তুমি_আছো_হৃদয়ে পর্ব-০৪

0
2586

#তুমি_আছো_হৃদয়ে
#পর্ব-৪

রোদেলা একা দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর আশেপাশে আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে কি আমার কল্পনাটা মিথ্যা ছিলো? রোদেলা তাঁর বয়ফ্রেন্ডকে সাথে নিয়ে আসেনি। সে কি এমন বলবে যে কারণে এভাবে বাহিরে একা দেখা করতে বলেছে আমি আন্দাজ করতে পারলাম না। তবে যাই বলুক না কেনো সে আমি তাঁর কথামতো বিয়েটা ভাঙবো না,বাসা থেকে বের হওয়ার আগে খুব ভেবে চিন্তেই এসেছি। আমি জানি সে অনেক আবেগী কথা বলে আমাকে গলাতে চাইবে তবে আমি সেসবে মন দিবো না। আমার মায়ের জন্য শুধু আমি বিয়েটা করতে চাচ্ছি না। নুসরাতও এর একটা কারণ। আমি যদি এই মেয়েটাকে বিয়ে না করতে পারি তাহলে নুসরাত কোনো একদিন আমাকে উপহাস করবে। তুমি এই মেয়ের যোগ্য ছিলে না তাই সে তোমাকে রিজেক্ট করেছে। আমি জানি নুসরাত এমন কিছু বলবে। নুসরাতকে জবাব দেওয়ার জন্য হলেও আমাকে এই বিয়েটা করতে হবে।

একটা মেয়েকে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে রাখা কি কোনো দায়িত্বশীল পুরুষের কাজ?
– আমি দুঃখিত। একটু দেরি হয়ে গিয়েছে। তবে আমার মনে হয় মেয়েরা যত্নবান, দায়িত্বশীল পুরুষ খুব একটা পছন্দ করে না।
– একটু না,ত্রিশ মিনিট দেরি করে এসেছেন। আপনি কিভাবে বুঝলেন মেয়েরা দায়িত্বশীল পুরুষ পছন্দ করে না।
– কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে।
– পৃৃথিবীর সব মেয়ে তো আর এক না।
– আলাদা ভাবারও তো কোনো কারণ দেখি না।
– আপনাকে যে জন্য দেখা করতে বলেছি। সিরিয়াসলি একটা কথা বলেন তো,আপনি কি সত্যিই বিয়েটা করছেন?
– হ্যাঁ। বয়স বেশি হয়ে যাচ্ছে। এতো সুন্দর একটা মেয়েকে রিজেক্ট করার কোনো কারণ দেখছি না আমি।
– একটা মেয়ে আপনাকে পছন্দ করে না,তারপরেও তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন কেনো? এটাতে যে দুইজন মানুষের জীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারে,একটাবারও ভেবে দেখেছেন?
– হুম দেখেছি,আর তাছাড়া আপনি আমাকে পছন্দ করেন না এটা কিন্তু একবারও বলেন নি। যদি বলতেন আমাকে আপনার অপছন্দ তাহলে হয়তো এমনটা বলতে পারতেন কিন্তু এখন আপনি এই কথাটা বলতে পারেন না।
– আমি তো ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়েছি আপনাকে আমার পছন্দ না,এমন কি এটাও বলেছি আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। বিয়ে হলেও আমি তাঁর সাথে পালিয়ে যাবো।
