘুমানোর পরে কারো ধাক্কা অনুভব করি। দেখলাম রোদেলা আমার কাঁধে হাত রেখেছে।
“ঢাকা চলে এসেছি। এবার আর না ঘুমিয়ে কোথায় যাবো ড্রাইভারকে বলেন।”
রোদেলার কথাতে আমার ঘুম পুরোপুরি চলে গেলো।
মালপত্র সব বাসার ভিতরে নিতে নিতে অনেক রাত হয়ে গেলো। বাসাটা আগে থেকেই গোছানো ছিলো। অন্তত মানুষ থাকার মতো। তাই বেশি চিন্তা করলাম না। থাকার মতো ব্যবস্থা যেহেতু আছে সেহেতু আজকের রাতটা অন্তত ঘুমিয়ে কাটাতে পারবো।
নুসরাত চলে গিয়েছে। রোদেলা থাকতে বললেও আমি চাচ্ছিলাম সে যেনো না থাকে। আমার চাওয়াটাই পূরণ হলো।
আপনার জন্য একটা সুসংবাদ আছে।
– কি?
– সত্যি বলতে আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। আমি চাইনি এতো আগে বিয়ে করে নিজের জীবনটা অন্য কারো হাতে তুলে দিতে। তাই যেকোনো কিছু বিনিময়ে বিয়েটা করতে চাইনি। কিন্তু আপনার জন্য পারিনি।
– বিয়ে করলে বুঝি নিজের জীবনটা অন্য কারো হাতে তুলে দেওয়া হয়? আপনার যে কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম।
– তাই তো। বিয়ের পর নিজের ইচ্ছার কোনো দাম থাকে না। সব কিছুতেই হাসবেন্ড অধিকার খাটাতে চাইবে। যেমনটা আপনি চান।
– বিয়ে মানে হচ্ছে একজন আরেকজনকে বুঝা। স্ত্রীরাই কি শুধু স্বামীর কথা শুনে? স্বামীরা কি স্ত্রীর কথা শুনে না? স্বামী স্ত্রীর জন্য সেকরিফাইস করবে,স্ত্রী স্বামীর জন্য সেকরিফাইস করবে এটাই তো নিয়ম। এটা না করলে দাম্পত্য জীবন কখনো সুখের হয় না।
– এসব নীতি কথা আমাকে শুনিয়ে কোনো লাভ নেই। আমার আপনাকে আগেও ভালো লাগেনি ভবিষ্যতেও লাগবে না। বিয়েটা করেছি পরিবারের চাপে পড়ে। সবসময় শুধু শুনে এসেছি অনেক মেয়ে আছে যারা শুধু মাত্র ফ্যামিলির চাপে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকেও ছেড়ে দেয়। যদিও আমার কোনো ভালোবাসার মানুষ ছিলো না। তবে আমি আমার নিজের জীবনটা কোরবানি দিয়েছি নিজের হাতে শুধু মাত্র পরিবারের জন্য। আমি আপনাকে বলেছিলাম না,আমাকে বিয়ে করলে ইহকালেই আপনি নরক যন্ত্রণা ভোগ করবেন। প্রস্তুত হন আমার খারাপ রুপ দেখার জন্য। আমি কতোটা খারাপ সেটা আপনি ভাবতেও পারবেন না। এইখানে যাই করি না কেনো কেউ দেখতে পারবে না,জানতে পারবে না। অত্যাচার কাকে বলে আপনি বুঝতে পারবেন। আমার হুদয়ে কখনোই আপনি জায়গা পাবেন না। আর একটা কথা আমি আপনাকে রান্না করে খাওয়াতে পারবো না। রান্না করে খাওয়ার জন্য আমি আপনার কাজের মেয়ে না।
আমি কোনো কথা না বলে রোদেলার ঠোঁটে চুমু খাই। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের ঠোঁঠের স্পর্শ নিলাম। সব সময় সিনেমায় দেখে এসেছি জোর করে আদর করতে,জোর করে ভালোবাসতে। কিন্তু কখনো ভাবিনি আমিও কাউকে জোর করে আদর করবো।
“অত্যাচার কি শুধু আপনিই করতে পারেন? আমি পারি না? এই যে আমি আপনাকে চুমু খেলাম এটা আপনি কাউকে বলতে পারবেন না। যদি বলেন আমার স্বামী আমাকে জোর করে চুমু খেয়েছে তাহলে মানুষ আপনাকেই পাগল বলবে। কারণ একজন স্বামীর স্ত্রীর ওপর এই অধিকারটা আছে। দেখা যাক ভবিষ্যতে কে কাকে অত্যাচার করে।”
কথাগুলো বলে আমি আমার মতো ঘুমিয়ে পড়ি। মেয়েটার অসহায় রাগান্বিত চেহারাটা দেখতে ইচ্ছে করছিলো না তাই তাঁর দিকে না তাকিয়ে মুখটা ঢেকে ঘুমের ঘরে তলিয়ে যাই।
চলবে………
লেখাঃ আমিনুর রহমান