– আমারও গার্লফ্রেন্ড ছিলো,সো আপনার বয়ফ্রেন্ড অাছে এটাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আর বিয়ের পর আমার বউ অন্য কারো সাথে পালিয়ে যাওয়ার মতো এতোটা সাহস দেখাতে পারবে না। আমি জানি বউকে কিভাবে নিজের কাছে ধরে রাখতে হয়।
– আপনার ছিলো বাট আমার বর্তমান। এখনো আমাদের সম্পর্কটা আছে।
– এতোই যদি আপনি আপনার বয়ফ্রেন্ডকে ভালোবাসেন তাহলে বাসায় বলে দিলেই পারেন। তারাই বিয়েটা ভেঙে দিবে। এতো নাটক করছেন কেনো?
– আমি যদি বাসায় এই কথাটা বলতে পারতাম তাহলে আপনার কাছে এতোটা অনুরোধ করতাম না। সমস্যা হলো আমার বয়ফ্রেন্ড বেকার। আপনাকেও বাবার অনেক পছন্দ হয়েছে। সেজন্যই তো এতো সমস্যা। আর নাটক করার হলে অভিনয় করতাম আপনার সামনে নাটক করে আমার দুপয়সার লাভও নেই।
– আমি তো বলেছি আমি কোনো সাহায্য করতে পারবো না,অন্তত বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে।
– আপনি যে ছ্যাকা খেয়েছেন সেটা আপনার কথা শুনলেই বুঝা যায়। সত্যি কাউকে ভালোবাসলে তো আমার অবস্থাটা বুঝতেন,আমার পাশে দাঁড়াতেন।
– বিয়ের আগের প্রেমে বিশ্বাস করি না আমি। বিয়ের আগে প্রেম করলে ভালোবাসার মানুষটার ওপর নিজের সবটুকু অধিকার খাটানো যায় না। খাটালেও সেটা সে মেনে নিতে চায় না। তাই বিয়ের আগে প্রেম নয়,যতো প্রেম ভালোবাসা সব বিয়ের পরে।
– আপনি কি করে ভাবলেন আমাকে বিয়ে করলে আপনি হাসবেন্ড এর দাবি নিয়ে আমার ওপর সবটুকু অধিকার আদায় করতে পারবেন?
– এমনটাই তো হয়ে আসছে। প্রেমিককে না করতে পারলেও হাসবেন্ডকে না করা যায় না।
– আমাকে বিয়ে করলে আপনি সারাজীবন নরক যন্ত্রণায় ভুগবেন।
– আমি প্রস্তুত।
– আপনি পাগল।
– আপনার বয়ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করান,কথা বলিয়ে দিন। তাহলে ভেবে দেখবো আমি।
– ওতো এখানে থাকে না। ঢাকায় থাকে।
– আসতে বলেন।
– সমস্যা আছে। আসতে পারবে না।
– ভালোবাসার মানুষের জন্য সব সমস্যা ফেলে চলে আসতে পারে। আমার তো মনে হচ্ছে আপনার কোনো বয়ফ্রেন্ডই নাই। সব মিথ্যা বলছেন আমাকে।
– বিয়ের পর যখন পালিয়ে যাবো তখন বুঝতে পারবেন বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি নাই।
– গেলে আগেই যেতে হবে।
– কেনো?
– বিয়ের পর সেই সুযোগটা আমি দিবো না সেটাতো আগেই বলেছি।

রোদেলা মেয়েটা আমার ওপর রাগ করে আগুন ঝরা চোখে তাকাতে তাকাতে চলে যায়। হয়তো সে অনেকটা আশা নিয়ে আমার কাছে এসেছিলো কিন্তু তাকে নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে হলো।

রাতে খাওয়ার সময় মা হঠাৎ করেই বলল,
“বিয়েতে কি তোর মত আছে?”
কথাটা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। আসলে এই প্রশ্নের উত্তরটা আমার নিজেরই জানা নেই।

তোর যদি মত না থাকে বল। আমরা চাই তুই সুখী হবি। তোর সুখই আমাদের সুখ। তোর জন্যই আমরা এতো কষ্ট করেছি। তোর কষ্ট দেখতে চাই না কখনো।
-তোমাদের পছন্দ হয়েছে তো মেয়ে? এতেই আমি খুশি। বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করাটাও যে কতোটা আনন্দের সেটা তোমরা বুঝবে না।
-মেয়েটার বাবা আমাদের কথা দিয়েছেন। আমিও তাদের কথা দিয়েছি। আমার তো অনেক আগে থেকেই মেয়েটাকে ভীষণ পছন্দ। তোদের দুজনকে অনেক মানাবে।

সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। যে মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে না,যে মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড আছে সেই মেয়েটার সাথেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের দিন আমি নুসরাতের দিকে কেনো জানি তাকাতে পারিনি। তাঁর দিকে যখন তাকাতাম তখন নিজেকে অপরাধী মনে হতো। আবার মনে হতো সে তো এখন আর আমাকে আগের মতো চায় না,আগের মতো ভালোবাসে না। সে যদি ফিরে আসতে চাইতো কিংবা বলতো এই বিয়েটা করো না,তাহলে হয়তো অন্য কিছু হতে পারতো। কিন্তু সে এসবের কিছুই করেনি চুপচাপ নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের বিয়েটা সে দেখেছে। তবে আমি একপ্রকার জেদের বশবর্তী হয়েই এই বিয়েটা করেছি। আমি এখন নুসরাতকে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবো।
“তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে তুচ্ছ একটা কারণে। ভেবেছিলে আমি তোমার যোগ্য না,তুমি আমার থেকে আরও ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো। তাই আমাকে খুব সহজেই ভুলে গিয়েছিলে। কিন্তু তুমি হয়তো কখনো চিন্তা করে দেখোনি আমিও তোমার থেকে বেটার কাউকে ডিজার্ভ করি,আর সেটা পেয়েছিও।”

আমি যখন আমার সদ্য বিয়ে করা বউ নিয়ে নুসরাতের সামনে দিয়ে চলে আসছিলাম তখন আমি নুসরাতের চোখে হিংসা দেখেছিলাম। সে হয়তো চাইনি বিয়েটা হোক। তাঁর মনটা খারাপ ছিলো যখন আমি তাঁরই সামনে দিয়ে রোদেলার হাত ধরে তাকে নিয়ে আসি। তবে আমি এসব নিয়ে একটুও ভাবিনি। কারণ আমি আমার অতীত ভুলে গিয়েছে। আমি সৃষ্টিকর্তাকে সবসময় ধন্যবাদ জানাই আমার অতীত সম্পূর্ণ রুপে ভুলে যাওয়ার অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছেন সে জন্য। আমি এখন আমার বাবা মা ব্যতীত কাউকে ভালোবাসি না। যদি কাউকে ভালোবাসতে হয় নতুন করে বাসবো।

বাসর ঘরে আমার জন্য আমার বউ বসে আছে। তবে তাঁর কাছে যেতে আমার কেনো জানি ভয় লাগছে। বিয়েটা তো তাঁর ইচ্ছেতে হয়নি। তাঁর কাছে গেলে সে কি বলবে এটাই ভাবছিলাম আমি। কিন্তু যেতে তো হবেই। এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। আমি সাহস করে রুমে ঢুকে দরজাটা এমন ভাবে লাগালাম যাতে কোনো শব্দ না হয়। কিন্তু তবুও শব্দ হলো। বিছানায় বসতেই মেয়েটার রাগেগরগর করা কণ্ঠ শুনতে পাই।

আপনি আমার কাছে আসবেন না। আপনি আমার জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছেন। কতো স্বপ্ন দেখেছিলাম, জীবনে নিজে কিছু করবো। বড় কিছু হবো। নিজের পছন্দে বিয়ে করবো কিন্তু আপনি সব শেষ করে দিয়েছেন। আমাকে আপনি ভুলেও স্পর্শ করার চেষ্টা করবেন না।
– ওয়েট ওয়েট। ঠিক আছে,আমি জানি আমার ওপর অনেক রাগ। রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে আমাদের এই বিয়েটাতে হয়তো আমরা খুশি হতে পারিনি। কিন্তু দুই পরিবারের মানুষগুলো কতোটা খুশি হয়েছেন সেটা হয়তো আপনি জানেন না। আমার মনে হয় বাবা মায়ের ভালোবাসার কাছে এসব বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের ভালোবাসা খুবই তুচ্ছ। আপনি কি চলে আসার সময় আপনার বাবার দিকে একটাবার তাকিয়ে ছিলেন? তাঁর চোখে জল ছিলো তবে সেটা দুঃখের নয় সুখের। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। সমস্যা নেই। আমি ওতোটা খারাপ মানুষ না যতোটা ভাবেন। আমি মানুষকে ভালোবাসতে চাই কিন্তু আফসোস বাবা মা ছাড়া কেউ আমাকে বুঝতে পারে না।

চলবে………..

লেখাঃ আমিনুর রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে